বাদশাহ নামা পর্ব ৪৯+৫০
আমিনা
রাতের এখন তৃতীয় প্রহর। ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায় সকলে, প্রাসাদের কিছু কিছু কামরায় এখনো টিমটিম করে বাতি জ্বলছে।
রাতের নিস্তব্ধতা কে ভেঙে দ্রুত পায়ে দাসী দের প্রধান নিয়ন্ত্রক হুমায়রা তাইরের কক্ষের দিকে ছুটছে আফিয়া। চোখে মুখে তার উদভ্রান্ত ভাব, মাঝে মাঝে কোনো অজানা কারণে তার মুখে হাসির রেশ দেখা যাচ্ছে৷ শেহজাদী প্রাসাদে ফিরে আসায় তার আনন্দে একটু ভাটা পড়েছিলো, কিন্তু আজ দুদিন হলো তিনি নেই, কোথায় চলে গেছেন কেউ জানে না। তাই মেজাজ টা আজ ওর বেশ ফুরফুরা।
যতক্ষন পর্যন্ত ওই হোয়াইট উইচ টা প্রাসাদে থাকে ততক্ষন পর্যন্ত ওদের সবার দম আটকে আসে যেন, নিজেদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে ওরা। এখন সে নেই, এখন নিঃশ্বাস নিয়েও যেন শান্তি।
হুমায়রা তাইরের কক্ষের দরজায় দুবার মৃদু করাঘাত করলো আফিয়া। ভেতর থেকে প্রশ্ন এলো,
— কে?
— তাইর চাচি, আমি আফিয়া বলছি।
আফিয়ার গলা শুনে কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বের হয়ে এলেন হুমায়রা। বের হয়েই কন্ঠে সামান্য বিরক্তি মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— এত রাতে এসে ডাকছো কেন? কি হয়েছে?
— হিজ ম্যাজেস্টি ফিরেছেন, সেই মেয়েটিকে নিয়ে!
আফিয়ার চোখে খুশির ঝিলিক। আফিয়ার কথা শুনে এবার দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়রা বেরিয়ে এলেন সম্পুর্ন, তারপর অবিশ্বাস্য গলায় বললেন,
— হিজ ম্যাজেস্টি ফিরে এসেছেন? তুমি মেয়েটিকে দেখেছো? কেমন দেখতে? সুন্দরী?
— শেহজাদীর মতো সুন্দরী না হলেও আমাদের এখানের গতানুগতিক দাসী গুলোর থেকে সে অনেকটাই এগিয়ে আছে চাচি! মেয়েটার মাথায় লাল রঙের চুল, শেহজাদীর চুলের মতো অতোটা লম্বা চুল না হলেও বেশ অনেক খানিই লম্বা৷ চোখ জোড়া নীল। আর যে দারুন করে সে হাসছে, আমিই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি! হাসলে আবার তার গালে টোলও পড়ে!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— এবার যদি শেহজাদীর দেমাগটা একটু কমে! স্বামী নিয়ে তার যে আহ্লাদ ছিলো এখন তো আর তার কিছুই থাকবে না!
তার জন্য প্রাসাদের কোনো দাসী কখনোই সুযোগ পায়নি হিজ ম্যাজেস্টির নিকটে যাওয়ার। আমাকেই দেখো না! আজ যদি সে না থাকতো তবে আমি নিশ্চিতভাবে হিজ ম্যাজেস্টির সন্তানের মা হতাম! জীবন আমার কাটতো রানীর হালে, আমিও ঘুমোতাম শেহজাদীর কামরার বিছানার ন্যায় মোলায়েম বিছানায়। হিজ ম্যাজেস্টির সোহাগ পেতাম যতদিন আমার যৌবন থাকতো! কিন্তু সেসবের কিছুই হয়নি!
— আপনি আর এসব নিয়ে মন খারাপ করবেন না চাচি, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এগুলো মনে রেখে কি লাভ বলুন! এখন আপনি চলুন, মেয়েটিকে তার কামরা দেখিয়ে দিতে বলেছেন হিজ ম্যাজেস্টি।
কিন্তু তিনি এসেই শেহজাদীর খোজ করেছেন। আমি বলে দিয়েছি আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানিনা, ইয়াসমিন জানতে পারে।
এখন উনি ওনার কামরার দিকে যাচ্ছেন, নিশ্চয় শেহজাদীকেও খুজবেন, আর যখন পাবেন না তখন নিশ্চিতভাবে প্রাসাদ মাথায় তুলবেন, সাথে ইয়াসমিনকে ভালো মতো ধুয়ে দিবেন, কারণ বহির্বিশ্বে যাওয়ার সময় শেহজাদীর দায়িত্ব তিনি ইয়াসমিন কে দিয়ে গেছিলেন৷ শেহিজাদী ফিরে আসায় ওর খুব বাড় বেড়েছিলো।এবার ওর ডানা কেটে পড়বে। আমার যা খুশি লাগছে না চাচি, কি বলবো তোমাকে!
হুমায়রা তাইর আফিয়ার কথায় কিঞ্চিৎ সায় জানিয়ে মৃদ্য হেসে কামরার ভেতরে ঢুকলেন তৈরি হওয়ার জন্য। আফিয়াও ঢুকলো তার পেছন পেছন৷ হ্যমায়রা আলমিরা থেকে পোশাক বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
— হিজ ম্যাজেস্টির মন কেমন বুঝলে, মেয়েটাকে তিনি কিভাবে গ্রহণ করেছেন, টের পেয়েছো কিছু?
— জানেনই তো উনি কেমন, মনের ভাব মুখে প্রকাশ করেন না। তাই বুঝতে পারিনি কিছু। তবে মেয়েটার বুদ্ধি আছে যা বুঝলাম, সে যতক্ষন হিজ ম্যাজেস্টির কাছাকাছি ছিলো ততক্ষণ ওনার দিকেই অপলকে তাকিয়ে ছিলো৷ হিজ ম্যাজেস্টি খেয়াল করেছেন কিনা আমি জানিনা।
— হিজ ম্যাজেস্টির দিকে অপলকে তাকায়নি কে বলোতো! তুমিই বলো ওনাকে প্রথম দেখে তুমি থমকে ছিলে কিনা!
হ্যমায়রার কথায় মৃদু শব্দ করে হাসলো আফিয়া, তারপর বলে উঠলো,
— আমি প্রথমবার ওনাকে দেখে সত্যিই থমকে গেছিলাম! প্রথম প্রথম প্রাসাদে এসেছিলাম তখন৷ শেহজাদীর কামরায় খাবার দিতে গেছিলাম আমি সেদিন, হিজ ম্যাজেস্টি সেখানেই ছিলেন! শুধু একটা ট্রাউজার ছাড়া ওনার পরণে আর কিছুই ছিলো না। শেহজাদী তখন কামরায় ছিলেন না, আর আমি ওনার দিকে বলদের মতো তাকিয়ে ছিলাম! সেদিন উনি আমাকে এক ধমকে কামরা থেকে বের করে দিয়েছিলেন!
শেষোক্ত কথাটা মুখ নামিয়ে বলল আফিয়া। হুমায়রা পোশাক পরতে পরতে হাসলো ওর কথায়। আফিয়া আবার বলে উঠলো,
— তবে মেয়েটা যদি হাত ধুয়ে লেগে পড়ে তবে হিজ ম্যাজেস্টির মন জয় করে নিতে পারবে আমার ধারণা। আর তাছাড়া ওনাদের তো বিয়ে হবে! বিয়ে হলে না চাইতেও একটা মায়া এসে যায় দম্পতি দের ভেতরে, সুতরাং হিজ ম্যাজেস্টিরও আসবে! আর যদি সে হিজ ম্যাজেস্টির সন্তানের মা হতে পারে তবে তো কথাই নেই! নিজের সন্তানের মা কেই তো তিনি বেশি আগলে নিবেন তাই না?
