বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২
ইশরাত জাহান

দর্শন এসে সবার সাথে সাক্ষাৎ করে নিজের ঘরে গেলো।সেভাবে কোনো কথা বলেনি কারো সাথেই।পারুল বেগম পিছন থেকে দর্শনকে দেখে দীর্ঘস্বাস ছাড়েন।দীপ্ত ফরাজি দর্শনের বাবা হুইল চেয়ারে বসা অবস্থায় এগিয়ে এসে বলেন,“কি মনে হয়?মেয়েটার কি কপাল ফিরবে?”
পারুল বেগম উদাস কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস বজায় রেখেই বলেন,“অবশ্যই মেয়েটার জীবনে ভালো কিছু হবে।আমরা ছাড়া কে আছি ওর জীবনে?ওর মা মারা যাওয়ার আগে আমার হাতেই আস্থা রেখে দিয়েছেন মেয়েটাকে।বিয়েটা কোনো এক কারণে হলেও হয়েছে তো।বিয়ে শব্দটার মর্ম এবার বুঝতে হবে আমাদের ছেলেকে।এভাবে বউকে এড়িয়ে তার জীবন চলতে দেওয়া যাবেনা।”

“শাসন করো তুমি তোমার ছেলেকে।”
“তুমি তো কিছুই করবে না।যা করার আমাকেই করতে হবে।”
“আমিও আছি বউমা।আমার ছেলে কোনো কাজের না হোক দাদুভাইকে বউয়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে আমি একাই একশত।”
পারুল বেগম মৃদু হেসে জানান,“আপনি আমার শেষ ভরসা বাবা।”
“আমি যতদিন বেঁচে আছি কোনো ভুল কিছু হতেই দিবো না।হতচ্ছাড়া এবার বউ রেখে যায় কি করে এটা আমিও দেখবো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দীপ্ত ফরাজি একগাল হেঁসে চ্যালেঞ্জিং সুরে বলেন,“আমার ছেলেকে চিনতে পারোনি বাবা।এই ছেলের রাগ মাথার উপরে।জীবনের মূল্যবান সম্পদ বলে যদি ওর কিছু থাকে তাহলে সেটা রাগ।এই রাগের ধাচ তো দেখেছো।”
দিজা মন খারাপ করে বলে,“কিছু একটা করো দাদাজান।শোভা এতদিনে অনেক কষ্ট পেয়েছে।মেয়েটার সমাজে মুখ দেখানো কষ্টের হয়েছে।আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওর কতকিছু ফেস করতে হয়।”
“আবার কেউ কিছু করেছে নাকি?”
“আরে না কিন্তু কিছু কুচুটে প্রতিবেশী ওর নামে বদনাম করে।”
“মেরে থোটকা ভাইঙ্গা দিতে পারলি না?”

“সামনে যে কয়টাকে পেয়েছি শাসিয়ে এসেছি। বাকিদের কোথায় পাবো যে শাসাবো?কিন্তু আমি জানি এই সম্মান শোভা ফেরত পাবে যদি ভাইয়া ওকে নিয়ে সংসার করে।”
“দেখেছেন বাবা আপনার ছোট নাতনির বুদ্ধিতে এগুলো আসে কিন্তু ওই বদমেজাজি বড় নাতির বুদ্ধিতে আসেনা।”
“আরে বউমা শান্ত হও।আমি আছি তো পিরিতের ডোজ দিয়ে নাতিকে সংসার করানোর সুযোগ করে দিতে।”
দিজা খুশিতে হাততালি দেয়।অপেক্ষায় আছে কখন তার ভাবী আসবে।
বাগানের সাথে লাগোয়া বেঞ্চে বসে আছে দর্শন,দাদাজান ও পারুল বেগম।দর্শন প্রশ্ন করে,“তোমাকে দেখে তো সুস্থ লাগছে দাদাজান।”
একটু শুকনো ঢোক গিলে দাদাজান বলেন,“তুমি কি চাও আমি বারোমাস অসুস্থ থাকি?”
“যেভাবে ফোনে বলছিলে যে তোমার এই পৃথিবীতে মেয়াদ আছে কিছুদিনের।আমি তো তেমনভাবেই প্রস্তুত নিয়ে আসলাম।”

“বিদেশ থেকে কি আমার মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই কাফনের কাপড় এনেছো?”
দর্শন বিরক্তিতে চ করে বলে,“বাজে বোকো না।তোমাকে সুস্থ দেখাচ্ছে বলেই প্রশ্ন করা।”
“তোমাকে কল দিয়ে অসুস্থ ব্যাপারে জানিয়েছিলাম আজ থেকে দুই সপ্তাহ আগে।এর মধ্যে আমার মেয়াদ উত্তীর্ণ না হয়ে নতুনরূপে মেয়াদ বেড়ে গেলে আমি কি করতে পারি?তোমার মন চাইলে ফিরে যেতে পারো। করো তো ওই একটাই কাজ।”
“হুম,যেতে তো হবেই কিন্তু এবার বিদেশ না ঢাকা যাচ্ছি।”
“কেন ওখানে কেউ আছে নাকি?”
রাগ বাড়লেও সংযত হয়ে বলে,“বিদেশী একটা চাইনিজ ও ইটালিয়ান ফোনের কোম্পানি আমরা দেশে ওপেন করবো।আর কোনো মেয়ের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট নেই,জানোই তো।”
“তাহলে কি ছেলেদের প্রতি ইন্টারেস্ট তোমার!”
“দাদাজান!”

“ধমকাবে না আমাকে।তোমার বাবাকে জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখি আমি,সেখানে তোমার ধমক সহ্য করবো না।”
“কিসব উল্টো পাল্টা কথা বলছো?ছেলেদের টানছ কেন?”
“তাহলে তোমার মেয়েদের প্রতি ইন্টারেস্ট নেই কেন?”
“কারণটা খুব ভালো করেই জানো।আর হ্যাঁ ওই মেয়েকে আমি ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবছি।”
দাদাজান আতকে উঠলেন।যা একটু নাতির জীবনসঙ্গী আছে বলে নিশ্চিন্ত এখন এটা গেলে নাতি সারা জীবনেও বিয়ে করবে না শিওর দাদাজান।এই ছেলে ক্যারিয়ার গড়বে।সেই ক্যারিয়ারের কোনো উত্তরাধিকার নেই।নিজে গড়ে নিজেই খেয়ে বিদায় নিবে।দাদাজান অনেক ভেবে বলেন, “আর যাই করো তোমার জবান থেকে যেনো ডিভোর্স শব্দ না শুনি।”

“ধমক দিচ্ছ আমাকে?ভয় পাইনা আমি এসবের।”
“ধমক না সোজা আমার সিদ্ধান্ত।এই বাড়ির মুল কর্তা হিসেবে আমার এটাই সিদ্ধান্ত।যদি হেরফের হতে দেখি তাহলে আমার লাশ দেখতে হবে তোমাকে।”
দাদাজান যে মুখে কথা বলে থেমে থাকেন এমন না।তিনি ঘটিয়েও দেখান।দর্শনকে কোনো ব্ল্যাকমেইল করে যে হবেনা এটা জেনেই দাদাজান এভাবে আঘাত দিলো।দাদাজান আর বসে রইলেন না ভিতরে চলে যেতে লাগলেন।পিছন পিছন পারুল বেগম আসতে আসতে বলেন,“এভাবে বলাটা কি ঠিক হলো?ছেলেটা পাথর হয়ে বসে আছে।”
দাদাজান পিছন ফিরে তাকান।একদৃষ্টিতে শূন্যে চোখ স্থির করে দর্শন হাতের মুঠোয় নিজের রাগ সংবরণ করতে ব্যাস্ত।দাদাজান তার দুর্বলতায় আঘাত করলো।জানে যে এই ব্যক্তির উপর দর্শন দুর্বল তাই সুযোগের সৎ ব্যবহার করে নিলো সবাই।দাদাজান কণ্ঠে কাঠিন্য প্রকাশ করে বলেন,“এই ছোকরা কোনোদিন আমার নরম কথাতে গলবে না।আমাকেই জব্দ হয়ে ওর সংসারে মনোনিবেশ করাতে হবে।”
“এর প্রভাব যদি মেয়েটার উপর পড়ে?”
“মেয়েটার মাঝে কঠিন একটা ভাব আছে।রাগ জেদ মেয়েটারও কম না।কত বড় সাহস!আমি টাকা দিতে গেলে বলে লাগবে না।দর্জির কাজ করে চলে।যাই হোক আদর্শ মেয়ের পরিচয় দিয়েছে বলে কিছু বলিনি।এমন হিরেকে তোমার ছেলে চিনতে সময় নিবে না।”
পারুল বেগম মৃদু হাসলেন।দাদাজান আবারও লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেন,“ছেলের এই বেঁচে থেকেও মরা জীবনের পরিবর্তন করতে হলে এমন সঙ্গীর প্রয়োজন যেটা আমরা ভাগ্যক্রমে পেয়েছি।তাকে হাতছাড়া হতে দেওয়া যাবেনা।”

“একদিকে অপেক্ষা করছে বউ আরেকদিকে রেগে আগুন হয়ে আছে বর।কি যে হবে আল্লাহ ভালো জানেন।”
“উত্তম কিছু পরিকল্পনা করে সফলের চেষ্টা করো।ছেলে মেয়ে দুজনেরই সুখ দেখা আমাদের দায়িত্ব।একা দর্শন না শোভাকেও সুখে রাখতে হবে।”
পারুল বেগম মৃদু হেসে সম্মতি দিলেন।ভিতরে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে মাথার কাপড় সরালেন।যে গরম তাতে মাথায় কাপড় রাখা সম্ভব না।রান্নাঘরে কোনো পুরুষ মানুষ আসেনা।বারান্দার সোফায় বসে গলা উঁচিয়ে যা চাওয়ার চেয়ে নেয়।পারুল বেগম রান্নায় ব্যাস্ত আর ভাবছেন কিভাবে কি করবেন।ছেলের মুখে হাসি দেখেন না বহু বছর হয়েগেলো।

বাগান থেকে এসে দর্শন ছাদের দিকে চলে যায়।রাতের অন্ধকার চারিদিকে।চার বছর আগের স্মৃতি একের পর এক ভেসে উঠছে চোখের সামনে।অপরাধ না করেও সহ্য করতে হয় অপমান।সেই রাতে কল করেছিলো পুলিশের কাছে।পুলিশ কি না বখাটের হয়েই সাক্ষী ছিলো।দর্শনের কথার প্রমাণ নেই ভিত্তি নেই অথচ এলাকার একগুচ্ছো লোক যাই বলেছে সব সত্যি!

