বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২৫

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২৫
ইশরাত জাহান

মিটিং রুমে পা রাখতেই নীরবতা নেমে আসে।
দর্শনের প্রবেশমাত্র সবাই উঠে দাঁড়ায়।সম্মানের সাথে স্বাগতম জানায়।দর্শন কোর্ট খুলে চেয়ারের পেছনে রাখে।একবার সকলের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় সবাইকে বসতে বলে।নিজেও চেয়ারে বসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,“শুরু করি।”

প্রজেক্টর অন হয়।আলো কমিয়ে দেওয়া হলে ঘরটা হালকা আঁধারে ঢেকে যায়।লাইন বাই লাইন প্রেজেন্টেশন চলতে থাকে।দর্শনের চোখ অন্য কিছু খুঁজছে যেন।স্ক্রিনে আচমকা শোভার মুখ দেখে চোখ খিঁচে বন্ধ করে।চোখ খুলে মাথা ঝাড়া দেয়।তারপর কাজে মন।হঠাৎই মোবাইল ভাইব্রেট করে ওঠে।নোটিফিকেশন আসলো যেনো।ভেবে নিলো কোনো প্রজেক্টের মেইল।টেবিলের নিচে ফোনটা বের করে দেখে প্রজেক্ট এসেছে সাথে আরেকটি ম্যাসেজ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

স্ক্রিনে ‘Diza’সে ভ্রু কুঁচকে ম্যাসেঞ্জারে ঢোকে।আর সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের ভিতরটা থমকে যায়।একটা স্টোরি! দিজার মত লাগছে না।চেনা পরিচিত দেখতে স্টোরিতে ঢুকলো।সাদা শাড়ি লাল পাড়,লাল ব্লাউজ,চুল খোলা ও ঠোঁটে গাঢ় টুকটুকে লাল লিপস্টিক।চোখে মোহ জমানো গাঢ় কাজল।আর কিছুই নেই অথচ সবই আছে।এই চোখ এই মুখ যে শোভা?হৃদপিণ্ড যেন বুকে আর থাকে না।শরীরের ভিতর দিয়ে গরম ঢেউ বয়ে যায়।গলা শুকিয়ে আসে।মুখ শুকিয়ে কাঠ।কাঁধ সোজা করে বসে ঠোঁট চেপে ধরে।এর মাঝেই দেখে দিজার ম্যাসেজ,“ভাবী বাড়িতে একা আছে।অনেক বৃষ্টি আজ।আমি খালমণীদের বাসায় আসার পর বৃষ্টি।তোমাকে কল দিয়েছিলাম ধরনি।”
মনে মনে ফোঁস নিশ্বাস নেয়।শোভা একা বাসায় জানতে পেরে বুকটা হাসফাস করছে।

“মেয়েটা আজকে সেজেছে কেন?”
বলেই আবারও স্টোরি দেখে ফোস করে বলে,“She is trying to kill me.”
হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়।চেয়ার পিছিয়ে শব্দ করে।কোর্টটা টান দিয়ে হাতে নেয়।রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিতে ম্যানেজার বলে,“স্যার,মিটিং তো এখনও শেষ হয়নি!”
দর্শনের চোখ রাগে লাল।পিছনে তাকিয়ে বলে,“বাকিটা তুমি দেখে নিও।আমি একটা আর্জেন্ট মিটিংয়ে যাচ্ছি।”
ম্যানেজার থমকে গিয়ে ফিসফিস করে,“অফিসেই তো মিটিং।আর্জেন্ট আর কোথায় পেলো স্যার?”
গাড়িতে উঠেই দর্শনের হাত কাঁপছে।তবে মুখে আগুন।একবার কল দেয় দিজাকে।রিং হয় কিন্তু দিজা রিসিভ করে না।পরক্ষণেই দেখা যায় স্টোরি ডিলিটেড।মেসেজ আসে,“সরি ভাইয়া,ভুল করে স্টোরি হয়ে গেছে।আমি প্রকৃতির একটা সুন্দর দৃশ্য দিতে গিয়েছিলাম।ভাবী বাসায় একা আছে সেটাই বলতে কল দিচ্ছিলাম।”

দর্শনের চোখ সরু হয়ে আসে।ঠোঁট কামড়ে ধরে। গলার বোতাম খুলে টাই একটু ঢিলা করে নেয়। তারপর গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে বলে,“Today,I will finish you.”
গলা ভারী। নিশ্বাস গরম।রাগ মিশ্রিত মস্তিষ্ক সাথে কাছে আসার আকর্ষণ সব মিলিয়ে আজ যেন আগুন লেগে গেছে।গাড়িটা ঘোরে।গন্তব্য শোভার নিকটে।

