বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৩২
ইশরাত জাহান
দুপুরের দিকে শোভার জ্ঞান ফিরেছে ঠিকই,কিন্তু শরীরটা যেন তার চলছেই না।সকালবেলায় বারবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল খাবার দেখে।কয়েক চামচ ভাত খেতে গেলেও গা গুলিয়ে উঠে এল,তারপর একেবারে বেসামাল হয়ে বমি করে দিল।দর্শন সব দেখে চুপচাপ বসে থাকতে পারছে না।মেয়েটা এভাবে থাকলে আরো শুকিয়ে মারা যাবে অবস্থা।কিছু খেতে না পারলে শরীরের ক্ষতি।শোভা কিছু খেতে পারছে না বুঝে সে ডাক্তার ডেকে বাসায় সেলাইনের ব্যবস্থা করল।
নার্স এসে ইভি স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়াল।সেলাইনের বোতল ঝুলিয়ে ক্যানোলা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল শোভার দিকে।হঠাৎ শোভার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। ভয়ে চিৎকার করে বলে,“থামুন!”
নার্স একটু অবাক হলেও শোভা বলে,“এইসব আমার লাগবে না।আমি মরলে মরব,তবুও সেলাইন নেব না।”
দর্শন কাছে এসে শান্ত কণ্ঠে বলে,“তুমি খেতে পারছ না।শরীরে পানি যাচ্ছে না।একটু বোঝার চেষ্টা করো।”
শোভা বিছানা থেকে উঠে বসে চাদরটা আঁকড়ে ধরল।চোখদুটো জেদে চকচক করছিল।হাত এখনও ব্যাথা এই ক্যানোলা দেওয়ার কারণে।তাই জেদ দেখিয়ে বলে,“আপনি জানেন না আমার এগুলো সহ্য হয়না।হাত বিষ ব্যাথা হয়ে আছে।আমি আর পারবো না।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“শোভা,জেদ করবে না প্লীজ।এটা বোকামি।তুমি….”
“আপনি চুপ করুন!”
চিৎকার করে দূরে সরে যায় শোভা আর কাপতে কাপতে বলে,“আমি ক্যানোলা দিবো না মানে দিবই না।”
দর্শন এবার ঝাড়ি দিয়ে বলে,“চুপচাপ আমার কথা শোনো নাহলে কিন্তু মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার।”
“তাতে আমার কি?”
“এই মেয়ে আমার কথা শুনতে বলছি না?”
“না আমি শুনবো না।”
দর্শন ধমকে যাচ্ছে আর শোভা ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে।এই ক্যানোলার ব্যাথা যে কি এটা,যে টানা পাঁচ ছয়দিন ব্যাবহার করে সেই জানে।শোভা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে হাত না নাড়িয়ে একটানা রেখে কত কষ্ট।এখন আবার ব্যাথাও আছে।দর্শন এগিয়ে এসে দাঁত চেপে ঠান্ডা গলায় বলে,“তোমাকে সেলাইন নিতে হবে।আমি এভাবে তোমার দুর্বলতা মেনে নিতে পারব না।”
শোভা এক ধাপ এগিয়ে বলে,“আপনি আমার কষ্ট কোনোদিন বুঝবেন না।এর থেকে ভালো আমি আমার ভাই ভাবির কাছে যাবো।ওরা আমাকে বুঝবে।আমি এসব লাগাবো না।হাত পুরো ব্যাথা।”
দর্শন শোভার কনুই ধরে টেনে নিয়ে আসে।শোভা আসতে চায় না।জোর করে বিছানার কোণায় আনতেই শোভা দর্শনকে ছাড়ানোর জন্য বলে,“আমি মরে যাবো তাও এত বিষ ব্যাথা সহ্য করতে পারব না।আপনি বুঝবেন না এটার কষ্ট কি!”
