বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ১৭

বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ১৭
মিহি

অভ্রের কলার ধরে রাস্তার এক পাশে ছুঁড়ে ফেলল নাদিম। অভ্র পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে সামলে তেড়ে এলো নাদিমের দিকে। ভার্সিটির বাইরে মারামারি লেগেছে। উৎসুক জনতার কাছে এক বিরাট বিনোদন। সবাই জড়ো হয়ে দেখছে দুজনের মারামারি। নাদিমের বন্ধুরা এসে নাদিমকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। অভ্র এখনো অবধি নাদিমের হঠাৎ আক্রমণের কারণ বুঝে উঠতে পারেনি।

‘আমার তন্বীর দিকে এগোনোর চেষ্টা করলে তোর পা আমি ভেঙে দেব অভ্র। আমাদের শত্রুতা ক্যাম্পাস অবধি ছিল কিন্তু তুই ব্যক্তিগত জীবনে সেটা ইউজ করলি! এর ফল ভালো হবে না।’ বলতে বলতে নাদিম সরে গেল। অভ্র এবার বুঝতে পারলো নাদিম কেন আচমকা এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করলো। তন্বীকে অভ্র এমনিতেও বিয়ে করতো না, তার মনে অন্য কারো বসবাস। তবে নাদিমকে খানিকটা ঘোরানোর সুযোগ সে কিছুতেই ছেড়ে দিবে না। তন্বীর কাছে ফোন দিল সে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাহেলা বানু ফোনে অভ্রের নম্বর দেখেই আন্দাজ করলেন নিশ্চিত তন্বীর সাথে কথা বলতে কল দিয়েছে। জোরপূর্বক তিনি তন্বীকে কথা বলতে বসিয়ে দিলেন এবং নিজেও তন্বীর সামনে বসে পড়লেন। তন্বী যেন অভ্রকে উল্টোপাল্টা কিছু না বোঝায় তার জন্যই এ সতর্কতা।
-‘আসসালামু আলাইকুম।’
-‘ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো তন্বী?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

এটুকু বলেই চুপ করে গেল তন্বী। রাহেলা বানু রক্তচক্ষু মেলে তাকালেন। তন্বী ঢোক গিলে অভ্রকে জিজ্ঞাসা করলো সে কেমন আছে। অভ্র সংক্ষেপে উত্তর দিল ভালো আছে। অভ্র অনেক কথাই বলছে, তন্বী অনিচ্ছাসত্ত্বেও শুনছে। রাহেলা বানুর চোখ রাঙানির ভয়ে মাঝে মধ্যে দু-চারটে প্রশ্ন করছে।
-‘আচ্ছা তন্বী, তোমার সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট নেই কেন? এটলিস্ট হোয়াটসঅ্যাপ রাখো। সবসময় তো কল দিয়ে কথা বলার সুযোগ হয় না।’
-‘আমি আসলে ফোন চালাই না তেমন।’

কথাটুকু বলতেই রাহেলা বানু আবারো চোখ রাঙালো। তন্বীর মনে হচ্ছে তার গলায় কেউ ছুরি ধরে আছে। বেফাঁস কথা বললেই ছুরির এক কোপে গলা দু’ভাগ হয়ে মেঝেতে পড়বে।
-‘আচ্ছা আমি হোয়াটসঅ্যাপ একাউন্ট খুলে আপনাকে এড করছি।’
-‘এক্ষুণি করো।’
তন্বী সায় দিয়ে কল কেটে দিল। রাহেলা বানু তন্বীর সামনে থেকে সরলেন না।
-‘আমার সামনেই কর কী করবি।’

-‘কিছূ করতে পারবো না ধরো। বিয়ের জন্য তো রাজি হইছিই, কথাও বলতেছি ওনার সাথে। তাই বলে সবসময় তোমার সামনে কথা বলা লাগবে? প্রাইভেসি নাই আমাদের? বাসর ঘরে গিয়েও বসে থাইকো।’
তন্বীর কথায় এবার খানিকটা বিব্রত হলেন রাহেলা। ফোনটা তন্বীর কাছে রেখেই তিনি ঘর ছেড়ে বির হয়ে গেলেন। তন্বী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। নাদিমের সাথে কথা বলতে হবে তার। অভ্রকেও জানাতে হবে এ বিয়ে যেন ভেঙে দেয়। একটু ভালো থাকার জন্য কত যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয় তা উপলব্ধি করতে পারছে তন্বী। নাদিমকে নক দেওয়ার সাথে সাথে রিপ্লাই পেল সে।

-‘নাদিম, মা আমার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।’
-‘তুমি তো রাজিই। আমার প্রতি তো তোমার কোনো অনুভূতি নাই। আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে শিখে গেছো।’
-‘নাদিম, এখন ঝগড়া করার সময় না। কী করবো কিছু বুঝতে পারছি না। অভ্রকে না করতে বলবো?
-‘জীবনেও করবে না। আজ মারছি ওরে। এখন তো জেনেও গেছে তুমি আমার প্রেমিকা। এখন আরো বিয়ে ভাঙবে না।’
-‘গাধার বাচ্চা! তোরে এইসব করতে কে বলছিল?’