দর্শনের গাড়ি গলির মাথা ঘুরতেই চোখে পড়ে লোহার সেই বিশাল ফটকে তালা।দিজা তালা দিয়ে গেছে যেন কেউ ঢুকতে না পারে।দর্শনের কাছে তো চাবি আছে। চাবি বের করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই তালা খুলে গ্যারেজে ঢোকায় গাড়ি।বৃষ্টির ধারায় চুল-মাথা ও সম্পূর্ণ গা বেয়ে পানি গড়াচ্ছে।সেদিকে তার মন নেই।মন এখন শোভাকে খোজার ব্যস্ততায় আছে।
প্রথম ঘর,দ্বিতীয় ঘর তারপর বারান্দা পেরিয়ে দরজার পর দরজা ঠেলে যায় দর্শন।কিন্তু শোভা নেই।হঠাৎ বুকের ভেতর খেলে ওঠে অদ্ভুত একটা টান।ছাদ!
দৌড়ে ওঠে সে লোহার সিঁড়ি বেয়ে।ছাদের দরজাটা আধখোলা।বাতাসে দুলছে ছাদের উপর টবে থাকা গাছের পাতাগুলো।এক পা ভিতরে ফেলতেই যা দেখে
দর্শনের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

সাদা শাড়ি লাল পাড়, লাল ব্লাউজে ভেজা শরীর।শোভা দাঁড়িয়ে আছে আকাশের নিচে।
দুই হাত মেলে রেখেছে।চোখ বন্ধ মুখটা উঁচিয়ে ঠোঁটে শান্তির হাসি।বৃষ্টির ধারা তার কপাল ছুঁয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাড়ে বুকের দিকে।চুলগুলো কোমর পেরিয়ে হাঁটু ছুঁইছুঁই করছে।পেছনে থেকে কোমরের অংশ থেকে শাড়ি সরে গিয়ে কোমরটা উন্মুক্ত করে দিয়েছে।সাদা ধবধবে চামড়া সেখানেও বৃষ্টির ফোঁটা এসে লাগছে।দর্শনের বুকের মধ্যে দাবানল।সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে দরজায় হেলান দিয়ে।
চোখ আটকে যায় কোমরে তারপর দৃষ্টিটা নামিয়ে আনে।

গলা খাঁকারি দেয় হালকা কাশে কিন্তু শোভা শুনতে পায় না।দর্শনের ধৈর্য নেই।এক পা,দুই পা এগিয়ে আসে।শুভ্র ছায়ার মতো কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ঠিক পেছনে।শোভা নিজের মতো ঘুরে দাঁড়ায়।আচমকা পিঠ গিয়ে ঠেকে দর্শনের ভেজা বুকে।গরম নিঃশ্বাস শোভার ঘাড় ছোঁয়।শোভার গা শিউরে ওঠে।
চমকে গিয়ে পিছনে তাকাতেই হাতটা গিয়ে পড়ে দর্শনের গালে।আর ঠোঁট!একটুর জন্য স্পর্শ করে না দর্শনের ছোপ ছোপ দাড়িতে।পা পিছলে যায় তার কিন্তু সে পড়ে না।দর্শনের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার কোমর।
বৃষ্টি তখন ঝমঝম করছে আচমকা বিদ্যুৎ চমকালো।আলো এসে পড়ে তাদের ভিজে মুখে।শোভা একটুও ভাবার সময় না নিয়ে জড়িয়ে ধরে দর্শনকে।তার গলা কাঁপছে,ঠোঁট কাঁপছে।ঘাবড়ে বলে ওঠে,“আমি খুব ভয় পেয়েছি।এভাবে কেউ পিছনে এসে দাঁড়ায়?”

দর্শনের মুখে মৃদু একটা বিজয়ী হাসি।হাতদুটো দিয়ে শোভার কোমরে আঁকড়ে ধরে নিচু গলায় ফিসফিস করে বলে,“তাহলে ভিজতে এসেছিলে কেন?”
শোভা ধীরে বলে,“ফাঁকা বাড়ি নীরবতা বৃষ্টিঘেরা চারপাশ।মনে হলো নিজেকে একবার ভিজিয়ে নিই।ভেতরের জমে থাকা ভার যেন ধুয়ে যায়।”
দর্শন ভাবছে,“আসলেই কি জমে থাকা ভার ধুয়ে যায়?”
শোভা মুখ তুলে তাকালো।দর্শনের দিকে চেয়ে বলে,“আপনি না রাতে আসবেন বলেছিলেন?”
“হুমমম কিন্তু চলে এলাম এখন।”
“কেন?”
“জানিনা কিন্তু আসতে ইচ্ছে করলো।”
“নিচে চলুন।”

