বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৩

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৩
ইশরাত জাহান

“আমি তো মেয়েদের ঘৃণা করি।এই বিশ্বাসটা ছিল আমার অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।মায়া,স্নেহ, ভালোবাসা এই শব্দগুলো নারীদের মুখে শুনলেই বিরক্ত লাগত।ভাবতাম সবাই এক।প্রতারণার মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়।কিন্তু শোভা?সে যেন সেই নিয়মের বাইরে এক ব্যতিক্রম।তার চোখে কোনো প্রলোভন নেই,আচরণে নেই কৃত্রিমতা।চুপচাপ মাথা নিচু করে হাঁটে কিন্তু সেই হাঁটাতেই যেন এক অদ্ভুত সম্মোহন। আমি বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দিই আমি তো মেয়েদের ঘৃণা করি।তাহলে কেন তাকে দেখলে বুকের ভেতর অদ্ভুত এক টান অনুভব করি?কেন তার নীরব উপস্থিতি আমাকে ব্যথা দিচ্ছে?আবার প্রশান্তিও দিচ্ছে?এটা কি দুর্বলতা?নাকি বহু বছর ধরে জমে থাকা এক ভুল বিশ্বাস ভাঙার শুরু?”

ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো দর্শন।অতঃপর বলে,“পৃথিবীতে হাজারও সুন্দরী আছে।তাই এটা নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না।নারী যদি হয় সুন্দরী,তবে তার মধ্যেই আরেক রূপ থাকে সেটা হলো ছলনাময়ী।”
দুপুরের তপ্ত রোদে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে পারুল বেগম,শোভা আর দিজা।পারুল বেগম চুলার পাশে দাঁড়িয়ে হাত চালাচ্ছেন,শোভা বাটনা নিয়ে ব্যস্ত, আর দিজা করছে সবজি কাটাকাটি।বাটা শেষ করে শোভা বলল,“আম্মা, আমি রান্না করে দিই?”
পারুল বেগম হেসে বললেন,“না না, তুই ঘরে যা। বিকেলবেলা দর্শনের সঙ্গে বাইরে যাবি।সেই আসা ধরে দিজার জামা পরে আছিস।আজকে তোকে ভালো ভালো জামা কিনে দেবে তোর বর।”
শোভা চোখ বড় বড় করে বলে উঠল,“কে কিনে দেবে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তোর বর,দর্শন ফরাজি।”
পারুল বেগম হাসিমুখে বললেন।শোভা মুখ শুকনো করে বলে,“হাহ!তিনি আমাকে জামা কিনে দেবেন?তিনি তো মুখ খুললেই বলেন বউ মানি না।এমন একজন মানুষ জামা কিনে দেবে?”
বিয়ের পর থেকেই পারুল বেগমকে আম্মা বলে ডাকে শোভা।তবে সম্পর্কটা ছিল আরও আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ।রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দর্শন আচমকা থেমে গেল।এই কথাগুলো যে তারই নামে!শোভা তখনও থামেনি।একটু হেসে আবার বলে উঠল, “তোমার ছেলে বদমেজাজি ঠিকই কিন্তু ভিতরে ভিতরে একেবারে ভীতু।বউকে স্বীকার করতে সাহস লাগে আর সেটা তার নেই।অবশ্য তোমরাও আমাদেরকে এক করতে বাধ্য করছো এটা আমি বুঝি।”
পারুল বেগম প্রথমে হাসলেও শেষের কথাতে মুখটা মলিন করে বলেন,“কেন তুই কি বিয়েতে রাজি না?”

“আমি মুসলিম ঘরের মেয়ে।সাদামাটা জীবন আমার।আমার শিক্ষা আমার বিয়েটা যখন হয়েছে এটাকে ধরে রাখা।তাই বলে নিজেকে অপদস্ত হতে দেওয়া নয়।আমি নিজের সম্মান ধরে রাখার চেষ্টা করতে চাই।বিশ্বাস করো তোমাদের ছেলের সাথে আমার যুদ্ধ করে চলতে হত না যদি তোমরা আমার ভাই ভাবীকে বুঝিয়ে গ্রামে না পাঠাতে।ওইদিনই হয়তো আমি বাড়িতে চলে যেতাম রাগের মাথায়।”
“আমি নারী আমি বুঝি।আমিও এসবের সম্মুখীন হয়েছি।তাই তো তোর প্রতিবাদে আমি কখনও রাগ করিনি বরং আব্বা নিজেও খুশি তুই মুখ খুলিশ।তোর সম্মান ধরে তোর অধিকার তুই ধরে রাখবি।”
“দোয়া করো যেনো আমার সম্মান ধরে অধিকার পাই।নাহলে তোমাদের ছেলের যে রাগ!উনিই কখন না জানি সংসার ভেঙ্গে দেয়।ওনাকে দেখলেই আমার কেমন জানি গন্ডারের কথা মনে পড়ে।”

হেসে দিল দিজা।দর্শন আবারও নিজেকে গন্ডারের সাথে তুলনা শুনে রেগে গেলো।রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে আসতে নিবে দিজা দেখেই তুতলিয়ে বলে, “ভ ভাইয়া।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইয়াই।তার কথাই বলছি।উনি তো গন্ডার।”
“ওহ রিয়েলী!”
দর্শনের কন্ঠ পেয়ে শোভা চোখ বড় বড় করে পিছনে ফিরল।পারুল বেগম কিছু বলতে নিবেন দীপ্ত ফরাজি ডাক দিলেন।বাধ্য হয়ে চলে গেলেন তিনি।এদিকে মাকে চলে যেতে দেখে দিজা পালিয়ে গেলো।দর্শন হাতা গুটিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,“আমি কি?”

