বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২২

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২২
ইশরাত জাহান

দোতালা বিশিষ্ট পুরনো ধাঁচের বাড়ি।নব্বই দশকের ঘরদোর।নিচতলায় কোনো থাকার ঘর নেই।বড় এক উঠান পাশে লোহার গেট।ডান পাশে রান্নাঘর,গ্যারেজ আর এক কোণে আলাদা গোসলখানা।চারপাশে গাছপালা আর সেই পুরনো দিনের নিরবতা যেন এখনও জমে আছে।দিজার হাত ধরে শোভা গাড়ি থেকে নামে।মাথায় কালো ওড়না টেনে ধরে। বোরকাতে লেগে আছে শোভার বমি।বেচারি মাঝরাস্তায় বমি করে কাহিল হয়ে আছে।চোখে ক্লান্তি সাথে একটু অভিমান।নতুন বাড়িতে আসা মানে নতুন সংসার কিন্তু তাও তো মাত্র একমাসের।একমাসের মধ্যে চলে গেলো কয়েকদিন।

উপরে তিনটি ঘর।একটায় পর্দা হালকা নড়ছে বাতাসে।দেয়ালে ধূসর রঙ করা।দরজায় কাঠের কাজ।দর্শন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে নির্লিপ্ততা মুখ গম্ভীর কণ্ঠে কোনো আবেগ নেই।দর্শন ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,“ওপরেই তিনটা ঘর। একটা দিজা তোর একটা আমার।আরেকটা খালি আছে।”
শোভা থেমে যায় সিঁড়ির মাঝপথে।চোখে জিজ্ঞাসা ঠোঁটে অভিমান কাজ করছে।বুঝতে পারল তার ইঙ্গিতে কিছু বলছে দর্শন।শোভা ধীরে ব্যথা চেপে বলে,“আমার জন্য কোন ঘরটা রাখা হয়েছে বলে দাও দিজা আপু।”
এক মুহূর্ত নিরবতা।বাতাস যেন থমকে যায়।দর্শনের মুখে কোনো পরিবর্তন নেই।দিজা অবাক হলেও সবাইকে দেখিয়ে মৃদু হেসে বলে,“তোমার স্বামীর ঘরটাই তো তোমার।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“স্বামী ঠিকই আছে কিন্তু কিছুদিনের।যার কারণে তার ঘরে থাকাটা বেমানান লাগছে।”
“এতদিন তো…
“এতদিন অধিকার দেখানোর চেস্টা করেছিলাম কিন্তু কেউ অধিকার না দিলে জোর করা যায়না।বেশি কথা বলতে ভালো লাগছে না।শরীর ক্লান্ত একটু বিশ্রাম নিবো।”
“দিজা ওকে জানিয়ে দে ওর যেখানে ইচ্ছা থাকতে পারবে।”
বলেই দর্শন চলে গেলো।আসলে ব্যাটা ইঙ্গিত দিলো যে বুঝে শোভা তার কিছুই বুঝেনি।সাথে বুঝেনি দিজা নিজেও।শোভা বলে ওঠে,“তুমি কোন ঘরে থাকছো?”
“দক্ষিণের ঘরটা।তুমি চাইলে আমার সাথেও থাকতে পারো।”
“অসুবিধা হবেনা তোমার?”
“না,আমার অসুবিধা নেই কিন্তু তুমি এটা বলো কিছু হয়েছে কি?”
“কিছুই হয়নি আমার।”
“ভাইয়ার থেকে দূরে যাচ্ছো কেন?”