— কিছুই বলা যায়না আফিয়া! ওই সাদা রঙের ডাইনিটার ক্ষমতা কত তুমি জানো না! এখন যদি সে এসব মান অভিমান ভুলে একবার হিজ ম্যাজেস্টির কাছে আসেন, আর ওনার ওই অদ্ভুত চোখ দিয়ে তাকান, তবে হিজ ম্যাজেস্টি এমনিতেই গলে যাবেন। বাকি সব তো পড়েই রইলো ওদিকে। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় ডাইনিটা নিজের সাথে সারাক্ষণ ব্লাক ম্যাজিক নিয়ে ঘোরে কিনা!
হ্যমায়রার কথায় হাসলো আফিয়া, তারপর নিজেদের ভেতর আরও কিছুক্ষণ শেহজাদী কে নিয়ে সমালোচনা করে বের হলো নতুন মেয়েটির কাছে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে।
সূর্যের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এই মুহুর্তে মীরের কামরার সামনের বিশাল বারান্দাটায় মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনটা প্রাণী। ইয়াসমিন, কোকো আর ফ্যালকন। তাদের সামনে চোখে মুখে ভয়ানক ক্রোধ নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে দাঁড়িয়ে আছে মীর৷ চোখ জোড়া দিয়ে যেন আগুন ঝরছে ওর! ওর শক্ত হয়ে যাওয়া চোয়ালদ্বয় দেখে ভয়ে বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শুরু হয়েছে সকলের।
— তোদেরকে বিশ্বাস করে তোদের ওপর আমি আমার শিনজোর দায়িত্ব দিয়ে গেছিলাম! অথচ আজ দুদিন ধরে আমার শিনু নিখোঁজ! রেড জোনের ভেতরে আহত অবস্থায়, খেয়ে না খেয়ে মেয়েটা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আর তোরা এখানে হাত গুটিয়ে বসে আছিস!
দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে কথা গুলো বলল মীর৷
অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে রাখা কোকো কোনোমতে সাহস সঞ্চয় করে মৃদু স্বরে বলতে নিলো,
— ইয়োর ম্যাজেস্টি, আম্মা হঠাৎ করেই ছাদ…..
কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারলো না ও, তার আগেই মীরের বজ্রকন্ঠে কেঁপে উঠলো ও,
— স্টপ দ্যিজ ননসেন্স! ও ছাদ থেকে লাফ দিলো আর তোরা কি করছিলি? বসে বসে তামাসা দেখছিলি? ওর কাছেই তো বসে ছিলি! তবে ও কিভাবে পালালো! কিভাবে?
মীরের ক্রোধের চিৎকারে কেঁপে উঠলো যেন পুরো প্রাসাদ টা! কোকো মাথা নিচু রেখে ঢোক গিললো একটা। চোখ জোড়া ওর লোনাপানিতে ভর্তি হয়ে আসছে! ওর পাশে দাঁড়ানো ফ্যালকন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। একটা শব্দও মুখ থেকে বের করছে না ও। চুপচাপ তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো ইয়াসমিন থেকে থেকে ফোপাচ্ছে, নিঃশব্দে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ওর শরীর টা৷
মীর ওদের দিকে আর এক বার শকুনি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে গটগটিয়ে চলে গেলো নিজের কামরায়৷ তারপর বাইরের পোশাক ছেড়ে একটা পাতলা ঢিলাঢালা রোব আর একটা ট্রাউজার পরে নিলো, আর এরপর বেরিয়ে এলো বাইরে৷ এসেই গটগটিয়ে যেতে নিলো প্রাসাদের বাইরে যাওয়ার পথের দিকে৷
কোকো ফ্যালকন বুঝলো মীর ঠিক কোথায় যেতে চলেছে। ওরা দুজনও মীরের পেছন পেছন হাটা শুরু করলো নিঃশব্দে।
রেড জোনের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে সামনে এগিয়ে চলেছে মীর। ওর স্বর্ণালী আভা ছড়ানো চোখ জোড়া দিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে নজর বুলিয়ে এগোচ্ছে ও৷
ওর পেছনে, কিছুটা দুরত্ব নিয়ে এগোচ্ছে কোকো আর ফ্যালকন।
গত দুন দিন ধরে ওরা সকলে মিলে সমস্ত রেড জোন চষে বেড়িয়েছে, তারপরও অ্যানাকে খুজে পায়নি! সে যেন বাতাসের সাথে মিশে হারিয়ে গিয়েছে!
মাঝ রাতের পর মীর প্রাসাদে এসে ইয়াসমিন কে দেখা মাত্রই অ্যানার খোজ করলে ইয়াসমিনের দেওয়া উত্তর শুনে প্রচন্ড রেগে যায় ও। তারপর থেকে ওর ক্রোধ যেন আর থামছেই না! ভয়ানক রাগ হচ্ছে ওর ইয়াসমিন আর কোকো ফ্যালকনদের ওপর।
এতবার করে সবাইকে সাবধান করে দিয়ে গেলো ও, যেন অ্যানাকে ওরা দেখে রাখে, পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ওর খেয়াল রাখে। একটুও যেন এদিক ওদিক না হয়। কিন্তু এরা কি করলো!
সমস্ত রাতটা মেয়েটাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দিলো, তাকে কেউ নিচে নামিয়ে আনতে পারলো না! আর এরপর কিনা এত গুলো মানুষের চোখের সামনে দিয়েই সে পালিয়ে গেলো! আর এরা কিছুই করলো না, ওর পালিয়ে যাওয়া টা চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু! রাগে মীরের শরীরের ভেতর রিরি করছে!
দ্রুত পায়ে এদিক ওদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাটিতে হাটতে হঠাৎ করেই পেছন থেকে কোকোর ডাকে থেমে গেলো মীর৷ প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে পেছন ফিরে তাকালো ও। কোকো ফ্যালকন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ ওকে ফিরে তাকাতে দেখে কোকো বলে উঠলো,
— ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনাকে না জানিয়ে আমরা একটা কাজ করে ফেলেছি!
মীর এবার সোজা হয়ে ফিরলো ওদের দিকে, তারপর এক ভ্রু উচু করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কোকোর দিকে। কোকো এক পলক মাথা উচিয়ে মীরের চেহারা টা দেখে নিয়ে সাথে সাথে চোখ নামালো আবার, তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
— আপনার আর আম্মার সন্তানের কথা আমরা আম্মা কে বলে দিয়েছি! আম্মাকে কোনোভাবেই মানানো যাচ্ছিলো না, তাই জন্য!
কোকোর কথা কানে আসা মাত্রই থমকে গেলো মীর। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো যেন ওর!
এবার কি হবে! শিনু, ওর শিনজো এটা কিভাবে মেনে নেবে! ও তো ট্রমাটা থেকে কোনো রকমে বেরিয়ে আসতে পেরেছে ! কিন্তু ওর শিনু কিভাবে মেনে নেবে এটা! এরা এটা কিভাবে করতে পারলো! শিনু কে ওদের মৃত সন্তানের কথাটা ওরা কিভাবে বলে দিতে পারলো! এত এত বার নিষেধ করা সত্বেও, কিভাবে……!
ওর শিনজো কি ভাববে এবার! শিনু তো ভাববে ওর অনুভূতির কোনো তোয়াক্কা না করেই মীর নিজের সন্তান তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এগুলো করছে! শিনুকে ও এবার কিভাবে বোঝাবে যে ও চেষ্টার বিন্দুমাত্র কমতি রাখেনি! কোনো আর্টিফিশিয়াল পদ্ধতি ব্যাব৬করতে ও বাদ রাখেনি! কিন্তু কোনো কিছুই ওদের কোনো কাজে আসেনি! কিভাবে বোঝাবে ও!
ও তো নিজের ঔরসজাত সন্তান টা পেয়েই ওর শিনু কে বাচ্চাটা বুঝিয়ে দিতো! শিনু কে তার মা করে ও হতো বাবা! কিন্তু এখন কি হবে! এত বড় একটা সত্য ওর শিনুর থেকে লুকানোর পর ও ওর শিনুর সামনে গিয়ে কিভাবে দাঁড়াবে?
মীর হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো কোকোর দিকে। তারপর অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,
— তুই এটা কিভাবে করতে পারলি কোকো! ওই ঘটনা যারাই জানতো তাদের সবাইকে আমি আদেশ করেছিলাম যেন এই কথা ঘূর্ণাক্ষরেও আমার শিনুর কানে না যায়! আর তুই কিনা……
কোকো অপরাধবোধে মাথা নিচু করে যেন কুকড়ে গেলো আরও। কোনো রকমে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
— ক্ষমা করবেন ইয়োর ম্যাজেস্টি! আমি ভেবেছিলাম আম্মা হয়তো আপনার আর তার সন্তানের জন্য করা আপনার স্ট্রাগলের কথা শুনলে মন নরম করবেন!
— সেটা হলে তো আমি নিজেই ওকে বলতাম! ওর কিসে রাগ হয়, কিসে অভিমান হয়, ও কিসে কষ্ট পায়, কিসে খু্শি হয়, কিসে ওর মন খারাপ হয়, কিসে ও খিলখিলিয়ে হাসে এসব আমি জানি, শুধুমাত্র আমি! আর অন্য কেউ না! ওর মনটা খোলা বই এর মতো পড়তে পারি আমি! ওর চেহারা দেখলে আমি বলে দিতে পারি ও কি ভাবছে, ওর কি খেতে মন চাইছে, ওর কি করতে মন চাইছে! সেই আমি যখন বললাম ওকে তোরা এই কথাটা জানাবি না, তোরা সেটা শুনতে পারলি না! তোরা ওকে বলেই দিলি!
তুই কি জানিস ও বাচ্চা কতটা ভালোবাসে? তোদের কোনো ধারণা আছে ওর নিজের একটা সন্তানের জন্য চব্বিশটা ঘন্টার ভেতরে কতটা হা-হুতাশ করে! তোদেরকে ও কেন পেলেছে? কিসের জন্য? এমনিতেই? তোদেরকে নিজের সন্তান মনে করে বুকে টেনে নিয়েছে ও কেন! ওর একটা বাচ্চার কতটা শখ সে সম্পর্কে তোদের কোনো ধারণা আছে?
তোদেরকে ও চিনতোনা জানতোনা, তবুও মাটি থেকে কুড়িয়ে ও কেন নিজের কাছে রেখেছে? নিজের সন্তানের অভাব পূরণ করতে! কি ভাববে ও এখন! ও ভাববে আমি ওর জন্য ভাবিনা! আমি শুধু নিজের টা ভাবি! ওকে এখন আমি এসব কিভাবে বোঝাবো! কিভাবে ফেরাবো ওকে নিজের কাছে?
শেষোক্ত প্রশ্নগুলো মীর উচ্চস্বরে ছুড়ে দিলো কোকো ফ্যালকনের দিকে। আর এরপর ওদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ধীরে ধীরে ও হাটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে! চোখ মুখ দিশেহারা হয়ে উঠলো ওর! উদভ্রান্তের ন্যায় অসহায় চোখে চারদিকে তাকাতে লাগলো ও। চোখ জোড়া জ্বালা করছ ওর, বুকের ভেতর টা পুড়ছে তুষের আগুনের মতো!
ফ্যালকন চেয়ে দেখলো একবার মাটিতে বসে পড়া মীর কে। শক্তপোক্ত, কঠোর মানুষ টা সর্বহারা মুসাফিরের ন্যায় অসহায় মুখে বসে আছে মাটিতে!
এসব কি হচ্ছে ওদের সবার জীবনে! কিছুদিন আগেও তো ওরা কত ভালো ছিলো! কত হাসিখুশিই না ছিলো ওরা সকলে! ওদের জীবন গুলো হঠাৎ করেই এত জটিল হয়ে গেলো কেন! কান্না পেলো ওর ভিষণ! ভ্রু জোড়া কুচকে ঠোঁট চেপে কান্নাটাকে আটকানোর চেষ্টা করলো ও, কিন্তু পারলো না। না চাইতেও শব্দ করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো!
ফ্যালকন কে কাঁদতে দেখে কেঁদে ফেললো কোকো নিজেও! ঠোঁট উলটে ফুপিয়ে উঠে ফ্যালকন কে বুকে টেনে নিলো ও। কোকোর বুকে ঠাই পেয়ে ফ্যালকনের কান্নার বেগ আরও বাড়লো! আর্তনাদের সুরে ও বলে উঠলো,
— তোকে আম্মা ডাকতে শেহজাদী নিষেধ করে গেছে কোকো! তুই আর আম্মা ডাকিস না তাকে! নইলে শেহজাদী রাগ করে আর ফিরবেন না!
শেহজাদী কিভাবে বলতে পারলো এমন কথা! কিভাবে বলতে পারলো তোদের শেহজাদী মরে গেছে! আমার শেহজাদী আমদের ফেলে কোথায় চলে গেলো রে কোকো!
কোকো ঢোক গিকে ফ্যালকনের পিঠে মৃদু চাপড় দিতে দিতে বলে উঠলো,
— কাঁদিস না আর, আম্মা ফিরে আসবেন! তার সন্তান দেরকে এভাবে মাতৃহারা করে আম্মা কখনোই দূরে থাকবেন না! আমাদের আম্মা এতটা কঠিন মনের নন! আর কাঁদিস না তুই!
মীর ওর সামনে ক্রন্দনরত বাচ্চা দুটোর দিকে তাকালো একবার। তারপর মুখ দিয়ে জোরে সোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে নিজের মনে বলে উঠলো,
— ইয়া রব! ধৈর্য দিন আমাকে! এত চাপ আমি আর নিতে পারছিনা! আপনি ঠিক করে দিন সবকিছু! আমার শিনু কে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন আবার! আমাকে ওর অভিমান ভাঙানোর মতো ক্ষমতা দিন! ক্ষমা করুন আমাকে!
আরও কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে সৃষ্টিকর্তার সাথে নিজের মনের কথাগুলো বলে নিয়ে উঠে দাড়ালো মীর। তারপর সামনে দাঁড়ানো কোকোর দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন ক্রলো,
— আমাদের সন্তানের কবরের লোকেশন দিয়েছিলি আমার শিনু কে?
— জ্বি দিয়েছিলাম, ইয়োর ম্যাজেস্টি!
কোকোর উত্তর শুনে মীর আবার পা বাড়ালো জঙ্গলের ভেতরের দিকে। কোকো আর ফ্যালকন সেখানেই দাড়িয়ে রইলো।
শিরো মিদোরির পশ্চিম কোণায় থাকা অর্কিডে পরিপূর্ণ গাছপালার মাঝের একটি ছোট্ট, সুন্দর, ঝকঝকা কবরের পাশে বসে আছে অ্যানা৷
মাঝে মাঝে কবরটির ওপর নিজের হাত বুলিয়ে নিয়ে চলেছে ও। কবরটার চারপাশে ফুটে আছে রঙ বেরঙের জংলি ফুল, কিন্তু এগুলো রেড জোনের জঙ্গলের নয়, প্রাসাদের। মীর লাগিয়ে রেখেছিলো হয়তো!
কবরের ওপরের মাটিটা খুব সুন্দর মসৃণ করে রাখা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ প্রায়শই কবরটিকে খুব যত্ন সহকারে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়! অ্যানা এসে কবরটির ওপর এক গুচ্ছ শুকনো পাতা পড়ে থাকতে দেখেছিলো, এতক্ষণ বসে বসে সেগুলো হাতে করে পরিষ্কার করেছে ও।
এতক্ষণ ও বসে বসে হাটুতে মাথা রেখে কবরটার ওপর হাত বুলিয়ে চলছিলো। কিন্তু এবার কবরের পাশেই নরম ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লো ও৷ তারপর একটা হাত বাড়িয়ে কবরটির ওপর রাখলো।
এই বাচ্চাটা ওর, ওদের! ওর আর মীরের ভালোবাসার ফসল! কিন্তু কোথায় সবাই? কোথাও কেউ নেই আর! চারদিকটা ফাকা, নিস্তব্ধ! কারো আওয়াজ নেই কোথাও! যেন পৃথিবী মূক হয়ে গেছে! নাকি অ্যানা বধির হয়ে গেলো!
এই যে সমস্ত জঙ্গল জুড়ে পাখিরা কলতান করছে, অদ্ভুত অদ্ভুত ছোট্ট ছোট্ট জীব গুলো মাটিতে শব্দ করে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে, কখনো কখনো অ্যানাকে ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে, গাছের শুকনো পাতা গুলোতে বাতাসের স্পর্শে শন শন শব্দ বয়ে যাচ্ছে, এ সবকিছুই তো ও শুনছে, কিন্তু তবুও এত নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে কেন?
বধির তো ও হয়নি, হয়েছে ওর মনটা! সে এখন আর কিছুই শুনতে চায় না! কোনো শব্দই আর ওর মনের তলানিতে পৌছচ্ছে না!
চোখ জোড়া বন্ধ করলো অ্যানা। একটা বাচ্চার কত শখ ছিলো ওর! মীরের সাথে কাটানো প্রথম ঘনিষ্ঠ রাতে সে মীরের কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো ওর বাবু চাই, অনেক গুলো! মীর ওর চোয়ালে নাক ঘষে দিয়ে বলেছিলো রোজ আল্লাহর কাছে চাইবে ওর বউ কে যেন এক গাদা বাচ্চা দেয়! যাদের কে সামলাতে সামলাতে ওর বউ আর দম ফেলানোর সময় পাবে না! কিন্তু পরক্ষণেই মত পালটে বলেছিলো অতগুলো বাচ্চার কোনো দরকার নেই, বেশি বাচ্চা হলে মীরকে দেওয়া অ্যানার সময়, আদর সোহাগের ভাগাভাগি হয়ে যাবে! এটা ও মানতে পারবে না!
অতীত স্মৃতিচারণ করতে করতে মৃদু হাসলো অ্যানা। ওর মীর তো আর ওর নেই! অন্য কারো হয়ে গেছে! ওর চেনা মীরের সাথে এই মীরের তো কোনো মিল নেই! ওর চেনা মীর তো ওকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না! এই মীর তো সেই মীর নয় যে কিনা হুটহাট সাম্রাজ্যের কাজে ফাকি দিয়ে চলে আসতো ওর কাছে, আদর নিতে; যে কিনা প্রতিটা মুহুর্ত ওর চিন্তায় মগ্ন থাকতো; যে ছিলো জেলাসিতে ভরপুর! যে ওকে প্রাসাদের দাসীদের সামনেও ঢিলাঢালা পোশাক পরতে বাধ্য করতো যেন ওর শিনুর মোহনীয় শরীরটার দিকে তাকিয়ে ওরা ওর শরীর নিয়ে আলোচনায় না বসে প্রতিনিয়ত! এই মীর তো সেই মীর নয় যে অ্যানা সামান্য কাশলেও সমস্ত রাত জেগে থাকতো তার শিনুর কোনো কষ্ট হচ্ছে কিনা দেখতে! এ মীর তো অন্য মীর! এ মীর তো ওর মীর নয়!
চোখ জোড়া বন্ধ করে এসবই ভেবে চলেছিলো অ্যানা, ঠিক তখনি ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো ওর চিরচেনা মানুষটির উপস্থিতি! সে আসছে!
হন্তদন্ত হয়ে শিরো মিদোরির পশ্চিম কোণায় থাকা অর্কিড বাগানটায় ছুটে এলো মীর। চারদিকে সন্ধানী দৃষ্টি বুলালো একবার। ওর শিনুর শরীরের ঘ্রাণ এখানে প্রকট, কিন্তু কই ওর শিনু!
মীর উদভ্রান্তের ন্যায় নিজ সন্তানের কবরের চারপাশে একবার ঘুরে চারদিকে নজর বুলালো, শিনু নেই, এখানেও নেই! একটু আগেই হয়তো ছিলো, নইলে ওর শরীরের ঘ্রাণ এতটা গাঢ় হতো না৷
চারদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁসফাঁস করতে শুরু করলো মীর৷ এই কয়েকটা দিন ও ওর শিনজো কে একটা বারের জন্যেও দেখেনি, ওর কন্ঠটা শোনেনি একটা মুহুর্তের জন্যেও!
প্রাসাদে ফিরে অ্যানার নিখোঁজ সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই প্রচন্ড সাফোক্যেটিং লাগছে ওর! দম নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর প্রচন্ড! বুকের ভেতরটা যেন চিনচিনে এক যন্ত্রণায় জমে যাচ্ছে বার বার!
মীর চারদিকে আর একবার দৃষ্টি দিয়ে বড় বড় দম নিতে নিতে আকুল কন্ঠে, উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো,
— শিনজো! আমি জানি তুমি আমার আশেপাশেই আছো! একটাবার আমার সামনে আসো প্রাণ আমার! একটা বার আমার কথা গুলো শোনো প্লিজ! আ’ ক্যান এক্সপ্লেইন! প্লিজ শিনু, একটাবার দেখা দাও আমাকে, প্লিজ!
শেষোক্ত কথা টা ভ্রু তুলে অনুরোধের সুরে বলল মীর৷ কিন্তু অ্যানার সাড়া পাওয়া গেলো না কোথাও! শুধুমাত্র উন্মত্ত বাতাসের উচ্ছল খেলায় আলুথালু হয়ে যাওয়া শুকনো পাতার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না সেখানে। মীর আশাহত হলো! ওর শিনু তো ওর ওপর রাগ করে এভাবে পালিয়ে লুকিয়ে থাকে না কখনো! এর আগেও তো কতবার অভিমান করে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে রেড জোনে চলে এসেছে ও, হয়তো লাইফ ট্রির কাছে, নয়তো ওদের ট্রি হাউজে, নয়তো রেড উড গাছের মগডালে! চেনা জায়গা ছাড়া অ্যানা যে কোথাও যায় না!
আর মীর প্রতিবারই ওকে খুঁজে নিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ওর অভিমানের শেষ বিন্দুটাও চুমুতে চুমুতে শুষে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে গিয়েছে!
কিন্তু আজ কই ওর শিনু! ওর শিনু তো ওকে দেখাও দিচ্ছে না! কি করবে ও এখন! কিভাবে মানাবে ও ওর শিনু কে! মীর অসহায় ভঙ্গিতে আবারও ডেকে উঠে বলল,
— শিনু! আমি জানি তুমি আমার খুব খুব কাছে আছো! আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমি তোমার উপস্থিতি অনুভব করছি! তোমার অভিমান আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে শিনু!
আমি জানি আমি ভুল করেছি, আমার তোমার সাথে সরাসরি কথা বলা উচিত ছিলো! কিন্তু তুমি তো কখনো শুনতে চাওনি, মানতে চাওনি! কি করতাম আমি!
