বিয়ে পর্ব ১৪

বিয়ে পর্ব ১৪
ইসরাত জাহান ফারিয়া

অদ্রি মুখ গোঁজ করে বলল,
— না তো। এঘরে আমার থাকতে-পড়তে অসুবিধা হবে। আপনি কখন কোন দৃষ্টিতে তাকান আমি তো আর জানবো না।
ধ্রুব রেগে বলল,

— আমি যে দৃষ্টিতেই তাকাই না কেন সেখানে কু-দৃষ্টি থাকে না। কারণ তুমি আমার বউ।
অদ্রির হাতে থাকা বই ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল। চোখ বড় বড় করে বলে ওঠলো,
— কি বললেন?
ধ্রুব কাতরতা নিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

— বলেছি তুমি এঘর ছাড়া অন্য কোথাও যেতে পারবে না। বুঝো না কেন অদ্রি? তুমি আমার ঘরে না থাকলে আমার জ্বর হবে, ভীষণ জ্বর!
অদ্রি থমকে গেলো। ধ্রুব’র কথাবার্তা স্বাভাবিক নয়। অদ্ভুত আচরণ লোকটার। ও কড়া গলায় বলল,
— আপনার জ্বর হলে আমার কি? আমি তো আর ডাক্তার নই যে চিকিৎসা করাবো।
ধ্রুব অধৈর্য্য হয়ে ওঠলো,

— চিকিৎসা লাগবে না অদ্রি।
কথাটা বলেই ধ্রুব চুপ করে গেলো। মনে মনে ভাবলো তুমিই তো আমার ঔষধ। কিন্তু মুখে বললো না। এসব কথা সরাসরি বলা যায় নাকি? অদ্রি বলল,

— তাহলে থাকুন। আপনার ঘর আপনারই রইলো। আমি তো রাত জেগে পড়বো সেক্ষেত্রে আপনার আর সমস্যা হবে না। টেবিল আর ওয়্যারড্রোবটা তো এখানে রইলো মাঝেমধ্যে দরকার পড়লে নিজের জিনিসপত্র নিতে আসবো। বাই।
বলে অদ্রি নিজের বইখাতা গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে ধ্রুব ধপ করে বসে পড়লো।
নিজেকে নিজে গালি দিলো। কেন বলতে গিয়েছিলো অদ্রিকে ওসব কথা? এই মেয়ের মনে যে মায়াদয়া নেই সেটা তো ও জানতো। ধ্রুব কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে একসময় বিরক্তি নিয়ে ওঠে দাঁড়ালো। দেখতে হবে অদ্রি কোন ঘরে থাকবে, বেশি দূরে না গেলেই হলো!

পড়াশোনার অযুহাত দিয়ে শায়লাকে বলে অদ্রি ঘর আলাদা করেছে। শায়লাও রাজি হলো। মেয়েটা নিজের মতো পড়াশোনা করতে চায়, থাকতে চায় এতে যদি ও খুশি থাকে তাহলে তার আর কি! তবে বাড়িতে গেস্টরুম বাদে শুধুমাত্র দুটো ঘরই খালি ছিলো। একটা নিচতলায় রান্নাঘরের পাশে। অন্যটি ধ্রুবে’র ঘরের মুখোমুখি। শায়লা অদ্রিকে সেখানেই থাকতে বললো।

অদ্রি বইখাতা টেবিলে গুছাচ্ছিলো। এই ঘরে বিশাল একটা বারান্দা আছে, জানালাগুলোও খোলামেলা। বাইরে থাকা কাঠবাদাম গাছটার ছায়া পড়ে এখানে। রোদের আলো খুব কমই আসে। নিরিবিলি পরিবেশটা অদ্রির খুব পছন্দ হলো। বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে গল্পের বই পড়ছিলো ও। আচমকা চোখ পড়লো ভিড়িয়ে রাখা দরজার দিকে। ওর মনে হলো কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। পর্দার নিচ দিয়ে কারো পা দেখা যাচ্ছে। অদ্রি সন্দেহ নিয়ে ছোট ছোট চোখ করে দেখতে লাগলো। সাদা পা আর নেভি ব্লু ট্রাউজারটা দেখে নিশ্চিত হয়ে গেলো এটা আর কেউ নয়, ধ্রুব! ও চেঁচিয়ে বলে ওঠলো,