সে কখনো শোভার মুখটা ঠিকমতো দেখেনি।দেখার প্রয়োজন হয়নি বলেই দেখেনি।পারুল বেগম যখন দেখলেন ছেলের সম্মান ও শোভার সম্মান নিয়ে টানাটানি তখন বাধ্য হয়েই কলমা কাবিন করে দেন।এটাই ছিল দর্শনের বড় রাগ।এমনিতেও মেয়েদের প্রতি তার রাগ ও ঘৃণা কাজ করে।সিগারেটের গন্ধ নাকে আসতেই দর্শন ভ্রুকুটি করে পাশে ফিরল।ট্যাঙ্কির পাশ দিয়ে ধোয়া উড়তে দেখা দিলো।পাশেই ল্যাম্পপোস্টর আলোয় দেখা দিলো অবয়ব।অবয়বে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ওখানে কেউ কানে ফোন নিয়ে কথা বলতে ব্যাস্ত আর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে গন্ধ বের হলো।দর্শন এগিয়ে এসে ট্যাঙ্কির পাশে তাকাতেই রাগে গা রিরি করে উঠলো।কথা বলা ব্যক্তিকে কোনকিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই গালে দিলো ঠাটিয়ে এক চড়।থাপড় খেয়ে পাশ ফিরে জম আকারে নিজের বড় ভাইকে দেখে শুকনো ঢোক গিলে দীদার।প্রেমিকার সাথে মনের সুখে কথা বলছিল আর সিগারেট নিয়ে ব্যস্ত ছিল।দর্শনকে আচমকা এভাবে আক্রমণ করতে দেখে ভয়ে জান নিয়ে পালাই পালাই করছে দিদারের।ফোনটা পকেটে রেখে দর্শনের লাল রক্তিম চোখে আর চাইলো না।সোজা দিলো দৌড়।কিন্তু বেচারা বেশিদূর পালাতে পারল না।দর্শন পিছনে ছুটে এসে দিদারের কলার চেপে ধরে।পিছন থেকেই কিল দিয়ে নিচে নামাতে নামাতে বলে,“দিন দিন বিগড়ে যাওয়া হচ্ছে?বেয়াদপ ছেলে একটা।সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে!ফোনের ওপাশে জান বাবু বলা!তোকে তো আমি মেরেই ফেলব।এটুকু ছেলের কিনা আবার থাকে জান বাবু।এখনও তো নিজের পায়েই দাঁড়াতে পারলি না।”

দিদার পিঠে ব্যাথা পাচ্ছে।কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছে না।দর্শন আজ তাকে ছাড়বে না।এখন যদি তর্ক করে তাহলে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিবে।মারের শব্দ পেয়ে সবাই বাইরে বের হয়।দাদাজান দৃশ্য দেখে চোখ বড়বড় করে চাইলেন।দাদাজান দ্রুত গলা উঁচিয়ে বলেন,“মেরে ফেলতে চাও নাকি নিজের ভাইকে?”
“উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেকে মারবো না তো কি করবো?পড়ালেখা না করে তোমার নাতি এখন প্রেম করে।সিগারেট মুখে নিয়ে ভাব দেখায়।লাট সাহেব হয়েছে উনি।বাবার পরিশ্রমের মূল্য বুঝবে কি আদৌ?নিজের যোগ্যতায় আসতে পারেনি এখনই প্রেম!”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১

বলেই আবারও দিলো গালে থাপ্পড়।পারুল বেগম রেগে গেলেন ছোট ছেলের উপর।এই ছেলে হয়েছে আরেক বেহাংলা।ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবেইনা বরং বাবার টাকা উড়ায়।সবে অনার্স তৃতীয় বর্ষে উঠেছে।এখন সময় ক্যারিয়ার গড়ার।উশৃঙ্খল ছেলেকে মারতে দ্বিমত করলেন না পারুল বেগম।দীপ্ত ফরাজিও কোনো বাধা দিলেন না।মারুক এটাকে আজ।দিজা ভয়তে ভয়তে কাপছে।ফোনের স্ক্রিনে থাকা প্রিয় ব্যক্তিটির ছবি দেখে স্ক্রিন বন্ধ করে দেয়।না জানি এখন ফোনে নিজের বন্ধুকে দেখে কি রিয়েক্ট করে দর্শন!কেউ তো জানেনা যে দিজা মনে মনে দর্শনের বন্ধুর প্রেমে পড়েছে।কেউ তো দূরের কথা সেই ব্যক্তি তুহিন আল মাহমুদ নিজেই কিছু জানেন না।

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here