বিয়ে পর্ব ১২

বিয়ে পর্ব ১২
ইসরাত জাহান ফারিয়া

কোচিংয়ে অদ্রি দশ মিনিট লেইটে ঢুকলো। পুরো একঘর ভর্তি ছেলে-মেয়ে। বসার জায়গা আলাদা। অদ্রিকে একটা মেয়ে প্রথম বেঞ্চে জায়গা করে দিলো। পড়ানো শুরু হলো একটা সময়। অদ্রি মনোযোগ দিয়ে স্যারদের কথা শুনছে। কিন্তু ছেলেরা সেদিনের মতোই অদ্রির প্রতি মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো। এদের মধ্যে একজনের নাম রাহাত। খুব ব্রিলিয়ান্ট, দেখতেও বেশ ভালো। সে একটু পরপর অদ্রিকে আড়চোখে দেখতে লাগলো। পাশে বসা রাহাতের বন্ধু পরশ ওর কানেকানে জিজ্ঞেস করল,

— কি মাম্মা? এতদিন পরে মনে ধরছে নাকি
অবশেষে?
রাহাত হাসলো। বলল,
— এত কথা না বলে ফোন নাম্বারটা জোগাড় করে দেওয়ার ব্যবস্থা কর!
পরশ তার সাদা দাঁত বের করে হেসে বলল,
— দু’দিন সময় দে দোস্ত!
— দিলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

বলে রাহাত হাসলো। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ে তার নজর কেড়েছে। তার খুব কৌতূহল হচ্ছে মেয়েটির সম্পর্কে জানতে। পরশ বলল,
— যেভাবেই হোক তোরে ভাবির ফোন নম্বর জোগাড় কইরা দিবো দোস্ত।
রাহাত খানিকটা রেগে বলল,
— ভাবি? এখনই? এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো
না? পরে দেখা যাবে মেয়ের অন্য কোনো রিলেশন আছে।
পরশ ভাবুক গলায় বলল,

— তাও ঠিক। তবে তোর যখন মনে ধরছে তখন
অন্য কোথাও রিলেশন থাকলেও আমরা চেষ্টা কইরা
দেখবো।
রাহাত বলল,
— তোর কি ধারণা আমি এমন?
পরশ বোকা বোকা হেসে বলল,
— আ আমি তো মজা করছিলাম দোস্ত…

ক্লাসে ফিসফিস আওয়াজ হচ্ছে শুনে টিচার এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলেন রাহাত পরশের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। রাহাতকে এমন অমনোযোগী দেখে তিনি বেশ রেগে গেলেন। ওর মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট কিনা পড়া বাদ দিয়ে গল্প করছে? তিনি এটা মেনে নিতে পারলেন না। বেশ রেগে রাহাত আর পরশকে দাঁড় করালেন সবার সামনে। তারপর জোর গলায় ধমকে ওঠলেন,

— এটা কি গল্প করার জায়গা? নিজেরা অমনোযোগী বলে অন্যদের ডিস্টার্ব করবে? শিক্ষা-দীক্ষা ভুলে গেছো নাকি তোমরা?
রাহাত মাথা নিচু করে বলল,
— স্যরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না।
— এখানে তোমার মা-বাবা পড়াশোনা করতে
পাঠিয়েছে, গল্প কর‍তে নয়। পড়তে হলো পড়ো নয়তো বাইরে বেরিয়ে গল্পের আসর জমাও।
পরশও লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,

— আর হবে না স্যার।
টিচার নিজের রাগ শান্ত করে বললেন,
— ফার্স্ট টাইম বলে ছেড়ে দিলাম। আবার রিপিট হলে
অভিভাবক ডাকাবো। বসো।
রাহাত আর পরশ বসে পড়লো। সবার সামনে এভাবে
বকা খেয়ে দুজনেরই মুখ কালো হয়ে আছে। পরশ নিচু স্বরে বলল,
— এতগুলো মেয়ের সামনে কি অপমানটাই না হইলো।
রাহাত রেগে বলল,

