বাদশাহ নামা শেষ পর্ব
আমিনা
থমকালো ব্রায়ান। কি ওইটা? ওইটা কি কোনো অশরীরী! আকৃতি টা সম্পুর্ন একটি নারী দেহের মতো। এটা কি কোনো ট্রাপ! হয়তো ওকে মায়ায় ভুলিয়ে রেড জোনে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলার ধান্ধা কোনো মায়াবিনীর!
ব্রায়ানের ভাবনার মাঝেই নড়ে চড়ে উঠলো সে নারী অবয়ব টা। মুখের দিক টা দৃষ্টি গোচর হলো সামান্য। ব্রায়ানের এবার চোখ কপালে উঠলো, এটা তো অ্যানার মতো দেখতে! তবে কি আগের দিনের মতো আজও অ্যানার রূপ ধরে কেউ ওকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে রেড জোনের ভেতরে!
অজানা আতঙ্কে হতবাক হয়ে যাওয়া ব্রায়ানের মুখ থেকে না চাইতেও অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসলো একটি শব্দ,
— অ্যানা!
আর সে শব্দটা শোনা মাত্রই গাছের ডালে শুভ্র কেশ বিছিয়ে শুয়ে থাকা রমনীটি মাথা তুলে তাকালো। আর তাকে দেখা মাত্রই প্রমাদ গুনলো ব্রায়ান! সাদা চুল, উজ্জ্বল এক জোড়া চোখ, তা থেকে আবার আলোচ্ছটা বেরিয়ে আসছে!
মেয়েটির সমস্ত শরীর থেকেই যেন শুভ্র, নির্মল আলো টিকরে পড়ছে! যেন রেডিয়ামের তৈরি কোনো উজ্জ্বল বস্ত সে! কিন্তু সে অ্যানার রূপ কেন ধরেছে!
ব্রায়ান আতঙ্কের ভেতরেই নিজের চারপাশ টা দেখে নিলো, নাহ সে সেইফ জোনেই আছে। অ্যানার রূপধারী এই মায়াবিনী যদি তাকে আক্রমণ করতে চায় তবুও পারবে না। সেইফ জোনে তো ওরা ঢুকতে পারে না!
ব্রায়ানের পা চলছে না, চাইলেও পেছন দিকে চলে যেতে পারছে না। ওই মায়াবিনী তার চোখের মোহনীয় দৃষ্টি দিয়ে তাকে আটকে রেখেছে যেন!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কিন্তু এবার দম আটকালো ব্রায়ানের, বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে, কারণ মেয়েটা গাছের ডাল থেকে ধুপ করে মাটিতে লাফিয়ে নেমে তার দিকেই হেটে আসছে!
মেয়েটির শরীরে একটা সাদা রঙা পাতলা ফিনফিনা পোশাক, পোশাকের ওপর দিয়ে তার মোহনীয় শরীরের ভাজ গুলো স্পষ্ট! ব্রায়ান চোখ নামিয়ে নিতে চেয়েও পারলো না৷ মস্তিষ্ক দেখতে বাধা দিতে চাইলেও বেহায়া মন টাকে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না৷ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে কোমরে ঢেউ তুলে এগিয়ে আসা রমনীটির সুডৌল বক্ষের দিকে।
আর এরপর ওকে হতবাক করে দিয়ে সে মেয়েটি রেড জোন পার হয়ে ব্লু জোন কে ছাপিয়ে এসে প্রবেশ করলো সেইফ জোনে। এরপর মৃদু গতিতে হেটে ব্রায়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দ্বিধা ভরা দৃষ্টিতে মৃদু স্বরে ডেকে উঠলো,
— ব্রায়ান!
ব্রায়ান শ্বাস নিতে ভুলে গেছিলো যেন, কিন্তু মেয়েটির মুখে নিজের নাম শোনা মাত্রই চমকালো ও। এ কি তবে সত্যিই অ্যানা! বিস্ময়াভিভূত হয়ে ও চোখ জোড়া বড় বড় করে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— অ্যানা! তুমি এখানে এ অবস্থায় কি করছ? তুমি রেড জোনে ছিলে কেন? তোমার চুল, তোমার চোখ এমন হয়ে গেছে কেন? ওরা কি করেছে তোমার সাথে অ্যানা!
অ্যানা ব্রায়ানের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে তইলো ব্রায়ানের দিকে। না চাইতেও ব্রায়ানের চোখ জোড়া আবার চলে গেলো পাতলা পোশাকের ওপর দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে থাকা অ্যানার বক্ষের দিকে।
দ্রুত সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের গায়ের শার্ট টা খুললো ও। তারপর সেটা অ্যানার গায়ে চড়িয়ে দিতে নিতেই দ্রুত গতিতে দু কদম পেছন দিকে সরে গেলো অ্যানা৷ তারপর আগের মতোই মৃদুস্বরে ভাবলেশহীনের ন্যায় বলে উঠলো,
— পুরুষের ছোয়া আমি ঘেন্না করি!
ব্রায়ান এক পলক তাকালো অ্যানার মুখ খানার দিকে। অনুভূতিশূন্য সে চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে ব্রায়ানের মনের কোণে কোথায় খুব যন্ত্রণা দিয়ে উঠলো। ওই লোক গুলো অ্যানার সাথে কি করেছে সেটাই ভাবতে লাগলো ও! হয়তো ওরা এমন জঘন্য কিছু করেছে যার জন্য অ্যানার আজ এমন অবস্থা! আর কিছু ভাবতে পারলো না ও!
গা থেকে খুলে ফেলা শার্ট টা অ্যানার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ও বলে উঠলো,
— আমি তোমাকে স্পর্শ করছিনা অ্যানা, আমাকে ভুল বুঝো না, এইটা পরে নাও প্লিজ!
অ্যানা বাধ্য মেয়ের মতো ব্রায়ানের হাত থেকে ওর শার্ট টা নিলো, তারপর ধীরে সুস্থে গায়ে পরে নিলো সেটা। ব্রায়ান ত্রস্ত ভঙ্গিতে ওকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
— শোনো, তুমি এখানেই থাকো, কোথাও যেও না। আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি।
বলেই পেছন দিকে ছুটে মিটিং জোনের দিকে এগোলো ব্রায়ান। অ্যানা ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।
ব্রায়ান দৌড়ে পৌছালো মিটিং জোনে৷ তারপর সেখানে সবার সাথে বসে থাকা শার্লট কে হুট করেই কথা আছে’ বলে টেনে উঠিয়ে নিয়ে এলো মাঞ্জারের দিকে৷ শার্লট ব্রায়ানের এমন অদ্ভুত আচরণে ভ্রু জোড়া কুচকে নিয়ে কৌতুহলী কন্ঠে বলল,
— কি হয়েছে ভাইয়া? কোনো সমস্যা হয়েছে? তুমি আমাকে এভাবে নিয়ে এলে কেন?
— অ্যানার মাঞ্জারে যাবি, গিয়ে ওর পোশাক বের করে নিয়ে সোজা চলে যাবি মাঞ্জারের পেছনের দিকের জঙ্গলের কাছে। অ্যানা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ওকে নিয়ে এক্ষুনি ওর মাঞ্জারে ঢুকে যাবি, কেউ যেন না দেখে ওকে। ওর অবস্থা বেশি ভালো না, দ্রুত যা, নইলে ও আবার কোথাও চলে যাবে বলে আমার মনে হচ্ছে৷ দ্রুত, দ্রুত!
এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে উঠে, শার্লট কে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই ওকে পাঠিয়ে দিলো ব্রায়ান। শার্লট ঘটনা না বুঝেই ছুটলো অ্যানার মাঞ্জারের দিকে। তারপর সেখান থেকে অ্যানার একটা হুডি আর ট্রাউজার নিয়ে ছুটলো মাঞ্জারের পেছন দিকে।
মাঞ্জারের পেছন দিকে গিয়েই আঁতকে উঠে থমকালো ও! এই মেয়েটা কে! এ তো অ্যানার মতোই দেখতে! কিন্তু ওর চুল সাদা কেন? চোখ জোড়াও সাদা! এটা কিভাবে সম্ভব! নাকি অ্যানা পরচুলা লাগিয়েছে? কিন্তু অ্যানা পরচুলা লাগাবে কেন? আর চুল দেখেও তো নকল মনে হচ্ছে না!
শার্লট দ্বিধা ভরে এগিয়ে গেলো সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা অ্যানার দিকে৷ অ্যানা যেন ওকে দেখেও দেখলো না, বা চিনলো না! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শার্লটের মুখ খানার দিকে। শার্লট ভ্রু জোড়া তুলে ওর দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠলো,
— অ্যানা!
অ্যানা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ওর দিকে, তারপর রোবটের ন্যায় বলে উঠলো,
— শার্লট!
শার্লট অ্যানার পোশাকের দিকে তাকালো, তাকিয়ে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে নিয়ে অ্যানার দিকে ওর হুডি আর ট্রাউজার টা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— এটা পরে নে অ্যানা!
