বিকেলের প্রণয় পর্ব ১৩

বিকেলের প্রণয় পর্ব ১৩
Arshi Ayat

প্রচন্ডে কষ্টে আর সহ্য করতে পারলো না মিলাত।শব্দ করে আর্তনাদ করে উঠলো।এতে চৈতি যেন আর বেশি আনন্দ পেলো।ঠোঁটের হাসি আরেকটু চওড়া করে আবারও কিছু বলতে যাবার আগেই মিলাতের ফোনটা বন্ধ হয়ে গেলো।তাই কলও কেটে গেলো।চৈতি ভাবলো বেচারি আর নিতে পারছে না তাই কেটে দিয়েছে।থাক আজকের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।বাকিটা পরে।
রুজিনা,নিরু অনেকটা সময় নিয়ে মিলাতের কান্না বন্ধ করতে সক্ষম হলো।রুজিনা তো রাগে ফেটে পড়লো।বলল,’চৈতিটা দিনদিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে।প্রথমেই যদি ভাই,ভাবি শক্ত হতো তাহলে এত বাড়তো না।’
মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিরুও ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,’আপু এরপর যদি ওই ডাইনীটা আবার ফোন করে তুমি আমাকে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকবা।’

নিরুর কথায় মিলাত মলিন হাসলো।বলল,’ও তো তোরও আপু হয়।’
‘না,হয় না।ওমন ডাইনী মেয়ে আমার আপু না।’নিরু প্রতিবাদী হলো।
‘ছোটো বেলা থেকেই কেড়ে নেবার অভ্যাস ওর।ও চায় ওর আশেপাশে যেন কেউ ভালো না থাকে।তবে মজার ব্যাপার কি জানিস মিলাত?ও যাকে ভালোবাসবে তাকেও শান্তি দেবে না।’রুজিনা বেগম বললেন।
এরপর আরও কিছুক্ষণ ফুপু আর ফুপাতো বোনের সাথে থেকে রুমে এলো মিলাত।নিরুর শনিবার পরীক্ষা।তাই ও আরও কিছুক্ষণ পড়ে পরে ঘুমাতে আসবে।মিলাত ওর জন্য অপেক্ষা না করেই শুয়ে পড়লো।কান্নার ফলে মাথাব্যথা করছে এখন।ঘুমও আসছে না তাই ফোনটা চার্জ থেকে খুলে অন করতেই দেখলো অপরিচিত নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল এসেছে।মিলাত ভয় পেলো।আবারও চৈতি নয়তো!এসব ভাবতে ভাবতেই আবারও ফোন এলো।রিসিভ করবে না ভেবেও রিসিভ করলো ও।তবে আগে কথা বলল না।ওপাশ থেকে গলার স্বর আসার অপেক্ষা করলো।কি যেনো মনে করে রেভানও কথা বলল না।একদম পিনপতন নীরবতা।তবে এটা বেশিক্ষণ চলল না।দু’মিনিটেই অসহ্য হয়ে বলল,’কথা বলছো না কেনো?’
মিলাত এবার মুখ খুললো,’আপনি বলছেন না কেন?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘তুমি বলছো না তাই।’
‘আমিও আপনি বলছেন না তাই।’
‘আমি যা করব তুমিও তাই করবে?’
‘করতে মানা?’
‘না,মানা নেই।তবে এসব না করে ভালো কিছু করো।’
‘যেমন?’
‘মাঝেমধ্যে আমাকে ফোন করা,দেখা করা এইতো এসবই।’
‘এসব ভালো?’
‘ভালো না?’
‘আপনি বলুন।’
‘ভালোই তো।’
‘আচ্ছা,তো কেনো আমি আপনার সাথে কথা বলবো,দেখা করব?’
‘কারণ তো একটা আছে অবশ্য।’
‘কি কারণ?’
‘কাল তো শুক্রবার।কাল দেখা করার পর বলি?’
‘আচ্ছা।’
‘কখন দেখা করবে?’
‘সকাল দশটায়?’
রেভান একটু ভেবে বলল,’আচ্ছা।বের হয়ে বাসার সামনে থেকো।’
‘আচ্ছা।’

ফোন রেখে মিলাত ভাবলো সে কি বলবে রেভানকে।ইতিমধ্যে রেভানের হাবভাবে বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটা কি বলবে!এমনভাবে বলতে হবে যেনো ছেলেটা কষ্ট না পায়।শত হোক ছেলেটা তো ওকে বাঁচিয়েছেও।
অনুরুপ মেয়ে দেখতে যেতে রাজি না হওয়ায় কলি বেগম গাল ফুলিয়ে রেখেছেন সন্ধ্যা থেকে।স্বামী,ছেলে কারো সাথেই কথা বলছেন না।রাতের খাবার টেবিলে দিয়েই চলে গেছেন।খেতেও বসেন নি।এমন অবস্থায় আমিনুল সাহেব অসহায় গলায় বললেন,’রাজি হয়ে যা না বাবা।দেখছিস তো কি রাগ তোর মায়ের।এটা ঝড়ের পূর্বাভাস।এখনিই থামা নয়তো সুনামি চলে আসবে।সেই ঝড়ে কেবল তুই না আমিও উড়ে যাব।’
অনুরুপ পড়লো বিপাকে।ছোটোবেলা থেকেই সে জানে তার মা প্রচন্ড রাগী।নিজের মনমতো কিছু না হলেই মাথাগরম হয়ে যায়।আর নিজের ক্ষতি করে ফেলে।এমনিতেই বিভিন্ন রোগ শরীরে।প্রতিদিন অনেক ঔষধ খেতে হয়।রাতের খাবার না খেলে ঔষধগুলোও খেতে পারবে না।তখন দেখা যাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে অনুরুপ আর নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারলো না।মায়ের কাছে গিয়ে জানালো সে মেয়ে দেখতে যেতে রাজি।কলি বেগম জয়ের হাসি হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’আমার সোনা ছেলে!আয় খেতে,আয়।’

তিনি জানেন দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলেও তার স্বামী,ছেলে ঘরে থাকলে তাকে ছাড়া কখনোই খেতে বসবে না।
খেতে খেতে কলি বেগম নিজের স্বভাবসুলভ কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন।এদিকে বাবা আর ছেলে অনুগত ভৃত্যের মত বসে শুনতে লাগলো।
এলার্মের শব্দে শোয়া থেকে উঠে বসলো রেভান।এখন সকাল আট’টা।প্রথমে গোসল করে আস্তেধীরে তৈরি হয়ে তারপর বের হবে।বিছানা ছাড়ার আগে মিলাতকে একটা টেক্সট দিলো ও।
মিলাত ঘুম থেকে উঠলো পৌনে দশটায়।তাও রুজিনার বেগমের ডাকে।ওর মনেই ছিলো না দেখা করার কথা।ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিতেই মনে পড়ে গেলো।তবুও কোনো তাড়াহুড়ো দেখা গেলো না ওর মধ্যে।ধীরেসুস্থে নাস্তা করে রেডি হতে হতেই ফোন এলো।মিলাত ফোন রিসিভ করতেই রেভান বলল,’কি ব্যাপার?না আসার পায়তারা করছো নাকি?’
‘আর পাঁচ মিনিট লাগবে।’
‘ঠিকাছে,আসো।’

ফোন রেখে চুল আঁচড়াতে লাগলো মিলাত।পাঁচমিনিট না,কমপক্ষে আরও পনেরো মিনিট তো লাগবেই।
অবশেষে পৌঁনে একঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখার পর মিলাতের দেখা মিললো।রেভান মুখখানা বেজার করে বলল,’তোমার পাঁচ মিনিট যে পয়তাল্লিশ মিনিটে হয় সেটা তো জানতাম না।’
মিলাত একটু শব্দ করে হাসলো।বলল,’প্রাকটিস করুন।ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’
‘প্রাকটিস করা লাগবে না।সারাদিন অপেক্ষা করারও অভিজ্ঞতা আছে।’
‘তাই নাকি?’মিলাত ভ্রু কুঁচকে বলল।
‘হ্যাঁ,প্রথম প্রেম ছিলো।আবেগে টইটুম্বুর ছিলাম।যখন যেটা বলতো সেটাই শুনতাম।তারপর চার বছর পর একদিন বলল বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করেছে।আমি দিশা না পেয়ে আমার বাসায় জানাই।বাবা,মা রাজি হয়।ওকে বললাম ওর বাসায় জানাতে কিন্তু ও জানাতে চায় নি কারণ ও বিয়েতে রাজি।তারপর আর কি ওর বিয়ের দিন সারাদিন আমি ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।মনে ক্ষীণ আশা ছিলে হয়তো দৌড়ে এসে বলবে আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না।কিন্তু বলে নি।সেই থেকে এখন পর্যন্ত সিঙ্গেল।অলমোস্ট পাঁচ বছর হয়ে গেছে।’
রেভানের কথা শুনে মিলাতের মনটা ভারী হলো।মনে পড়ে গেলো নিজের কথা।মানুষগুলো এমন হয় কেনো?এত ভালোবাসা উপেক্ষা করার অসুরিক শক্তি ওরা কোথায় পায়?
হাঁটতে হাঁটতেই রেভান জিজ্ঞেস করলো,’নাস্তা করেছো?’

