বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৪
ইশরাত জাহান
বিকালের দিকে শোভা খাবার খেয়ে অপেক্ষা করছিল।কখন দর্শন এসে বলবে তৈরি হও কেনাকাটা করতে যাবো।কিন্তু নাহ!দর্শনের দেখা নেই।দর্শনের উপর থেকে আস্থা সরিয়ে যেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল ওমনি দর্শন গোসলখানা থেকে বের হয়।শোভার চোখ ওপরে।শোয়া থেকে উঠে বসে বলে,“আপনি এখনো ওর ভিতর ছিলেন?”
“দিসগাস্টিং।”
শোভা দিজার ঘরে গোসল করে।ওর মাথায় এখনও অল্প অল্প আটা লেগে আছে কিন্তু কিছু করার নেই।ধীরে ধীরে তেল দিলে উঠে যাবে।দর্শন আয়নার সামনে এসে চুল আছড়ে অনেক আটা বের করে।যেগুলো চিরুনিতে লেগে আছে।চিরুনির বেহাল অবস্থা দেখে শোভা মুখ টিপে হেসে দেয়।আয়নায় শোভাকে হাসতে দেখে বলে,“ইডিয়ট।”
শোভা ঠোঁট উঁচিয়ে বলে,“গন্ডার।”
দর্শন চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর ছুঁড়ে মেরে বলে,“দ্রুত রেডি হও।বাইরে যেতে হবে।”
“নিয়ে যাবেন তাহলে?”
“তাহলে কি আমার বোনের জামাকাপড় পরে থাকবে?”
“না না তা তো চাইছি না।”
“দ্রুত রেডি হয়ে আসো।আমি নিচে খেতে যাচ্ছি।”
বলেই আয়নায় নিজের চুলগুলো দেখে একটু ঠিক করে নেয়।শোভা উঠেই ওযু করে আছরের নামায অগ্রিম পড়ে নিলো।একটু পর আছরের আযান দিবে তাই।বাইরে গেলে নামাজ পড়ার সুযোগ যদি না হয় তাই আগে আগে পড়ে নিলো।বোরকা পরে মুখ ঢেকে বাইরে এসে দেখে দিজাও তৈরি হয়েছে।মুখ গোমড়া করে বলে,“তোমরা একা যাবে তা না আমাকে আবার দিদার ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে।”
“তাতে কি হয়েছে?একসাথে আনন্দ হবে।”
“ভাই থাকলে ওখানে আনন্দ!”
“এটাও ঠিক।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
দুজনে নিচে এসে দেখে দর্শন হাত ধুচ্ছে।দিদার এসে বলে,“আমি রেডি।”
দাদাজান বলেন,“শোনো দাদুভাই ওদেরকে যখন নিয়েই যাচ্ছো তাহলে দিদার দাদুভাইকে একটু ফিটফাট দেখতে একটা কোর্ট কিনে দিও।পরশুই তো যাবো মেয়ে দেখতে।”
দর্শন বিরক্তি চাহনি দিলেও দিদার লাজুক হাসি দেয়।যেটা দেখে দিজা মুখ বেঁকিয়ে বলে,“বেশি লাফাস না।আমার মনে হচ্ছে তোর এই বিয়েটা হবেনা।মনটা সায় দিচ্ছে না আমার।”
“আমার বিয়েতে তোর মন এত সায় দেওয়ার কি আছে?”
“বোন তো ভাইয়ের জন্য এমন হতেই পারে।”
“জীবনেও তো আমার জন্য কিছু করলি না।এখন আবার বোন হতে এসেছিস!”
“তোর ভালো চাওয়াই উচিত না।”
“চাইতে বলছি তোকে ভালো?আমার অভিভাবক আছে অনেক।”
“ঠিক কাজ করে ভাইয়া যখন তোকে মারে।”
“তোকেও তো মারে।”
“গুনে গুনে দেখ তোর থেকে কম মারে।”
“মুখে মুখে তর্ক করিস?আমার থেকে এবার একটা খাবি।’’
“আমার গাল কি তোর বাবার সম্পত্তি?”
শোভা বিড়বিড় করে বলে, “আমার গালটাও তো আমার শ্বশুরের সম্পত্তি না।তাও কেন মার খাই?”
দিজা শুনতে পেয়ে বলে,“তোমার স্বামী কারো সম্পত্তি দেখে না তাই।”
শোভা মন খারাপ করে দর্শনের দিকে তাকালো।দর্শন চলে যাচ্ছে।দিজা এবার শোভাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,“চলো দ্রুত।”
তিনজনে চলে গেলো।দিজা ও দিদার গাড়িতে উঠে বসতেই শোভা বেক্কল হয়ে দাড়িয়ে আছে।দিজা ভ্রু কুঁচকে বলে,“তোমার কি হলো?”
“আমি কোথায় বসবো?”