— মিস্টার ইফতেখার হাসান, এরকম চোর চোর আচরণ করছেন কেন?
ধ্রুব বাইরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ লুকিয়ে লুকিয়ে লক্ষ্য করছিলো অদ্রিকে। মেয়েটা একা একা কি সুন্দর ভাবছে, পড়ছে সেগুলো উপভোগ করছিলো।
কিন্তু হঠাৎ এভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি। অদ্রির মুখে “চোর” শুনে ধ্রুব’র বুক কেঁপে ওঠলো। ও দ্রুত লম্বা লম্বা পা ফেলে নিজের ঘরে চলে এলো।
ধ্রুব’কে ঘাবড়ে দিয়ে অদ্রি খুব মজা পেলো।

লোকটাকে সে বুঝে ওঠতে পারে না। এমন নয় যে ধ্রুব খুব খারাপ ছেলে বা অদ্রির সাথে সে অত্যাধিক খারাপ আচরণ করে। সবকিছুতেই সে পারফেক্ট। কিন্তু তবুও কোথাও গিয়ে ও আটকে যায়। এখন আর কাউকে সহজে মেনে নিতে চায় না ওর মন। আজকাল ধ্রুব’র এমন আচরণও ওকে বেশ ভাবাচ্ছে। ওকে বউ ডাকছে। লোকটা প্রথম ক’দিন ওকে সহ্য করতে পারছিলো না।

কিন্তু হুট করেই ওর আচরণ বেশ পাল্টেছে। অদ্রি বুঝতে পারে সেটা। বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবাই আস্তে-ধীরে মানিয়ে নেয় নিজেদের মতো করে। সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যায় মায়া, ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে। আবার অনেকে শুধু নিজেদের দায়িত্ব পালন করে থাকে। কেউ কেউ সংসারী হওয়ার অভিনয় করে পুরোটা জীবন কাটিয়ে দেয়, আজীবন মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট রেখে। এসব ক্ষেত্রে ভালোবাসার কোনো ছিঁটেফোঁটা থাকে না। ধ্রুব ও কি তা-ই করছে?

মায়ের চাপে পড়ে অদ্রিকে মেনে নিতে চাইছে? সারাজীবন ভালোবাসা বিহীন সম্পর্কে অভিনয় করার জন্য? কিন্তু এটা অদ্রি মানবে কেন? অদ্রি জানে কাউকে ভালোবাসা সহজ কাজ নয়।
আর সংসারী হওয়ার মিথ্যে অভিনয়টা সেও করতে পারবে না। তাতে সবাইকে ধোঁকা দেওয়া হবে। অদ্রি কাউকে ধোঁকা দিতে চায় না। অদ্রি জানে, ভালোবাসা আসলে ওর জন্য নয়।[ ইসরাত জাহান ফারিয়া[

গভীর রাত। ঘড়িতে দুটো বেজে বিশ। অনেক পড়া জমে যাওয়ায় অদ্রি একে একে টপিকগুলো শেষ করতে থাকে। পড়ার মাঝে ক্লান্তি অনুভব করায় চা বানিয়ে আনে। তারপর বারান্দায় গিয়ে বসে রাত উপভোগ করার জন্য। চা খেতে খেতে আচমকা লক্ষ্য করে ধ্রুব’র ব্যলকনিতে। অন্ধকারে কেউ একজন বসে আছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর বারান্দার দিকে। অদ্রির ভুল হয় না, মানুষটা ধ্রুব ছাড়া আর কেউ নয়।

অদ্রি বিব্রতকর করে। ঘরে চলে আসে। ধ্রুব’র এমন অদ্ভুত আচরণে ওর মন কেঁপে ওঠে। একরাশ দ্বিধা নিয়ে অদ্রি শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে যথারীতি এলার্মের শব্দে ওর ঘুম ভাঙে৷ ধ্রুব অফিসে যাওয়ার পথে ওকে ড্রপ করে যায়। যতীন এসে ওকে নিয়ে যাবে, একা যাতে না ফেরে এটাও বলে দেয় বারবার করে। অদ্রি আজ আর না বলে না। পরদিন শায়লা ঘরে এসে ওকে একটা বক্স দেয়। অদ্রি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে বক্সটা খুলে দেখতে বলে। বক্সটা খুলতেই বেশ দামী একটা মোবাইল ফোন দেখতে পায়। অদ্রি অবাক হয়ে বলে,

— এত দামী ফোন দিয়ে আমি কি করবো?
শায়লা বলল,
— ফোনের কাজ যা তা-ই করবি!
অদ্রি ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
— না না। আমি এটা নিতে পারবো না।
শায়লা ধমকে বলল,

— ধ্রুব কিন্তু বেশ রেগে যাবে। কালকে কি চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলি মনে নেই? একটা ফোন থাকলে এত ঝামেলাই হতো না।
অদ্রি সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— এটা কে দিয়েছে?
শায়লা হালকা কেশে নেয়। ধ্রুব বারবার বলে দিয়েছে অদ্রিকে যাতে না বলে যে এটা ও দিয়েছে। ও অদ্রিকে সারপ্রাইজ দিতে চায়। তিনি চান না পুত্রের সারপ্রাইজ নষ্ট হোক। সেজন্য তিনি বললেন,

— তোর আংকেল। না নিলে কিন্তু আমরা খুব রাগ করবো। তুই হয়তো আমাদের নিজের মানুষ ভাবিস না। আপনজনের দেওয়া ছোট্ট একটা গিফটও কিন্তু
মহামূল্যবান।

অদ্রি আর না করতে পারে না৷ কি বলবে ও? গিফটের জিনিস আসলেই ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। এগুলোতে আপনজনের ভালোবাসা মিশে থাকে। ও ফোনটা রেখে দেয়। শায়লা খুশি হয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অদ্রি ফোনটা স্ক্রল করতে থাকে। কন্ট্রাক্ট লিস্টে শুধুমাত্র ধ্রুব’র নাম সেট করা দেখে কিছুটা অবাকও হয়। তবে বেশি মাথা ঘামায় না। সত্যিই এখনকার দিনে ফোন ছাড়া চলা বেশ কষ্টকর।

অদ্রির ওর বাবার দেওয়া ফোনটার কথা মনে পড়ে। হয়তো ওর ড্রয়ারেই পড়ে রয়েছে ওর প্রিয় ফোনটা। নাকি ওর মতোই ওর জিনিসপত্র গুলোকেও বাবা ফেলে দিয়েছে অদ্রি জানে না! শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ ধ্রুব অফিস থেকে ফিরেছিলো মাত্র। মা’কে দিয়ে ফোনটা দিয়ে ভালোই করেছে। ও শিওর, যদি নিজ হাতে দিতো অদ্রি তা নিতো না। দরজায় উঁকি দিয়ে অদ্রিকে দেখে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় ধ্রব। টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। যাক, ধ্রুব’র ভাইরাস জ্বর ওর থেকে অন্তত কিছু একটা নিয়েছে!

এভাবেই দিনগুলো কাটতে থাকে। পড়াশোনায়ই অদ্রির সব মনোযোগ। এসব বাদেও বাড়ির কাজে শায়লাকে খুব সাহায্য করে। জরিনাকে সঙ্গে নিয়ে বাগানে কাজ করে। নতুন নতুন ফুলগাছ গুলোর যত্ন নেয়। তবে এখনো রাতে বারান্দায় গেলে দেখে অদ্রি দেখে ধ্রুব ওর ব্যলকনিতে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে পুরোটা রাত। অনেক সময় কাজ ফেলে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অদ্রির ঘরের দিকে।

কোচিংয়ে অদ্রির কিছু ফ্রেন্ডও হয়েছে। সবই মেয়েবন্ধু। ছেলেদের ও যথেষ্ট এড়িয়ে চলে। তবে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হওয়ায় স্যারদের খুবই পছন্দ রাহাত। পড়াশোনায় যেকোনো সমস্যা হলে সবাই ওর কাছেই যায়। সব নোটস করা থাকে ওর কাছে। অদ্রিও মাঝেমধ্যে ওর কাছ থেকে সাহায্য নেয়। এভাবেই ওদের মধ্যে বেশ ভালো একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তবে রাহাত ওকে বন্ধুর থেকেও বেশিকিছু ভাবে। যেটা অদ্রি ওর আচরণ দেখে বুঝতে পারে না। এজন্য রাহাত ইদানীং বেশ আপসেট। চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে পরশ ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

— এতদিন তো হইলো, এইবার তো কিছু ক!
রাহাত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,
— কি বলবো?
— প্রপোজ করবি৷ আমি শিওর ও না করবো না।
রাহাত হেসে বলে,

— সম্ভব না দোস্ত। ওকে দেখে আমার তেমন মনে হয় না। ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এতদিনে একটু হলেও বুঝতে পারতো সেখানে ও কেমন জানি! অদ্ভুত লাগে মাঝেমধ্যে আমার।
পরশ ওর কথার সাথে একমত হয়। কিছু একটা ভেবে বলে,
— আচ্ছা, ওর সাথে যে একটা লোক আসে হেইডা কে?
রাহাত জিজ্ঞেস করে,

— কে? ওই লম্বা লোকটা?
— হুম।
— জিজ্ঞেস করিনি। ভাইটাই হবে।
পরশ মাথা নাড়িয়ে বলে,
— হ। অদ্রির চেহারার সাথে মিল আছে। গাড়ি কইরা ওরে নামায় দিতে আসে, আবার ড্রাইভার পাঠায় নিতে।
রাহাত বলে,

— রিচ পিপোল…
পরশ ভেঙ্গিয়ে বলে,
— তুইও কি কম নাকি? তোর বাবা কত বড় ডাক্তার।
— তাতে কি!
পরশের মাথায় হঠাৎ এক বুদ্ধি খেলে যায়। সে বলে,
— শোন দোস্ত, তুই তো অদ্রির ব্যাপারে সিরিয়াস তাইনা?
রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলল,

— ডাউট আছে তোর? ও ফার্স্ট এবং চাইলে লাস্ট।
পরশ দাঁত বের করে হেসে বলে,
— তাইলে এক কাজ করি চল। প্রতিদিন যে ড্রাইভারটা ওরে নিতে আসে ওর থেইকা অদ্রির ভাইয়ের ফোন নম্বরটা নিই। এরপর সরাসরি ফোন করে বইলা দিমু যে তুই ওনার বোনরে ভালোবাসিস। তোর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড তো আর খারাপ না। সামনে তোর ব্রাইট একটা ফিউচার পড়ে আছে। আমার মনে হয়না এসব শুনে ওনি না করবো৷ আর যদি তিড়িংতিড়িং করে তাইলে অন্য ব্যবস্থা নিমু। কি কস?
রাহাত সব শুনে মাথা নাড়িয়ে বলে,

— এটা ভালো আইডিয়া। কিন্তু অদ্রিকে তো আগে প্রপোজ করতে হবে তাইনা?
পরশ মুখ গোঁজ করে বলল,
— রাখ তোর প্রপোজ। তুই বীরপুরুষ। আগে ওর ভাইরে প্রস্তাব দে এরপর বুক ফুলিয়ে অদ্রিরে প্রপোজ করবি। তাইলে অদ্রি ভাববো তোর সাহস বেশি, ও তাইলে অনেক ইম্প্রেস হইবো। আমি নিশ্চিত।

রাহাতের বেশ ভালো লাগলো এই আইডিয়া। অদ্রির থেকে ওর ফ্যামিলি বা ভাইকে আগে প্রস্তাব দেওয়াটা বেশি ভালো। দু’জনই যেহেতু স্টুডেন্ট, পরিবারকে আগে জানিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না। অদ্রিও বেশ ইম্প্রেস হবে ওর ওপর। রাহাতের বেশ ভালো লাগলো এই আইডিয়া।

বিয়ে পর্ব ১৩

কারণ ওর মনে হয় অদ্রি বেশ অদ্ভুত গোছের। প্রেম-ভালোবাসায় উদাসীন একটা মেয়ে। ও আর পরশ ঠিক করে কাল-পরশু অদ্রির ড্রাইভার থেকে লম্বা লোকটার নাম্বার নিতে হবে। যদিও এগুলো ভেবে রাহাতের বেশ চিন্তা হচ্ছে, তবে প্রেম-ভালোবাসায় এসবকে তো অবশ্যই জয় করতে হবে। হুহ! নয়তো ও কিসের প্রেমিক পুরুষ?

বিয়ে পর্ব ১৫