— চুপ থাক, নয়তো আরও অপমানের বাকি আছে!
ধমক খেয়ে পরশ চুপ রইলো। রাহাত পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তেমন একটা মন দিতে পারলো না। এতগুলো মেয়ের সামনে জীবনের প্রথম কোনো স্যারের ঝাড়ি খেয়েছে সে। সবই পরশের জন্য।
রাহাতের মনটাই বিষন্ন হয়ে গেলো।

ধ্রুব অদ্রিকে কোচিংয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো ওয়েটিং রুমে। ভেবেছিলো একেবারে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু অফিস থেকে হঠাৎ ফোন আসায় না চাওতেও ওকে চলে যেতে হলো। অদ্রিকে কোচিং শেষে নিতে আসবে বলে গেছে। যদিও অদ্রি মানা করেছিলো তবুও ধ্রুব রাজি হয়নি। কোচিং শেষে অদ্রি বাইরে ধ্রুব’র জন্য অপেক্ষা কর‍তে লাগলো। ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটায়। অদ্রিকে অপেক্ষমান দেখতে পেয়ে একটি মেয়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা দেখে অদ্রি চিনতে পারলো এই মেয়েটা তার
কোচিংয়েই পড়ে। মেয়েটি এসে বলল,

— হাই, আমি নীরা। তোমার সাথে পরিচিত হতে এলাম।
অদ্রি হাসিমুখে বলল,
— আমি অদ্রি।
নীরা বলল,

— একা একা দাঁড়িয়ে আছো যে? কেউ নিতে আসবে?
— হ্যাঁ। তুমি যাওনি যে?
নীরা লাজুক হেসে বলল,
— ফিয়ন্সের নিতে আসার কথা, তাই ওয়েট করছি।
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে বলল,

— কংগ্রাচুলেশনস। ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি?
— তা আছে বৈ-কি! ফিয়ন্সে হওয়ার আগে ও আমার বহুদিনের প্রেমিক ছিলো।
অদ্রি হেসে বলল,
— বাহ!

নীরা লাজুক হাসলো। এভাবেই আরও নানা কথা হলো দু’জনের মধ্যে। পড়াশোনা নিয়েও আলোচনা হলো। একসময় নীরার ফিয়ন্সে এলো ওকে নিতে। বেশ হাসিখুশি একটা ছেলে। নীরা পরিচয় করিয়ে দিলো অদ্রির সাথে। পাতলা চেহারার তরুণের চোখে নীরার জন্য উপচে পড়া ভালোবাসা দেখতে পায় অদ্রি। দু’জনকে বেশ মানিয়েছে। সত্যি ভালোবাসা
দেখতেও ভালো লাগে। মা মারা যাওয়ার পর অদ্রির মনে একটা সুপ্ত ধারণা জন্মেছে। ভালোবাসার মানুষটা বেঁচে থাকা পর্যন্তই মানুষ তাঁকে ভালোবাসে।
পৃথিবী থেকে তাঁর অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার সাথে
সাথেই তার জায়গাটা অন্য কেউ দখল করে নেয়।

তাই অদ্রি কাউকে ভালোবাসতে চায় না। কারো সাথে নিজেকে এতোটাও জড়িয়ে ফেলতে চায় না, যাতে একসময় নিজেরই কষ্ট পেতে হয়। তাঁর মা-ও
হয়তো ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে বাবার এই পরিবর্তন দেখে। অদ্রির মনে পড়ে, তার বাবা কিভাবে তাঁর মা আর
ওকে ভুলে অন্য একটা মহিলাকে পনেরো দিনের মাথায় বিয়ে করে নিয়ে এসেছিলো! যে বাবা অদ্রিকে ছাড়া খেতে পারতো না, বাইরে গেলে সারাক্ষণ
উদ্বিগ্ন থাকতো, মেয়ের চিন্তায় মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়তো সেই বাবা এতগুলো দিন কি অনায়সেই
কাটিয়ে দিতে পারছে! মানুষ সময়ের সাথে পাল্টায়, বড্ড পাল্টায়। অদ্রি তার কষ্টের স্মৃতিগুলো ভাবতে চাইলো না।