আমি জানি আমি তোমাকে তোমার উপযুক্ত গুরুত্ব, ভালোবাসা দিতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছি; কিন্তু আমি তোমাকে একটা মুহুর্তের জন্যেও কখনো ভুলিনি শিনু! আমার এ হৃদয় টা জুড়ে শুধু তোমারই বসবাস শিনু, আর অন্য কারো নয়!
তোমাকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি শিনু, তুমি নিজেও জানো! ফিরে আসো শিনু, আমরা আমাদের ভেতর কথা বলে সব ঠিক করে নেবো শিনু! তারপর তুমি আমাকে যে শাস্তি দিতে চাও আমি মাথা পেতে নেবো, কিন্তু এভাবে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকো না, আমার থেকে দূরে চলে যেও না শিনু! তুমি এমন করলে আমি মরে যাবো, প্রাণ আমার!
তুমি ছাড়া আমার সব কিছু অন্ধকার শিনু, নিথর সমস্তটা! তুমি আমার হৃদয়ের তন্ত্রী, যার সুর ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন! সেই তুমি এভাবে নিরব হয়ে গেলে আমি কি করবো শিনু! তুমি আমার কাছে আসো, আমাকে মারো বকো যা ইচ্ছা করো, কিন্তু চুপ থেকো না শিনু প্লিজ! ফিরে এসো তুমি আমার কাছে!
আমি তোমার আওয়াজ পাচ্ছিনা শিনু! দম বন্ধ লাগছে আমার! একটাবার তোমার নিরবতাকে ভেঙে আমার কাছে আসো শিনু! তোমার হৃদয়ের কথা গুলো শোনাও আমাকে, সব শুনবো আমি, গালি দাও সেটাও শুনবো, তবুও কথা বলো! একটা বার তোমার কন্ঠস্বর শুনতে দাও আমাকে প্লিজ!
আমাকে তুমি ভুল বুঝোনা শিনু, আমি শুধু তোমারই, আমার এ হৃদয়টা শুধুমাত্র তোমারই, আমার সবকিছু কেবলমাত্র তোমার জন্যই! তুমি ছাড়া আমি অর্থহীন শিনু! একটাবার ফিরে আসো প্লিজ!”
মীরের ব্যাথাতুর আর্তনাদ শেষ হলো, কিন্তু অ্যানার কোনো অস্তিত্বই পাওয়া গেলো না সেখানে। চারদিকে নেমে এলো নিস্তব্ধতা। বাতাসটাও যেন নিজের প্রবাহ বন্ধ করে দিলো এবার।
অ্যানা ওর সামনে আসছে না ভাবতেই হাঁসফাঁস করে উঠলো মীর। হাপরের মতো করে দম নিতে শুরু করলো ও, চোখ জোড়া বিস্ফোরিত হয়ে আসছে! বুকের ভেতর ভীষণ ভয় ঘূর্ণি পাকিয়ে উঠে আসছে।
ওর শিনু কি এবার আর ফিরবে না? ওর শিনু কি আর ওর কথায় অভিমান ভেঙে ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়বে না? ওর উষ্ণ আদরে ভিজবে না? এতটা অভিমান হয়েছে ওর শিনুর! ওকে কন্ঠস্বর টা পর্যন্ত শুনতে দিচ্ছে না! কোথায় গেলো ওর শিনু ওকে ছেড়ে! কি হবে এবার ওর!
হাটু গেড়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো মীর। হাতের আঙুল গুলো কাঁপতে শুরু করেছে ওর অস্বাভাবিক ভাবে! নিজের কাঁপতে থাকা হাত জোড়া সামনে নিয়ে একটা বার তাকালো মীর। হাঁসফাঁস লাগলো ওর আরও বেশি, আর তার পরমুহূর্তেই কন্ঠে চরম আকুলতা নিয়ে ও চিৎকার করে বলে উঠলো,
— শিনু, ফিরে আসো আমার কাছে! শেষ বারের মতো! দয়া করো আমার ওপর!
— উনি কি আমাকে বিয়ে করবেন না আফিয়া?
অনদরমহলে, দাসীদের হলরুমে গোছগাছ করার সময়ে হঠাৎ পাশ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে ঘুরে তাকালো আফিয়া। চোখে মুখে চরম উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে আফিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে লাল রঙা চুলের মেয়েটি৷ আফিয়া ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের কাজে হাত লাগাতে লাগাতে বলে উঠলো,
— করবেন না কেন? অবশ্যই করবেন। উনি তো তোমাকে এনেছেনই বিয়ে করার জন্য। কিন্তু ওই ডাইনি টা চলে গেলো যে! দুইটা মাস হলো তার কোনো খোঁজ নেই। এই মুহুর্তে উনি বিয়ে নিয়ে কিছু ভাববেন বলে আমার মনে হয় না!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফিয়া আবার বলে উঠলো,
— হিজ ম্যাজেস্টির মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না! চোয়াল ভেঙে গেছে ওনার, চোখ দুটো যেন গর্তে চলে গেছে! অথচ তার কোনো খোঁজ নেই! এর আগেও তো কত বাদশাহ এসেছেন আর গেছেন, তাদেরও তো হাজার হাজার দাসী ছিলো, কারো কারো একের অধিক স্ত্রী ও ছিলো, কিন্তু কাউকে এমন করতে দেখিনি বাবা!
জন্মের পর থেকে হিজ ম্যাজেস্টি কে একদম শুষে খেয়ে নিলো হোয়াইট উইচ টা! দুদন্ড শান্তি দিলো না কখনো!
শেষোক্ত কথাটা বলা মাত্রই কারো হাতের হেচকা টানে হাতে থাকা এতক্ষণের গোছানো কাপড় গুলো ঝুপঝাপ করে পড়ে গেলো মেঝেতে, আর এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই আফিয়ার চোয়ালে সজোরে এসে পড়লো একটা থাপ্পড়! আফিয়ার কানে তালা লেগে গেলো যেন। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে থাপ্পড় দাতার দিকে তাকালো ও! ইয়াসমিন!
চারদিকে দাসীরা জড়ো হয়ে গেছে ইতোমধ্যে, এখন একটা দারুন শো দেখা যাবে, মাঝে মাঝে এমন শো হলে মন্দ হয়না ওদের৷ বিনোদনের অভাব টা পূর্ণ হয়ে যায়।
আফিয়া নিজের আঘাত পাওয়া গালে হাত রেখে ইয়াসমিনের দিকে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে বাজখাই গলায় বলে উঠলো,
— আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন!
— বেশ করেছি হাত তুলেছি! তোমার সাহস কি করে হয় একজন শেহজাদীর সম্পর্কে এমন কথা বলার! এত স্পর্ধা তোমাকে কে দিয়েছে আফিয়া? কাদের সাথে মেশো তুমি? এই প্রাসাদে কার দয়ায় আছো তুমি? নেমকহারামী করো কোন সাহসে!
আফিয়ার চোখের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বজ্রকন্ঠে বলে উঠলো ইয়াসমিন।
— হ্যাঁ তো! আমি মিথ্যা কি বলেছি? উনি কি বেশি বেশি করছেন না? দুইটা মাস হতে চলল তার কোনো পাত্তা নেই! তার জন্য আমাদের সবকিছু থমকে আছে। সাম্রাজ্যের কাজে হিজ ম্যাজেস্টির কোনো মন নেই! ওই ডাইনিটা…….
পুরো কথা শেষ করতে পারলো না আফিয়া, তার আগেই আর একটা ভারী থাপ্পড় ওর মুখে এসে পড়লো,
— আবার! আবার তুমি শেহজাদী কে ডাইনি বলে ডাকলে! আজকেই, এই মুহুর্তে তুমি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যাবে! আর কখনো ফিরে আসবে না। তোমাকে তোমার চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো!
— কে বরখাস্ত করবে আফিয়া কে?
