বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৩
ইশরাত জাহান
রাতের গভীর নীরবতা।হাসপাতালের করিডোরে কেবল কিছু ঘোলাটে আলো জ্বলছে।দরজার বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দর্শন।তার চোখে বিষণ্ণতা আর অপরাধবোধের ছাপ।কেবিনের ভিতরে বিছানায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছেন দাদাজান।নাকে অক্সিজেনের পাইপ কপালে ভাঁজ।পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে দুজন নার্স।তাদের কণ্ঠে কথোপকথন শোনা যাচ্ছে।একজন নার্স বলে,“দুদিন কিছু খাননি।শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতা, বয়সও কম নয়।”
অপরজন বলে,“তার কোন মানসিক ধাক্কা লেগেছে বুঝি?”
“হ্যাঁ,পরিবারের কারো কথা বলছিলেন বারবার নাতবউ শোভার কথা।”
কথাগুলো শুনে দর্শন অপরাধবোধের সাথে দাদাজানের দিকে তাকায়।ধীর পায়ে এগিয়ে আসে দাদাজানের কাছে।দাদাজান চোখ মেলে দর্শনকে দেখেন।গলা শুকনো তবু বলার চেষ্টা করেন,“আমার শেষ ইচ্ছেটা কি পূরণ হবে না দাদুভাই?ও মেয়েটাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি।তুমি কখনও ঠকবে না।ও অনেক ভালো মনের নরম স্বভাবের।অহংকার লোভ কোনোটাই নেই ওর মাঝে।আমি তোমায় সুখে সংসার দেখতে চাই।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
দর্শন কিছু বলে না।চুপচাপ কেবিন থেকে বের হয়ে যায়।যাওয়ার আগে সকলের দিকে চোখ রাখলো।দিদার তো ভয়ে নিজের চোয়ালে হাত রেখে ভয়ে চুপ আছে।দাঁতে এখনও ব্যাথা আছে তবে অল্প।বাইরে এসে দর্শন দাদাজানের কথা ভাবছে।দুদিন না খাওয়ার পণ করেছে তাই পালন করলেন তিনি।দর্শন এতবার রাগ দেখালো যে দাদাজান শেষমেষ হাতিয়ার হিসেবে নিজেকে ঝুঁকিতে রাখলেন।তাও যদি নাতিটার সুখ দেখতে পায়।দাদা দাদী বা নানা নানী নাতি নাতনির জন্য সবসময় দুশ্চিন্তা করেই যান।
বাড়িতে এসে বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় দর্শন।চোখ বন্ধ করতেই ছোটবেলার এক দৃশ্য চোখে ভাসে।বাবার হাত ধরে স্কুল ব্যাগ কাঁধে করে হাসতে হাসতে বাড়ির দিকে আসছিল।মাঝেই একটা পার্ক বাদে।সেখানে দর্শন তার মায়ের মত কাউকে দেখে বাবা দীপ্ত ফরাজিকে জানায়,“বাবা বাবা ঐ দেখো মায়ের মত লাগে।”
দীপ্ত ফরাজি ছেলের কথা না বুঝে হাসি মুখে পার্কের দিকে তাকিয়ে দেখেন তার প্রথম স্ত্রী মানে দর্শনের বায়োলজিক্যাল মা।একজন অচেনা পুরুষের হাত ধরে কান্না করে কিছু বলে পর মুহূর্তে আলিঙ্গন করে।ওখানেই রাগ দেখিয়ে দীপ্ত ফরাজি এগিয়ে গেলেন ওদের মাঝে।দর্শন নিজেও যায় পিছু পিছু।বাবা মা ও তৃতীয় ব্যক্তির মধ্যে তর্ক বিতর্ক চলে। এক পর্যায়ে দীপ্ত ফরাজিকে এতগুলো লোকের সামনে ধাক্কা দিয়ে দর্শনের মা বলে,“তোমার মত সুগার ড্যাডি আমি চাইনি।আমার বয়স অনুযায়ী তোমার মত বয়স্ক লোককে কখনও আমার সাথে মানায়না।”
“তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন?”
