বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১১

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১১
ইশরাত জাহান

দুপুরের নামাজ পড়ে বাসায় এসে দর্শন ও দিদার হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসে।খাবার টেবিল ভর্তি সুগন্ধে ভরে আছে গরম ধোঁয়া ওঠানো ভাতের।গরম ভাতের সাথে গরম গরম মুরগির ঝোল,শুঁটকির ভর্তা,বেগুন ভাজি সবকিছু এমনভাবে সাজানো যেন কোন উৎসব চলছে।পারুল বেগম প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন, “এই নে বাবা খিদে পেয়েছে তো?”

দর্শন বিনয়ে মাথা নাড়ল।বেগুন ভাজি খেয়ে যেই মুরগির মাংস নিবে ওমনি পাশ থেকে দাদাজান হাত বাড়িয়ে এক চামচ শুঁটকির ভর্তা মুখে দিলেন।মুহূর্তেই চোখ বড় হয়ে উঠল তাঁর।প্রশংসা করে বলেন,“আহা!কী চমৎকার স্বাদ।বউমা তুমি আজ যেন এক্কেবারে পুরনো আমলের মত রান্না করেছো!”
পারুল বেগম একটু হাসলেন কিন্তু কিছু বললেন না।দর্শন বিস্ময়ে তাকালেন পারুল বেগমের দিকে।দর্শন যতদূর জানে পারুল বেগম কখনো শুঁটকির ভর্তা বানায় না।তবু চুপচাপ খাওয়ায় মন দিলো এই ভেবে যে পরে শিখেছে।কিন্তু যখন দাদাজান আবারও শুঁটকির ভর্তা চাইলেন আর বললেন,“এই স্বাদ সচরাচর পাওয়া যায়না।পুরো মন ছুঁয়ে গেল রে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তখন দর্শন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।নিজেও প্লেটে শুটকি ভর্তা নিয়ে গরম ভাতের সাথে মেখে মুখে নেয়। সত্যিই মজাদার হয়েছে।দর্শন প্রশংসা করে বলে,“অনেক ভালো ভর্তা বানিয়েছেন আপনি।এমনভাবে ভর্তা বানান আগে জানলে বলতাম আমার জন্য বেশি করে ভর্তা বানান।মাছ মাংস ছেড়ে মাঝে মাঝে ভর্তা খেতে খুব ইচ্ছা করে।কালকেও একটু বানাবেন।”
পারুল বেগম মুচকি হেঁসে শোভার দিকে তাকালেন।শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে হেসে শোভার দিকে চেয়ে আছে দেখে দিদার সন্দেহের সাথে প্রশ্ন করে,“মা তুমি এই ভর্তা বানিয়েছো?তুমি তো শুঁটকির গন্ধে আরো পালিয়ে যাও।”
পারুল বেগম এবার সবার সামনে মুচকি হেসে বললেন, “না রে এটা শোভা করেছে।ওর খুব খেতে ইচ্ছা করে শুটকি মাছ দেখে।আমি আবার আব্বাদের বরিশালের শুটকি ভর্তার কথা তুলে ধরেছিলাম তো সেই শুনে বেশি করে আব্বার জন্য বানায়।”

দর্শনের হাত থেকে ভাত পড়ে গেল প্লেটে।চোখ স্থির হয়ে রইল সামনে রাখা ভর্তার দিকে। যার হাতে খাবেনা বলে ঘোষণা করেছে তার হাতের খাবারই না জেনে খেয়ে আবার প্রশংসা করে!আহাম্বোক হয়ে তাকিয়ে রইল সে।তার বুকের ভিতর যেন কেউ হালকা একটা ধাক্কা দিল।মেয়েটা না বলেই অনেক কিছু বলে গেল যেন এক চামচ শুঁটকির ভর্তায়।শোভার দিকে তাকাতেই দেখে মুখ ঢেকে রাখা।এখানে পরপুরুষ আছে তাই।মুখটা ঢেকে রাখা না থাকলে হয়তো মেয়েটার মুখে বিজয়ীর হাসি দেখা যেতো।দাদাজান ভ্রু নাচিয়ে বলেন,“কি দাদুভাই!বউয়ের হাতের রান্নায় মেলা স্বাদ।যে বউকে মানিনা তার হাতের রান্না আবার বেশি বেশি করে চাই।”