হুমায়রা তাইরের কন্ঠে শুনে সামনে তাকালো ইয়াসমিন। ধীর গতিতে মুখে দাম্ভিকতা ঝুলিয়ে সে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ইয়াসমিন হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— আমি বরখাস্ত করবো ওকে। ওর এতবড় স্পর্ধা, ও আমাদের শেহজাদী কে নিয়ে বাজে কথা বলে! শুধু ও নয়, যে-ই আমাদের শেহজাদী কে নিয়ে কোনো ধরণের বাজে কথা বলবে তাকেই এই প্রাসাদ থেকে বের করে দেওয়া হবে!
শেষোক্ত কথাটা যে তাকে উদ্দ্যেশ্য করেই বলা হয়েছে সেটা ভালোভাবেই টের পেলো হুমায়রা৷ বাকা হেসে সে এগিয়ে এলো ইয়াসমিনের দিকে৷
— ইয়াসমিন, তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো যে আমি প্রাসাদের দাসীদের প্রধান নিয়ন্ত্রক। কে থাকবে আর কে যাবে সেটা আমি ডিসাইড করবো, তুমি নও। তুমি শেহজাদীর খাস দাসী, তাই বলে এই নয় যে তুমি সব ক্ষমতা পেয়ে গেছো! ক্ষমতা এখনো আমার হাতে। এখন শেহজাদী নেই, আর সে ডাইনিটা ফিরে আসবে কিনা সেটারও আর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই তোমাকে এই প্রাসাদ থেকে সরিয়ে ফেলতে আমার দুইটা মিনিট ও লাগবে না। হিজ ম্যাজেস্টিও তার ব্যাক্তিগত সমস্যা নিয়ে জর্জরিত, তারও একবারের জন্যেও দেখার কৌতুহল জাগবে না যে তার বেগমের ব্যাক্তিগত দাসী টা আছে না গেছে! তাই এখন থেকে সাবধানে চলবে৷ আর শেহজাদী একটা ডাইনি, সে নিজের চার্ম দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছ সবাই কে, তোমাকেও।তাকে ছাড়া কেউ কিছু বুঝে না৷ তাই ডাইনি কে ডাইনিই বলা সই! এখন সরো আমার সামনে থেকে, আমার ত্রী সীমানায় যেন তোমার চেহারা না দেখি, শেহজাদীর চামচা!
হুমায়রার কথা শেষ হতে না হতেই হলরুমের প্রবেশদ্বারে থাকা রয়্যাল মেম্বার ইন্ডিকেটরে একটি ফিমেইল ভয়েস সমস্ত অন্দরমহল টাকে নিস্তব্ধ করে দিয়ে বলে উঠলো,
— অ্যাটেনশন, আওয়ার অনারেবল কিং, নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান!
মীরের নাম টা শোনা মাত্রই হলরুমে জড়ো হয়ে ঝামেলা দেখতে থাকা দাসী গুলো তড়িঘড়ি করে হলরুমের দুপাশে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ নিজেদের কে সংযত করে নিলো যেন সামান্যতম ত্রুটিও বাদশাহর চোখে না পড়ে!
হুমায়রা প্রমাদ গুণলো! ওর কথা কোনোভাবে বাদশাহ শুনে ফেলেননি তো! নইলে উনি এই অসময়ে এখানে কেন আসবেন!
আফিয়া সটান দাঁড়িয়ে রইলো, ভয়ে ওর শীরদাড়া ঠান্ডা হয়ে আসছে! ওদের কথা যদি এখন ইয়াসমিন হিজ ম্যাজেস্টির কানে তুলে দেয়, তাহলে কি হবে!
ইয়াসমিন ওর চোখে মুখে ফুটে থাকা ক্রোধ টাকে যথাসম্ভব দমন করে রেখে নিজের মুখের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ওর সে চেষ্টা বিশেষ কাজে এলো না৷ আর তার পরমুহূর্তেই ধীর, ভারী পা ফেলে হলরুমে এসে উপস্থিত হলো মীর৷ তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া ওর হুমায়রার দিকে।
হলরুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা। কেউ সামান্যতম নড়াচড়াও করছে না৷ মীর এগিয়ে এলো আরও একটু। চোয়াল জোড়া ভেঙে গেছে ওর, হৃষ্টপুষ্ট চেহারা টা বিষণ্ণ, মলিন। বসে যাওয়া চোখে নিদ্রাহীন রাতের ছাপ। স্বর্ণালী আভা টা ম্লান হয়ে এসেছে ভীষণ ভাবে। চোখ জোড়াতে নিকষ কালো অন্ধকারে সামান্য আলোর দেখা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা পথিকের দৃষ্টি। কিন্তু তাতে তার সৌন্দর্য এক ফোটাও কমেনি, শাণিত চেহারাটা যেন আরও ধারালো হয়ে উঠেছে!
ইয়াসির নামক গার্ড টা পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো, মীর কঠিন গলায় ডেকে উঠলো,
— ইয়াসির!
ইয়াসির দ্রুত পায়ে মীরের সামনে এগিয়ে এসে মাথাটা সামান্য নত করে বলে উঠলো,
— আদেশ করুন ইয়োর ম্যাজেস্টি!
মীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হুমায়রা আর আফিয়ার দিকে নির্দেশ করে ইয়াসিরের উদ্দেশ্যে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
— এই দুই জঘন্য নারীকে এই মুহুর্তে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রেড জোনে ফেলে দিয়ে এসো, এবং নিশ্চিত করে আসো যেন রেড জোনের পশু গুলো এদের শরীরের পুরোটাই ছিড়ে ছিড়ে খেয়ে নেয়, একটা টুকরোও যেন অবশিষ্ট না থাকে!
ইয়াসির মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে উঠলো,
— আপনার আদেশ শিরোধার্য ইয়োর ম্যাজেস্টি!
আর এরপর পেছন থেকে আরও কয়েকজন গার্ড কে ইশারায় ডেকে নিয়ে সে এগোলো হুমায়রা আর আফিয়ার দিকে।
আত্মা কেঁপে উঠলো হুমায়রার। আতঙ্কিত হয়ে বিস্ফোরিত নয়নে সে আর একবার মস্তিষ্কের ভেতরে হিজ ম্যাজেস্টির কথা গুলো আওড়ালো, আর তার পরমুহূর্তেই হাউমাউ করে ছুটে এসে মীরের পায়ে পড়ে গেলো। কিন্তু মীর কে স্পর্শ করার আগেই হুমায়রার দিকে প্রচন্ড ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দু কদম পেছনে ফিরে গেলো মীর। হুমায়রা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মিনতি পূর্ণ কন্ঠে বলল,
— ক্ষমা করে দিন ইয়োর ম্যাজেস্টি! এমন ভুল আর কখনোই হবে না! আর কখনো এমন কথা উচ্চারণ করার কথা মাথায়ও আনবোনা ইয়োর ম্যাজেস্টি! ক্ষমা করে দিন আমায়! দয়া করুন!
হুমায়রার আহাজারিতেও মীরের ঘৃণার দৃষ্টুর কোনো পরিবর্তন হলো না! ঘৃণার সাথে এবার চোখে এসে জড়ো হলো এক রাশ বিরক্তি। হুমায়রার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ইয়াসিরের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই ইয়াসির তড়িঘড়ি করে গার্ড গুলোর সহায়তায় আহাজারি করতে থাকা হুমায়রা আর আফিয়া কে ধরে বেধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেলো প্রাসাদের বাইরে।
ওরা চলে যেতেই মীর হলরুমে দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত দাসীদের দিকে দৃকপাত করে শকুনি দৃষ্টিতে তাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো,
— দ্বিতীয়বার যদি কেউ আমার স্ত্রীর নামে কোনো ধরণের অসম্মানজনক কথা বলার মতো স্পর্ধা দেখায় তবে তাকে ফুটন্ত গরম পানিতে সেদ্ধ করে তার চামড়া ছিলে লবণ মাখিয়ে গলায় দড়ি বেধে অন্দরমহলের দরজায় ঝুলিয়ে রেখে দিবো। তাই সে যে-ই হোক না কেন!
