বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ১৯

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ১৯
জাওয়াদ জামী

কুহুর হোস্টেল সুপারকে আনানের চাচা সাজ্জাদ বলে রেখেছিলেন কয়েকটা দিন কুহুর হোস্টেলে ফিরতে রাত হবে। তিনিও মেনে নিয়েছেন। এতে করে কুহুর প্রতিদিন রাতে হোস্টেলে যেতে অসুবিধা হচ্ছেনা। প্রতিদিনই কুহুর সাজ্জাদ স্যার কুহুকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে যান।

আজ হলুদ সন্ধ্যা। এ উপলক্ষে প্রত্যেকটা মেয়ে বাহারি সাজে সেজেছে। আজ মেয়েরা পরছে সরষে ফুল রংয়ের শাড়ি। সঙ্গে আছে টাটকা ফুলের মালা। খোঁপা সাজিয়েছে লাল জারবেরায়। আর ছেলেরা তাদের সাথে মিলিয়ে পরেছে পাঞ্জাবী আর জিন্স।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সবাই চুলে খোঁপা বাঁধলেও কুহু ওর ঘন কেশরাশি খুলে রেখেছে। সেই খোলা চুলে পেঁচিয়ে রেখেছে হলুদ চন্দ্রপ্রভার মালা। জারবেরার থেকেও চন্দ্রপ্রভা কুহুর বেশি পছন্দের। ওর হোস্টেলের বাগানে একটা বড় চন্দ্রপ্রভা গাছ রয়েছে। গাছ জুড়ে ফুটে আছে থোকায় থোকায় ফুল। সেখান থেকেই কিছু ফুল নিয়ে মালা গেঁথেছে কুহু।

সিক্তা, আরোশি, দৃষ্টি, তনয়াসহ সব মেয়েরা উচ্ছল প্রজাপতির ন্যায় এদিকসেদিক ছুটোছুটি করছে। ব্যতিক্রম শুধু কুহু। ও চুপচাপ সুপ্তির পাশে চুপটি মেরে বসে আছে। মূলত শিউলি আক্তারের ঈগল দৃষ্টি থেকে বাঁচতেই ওর এভাবে বসে থাকা। এদিকে শিউলি আক্তার শুধু সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কুহুর কোন ত্রুটি পেলেই ওকে আচ্ছামত ঝাড়বে।

তাহমিদ শত ব্যস্ততার মাঝেও তার শ্যামাঙ্গীনিকে আড়ালে আবডালে থেকে ঠিক দেখে নিচ্ছে। বারবার দেখায়ও যেন ওর চোখের তৃষ্ণা কিছুতেই মিটছেনা। যতবার ও কুহুকে দেখছে ততবারই নতুন করে ওর শ্যামাঙ্গীনির প্রেমে পরছে। তাহমিদ বুঝতে পারেনা কি মায়া আছে এই মেয়ের মাঝে! হুট করেই এত অনুভূতি কিভাবে জন্মালো! এই অনুভূতির কোন নাম খুঁজে পায়না তাহমিদ। এমনকি এই অজানা অনুভূতির কোন নামও দিতে চায়না। শুধু অনুভব করতে চায় এক সমুদ্র প্রেমের। যে প্রেমের জোয়ারে ভাসাতে চায় মনের দুকূল। সেই সাথে ভাসাতে চায় তার শ্যামাঙ্গীনিকে৷ যে জোয়ারে ভাসলে তার শ্যামাঙ্গীনিকে হারানোর কোন ভয় থাকবেনা। যে জোয়ারে ভাসলে তার শ্যামাঙ্গীনির শিরায়-উপশিরায়, তনু-মনে শুধুই তাহমিদের নামের ভালোবাসা প্রবাহিত হবে।

” এতক্ষন ধরে দেখছ, তবুও দেখার সাধ মিটছেনা, ভাই! তোমার চোখে শ্যাওলা পরেনি এতবার ওকে দেখতে দেখতে! ধন্য তোমার চোখ। ” আনান টিটকারি মারে তাহমিদকে।
” তুই এখানে কি করছিস? তোর তো দেখছি মিনিমাম লজ্জাটুকুও নেই! বড় ভাই হয়ে ছোট বোনের প্রেমিকের দিকে নজর রাখছিস! তবে একটা কথা কি জানিস? তোর বোনটা কিন্তু সেই লেবেলের হট। ” তাহমিদ চোখ টিপে তাকায় দিকে। এবার আনান লজ্জা পায়।

” তুমি আমাকে বলছো লজ্জা নেই আর তুমি আমাকে কি বললে! সম্পর্কে আমি তোমার বউয়ের বড় ভাই মানে তোমারও বড় ভাই। তোমার উচিত পাঁচ বেলা করে আমাকে সালাম দেয়া। তা না করে তুমি আমার সামনে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করছ। ছিহ্ ভাই ছিহ্। ”

” আমার দেখার মাঝে ব্যাঘাত ঘটালে এরপর থেকে প্রতিনয়িত আরও অশ্লীল শব্দ তোকে শুনতে হবে। যদি সেসব শুনতে ইচ্ছে হয় তবে আমার দেখার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাতে পারিস। ” তাহমিদ ভাবলেশহীন মুখে জবাব দেয়।
আনান মুখ কালো করে থাকে। ও জানে তাহমিদের একরোখা স্বভাব। ধুপধাপ পা ফেলে অন্য দিকে চলে যায়। আনানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তাহমিদ। আজকের মত ভালোই জব্দ করা গেছে।
স্টেজে রাজসিক চেয়ারে বসে আছে সুপ্তি। ওর চারপাশে কাজিন সমাজ এবং বন্ধুমহলের আনাগোনা। একে একে সবাই এসে সুপ্তিকে হলুদ মাখাচ্ছে। এরমধ্যে বরপক্ষও এসে গেছে। তাদের স্বাগত জানাতে সবাই ব্যস্ত হয়ে গেছে। কুহু ফুপুদের সাথে হাতে হাত মিলেয়ে এটা সেটা করছে।

বরপক্ষের সবাই স্টেজে এসে সুপ্তিকে হলুদ মাখায়। ওর সাথে সেলফি নিচ্ছে।
জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন চলছে হলুদে। সবার হলুদ দেয়া শেষ হলে শুরু হয় দু’পক্ষের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যে যার মত পারফর্ম করতে শুরু করেছে। সিক্তা, আরোশি কুহুকে খুব করে অনুরোধ করছে গান গাইতে কিন্তু কুহু ওদের কথায় রাজি হয়নি। ওরাও মুখ গোমড়া করে আবার সুপ্তির কাছে ফিরে গেছে।
সানাউল রাশেদিন হাতে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে কিচেনের দিকে যাচ্ছেন।

” কি ব্যাপার সিনিয়র রাশেদিন! আপনাকে কে কাজ করতে বলেছে? আমরা কি দেশে নেই, যে আপনাকেই কাজ করতে হবে? নাকি সবাইকে দেখাচ্ছেন নিজের মেয়ের বিয়েতে ভাইয়ের ছেলে কোন হেল্প করছেনা! ” সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে সানাউল রাশেদিন তাহমিদের সাথে তেমন একটা কথা বলেননা। আর তাহমিদও বড় চাচ্চুর ভাবভঙ্গি দেখে তার সাথে আপনি করে কথা বলে। আসলে ও একটু খোঁচাতে চায় বড় চাচ্চুকে।

” তা হবে কেন! আমাকে হেল্প করার জন্য অনেকেই আছে। আর ভাইয়ের ছেলেও যে যথেষ্ট করছে তা-ও আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে একটুআধটু সাহায্য করে এত নাম কেনার দরকার নেই। আমার মেয়ের আরও ভাই-বোন আছে তার বিয়েতে হেল্প করার জন্য। আর সবাই যেখানে আনন্দ করছে তোমারও উচিত তাদের সাথে থেকে আনন্দ করা। তাছাড়া পরে তুমিই বলবে সিনিয়র রাশেদিন খাটিয়ে নিয়ে তবেই খেতে দিয়েছে। ” সানাউল রাশেদিন বিরক্ত হয়ে জবাব দেন।

তাহমিদ বড় চাচ্চুর হাত থেকে প্যাকেট জোড় করে নিয়ে প্রত্যুত্তর করে, ” আমার বাপেরও কম নেই যে আপনারটা খেয়েই বাঁচতে হবে। আর আপনার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে দুইদিন আপনার খেয়ে তো আজীবন থাকতে পারবনা। দুইদিন পর থেকেই আমার বাপেরটাই খাব। তাই এত খোঁ’টা দেয়ারও কাজ নেই। আর বোনের বিয়েতে ভাই কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ খেতে দিলেও কাজ করবে, না খাইয়ে রাখলেও কাজ করবে। ” তাহমিদ হনহন করে কিচেনের দিকে রওনা দেয়।

সানাউল রাশেদিনও চোখমুখ কুঁচকে তাহমিদের পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকেন। বড্ড সাহস হয়েছে ছেলেটার৷ আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। আফরোজা আদর দিয়ে ছেলেটাকে মাথায় তুলে নাচাচ্ছে।
কমিউনিটি সেন্টারের বিশাল কিচেনে শেফের পাশাপাশি আফরোজা নাজনীনসহ কয়েকজন তদারকি করছেন।
তাহমিদ কিচেনে এসে প্যাকেটটা বড়মার কাছে দেয়।

” বড়মা, তোমার হাসবেন্ডকে বলে দিও, ওস্তাদি করে যেন কোন কাজ করতে না যায়। তখন আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা। ”
” আফরোজা, তোমার আদরের ছেলেকে বলে দাও ভবিষ্যতে আমার সাথে এরকম বে’য়া’দ’বি করলে ওকে ছেড়ে কথা বলবনা। ” সানাউল রাশেদিন ঝাঁঝ দেখিয়ে বললেন।

” তুমি এখানে কি করছ? হলরুমে যাও, দেখ সবাই ঠিকঠাক খাবার পাচ্ছে কিনা। দিনদিন তোমার বয়স বাড়ছে না কমছে? মেহমানদারি না করে ছেলেটার পিছনে লাগছ! ” আফরোজা নাজনীন দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বলে উঠেন।
স্ত্রীর ঝাঁঝ দেখে আর কিছু বলার সাহস পাননা সানাউল রাশেদিন। চুপচাপ হলরুমের দিকে চলে যান৷ তাহমিনা আক্তার ভাসুর – জা’র খুনসুটি দেখে মুখ টিপে হাসেন।

কমিউনিটি সেন্টারের হলরুম লোকজনের পদচারণায় গমগম করছে। আফরোজা নাজনীন তার দুই জা, বোন এবং অন্যাদের নিয়ে মেহমানদের আপ্যায়ন করছেন। সবার সাথেই টুকিটাকি কথাবার্তা বলছেন।
সন্ধ্যায় তাওহীদের শ্বশুর বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। ব্যস্ততার জন্য তাদের সাথে কথা বলা হয়ে উঠেনি। তিনি এখন হলের একপাশে দাঁড়িয়ে উনাদের সাথে কথা বলছেন। সেখানে তাহমিনা, নাজমাও আছেন।

” বড়মা, কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন গেস্ট এসেছেন। তুমি একটু দশজনের খাবার রেডি করে আমাকে দাও। পরে গল্প করো। ” তাওহীদ এসে আফরোজা নাজনীনকে বলল। তাওহীদকে এদিকে আসতে দেখে নীরাও এখানে এসেছে৷
কিন্তু তাহমিদ আগেই সেই দশজন মেহমানের জন্য খাবার নিতে কিচেনে গেছে। সেখানে শাহনাজ সুলতানা,শিউলি আক্তার, তাহমিনার দুই বোন আছে। তাহমিদ খাবার নিয়ে আসতেই বড় ভাইয়ের কথা ওর কানে যায়।
” তোমার আর মেহমানদারি করে কাজ নেই। তুমি দুইদিনের অতিথি, বরং তুমি আনন্দ কর। ” তাহমিদ কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে তাওহীদকে কথাগুলো বলে৷

” কি বলছিস তাহমিদ! আমি অতিথি হতে যাব কেন! আমি সুপ্তির ভাই। কিছু কিছু কাজ আমাকেও করতে হবে। ”
” বাহ্ মনে রেখছ তাহলে তুমি সুপ্তির ভাই। আমিতো ভেবেছিলাম যেখানে দূরের আত্মীয়রাও তিনদিন আগে এসেছে, সেখানে তুমি বিয়ের আগের দিন আসছ, হয়তো ভুলেই গেছ তোমার বোনের বিয়ে হচ্ছে। ”
” আমি ছুটি পাইনি তাই আসতে দেরি হয়েছে। কিন্তু তাই বলে ভুলে যেতে পারিনা, সুপ্তি আমার বোন। ” মুখ কাঁচুমাচু করে বলে তাওহীদ।

” শালীর বিয়েতে ঠিকই সাতদিন আগে ছুটি পাও। তোমার বউও বোনের বিয়েতে পনের দিন আগে আসতে পারে। কিন্তু বোনের বিয়েতে তিন দিন আগে ছুটি পাওনা। বিষয়টা হাস্যকর হয়ে যায়না! তোমার কোন কাজ করতে হবেনা। তারচেয়ে বরং বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাক৷ হাজার হোক বড় ঘরের মেয়েকে বিয়ে করেছ। তাকে তো একা ছেড়ে দিতে পারনা। আর নিজের বাড়ির মানুষদের সামনে তো অবশ্যই নয়। তোমার বাপ-দাদার তো আর তাদের মত স্ট্যাটাস নেই। আমার কি মনে হয় জানো? তোমাকে লেখাপড়া করিয়ে বিসিএস ক্যাডার শফিউল রাশেদিন বানায়নি, বানিয়েছে তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। সেজন্যই তাদের এত তাঁবেদারি করো। ”

তাহমিদের এহেন কথায় উপস্থিত সকলে থমকে যায়। তাওহীদের শ্বশুর-শ্বাশুড়ি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে, আর নীরা ঘামছে।
” তাহমিদ, এসব কি বলছিস? তুই যেয়ে মেহমানদের খাবার দে। এক্ষুনি যা। ” তাহমিনা আক্তার ছেলেকে ধকম দেন।
” ধমক দিয়ে কয়দিন সবাইকে থামিয়ে রাখবে মা! তারচেয়ে বরং সবাইকে জানতে দাও তোমার ছেলের আর তার বউয়ের চরিত্র। যে ছেলে বাবা-মা’কে দূরে ঠেলে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে মাতামাতি করে আর যাই হোক সে কোন আদর্শ সন্তান হতে পারেনা।

তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি প্রতি মাসেই মেয়ের কাছে গেলে তাদের মেয়ের কোন সমস্যা হয়না, কিন্তু তুমি গেলেই তার যত সমস্যা? তার বাবা-মা’র থেকে কি তোমার যোগ্যতা কোন অংশে কম? নাকি তার বাবার থেকে আমার বাবা প্রভাব-প্রতিপত্তি কম? কোন অংশেই কম নয় বরং আমার বাবার তাদের থেকে কয়েকগুন বেশি প্রভাব-প্রতিপত্তি। ধন-সম্পদেও বেশি। তবে তুমি কার কাছে মাথা নিচু করে থাক? মনে রেখ তোমার ঐ নামধারী আদর্শ বিসিএস ক্যাডার বড় ছেলেও যেমন আছে তেমনি তাহমিদ নামক এক অসভ্য ছেলেও আছে। যে তোমাকে কোনদিন ফুলের টোকাও দিবেনা। আর তার বউও হবে স’ভ্য। কোন রূপবতী অ’স’ভ্য’কে বিয়ে করবেনা সে। তুমি বড় ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়েছ ঠিকই কিন্তু মানুষ বানাতে পারনি। তার ফল আজ ভোগ করছ, মা। ” তাহমিদ আর সেখানে দাঁড়ায়না।

তাওহীদ ছোট ভাইয়ের কথা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। নীরা কিছু বলার অবস্থায় নেই। আর নীরার বাবা-মা যেন পালাতে পারলে বাঁচে।
আফরোজা নাজনীন জানেন তাহমিদ যা বলেছে তাতে এক বিন্দুও মিথ্যা নেই। আজ তার কেন যেন তাহমিদকে বুকে জরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ১৮

তাহমিনা আক্তার মুখে আঁচল চেপে কাঁদছেন৷ তার এতদিনের আক্ষেপ, কষ্ট সব চোখের জল হয়ে ঝরছে। সত্যিই তিনি ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন কিন্তু মানুষ বানাতে পারেননি৷
পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে কুহু এতক্ষণ সব দেখছিল৷ তাহমিদের কথা শুনে ও অবাক হয়ে গেছে। সত্যিটা এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে কয়জন দেখাতে পারে!

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ২০