“পরিবারের চাপে।আরে বয়সের পার্থক্য দেখো সাথে তোমার মাথায় আছে একটা ফাঁকা মাঠ।কি বিশ্রী লাগে দেখতে।সংসার করার রুচিটাই নেই।”
রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বলে দিলো কথাগুলো।আশেপাশের সবাই হাসাহাসি করে।দীপ্ত ফরাজি অপমানবোধ করলেও ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,“আমাদের সন্তান আছে।ওর কথা ভেবে সংসার করো।তোমাকে কোনদিন বিরক্ত করব না।শুধু আমাদের পরিবারের সম্মান ধরে রাখো।এখান থেকে চলো।”
দর্শন নিজেও জড়িয়ে ধরে তার মাকে কিন্তু মায়ের সেই প্রেমিক যেন মাকে নিয়ে যেতে চায়।কিছু আশা জাগিয়েও দিলো মায়ের মনে।মায়ের মন তখন লোকটার রূপ ও বয়সের দিকে ঝুঁকে ছিল।তাই তুচ্ছ করে দিলো মাতৃত্বের অধিকার।ওইদিন পরিবারের সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে চলে গেলো প্রেমিকের হাত ধরে। যাওয়ার সময় রাগ দেখিয়ে সুফিয়া বেগম দর্শনের ফুফু কিছু বললে দর্শনের মা জানায়,“যে পুরুষের মধ্যে থাকেনা সাহসিকতা যে পুরুষ মিনমিন করে তার সাথে সংসার করে কিভাবে?একটা কথা বললে মাইনকা পুরুষের মত রাজি হয়।কেউ অপমান করলে বলদের মত অপমান হয়ে ফিরে আসে।যা একটু বয়স মানিয়ে চলতাম এখন দেখি পরিবেশে চলাও যায়না।ছেলেটাকেও তো ওরকম বলদ বানাচ্ছে।বাপ ব্যাটা দুজনেই বলদের কারখানা।আমি পাগল হয়ে যাবো।তার আগেই বিদায় নিলাম।কাপুরুষ বাপ ব্যাটা গলা ঝুলিয়ে সংসার করুক।”
কথাগুলো দর্শন না বুঝলেও দাদাজানকে অনেকবার প্রশ্ন করে।উত্তর পায়নি এই প্রশ্নের।এরপর যাকে পায় তাকেই প্রশ্ন করে সুফিয়া বেগমকেও প্রশ্ন করেছিলেন।শেষমেষ ফুফুর থেকে উত্তর পেয়ে রাগে গজগজ করতে করতে দর্শন বড় হয় নিজের মত।এরমাঝে বাবার বিয়ে হয়।পারুল বেগম মানুষটা যেন দর্শনের আপন মা।দর্শন তাকে সম্মান করে কিন্তু নিজের রক্ত যখন আঙুল দেখিয়ে অপমান করে চলে যায় ওটাই মনে জমা থাকে বেশি।দর্শনের অবস্থা ঠিক তাই।ওর মনে পারুল বেগমের সততা জমেনি জমেছে নিজের মায়ের নোংরা দৃশ্য ও অপমান।সেই থেকে দর্শন হয়েছে রাগী ও জেদি।নারীদের প্রতি তার ঘৃণা অনেক।যুগে যুগে আরো নতুন মেয়েদের বাইরে সমাজে নোংরা অবস্থায় দেখে আরো বেশি ঘৃণা লাগে।এই যেমন বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডকে নাইট ক্লাবে ধরা পড়তে দেখেছে আবার প্রতিবেশী কারো বউকে পরকীয়া করতে শুনেছে।ঘৃণা জমতে থাকে দর্শনের মাঝে।
সকাল বেলা,
দর্শন গাড়ি চালাচ্ছে নিজ মনে।গাড়ির ভেতরে দর্শনের চোখে কঠিন দৃঢ়তা আর মনেমনে হাজারো স্মৃতি।
শোভার বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে দরজা ধাক্কাতে থাকে।আগে ছিল বেড়া দিয়ে ঘেরা এখন আছে লোহার দরজা।শোভা মাথায় কাপড় দিয়ে সুন্দরভাবে নিজেকে ঢেকে নিলো।দৌড়ে এসে দরজা খুলে বাইরে চোখ রেখে পুরুষ মানুষের পা দেখে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে নরম কণ্ঠে বলে,“কাকে চাই?”
“শোভা।”
নিজের নাম শুনে কাঁপা কণ্ঠে শোভা বলে,“আমাকে?আপনি কে?”