এরপরেই সব শব্দ থেমে গেল।দর্শনের ধৈর্য শেষ হয়ে গিয়েছিল।পর মুহূর্তেই একটা ঝড়ের মতো থাপ্পড় পড়ল শোভার গালে।ঘরে এক মুহূর্তে নীরবতা নেমে এলো।
শোভা হতবাক!চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল দর্শনের দিকে।মুখের এক পাশে লাল ছাপ পড়ে গেছে কিন্তু সে চুপ।চোখে পানি এসে গেল তবু গাল ধরে বসে কাঁদল না।বসে থেকেও যেন ভেঙে পড়ল।দর্শন গভীরভাবে নিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে এল।এবার কণ্ঠটা ছিল শান্ত কিন্তু দৃঢ়,“এখন একটা শব্দও না।আমি তোমাকে মরতে দেব না।জেদ করো,যত খুশি করো।কিন্তু তোমার সব জেদ আমি শেষমেশ সহ্য করেই নেব তবুও তোমার ক্ষতি না।”
দর্শন নার্সের হাত থেকে ক্যানোলা নিয়ে নিজেই শোভার পাশে বসে পড়ল।ধীরে ধীরে শোভার হাত ধরে শিরা খুঁজে নিয়ে ক্যানোলা ঢুকিয়ে দিল।শোভা এবার বাধা দিল না চোখ দুটো বন্ধ করে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল।সেলাইনের ফোঁটা ফোঁটা পানির মতোই যেন ঘরের উত্তেজনাও আস্তে আস্তে ঝরে পড়ছিল।আর শোভার চোখে ভাসছিল একটাই কথা,“জেদ করো,যত খুশি করো।কিন্তু তোমার সব জেদ আমি শেষমেশ সহ্য করেই নেব তবুও তোমার ক্ষতি না।”
টানা ছয় ঘণ্টা পর নার্স ডেকে ক্যানোলা খোলা হয়।দর্শন কিছু মেডিসিন নিয়ে আসে।শোভার সামনে বসতেই শোভা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরল।দর্শন হতাশার নিশ্বাস ফেলে বলে,“যার জন্য করি চুরি,সেই বলে চোর!”
শোভার হাতটা ধরে নিজের কাছে আনে।শোভা সরিয়ে নিতে চাইলে দর্শন শক্ত করে ধরে।শোভা ছাড়াতে ব্যর্থ।দর্শন এবার মলম লাগিয়ে দিচ্ছে।তারপর শোভার মুখটা নিজের হাত দিয়ে টিপে ধরে গোল করে তারমধ্যে ঔষধ দিয়ে পানি দিলো।যেনো শোভা আবারও কোনো মান অভিমানের ভঙ্গি না দেখায়।আসলেই পারল না।এমন দর্যাল থাকলে কোনোদিন সম্ভব না।শোভা চুপচাপ জানালার দিকে চেয়ে আছে।দর্শন ভ্রুকুটি করে বলে,“হাতের ব্যাথা তো কমে যাওয়ার কথা।”
শোভা হাত উঁচিয়ে দেখছে নীল দাগ এখন নেই।আবার ব্যাথা অনেকটা কমেছে।দর্শনের দিকে ফিরে তাকালো।দর্শন শোভার নিকটে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,“রাগী হতে পারি কিন্তু দায়িত্বহীন নই।”
শোভা গালে হাত দিয়ে ইশারা করে।থাপ্পড়ের কথাটা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো।দর্শন মৃদু হেঁসে বলে,“May I can kiss you?”
শোভা বাচ্চাদের মত করে বলে,“আপনি তো সময় লাগান কিস দিতে গিয়ে।অবশ্য সময় লাগিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন কিস দিতে।”
দর্শন অবাকের সাথে বলে,“তুমি জেগে ছিলে?”
“হুমমম।”
“বলোনি কেন?”
“কারণ ঘুমঘুম পাচ্ছিলো খুব। আর আপনি আমাকে জোর করে আবার কিছু খাওয়াতেন তাই।”
“তুমি তো দেখছি ড্রামা কুইন।”
“তাহলে কিন্তু আপনি ড্রামা কিং।”
দর্শন রসিকতা করে বলে,“ড্রামা কুইন।”
শোভাও মুচকি হেঁসে মুখ ভেংচে বলে,“ড্রামা কিং।”
দর্শন হেসে দেয়।শোভা নিজেও মৃদু হাসে।অতঃপর শোভার টোল পড়া দেখে সেদিকে তাকাতেই নিজের হাতের পাঁচ আঙুলের বদলে চার আঙুলের ছাপ দেখে।যেটা দেখে দর্শনের মধ্যে অনুশোচনা কাজ করে।এই অনুশোচনা মেটাতে সে তার ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে গেলো শোভার গালে কাছে।সাহস করে এবার শোভার গালের সাথে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো দর্শন।আচমকা এমন চুমু পেয়ে কেঁপে উঠলো শোভা।চোখ দুটি রসগোল্লার মত বড় হয়ে গেলো।দর্শন সেদিকে দেখে বলে,“কি হলো ম্যাডাম?চুমু খেয়ে হা হয়ে গেলেন কেন?”