দর্শন বেচারা সবার দিকে চাইলো।সবাই মুখ টিপে হাসছে।দর্শন ধমক দিয়ে দিদার ও দিজাকে থামালো।কারণ এদের দুজনকে ধমক দেওয়া মানে বড়রা চুপ করবে এমনিতেই।সবাই হাসি থামালে দর্শন বলে ওঠে,“খাবারটা ভালোই হয়েছে কিন্তু একটু ঝাল বেশি আছে।সাথে লবনটাও ঠিক নেই।আর শুঁটকিতে একটু কাটা কাটা বাঁধছিল।”
“যেমন তোমার গলায় কথাগুলো কাটা হয়ে আছে ঠিক তেমন শুঁটকিতেও কাটা আছে।”
আবারও হেসে দিল দিদার ও বাড়িসহ প্রত্যেকে।খাওয়া সম্পূর্ণ হলো না দর্শনের।উঠে চলে গেলো ঘরের ভিতর।এখানে থাকা তার দ্বারা সম্ভব না।

দর্শন চলে যাবার পর মনটা খারাপ হয়ে এলো শোভার।যতই হোক স্বামী তো।স্বামীর মূল্য কি এটা শোভার কানের কাছে প্রতিবেশী নানী দাদীরা দিনে রাতে খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে।এখন শোভা না চাইতেও স্বামীকে না খাইয়ে থাকতে দেখতে পারেনা।প্লেটে করে ভাত আর মুরগির মাংস নিয়ে উপরে চলে গেলো।সবাই দেখলো কিন্তু মুখে কিছু বলল না।শোভা উপরে যেতেই দাদাজান বলেন,“আমি যোগ্য মেয়েই পেয়েছি।”
দিজা বলে ওঠে,“ভাবীর ধৈর্য আছে দাদাজান।আজকে সকালে ভাইয়ের মাথায় টবের মাটি ফেলে দেয়।”
“কি বলো!তোমার ভাই কিছু করেনি?”
“কিছু বলেনি মনে হয় কিন্তু ভাবীও জবাব দিয়ে চলে আসে।”
“এটা তো সাপে নেউলে হয়ে গেলো।”

“ঠিকই তো আছে।ছেলেটা এমন রাগী হলে একটা ঘাড়ত্যাড়া বউ খুব প্রয়োজন।”
পারুল বেগমের কথা শুনে হেসে দেয় সবাই।দাদাজান মনে মনে দোয়া করেন ওদের জন্য।দর্শনের জন্য তার খারাপ লাগে।আল্লাহর কাছে প্রতি ওয়াক্তে তিনি দর্শনের জন্যই সুখ ভিক্ষা চান।
ঘরে এসে শোভা দরজায় কড়া নাড়ে।দর্শন এক পলক চেয়ে চুপ করে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়।শোভা ভিতরে ঢুকে বলে,“আপনি জানেন কথায় কথায় অভিমান করে খাবার ছেড়ে উঠে যায় কারা?”
“না জানলেও তোমার মত বাচাল আছে জানাতে?”
“এই তো ঠিক ধরেছেন।আপনার মাথায় যতগুলো ছারপোকা আছে আমিই ঠিক করে দিবো।কারণ আমি তো বাচাল।আর বাচাল যারা তারা মুখের গোড়ায় কথা রাখে।আমার কাছে এগুলোর উত্তরও আছে।”

“আসল কথায় আসো।”
“বাচ্চারা অভিমান করে খাবার ছেড়ে উঠে মুখ ফুলিয়ে রাখে।আমার ভাইয়ের মেয়ে মৌলি এমন।তাই বলে আপনি আমার মুরুব্বী হয়ে এমন ভাব করবেন?”
দর্শন চোখ তুলে তাকালো।ধমক দিয়ে বলে,“এই মেয়ে এই!কে মুরুব্বী তোমার?”
“কেন আপনি?আপনিই তো বলেছিলেন আপনি আমার বড়।সম্মান করতে হবে।বড়রা তো মুরুব্বীই হয়।”
“তুমি আসলেই বাচাল।”
“এতক্ষণ কি নকলে ছিলাম?”
“থাপ্পড় কি ভুলে গেছো?”
“পাল্টা আঘাত কি ভুলে গেছেন?”