অ্যানা বিনা বাক্যব্যায়ে ওর হাত থেকে পোশাক দুটো নিয়ে পরে নিলো কোনো রকমে। অ্যানা যে কোনো ভাবে ঠিক নেই সেটা বুঝলো শার্লট, নইলে যে মেয়ে কখনো নিজের বডি শেইপ কাউকে বুঝতে দেয়না সে কিভাবে এই পোশাকে এইভাবে ঘুরে বেড়াবে৷
শার্লট চিন্তিত মুখে অ্যানার হাত টা ধরে ধীরেসুস্থে নিয়ে এলো অ্যানার মাঞ্জারে। তারপর ওকে সেখানে বসিয়ে রেখে বাইরে এসে রুমের বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে গেলো ব্রায়ানের কাছে। ব্রায়ান মিটিং জোন আর মাঞ্জারে ঢোকার রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে ছিলো। শার্লট এসে ওকে বলল অ্যানার জন্য কিছু খাবারের ব্যাবস্থা করতে, অ্যানাকে খাইয়ে দাইয়ে দিয়ে ঘুমাতে বলবে। ওকে একদমই ঠিক লাগছে না।
ব্রায়ান শার্লটের কথা মতো কিচেন থেকে অ্যানার জন্য কিছু খাবারের ব্যাবস্থা করে নিয়ে চলল অ্যানার মাঞ্জারে। কামরার দরজায় এসে টোকা দিতেই শার্লট দরজা খুললো। ব্রায়ান ওর হাতে খাবার টা তুলে দিতে গেলে শার্লট ‘তুমি গিয়ে খাইয়ে দাও’ বলেই কামরা থেকে বেরিয়ে চলে গেলো কোনো এক দিকে। ব্রায়ান শার্লটের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝলো শার্লট চাইছে ব্রায়ান অ্যানার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাক, নিভৃতে।
শার্লটের যাওয়ার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হেসে ও ঢুকলো অ্যানার কামরায়৷ অ্যানা নিজের দু পা ভাজ করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে হাটুতে মুখ গুজে বসে ছিলো বিছানায়। ব্রায়ান খাবার হাতে নিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ওর দিকে তাকালো একবার।
শুভ্র চুল গুলো পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে বিছানায় এলিয়ে আছে। বিষণ্ণতায় ছেয়ে থাকা, হীরকখন্ডের ন্যায় উজ্জ্বল চোখ জোড়া দ্যুতি ছড়াচ্ছে ভিষণ ভাবে! চারপাশটায় রঙ্ধনুর ন্যায় কুচি কুচি আলোকরশ্মি টিকরে পড়ছে যেন! কালো রঙা হুডির ভেতর দিয়ে উঁকি মারছে অ্যানার শুভ্র মোলায়েম গলা। চকচক করছে যেন সেখান টা!
হা হয়ে অ্যানার চেহারাটা দেখতে থাকলো ব্রায়ান। তারপর হুসে ফিরতেই হা বন্ধ করে খাবার টা নিয়ে এগোলো ও অ্যানার দিকে৷ তারপর ধীর গতিতে অ্যানার পাশে গিয়ে বসলো। অ্যানা একটাবার তাকিয়েও দেখলো না কে বসলো ওর পাশে৷
ব্রায়ান পাশে বসে অ্যানার গোলাপি রঙে রাঙিয়ে ওঠা গাল খানাকে দেখলো একবার। সাথে নজর দিলো ওর টেরাকোটা রঙা টসটসে ঠোঁট জোড়ার দিকে। এই অদ্ভুত সুন্দর ঠোঁট জোড়াকে নিজের দখলে নেওয়ার জন্য মস্তিষ্কের ভেতর থেকে বারংবার তাড়া দিতে লাগলো কে যেন! কিন্তু ব্রায়ান ওর মন আর মস্তিষ্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে একটা শুকনো ঢোকের সাথে অদম্য ইচ্ছাটাকে গিলে নিলো নিজের ভেতর। তারপর খাবারের পাত্রটা কোলের ওপর নিয়ে ডেকে উঠলো,
— অ্যানা!
ব্রায়ানের ডাকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো অ্যানা৷ ওর অনুভূতি হীন চক্ষুজোড়ায় আজ নেই কোনো কঠোরতা, নেই কোনো বিরক্তি! আছ্ব শুধু এক রাশ বিষণ্ণতা!
ব্রায়ানের বুকে বাজলো ওর দৃষ্টি। কোলের ওপর রাখা খাবারের পাত্র থেকে চামচে করে খাবার তুলে অ্যানার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো,
— খেয়ে নাও অ্যানা৷
কিন্তু ওকে হাত বাড়াতে দেখা মাত্রই চোখ মুখের ভাব বদলে গেলো অ্যানার। চোয়াল শক্ত করে পেছন দিকে সরে গেলো ও কিছুটা তারপর শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— পুরুষের ছোয়া আমি ঘেন্না করি!
ব্রায়ান আহত চোখে তাকালো ওর দিকে। না জানি মেয়েটার ওপর দিয়ে কি চলেছে এই কয়দিনে! ব্রায়ান গলা খাকারি দিয়ে অ্যানাকে মানানোর ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
— আমি তোমাকে স্পর্শ করছিনা অ্যানা! শুধু তোমার মুখে খাবার তুলে দিবো, তোমার শরীরে আমার হাতের স্পর্শ লাগবে না একটুও! দূরে যেও না! আমার কাছে আসো!
তবুও এগিয়ে এলো না অ্যানা৷ সন্দেহ আর দ্বিধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ব্রায়ানের দিকে। বাধ্য হয়ে ব্রায়ান এবার নিজেই এগিয়ে এলো ওর দিকে, বেশি এগোলোনা; যাতে অ্যানা আবার রেগে না যায়। কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে বসেই চামচে করে খাবার তুলে আবার অ্যানার মুখের সামনে ধরলো ব্রায়ান। তারপর নরম সুরে বলে উঠলো,
— খেয়ে নাও অ্যানা! আমি তোমাকে স্পর্শ করছিনা, ভয় পেয়ো না। তুমি আমাকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারো।
অ্যানা এবার আর কিছু বলল না। ভাবলেশহীন ভাবে ব্রায়ানের দিকে তাকিয়ে ব্রায়ানের বাড়িয়ে দেওয়া চামচ টা মুখে পুরে আলতো করে খেয়ে নিলো খাবার টা।
ওকে খেতে দেখে মৃদু হাসলো ব্রায়ান, মুখে বলে উঠলো,
— এইতো, ভালো মেয়ে! পুরোটা খেয়ে নেবে এখানে বসে।
অ্যানা চুপচাপ খেয়ে নিলো সবটুকু খাবার। ওকে পুরো খাবার টা খাওয়াতে পেরে ব্রায়ান তৃপ্তির হাসি হাসলো। তারপর অ্যানার ঢুলু ঢুলু চোখের দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে শুধালো,
— ঘুম পাচ্ছে তোমার?
অ্যানা ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
— শার্লট কই? আমি ওর সাথে ঘুমোবো।
ব্রায়ান ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠলো। হাতে খাবারের পাত্রটা নিয়ে ত্রস্ত ভঙ্গিতে অ্যানার বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,
— এখনি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি, তুমি এখানে অপেক্ষা করো একটু!
তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে। এরপর চারদিকে নজর বুলিয়ে শার্লট কে খুজে পাঠিয়ে দিলো অ্যানার কামরায়। আর নিজে চলে গেলো মিটিং জোনের দিকে৷ বুকের ভেতর টা এখনো ওর ধুকপুক করছে অজানা উত্তেজনায়। আজ যদি অ্যানা একটাবার বলতো ওকে থেকে যেতে, একটা বার বলতো যে ও শার্লটের সাথে নয় ওর সাথে ঘুমাবে, তবে অ্যানার ওই তুলতুলে শরীর টা নিজের বুকের ভেতরে নিয়ে ও চিরনিদ্রায় যেতেও রাজি ছিলো! অ্যানাকে ও বুকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে আছে ভাবলেই সমস্ত শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে ওর। অ্যানাকে ও ঠিক করে তুলবে, যেভাবেই হোক স্বাভাবিক করে তুলবে, তারপর করে নিবে নিজের, একান্ত নিজের!
৭৭. ভোর হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙে গেলো অ্যানার। ঘুম ভেঙে উঠে নিজেকে মাঞ্জারের ভেতরে শার্লটের পাশে আবিষ্কার করে চমকালো ও৷ ও এখানে কখন কিভাবে এলো মনে করার চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ।
কিয়ৎক্ষণ মস্তিষ্কে চাপ দিতেই মনে পড়ে গেলো ওর সবকিছু। ও তো ছিলো রেড জোনের ভেতরে!
নিজের চুল আর চোখের কথা মনে পড়তেই চুল গুলোকে সামনে নিয়ে এলো অ্যানা৷ তবে তো শার্লট দেখে ফেলেছে ওর চুলের রঙ! ব্রায়ানও দেখেছে! এখন তো আর বদলে ফেলার সুযোগ নেই!
দুঃশ্চিন্তা ছেড়ে স্থীর হয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে বিগত দু মাসের কথা ভাবতে লাগলো অ্যানা। সেদিন ওর সন্তানের কবরের পাশ থেকে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে কোনো এক গাছের সাথে লুকিয়ে নিয়েছিলো অ্যানা। মীরের সমস্ত আর্তনাদ সেদিন শুনেছিলো ও। কিন্তু ফেরেনি, আর ফিরবেও না!
তারপর থেকে ওই জঙ্গলকেই নিজের বাড়ি বলে মেনে নিয়েছিলো অ্যানা। ওই জঙ্গলেই ও ঘুরেছে ফিরেছে, ক্ষিদে লাগলে গাছ থেকে ফল পেড়ে খেয়েছে, কখনো বা খেয়েছে আধাপোড়া মাংস, ঘুমিয়েছে গাছের চওড়া ডাল গুলোতে! গাছের ডালগুলো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ওকে সবদিন।
আর যখনি যেখানে মীর বা কোকো দের উপস্থিতি টের পেয়েছে তখনি সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে ও। কিন্তু বিগত পনেরো দিন ধরে ও কারো উপস্থিতিই টের পায়নি। কিভাবে কিভাবে যেন সকলের চোখ থেকে ওকে লুকিয়ে ফেলেছে রেড জোন। অ্যানাকেও বুঝতে দেয়নি কারো উপস্থিতি!