-‘আরে ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম। এখন তুই-তুকারি ছেড়ে কী করা যায় ভাবো।’
-‘এখন অনামিকা ভাবী ছাড়া কেউ বাঁচাতে পারবে না আমাকে। ভাবীর সাথেই কথা বলতে হবে।’
নাদিম আচ্ছা বলতেই অভ্রের টেক্সট এলো। তন্বী সিন করে রেখে দিল। অভ্রের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই তার নেই। এখন তার একটাই চিন্তা যে বিয়েটা ভাঙতে হবে।

অনামিকার শরীরটা ভালো নেই। খাবার দাবারে প্রচণ্ড অরুচি লাগছে। পরীক্ষার চিন্তায় ওজনটাও অনেকখানি কমেছে বোধহয়। চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। সোহরাবের সাথেও ঠিকমতো কথা হয় না। এ বাড়িতে এখন দম বন্ধ লাগে অনামিকার। সাজিয়া শেখের পর অনেকখানি অভিমান জমে আছে। একবার দেখাও করতে আসেননি তিনি। সেই যে এসেছে তারপর থেকে একটাবার কলেও কথা হয়নি। অনামিকা যতই চেষ্টা করে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার, ততই সাংসারিক নানান চিন্তা ভীড় করে তার মাথায়। ভাবতে ভাবতেই অন্তরা এসে মেয়ের পাশে বসলেন।

-‘কী হয়েছে কী তোর? খাওয়া দাওয়া নিয়ে কি ফাজলামি শুরু করছিস?’
-‘আহ মা, ভাল্লাগছে না এখন। খাওয়ার কথা শুনতেও বিরক্ত লাগছে।’
-‘এহ তুই যা তো, তুই তোর স্বামীর কাছে ফেরত যা। বিরহে একবারে দেবদাসী হয়ে যাচ্ছে।’
রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন অন্তরা। অনামিকা শব্দ করে হেসে উঠলো। অন্তরার এই কপট রাগ সম্পর্কে সে অভ্যস্ত। একটু বাদেই আবার এসে এটা-সেটা খেতে বলবে। মায়ের মন বলে কথা। পড়ার মাঝখানেই সোহরাবের ফোন এলো। অনামিকা ফোন রিসিভ করলো।

-‘মা বলছিল খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিছো! এরকম করলে তোমাকে বাড়িতেই তুলবো না বলে দিচ্ছি। অসুস্থ হলে তো আরো খবর আছে।’
-‘বাব্বাহ! জামাইয়ের কাছে নালিশ করা হয়ে গেছে এত তাড়াতাড়ি?’
-‘বাচ্চামি শুরু করছো অনামিকা? কতটা প্রেশার যাচ্ছে আমি বুঝি না? এর মধ্যে যদি না খেয়ে থাকো তাহলে এক্সামে বসার আগে হাসপাতালে এডমিট করতে হবে।’

-‘হয়েছে বুঝছি। মায়ের কী হয়েছে বলেন তো, একবারও কল দিল না। আমি কল দিলাম, রিসিভও করলেন না।’
-‘মায়ের ফোন নষ্ট, ডিসপ্লে কাজ করছে না। কল দিয়ে লাভ নাই।’
-‘তাহলে অফিস থেকে ফিরে মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দিয়েন আমার।’
-‘আচ্ছা বলিয়ে দেবো। তুমি খেয়ে নাও। মায়ের যেন বলা না লাগে আর।’
অনামিকা হুহ বলে কল রাখলো। কয়েকদিন ধরেই তার মনে অস্থিরতা কাজ করছে। কোথাও একটা শুন্যতা অনুভব করছে সে। অনামিকা ঠিক করলো আজ একবার ও বাড়িতে যাবে। মায়ের সাথে দেখা করে কাল ফিরে আসবে। কিন্তু সোহরাবকে আগেই জানাবে না, হঠাৎ গিয়ে সারপ্রাইজ দিবে।

ইমাদের মন-মেজাজ বেজায় খারাপ। সুমির সাথে স্বাভাবিক ভাবে মেশার চক্করে তানহাকে সময় দিতে পারছে না সে। এদিকে তানহা মনে করে বসে আছে ইমাদ অন্য কারো সাথে প্রেম করছে। এদিকে ইমাদ সুমিকেও সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারছে না। কিন্তু দুই নৌকায় আর কতদিন? ইমাদ ঠিক করেছে তানহাকে প্রথমে সবটা বুঝিয়ে বলবে। তানহা যদি বুঝতে না চায় তাহলে না চাইতেও সুমির সাথেই বোঝাপড়াটা সারতে হবে তার। অন্যদিকে সোহরাবের জোরাজুরি তো আছেই। তাকেও বোঝাতে হবে। সব মিলিয়ে ইমাদের অবস্থা শাঁখের করাতের মতো, এদিকে গেলেও কাটে ওদিকে গেলেও কাটে।

বিকেলবেলা মাত্র রেডি হয়ে বেরোতে নিয়েছে অনামিকা। এরই মধ্যে বারবার ফোন বাজছে। অনামিকা বেশ বিরক্ত হলো। ফোন নামক জিনিসটা কি বিরক্তিকর সব পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই জন্মেছে নাকি? একটা জায়গায় যাওয়ার জন্য অনামিকা তাড়াহুড়ো করছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই বারবার এই ফোনটার কেন বাজতে হবে? মাথা ঠাণ্ডা করলো অনামিকা। নিশ্চয়ই কোনো ইমার্জেন্সি। নাহলে তো কেউ অযথা এতবার কল দিবে না।

বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ১৬

অনামিকা নম্বর চেক না করেই ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো। অপর পাশ থেকে করুণ কান্নার স্বর ভেসে উঠলো। অনামিকা খানিকটা বিস্মিত হলো। কান্নার কারণে বোঝাই যাচ্ছে না কে কল করেছে। অনামিকা নম্বর চেক করতে যাবে এমন সময় অপর পাশের ব্যক্তি মুখ খুললো। পরবর্তী পাঁচ মিনিটের কথার সবটুকুই অনামিকার মনে ভয়ানক ঝড় তুললো। এতদিন ধরে তার মনের অস্থিরতা তবে অহেতুক নয়। আসলেই তার কাছের মানুষজনের বিপদ অতীব সন্নিকটে!

বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ১৮