মীরের এমন কন্ঠ শুনে দাসী গুলো আতঙ্কে জড়সড় হয়ে উঠলো। মীর চোয়াল শক্ত করে তাদের দিকে থেকে চোখ নামিয়ে অন্দরমহল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে ইয়াসমিনের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
— হেরেম এখন থেকে তোমার দায়িত্বে ইয়াসমিন!
বলেই গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। ইয়াসমিন কৃতজ্ঞতা জানানোর সময়টুকুও পেলো না।
মীরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ইয়াসমিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা, তারপর নিজের নতুন দায়িত্ব বুঝে নিতে পা বাড়ালো। তখনি পেছন থেকে নরম সুরে কেউ প্রশ্ন করে উঠলো,
— উনি কি শেহজাদীকে খুব ভালোবাসেন?
প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরলো ইয়াসমিন৷ লাল রঙা কোকড়া চুলের নীল নয়না মেয়েটি চোখে একরাশ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে৷ ইয়াসমিন দু কদম এগিয়ে গেলো তার দিকে, তারপর জিজ্ঞেস করলো,
— কি নাম তোমার?
— বাহার, গুল বাহার।
— শুনো বাহার! এই পৃথিবীতে হিজ ম্যাজেস্টি সর্বমোট চারজন মানুষ কে ভালোবেসেছেন; তার দাদাজান, তার আম্মা, তার চাচাতো ভাই আর শেহজাদী। প্রথম তিন জনকে তিনি অনেক আগেই হারিয়েছেন। তাই চতুর্থ জনকে তিনি তার সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন, কোনোভাবেই আর তাকে হারাতে দিবেন না৷ নশ্বর কারো ক্ষমতা হবে না শেহজাদী কে বাদশাহর থেকে আলাদা করার। তাই এতদিন হুমায়রা আর আফিয়া মিলে তোমাকে যে দিবাস্বপ্ন দেখিয়েছে সেগুলো ভুলে যাও।
কথা শেষ করে বাহারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ইয়াসমিন চলে যেতে নিচ্ছিলো। তখনি বাহার পেছন থেকে আত্মবিশ্বাসের সাথে আবার প্রশ্ন করলো,
— উনি কি আমার থেকেও সুন্দরী?
ইয়াসমিন ঘুরে দাঁড়িয়ে একবার বাহারকে আপাদমস্তক দেখে নিলো, তারপর সামান্য শব্দ করে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
— কোথায় চাঁদের কণা আর কোথায় কচুরিপানা!
সশব্দে দরজা ঠেলে অ্যানার কামরায় ঢুকলো মীর। দরজা খুলতেই একটা নরম, স্নিগ্ধ বাতাস এসে বাড়ি খেলো মীরের দেহে। ব্যালকনির দরজা টা খোলা। অ্যানা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে দরজাটা সারাক্ষণ খোলাই রাখে মীর। যদি মেয়েটা কখনো ভুলবসতও কামরাটায় একটু উঁকি মেরে যায়!
একপা দুপা করে কামরার ভেতরে এগোলো মীর। এই সেই কামরাটা, যেখানে ওর শিনুর ভালোবাসার চাদরে সারাটাক্ষন নিজেকে মুড়িয়ে রাখতো ও! আজ সেখানে বিষণ্ণতার স্রোত বইছে! ওর শিনুর ছোয়া গুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে কামরা টা থেকে!
মীর এগিয়ে গেলো অ্যানার ড্রেসিং টেবিলটার দিকে। এখানে বসে রোজ নিজের দীঘল শুভ্র কেশগুচ্ছ আলগা করতো অ্যানা। নিজের শুভ্র কোমল চেহারাটা দেখতো ওই আয়নায়! অ্যানার নিতম্ব ছাড়ানো চুল গুলোতে রোজ রাতে তেল লাগিয়ে দিতো মীর। সযত্নে আচড়ে বেনী করে দিতো ওর রেশমী চুল গুলো! সবখানেই নিজের আলতো, কোমল স্পর্শ রেখে গেছে সে!
ড্রেসিং টেবিলটার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেখান থেকে সরে মীর এবার এগোলো অ্যানার বিছানার দিকে। ঝিনুকের আকৃতির ন্যায় বিশাল বিছানাটার মোলায়েম ফোমের ওপর নিজের পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লো ও, তারপর পরম আবেশে চোখ বুজে নিলো।
এই বিছানায় কতশতবার ওদের ভালোবাসাবাসি হয়েছে। অগণিত মান অভিমানের পালা চলেছে! মান অভিমান শেষে আবার একে অপরের বুকে ঝাপিয়ে পড়েছে! এই বিছানাতেই হয়েছে কত শত আবদার, কত শত আদর! কত রাত আদরে আদরে ও পাগল করে তুলেছে ওর শিনু কে! শিনুর প্রেমের ঝুমবৃষ্টিতে ভিজেছে ও রাতভর! সংযমের রাত গুলোতে অ্যানার যন্ত্রণা যুক্ত পেটটাকে আগলে নিয়েছে নিজের উষ্ণ হাতের তলায়! ওর হাতের ওই ভালোবাসাময় উষ্ণতা না পেলে যে ওর শিনুর যন্ত্রণা কমতো না! তবে এখন কি করছে ওর শিনু! ওর শিনু ওকে ছেড়ে কিভাবে আছে?
বিছানা থেকে অ্যানার শরীরের ক্ষীণ সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। বুক ভরে অ্যানার ঘ্রাণ মিশ্রিত বাতাস টেনে নিতে চাইলো মীর!
কিন্তু এ কি! অ্যানার শরীরের ঘ্রাণ টা আগের মতো আর পাওয়া যাচ্ছে না কেন! ম্লান হয়ে আসছে যে!
মীর চোখ মেলে তাকালো তখনি! ক্ষীপ্র গতিতে উঠে বসে পাশ থেকে অ্যানার মাথার বালিশ টা নিয়ে সেখানে নাক ডুবালো! আসছে না ওর শিনুর ঘ্রাণ! আর আসছে না! সব কিছু মিলিয়ে যাচ্ছে, ফিকে হয়ে যাচ্ছে! এমন কেন হচ্ছে!
আর কতদিন! আর কতদিন থাকবে এ ঘ্রাণ! ধীরে ধীরে তো সবই মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়! কি করবে এবার ও! ওর শিনুকে ছাড়া কিভাবে থাকবে ও এখানে!
মেয়েটা সেই চলে গেলো! আর তারপর এতগুলো দিন ধরে এত খোজাখুজি করেও তার কোনো হদিস পেলো না মীর! সমস্ত রেড জোন তন্নতন্ন করে খুঁজেছে ও অনেক অনেক বার! কিন্তু যাকে খোঁজার জন্য ওর এত পরিশ্রম, একটা বারের জন্যও তার উপস্থিতি কোথাও পেলো না মীর! কোথাও না!
পঞ্চদ্বীপের একটা দ্বীপও খুজতে বাকি রাখেনি মীর। সবখানে খোঁজা হয়ে গেছে ওর! কিন্তু কোথাও ওর শিনুকে ও খুঁজে পায়নি!
অ্যানার বালিশ টা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে আবার দুর্বল ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লো মীর। শুয়ে শুয়ে গত দুমাসের সমস্ত ঘটনা গুলো একবার চোখের সামনে দেখে নিলো ও। একটাবারের জন্যেও অ্যানার উপস্থিতি ও কোথাও পায়নি ভাবতেই অস্ফুট এক আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ওর বুক চিরে!
আবার চোখ বুজে নিলো ও। একটা শুকনো ঢোক গিলে আবারও অ্যানার শরীরের ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করলো। হঠাৎ করেই ওর মনে হলো অ্যানা যেন ওর পাশেই ঘুমিয়ে আছে, এইতো এখনি ঘুম থেকে স্বল্প ইস্তফা দিয়ে ওর ডান পা টা মীরের শরীরের ওপর উঠিয়ে দিয়ে বেঘোরে আবার ঘুমিয়ে পড়বে!
অ্যানার উপস্থিতির কথা মনে হতেই মীরের বুকের ভেতর টা ধক করে উঠলো হঠাৎ। জানে কোনো উত্তর আসবে না, তবুও একবার অস্ফুটস্বরে ও ডেকে উঠলো,
— শিনু!
কোনো উত্তর এলো না, কেউ সে ডাকে সাড়া দিয়ে বলে উঠলো না, ‘এইতো আমি, তোমার কাছেই’
নিস্তব্ধ, সব নিস্তব্ধ, সব নিশ্চুপ! তবুও যেন মীরের মনটা মানতে চাইলো না! নিজের বা হাত টা আস্তে আস্তে অ্যানার দিকের বিছানার দিকে বাড়ালো। যদি কোনো অলৌকিক শক্তি বলে ওর শিনু ওর কাছে চলে আসে!
মীরের বুকে জন্মানো এই শিশুসুলভ ক্ষীন আশা বিফলে গেলো সম্পুর্ন। হাত টা বিছানার ওপর রেখে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে ডুবে যেতে থাকা ব্যাক্তি যেভাবে একটা অবলম্বন খোঁজার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, ঠিক সেভাবেই বিছানার অপর পাশটা হাতড়াতে লাগলো মীর!
নেই নেই নেই! কেউ নেই এখানে! কোথাও নেই ওর শিনু! কোথাও না! ওর ওপর অভিমান করে চলে গেছে কোনো দূর অজানায়, যেখানে ও পৌছাতে পারছে না, কিছুতেই পৌছাতে পারছে না, কিছুতেই না!
হঠাৎ করেই দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠা শিশুর ন্যায় ডুকরে কেদে উঠলো মীর। ওর বুকটা আজ ফাঁকা, ভীষণ রকম ফাঁকা! নিজের কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে নিজের হাফিয়ে যাওয়া ফুসফুসকে সামান্য শান্তি দিতে শিনুর উদ্দ্যেশ্যে ও অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
— শিনু! প্রাণ আমার! তোমার অভিমানের কারণে আজ আমার সমস্ত জীবন বিষণ্ণতায় ভরে উঠেছে, যেখানে আলো বলতে আর কিছুই নেই, আঁধারে ছেয়ে আছে সবকিছু।
তোমার সেই ঝংকার তোলা মিষ্টি হাসির জায়গায় এখন এই কামরার নিস্তব্ধতায় আমি কেবল শুনছি আমার নিজেরই হাহাকার।
আমার প্রতিটি প্রহর কাটতো তোমার ওই মায়াভরা চোখের দিকে তাকিয়ে, অথচ আজ তুমি নেই। আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে তুমি মিশে আছো, অথচ এই শূন্য কামরায় তোমার ছায়া আর ফেরে না। তোমার আদরের প্রতিটি স্পর্শ আমার স্মৃতির পরতে পরতে লেপ্টে আছে!
আর আমি ওই আকশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে আছি তোমার অপেক্ষায়… আমার প্রতিটি দুয়াতে তোমার উপস্থিতি, যেন এখনি তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে; আমার বুকের ভেতরে প্রতিনিয়ত ঝড় তোলা এই যন্ত্রণাকে চিরতরে মুছে দিতে! ফিরে এসো শিনু! ফিরে এসো একটিবার!”
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ আগে। বিশাল সমুদ্রের এক কোণায় এখনো সূর্যের লালচে কিরণ দেখা যাচ্ছে কিঞ্চিৎ। ওয়ার্কিং জোনে রাত নেমে এসেছে, চারদিকে ধীর ধীরে জ্বলে উঠছে বৈদ্যুতিক বাতি৷
রাতের বেলা কাজের চাপ কম। ওয়ার্কার্স রা সবাই মিটিং জোনে বসে গল্প করছে টুকটাক। কেউ কেউ নিজেদের বেচে থাকা কাজ গুলো সমাপ্ত করছে।
শার্লট ওর ভাইয়ের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে মিটিং জোনে বসে বসে সবার গল্প শুনছে, মাঝে মাঝে গল্পের প্রয়োজনে মৃদু মৃদু হাসছে। ব্রায়ানও সে গল্পে শামিল হচ্ছে মাঝে মাঝে।
কিছুক্ষণ পর ব্রায়ান হঠাৎ করে উঠে যেতে নিলো। আরামের জায়গাটা সরে পড়ায় শার্লট ভাইয়ের গমন পথের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
— কোথায় যাচ্ছো ভাইয়া?
— হাটতে যাচ্ছি একটু, ভালো লাগছে না!
বলে নিজের পকেটে দু হাত ভরে ধীর পায়ে নিজেদের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার দিকে এগোলো ব্রায়ান।
অ্যানা চলে যাওয়ার পর থেকে ওর সমস্ত আনন্দে ভাটা পড়েছে। সেদিনের পর থেকে আর কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারেনি ও। সব কিছুতেই চলে আসছে বিরক্তি!
অ্যানাকে নিয়ে ওই লোক গুলো কি করলো সেটা আজও জানিতে পারেনি ওরা কেউ৷ শার্লট টা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে অ্যানার ব্যাপারে, ব্রায়ান কোনোভাবে কিছু জানতে পেরেছে কিনা!
কিন্তু ব্রায়ান বিরাবরই নিশ্চুপ। কি উত্তর দেবে ও? কিভাবেই বা জানবে অ্যানা কোথায় আছে, ওর কি হয়েছে! ওর তো জানার মতো কোনো সোর্স নেই!
মাঞ্জারের ভেতরের সরু পথ বেয়ে হেটে চলেছে ব্রায়ান। রাস্তার দুপাশে ফুটে আছে হরেক রকমের ফুল। মৃদুমন্দ বাতাসে থেকে থেকে দুলে উঠছে সেগুলো, তাদের মোহনীয় সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে।
বুক ভরে ঠান্ডা বাতাস টেনে নিয়ে সামনে এগোলো ব্রায়ান। হাটতে হাটতে পৌছে গেলো মাঞ্জারের শেষ সীমানায়, ব্লু জোনের নিকটে।
কিছু স্মৃতি তাজা হয়ে উঠলো ওর। সে রাতে অ্যানা এখানেই সেই ছেলেগুলোকে খুন করেছিলো! বাঁচিয়েছিলো ওর আর ওর বোনের প্রাণ! কিন্তু সেই অ্যানাকে বাচাতে ও কিছুই করতে পারলো না। ওর চোখের সামনে দিয়ে অ্যানাকে নিয়ে চলে গেলো ওরা! আর ও হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখলো শুধু!
বাদশাহ নামা পর্ব ৪৭+৪৮
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ব্রায়ান। তারপর কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রেড জোনের জঙ্গলের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফিরে আসতে নিলো। তখনি ওর চোখ গেলো রেড জোনের ভেতরে থাকা একটি বিশাল, বিস্তৃত বটবৃক্ষের চওড়া ডালের ওপর। সেখানে শুয়ে আছে কেউ, চুল গুলো তার সাদা, গাছের ডালটাকে ছাড়িয়ে অভিকর্ষের টানে সে শুভ্র কেশ গুচ্ছ ঝুলে আছে নিচের দিকে! মৃদুমন্দ বাতাসে মিহি সুর তুলে উড়ছে সেগুলো!