‘হ্যাঁ,আপনি?’
‘হ্যাঁ,করেই বেরিয়েছি।’
‘কোথায় যাব এখন?’
‘নৌকায় উঠেছো কখনও?’
‘না।’
‘উঠতে চাও?’
মিলাত উৎসাহে মাথা নাড়লো।
‘সাতার পারো?’
‘না।’
‘তাহলে তো ওঠানো যাবে না।’
মিলাত এবার মিনতির সুরে বলল,’প্লিজ!’
রেভান একটু ভেবে বলল,’আচ্ছা,চলো।সাঙ্গু নদীতে যাই।নৌকায় ঘুরব।’
মিলাত খুশি হয়ে গেলো।
সাঙ্গু নদীর পাড়ে এসে রেভান একটা নৌকা ভাড়া করলো।মিলাত ওর পাশে দাঁড়িয়েই চারপাশটা দেখতে লাগলো।ভীষণ সুন্দর জায়গাটা।গাছগাছালির সমারোহ,পাখিদের কিচিরমিচির আর শান্তনদীর জলধারা পরিবেশটাকে অনন্য করে তুলেছে।প্রথমে রেভান উঠলো পরে মিলাতের হাত ধরে উঠালো।এতে নৌকা সামান্য দুলতেই মিলাত ভয় পেয়ে রেভানের দু-হাত শক্ত করে ধরে ফেললো।রেভান অভয় দিয়ে বলল,’ভয় পেয়ো না।ঠিক হয়ে যাবে।তুমি মাঝে গিয়ে বসো।’

মিলাত সাবধানী পায়ে নৌকার মাঝে গিয়ে বসলো।রেভান বসলো মুখোমুখি।
একটা স্নিগ্ধ সুন্দর সকাল!শান্ত নদীর জল,পাড়ে বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় পাহাড় আর ঘন সবুজ বনাঞ্চল।নদীটি পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এর পাড়ে অনেক পাথুরে জায়গা দেখা যায়। কিছু স্থানে বড় বড় পাথর নদীর পাড়ে এবং পানির ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে।পাড়ের কিছু অংশে আদিবাসী ও স্থানীয় লোকদের ছোট ছোট গ্রাম রয়েছে। তারা নদী থেকে মাছ ধরে, কৃষি কাজ করে এবং পানির নৌকায় চলাচল করে।কিছু জায়গায় নদীর পাড়ে সমতল ভূমি দেখা যায় যেখানে স্থানীয় মানুষ কৃষিকাজ করে।পাড়ে নানা ধরনের স্থানীয় গাছ ও বুনো ফুল ফুটে থাকে।

এত সুন্দর সকাল বোধহয় আর কখনোই আসে নি মিলাতের জীবনে।ইশ!পৃথিবীটা সুন্দর।মিলাত মনে মনে স্থির করলো এভাবে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়বে প্রকৃতির গহীনে।
অনেকটাদূর যাবার পর রেভান বলল,’চা খাবা?’
মিলাত মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি দেখছিলো।রেভানের কথা শুনে অবাক হয়ে বলল,’এখানে?কিভাবে?’
‘মাঝি মামার কাছে চায়ের সরঞ্জাম আছে।তুমি চাইলে আমি বানাতে পারি।’
মিলাত খুশি হয়ে বলল,’অবশ্যই।’
রেভান তিনকাপ রঙ চা বানালো।এক কাপ মাঝিকে দিলো,এক কাপ মিলাতকে দিয়ে নিজের কাপটা নিয়ে বলল,’আজকের দিনটা এতটা সুন্দর যাবে ভাবি নি।’
মিলাত চায়ে চুমুক দিয়ে আনন্দিত স্বরে বলল,’আমিও।’
সাঙ্গু নদীতে নৌকা ভ্রমণ শেষে ওরা আশেপাশে আরো কিছুক্ষণ ঘুরে বাড়ির পথ ধরলো।এখন দুপুর।আজান দিয়ে দিয়েছে।রেভান মিলাতকে ওর ফুপুর বাড়ির সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,’ধন্যবাদ।এত সুন্দর দিনটার জন্য।’
‘এই ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।’

বিকেলের প্রণয় পর্ব ১২

রেভান অল্প হাসলো।মিলাত পুনরায় বলল,’আপনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন।’
‘চেয়েছিলাম তবে আজ সময় নেই।একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে বাড়িতে।নামাজ পড়ে বাড়ি যেতে হবে।’
মিলাত আর জোর করলো না।রেভান স্বভাবসুলভ হেসে বিদায় নিলো।
বিকালে অনুরুপ আর ওর বাবা,মা এলো মেয়ে দেখতে।সালেহা বেগম নাইমাকে সাজিয়ে এনে পাত্রপক্ষের সামনে বসালো।অনুরুপ নাইমার দিকে একবারও তাকালো না।কোনোরকম সময়টা যাবার অপেক্ষা করতে লাগলো।এদিকে নাইমা এক পলক চোখ উঠিয়ে দেখেই আর ফেরাতে পারলো না।এত সুন্দর কোনো পুরুষ মানুষ হয়?

বিকেলের প্রণয় পর্ব ১৪