“দর্শন।”
শোভা নামটা শুনে বিষ্ময়ে উপরে তাকালো।কপালের কাপড়টা এগিয়ে এলো।যার ফলে লোকটার মুখ দেখতে পেলো না।বিরক্ত লাগলো যেন ওড়নার প্রতি।কন্ঠ নরম রেখেই বলে,“ভেতরে আসুন।”
দর্শন বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখে পরিবেশ আগের থেকে পরিবর্তন।আহামরি উন্নত না হলেও দেখতে ভালই লাগছে।ওইদিন বাড়িতে ঢুকে মনে হয়েছিল তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে যাই।আজকে বাড়ির উঠোনে দখিনা বাতাস পাচ্ছে।এরা মনে হয় বুদ্ধি করে এদিকটায় গাছ লাগিয়েছে।পাখার প্রয়োজন হবেনা।উঠানে আছে একটি চৌকি।শোভা বসতে বলে দৌড়ে গেলো ভিতরে।মিতুর কাছে এসে বলে,“উনি এসেছেন ভাবী।”
মিতু বুঝলো না তাই বলে,“উনিটা আবার কে?”
“দর্শন ফরাজি।”
মিতুর হাসিমুখটা কেমন যেনো হলো।ননদের জন্য চিন্তা হচ্ছে।এই লোক না জানিয়ে এলো কেন!ভাবতে ভাবতে বলে,“নাস্তা পানির জোগাড় করতে হবে তো।বেশি কিছু তো নেই।একটা আপেল আছে আর ছোট এক প্যাকেট বিস্কুট।আমি চা বানাই তুমি ওগুলো প্রিজে সাজাও।”
“ভাইয়া কোথায়?”
“ঔষধ সাপ্লাইয়ের কাজে গেছে।আজকে তো মঙ্গলবার।”
“ওহ,আমি যাচ্ছি তাহলে।”
দর্শন যেনো রাগে ফেটে যাচ্ছে।এসেছে মেয়েটার খোঁজে এরা মেয়েটাকে না এনে এদিক ওদিক ছুটছে।বিরক্তিতে হাত মুঠ করে দাঁত খিঁচে বসে আছে।একটা সময় দেখতে পেলো চার বছর বয়সী এক বাচ্চাকে।তাকে দেখেই দর্শন মোটা কন্ঠ বলে,“এই পিচ্চি শোনো।”
মৌলি এগিয়ে এসে পিটপিট চোখে তাকায়।এই স্বভাবটা মৌলি পেয়েছে শোভার কাছ থেকে।দর্শন কর্কশ কন্ঠে প্রশ্ন করে,“শোভা কোথায়?”
“পিপি রান্নাঘরে।”
বলেই দৌঁড় দেয় মৌলি।দর্শনের চোখ দেখেই ভয় পেয়েছে।এই ছেলে যেমন রাগী স্বভাবের তেমনই এখন দেখতেও।প্রতিনিয়ত এভাবে চলাফেরা করার দরুন অবস্থা এমন হয়েছে।শোভা খাবার এনে চৌকিতে রাখে দর্শনের পাশে।মিতু ভালোভাবে হিজাব বেঁধে সামনে এসে বলে,“আসসালামু আলাইকুম ভাইজান,কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম,ভালো আছি।শোভা কোথায়?”
মিতু এক পলক চাইলো শোভার মুখের দিকে।মনে মনে বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,“ব্যাটা এটাই তোর বউ যাকে রেখে পালিয়েছিলি।”
মনের কথা মনের মাঝে গোপন রেখে বলে,“এই যে ভাইজান শোভা।কিছু বলবেন?আমি কি চলে যাব?”