“কারণ যে আমাকে দূরে রাখতে চায় তাকে কাছে আনার চেষ্টাটা সবসময় করা যায়না।সহ্যের একটা সীমা থাকে।আমার শেষ সেই সহ্য ক্ষমতা।”
দিজা বুঝে নিলো এরা স্বামী স্ত্রী কোনো এক কান্ড ঘটিয়েছে।কপালে হাত রেখে চলে গেলো ঘরে।ঘরগুলো পরিষ্কার ও চারটা ফার্নিচার রাখা।জানালার গা ঘেষে বিছানা তার সাথে পড়ার টেবিল অন্যপ্রান্তে ড্রেসিং টেবিল ও পাশে আলমিরা।শোভা সব দেখে বলে,“এগুলো কে সাজালো?”
“আমার খালাতো ভাই আছে ভাইয়ার আন্ডারে কাজ করে।সেই এসব গুছিয়েছে।”
শোভা চারপাশ দেখছে।দিজা জানালা খুলে দিতেই ফুরফুরে বাতাস অনুভব করছে।বিকালের দিকে সূর্যের তাপ নেই।মুগ্ধকর পরিবেশে দিজা চোখ বন্ধ করে বলে,“আমি এসেছি মিস্টার তুহিন আমি এসেছি।আপনার মন জয় করতে আমি এসেছি।কাল থেকে দেখা হবে আমাদের।আমি আপনাকে পাওয়ার জন্যই এতদূর খেটেছি।এত বুদ্ধি সাজিয়েছি।আমি জানি আপনার জীবনে কেউ নেই।তাই আমি সবার আগে আপনার মনে জায়গা করে নিতে চাই।যেনো আমি আপনাকে পাই।”

ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে দর্শন কল করে তুহিনের কাছে।তুহিন ধরেনা।মিনিট বিশ পর কল দিয়ে বলে,“ক্লাসে ছিলাম।কোথায় তুই?রওনা দিয়েছিস?”
“পৌঁছে গেছি।”
“কি বলিস?আমাকে আগে জানালি না তো।দুপুরে খেয়েছিস কি?”
“না,ওরা দুজন হালকা পাতলা নাশতা করেছে।আমি ড্রাইভিংয়ে ব্যাস্ত ছিলাম।”
“আমি খাবার নিয়ে আসবো?”
“কষ্ট করতে হবেনা।কাল তোদের কলেজে যাবো।দেখা হবে নাহয়।”
“আসার আগে জানাস।আমি তো ক্লাসে থাকি।”
“আচ্ছা,সন্ধ্যায় আমার অফিসে আসিস।দেখা হবে ওখানে।”
“আজকেই যাবি অফিসে?”
“এছাড়া কি করবো?”
“বিয়ে করেছিস বউ নিয়ে ঘুরবি না?”
“Stop talking nonsense.”
“ওকে ওকে রেগে যাস না।আমি আসব সন্ধ্যার পর।”

দর্শন কল কাটে।ওপাশে তুহিন নিজেও মৃদু হাসে।তার এই বন্ধুর রাগকে সেও খুব ভয় পায়।এখন শিক্ষক হয়ে সে এতটা রাগী না যতটা দর্শন।ফোন বন্ধ করতে স্ক্রিনে থাকা মেয়েটির ছবি জ্বলজ্বল করে। ওয়ালপেপারে দিয়ে রাখা।মেয়েটির বয়স তখন ছিল আনুমানিক ষোলো।ওই সময় চাকরির চেষ্টা করে তুহিন।রাস্তায় দেখতে পায় মেয়েটিকে।এই ভার্সিটি থেকেই কিছুটা দূরে।মেয়েটিকে তার হাওয়াই মিঠাই খাওয়া অবস্থায় দেখেছিল প্রথমে।তারপর ছুটে চলে যায় ঝালমুড়ির দোকানে।যেটা তুহিনের পাশেই ছিল।মেয়েটির গজ দাঁত বের করে হাসি দিয়ে হাত উঁচিয়ে বলে,

“আপু এদিকে আসো।ঝালমুড়ি খাবো।”
মেয়েটির বোন এগিয়ে আসে।এসেই বিরক্তির সাথে বলে,“এই দুপুর বেলা কে ঝালমুড়ি খায় রে?”
“আমি খাই।আমার খুব ভালো লাগে।”
“আম্মু আজ তোর জন্য এত এত রান্না করেছে।তুই কিনা এগুলো খাবি?”
“হ্যাঁ,আমি এগুলোই খাবো।বাসায় গেলে তো আম্মু খেতেই দেয়না।এখানে যতদিন আছি জ্বালাবে না।”
“পেট খারাপ করবে তোর।”
“ডাক্তার আছে তো এর জন্য।”
“তোর ইচ্ছা তুই খা।”
“খাবে না তুমি?”
“ডায়েট করি।”
“ভালো,আমি খাই তুমি দেখো কিন্তু নজর দিবেনা।”

মেয়েটির বোন মুখ ভেংচি দিলো।এরমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হলো।মেয়েটি ছুটে গেলো পাশের পার্কে ফাঁকা জায়গায়।বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।আশেপাশে তেমন কেউ নেই।কারণ তারা সবাই বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে ছাউনী খুঁজতে ব্যাস্ত।মেয়েটিকে ভিজতে দেখে তখনই তার কিছু ছবি তুলে নেয়।সাথে সাথে বলে,“আমার দেখা অমায়িক সুন্দরী বালিকা তুমি।”

এরপর প্রায়ই এখানে আসলে দেখা হতো কিন্তু আড়ালে থাকতো তুহিন।ঠিক একমাস পর আর খুঁজে পাওয়া গেলো না।তবে মেয়েটির সেই বোনের সাথে যোগাযোগ রেখেছে।জানতে পেরেছে মেয়েটি আসবে তাদের বাসায়।আসলেই তুহিনকে জানাবে।ওই বোনের থেকেই মেয়েটির বর্তমান কয়েকটি ছবি নিয়েছে।যেগুলো দেখে নিজে নিজে ছবির সাথে কথা বলে।অপেক্ষায় আছে মেয়েটির সামনে এসে তাকে ভালোবাসার কথা জানানোর জন্য।মেয়েটি এত দ্রুত। বিয়ে করবে না বলে তুহিন সময় নিলো।নাহলে কবেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতো তাদের বাসায়।

একটু বিশ্রাম নিয়ে বাইরে আসলো দর্শন।দিজার ঘরের কাছে গিয়ে দরজায় কড়া নেড়ে বলে,“আছিস?”
দিজা বাইরে এসে বলে,“হ্যাঁ ভাইয়া,বলো?”
“বাইরে থেকে খাবার আনতে যাচ্ছি।কি খাবি তোরা?বিরিয়ানি নাকি চাইনিজ?”
“আজ চাইনিজ না।তুমি বিরিয়ানি আনো।”
“ওর থেকে শোন।”
দিজা মনে মনে দুষ্টু হাসে।না বোঝার ভান করে বলে,“ও বলতে কার কাছে শুনবো ভাইয়া?”
দর্শন চোখ গরম করে তাকালো দিজা শুকনো ঢোক গিলে বলে,“ওওও ভাবী তুমি কি খাবে দুপুরে?ভাইয়া তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করতে বলেছে।”
দিজার চুল ধরে টান দেয় দর্শন।দিজা একটু কেঁপে উঠলেও স্বাভাবিক হয়ে থাকে।শোভা বলে,“তুমি যা খাবে তাই খাবো।”
দিজা মুখ ফিরে দর্শনের দিকে তাকালে দর্শন বলে,“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।”
দর্শন চলে যেতেই শোভা বলে,“গেছে?”

“হ্যাঁ।”
“তোমার ভাই তো বাইরের খাবার খায় না।”
“তাও তো ঠিক।কিন্তু আজকে বাসার খাবার কোথায় পাবে?”
“ঘর যদি গুছিয়ে রাখে রান্নাঘরেও নিশ্চয়ই কিছু রাখা আছে।চলো গিয়ে দেখি তার জন্য কিছু রান্না করা যায় নাকি।”
দিজা মৃদু হেসে বলে,“এত যত্ন আমার ভাইয়ের?”
“চলো!”
দুজনে নিচে গেলো।শোভা সব খুটিয়ে দেখে।সবকিছু খুঁটিয়ে শুধু চাল কিছু মশলা আর ডাল পেলো।সবজি মাছ মাংস এগুলো রাখেনি।সব দেখে শোভা ভাত চাপালো আর ডাল রান্না করে ঘন করে।যেনো শুধু ডাল ভাত খেতে পারে অন্তত।দিজা সব দেখছে আর ভিডিও করছে,“তোমার নতুন সংসারের সব স্মৃতি হয়ে থাকবে।”
শোভা মৃদু হাসলো।মনে মনে ভাবছে,“কতদিন থাকে এটাই বা কে জানে?”
দর্শন আসলো বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে।দিজা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসতেই দর্শন বলে,“রান্নাঘরে কি করছিলি?”

“রান্না।”
“কি রান্না?”
“তোমার জন্য ডাল ভাত।ভাবী রান্না করছিল,আমি ভিডিও করছিলাম।”
“কেন সে বিরিয়ানি খায়না?”
“খায় কিন্তু তুমি তো খাওনা।বাইরে থাকতে তো নিজের রান্না নিজে করে খেয়েছো।”
“এখানেও পারবো।তোদের কষ্ট করতে হবেনা।”
“আমি তো কষ্ট করিনি।করেছে তোমার বউ মানে আমার ভাবী।”
দর্শন তাকাতেই দিজা থেমে গেলো।রান্নাঘরের সামনের বড় ফাঁকা জায়গাটায় খাবারের টেবিলে রাখা।ওখানেই বিরিয়ানির প্যাকেট রেখে বলে,“খেয়ে নে তোরা।”
“তুমি খাবে না?”

দর্শন যেতে নেয়।শোভা রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে কথা শুনছিল।দর্শন যেতে নিলে শোভা কষ্ট পেলেও দিজার কথা শুনে চোখ রাখে দর্শনের দিকে।পা থামিয়ে পিছন ঘুরে দর্শন জানায়,“গোসল করে আসি,তারপর।”
দর্শন চলে যেতেই দিজা প্যাকেট খুলতে থাকে।দেখলো বেশি করে বিরিয়ানী আনা।শোভা গামলা ধুয়ে আনলো।দিজা খাবার বাড়তে থাকে শোভা তিনটি প্লেট ধুয়ে আনে।দর্শনের জন্য রান্না খাবার বাটিতে ঢেলে নিয়ে আসে।দর্শন গোসল করে নিচে আসলো।দুজনকে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে দেখে বলে,“খাচ্ছিস না কেন?”
“তোমার জন্য অপেক্ষা।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২১

দর্শন চেয়ার টেনে বসে দেখলো শোভার মুখ ভার।চুপচাপ দর্শনের খাবারের বাটিগুলো দর্শনের দিকে এগিয়ে দিয়ে দিজার প্লেটে বিরিয়ানি দেয়।অতঃপর নিজে নিয়ে খেতে শুরু করে।একবারও দর্শনের দিকে চোখ রাখলো না।মেয়েটার মনে অভিমান জমেছে।কিন্তু পাত্তা দিতে চাইলো না দর্শনের গম্ভীর মস্তিষ্ক।মনটা একটু খচখচ করছে শুধু।হয়তো সেও ধীরে ধীরে শোভার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করে।শোভার আচরণ সবার সাথে মিলেমিশে থাকা সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখা সবকিছু বদলে দিচ্ছে দর্শনের অনুভূতিকে।দর্শন কেমন যেন হাত মুঠ করে অতঃপর শোভাকে দেখে খাবারে মনোযোগী হুলো।দিজা খাওয়ার মাঝে দুজনকে দেখছে আর ভাবছে,“ভাই কি কোনমতে ভাবীর এই দূরত্ব হজম করতে পারছে না নাকি অন্য কোনো কারণ?অতিরিক্ত হাইপার হলে ভাইয়া এমন করে।এখন কি এমন হলো?”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here