প্রাসাদে থাকতে অ্যানা খুব ছোট বেলায় বই এ পড়েছে এক অদ্ভুত সতর্কবার্তা, যেন কোনো শেহজাদীই রেড জোনের ভেতর দীর্ঘদিন না কাটায়। কিন্তু সেখানে কোনো কারণ উল্লেখ করা ছিলো না৷ মীর কেও এই অদ্ভুত ব্যাপার টা সম্পর্কে কিছুই জানায়নি ও, মীর ও হয়তো ব্যাপার টা কখনো খেয়াল করেনি। কিন্তু এখন অ্যানা টের পাচ্ছে কেন শেহজাদী দের কে জঙ্গলে দীর্ঘদিন থাকা কে ফরবিডেন করা হয়েছে!
ওই রেড জোন ওকে সব ভুলিয়ে দিচ্ছিলো ধীরে ধীরে! কি ওর পরিচয়, কে ওর আপন, কারা ওর পরিচিত সবকিছু! সবকিছু ক্রমে ক্রমে ভুলতে বসেছিলো অ্যানা৷ ওই রেড জোন যেন তাকে একান্তই নিজের করে নিতে চাচ্ছিলো, তাকে নিয়ে নিতে চাচ্ছিলো নিজেদের ভেতরে, সারাজীবনের জন্য!
আজ যদি ব্রায়ান ওকে না দেখতো, আর ওকে ওর নাম ধরে না ডাকতো তবে অ্যানা হয়তো হারিয়ে যেত চিরকালের জন্য! ওর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত রেড জোনের ওই জঙ্গলের ভেতর! ওর সমস্ত শরীর কে রেড জোন টেনে নিয়ে নিতো নিজেদের ভেতরে, ও হয়ে উঠতো এই জঙ্গলের এক বাসিন্দা, যে জঙ্গলটা ছাড়া আর কোনো কিছুই চিনে না, কাউকে চিনে না! নিজেকেও না!
অ্যানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ব্রায়ানের ওপর ক্ষোভ জন্মালো ওর। কেন ওকে ডাকলো ব্রায়ান! ওকে না ডাকলে তো ওর কিছুই মনে পড়তো না। মানসিক শান্তি নিয়ে জঙ্গলের ভেতরেই এক অদৃশ্য সত্তা হয়ে ও কাটিয়ে দিতো বাকি জীবনটা! মীর ওকে আর খুজে পেতো না কোথাও, কখনোই! হয়তো কখনো ভুলবসত দেখা হয়ে যেতো ওদের, কিন্তু অ্যানা ওকে চিনতো না একটুও! কোনো অচেনা মুসাফিরের ন্যায় মীরের দিকে এক পলক তাকিয়ে ও চলে যেত ওর গন্তব্যে! হয়তো প্রতি মাসে মীর শুনতো লাইফ ট্রির নিকট থেকে ভেসে আসা ওর কণ্ঠনিঃসৃত মোহনীয় সুর, কিন্তু অ্যানাকে দ্বিতীয়বার আর স্পর্শ করার সুযোগ পেতো না। অ্যানাকে ছুয়ে দেখার এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে বাকিটা জীবন তড়পাতো মীর!
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠলো ও৷ ক্ষিদে পেয়েছে প্রচন্ড। ওয়াশরুমে গিয়ে একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে সোজা চলে গেলো ও কিচেনে৷
কিচেনে তেমন কিছুই নেই, তবুও খুঁজে খুঁজে কিছু পাস্তা আর চিকেন স্যুপের প্যাকেট পেয়ে গেলো অ্যনা। কোনো সবজি নেই এখানে। অগত্যা পাস্তা আর চিকেন স্যুপ টা দিয়েই কোনোরকমে একটা নাস্তা বানিয়ে নিলো অ্যানা৷
কিচেনে চামচের টুংটাং শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেলো শার্লটের। নিজের পাশে অ্যানাকে না পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ও এগোলো কিচেনের দিকে৷ কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে ও মুগ্ধ চোখে দেখতে লেগে গেলো অ্যানা কে৷
অ্যানার পরণে শুধুই একটা পাতলা ফিনফিনা সাদা রঙা ওভার সাইজ শার্ট, শার্ট টা যে অ্যানার নয়, অন্য কারো সেটা সাইজ দেখা মাত্রই বুঝলো শার্লট। কিন্তু শার্ট টির মালিকের দেহ কল্পনা করেই হিচকি উঠে গেলো ওর!
শার্ট টা অ্যানার নিতম্ব ছাড়িয়ে উন্মুক্ত উরুর ওপর এসে পড়েছে। ভেতরে শুধু মাত্র আন্ডারওয়্যার ছাড়া আর কিছুই পরেনি অ্যানা৷ উজ্জ্বল শরীর টা দৃশ্যমান হয়ে আছে। আধভেজা শুভ্র রেশমী চুল গুলো ওর সুডৌল নিতম্বের ওপর সাজিয়ে আছে নিখুত ভাবে। এক হাতে ইলেকট্রিক চুলার ওপরে থাকা কুকওয়্যারে একমনে খুন্তি টা দিয়ে স্যুপ টাকে ধীর গতিতে উলটে পালটে দিচ্ছে অ্যানা। খাবার টা থেকে জিভে জল আনা সুঘ্রাণ আসছে।
দরজায় কারো উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই সেদিকে দৃষ্টি না দিয়েই অ্যানা বলে উঠলো,
— ভেতরে এসে বস৷
শার্লট দরজা থেকে সরে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ব্যাকুল হয়ে কৌতুহলী কন্ঠে শুধালো,
— এতদিন কোথায় ছিলি তুই অ্যানা? কি করেছে ওরা তোর সাথে? তোর চুল গুলোর এমন অবস্থা হয়েছে কিভাবে? আর চোখ! চোখ গুলো এমন কিভাবে হলো? আর তুই রেড জোনে কি করছিলি? রেড জোনে সাধারণ মানুষের ঢোকা নিষিদ্ধ তুই জানতি না? ওখানে ঢুকলে যে কোনো সময় যে কারো জান চলে যেতে পারে! যেসব হিংস্র প্রাণী থাকে ওখানে, তাতে তোকে ছিড়ে খেতে তো ওদের দু মিনিটও লাগতো না! তার ওপর তুই নাকি গাছের ডালের ওপর শুয়ে ছিলি! অত মোটা গাছের ডালের ওপর তুই কিভাবে উঠেছিস? আর কেনই বা উঠেছিস?
শার্লটের একের পর এক প্রশ্নে ভ্রু কুচকালো অ্যানা। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার শার্লটের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— ধৈর্য ধর, সব জানতে পারবি। এখন আমাকে বিরক্ত করিস না, ক্ষিদে পেয়েছে আমার। পারলে তুই দুইটা স্যুপ বৌল আর স্পুন নিয়ে আয়।
শার্লট মনোক্ষুণ্ণ হলো। কতগুলো দিন পর অ্যানাকে কাছে পেয়েছে ও, কোথায় দুটো কথা বলবে, ওর কৌতুহল মিটিয়ে দিবে অ্যানা, তা না করে ওকে বকা দিচ্ছে! ভাল্লাগে না ওর আর কিছু!
মুখ ভার করে কিচেনের ছোট্ট আলমিরা থেকে দুটো বৌল আর স্পুন বের করলো শার্লট, তারপর সেগুলো ধুয়ে এনে রাখলো অ্যানার পাশে।
রান্না শেষে দুইবাটিতে স্যুপ ঢেলে শার্লট কে নিয়ে অ্যানা বসলো খেতে। চামচে করে স্যুপ নিয়ে ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ গোল করে ফু দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট চুমুকে স্যুপ খেতে লাগলো অ্যানা৷ শার্লট এক চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে বলে উঠলো,
— তুই যা-ই রান্না করিস তা-ই এমন মজা হয় কেন রে অ্যানা!
— যাতে আমার রান্না খেয়ে আমার জামাই পাগল হয়ে যায় তাই!
সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাটা বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো অ্যানা। শার্লট ওর বলার ভঙ্গি দেখে ফিক করে হেসে উঠলো, তারপর বলল,
— তোকে দেখলেই আমার পঞ্চদ্বীপের বেগমের কথা মনে পড়ছে রে অ্যানা! শুনেছি তার চুল ও নাকি এমন ধবধবে সাদা, চোখ জোড়া দেখলে নাকি মনে হয় চোখের ভেতরে কেউ হীরা বসিয়ে দিয়েছে দুই টুকরো। রাতে নাকি চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে! তোর চোখও রাতে এমনই জ্বলজ্বল করছিলো। তুই কি চোখে লেন্স লাগিয়েছিস? সত্যি করে বল। আমিও কিনবো এরকম একজোড়া, যার রঙ হবে বেগুনী। রাতের বেলা জ্বলজ্বল করবে, আর আমি ওই চোখ নিয়ে সবাইকে ভয় দেখিয়ে বেড়াবো।
— ঠিক আছে, নেক্সট টাইম কোথাও পেলে তোর জন্য কিনে নিয়ে আসবো, বেগুনী কালার।
খেতে খেতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল অ্যানা। শার্লট খুশিতে নেচে উঠলো। তারপর চোখে মুখে উচ্ছাস ফুটিয়ে বলল,
— কাল তুই ভাইয়ার হাতে খেয়েছিস, মনে আছে তোর?
ব্রায়ানের কথা মনে হতেই লজ্জা পেলো অ্যানা, সেই সাথে বুকের ভেতর জেঁকে বসলো ভয়। কাল রাতে ও ওই পোশাকে ব্রায়ানের সামনে এসেছিলো। ব্রায়ান দেখে ফেলেছে ওকে! এ কথা মীর কোনোভাবে জানলে ব্রায়ানের চোখ জোড়াই না উপড়ে দেয়! এমনিতেই ব্রায়ানের ওপর সেই চুমু কান্ড থেকে ক্ষ্যাপা ও, তার ওপর সময়ে সময়ে শার্লটের তাকে আর ব্রায়ানকে জড়িয়ে বলা বিভিন্ন কথা তো আছেই!
কিন্তু ব্রায়ানের তো কোনো দোষ নেই, অ্যানা তো নিজেই ওভাবে চলে এসেছিলো ওর সামনে, ওর তো তখন হিতাহিত জ্ঞান ছিলো না। এ কথা তো আর মীর বুঝতে চাইবে না! অ্যানার শরীর কেউ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত দেখে ফেলেছে জানলেই তো ওর গায়ে আগুন ধরে যায়! তাকে আর ও পৃথিবীর আলো দেখতে দেয়না! সাইকো একটা!
অ্যানার শরীরে যৌবন আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো দাসীকেও মীর অ্যানার ওয়াশরুমে ঢুকতে দেয়নি গোসলের সময়। হয়তো নিজে গোসল করিয়েছে, নয়তো অ্যানার একা একাই গোসল সারতে হয়েছে! অ্যানার পোশাক পরাতেও কোনো দাসীকে ও সাহায্য করতে দিতো না কখনো, তবুও ভালো যে ইয়াসমিন কে কখনো হিংসা করেনি ও! নইলে তো অ্যানার জীবনটাই ত্যানা ত্যানা হয়ে যেত!
শালার নিজের বেলায় ষোলো আনা!
আর ফিরবে না ও ওই প্রাসাদে! আবার ফিরে যাবে রেড জোনে। নিজেকে বিলিয়ে দেবে ও প্রকৃতির মাঝে। সবাই ভালো থাকুক, ওকে ছাড়া। ও না হয় এই শিরো মিদোরির বুকেই নিজেকে সঁপে দেবে, শিরো মিদোরি তো আর ওকে অবহেলায় দূরে ঠেলবে না! ঠিকই নিজের বুকে আগলে নেবে, এতটাই আগলে নেবে যে ওর সমস্ত দুঃখ কষ্ট, সুখের স্মৃতি সবকিছুই কেড়ে নেবে ওর থেকে, ওকে করে ফেলবে নিজেদের একজন, যার কোনো শিকড় নেই, কোনো কিছুই তাকে কোনো বাধনে আটকে ফেলতে পারবে না আর। না মীর, আর না অন্য কেউ! এই বিষাক্ত জনজীবন থেকে নিজেকে ও নিয়ে চলে যাবে ওই গহীন জঙ্গলের অন্তস্তলে, যেখানে নশ্বর কেউ হাজার সাধনা করলেও খুজে পাবে না ওকে কোনোদিন।
অ্যানাকে নিজের ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে শার্লট ওর চোখের সামনে তুড়ি বাজালো। অ্যানা চমকে তাকাতেই বলে উঠলো,
— তোর স্যুপ গ্রিন ল্যান্ডের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে দ্যাখ! আমার ভাইকে নিয়ে ভাবার অনেক সময় পাবি, এখন খেয়ে নে৷ ভাবনা চিন্তা পরে করিস৷
— আমাকে যেতে হবে শার্লট।
নিজের ব্যাকপ্যাকে কিছু পোশাক, শুকনো খাবার আর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো অ্যানা৷ শার্লট বসে বসে কুর কুর করে বিস্কিট খাচ্ছিলো। অ্যানা চলে যাবে শুনতেই তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলো ও। তারপর ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাবি তুই?
— রেড জোনে।
— রেড জোনে কেন যাবি তুই? ওখানের জন্তু জানোয়ার তো তোকে ছিড়ে খেয়ে ফেলবে? ঘেউলের কথা কি তোর মনে নেই? ওরা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা কি তুই জানিস না? কি কাজ তোর ওখানে?
আকুল কন্ঠে পরপর এতগুলো প্রশ্ন করলো শার্লট। অ্যানা নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিলো,
— রেড জোনই আমার স্থায়ী ঠিকানা। এছাড়া আমার আর কোনো আশ্রয় নেই। আর কোথাও আমি নিরাপদ নই। সবখানে আমাকে যন্ত্রণা দিতে প্রস্তুত সকলে।
— কি সব আবোল তাবোল বকছিস! মাথা খারাপ হয়েছে তোর অ্যানা? দাড়া আমি ভাইয়াকে ডাকছি।
বলেই অ্যানার উত্তরের অপেক্ষা না করে ছুটলো ও বাইরে। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অ্যানা ফোস করে দম ছাড়লো একটা। তারপর ব্যাগের চেইন আটকে নিয়ে কামরার দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ব্যাগ টা কাধে ঝুলিয়ে৷
শুভ্র রঙা চুল গুলো মাথার ওপর শক্ত করে খোপা করে রাখা। পরণে কালো রঙা একটা প্যান্ট, আর একটা অফ হোয়াইটের লেট্যুস ট্রিমের ফুল স্লিভ টপ। সরু পেট টা কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত হয়ে আছে তাতে।
ওয়ার্কিং জোন জেগে উঠেছে অনেক আগেই। সবার কন্ঠস্বর শীনা যাচ্ছে বাইরে থেকে। খলবলিয়ে কথা বলছে সকলে! সবার চোখ এড়িয়ে কিভাবে রেড জোনে আবার ফিরে যাবে সেই চিন্তা করতে করতে মাঞ্জার থেকে নামলো অ্যানা। বের হয়ে সামনে এগোতেই শার্লটের সাথে ব্রায়ান কে হন্তদন্ত হয়ে ওর দিকেই এগোতে দেখলো অ্যানা৷ ব্রায়ান হাঁফাতে হাঁফাতে এসে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েই ভ্রু জোড়া আকুলতার সাথে ওপরে তুলে বলে উঠলো,
— তুমি কোথায় যাচ্ছো অ্যানা! আবার কেন হারিয়ে যেতে চাচ্ছো? এখানেই থাকো না প্লিজ! আমাদের সাথে, আমার সাথে!
— আমাকে যেতে হবে ব্রায়ান। নইলে আমিতো বিপদে পড়বোই, সাথে বিপদে পড়বে তুমিও৷ সরে যাও আমার সামনে থেকে। যেতে দাও আমাকে।
অভিব্যাক্তিহীন চোখে চেয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো অ্যানা। তারপরেই ব্রায়ান কে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো সামনের দিকে। কিন্তু ব্রায়ান খপ করে ধরে ফেললো ওর হাত খানা। অ্যানা চমকালো, ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকালো চারদিকে! ওর শরীরে এখন ট্র্যাকার নেই, তবুও বুকটা প্রচন্ড ভয়ে দুরু দুরু করে উঠলো ওর। ব্রায়ান ছেলেটা ভালো অনেক। বাচ্চা একটা ছেলে, ওকে প্রচন্ড ভালোবাসে! এমন দারুণ একটা ছেলে এত অল্প বয়সে নিজের প্রাণ হারাক তা কোনোভাবেই চায়না অ্যানা৷
দ্রুত গতিতে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ব্রায়ানের দিকে এগিয়ে এসে ও শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— আমাকে দ্বিতীয়বার স্পর্শ করার সাহস করবে না ব্রায়ান! পুরুষের ছোয়া আমি ঘেন্না করি।
ব্রায়ান ওর দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্যাকুল হয়ে বলে উঠলো,
— তুমি প্লিজ থেকে যাও অ্যানা, আমি ভালোবাসি তোমাকে! অনেক অনেক ভালোবাসি! থেকে যাও তুমি আমার জীবনে অ্যানা! বিশ্বাস করো তোমাকে রানীর মতো করে রাখবো আমি! আমার বিরুদ্ধে কখনো সামান্য কোনো অভিযোগ করার সুযোগটাও দিবো না তোমাকে! আমার শাস্তি শেষ হয়ে যাবে খুব দ্রুতই, তারপরেই শার্লট আর তোমাকে নিয়ে কুরো আহমারে ফিরে যাবো আমি! আমার ম্যেডিক্যালের কোর্স আর অল্প একটু বাকি আছে, সেটা শেষ হলেই আমার ব্রাইট ফিউচার হবে অ্যানা! তোমার কোনো অযত্ন হবে না অ্যানা! থেকে যাও প্লিজ!
— আমি বিবাহিতা ব্রায়ান। আমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখোনা৷ আমাকে যেতে হবে। এখানে আর একটা মুহুর্ত থাকা মানেই আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে ওই বিষাক্ত জায়গাতে! যা আমি কোনোদিনও মেনে নিতে পারবো না। ভালো থাকো তোমরা।
বলেই ব্রায়ান আর শার্লট কে একঝাক কৌতুহলের ভেতর ডুবিয়ে দিয়ে অ্যানা দ্রুত গতিতে উল্টো দিকে হাটা ধরলো, এখানে আসা টাই ওর ভুল হয়েছে। এতক্ষণে হয়তো কোনো না কোনো ভাবে মীর টের পেয়ে গেছে ওর উপস্থিতি! ঘুম থেকে উঠেই ওর চলে যাওয়া উচিত ছিলো এখান থেকে, কাউকে কিছু না জানিয়ে!
বলদের মতো কাজ করে ফেলেছে ও! ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রকট ভাবে জানান দিচ্ছে খুব নিকটেই মীরের উপস্থিতির কথা। কোনোভাবেই মীরের সামনে পড়বে না ও!
মীরের সাথে পেরে উঠবে না ও, মীর ওকে কোনোভাবেই ছাড়তে চাইবে না, কোনোভাবেই না!
এতদিনে হয়তো সেই মেয়েকে ও বিয়েও করে ফেলেছে! যে হাতে মীর ওই মেয়েকে ছুয়েছে, আষ্টেপৃষ্টে, সেই হাতে ওকে স্পর্শ করলে ও সহ্য করতে পারবে না কোনোভাবেই! একদমই না! মীর ওকে স্পর্শ করার আগেই যেন ওর মৃত্যু হয়! কোনো ভাবেই যেন জীবিত অবস্থায় মীর ওকে স্পর্শ করতে৷ আ পারে!
কিন্তু অ্যানা কয়েক পা এগোনোর পরেই মিটিং জোনের প্রবেশ দ্বারা থাকা রয়্যাল মেম্বার ইন্ডিকেটরের বিশাল স্পিকারে একটি আর্টিফিশিয়াল ফিমেইল ভয়েস বলে উঠলো,
— অ্যালার্ট! অ্যালার্ট! প্রিপেয়ার ইয়োরসেলভস! দ্যা মাইটি কিং নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান ইজ অন হিজ ওয়্যে!
আর্টিফিশিয়াল ভয়েসটি শোনা মাত্রই বুকের ভেতর ধক করে উঠলো অ্যানার। সেই সাথে মাথায় চাপলো ভয়ঙ্কর জেদ। কোনোভাবেই মীরের সামনে আসবে না ও। একফোটাও না! কি পেয়েছে কি ওকে? ওর যখন যা ইচ্ছা হবে তাই করবে আর অ্যানার অনুভূতির সামান্য তোয়াক্কা পর্যন্ত করবে না! বিয়ে তো করেই ফেলেছে ওই মেয়েকে, রাতও কাটিয়ে ফেলেছে কত গুলো, তাহলে এখন আবার কিসের নাটক! কি প্রয়োজন ওর অ্যানাকে? সেটাও তো প্রয়োজন স্বার্থেরই জন্য! অ্যানাকে না দেখলে তো আবার তার ঘুম আসে না, এটাও তো স্বার্থ! এটাও তো নিজের কথাই ভেবে! অ্যানার যে কষ্ট হচ্ছে সেটা ভেবে তো নয়!
এদিকে বাদশাহর ওয়ার্কিং জোনে আসার খবরটা শোনা মাত্রই সমস্ত ওয়ার্কার্স আর আউটসাইডার্স দের ভেতরে হুড়োহুড়ি লেগে গেলো। যে যার কাজ ফেলে চলে তড়িঘড়ি করে চলে এলো মিটিং জোনে, আসার পথে অ্যানাকে দেখলো অনেকে, কিন্তু বাদশাহর উপস্থিতিতে অ্যানার দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় পেলো না তারা। মিটিং জোনে এসে সকলে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে পড়লো সাথে সাথেই; চোখে মুখে তাদের ভয় আর উৎকন্ঠা! হঠাৎ বাদশাহ তাদের ওয়ার্কিং জোনে কেন আসছেন সেটাই ভেবে পেলো না ওরা কেউ।
শার্লট আর ব্রায়ান পড়লো বিপদে, একদিকে অ্যানা চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাদশাহ এসে উপস্থিত হয়েছেন, কোনদিকে ওরা যাবে ভেবে পেলো না, দোনোমনা করতে শুরু করলো। আর অ্যানা ওদের কে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে দেখে দ্রুত গতিতে ছুট লাগালো মাঞ্জারের পেছন সাইডের দিকে।
আর ওকে ছুটে চলে যেতে দেখেই ব্রায়ান তড়িঘড়ি করে শার্লট কে মিটিং জোনের দিকে যেতে বলে নিজেও ছুটলো অ্যানার পেছন।
কিন্তু অ্যানা ছুটে বেশিদূর যেতে পারলো না। তার আগেই ওর পথ আগলে দাঁড়িয়ে গেলো কোকো, ফ্যালকন আলফাদ আর জোভি। সকলের চোখে মুখে উৎকন্ঠা, অ্যানাকে আটকে রাখার সাধ্য ওদের কারো নেই, তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!
অ্যানা তড়িৎ গতিতে ওদের সবাইকে এক পলক দেখে নিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠলো,
— ভালোয় ভালোয় আমার পথ ছেড়ে দে, আমি তোদের কাউকে আঘাত করতে চাইনা৷
অ্যানার কথার ভেতরেই ওর পেছনে এসে পৌছালো ব্রায়ান। সেইফ জোনের ভেতরে হঠাৎ করে এই অচেনা চারজন পুরুষ কে দেখে থমকালো ও! অ্যানাকে ওদের সাথে কথা বলতে দেখে বোঝার চেষ্টা করলো অ্যানার সাথে ওদের কি সম্পর্ক। ওরা কি তাদের লোকজন, যারা অ্যানাকে সেদিন নিয়ে চলে গিয়েছিলো?
ব্রায়ানের বুকের ভেতর ধক করে উঠলো, ছুটে অ্যানার সামনে এসে অ্যানাকে আগলে নেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেলো ও। তারপর ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোকো ফ্যালকন দের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন করলো,
— কারা তোমরা? অ্যানার কাছে কি চাও?
কোকো ব্রায়ানের কথার কোনো তোয়াক্কা না করে ধীর, সতর্ক পায়ে অ্যানার দিকে এগোতে এগোতে ওকে মানানোর ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
— আম্মা! আপনার কাছে হাত জোড় করছি! আপনি আর জঙ্গলে পালিয়ে যাবেন না! প্রাসাদে ফিরে চলুন আম্মা! আপনাদের ভেতরকার ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুন না আম্মা! এরকম করবেন না আম্মা, আর অভিমান করে থাকবেন না প্লিজ!
— কোকো, আমার দিকে এগোবিনা, আমাকে যেতে দে! বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমি সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে যাবো! তোদের কে আঘাত করতে চাই না আমি! সরে যা আমার সামনে থেকে!
চোয়াল শক্ত করে, ভ্রু জোড়াতে প্রচন্ড ক্রোধ তুলে হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো অ্যানা। ব্রায়ান অ্যানার কন্ঠস্বর শুনে ভড়কালো। সেই সাথে এদের কথোপকথন শুনে দ্বিধায় পড়লো গেলো।
বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে একবার অ্যানা আর একবার কোকোর দিকে তাকালো ও। অ্যানাকে ওই হাতির মতো ছেলেটা আম্মা কেন ডাকছে সেটাই মাথায় এলো না ওর৷ এরা কি তবে একে অপরকে খুব ভালোভাবেই চেনে!
আর যদি চিনেই থাকে তবে এদের ভেতরকার ঝামেলাটা আসলে কি!
কোকো অ্যানার হুঙ্কারে টলল না, ধীর গতিতে আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে আবার বলল,
— হিজ ম্যাজেস্টি ভালো নেই আম্মা! আপনি ফিরে চলুন, সব ঠিক হয়ে যাবে আম্মা! আপনি অভিমান করে থাকবেন না আমাদের ওপর! ফিরে চলুন!
অ্যানা বুঝলো এভাবে কাজ হবে না। মাঞ্জারের পেছন দিক থেকে বের হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ও এবার ছুটলো যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে৷ ওদিক দিয়ে সেইফ জোন পার হতে ওর দেরি হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় নেই৷
ওকে বিপরীত দিকে ছুটে যেতে দেখে কোকো ফ্যালকনেরাও ওকে ডাকতে ডাকতে ছুটলো ওর পেছন পেছন। ব্রায়ান নিজেও অ্যানাকে ডেকে ফেরানোর চেষ্টা করতে করতে ছুটলো ওদের পেছনে৷
কিন্তু অ্যানা ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে! কোনোভাবেই মীরের হাতে ধরা দেবে না ও! ওই প্রাসাদে ও দ্বিতীয়বার আর ফিরবে না। ওটা এখন ওর কাছে জাহান্নামের চাইতেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। যে প্রাসাদে মীরের ওই দ্বিতীয় স্ত্রীর স্পর্শ আছে সেখানে ও কোনোভাবেই ফিরে যাবে না। যে শরীর, যে বিছানা ওই মেয়ে সুস্পষ্ট অধিকার নিয়ে স্পর্শ করেছে সেখানে ও আর কখনোই ফিরবে না!
ওই মানুষ টা আর ওর নেই! ও চায়ও না আর! একবার রেড জোনে পৌছাতে পারলেই আর কেউ খুজে পাবে না ওকে! ধোঁয়াসার ন্যায় বাতাসে মিলিয়ে যাবে ও! কারো সাধ্য হবে না ওকে খুঁজে পাওয়ার!
কিন্তু আরও কিছুদূর যেতেই ওর সামনে ও দেখতে পেলো লিও, কাঞ্জি, হাইনা আর ওকামি কে! লিও ওকে দেখামাত্রই এগিয়ে এসে ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠলো,
— শেহজাদী! আপনি যাবেন না প্লিজ! আমাদের দিকে তাকান একবার! একবার আপনার এই সন্তান গুলোর দিকে তাকান, হিজ ম্যাজেস্টির কথা ভাবুন একবার! উনি ভালো নেই শেহজাদী! আপনিও ভালো নেই হিজ ম্যাজেস্টি কে ছাড়া! ফিরে চলুন শেহজাদী! আর যদি যেতেই হয় আমাদের বুকের ওপর দিয়ে যান শেহজাদী! দয়া করুন আমাদের ওপর!
অ্যানা বুঝলো এরা সকলে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে এখানে! ওকে কোনোভাবেই বের হতে দেবে না এখান থেকে! নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হলো ওর! কেন ও সকালে উঠেই চলে গেলো না! দাঁতে দাঁত পিষে ও তাকালো লিওর দিকে একবার। এখন এদের সাথে পেচাল করার মতো সময় ওর নেই৷ অ্যানা তড়িৎ গতিতে একবার তাকালো ওর বা দিকে থাকা মিটিং জোনে যাওয়ার রাস্তার দিকে৷ মীর আসলে ওদিক থেকেই আসবে৷ কিন্তু মীর এখনো এসে পৌছায়নি!
একবার ভাবলো ছুটে বেরিয়ে যাবে মিটিং জোন দিয়ে, একবার বের হতে পারলেই আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া পার হয়ে সমুদ্রের দিকে যেতে পারলেই রেড জোনে ঢুকে পড়বে ও।
কিন্তু হঠাৎ করে মীর এসে পড়লে কোন দিকে যাবে ও!
