বিয়ে থা সিজন ২ পর্ব ৩
তাহিনা নিভৃত প্রাণ
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভীড় জমেছে। নিনীকা বিরক্তিতে চোখমুখ শক্ত করে রেখেছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর তার ঘুম হয়নি। মাথা ব্যথায় মনে হচ্ছে চিৎ হয়ে পড়ে যাবে যেকোনো সময়। তার উপর চারিদিকের এমন হৈচৈ তার মাথা ব্যথা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। গেইটের বাহিরে মিডিয়াকে সামলাচ্ছেন ডিরেক্টর। নিনীকার পাশে দাড়িয়ে আছে তার সিনেমার নায়ক নির্ঝর আব্রাহাম। সে ও যে মারাত্মক বিরক্ত তা নিনীকা বুঝতে পারছে। ইতিমধ্যেই আব্রাহাম কয়েকবার বলে ফেলেছে,
‘ মিস নিনীকা মাথা ধরে যাচ্ছে, আপনি ঠিক আছেন কিভাবে এখনো? ‘
নিনীকা বিনিময়ে হাসি দিয়েছে। তারও যে মাথা ফে*টে যাচ্ছে সেটা সে একদমই বুঝতে দিচ্ছে না। পেইন কিলার খেয়েছে, বিমানে উঠে একটু ঘুম দিবে। ব্যস রিলিফ কাজ করবে অনেক।
বিমানবন্দরে সাদা পোশাক পড়া একদল লম্বা ও বলিষ্ঠ শরীরের পুরুষের প্রবেশ ঘটেছে। সবাই হা করে সেদিকে তাকিয়ে আছে। মাথার আর্মি কাট বলে দিচ্ছে তাদের পরিচয়৷ নিনীকার ডান দিকে দাঁড়ানো কাজের বোয়ার চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী তনু মুখে হাত দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ এদেরকেই বলে সত্যিকারের পুরুষ। দেখেছো নিনীকা? ‘
নিনীকা নিজেও তাকিয়ে ছিল। একসাথে এতজন লম্বাচওড়া শরীরের পুরুষ দলবদ্ধ হয়ে আসাতে দেখতে সুন্দর লাগছিল। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বলল,
‘ আল্লাহর সৃষ্টি সব সুন্দর তনু আপা। ‘
‘ এদের মধ্যে কেউ যদি আমাকে প্রপোজ করতো! নিনীকা আমি কি একটু ট্রাই করে দেখবো? ‘
নিনীকার মাথা ব্যথা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। বলল,
‘ দেখতে পারেন। ‘
তনু হাইহিলের শব্দ তুলে এগিয়ে গেলো। সোজা গিয়ে দাড়ালো দলবদ্ধ সেই পুরুষদের সামনে। সাদা পোশাকে থাকা আর্মি অফিসার গুলো একসাথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তনুর দিকে। স্বাভাবিক দৃষ্টি অথচ কতো ধারালো৷ তনু কিছু বলতে পারলো না, বরং স্যরি বলে সামনে থেকে সরে পড়লো।
একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা নিনীকা ও আব্রাহাম ঠোঁট চেপে হাসলো। আব্রাহাম বলল,
‘ এই তনু আপা ও পারেন বটে। ‘
অফিসার ওগুলোকে আড়চোখে দেখলো নিনীকা। চেহারা ফ্যাক্ট নয়, এদের জন্য প্রায় অনেক মেয়েই পাগল থাকে শুধুমাত্র ফ্যাশনের জন্য। ওদের স্টাইল টিনেজারদের অনেক পছন্দের। তার উপর দেশের সৈনিক, নরম মনের মেয়েদের মনে প্রভাব পড়বে স্বাভাবিক। তনু আপা টিনেজার নন, কিন্তু নরম মনের মানুষ। তিনিও যে ইতিমধ্যে দলবদ্ধ থাকা সব সৈনিকের উপর মারাত্মক ক্রাশ খেয়েছেন সেটা ভেবেই নিনীকার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