দর্শন দমিয়ে থাকতে পারলো না।দিলো এবার মুখে মুখে তর্ক করার জন্য গালের উপর।এই ব্যাটার এক সমস্যা,কেউ তার মুখের উপর কিছু বললেই হাত চালাতে শুরু করে।শোভাও তো কম না।নিজেকে যেহেতু এই জায়গা থেকে দূরে রাখতে পারবেনা তাই সে পাল্টা আঘাত করেই ছাড়বে।কি করবে বুঝতে না পেরে মুরগির মাংসের বাটিটা নিয়ে সোজা দর্শনের গায়ে ছুঁড়ে মারে।দর্শন নিজের শরীরের পাঞ্জাবি দেখে চোখ বড় বড় করে আবারও হাত উঁচিয়ে থাপ্পড় দিতে নিবে শোভা ভাতের প্লেট উঁচিয়ে বলে,“আমিও কিন্তু পাল্টা আঘাত করবো।”
“এই মেয়ে তো খুব ডেঞ্জারাস!”
“আপনি কি মনে করেন পৃথিবীতে আপনি একাই একশ বাকিরা শূন্য?আপনাকে ভুল প্রমাণ করবো আমি মিস্টার দর্শন ফরাজি।

“বেয়াদপ!চলে যাও আমার ঘর থেকে।”
“যাবো না কারণ এটা আমারও ঘর।”
“তোমাকে অধিকার দিয়েছে কে এই ঘরে থাকার?”
“আমার নসিব আমার সহায়।তা নাহলে চিনি না জানিনা এমন বদমেজাজি লোকের সাথে আমার বিয়ে হয়ে কপাল পুড়ল কেন?কপাল যখন পুড়েছেই তখন পোড়া কপালে মলম দিতে হবে।”
“সরাসরি বলো।”
“মানে হলো এই যে বিয়ে যেভাবেই হোক আর আমাদের মনের অবস্থা যেমনই হোক না কেন আমি আপনার বউ।যতদিন আল্লাহর নিকট এটা গ্রহণযোগ্য,ততদিন আমি এই ঘরের মালকিন।আমাকে আমার অধিকার থেকে সরানোর অধিকার আপনারও নেই।”
“আমার ঘর আমার সবকিছু আমাকেই দেখানো হচ্ছে অধিকার!সামনে থেকে সরে যাও তুমি।তোমাকে দেখতেই আমার ইচ্ছা করেনা।”

“আপনাকে দেখতে বলে কে?আপনি আপনার কাজ করুন আমি আমার কাজ করি।”
দর্শন কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো গোসল করতে।এই মেয়ে এই নিয়ে তিনবার তার উপর হামলা করেছে।যে সে মেয়ে এ না এটা বুঝেছে দর্শন।সেই সাথে দর্শন লক্ষ্য করে এই মেয়ে মনের মধ্যে মারপ্যাঁচ ধরে রাখেনা।আচমকা ঝর্নার নিচে মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়ালে দুইহাত রেখে নিজেকে ভেজাতে থাকে দর্শন।ভাবতে থাকে সে অনেকটা বদলেছে।এই দুইদিনে সে কিছুটা বদলেছে।নাহলে মেয়েটার তো এই ঘরটিতে থাকার কথাই না।অনেক্ষক গোসল করে বাইরে এসে দেখে প্লেটে খাবার ও ঘর পরিষ্কার।প্লেটের পাশে আছে একটি কাগজ।কাগজ হাতে নিয়ে দেখে খুব সুন্দর হাতের লেখা।শোভা লিখেছে,

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১০

“এই যে মিস্টার বদ মেজাজের গোডাউন।আপনার তো আবার মেয়েতে এলার্জি।তাই আমি খাবার রেখে চলে গেলাম।আপনি খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।না খেলে কিন্তু আবারও আমার মত বাচালের সম্মুখীন হতে হবে।তখন কিন্তু এর দায়ভার আমার না।
ইতি,
আপনার জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আগমণিত
বাচাল নারী(বউ)।”
দর্শন পড়ে কাগজটা দলা পাকিয়ে যেই ডাস্টবিনে ফেলতে নিবে হাত যেনো এগোলো না।দলা পাকানো কাগজটি আবারও খুলে রাখলো নিজের ওয়ালেটে।বউয়ের দেওয়া প্রথম চিঠী রাখলো তার ওয়ালেটে।

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here