মিতু ভাবছে ওদেরকে আলাদা কথা বলার সুযোগ দিবে কি না।দর্শন মাথা উঁচিয়ে এক পলক চাইলো শোভার দিকে।মেয়েটার মুখ দেখা গেলো না।শুধু চোখদুটো দেখা গেলো।কিন্তু শোভার নজর মাটিতে।দর্শনের দিকে তাকালো না এখনও। এতে দর্শনের যায় আসেনা।মৌলি খাবার খেতে ব্যাস্ত।দর্শনের পাশে দাঁড়িয়ে একবার দর্শনকে দেখে সুযোগ বুঝে বিনা অনুমতিতে টুকটুক করে আপেল বিস্কুট নিয়ে গালে পুড়ছে।মিতু চোখ গরম করে মৌলির কান টেনে নিয়ে আসে নিজের কাছে,“ফুফা তোমাকে পঁচা বলবে।”
বাচ্চা মৌলির মনক্ষুন্ন হলো।মিতু চোখ দিয়ে না ইশারা করে দর্শনের দিকে ফিরে বলে,“আপনারা কথা বলুন আমি যাচ্ছি।”
দর্শন তড়িৎ গতিতে জানায়,“আমি ওকে নিতে এসেছি।”
শোভার মনে যেনো শান্তি মেলে।মুখে হাসি ফুটে ওঠে যেটা কেউই দেখতে পায়না।হিজাবের নিকাব দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার কারণে।মিতু একবার শোভার দিকে ফিরে আরেকবার দর্শনকে দেখে বলে,“এখনই যাবেন নাকি উনি এলে যাবেন?”
দর্শন বুঝলো না বিধায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো।মিতু গলা খাকারি দিয়ে বলে,“শোভার ভাইয়ের কথা বলছি।উনি বাসায় নেই তো তাই।”
দর্শন জানায়,“দাদাজান অসুস্থ হাসপাতালে ভর্তি।আমাদের দ্রুত যেতে হবে।”
মিতু কিছু বলবে ভাবছে তার মধ্যেই শোভা দৌঁড়ে গিয়ে বোরকা পড়ে।দাদাজানকে অনেক ভালোবাসে শোভা।এই ব্যক্তি শোভার জীবনে অনেক অবদান রাখে।প্রায় দিন এসে চৌকিতে বসে গল্প করে সবাই মিলে।শোভার খোঁজ খবর রাখে।মৌলিকে কতকিছু এনে দেয়।দাদাজানের মানবিকতা শোভাকে দাদাজানের প্রতি স্নেহ বাড়িয়ে দেয়।তার অসুস্থতার কথা শুনে শোভা দাড়িয়ে থাকতে পারেনি।দ্রুত বের হয়ে বলে,“আমি রেডি।”
কালো বোরকা কালো হিজাব ও নিকাব সাথে হাত পায়ে কালো মোজা।চোখটাও এবার দেখা যাচ্ছে না।কারণ চোখেও হিজাবের উপরের অংশ দিয়ে ঢাকা।মিতু কিছু বলতে নিবে তার আগেই পারুল বেগমের কল আসে।কথা বলা শেষ করে শোভার কাছে এসে বলে,“সাবধানে যেও।আমার মোবাইল নিয়ে যাও।কাজে লাগবে তোমার।”
শোভা মোবাইল নিয়েই মৌলিকে একটু আদর করে বের হয়।দর্শন আগেই গাড়িতে উঠে বসেছে।শোভা পাশে বসতেই দর্শন গাড়ি চালানো শুরু করে বলে,“শোনো মেয়ে আমার থেকে দূরে থাকবে।তোমায় নিতে এসেছি নিজের জন্য না।শুধুমাত্র দাদাজানের জন্য।”
শোভা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।পর্দার আড়ালে তার চোখে পানি।দর্শনকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে যুবকটির মুখে খোচা খোচা দাড়ি চুলগুলো স্টাইল করে রাখা।শোভার ঠোঁটে নিঃশব্দে ফুটে ওঠে, “দাদাজান কেমন আছেন?”
“তোমার কারণে না খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি।এসবের জন্য আমাকে দায়ী করা হচ্ছে।লাইক সিরিয়াসলি!এই বিয়েতে আমি দায়ী?”
“আমিও তো দায়ী না।”
“তাহলে বাসায় বলো এই বিয়ে তুমি মানো না।”
শোভার কান্না পাচ্ছে।এই লোকটা বিয়েই মানে না।তাহলে মর্যাদা দিবে কিভাবে?অনেক কষ্টে ঠোঁট নাড়ালো,“আপনি কেন বলছেন না?”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২
“প্রত্যেক মুহূর্তে প্রসঙ্গ উঠলেই আমি বলে দেই কিন্তু আমার কথা শুনবে কে?”
শোভার রাগ বাড়লো।এই লোক তাকে অপমান করলো।এটা মানতে পারবে না সে।শোভার নিজেরও আত্মসম্মানবোধ আছে।মেয়ে বলে কি যা না তাই শুনবে!কখনোই না।সংসার হোক বা না হোক দুই চারটে কথা সেও শুনিয়ে দিবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা…