বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩৫

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩৫
জাওয়াদ জামী

মঙ্গলবার বিকেলেই আনান ওর বড় খালার বাসায় হাজির হয়। তবে আসার পথে কুহুকে নিয়ে এসেছে।
কুহু এখানে এসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। সবার সাথে কথা বললেও আশেপাশে তাহমিদকে দেখলনা। আজ কুহু সোজা দিদুনের রুমে আসে। আজ ও দিদুনের সাথে থাকবে।
তাহমিদ বাসায় ফিরে রাত নয়টায়। ওর জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল। তাহমিদ আসলে বড়মা ওকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে। ও ফ্রেশ হয়ে আসলে সবাই একসাথে খাওয়া শুরু করে।

রাত এগারোটা বাজে অথচ কুহুর চোখে ঘুম নেই। দিদুন সেই কখন ঘুমিয়ে গেছে। ঘুম না আসায় কুহু বিরক্ত হয়ে গেছে। খাট থেকে নেমে পা টিপে রুম থেকে বের হয়। সোজা উপরে এসে সিক্তার রুমের দরজায় ধাক্কা দেয়। দরজা ভেতর থেকে লক করা। এবার বিরক্তি তরতরিয়ে বেড়ে যায়। তারপর হঠাৎই মনে ইচ্ছে জাগে ছাদে যেয়ে রাতের প্রকৃতি উপভোগ করতে। যেই চিন্তা, সেই কাজ। কুহু এক দৌড়ে ছাদে আসে। একি! ছাদের দরজা খোলা কেন! কুহু দরজার সামনে এসে ছাদে উঁকি দেয়। কিন্তু পুরো ছাদ ফাঁকা। ও ভাবল হয়ত মনের ভুলে রোজি দরজা লাগায়নি।
ছাদে পা রাখতেই হাসনাহেনার তীব্র সুবাস নাকে এসে বা’রি লাগে। আজ চাঁদ যেন ঝিমিয়ে গেছে। আলোর পসরা সাজিয়ে ধরনীকে করেনি গরবিনী।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কুহু অন্ধকারে ধীর পায়ে হাসনাহেনা গাছের নিকট আসতেই, কোন কিছুর সাথে বেঁধে ধপাস করে পরে যায়।
” আউচ্, এভাবে হাঁটছ কেন! তুমি কি চোখে দেখনা? নাকি আমাকে মানুষ মনে হয়না! সোজা এসে কলিজার উপর ঝাঁ’প দিয়েছ। দিলে তো কলিজার হালুয়া বানিয়ে। তোমাকেই এই কলিজার হালুয়া নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে। তখন কিন্তু আমাকে দো’ষ দিতে পারবেনা। এবার উঠ, নাকি আমাকে দম বন্ধ করে মে’রে দিতে চাও! ” অন্ধকারে কথা বলে উঠে তাহমিদ। সেই সাথে চেপে রেখেছে কুহুর কোমড়।
অন্ধকারে এভাবে পা হড়কানোয়, আবার তাহমিদের কথা বলে ওঠায় কুহুর কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে।

” এতরাতে আপনি ছাদে! ”
” একই প্রশ্ন তো আমারও। ”
” ঘুম আসছিলনা, তাই এসেছিলাম। ”
” আর আমি ঘুমাতে এসেছি। ”
তাহমিদের কথা শুনে ঝটকা লাগে কুহুর। কেউ ঘুমাতেও ছাদে আসে! লোকটা কি দিনদিন পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছে!
” এভাবে নড়াচড়া করোনা। একটু শান্ত হয়ে থাকো কিছুক্ষণ। ” তাহমিদের কথায় কুহুর হুঁশ আসে। এতক্ষণ যাবৎ ও তাহমিদের বুকের উপর পরে আছে!

” ছাড়ুন, আমি উঠব। ”
” আরেকটু পর। ”
” প্লিজ, ছাড়ুন। ” কুহুর কন্ঠে অনুনয় ঝরছে।
” আমি কি সত্যিই তোমাকে ধরে রেখেছি! নাকি আমার সংস্পর্শে আরেকটু থাকতেই এত বাহানা করছ। ”
কুহু লক্ষ্য করল, তাহমিদের বাঁধন থেকেও সম্পূর্ন মুক্ত। কিন্তু এতক্ষণ তো ধরেই ছিল! আবার এখুনি ছেড়ে দিয়ে কত ভাব নিচ্ছে!

কুহু তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। তাহমিদও উঠে বসে।
একটু পর ছাদ কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হয়। তাহমিদ উঠে গিয়ে বাতি জ্বালিয়েছে।
কুহু রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে ওর মেঘবরণ কেশরাশি উড়ছে।
তাহমিদের নিকট এই মুহূর্তে কুহুকে অন্ধকার ফুঁড়ে বের হওয়া অতিমানবী মনে হচ্ছে। পেলব শরীরে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুহু। দাঁড়ানোর মাঝে কোনও জড়তা নেই। আজকাল মেয়েটার মাঝে বেশ দৃঢ়তা দেখা যায়। আগের সেই কুহুর সাথে এখনকার কুহুর বেশ তফাৎ।

তাহমিদ সেই কখন থেকে কুহুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তবুও এতে কুহুর কোন হেলদোল নেই।
” মেঘবরণ কন্যা, এবার অন্তত একটু সদয় হও। তোমার মুখের একটু কথা শোনার আশায় আমি চাতকের ন্যায় চেয়ে থাকি, তবু একটুও দয়া তোমার হয়না। অপেক্ষার অ’ন’লে আর কত পো’ড়া’বে? এ অ’ন’লে’র তীব্রতা যদি জানতে, তবে সেই কবেই আমার বুকে আ’ছ’ড়ে পরতে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু মিটিমিটি হাসছে।
এই মানুষটার কি সব সময়ই প্রেম পায়! যখনই দেখ, তখনই শুধু কথার আবেগে নিজেও ভাসবে,
আবার কুহুকে ভাসাবে।

” বলুন, কি শুনতে চান। ”
” এখন আর কিছু শুনতে চাইনা, অন্য কিছু চাই। ” তাহমিদের সোজাসাপটা জবাব।
কুহু ভুরু কুঁচকে তাকায় তাহমিদের দিকে। কুহুর এমন এক্সপ্রেশান দেখে তাহমিদ হেসে উঠে।
তাহমিদের প্রানখোলা হাসিতে মুখরিত হয় রাতের ধরনী। কুহু মুগ্ধ নয়নে তাহমিদের হাসি দেখছে। আগে কখনোই এই মানুষটার এমন প্রানখোলা হাসি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কারও হাসি কি এতটা মধুর হতে পারে!

” আচ্ছা বাদ দাও, আমার আপাতত কিছুই চাইনা। এবার বল, ফুলতলা থেকে কবে ফিরবে? ”
” তিনদিনের আগে ফিরছিনা। ”
” সাথে বই নিয়ে যেও। পরীক্ষার আর দেরি নেই। সারাদিন টইটই করে ঘুরে, রাতে পড়তে বসবে। আর হ্যাঁ, ঐ সৎমা নামক বি’ভী’ষি’কা’কে অযথা ভয় পাওয়ার কোন দরকার নেই। তুমি এখন ঐ বাড়ির দুই দিনের অতিথি। আর কখনোই সেখানে তোমাকে তিনদিনের বেশি থাকা হবেনা। আর বিয়ের পর তোমার সেখানে যাওয়া বন্ধ। প্রয়োজনে প্রতিমাসে আমার শালাবাবু আর শ্বশুরকে এখানে নিয়ে আসব। তখন তাদের দুচোখ ভরে দেখে নিবে। ”

” কি বলছেন, এসব! ফুলতলা আমার মা, দাদু-দাদি আছে। তাদের কাছে না গেলে আমার ভিষণ কষ্ট হবে। ”
কথা শেষ করে কুহু তাহমিদের দিকে তাকালে দেখতে পায়, তাহমিদ বাম ব্রু উঁচিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদের এমন চাহনিতে কুহু ভরকে যায়।
” শোন, আমি যা বলার বলে দিয়েছি। তবে বছরে একদিন আমি তোমাকে ফুলতলা নিয়ে যাব। আমরা ভোরে রওনা দিব, তুমি সেখানে কিছুটা সময় কাটাবে, আর সেইদিনই আমরা ফিরে আসব। ঐ সৎমার কাছে তোমাকে রাখবার কোন ইচ্ছে আমার নেই। ”

” ওহ্। ” খুব ছোট্ট করে উত্তর দেয় কুহু।
” একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি। ” কুহুকে দাঁড়াতে বলে তাহমিদ ছাদ থেকে বেরিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর ওয়ালেট হাতে নিয়ে ফিরে আসে।
” এই টাকাগুলো রাখ। প্রয়োজনে খরচ কর। ” ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে কুহুর দিকে বাড়িয়ে দেয় তাহমিদ।
” আমার কোনও টাকা লাগবেনা। আপনি রেখে দিন। তাছাড়া আমার কাছে টাকা আছে। আর আপনি টাকা দিচ্ছেন কেন! ”
” এত বেশি কথা বলো কেন! তোমার সকল দ্বায়িত্ব এখন থেকে আমার। তাই টাকা আমি দিতেই পারি। আর টাকা তোমার লাগবে কিনা তা কালকেই বুঝতে পারবে। ”