দিশেহারা হয়ে নিজের চারপাশে দেখতে লেগে গেলো অ্যানা৷ অসহায় লাগলো ওর প্রচন্ড। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইলো ওর! নিজের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন মানুষ টার থেকে ও আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছে! যার শরীরের পুরুষালি ঘ্রাণ না পেলে ওর ঘুম আসতো না আজ তার থেকেই ও পালিয়ে বেড়াচ্ছে চিরতরে ঘুমিয়ে যাবার আশায়! যার ইস্পাত-দৃঢ় হাতের স্পর্শ শরীরে না পড়লে ও শান্তি পেতো না, আজ তার স্পর্শ থেকে বাচতেই ও ঝড়ের কবলে পড়া চড়ুই পাখিটির ন্যায় আশ্রয় খুজে বেড়াচ্ছে! যেন সামান্য গর্ত পেলেই সেখানে ঢুকে পড়বে! সেখানে বিষাক্ত সাপের উপস্থিতিতেও তার আর কিছু যাবে আসবে না!
বাচ্চাগুলোকে ও নিজের হাতে করে, আদরে আদরে মানুষ করেছে! এদের শরীরে একটা ফুলের টোকা পড়লেও ওর বুকে লাগে সেটা! এদের যে আঘাত করে ও কিভাবে যাবে! এত মায়া কেন সবখানে? সবকিছু ওকে বেধে ফেলে, ও কেন কাউকে বাধতে পারে না! কেন ওর আপন মানুষ গুলোর প্রতি ওর এত দুর্বলতা! ওর জন্য কারো দুর্বলতা তো ওর চোখে পড়ে না! এ কেমন অবিচার!
এইভাবে ও আর পারবে না, মুক্তি চায় ও সবকিছু থেকে। আজ যা হয়ে যায় যাবে, তবুও ও মীরের কাছে ধরা দিবে না একটা মুহুর্তের জন্যেও! কেউ ওকে রেড জোনে হারিয়ে যাওয়া থেকে আটকাতে পারবে না। আর যদি কোনো বাড়াবাড়ি হয়েই যায়, তবে যে সিদ্ধান্তটা মীরের সাথে প্রতিবার হওয়া পাহাড়সমান মনোমালিন্যের সময় নিতো, সেই সিদ্ধান্তটাই আজ বাস্তবে পরিণত করবে অ্যানা।
কোনোদিকে যাবে ভেবে না পেয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে অ্যানা আবার ছুটে যেতে নিলো মাঞ্জারের পেছন দিকের উদ্দ্যেশ্যে। কিন্তু তার আগেই আকাশ কাপানো বজ্রের গতিতে মিটিং জোনে এসে পৌছালো একটি বুক খোলা রোব পরিহিত মীর। আর পৌছেই ওর দৃঢ়, পুরুষালি কন্ঠে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো,
— শিনজো!
মীরের সে মুখনিঃসৃত শব্দে কেঁপে উঠলো সেখানে উপস্থিত সকলের বুক। জীবনে প্রথমবার পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ কে নিজেদের এত নিকটে পেয়ে থমকে গেলো ওরা, মাথা নত করে রেখেও শূন্য মস্তিষ্কের মানবশ্রেনীর ন্যায় তাদের সামনে উপস্থিত এই দীর্ঘকায় ব্যাক্তিটাকে দেখতে লেগে গেলো ওরা৷
এই পেশিবহুল, বলিষ্ঠ পরুষালি শরীরের অধিকারী ব্যাক্তিটার সমস্ত মুখখানা জুড়ে তীক্ষ্ণ অভিজাত্যের ছাপ; স্বর্ণালি দ্যুতি ছড়ানো চোখ জোড়ার গভীরে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, যেন পুরো পৃথিবী তার করায়ত্তে। উঁচু, প্রশস্ত ললাট আর মসৃণ ত্বকের ওপর সকালের সূর্যের আলো ঝরে পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে যেন। গালে কিঞ্চিৎ দাড়ির ছোঁয়া তার চেহারায় জুড়ে দিয়েছে আরও বেশি গাম্ভীর্যতা।
ধীর পায়ে অ্যানার দিকে যাওয়ার জন্য এগোলো মীর, ওর প্রতিটা পদক্ষেপে যেন কেঁপে উঠলো মাটি। এক জীবন্ত কিংবদন্তির ন্যায় ভারী কদমে পা ফেলে সামনে এগোতে থাকলো ও।
ওয়ার্কিং জোনে নেমে এলো পিনপতন নিরবতা! আনুগত্যে নুইয়ে পড়লো সকলে; যেন সিংহ আজ তার গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে অরণ্যের মাঝখানে রাজত্ব করতে।
এক মুহুর্তের জন্য মীর তাকালো ওর ডান দিকে দাড়িয়ে থাকা ওয়ার্কার্স দের দিকে। আড়চোখে তারা এতক্ষণ দেখছিলো এই দীর্ঘদেহী সুপুরুষ টিকে। মীরের চোখে চোখ পড়তেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো যেন তাদের!
ওই চোখ জোড়া জুড়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যেখানে শুধু শাসন করার স্পর্ধাই নয়, আছে অদম্য সাহসের আগুন। সেখানে যেন লুকিয়ে আছে শত যুদ্ধের প্রতিফলন; ওই গভীর এবং গাঢ় দৃষ্টির সামনে যেন কেউ কিছুই লুকোতে পারবে না।
ওই শক্ত চোয়ালদ্বয় যেন তার বিশাল ক্ষমতা আর দৃঢ়তার প্রতীক। মুখের তীক্ষ্ণ রেখা গুলোয় যেন খোদাই হয়ে আছে শক্তির সিলমোহর, যেন দিবালোককে ছাপিয়ে অন্ধকারের সাথেও রয়েছে তার এক অলিখিত বন্ধন।
তার প্রশস্ত, লোমশ বুক যেন প্রতিশ্রুতি দেয় তার ক্ষমতা আর সৌন্দর্যের সামনে সবকিছু নত হতে বাধ্য!
মিটিং জোন আর মাঞ্জারের প্রবেশমুখ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যানার সমস্ত শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো যেন। মীরের থেকে পালানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো ও। চারদিক থেকে ওকে আটকে ফেলেছে সবাই! একদিকে কোকো ফ্যালকনেরা দাঁড়িয়ে আছে, অন্য দিকে আছে লিও, কাঞ্জিরা। এদিকে আছে ব্রায়ান আর ওদিকে মীর! ওর সামনে আর পথ খোলা নেই! সব পথ বন্ধ। তবুও ও আর থাকবে না এখানে, চলে যাবেই! তাই যা হয় হবে৷
মীর কোনোদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে দ্রুত পায়ে। ওর চোখে মুখে ভয়ানক বিষণ্ণতা আর সেই সাথে অ্যানাকে ফিরে পাওয়ার উচ্ছাস; যেন সর্বহারা কোনো ব্যাক্তি বহু সাধনার পর খুঁজে পেয়েছে তার সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ খানি!
মীর কে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অ্যানা দাঁড়িয়ে গেলো সেখানেই, আর তারপর মীরের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে, বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠে বলল,
— যেখানে আছো সেখানেই থাকো! আমার দিকে আর এক পাও যদি আগাও তবে আমি নিজেকে আজ এখানেই শেষ করে দেবো!
কথাটা বলেই নিজের শরীরে থাকা অদৃশ্য আর্মরটার পিঠের নিকট থেকে ও বের করলো একটা ধারালো খঞ্জর। এরপর মীরের দিকে দৃষ্টি রেখেই সেটাকে ডান হাতে ধরে তার ধারালো অংশ চেপে ধরলো নিজের বা হাতের কব্জিতে থাকা শিরার ওপর৷ মীর কাছে এলেই আজ আর দ্বিতীয় বার ভাববে না অ্যানা, সবকিছু শেষ করে দেবে! এই শিরো মিদোরি নামক জাহান্নামে ও আর থাকবে না!
মীর থমকালো! দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথেই! ওর আর অ্যানার মাঝে এখন কয়েক মিটারের দুরত্ব!
অ্যনার চোখ জোড়ার দিকে দৃষ্টি দিলো মীর। ওর শিনুর চোখ জুড়ে ওর প্রতি চরম বিতৃষ্ণা, আর সেই সাথে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা!
অ্যানার চোখের ভাষা বোঝামাত্রই মীরের বুকের ভেতরটা জমে গেলো যেন! চোখে মুখে দেখা দিলো স্পষ্ট ভীতি! অ্যানাকে হারানোর ভয় জেঁকে ধরলো ওকে। আঁতকে উঠে ও তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
— এরকম কোরো না শিনু! একটিবার আমার কথাটা শোনো! একটু শান্ত হয়ে যাও প্রাণ আমার! খঞ্জর টা হাত থেকে ফেলে দাও প্লিজ! ওইটা ধারালো অনেক, তোমার আঘাত লেগে যাবে! কথা শোনো আমার!
কিন্তু অ্যানা শুনলো না। আগের থেকেও বেশি জোরে চেপে ধরলো খঞ্জরটা। ওর শুভ্র চামড়ায় লাগলো খঞ্জরের ধারালো অংশের আচড়, রক্তিম সরু সরলরেখা দেখা দিলো সেখানে।
এ দৃশ্য দেখে মীরের দম আটকে যেতে নিলো যেন! অ্যানার লাল হয়ে ওঠা কব্জির দিকে তাকিয়ে হাঁসফাঁস করতে শুরু করলো ও!
অ্যানা এর আগে কখনোই এমন করেনি, তাই সে যত বড় কলহই ওদের ভেতর হোক না কেন! প্রতিবারই মীর ওকে ওর অভিমান ভাঙিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে ওর কাছে, কখনোই জমে থাকতে দেয়নি অ্যানার অভিমান!
কিন্তু আজ যদি ওর শিনু ওর ওপর অভিমান করে ভুলেও এরকম কিছু করে ফেলে তবে ও নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না! শিনু কে মানাতে হবে, যেভাবেই হোক মানাতে হবে! ওর শিনু না থাকলে ওর সমস্ত পৃথিবীটাই যে অন্ধকার হয়ে যাবে!
মীর সাহস হারালো না। চেহারার দৃঢ়তা ধরে রেখে খুবই মৃদু গতিতে, অ্যানাকে বুঝতে না দিয়ে, অ্যানার দিকে এগোতে এগোতে ও আকুল কন্ঠে বলে উঠলো,
— শিনু, প্রাণ আমার! আমার কথা শোনো শিনু! আমি জানি আমি ভুল করেছি, তোমার সাথে আমি অবিচার করেছি, আর তাতে আমি ভীষণ অনুতপ্ত! কিন্তু আমার ভালোবাসা তো মিথ্যা নয় শিনু!
তোমাকে আমি ভীষণ রকম ভালোবাসি শিনু! তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ, একেবারেই অসম্পূর্ণ! তোমার হাসি, তোমার স্পর্শ, সবকিছু আমার হৃদয়ের গভীরে প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হয়! আমার প্রতিটি শ্বাসে আমি তোমাকে অনুভব করি! আমি প্রতিটাদিন, প্রতিটা মুহুর্তে আমার মস্তিষ্কের ভেতর তোমার নাম উচ্চারণ করে বুঝি, তুমি ছাড়া আমার সব কিছুই অর্থহীন। তোমার ভালোবাসা ছাড়া আমি নিঃশেষ, তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই না।
আমার হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা শুধুমাত্র তোমার জন্য। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি।
তোমার এই নিদারুণ অভিমান আমার হৃদয়ে অবিরাম বিষাক্ত ঢেউ আনে শিনু, ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় আমার অন্তরকে! তুমি যে আমার সূর্য, তোমার আলো ছাড়া যে আমি নিকষ অন্ধকারে হারিয়ে গেছি শিনু! তোমার চলে যাওয়া যে আমার হৃদয়ের সমস্ত রঙ কেড়ে নিয়েছে। তোমাকে ছাড়া যে আমি একদম একা শিনু!
ফিরে এসো শিনু আমার কাছে! এখন, এই মুহুর্তে আমি তোমার কাছে আমার ভগ্ন হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি! অনুরোধ করছি তোমাকে, দয়া করে আবার আমার কাছে ফিরে এসো
আমি জানি তুমি এখন কঠোর হয়ে আছো! কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি দুয়া করি আমার এই প্রার্থনা যেন তোমার ওই কঠিন হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়, যেন তুমি বুঝতে পারো তোমাকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়!
তুমি যদি আমাকে আজ ফিরিয়ে দাও, অভিমানভরে আমার থেকে দূরে চলে যাও তবে আমি আমার সমস্ত সুখ হারিয়ে ফেলবো শিনু। তোমার চলে যাওয়া হবে আমার আত্মার শেষ নিঃশ্বাস।
তুমি আবার ফিরে এসো শিনু আমার কাছে! যেন তোমার কাঁধে মাথা রেখে বাকি জীবনটা আমি বুক ভরা শান্তি নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি! তোমার হাসি, কান্না, রাগ অভিমান, ভালোবাসা, তোমার সবকিছুকে প্রতিটা মুহূর্তে আমি অনুভব করতে চাই শিনু! ফিরে এসো আমার কাছে! প্লিজ!”
আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা, সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি! অ্যানা ছলছল চোখে এতক্ষণ মীরের বলা কথা গুলো শুনছিলো মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়। মীর যে কথা বলতে বলতে কখন ওর কাছে এসে পৌছেছে সেটা ও ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি। আর যখন টের পেলো ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷
অ্যানা মীরের আয়ত্তের ভেতর থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে নিতেই মীর ক্ষীপ্র গতিতে ধরে ফেললো ওকে। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে অ্যানার হাত থেকে খঞ্জর টা ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে দিলো কোথাও, আর এরপর নিজের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিতে চাইলো অ্যানাকে!
কিন্তু অ্যানা সেটা হতে দিলো না। নিজের শরীর টাকে মীরের শক্ত আলিঙ্গন থেকে, মীরের ইস্পাত-দৃঢ় হাতের স্পর্শ থেকে ব্যাকুল হয়ে ছাড়িয়ে নিতে নিতে আর্তনাদ করে বলে উঠলো,
— ছুইয়ো না আমাকে! একদম ছুইয়ো না! যে হাত দিয়ে তুমি ওই মেয়ের শরীরে স্পর্শ করেছো সেই হাত দিয়ে তুমি আমাকে ছোবে না! কোনোদিনও ছোবে না! ঘেন্না করি আমি তোমার স্পর্শ, ঘেন্না করি তোমাকে! ছেড়ে দাও আমাকে!
মীর ছাড়লো না! সর্বশক্তি দিয়ে অ্যানাকে নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে রেখে অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,
— আমার কথা শোনো! ওকে আমি বিয়ে করিনি শিনু! স্পর্শ করিনি আমি ওকে! বিশ্বাস করো আমাকে! এরকম কোরো না! শান্ত হও প্রাণ আমার! আমি শুধুমাত্র তোমার, আর অন্য কারো না!
কিন্তু অ্যানা শান্ত হলো না! মীরের কোনো কথাই কানে গেলো না ওর! ওর মস্তিষ্ক শুনতে দিলো না ওকে কিছু, ওর মীর অন্য কোনো নারীকে ওর মতোই অধিকার দিয়েছে, ওর মতোই আদর দিয়েছে, ওর মতোই স্পর্শ দিয়েছে, এ খবরটাই ওর মস্তিষ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে ওর প্রতিটা নিউরনে, ওর শরীরে ছুটে চলা প্রতিটা রক্তকণিকায়! মীরের কোনো কথা ঠাই পেলো না সেথায়!
আর এরপর হঠাৎ করেই মীর কে অবাক করে দিয়ে প্রচন্ড শক্তি দিয়ে মীরের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে মীরের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিলো অ্যানা! আর তারপর দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটতে শুরু করলো রেড জোনের দিকে!
কোকো ফ্যালকন সহ সমস্ত বাচ্চা গুলো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে ওকে আটকানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ওদের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে ওদের কে আঘাত করেই ওদের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো অ্যানা৷ অ্যানার আঘাতে ছিটকে পড়লো ওরা চারদিকে!
অ্যানার ছুটে চলে যেতেই মীর এক মুহুর্তও দেরি না করে ছুটলো ওর পেছন পেছন! বার বার ওকে ডেকে থেমে যেতে বললো মীর, কিন্তু মীরের কোনো কথাই কানে গেলো না ওর!
বাচ্চারা মাটি থেকে কোনোরকমে উঠে ছুটলো মীরের পেছন পেছন! শেহজাদীকে এবার হারিয়ে ফেললে যে আর কখনো পাবে না!
অ্যানা ছুটছে, ছুটছে! কোথায় ওর পা পড়ছে সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করছে না! দম ধরে ছুটে চলেছে! গন্তব্য ওর নির্ধারিত, লাইফ ট্রি!
দেমিয়ান শেহজাদীরা লাইফ ট্রির সাথে কানেক্টেড! কোনো শেহজাদী যদি একবার লাইফ ট্রির ভেতর ঢুকে পড়ে তবে লাইফ ট্রি চিরকালের জন্য তাকে নিয়ে নিবে নিজের ভেতরে! নিজের অর্ধজীবিত, অর্ধমৃত, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ শরীরের সাথে শেহজাদীর শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মিশিয়ে নিয়ে তৈরি করবে নিজের নতুন শক্তি! শিরো মিদোরি তখন হয়ে উঠবে আরও প্রাণবন্ত, আরও আকর্ষণীয়! প্রকৃতি হয়ে উঠবে আরও সতেজ! এক শেহজাদী আছে যে এ প্রকৃতিতে মিশে!
অ্যানাও মিশে যাবে এ প্রকৃতির সাথে! ওর জন্মই তো হয়েছে শিরো মিদোরির প্রকৃতির জন্য, শিরো মিদোরির খেয়াল রাখার জন্য! মীরও তো ওকে শুধুমাত্র চায় নিজের জন্য, নিজের শান্তির জন্য! ওর শান্তির কথাটা তো ভাবার প্রয়োজনই মনে করেনা!
সবাইকে এবার শান্তি দিবে ও! চারদিক টা প্রশান্তিতে ছেয়ে দেবে! নিজের সব সৌন্দর্য বিলিয়ে দিবে এই প্রকৃতিতে, নিঃশেষ করে দিবে নিজের অস্তিত্ব! কারো কোনো কিছুতে আর হস্তক্ষেপ করবে না ও! অনধিকার চর্চা করবে না, থাকুক সবাই তাদের মতো করে, যেভাবে ইচ্ছা! ও না হয় দূর থেকে অনুভব করবে সবকিছুকে!
এই শিরো মিদোরি, ওর মীর, ওর কোকো, ওর ফ্যালকন, ওর লিন্ডা, ওর সমস্ত বাচ্চাগুলো, শার্লট, ব্রায়ান, ফাতমা, ইয়াসমিন সবাইকে দূর থেকেই না হয় অনুভব করবে ও! সবার সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না কে ও দূর থেকেই পরখ করে দেখবে!
তাতেই হবে, ওর দুঃখ গুলো কেউ না দেখুক সব সময়ের মতো! সুপ্ত থাকুক সেগুলো ওই প্রকৃতির ভেতরে। মীরের সন্তান গুলো নির্ভয়ে বড় হোক এই প্রকৃতিতে, এগিয়ে নিয়ে যাক এই সাম্রাজ্য কে অনেক অনেক দূরে! ও না হয় কোনো ছুতোয় নিজের পরিবর্তিত শরীরের স্পর্শ দিয়েই ছুয়ে দেখবে ওদের! ওরা ওর গর্ভের না হোক, মীরের ঔরসজাত সন্তান হবে তো! মীরের ছায়া থাকবে তো ওদের শরীর জুড়ে! তাতেই হবে! তাতেই খু্শি থাকবে ও!
এক ছুটে এসে লাইফ ট্রির সামনে এসে থমকে দাড়ালো অ্যানা। তারপর লাইফ ট্রির দিকে অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
— ওপেন ইয়্যোর ড্যোর! টেইক ম্যি ইনসাইড ইয়্যু। এমব্রেইস মি!
মীর অ্যানার কিছুটা পেছনেই ছিলো, অ্যানার কথা গুলো কানে যেতেই চমকালো ও!
না না না! এটা কখনো হতে পারে না! ওর শিনু ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারে না কোথাও, কোনোভাবেই না! এটা ও কোনোভাবেই হতে দেবে না! ও শেষ হয়ে যাবে!
অ্যানার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে ছুটে আসতে আসতে ও ডুকরে কেঁদে উঠে আর্তনাদ করে বলল,
— শিনু! যেও না প্রাণ আমার! যেওনা ওখানে! আমাকে একা করে রেখে যেও না কলিজা আমার!
কিন্তু ওর কথার ভেতরেই অদ্ভুত শব্দ করে খুলে গেলো লাইফ ট্রির বুকটা, ভেতর থেকে টিকরে পড়লো ধোয়া যুক্ত অদ্ভুত আলো! অ্যানা মীরের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফিরে তাকালো লাইফ ট্রির দিকে, তারপর এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো লাইফ ট্রির খোলা দরজার দিকে! ওকে এগিয়ে আসতে দেখে লাইফ ট্রির বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো লতাপাতা যুক্ত সিড়ি, যা ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে এলো ওর দিকে! বাড়িয়ে দিলো লাইফট্রির অদ্ভুত ডালগুলো, যেগুলো ক্রমে ক্রমে জড়িয়ে নিতে শুরু করলো অ্যানাকে!
মীর সেই মুহুর্তে ছুটে এসে হাটু গেড়ে বসে পড়লো অ্যানার পায়ের কাছে, তারপর ওর উরু জোড়া জড়িয়ে ধরে লাইফ ট্রির নিকট থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে করতে হাউমাউ করে বাচ্চাদের ন্যায় কেঁদে উঠে বলল,
— ক্ষমা করো আমাকে, আমাকে ছেড়ে যেও না! বাচবো না আমি তোমাকে ছাড়া, মরে যাবো আমি! সব ছেড়ে দেবো আমি, ছেড়ে দেবো ওই সাম্রাজ্য, শুধু তুমি থাকো আমার কাছে! চাইনা আমার বাচ্চা, চাইনা আমার সাম্রাজ্য! আমার শুধু তোমাকে চাই শিনু, শুধু তোমাকে! যেও না ওখানে, ফিরে চলো আমার সাথে! ফিরে চলো প্রাণ আমার! এতটা কঠিন হইয়ো না শিনু!
কিন্তু অ্যানা শুনতে পেলোনা ওর কথা, ততক্ষণে লাইফট্রির বুক থেকে বেরিয়ে আসা শিকড় গুলো জড়িয়ে নিয়েছে ওর হাত, মুখ, গলা, বুক, পেট! ওর মস্তিষ্ক আর ওর নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটা চলে গেছে লাইফ ট্রির নিয়ন্ত্রণে!
নিজের সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে ফেলার ঠিক আগ মুহুর্তে অ্যানার চোখের সামনে স্বপ্নের মতো ভেসে উঠলো মীরের সাথে কাটানো ওর সমস্ত সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত গুলো, সবকিছু ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় ওর শূণ্য হ্যে যাওয়া চোখ জোড়া থেকে কয়েকফোটা লোনা জল গড়িয়ে পড়লো ওর গাল বেয়ে, অস্ফুটস্বরে একবার ডেকে উঠলো,
— মীর!
ওর উরু জোড়া আকড়ে ধরে ওর কোমল তলপেটে মুখ ডুবিয়ে, রেড জোনটাকে কাপিয়ে ওকে হারানোর যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে থাকা মীরের কর্ণগোচর হলো না সেটা। লাইফ ট্রি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো অ্যানাকে, আর তারপর ধীরে ধীরে টেনে নিতে থাকলো নিজের ভেতর!
মীর ছাড়তে চাইলো না ওকে, বার বার করে জড়িয়ে ধরলো অ্যানাকে। ধীর গতিতে অ্যানার সমস্ত শরীর টা ঢুকে যেতে থাকলো লাইফ ট্রির ওই অদ্ভুত আলোকরশ্মির ভেতর! মীর অ্যানার শরীর টাকে আকড়ে ধরে রইলো সর্বশক্তি দিয়ে, কিন্তু আটকাতে পারলো না ওর শিনু কে, ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে লাইফ ট্রি নিয়ে নিলো সমস্ত অ্যানাটাকে!
মীর আর্তনাদ করে উঠলো আবারও, আকড়ে ধরতে চাইলো অ্যানার মোলায়েম পা জোড়াকে, কিন্তু পারলো না! তার আগেই অদ্ভুত শব্দ হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো লাইফ ট্রির বুকের দরজাটা!
মীর মানলো না, মানতে চাইলো না ওর মস্তিষ্ক, মানতে চাইলো না ওর মন! ওর শিনু নেই, ওর শিনু নেই! কোথাও নেই!
হাঁসফাঁস করতে করতে লাইফট্রির বুকের কাছটাকে ছিড়ে ফেলতে চাইলো দুহাতে! আর্তনাদ করে লাইফট্রির উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
— ফিরিয়ে দাও আমার শিনু কে! আমার শিনু কে নিও না! ও থাকতে পারবে না আমাকে ছাড়া! ওকে ফিরিয়ে দাও আমার বুকে! ফিরিয়ে দাও ওকে এখনি!
কিন্তু কেউ শুনলোনা ওর আর্তনাদ! স্তব্ধ হয়ে রইলো সমস্ত রেডজোন! লাইফট্রি অ্যানাকে নিজের ভেতরে টেনে নিয়ে আবার নিস্তেজ হয়ে গেলো, মীরের আর্তনাদে সাড়া দিলো না একটুও! আর মীর লাইফট্রির শক্ত বাকলের ওপর দিয়ে যত্রতত্র আঘাত করতে করতে ডেকে উঠলো বারবার, শিনু, শিনু, শিনু, শিনু! ফিরে আসো!
বাচ্চা গুলো স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো! নিজেদের চোখের সামনে শেহজাদীকে হারিয়ে যেতে দেখে নির্বাক হয়ে গেলো ওরা! কোকো ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে! ওর বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো, ওর আম্মা নেই! চলে গেছে, চিরদিনের জন্য!
ফ্যালকন সহ্য করতে পারলো না, অস্ফুটস্বরে একবার শেহজাদী’ শব্দটা উচ্চারণ করেই জ্ঞান হারালো ও! জোভি ওকে আগলে নিলো দ্রুত!
মীরের চোখ মুখ উদভ্রান্ত! বড় বড় দম ফেলতে ফেলতে ও ডেকে উঠছে বার বার, শিনু, আমার শিনু!
অসহায় চোখে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া লাইফ ট্রির দিকে তাকিয়ে দুর্বল পায়ে ও সরে এলো দুকদম! আর ঠিক সেই মুহুর্তেই একটা বিষাক্ত তীর সাই করে এসে লাগলো ওর খোলা বুকে, হৃৎপিণ্ড বরাবর!
মুহুর্তের জন্য থমকালো মীর, ভ্রু জোড়ায় ফুটে উঠলো অসম্ভব যন্ত্রণার ছাপ। দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে এক পলক দেখলো ওর বুকে বিধে যাওয়া তীর টির দিকে! আর তার পরমুহূর্তেই সাই সাই করে এসে ওর বুক জুড়ে বিধলো আরও চারটা তীর!
তীরগুলোর আগমনস্থলের দিকে একবার তাকালো মীর, তীক্ষ্ণ চোখে একবার দেখে নিলো ওকে আক্রমণকারী ব্যাক্তিটাকে! আর পরক্ষণেই মারাত্মক বিষের প্রভাবে টলে গেলো ওর পা জোড়া! বলিষ্ঠ, ভারী শরীর টা টলতে টলতে, পেছন দিকে সরতে সরতে ধাম করে পড়ে গেলো রেড জোনের মাটিতে। মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো একটি শব্দ, ‘শিনু’!
আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলো কোকো! ছুটে চলে গেলো মীরের নিকট! অন্য বাচ্চাগুলো সচকিত হয়ে উঠলো সাথে সাথে!
লিও শত্রুপক্ষের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠলো,
— সৌলজার্স!
মুহুর্তেই রেড জোন আর সেইফ জোনের বর্ডারে অদৃশ্য অবস্থায় থাকা রোবোটিক গার্ড গুলো দৃশ্যমান হয়ে জেগে উঠলো, আর এরপর নিজেদের অস্ত্রগুলো তুলে নিয়ে এগোলো শত্রুপক্ষের দিকে।
বাচ্চারা বিষের প্রভাবে অচেতন হয়ে পড়া মীর কে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা শুরু করে দিলো।
কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তেই ওদের বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসতে শুরু করলো ডার্ক প্যালেসের সৈন্যরা! মুহুর্তেই সেইফ জোনের গার্ড আর ডার্ক প্যালেসের সৈন্যদের ভেতরে শুরু হয়ে গেলো তুমুল লড়াই!
বাদশাহ নামা পর্ব ৪৯+৫০
তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুহুর্মুহু শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকলো রেড জোন!
দূরে দাঁড়িয়ে, অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা মীরের বলিষ্ঠ শরীর টার দিকে দৃকপাত করে ইলহান বাকা হেসে স্বগতোক্তি করলো,
— আহ, ম্যেকিং দ্যা মোস্ট অব অ্যান অপরচুনিটি!