শোভা নিচে যেতে নেয় কিন্তু শোভার হাত আঁকড়ে নিজের নিকটে আনলো দর্শন।দুজনেই ভিজে আছে।শোভার অবাক চাহনি।দর্শনের চোখে ঘোর তবুও চোয়াল শক্ত,“কার জন্য সেজেছোঁ?”
“আমি কারো জন্য সাজিনা।যখন একা থাকি তখন মন ভালো করি একটু।”
“দিজার সাথে গেলে না কেন?”
“যেতে ইচ্ছা করেনি।”
“আজ যদি আমি না আসতাম?”
“তাহলে আর কি?আমি একা থাকতাম।
“হঠাৎ বজ্রপাতে কি করতে?”
“দম আটকে মরে যেতাম।”
শোভার কাঠকাঠ উত্তর সহ্য হলো না।কোথাও আটকে গেলো।শোভার চোয়াল শক্ত করে ছুয়ে বলে,“খুব তো চেয়েছিলে নিজের মনে জমে থাকা ভার বৃষ্টিতে ধুয়ে দিতে,তাহলে আমার মনের ভারগুলো বৃষ্টিতে আরো জাগিয়ে দিচ্ছ কেন?”

“আমি কি করলাম?আমি তো আপনার কথায় তাল মিলিয়ে চলছি।”
“আমার তালে তাল দিয়েও আমাকে ধ্বংস করে দিচ্ছ।”
শোভা চোখ আওড়ালো।দর্শন আচমকা তাকে নিজের বুকের মাঝে ঠেসে ধরে বলে,“যখন দূরে রাখতে চাইতাম ছুটে এসে অধিকার জমাতে।এখন দোটানায় ভুগছি দেখে দূরে সরে আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাও।আমি তোমার এই চাওয়াকে মানি না।”
“আমি আপনার চাওয়া পাওয়াকে বুঝতে পারছি না।”
“প্রতি রাত আমার একা কাটানোতে অভ্যস্ত ছিল।তুমি এসে একটা সপ্তাহ এমনভাবে জড়িয়ে নিলে যে এখন আমার একা থাকতে গেলে কষ্ট বাড়ে।”
শোভা চোখটা উচু করে দর্শনের মুখ দেখে।দর্শনের শক্তপোক্ত বুকটাতে কান রাখতে কিছু শব্দ পায়।হৃদস্পন্দন ওঠানামা করতে থাকে।শোভা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,“ভালোবাসেন আমাকে?”
শোভার কানের কাছে মুখ এগিয়ে এনে বলে,“হুশ!এই প্রশ্নটা করবেই না।”

“কেন?”
“কারণ উত্তর দিবো না তাই।”
“নিচে চলুন আপনি ভিজে যাচ্ছেন তো।”
“আরেকটু থাকি।”
“আমার গায়ে ঠান্ডা লাগছে।মনে হয় জ্বর আসবে।”
“আমি আছি তো জ্বর কমানোর ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।”
শোভা ফ্যালফ্যাল চাহনিতে দেখে ভাবছে,“মাথা গেলো নাকি বৃষ্টিতে ভিজে!একসাথে দুজনেই মনে হয় অসুস্থ হয়ে যাবো।আমি শারীরিক উনি মানসিক।”

শোভা এখনও মানতে নারাজ দর্শন তাকে ভালোবাসে।হয়তো এই বৃষ্টিতে আলাদা টান অনুভব করছে দর্শন।কারণ এই দর্শন তো তাকে মানবেই না কোনোদিন।আর তো আছে মাত্র কয়েকদিন।
সময় কিছুটা ব্যয় করে শোভা নিজে থেকে ছেড়ে দেয় দর্শনকে।শোভার চোখমুখ গরম লাগছে।শরীরটা ভালো লাগছে না।বুঝতে পারছে জ্বর আসার আহ্বান এটা।কোনমতে আঁচলটা ঠিক করে বলে,“রান্না করতে হবে আমাকে।”
“আমি খাবার অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।”
“না,কোনো দরকার নেই।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২৪

বলেই শোভা দৌড়ে চলে যায়।খালি পায়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দৌড়ে চলে গেলো শোভা।পিছন থেকে দেখতে থাকে দর্শন।মুখে মুচকি হাসির সাথে মনে মনে বলে,“ভালোবাসার শব্দটা উচ্চারণ না করে তোমার সাথে সারাটাজীবন কাটাতে চাই।কারণ যে শব্দে সত্য মিথ্যা জড়িত থাকে সে শব্দটা সম্পর্কের মাঝে না আনাই শ্রেয়।ভালোবাসি বলেই বা কয়জন পারে সম্পর্ক ঠিক রাখতে?আমি না বলে সম্পর্ক মজবুত রাখতে চাই।আমি কথাতে না কাজে বিশ্বাসী।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here