একসময় নীরা ওকে ‘বাই’ জানিয়ে তার ফিয়ন্সের সাথে চলে গেলো।
নীরা চলে যাওয়ার পর অদ্রি একাকিত্ববোধ করতে লাগলো। বারবার ঘড়ি চেক করছে। অলরেডি আধঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ও ভীষণ বিরক্তবোধ করলো। ধ্রুব কি ওকে নিতে আসার কথা ভুলে গেলো? অদ্রির মন খারাপ হয়ে গেলো। ধ্রুব’র প্রতি অভিমান জন্মালো। কেন তা জানে না, হয়তো নীরা আর তার হবু বরের ভালোবাসা দেখে! অদ্রি রিকশা ঠিক করে একাই বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো। ঢাকা শহরের জ্যামের কারণে বাড়ি ফিরতে ওর দুপুর হয়ে গেলো। বাড়ি ফিরে
লিভিংরুমে পা রাখতেই দেখে শায়লা হাসানের কান্নারত চেহারা। অদ্রি বিস্মিত হয়ে যায়। জরিনা ওকে দেখে খুশি হয়ে বলে ওঠে,

— খালাম্মা দেখেন, ভাবিজান আইয়া পড়ছে।
অদ্রিকে দেখে শায়লা প্রাণ ফিরে পাবার মতো করে কেঁদে ফেললো। অদ্রি দৌড়ে গিয়ে তার পাশে বসে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— কি হয়েছে আন্টি? কাঁদছো কেন?
শায়লা হাসান চোখমুখ মুছে বলল,
— কোথায় ছিলি তুই? ধ্রুব তোকে আনতে গিয়ে দেখে তুই ওখানে নেই। ছেলেটা যখন ফোনে আমাকে এই খবর জানালো আমার তো আত্মা নাই হয়ে গেছিলো। সেই কখন থেকে ধ্রুব তোর খোঁজ করছে। তোর আংকেল আর আমি তো টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।
অদ্রি অবাক হয়ে বলল,

— আমি তো ওনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ওনি লেইট করেছিলেন তাই ভাবলাম ভুলে গেছে বোধহয়। সেজন্য একাই রিকশা করে চলে এসেছি।
শায়লা কান্নাভাব নিয়েই বললেন,
— তোর যদি কিছু হয়ে যেতো? আমি কি করতাম?
যতীনকেও পাঠিয়েছি তোকে খুঁজতে। ধ্রুব তো খুব রেগে আছে!
জরিনা চেঁচিয়ে বলল,

— হায়রে ভুইলা গেছি। ভাইজানরে ফোন দিয়া জানাই দেই খালাম্মা। ভাবি আইজকা ভালাই ঝাড়ি খাইবো। কি একটা অবস্থা!
বলেই জরিনা ধ্রুবকে ফোন করে অদ্রির বাড়ি
ফেরার খবরটা জানিয়ে দিলো। সকলের কান্ড দেখে অদ্রি বোকা হয়ে গেলো। ও তো ভেবেছে ধ্রুব বোধহয় ওকে আনতে যাওয়ার কথা ভুলে গেছে। সেজন্যই তো একা চলে এসেছে। এখানে ওর কি দোষ? অদ্রি মনে মনে খানিকটা ভয় পেলো। ধ্রুব আবার বকাঝকা শুরু করবে না তো ওকে? ইশ, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে এই অহেতুক ঝামেলাটা হতোই না। সবাই কত চিন্তা করছিলো!

ধ্রুব ফোন পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে দম নিলো। যতীনের খুব মায়া হলো ওর জন্য, ও পানি এগিয়ে দিলো ধ্রুব’র দিকে। চিন্তায় চিন্তায় ধ্রুব’র এতক্ষণে পাগল হবার দশা। কোচিংয়ে গিয়ে যখন জানতে পারলো অদ্রি সেখানে নেই, তখনই ওর মাথায় নানারকম খারাপ চিন্তা চলে এসেছিলো। বাড়িতে ফোন করেও জানলো যখন অদ্রি পৌঁছায়নি তখন সেন্টারের পুরো এলাকা যতীনকে নিয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে এতক্ষণ। অদ্রি পেয়েছেটা কি? নিজের মর্জিমতো যা খুশি তাই করে বেড়াবে?

প্রথমদিনই ধ্রুব’কে এত হেনস্তা করে ছেড়েছে। ভেবেই মেজাজ সপ্তমে পৌঁছালো ওর। না-হয় একটু দেরি হয়েছেই, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই হয়ে যেতো। ধ্রুব কি আর ইচ্ছে করে দেরি করেছে নাকি? ঢাকা শহরের জ্যামের কথা চিন্তা করে ধ্রুব’র মুখ দিয়ে কিছু গালি বেরিয়ে এলো। বাড়ি ফিরলো দ্রুত। লিভিংরুমে এসে দেখলো শায়লা কাজ করছে। তা মনের অবস্থা আন্দাজ করে ধ্রুব জরিনাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো অদ্রির কথা। জানতে পারলো অদ্রি তার ঘরে। ধ্রুব ঘরে এসে দেখলো অদ্রি ফ্রেশ হয়ে এসেছে। ও রেগে বলল,

— তুমি এ কাজটা কীভাবে করতে পারলে? তন্নতন্ন করে খুঁজেছি তোমায়।
ধ্রুব’র চেহারা বিধস্ত। অদ্রির অপরাধবোধ জাগ্রত হলো। নতমুখে বলল,
— আমি আসলে বুঝতে পারি নি। ভেবেছি আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন…
— ভুলে গেছি? ধ্রুব কখনো নিজের দেওয়া কথা ভুলে না। তোমার একবারও মনে হলো না আমার কথা? ফোন পর্যন্ত ব্যবহার করো না তুমি!
অদ্রি লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,

— স্যরি।
ধ্রুব’র মাথা গরম হয়ে গেলো স্যরি শুনে। ওর হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে আর অদ্রি স্যরি বলছে? ব্যাপারটা কি এতই সোজা? ও অদ্রির কাঁধ চেপে ধরে বলল,
— তুমি কি তোমার বন্ধুদের সাথে এসেছো? সেজন্য আমাকে ভুলে গেছিলে?
অদ্রি বিস্ময় নিয়ে বলল,

— আমার ব্যাপারে আপনি এসব ভাবেন?
ধ্রুব নিজের ভুল বুঝতে পারলো। মাথা গরম থাকলে ওর ভাবনাচিন্তা কাজ করে না। যা মুখে আসে বলে ফেলে। ধ্রুব’র চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— একদম ভাবি না। শুধু জানতে চাইছি। কারণ তুমি আমার সাথে যেতে আনইজি ফিল করো।
ধ্রুব প্রচন্ড অস্থির হয়ে পড়লো। অদ্রি নমনীয় গলায় বলল,

বিয়ে পর্ব ১১

— না। বাট আমাকে নিয়ে এত ইনসিকিউরড ফিল
করবেন না। আমি বাচ্চা নই। আজকের জন্য সত্যি ক্ষমা চাইছি, আর কখনো এমন হবে না। আপনি অস্থির হবেন না।
ধ্রুব নিজেকে সামলাতে পারলো না। আচমকা এক অভাবনীয় কান্ড করে বসলো। একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অদ্রির মুখের দিকে। ধীরগতিতে ঠোঁট এগিয়ে নিলো অদ্রির দিকে। শক্ত এক চুমু বসালো অদ্রির কপালে, অনেকটা সময় নিয়ে। অদ্রি কেঁপে ওঠলো। হাত-পা পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে গেলো ওর!

বিয়ে পর্ব ১৩