তনু আপা গোমড়ামুখে এসে দাঁড়ালেন।
‘ বুঝলে নিনীকা অফিসার গুলো কেমন যেনো। ‘
‘ কেমন আপা? ‘
‘ জানিনা বাবা, কেমন করে যেনো তাকালো আমি ভয় পেয়ে কিছু বলতেই পারিনি। ‘
আব্রাহাম হেসে বলল,
‘ তারা সবাইকে প্রথমে অপরাধীর দৃষ্টিতে দেখে। যদি তাকানোর পর মনে হয় সামনে দাড়ানো ব্যক্তি চোর বা অপরাধী হতে পারে না তখনই তাদের দৃষ্টি নরম হয়। ‘
তুন আপা ভেঙচি দিলেন,
‘ তুমি এতো কিছু জানো কেমনে বাপু। ‘
‘ আমার একটা জমজ ভাই আছে আপা, সে আর্মির একজন ক্যাপ্টেন। ‘
মিডিয়া সামলে ডিরেক্টর অবশেষে এলেন। নিনীকাদের সাথে অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করার জন্য বাকি অভিনেত্রী অভিনেতারাও এসেছেন। সবাই এয়ারপোর্টের ফর্মালিটি সেরে বিমানে চেপে বসলেন। এবং সবাইকে বকবকানি করতে দেখতে দেখতে নিনীকা ঘুমিয়ে ও পড়লো। নায়ক আব্রাহাম নিজের পাশে বসা নিনীকার আকস্মিক ঘুমিয়ে পড়াতে অবাক হলো। ডিরেক্টর ইশারায় নিনীকার মাথা ব্যথার কথা জানিয়ে দিলেন। আব্রাহাম ঠোঁট উল্টে ভাবলো মেয়েটাকে সে যখন নিজের মাথা যন্ত্রণার কথা বললো তখন হাসলো কেন!
নিনীকা শেখ একটু অদ্ভুত টাইপের মানুষ। আব্রাহামের সাথে এটা নিয়ে দ্বিতীয় সিনেমায় অভিনয় করবে সে। দারুণ একজন অভিনেত্রী সে। সেটা প্রথম সিনেমার কাজেই বুঝেছে আব্রাহাম৷ কিন্তু নিনীকাকে তার একটু অহংকারী মনে হয়। যেখানে সব নায়িকারা তার সাথে কাজ করতে এসে রীতিমতো উপরে পড়তে চায় সেখানে নিনীকা কখনো নিজ থেকে কথাও বলেনা প্রয়োজন ছাড়া। আপনি ছাড়া কখনো তুমি বলেছে বলে আব্রাহাম মনে করতে পারছে না। তারা সমবয়সী। নিজের এই ক্যারিয়ারে আব্রাহাম অসংখ্য নায়িকার বেড অফার রিজেক্ট করেছে। কারণ আছে অবশ্য, তার প্রেমিকা আছে। এবং সেই প্রেমিকাকে নিয়েই সে হ্যাপি। অন্য কোনো নারীর সান্নিধ্য তার প্রয়োজন হয়না।
নিনীকাকে এদিক থেকে আব্রাহামের ভালো লেগেছে। অযথা ঘেঁষাঘেঁষি সে নিজেও পছন্দ করে না। এমনি সিনেমায় অভিনয় করা ঘনিষ্ঠ কোনো দৃশ্য দেখলে তার প্রেমিকা খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। স্কুল লাইফের প্রেমিকাকে নিয়ে আব্রাহাম বরাবরই ভীষণ চিন্তিত থাকে।
থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্টে যখন সবাই নামলো তখন তনু আপা মৃদু চিৎকার করে উঠলেন।
‘নিনীকা লুক, সেই অফিসার গুলো! ‘
নিনীকা তাকালো। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ তো? ‘
‘ ওহ নিনীকা, তুমি অনেক নিরামিষ। ‘
নিনীকা কিছু বললো না। ট্রলি টেনে নিয়ে সবার সাথে এয়ারপোর্ট ত্যাগ করলো।
রাত হয়ে গেছে। ধারা সেই সকাল থেকে ছেলেকে একের পর এক কল দিচ্ছেন। কিন্তু বন্ধ দেখাচ্ছে। ধ্রুব তো প্রতিদিন একবার করে হলেও ফোন দিয়ে কথা বলে। আজ বলেনি, সেজন্য ধারার চিন্তার শেষ নেই। ফারিন নিজেও মন খারাপ করে বসে আছে। তার ভাই ঠিক ভাবে পৌঁছেছে কি না সেটা ও তো জানাতে ফোন করতে পারতো।
ফাহিম মাহবুব বাড়িতে ঢুকে স্ত্রী ও কন্যার গোমড়ামুখ দেখে চিন্তিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘ দুজনের কি হয়েছে? ‘
ফারিন ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ বাবা ব্রো’র ফোন বন্ধ সকাল থেকে, সে নিজে থেকে একটাও কল করেনি আজ। ‘
‘ তোমার ছেলেকে কি আমি বেশি চাপ দেই ফাহিম? একটা দুটো কলই তো প্রতিদিন দিতে বলি। মা আমি, আমার কি সন্তানের জন্য মন পুড়ে না? ‘
‘ ধারা তুমি ভুল ভাবছো। ধ্রুব দেশে নেই। ‘
ধারা আঁতকে উঠলেন,
‘ কিহ! কোথায় ধ্রুব? কোথায় আমায় ছেলে? ‘
‘ সে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশনে দেশের বাহিরে গেছে। ‘
ধারা কেঁদে ফেললেন,
‘ তুমি আমাকে এখন এসব বলছো! ফাহিম ধ্রুব মিশনে গেছে! বুঝতে পারছো তুমি? আমার ছেলেকে ফিরিয়ে এনে দাও। আমার একটামাত্র ছেলে ফাহিম। ‘
‘ আমি কিছু করতে পারবো না ধারা। আর তাছাড়া ধ্রুব এরকম কতো মিশনে যায়, মেজর সে এসব তো তার কাজ।’
‘ লাস্ট মিশন থেকে ফিরে ওর কি অবস্থা হয়েছিল দেখোনি? আমার ছেলের গুলি লেগেছিল। তুমি, তুমি চাইলেই পারতে গতকাল আমাকে বলে দিতে। কিন্তু তুমি বলোনি৷ আমার ছেলের কিছু হলে আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না। ‘
ফাহিম মাহবুব বুঝাতে চেষ্টা করলেন,
‘ লিসেন ধারা, ধ্রুব নিজে আমাকে বারণ করেছিলো। আর এটা ওর কাজ। তুমি যদি ওকে না করতে ও কি শুনতো? আর তাছাড়া তুমি কিভাবে ওকে মানা করতে? বি স্ট্রং ধারা, তুমি তো এমন নও। তুমি ধ্রুবর সেই মা যে ধ্রুকে শিখিয়েছে কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমি ধ্রুবর বাবা, ও আমাকে বিশ্বাস করে বলেছে। তোমাকে যদি আগে জানিয়ে দিতাম তো ধ্রুব আর কখনো আমাকে কিছু বলতো না। ছেলের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ একটি সম্পর্ক রয়েছে।
বিয়ে থা সিজন ২ পর্ব ২
‘ ফাহিম আমার একটামাত্র ছেলে! ওর কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে থাকবো! ‘
‘ কিছু হবে না, ওর জন্য দোয়া করবে শুধু। ও আমারও ছেলে। আমি যখন আর্মির জব করে এতো বছর পরিবারের পাশে আছি, ধ্রুব ও থাকবে। ও নিজের বাবার থেকেও সাহসী! এবং আমি আমার ছেলেকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। সে বলেছে সফল হয়ে ফিরে আসবে। ‘