“সামনে,ভাইয়ার পাশে বসবে।”
শোভা সামনে তাকিয়ে দেখে দর্শন স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে রেখেছে।চোখ তার সামনের রাস্তার দিকে।শোভা এখনও উঠছে না।এটা দেখে দর্শন বিরক্তিতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,“দিদার সামনে আয়।নাটক দেখার সময় নেই।”
কেঁপে উঠলো গাড়ি।লাফিয়ে উঠলো দিদার ও দিজা।দিদার উঠতে নিবে ঠিক তখনই দিজা দিলো দিদারের পায়ে একটা চিমটি।ব্যথায় বসে পড়ল।দিদার রাগ করে বলে, “মারলি কেন?”
“মারলাম কোথায়?”
“চিমটি দিলি কেন?”
“বেক্কল স্বামী স্ত্রী একসাথে বসে।দুদিন পর বিয়ে করবে এখনও বড় ভাইয়ের সংসার গোছানোর ব্যাপারটা বুঝল না।”
দিদার সামনে আসছে না দেখে দর্শন হুংকার ছেড়ে ডাক দেয়,“দিদার!”
দিদার লাফ দিয়ে বলে,“আমার কোমরে ব্যাথা করছে ভাই।সামনে বসতে কষ্ট হবে এক সিট যে।”
“তোর কোমর আমি ভেঙ্গে দিবো।”
এবার শোভা সাহস করে দর্শনের পাশে বসে বলে, “দিজা তোমার ভাইকে বলো গাড়ি চালাতে,কারো কোমর ভাঙতে হবেনা।”
দর্শন আড়চোখে শোভাকে দেখে বলে,“প্রথমে নাটক না করলেই হতো।”
“বুঝতে পারিনি যে আমার দেবর ও ননদ এতকিছু করবে।প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি যে বদমেজাজি আমাকে হয়ত পাশের সিটে বসতেই দিবেন না।”
“তাহলে এখন বসলে কেন?”
“কারণ আমি ভেবে দেখলাম আমি না বসলে আপনি আর আপনারা তামাশা করতে থাকবেন তাই।নাহলে আপনার মত রাগী লোকের পাশে বসার ইচ্ছা আমারও নাই।”
“আমি তোমার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি মেয়ে।”
পিছন থেকে দুই ভাইবোন ওদেরকে দেখে বিড়বিড় করে বলে,“আমরাও।”
দর্শন শুনতে পায় স্পষ্ট।শোভাও শুনতে পেয়ে বোরকার ভিতর হাসলো।দর্শন কথা না বলে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো।দিজা আচমকা বলে,“একটু গান চালাও ভাইয়া।ভালো লাগবে গাড়িতে।”
দর্শন গান চালাতে নিলে শোভা বলে,“গাড়িতে থাকলে কিছু দোয়া পাঠ করতে হয়,গান শুনতে নেই।এগুলোতে বিপদ আপদ থাকে তাই।”
দর্শন হাত বাড়িয়ে আবার পিছিয়ে নিলো শোভার কথা শুনে।সিটি প্লাজার গলির সামনে দিয়ে গাড়ি পার্কিং করলো।চারজনে বের হয়ে চলে গেলো সিটি প্লাজায়।ওখান থেকেই কেনাকাটা করে দিজা ও দিদার।তাই দর্শন এখানে আনলো তিনজনকে।শোভাকে নিয়ে সালোয়ার কামিজ দেখছে।সবই আধুনিক ও দামি।শোভা সব দেখে বলে,“এগুলো সারাদিন পড়ে থাকলে তো আমি গরমে শেষ।”
“আরেহ এগুলো তো বাইরে গেলে পরবে।বাসার জন্য সুতির নিবো।”
“আমি তো বাইরে বোরকা ছাড়া বের হইনা।এত মডার্ন আমি না।”
শোভার কথাটা শুনে এক পলক শোভার দিকে চোখ রাখলো দর্শন।মুখটা ঢেকে রাখা থাকলেও মেয়েটার কথা কেন জানি তার ভালো লাগলো।গাড়িতে যেভাবে ইসলামিক কথা বলেছিল এমনিতেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এছাড়া এখন জানালো এসব আধুনিক সালোয়ার কামিজ নিবেনা।এগুলো দর্শনের কাছে ভালো লাগার দিক হয়ে গেলো।এদিকে দোকানের কর্মচারী ডাক দিলো,“ভাই এই কোর্ট কি পছন্দ হয়?”
দর্শন মুখ ঘুরিয়ে কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে বলে,“যার জন্য নিতে এসেছি তাকে জিজ্ঞাসা করুন।”
“সে তো আপনার দিকে চেয়ে আছে।”
দর্শন এবার দিদারের দিকে ফিরে বলে,“তোর যেটা পছন্দ হবে তুই নে।”
দিদার খুশি হয়ে নিজের পছন্দের কোর্ট নিলো।শোভাকে নিয়ে ওদের কাছে আসলো দিজা।জানালো,“দুটো সালোয়ার কামিজ নিয়েছি।ভাবী বেশি নিতে না করেছে।”
“তোর জন্য নিয়েছিস?”
“দাদাজান সেদিনকেই আমাকে শপিং করার সুযোগ করে দেয়।তাছাড়া ঢাকায় গিয়ে গাউছিয়া থেকে নিবো ভাবছি।”
দর্শন উঠে দাড়ালো টুল থেকে।তারপর ক্যাশ কাউন্টারে টাকা দিয়ে বাইরে এলো।সিটি প্লাজার কাপড়ের দোকানগুলোর পাশেই রেস্টুরেন্ট।ওখানে ঢুকলো চারজনে।দিজা ঢুকেই বলে,“আমি আমেরিকানো চপ সুই খাবো।এখানকার এই খাবারটা বেস্ট।”
দিদার মুখ বেঁকিয়ে বলে,“অতখানি খাবার তুই খেতে পারবি?”
“আমরা চারজন আছি তো।হয়ে যাবে।”
“আর কি কি খাবি?”
দর্শনের প্রশ্নে দিজা বলে,“বাটার স্কোজ।”
দর্শন অর্ডার দিতে আসলো।অর্ডার দিয়ে এসেই দেখলো এতক্ষণ শোভার পাশে দিজা থাকলেও এখন শোভার পাশের জায়গা ফাঁকা।দিদারের কাছে গেছে দিজা।দর্শন হতাশ হয়ে তাকালো।রেস্টুরেন্টে সিনক্রিয়েট করলে লোকজন দেখবে তাই চুপচাপ বসে শোভার পাশে।শোভার বোরকা একটু মেলে রাখা ছিল।তাই বসতে গিয়ে শোভার বোরকার উপরে বসে। এতে অবশ্য দুজনের সমস্যা হয়না কিন্তু এতটা কাছাকাছি বসায় অস্বস্তি লাগছে দুজনের।প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিট পর ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেলো।শোভা খাবার দেখে ভাবছে কীভাবে খাবে!তবে বেশি অসুবিধা হলো না।ওয়েটার চারটা আলাদা প্লেট ও চারটা কাটা চামচ সাথে চারটা গোল চামচ দিলো।খাবারের উপর ছুরি রাখা আছে।যেটা দেখে শোভা মনে মনে বলে,“খাবারের উপরেও ছুরি থাকে!”
দিজা উপর দিয়ে কেটে চারভাগ করে খাবার।তিনটি প্লেটে সমানভাগ করে বলে,“আমি এটাতেই খাবো।”
ওয়েটার অভ্যস্ত দিজার এমন কান্ডে।এর আগেও কলেজ শেষ করে এখানে এসে খেয়েছে।খাবার খাওয়ার সময় বান্ধবীদের সাথে ভাগাভাগি করে খায়।তাই এগুলো জানা আছে।উনি চলে গেল বাটার স্কজ আনতে।শোভা সামনের দুজন ভাইবোনকে খেতে দেখছে।আসলে অনুসরণ করে।দেখলো এটা একদম নুডুলসের মতোই খেতে হয়।এমনকি দেখতেও নুডুলসের মত কিন্তু একটু ভিন্ন।দিজা দুই গাল খেয়ে শোভার দিকে তাকিয়ে বলে,“খাও।”
শোভা একবার দিদারের দিকে তাকিয়ে ভাবছে মুখ খুললে তো সর্বনাশ।চামচে অল্প করে নিয়ে নিকাব হালকা উঁচিয়ে গালে নিলো।খুব মজা লাগলো কিন্তু এভাবে খেতে কষ্ট তাই বলে,“তোমরা খাও।আমি আর খাবো না।”
দর্শন ভ্রু কুঁচকে তাকালো।কিছুক্ষণ পর দিজা জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে,“সরি সরি মাথায় ছিলো না যে তুমি পর পুরুষের সামনে মুখ খোলো না।দিদার ভাই চল আমরা অন্য টেবিলে বসি।”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৩
বলেই ফাঁকা টেবিল খুঁজলো।দর্শন চেয়ে আছে শোভার দিকে।মেয়েটার বিষয়ে যত আইডিয়া রাখছে তত মুগ্ধ হচ্ছে।একবার ভাবলো তার জন্য ভালো কেউই এসেছে।আবার নিজেকে বেশি ভাবনায় না রাখার সিদ্ধান্ত দিলো।ওরা যেতেই দর্শন একটু ঝুঁকে খাবারে মনোযোগী হলো।কারণ শোভার মুখ যেন কেউ দেখতে না পারে।শোভা নিকাব উঁচিয়ে এবার খেতে শুরু করে।খেতে এবার তার বেশ ভালই লাগছে।দর্শন আড়চোখে দেখছে শোভার খাওয়া। বাটার স্কজ নিয়ে যেই ওয়েটার আসে শোভা মাথা থেকে নিকাব নামিয়ে মুখ ঢাকে।ওয়েটার দুই জায়গায় কেক রেখে চলে গেলে শোভা আবারও মুখ খুলে খাবার খায়।দর্শন সবকিছুই অবলোকন করেছে।মনে মনে কেমন যেন ভালো লাগা কাজ করছে।মেয়েটা আর বাকি মেয়েদের না বরং ভিন্ন।