বিয়ে পর্ব ৩১

বিয়ে পর্ব ৩১
ইসরাত জাহান ফারিয়া

হন্তদন্ত পায়ে, আধভেজা মাথা নিয়ে ধ্রুব ঘরে ঢুকলো। হলুদাভ আলোয় অদ্রিকে এভাবে দেখে ওর মস্তিষ্কের নার্ভগুলো কেমন সচল হয়ে ওঠলো। চোখজোড়া জ্বলে ওঠলো। তীব্র ক্রোধ, ক্ষোভ নিয়ে ধ্রুব এগিয়ে গেলো অদ্রির দিকে। অদ্রি তখনো ওকে খেয়াল করেনি।
অন্ধকারে নিজের উন্মুক্ত পেটে পুরুষালি হাতের
অবাধ্য বিচরণ টের পেলো অদ্রি হঠাৎ। তৎক্ষনাৎ হিম হয়ে গেলো পুরো শরীর। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কম্পিত কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— ক কে?
ধ্রুব ততক্ষণে ওর গ্রীবাদেশে মুখ ডুবিয়েছে। অদ্রির কাঁপা কন্ঠস্বর শুনে ক্রোধিত গলায় তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
— আমাকে কখনোই ভালো লাগে না তোমার তাইনা?
অদ্রি ভড়কালো, চমকালো। নিজেকে দ্রুত ছাড়িয়ে নিয়ে শাড়ির আঁচল আঁকড়ে ধরে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
— আপনি?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

ধ্রুব ধীরপায়ে এগুলো অদ্রির দিকে। রক্তিম চোখ দুটো ভীষণ অন্যরকম। নির্লিপ্ত গলায় বলল,
— তোমাকে এভাবে অপ্সরাদের চেয়েও বেশি মোহনীয় লাগছে। সবার সামনে এতো সাজো আমার জন্য কেন কেন সাজো না? তোমার সবকিছুর অধিকার তো শুধুমাত্র আমার!
অদ্রি একরাশ বিস্ময় নিয়ে কথাগুলো শুনলো ওর। কন্ঠস্বরের মালিকটি ধ্রুব হলেও তার আচরণ আজ বেশ অচেনা, দুর্বোধ্য। আর্ত গলায় পিছুপা হতে হতে বলল,

— একদম এগুবেন না। দূরে থাকুন বলছি…
ধ্রুব তা দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
— আর কতদূরে? যতদূরে রাখতে পারলে তুমি আমার জীবন থেকে চলে যাবে? ঠিক ততদূরে?
অদ্রির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলো৷ পেছনোর আর কোনো রাস্তা নেই। ওর ভীষণ নার্ভাস লাগছে। ক্ষীণ কন্ঠে শক্তভাবে বলল,

— যেতে দিন আমাকে… কেন এমন করছেন?
ধ্রুব শুনলো তবে উত্তর দিলো না। ও তো জানে, ধ্রুব অন্য কারো সাথে ওকে সহ্য করতে পারবে না। অদ্রির আর্ত কন্ঠেও ওর ভাবা বোধ উদ্রেক হলো না। বাইরে শীতল বাতাসের সাথে সাথে আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। ভীষণ জোরে বাজ পড়ছে। অদ্রি বাজ পড়ার শব্দে ভয় পেলেও ওর ভয়টা ধ্রুব’র হিম করা চাহনির নিচে চাপা পড়ে গেলো। অদ্রি ভয়ে গুটিয়ে গেলো, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম।

হতবিহ্বল হয়ে ওকে ঠেলে সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছুটতেই ধ্রুব শক্ত করে পেছন থেকে টেনে ধরলো ওকে। অদ্রি ছটফট করতে লাগলো নিজেকে ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই পুরুষালি শক্তির সাথে পেরে ওঠলো না। জবরদস্তিতে অদ্রির পা খাটের কোণায় লেগে কেটে গেলো কিছুটা। ধ্রুব দেখলো সেটা, ওকে বিছানায় বসিয়ে শাড়িটা পায়ের পাতা থেকে আস্তেধীরে সরালো।

রক্তটুকু নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়ে চুমু খেলো সেখানটায়। অদ্রি কেঁপে ওঠে নিজের পা গুটিয়ে নিলো। আঁটোসাটো হয়ে বসে শাড়ি দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকার চেষ্টা করে বিছানা থেকে আবারও নামতে উদ্যত হলে ধ্রুব ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো। ওর মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। অদ্রির ইগনোর ও আর মেনে নেবে না। একটানে নিজের খুব কাছে এনে রেগে বলল,