” বাবা-মা’র কাছ থেকে টাকা নিয়ে, দ্বায়িত্ব পালন করতে আসছে। ”
” এই মেয়ে, এগুলো আমার রোজগারের টাকা। তুমি কি করে ভাবলে, বাবা-মা’ র কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি তোমাকে দিচ্ছি? সব সময়ই দুই লাইন বেশি না বুঝলেই নয়? ”
” আপনি টাকা রোজগার করলেন কিভাবে! কখনো তো কোন কাজ করতে দেখলামনা। ” তাহমিদকে পাত্তা না দিয়ে কুহু বলল।

” এই মেয়ে কি বলে! গত দেড় বছর ধরে আমি দুইটা টিউশনি করিয়ে, প্রতিমাসে ছয় হাজার টাকা রোজগার করি। সেই টাকাগুলো সব জমিয়ে রেখেছি। আর সেই টাকা থেকেই তোমাকে দিচ্ছি। ”
” আপনি টিউশনি করান কেন! আপনার কোন কিছুর অভাব আছে নাকি! ”
” আমি তোমার জন্য টিউশনি করাই। যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি, তোমাকে ভালোবাসি তার মাসখানেক পর থেকে টিউশনি করাচ্ছি। আমি জানতাম একদিন না একদিন তোমাকেই বিয়ে করব। তাই নিজে কিছু রোজগারের চেষ্টা করছি।”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুকের পাঁজরে উথাল-পাথাল ঢেউ আছড়ে পরে। এই মানুষটা আগে থেকেই এত কিছু ভেবে রেখেছে!

কুহু আর দ্বিরুক্তি না করে হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নেয়। পাশে দাঁড়ানো মানুষটাকে টাকা না নিয়ে কষ্ট দিতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা।
” তিনদিনের জন্য ছয় হাজার টাকার দরকার নেই। এক হাজার টাকা হলেই চলবে। ” এক হাজার টাকা নিজের কাছে রেখে বাকি পাঁচ হাজার টাকা তাহমিদের কাছে ফেরত দেয়।
” এটা সম্পূর্ণই তোমার। তোমাকে দিয়েছি, তুমি ইচ্ছে হলে নাও, আর নেয়ার ইচ্ছে না থাকলে ফেলে দাও। আই ডোন্ট কেয়ার। তবুও আমি ফেরত নিবনা। আন্ডারস্ট্যান্ড? ”

” যে নিজেই একটা ত্যা’ড়া’র গ্যারাজ। আর সেই আবার আমাকে বলে ত্যা’ড়া। ”
” গুড। এবার যাও। অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পর। তবে সকালে বেরোবার আগে আমাকে দেখা দিয়ে তারপর যেও। ”
ভোরে ঘুম থেকে উঠে, ফজরের নামাজ আদায় করে কুহু। কিছুক্ষণ পর আসে রান্নাঘরে। সেখানে তাহমিনা আক্তার এবং আফরোজা নাজনীন রান্নার কাজে ব্যাস্ত।
কুহুকে ওর ফুপু সিক্তাকে ডাকতে পাঠায়।
কুহু সিক্তাকে ডেকে তোলে।

সকাল সাতটা বাজতে বাজতে আনানও রেডি হয়ে নিচে আসে।
নাস্তা শেষে ওরা ফুলতলা যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
তাহমিদ সোফায় বসে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর সামনের সোফায় বসে তাহমিনার সাথে কথা বলছে। সিক্তা ওর ব্যাগ নিয়ে নিচে আসলেই ওরা রওনা দিবে।
” মা, তোমার ছোট বউমাকে বলে দাও, তার আদরের ছোটমার কোন ক’টু কথা যেন সহ্য না করে। আমি যদি এরকম কিছু শুনেছি, তবে তার কপালে দুঃ’খ থাকবে প্র’তি’বা’দ না করার জন্য। ”

তাহমিনা আক্তার ছেলের কথা শুনে হাসে। আফরোজা নাজনীনও হাসছেন।
সিক্তা নিচে আসলে ওরা বের হয় ‘ কুঞ্জছায়া ‘র ড্রয়িংরুম থেকে।
সবাই একে একে বেরিয়ে যায়। সবশেষে কুহু বের হতে গেলেই তাহমিদ ওর হাত টেনে ধরে, কপালে টুপ করে চুম্বন আঁকে।
তাহমিদের এমন কাজে কুহুর চোখ রসগোল্লার আকার ধারণ করে।
এদিকে তাহমিদ সেই ঘটনা ঘটিয়েই সেখান থেকে চ’ম্প’ট দিয়েছে।

” কই রে কুহু, তারাতারি আয়। নইলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। ” তাহমিনা আক্তারের ডাকে সম্বিৎ ফিরে আসে কুহুর।
আশেপাশে না তাকিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে আসে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩৪

বিঃদ্রঃ গতকাল শব-ই-বরাত ছিল। তাই আমি লিখিনি। এমনকি গতকাল বিকেল থেকে অনলাইনে ছিলামনা। আজ কাজের ফাঁকে এতটুকু লিখতে পেরেছি। সেটাই পোস্ট করলাম।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩৬