বুকের বা পাশে পর্ব ৪

বুকের বা পাশে পর্ব ৪
written Nurzahan akter Allo

প্রত্যয় বাগানে কিছুটা সময় হাঁটাহাঁটি করে একেবারে মাগরিবের নামাজ পড়েই বাসায় ঢুকলো। আর তুয়া বাসায় গিয়ে ওর বাবার কাছে প্রত্যয় আর তুরাগের নামে অভিযোগ দিলো। মেয়ের কান্না কমানোর জন্য জাহিদ সাহেব তুরাগ আর প্রত্যয়কে মিছিমিছি বকা দিলো।এবার তুয়ার মুখে বিশ্বজয় করা হাসি ফুটলো।
আজকে প্রিয়মের স্কুলে রেজাল্ট দিয়েছে। প্রিয়মের রেজাল্ট দিয়েছে এটা কেউ জানে না। প্রিয়মও জানায়নি কারণ তার বাবা মায়ের এত সময় নেই। প্রিয়মও এখন ওভাবেই নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে। এতটুকু বয়সের প্রিয়ম ফ্যাশান বুঝে আর সব সময় ফিটফাট হয়ে থাকতে পছন্দ করে। দিনে বার বার ড্রেস বদলাতে সে খুব ভালবাসে। সন্ধ্যায় প্রিয়মের বাবা আর আম্মু অফিস থেকে ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে আবার রেডি হচ্ছে। আজকে একটি বিজনেস পার্টি আছে। ওখানে যেতেই হবে।
সন্ধ্যায় তুয়া ওর আম্মুর সাথে প্রত্যয়দের বাসায় আসলো। তুয়াকে নামিয়ে দিতেই তুয়া প্রত্যয়ের রুমে গেল। প্রত্যয় তুয়াকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকলো। তুয়া কিছুক্ষণ প্রত্যয়ের কাছে ঘুরঘুর করলো কিন্তু প্রত্যয় কিছু বললো না। তুয়া যখন দেখলো প্রত্যয় ওর সাথে কথা বলছেনা তখন তুয়া বেডে উঠলো! আর বেড থেকে টেবিলে উঠলো। তারপর প্রত্যয়ের বইয়ের উপরেই ধপাস করে বসে পড়লো! প্রত্যয় ভ্রু কুচকে তুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তুয়া প্রত্যয়ের দিকে একবার তাকালো আর তার ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিয়ে প্রত্যয়ের কান ধরে বললো,

–“সইয়্যি” (দাঁত বের করে হেসে)
–“লাগবে না তোর সরি! আর আমার কান ধরে আমাকেই বলছিস সরি কেন?” (প্রত্যয় ভ্রু কুচকে)
–“হুম!আর কলবো(করবো) না!আর নাগ (রাগ)কলো(করো) না! না হলে আবার কামলে(কামড়ে)দিবো হুম।”
–“এবার আমাকে কামড়ালে আমিও তোকে কামড়ে দিবো তখন বুঝবি!” (প্রত্যয়)
–“উমম পালবে না! তুমি পালবে না আল(আর) তুমি কামলালে(কামড়ালে) আমি সবাইতে(সবাইকে) বলে দিবো। তখন সবাই তোমাকে পিট্টু দিবে আর তুমি তানবে(কাঁদবে)! হা হা হা” (হেসে)
তুয়া কথাটা বলে ও নিজেই খিলখিল করে হেসে দিলো। তুয়ার হাসি দেখে প্রত্যয়ও হেসে দিলো। প্রত্যয় তুয়াকে ওর হাত দেখালো ও যেখানে কামড় দিয়েছে । তুয়ার সামনের ছোঁচালো দুইটা দাঁত প্রত্যয়ের হাতে ঢুকে গেছে!তখনই হাত থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়েছিলো! এখন তো হাতটা বেশ ফুলেও আছে। তুয়ার এই কামড়টা প্রত্যয়ের হাতে দাগ হয়ে থেকে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তুয়া প্রত্যয়ের হাতটা ভাল করে দেখলো আর ফু দিয়ে একটা আদর দিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“বালো হপে!আমি আদল দিছি।”
–“ওলে আমার দুষ্টুরে! তুই এসবও বুঝিস!” (তুয়াকে কাতুকুতু দিয়ে)
–“হা হা হা!হুম আমি তব(সব)বুজি(বুঝি)!” (খিলখিল করে হেসে)
–“হা হা হা পাকা বুড়ি যে তুই।” (তুয়ার নাক টেনে)
তারপর তুয়া আর প্রত্যয় খুনশুটিতে মেতে উঠলো। এর মাঝেই প্রত্যয়ের বাবা প্রত্যয়কে ডাকলো। প্রত্যয় তুয়াকে কোলে নিয়েই ড্রয়িং রুমে গেল। তুয়ার আম্মু তখন তুয়াকে রেখেই চলে গিয়েছিলো। প্রত্যয় তুয়াকে সোফাতে বসিয়ে নিজেও বসলো। তখন প্রত্যয়ের বাবা প্রত্যয়কে বললো,
— “আব্বু পড়াশোনার জন্য তোমাকে প্যারিসে যেতে হবে। সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে।” (বাবা)
–“বাবাই এসব কি বলছো? আমি তোমাদের রেখে এতদূর কিভাবে যাবো? আর আমি তো এখানেই ভালো আছি, তাহলে প্যারিসে কেন যাবো বাবাই?”
–“আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে প্যারিস থেকে পড়াশোনা করানোর! আমার কথা শুনবে না আব্বু?” (বাবা)
–“তোমাদের রেখে আমি কিভাবে থাকবো বাবাই?” (অসহায় কন্ঠে)
–“কষ্ট ছাড়া কোন কাজেই সফলতা আসে না বাবা। তুমি আমার একমাত্র ছেলে আর তোমাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন! বাংলাদেশে পড়াশোনার যা অবস্থা, সেই বিষয়ে কিছু নাই বা বললাম! তুমি এখানে খুব একটা সুযোগ-সুবিধা পাবেনা। এটা এমনই একটা দেশ যে দেশে তুমি খুব ভাল একটা ছাত্র হও, তাহলে তোমার পেছনে কেউ না কেউ লেগে তো থাকবেই! আর সে তোমাকে একেবারে শেষ না করে থামবে না। এই দেশে উন্নতি করার কেউ নেই। যদিও বা কেউ উন্নতি করতেও চাই তাকেও এরা একেবারে শেষ করে দেয়! তোমার বাবা তোমার জন্য সবসময় বেস্ট কিছুই করবে আব্বু” (বাবা)

–“আম্মু! তুমি বাবাই কে কিছু বলো?” (প্রত্যয় ওর আম্মুর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে)
–“আমি সেই মা না যে বাঘের ভয় দেখিয়ে বাচ্চাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকার কথা বলবো! আমি তোমাকে ভয়কে জয় করতে শিখিয়েছি! তুমি নিজের ইচ্ছে আর মনোবল শক্তি বাড়াও, দেখবে তুমি পারবে!আমি জানি আমার ছেলে পারবে, কারন আমার ছেলে সহজে হার মানতে জানে না। আমি বলবো তুমি একটাবার ট্রাই তো করে দেখো আব্বু ! আর কিছু বলবো না। যদি তোমার মনে হয় তুমি পারবে তাহলে তুমি যাও। কারণ আমরা বললে হবে না, তোমার মনোবল শক্তি থাকতে হবে। ওখানে যদি যাও তো নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে তারপর দেশে ফিরো।” (মিথিলা)
–“ওকে! তোমরা চাও আমি প্যারিসে যাই তাই তো?” (প্রত্যয় মাথা নিচু করে)
–“হুমম চাই!” (বাবাই আম্মু দুজনেই)
–“আমি তোমাদের কথা রাখবো! বাট আমি ফিরে আসার পর আমি যা চাইবো আমাকে তাই দিতে হবে।” (প্রত্যয়)
–“সেটা তোমার চাওয়ার উপর নির্ভর করে আব্বু।
” (বাবা)
–“হুমম।”

প্রত্যয় উঠে রুমে চলে গেলো। আর তুয়াও সব শুনলো বাট কিছু বুঝলো ন। সে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলো। প্রত্যয়ের সাথে তুয়াও প্রত্যয়ের রুমে গেলো। প্রত্যয় বালিশে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। তুয়া গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসলো। প্রত্যয়কে কয়েকবার ডাকলো কিন্তু প্রত্যয় সাড়া দিলো না। তাই তুয়া মুখ গোমড়া করে চলে গেলো। আর প্রত্যয় বালিশে মুখ গুঁজে থাকলো। এভাবে প্রায় চারদিন কেটে গেলো। এই কয়েকদিন প্রত্যয় কেমন জানি হয়ে গেছে। সব সময় চুপচাপ থাকে। ওদের বাসায় তুয়া আসলে ছলছল চোখে তুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
এক সপ্তাহ পর…
প্রত্যয়ের প্যারিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেলো। প্রত্যয়ের বাবা উচ্চ মানের একজন ইন্জিনিয়ার হওয়ার কারণে ওখানে চেনা জানা অনেকেই আছে। প্রত্যয় ওখানে খুব ভালো থাকবে, সেই ব্যবস্থা তিনি করেছেন। প্রত্যয় সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে কেঁদে কেঁদে! কারণ এর আগে বাবা মাকে ছাড়া প্রত্যয় কোথাও থাকেনি। প্রত্যয় তুয়ার পরিবারের সবার সাথে কথা বললো। প্রত্যয় তুয়াকে অনেক গুলো চকলেট আরো অনেক কিছু গিফট দিলো।
–“এই তুয়া ভাল থাকিস। শোন, বেশি দুষ্টুমি করবি না।বড়দের কথা শুনবি আর আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো।” (তুয়াকে কোলে নিয়ে)
–“আততা!”(প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে ধরে)
–“আমি চলে গেলে আমাকে ভুলে যাস না!” (ছলছল চোখে তাকিয়ে)
–“হুম।”
–“আমি চলে যাচ্ছি আমাকে কিছু দিবি না?” (প্রত্যয়)

প্রত্যয়ের এই কথা শুনে তুয়া মুখ গোমড়া করে নিলো!তারপর মুচকি হেসে ওর হাতে থাকা পুতুলের ব্রেসলেট টা প্রত্যয়কে দিয়ে দিলো। আর প্রত্যয়কে এত এত আদর দিলো।‌ তারপর প্রত্যয় শেষ বারের মত বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলো। এক বুক চাপা দীর্ঘশ্বাস আর আপনজনদের রেখে প্রত্যয় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গমন করবে; শুধু তার বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে। প্রত্যয়কে ওর বাবা মা এয়ারপোর্টে রেখে গেলো। প্রত্যয় এখন ওয়েটিং রুমে বসে আছে এখন শুধু প্লেনে উঠার অপেক্ষা।
এয়ারপোর্টে গিয়ে দুইটা ছেলে মেয়ের সাথে প্রত্যয়ের পরিচয় হলো। বাংলাদেশ থেকে এই দুইজনও প্যারিসে যাচ্ছে। আর এরা দুজনেই প্রত্যয়ের সমবয়সী! এটাও আল্লাহর একটা রহমত মনে হয় প্রত্যয়ের জন্য! প্লেনে উঠে ওরা নিজেদের সিটে বসলো এবং সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। কিছুক্ষণ পর প্লেন চলতে শুরু করলো। প্রত্যয় জানালার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
–“বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে খুব শীঘ্রই আবার ফিরে আসবো আমার দেশে! ভালো থেকো আমার দেশ।”

তারপর প্রত্যয়রা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী charles De Gaulle International Airport, paris (CDG) এয়ারপোর্টে ওদের প্লেন ল্যান্ড করলো। ওরা আস্তে ধীরে বের হতেই দেখে ওদের নামে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দুইজন দাড়িয়ে আছে। ওরা এগিয়ে গেলো এবং কথা বললো। ওরা যে হোস্টেলে উঠবে সেখান থেকেই লোক পাঠানো হয়েছে ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রত্যয়ের সাথে যে দুইজন এসেছে বাংলাদেশ থেকে তাদের একজনের নাম পৃথা আর অন্যজনের নাম সাদ। ওরা আবার একে অপরের কাজিন। তারা ওই লোকেদের আনা গাড়িতে উঠে পড়লো। আর নির্দিষ্ট সময়ে ওরা পৌঁছে গেলো তাদের গন্তব্যে। ওরা যে স্কুলে ভর্তি হয়েছে সেই স্কুলে হোস্টেলেও আছে! ওদের জন্য আগে থেকে সব বুক করাই ছিলো। প্রত্যয় আর সাদ ছেলেদের সাথে আর পৃথা মেয়েদের সাথে থাকবে। ওরা দীর্ঘ পথ জার্নি করেছে তাই ওদের ফ্রেশ হয়ে ডিনার সেরে রেস্ট নিতে বললো। প্রত্যয় ফোন থেকে ওর বাবাকে ফোন দিলো! প্রত্যয় বাবা মায়ের সাথে কথা বলে শুয়ে পড়লো। শুয়ে আছে ঠিকই কিন্তু দুচোখের কোণা বেয়ে অশ্রু গড়ে পড়ছে অনবরত! এই অশ্রু গড়ে পড়ার কারণ হতে পারে আপনজনদের ছেড়ে আসার কষ্ট, আবার হতে পারে আপনের চেয়ে আপনকে মনে করে কষ্ট পাওয়ার কারণে। তুয়ার ব্রেসলেট টা প্রত্যয় #বুকের_বা_পাশে_ চেপে ধরলো কিছুটা সময়। আর এভাবেই প্রত্যয়ের জন্য আজকে থেকে শুরু হলো একা একা পথ চলার নতুন এক যুদ্ধ!
পরেরদিন সকালে_______

বুকের বা পাশে পর্ব ৩

প্রত্যয় সাদ আর পৃথা একই স্কুলে ভর্তি হয়েছে! আর তিনজনেই ক্লাস নাইনে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে।আজকে ওরা ওদের স্কুল আর হোস্টেলটা ঘুরে দেখলো।আজকে থেকেই ওরা একটা প্যারিস ল্যাংঙ্গুয়েজ কোচিং এ যাবে কারন এখানে থাকতে গেলে এখানকার ভাষাটা জানা আবশ্যক। আর ততদিন ইংলিশে কথা বলে ম্যানেজ করে নিতে পারবে। আর প্রত্যয় তো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র ছিলো! ওর জন্য তেমন সমস্যা না হলেও সাদ আর পৃথার জন্য সমস্যা হয়ে যাবে।আর রইলো এই জায়গাটা নিয়ে কথা, সেক্ষেত্রে প্রত্যয় এখানে আসার আগে প্যারিস শহরটা কেমন এই বিষয়ে টুকটাক ধারণা নিয়ে এসেছে। ওরা তিনজন হাঁটছে আর ঘুরে ঘুরে দেখছে এর মধ্যে সাদ প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“প্রত্যয় দেখ এখানকার রাস্তা গুলো কত্ত সুন্দর পরিষ্কার। এখানে শুয়ে পড়লেও জামাকাপড়ে ধুলো লাগবে না।” (সাদ)
–“হা হা হা! তুই শুয়ে পড়।” (পৃথা)
–“হুমম জায়গাটা আসলেই সুন্দর! তবে আমাদের দেশের মত না। এখানে বড় বড় বিল্ডিং এত পরিষ্কার রাস্তাঘাট, তবু আমাদের দেশের মত আপন আপন ব্যাপারটা নেই!” (প্রত্যয়)

–“তা ঠিক বলেছিস!” (পৃথা মন খারাপ করে)
–“মন খারাপ করিস না! আমরা তিনজনেই এই শহরটাকে আপন করে নিবো।” (প্রত্যয়)
–“হুমম।”
–“প্রত্যয় এই শহরটা কেমন তুই জানিস? না মানে তোর ধারণা আছে কি? যে কেমন হতে পারে?” (সাদ)
–“হুমম টুকটাক জানি! এখানে আসার আগে বাবাই বলেছে আমাকে!”

বুকের বা পাশে পর্ব ৫