— বাইরের কেউ হলে দেখাতে, তাইনা? আমি তো…
অদ্রি কান্নারত স্বরে অনুনয় করলো,
— আপনি তো এমন নন। ছেড়ে দিন না…
ধ্রুব উল্টো হিংস্রাত্মক শীতল গলায় বলল,
— ছেড়ে দিয়েছি, ছাড় দিয়েছি, সময় দিয়েছি সবসময়! বিনিময়ে কি পেয়েছি? কিচ্ছু না, জাস্ট কিচ্ছু না। আমার হৃদয়ে আগুন জ্বালানোর পায়তারা করার
আগে তোমার ভাবা উচিৎ ছিলো, ধ্রুব সরল হলেও সহজ নয়! সে যেটা চায় না, তার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু যা চায়, সেটা দেরিতে হলেও নিজের করে নেয়।

অদ্রি অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে। না, এই হিংস্র মানুষটার কোথাও ধ্রুব’র সেই সহজাত প্রবৃত্তির ছিঁটেফোঁটাও নেই। ওর তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে ধ্রুব দৃষ্টি পড়লো। পিপাসার্ত মানবের ন্যায় কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সে। অদ্রি নাক টানলো, কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই ধ্রুব ওর অধরে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়ায়! সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, জেদ, বহুদিনের না পাওয়ার আক্ষেপে পুড়তে থাকা ধ্রুব’র মুখ নখের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলেও সে অদ্রির মাঝে নিজেকে হারাতে ব্যস্ত। অদ্রি শুধু কান্নারত স্বরে বলল,

— আপনি এত অচেনা হয়ে গেলেন কেন…
ধ্রুব উত্তর না দিয়ে ওর কপালে শক্ত চুমু বসায়। ঘোর লাগা অন্যরকম স্বরে নিজের শার্ট ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে অদ্রির ঠোঁটে আঙুল রাখে,
— হুঁশ! কোনো কথা নয়…

বর্ষণমুখর ভোর। হিমশীতল বাতাস। এখনো চারদিকে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। জানালার পর্দাগুলো ওড়ছে। মেরুন রঙের শাড়িটির আঁচল বিছানায় কোণে অবহেলিত ভাবে পড়ে আছে। এলোমেলো ভঙ্গিতে চাদর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে অদ্রি। ওর চোখমুখ লাল। গলায়, কাঁধে আঁচড়-কামড়ের দাগ। সেগুলো ভালোবাসার নয়; হিংস্রতার। একটু পরপর অদ্রি কেঁপে ওঠছে, ওর বন্ধ দু-চোখের কোণ বেয়ে পানি পড়ছে। রাতের দুর্ঘটনাটি ওর মন থেকে কিছুতেই সরছে না। ধ্রুব’র ওমন হিংস্রাত্মক, বিভীষিকাময় আচরণে ওর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত।

সারা মুখে, পিঠময় জুড়ে অদ্রির নখের আঘাত। খুব জ্বলছে। ধ্রুব বিছানায় পিঠ লাগাতে পারছে না। মাথা ধরে আসছে ওর। তবুও সে নিজেকে নিয়ে চিন্তা বাদ দিলো। ওর মনে ভয় হচ্ছে, অপরাধবোধ কাজ করছে। কস্মিনকালেও ওর কোনো ইনটেনশন ছিলো না এমন আচরণ করার, কিন্তু কাল রাতে ওই আননোন নাম্বার থেকে আবারও ফোন আসার পর ওর যে কি হলো!

নিজের মধ্যে জেদ কাজ করছিলো, ইচ্ছে করছিলো ওই অচেনা ছেলেটার গলা টি’পে ধরতে। অদ্রিকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকেই তো সে এমন একটা কাজ করেছে। ও তো চেনে অদ্রিকে; পাথর হৃদয় নিয়ে বাস করা মেয়েটা ওকে আজকের পর হয়তো কখনোই ক্ষমা করবে না। ধ্রুব নিজের মাথা চেপে ধরে ওঠে বসে। অবহেলায় পড়ে থাকা শার্ট গায়ে চাপিয়ে অপরাধীর ন্যায় ওঠে গিয়ে বিছানার অপর প্রান্তে যায়। মেঝেতে হাটু রেখে অদ্রির সামনে বসে। প্রতিটি ক্ষণ চোখের জল ফেলতে থাকা অদ্রি ওকে দেখে অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ধ্রুব’র দমবন্ধ লাগে। অনেক কষ্টে
ব্যথিত গলায় বলে,

— আমি ক্ষমা চাওয়ার মতো অবস্থায় নেই অদ্রি। কিভাবে কি হয়ে গেলো আমার বোধগম্য নয়। আমি চাইনি এমনটা হোক…
অদ্রি উত্তর দিলো না। ধ্রুব করুণ কন্ঠে বলল,
— তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মেনে নেবো, শুধু আমার থেকে দূরে যেও না। তাকাও প্লিজ…
অদ্রি ওর দিকে তাকালো না। ওর মন মস্তিষ্ক কাজ করছে না। নাক টেনে নির্লিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— কেন আমার সাথে এরকম করলেন? এটার উত্তরটা চাই…

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিভাবে বলবে সে ওই ছেলেটার কথা? মনে হলেই তো ওর সারা গায়ে আগুন ধরে যায়। ধ্রুব তবুও নিজেকে শান্ত রেখে ছোট্ট করে বলল,
— একজন আননোন নাম্বারধারী ছেলে তোমার সাথে বুড়ো হতে চায়, ভোর হওয়া, সন্ধ্যে নামা দেখতে চায়। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি৷ জানোই তো, তোমার পাশে তো অন্য কাউকে আমি নিতে পারবো না অদ্রি….
অদ্রি এবার ওঠলো। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো ধ্রুবকে। এরপর আচমকাই ঠাস করে একটা চড় বসালো ধ্রুব’র গালে,

— সেদিন তো খুব বড় গর্ব করে বলছিলেন আমাকে বিশ্বাস করেন। এই আপনার বিশ্বাসের নমুনা? কে না কে কি বললো আপনি তাতেই বিশ্বাস করে এতদূর? ছিহঃ..
ধ্রুব শূন্য দৃষ্টিতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। অদ্রি ওকে ঘৃণাভরা কন্ঠে বলল,
— আমার চোখের সামনে থেকে যান আপনি। আপনার মুখদর্শন করতে চাই না আর…
ধ্রুব’র ভগ্নহৃদয়ে তাকিয়ে রইলো। অদ্রি ওকে না ভালোবাসুক কিন্তু ওর ঘৃণা নিতে পারবে না ধ্রুব! সেজন্য হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

— বলো, কি করলে ভালোবাসবে আমাকে? কি করলে?
অদ্রি তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,
— সেদিনের পর আমি সত্যিই আপনার কথাগুলো ভেবেছি। নিজের বাবা পর হয়ে গেছে বলে পৃথিবীর সব পুরুষ এমন সেই অসুস্থ চিন্তাটাকেও নিজের মন থেকে সরিয়েছি। ধীরেধীরে নিজেকে সংসারের সবকিছুতে মিশিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আপনার সাথে থাকতে থাকতে সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি৷ কারণ আপনি আমাকে একটু হলেও বোঝেন। রাতে আপনার কফি বানানোর অপেক্ষা করতে গিয়ে আপনাকে একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু আপনি? বুঝতেই পারেননা নিঃশ্চুপেও ভালোবাসা যায়…

ধ্রুব’র বুক চিনচিন করতে লাগলো। কোথাও একটা প্রজাপতি ওড়ে গেলো যেন! ওর নিজের কানে একটু আগে কি শুনলো তা বিশ্বাস করতে পারলো না। ভুল শুনেছে এমন দোটানা নিয়ে অদ্রির কাছে খানিকটা এগিয়ে গেলো৷ দু’হাতে ওর মুখটা আগলে ধরে অসংখ্য চুমু খেতে খেতে বলল,
— কি বললে? কি বললে?

অদ্রি ওকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। ওর মাথা ভার হয়ে আছে। ক্ষতগুলো জ্বলছে, অদ্রির চোখ ভিজে ওঠলো নিজের অবস্থা দেখে। চাদর টেনে আপাদমস্তক নিজেকে ঢাকতে ঢাকতে বলল,
— ইফতেখার হাসান ধ্রুবকে ভালোবেসেছি, কোনো হিংস্র, বিভীষিকাময়, অমানুষ ধ্রুবকে নয়।

বিয়ে পর্ব ৩০

ধ্রুব আহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো! অদ্রির চোখের ঘৃণা ওর হৃদয়ে দহন সৃষ্টি করেছে। ধ্রুব’র নজর পড়লো অদ্রির ক্ষত গুলোর দিকে। চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করলো সে। কি করে পারলো ফুলের মতো মেয়েটার সাথে এমন পশুর মতো ব্যবহার করতে? এবার ওর সব রাগ গিয়ে পড়লো আননোন ফোন নাম্বারের ছেলেটির ওপর!

বিয়ে পর্ব ৩২