শোভা গাল বন্ধ করে দূরে সরে এসে লজ্জায় কাপতে কাপতে বলে,“দ দরজা খো খোলা।”
দর্শন পিছন ঘুরে দেখে।মুচকি হেসে বলে,“লাগিয়ে দিয়ে আসব কি?”
শোভা লাজুক ভঙ্গিতে অন্যদিকে ফিরে জানালার পর্দা আঙুলের সাহায্যে খুটছে।সেই হাত আলতো করে ধরে দর্শন।তারপর শোভার দিকে চেয়ে বলে,“আমি কখনও কারো অসুস্থতা দেখে এতটা উতলা হইনি যতটা তোমার বেলায় হয়েছি।”
শোভার চোখ চলে গেলো দর্শনের দিকে।লোকটা তার পিছনে ঝুঁকে আছে পিঠ বরাবর।এতটা কাছে এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে কথা কখনও বলেনি লোকটা।শোভা বলতে চায়,“এভাবে অতি নিকটেও আসনেনি তো কখনও।”
মুখে বলে না এই কথা।কিন্তু তুতলিয়ে বলে,“দু দু দূরে সরুণ।অ অ অস্বস্তি লাগছে।”
“রিয়েলী!এটা আমারও হয়েছিল।যখন তুমি অজ্ঞান ছিলে তোমার দিকে আকর্ষিত হয়েও তোমাকে চুম্বন দিতে পারিনি।কারণ আমার অসস্তি লাগছিল,কিন্তু এখন একটুও লাগছে না অসস্তি।কারণ তুমি লাজুক হয়ে দিচ্ছ সম্মতি।”
শোভা আজ লজ্জায় নেতিয়ে পড়েছে।এটা কোনো সময় তার সাথে হয়না এবার প্রথম হচ্ছে।শোভা নিজেও বুঝতে পারছে না সে এতটা দুর্বল হচ্ছে কেন?জীবনের প্রথম চুম্বন প্রথম কাছে আসা বলেই কি আজ এই অনুভূতি?দর্শন প্রশ্ন ছুড়লো,“গালের ব্যাথা কমেছে?”
শোভা লজ্জা পেয়ে বলে,“আপনি দূরে না সরলে আমি আবার অজ্ঞান হয়ে যাবো।”
“কিছু করতে পারলাম না বউ আগেই অজ্ঞান হয়ে যাবে!ব্যাপারটা খুব দ্রুত গতিতে হয়ে গেলো না?”
শোভা ভাবছে এটা কোন দর্শন!তার এমন কেন আচরণ?আসলেই কি এটা তার স্বামী নাকি তার উপর ভর করেছে অন্য কেউ?দর্শন যখন দেখে শোভা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল তখন সরে গেলো।উঠে দাড়িয়ে বলে, “ভাত নিয়ে আসব নাকি নিচে গিয়ে খেতে পারবে?”
“নিচেই যাবো।”
“কোলে করে নিয়ে যাব নাকি একাই যাবে?”
“একাই যাবো।”
“নিজের হাতে খাবে নাকি আমি খাইয়ে দিবো?”
“নিজের হাতেই খাবো।”
“উঠতে…
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৩১
“আমি উঠতে পারবো।সেলাইন নেওয়ার পর একটু ভালো লাগছে।তারউপর জোর করে ঔষধ দিয়েছেন বলেই এখন সুস্থ বোধ করছি।”
দর্শন আর প্রশ্ন করলো না।মৃদু হেসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।শোভা উঠে মাথায় হিজাব দিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো।পিছন পিছন আসছে দর্শন।শোভা পিছনে না তাকালেও লজ্জা পেলো এই মানুষটির মুখভঙ্গি অনুমান করে।