“গন্ডার।”
“তোমার সাহস কিভাবে আমাকে ভুলভাল নামে ডাকার?”
“এটাতে সাহসের কি আছে?যেমন দেখতে তেমনই তো নাম দিবো।”
“খুব মুখ চলে তোমার!”
বলেই দেয়ালে দিলো এক কিল।কেঁপে উঠলো শোভা।দূরে সরে গিয়ে বলে,“রান্নাঘরে মাস্তানগিরি দেখাচ্ছেন কেন?এটা রান্না করার জায়গা মাস্তানদের মত অভিনয় করার জায়গা নয়।”

“তোমার মনে হয় আমি অভিনয় করি?”
“আমার তো কিছুই মনে হয়না।”
“তোমার মধ্যে কোনো ম্যানারস নেই।”
“আপনার মধ্যে খুব আছে!”
শোভার বামহাত মুচড়ে ধরলো দর্শন।শোভা কুকরিয়ে ওঠে।মুখ ফুটিয়ে বলে,“হাত ছাড়ুন।ভেঙ্গে ফেলার ধান্দায় আছেন দেখছি।”
“বেশি মুখ ফুটালে হাত ভেঙ্গে দিবো।”
“ফুটাচ্ছি তো মুখ,হাত কি দোষ করলো?”
দর্শন আরো চেপে ধরে।শোভা এবার কুকড়ে উঠে বলে,“আমার হাত নিয়ে আজ হাসপাতালে যেতে হবে।এই গন্ডারের গায়ে যে শক্তি!আমি তো এখনই শেষ।”

“ভালোয় ভালোয় বলছি শোনো,এই একমাস চুপ করে থাকবে।নাহলে আমার শাস্তির রূপ এখনও তোমার দেখা বাকি।”
“আটাশ দিন।”
“কিঃ!”
“আটাশ দিন আছে হাতে সময়।দুটো দিন তো চলে গেলো।আজকের দিন গেলে সাতাশ হবে।”
“তুমি কাউন্ট করো?”
“হ্যাঁ করি তো।কেন করব না?জীবনটা তো আমারই।আমাকেই তো একেক মুহূর্তে ভাবতে হবে জীবনে কিভাবে এগিয়ে যাব।”
“এটুকু মেয়ের এত কথা!”
“মেয়েটা এটুকু কোথায়?আপনার কাধ থেকে মাত্র দেড় ইঞ্চি নিচে আমার কাধ।আমরা তো একই লম্বা।আপনি মনে হয় পাঁচ ফিট সাত আমি পাঁচ ফিট পাঁচ।”

“পাঁচ ফিট দশ।”
“তাহলে আমার থেকে মাত্র এইটুকু লম্বা লাগছে কেন?”
“ইডিয়ট আমি ঝুঁকে আছি।”
শোভা এবার লক্ষ্য করে দেখে দর্শন নিচু হয়েছে একটু।শোভা বলে ওঠে,“মানলাম আমার হাত নরম তাই ধরে আছেন।কিন্ত আমি এটা মানতে পারছি না যে ব্যক্তি কোনো নারীদের বিশ্বাসই করতে পারেনা সে আবার আমার হাতটা পাঁচ মিনিটের উপরে ধরে আছে।”
দর্শন হাত ছেড়ে দিলো।শোভা হাতটা ঝাড়া দিয়ে দর্শনের দিকে তাকালো।দর্শন চলে যেতে নিলে শোভা বলে,“দাড়ান।”
দর্শন কপাল কুঁচকে ঘুরে তাকাতেই শোভা চুলা থেকে খড়ি নামিয়ে রান্নাঘরের ধোঁয়া বাসনপত্র থেকে একটা কাঁটাচামচ নেয়।ওটা নিয়ে এগিয়ে এসে দর্শনের সামনে দাড়িয়ে বলে,“আমার হাত অবস হয়েছে আপনার জন্য।ভয় নেই আপনাকেও অবস করে দিবো না শুধু একটু ব্যাথা দিবো।’’
বলেই অপেক্ষা না করে দর্শনের বাম হাতের কনুইতে কাঁটাচামচ দিয়ে দিলো ঘুতা।বেচারা দর্শন ব্যাথা পেয়ে কুঁকড়ে উঠে বলে,“ইউ ইডিয়ট।”

“অ্যান্ড ইউ গন্ডার।”
“থাপড়ে তোমার গাল লাল করে দিবো।”
“আমিও পাল্টা আঘাত করে দিবো।”
“বেয়াদপ।”
“বদমেজাজি।”
“মুখে মুখে তর্ক করা তোমার একটা স্বভাব তাই না?”
“মানুষকে অপমান করা আপনার একটা স্বভাব তাই না?”

এদের তর্ক এসে শুনতে পায় পারুল বেগম।রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে দাড়ালেন।দর্শন রেগে গিয়ে ঘুষি দিলো মিখছেপে।আটার কৌটা পড়ে ঢাকনা খুলে সব আটা পড়ল দুজনের মাথায়।রান্নার সময় শোভা মাথায় কাপড় রাখেনি।কারণ দিদার বাসায় নেই।দাদাজানের সাথে ডাক্তারের কাছে গেছে শরীরের অবস্থা জানতে।দীপ্ত ফরাজি এদিকে একা আসার অবস্থায় নেই।দর্শন তো নিজেই শোভার স্বামী।কিন্তু এমন পরিস্থিতি হবে জানলে বেচারি হিজাব খুলে না রেখে আজ মাথায় রাখতো।তার এতবড় লম্বা কালো ঘন চুল সব সাদা আটা আটা হয়েগেছে।এদিকে দর্শনের চাপ দাড়ি ও চুলগুলো সব সাদা হয়েছে।সাথে দুজনের ভ্রুও সাদা হয়ে আছে।শোভা নিজেকে দেখে বলে,“আপনার রাগের ফল আমি কেন ভুগছি?”

“কারণ আমার রাগের কারণ তুমি।”
বলেই আবারও লাথি মারতে যাবে শোভা বাঁধা দিয়ে বলে,“আর রান্নাঘরের উপর টর্চার করবেন না দয়া করে।ভুগতে কিন্তু হবে আমাদের দুজনকে।এখনও যে হলুদের কৌটা আছে উপরে।”
দর্শন মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে দেখে বড় বয়মে করে হলুদ রাখা।শোভা আবারও বলে,“পাশেরটাতে কিন্তু ঝালের গুড়ো আছে।”
“ধুর!”
বলেই চলে যাচ্ছে দর্শন।দরজার কাছে যেতে নিবে শোভা চিল্লিয়ে বলে,“রাগ মাথায় যেন ভুলে যাবেন না আপনার মাথায় আটা লেগে আছে।পানি ঢালার আগে মাথা ঝেড়ে নিবেন।নাহলে পানি লাগলে চুলগুলোতে আটা আরো বেশি মিশে যাবে।”

দর্শন সামনে পারুল বেগমকে মিটমিট করে হাসতে দেখলো।পারুল বেগম মুখে আঁচল গুঁজে হাসছেন কিন্তু দর্শনের চাহনি দেখে থেমে গেলেন।দর্শন রাগমিশ্রিত চাহনি কিন্তু কন্ঠ স্বাভাবিক করে বলেন,“এই মেয়েকে দিয়ে চাচ্ছেন সংসার করাতে তাও আমার সাথে?পারবে ও?”
“ঠিক পারবে।তোকে অনেকটা ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে দেখতে পাচ্ছি।”
দর্শন আর কথা বাড়ালো না।সোজা চলে গেলো সিঁড়ি দিয়ে উপরে।পারুল বেগম ভিতরে ঢুকে শোভার চুলগুলোতে হাত দিয়ে বলেন,“কি একটা অবস্থা হলো?তোর মা কত যত্ন করতো তোর চুলের।সেই চুলে কিনা আটা লাগিয়েছিস।”

“ইচ্ছা করে না তো।”
“আয় আমি ছাড়িয়ে দেই।”
“দুদিন গেলেও আটা সরবে না।”
“চেষ্টা তো করতে দে।”
শোভার মাথার চুলগুলো আলাদা আলাদা করে আটা সরিয়ে দিতে থাকে আর চুলার দিকে চোখ রেখে বলে,“তোর আব্বার জন্য পানি গরম লাগবে।গোসল করবে একটু পর।এখন তেল মেখে রোদে বসলো।দেরি হলে আবার গরমে তার গা চিটপিট করবে।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১২

“আব্বা গরমের মধ্যে গায়ে তেল মেখে রোদে থাকে?”
“ওনার অভ্যাস ওসব তাই।”
“ওওওও,আমি জানতাম না।তাই তো খড়ি সরালাম।”
“সমস্যা নেই।উনি কিছুই বলেন না এসব নিয়ে কিন্তু আমি তার কোনকিছুতে ত্রুটি রাখতে চাইনা।”
শোভা মৃদু হাসলো।পারুল বেগম বড় হাঁড়িতে পানি নিয়ে চুলায় বসিয়ে দিয়ে চুলা ধরালেন।ঢাকনা দিয়ে রাখলেন যেনো পানি দ্রুত ফুটে ওঠে।শোভার কাছে এসে বলেন,“দে আমি কিছুটা পরিষ্কার করে দেই।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here