বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪২+৪৩

বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪২+৪৩
রোজা রহমান

সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামল আমাদের সোনার বাংলাদেশ। ছোটকালে বাংলা পাঠ্য বইয়ে অনেক পড়েছি, জেনেছি। আমাদের বাংলাদেশের সৌন্দর্য কবিরা, লেখকরা তাদের অনুভূতি দ্বারা বিভিন্ন ভাবে কবিতা,পঙক্তি, ছোট গল্প, বড় গল্পের মাঝে তুলে ধরেছেন। সত্যি অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী আমাদের শস্য-শ্যামল বাংলাদেশ৷
শহর অঞ্চল থেকে বের হলে জানা যায় বাংলাদের সৌন্দর্য। যদিও এখন গ্রাম অঞ্চলও শহর অঞ্চলের মতো পরিণত হচ্ছে। বড় বড় খাল-বিল ভরাট করে বড় বড় বিভিন্ন দালান-কোঠা তৈরি হচ্ছে।

শশীদের গ্রামটা অপরূপ সুন্দর। বড় বড় মাঠ সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে। যতদূর চোখ যায় রাস্তা পাশে দিয়ে তাকালে ততদূর শুধু মাঠ আর মাঠ। কৃষকরা কৃষি কাজ করছে। মাঠের মাঝে তাদের আনাগোনা চলছে। আসছে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাস। নবান্ন উৎসবের মাস৷ ধান লাগানোর তোড়জোড় করছে কৃষকরা। নতুন চালের ভাত, শীতের পিঠা খাবার মাঝে তাদের নবান্নের উৎসব। ধান পাকলে কেটে বাড়িতে তুলতে পারলে যে হাসি কৃষকদের ঠোঁটে ফুটে ওঠে তা অমায়িক। তাদের প্ররিশ্রম স্বার্থক হয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শশীদের গ্রামের নাম ধলসা। ওদের বাড়ি যাবার রোডটা আগে মাটির ছিল বেশ কয়েক বছর হচ্ছে পাকা হয়েছে৷ দুই পাশের বড় বড় মাঠের মাঝখান দিয়ে যাতায়াতের জন্য রাস্তা হয়েছে। আগের থেকে বেশ উন্নত হয়েছে।
শহর থেকে বেরিয়ে শিশিরদের মাইক্রো গ্রামের পথ ধরেছে৷ তারা কেউ বাইক বা সিএনজি নেইনি৷ দুটো মাইক্রো করে এসেছে৷ কারন সদস্য সংখ্যা একে তো অনেক তারউপর শিশিররা বাইক নিলে তাদের বাবা-মা’দের সিএনজি করে আসতে অনেক সমস্যা হতো৷ এই জন্য দু’টো মাইক্রো নিয়েছে। কার নেয় নি তার কারণ অল্প কয়েকজন ছাড়া বসতে পারত না৷ কিন্তু শিশিরদের কথা তারা জার্নিটা উপভোগ করবে সকলে মিলে। এই জন্য বড়রা একটা মাইক্রোতে আর শিশিররা একটাতে। যদিও শিশিরদের গাড়িতে তুষার,তুহিন নেই।

গাড়ির জানালা খুলে দিয়েছে৷ শ-শ করে বাতাস ঢুকছে গাড়ির ভেতর। মাঠের দৃশ্যতে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। মাঠের পাশে কয়েক জায়গায় বড় বড় পুকুরও কাটা। হয়তো মাছ চাষ করে। সকলে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। শহরে থেকে থেকে তাদের চোখ এসব সৌন্দর্য মুগ্ধ করছে৷ শহরে তো গাড়ির পেঁ-পুঁ শব্দ, যানজট এসব দেখেই দিন পাড় হয়! গ্রামের মতো নিরিবিলি, শান্তিময় জায়গা আর দু’টো নেই। শান্তির নিঃশ্বাস টানা যায় গ্রামে।
কুয়াশা দেখতে দেখতে একসময় মন্ত্রমুগ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,
” কী অপরূপ সুন্দর জায়গা! ”

সকলে কুয়াশাকে দেখার চেষ্টা করল৷ সে জানালার পাশে বসা। শিশির সামনে থেকে বলল,
” হ্যাঁ, খালামণিদের গ্রাম অনেক সুন্দর। আমি ছোট থাকতে দুইবার এসেছিলাম। কিন্তু তখন আরো অন্যরকম ছিল। মাটির রাস্তা ছিল এখন তো পাকা হয়েছে। আর ঘরবাড়িও বেশিরভাগ মাটির তৈরি ছিল। পাকাবাড়ি খুব বেশি ছিল না। পাকা বাড়ি বলতে ইট দিয়ে চারচালা করে বানানো ঘর-বাড়ি। ”
নীহার বলল,
” হ্যাঁ, শশী শুধু ওর গ্রামের কথা বলে৷ কথা বলতেই গেলেই বলে তার গ্রাম নাকি অনেক সুন্দর। এখন দেখে সত্যি মনে হচ্ছে অনেক সুন্দর। কোনো ময়লা নেই রাস্তা পরিস্কার, সবুজ গ্রাম। মিষ্টি হাওয়াও। ফ্রেশ নিঃশ্বাস নিতে পারছি। ”
মিষ্টি হাসল সকলে। কুয়াশা শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” নিজে তো দুইবার এসেছিলে। কোনোদিন তো নিয়েও আসোনি। বড় আম্মু একবার আনতে চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তো বুনো ওল, সবটাতে বেগড়া দিতে হবে তোমার৷ তোমার জন্য বড় আম্মু আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারত না। স্বাধে তো বলি না গলা চুকলানোর গোডাউন! ”
” তোকে? তাও আবার আমার সাথে আনতাম? দেখ তাহলে, তোর চাচাদের জন্য কী দিন এসেছে আমার জীবনে। এখন আমার সবখানে তোকে নিতে হয়৷”
শিশিরের কথাটা শুনে গাড়িতে থাকা সকলে হেসে দিল। সত্যি কী দিন এসেছে তাদের! কুয়াশা রেগে গেল। সে-ও উল্টো জবাব দিল,

” হ্যাঁ, দিন খারাপ না হলে কী আর তোমাকে আমার সহ্য করতে হয়? তোমার বাপ চাচারা সারাজীবনের জন্য তোমার মতো গলা চুলকানোর গোডাউনকে সঙ্গী করে দিয়েছে। এখন সারাজীবন গলা চুলকিয়ে জীবন পাড় করতে হবে আমার। নিজেকে দেখলে নিজেরই অভাগী নারী মনে হয়। হায় আফসোস!!”
শিশির উচিত জবাব পেয়ে কটমট করে উঠল। কুয়াশা পাত্তা দিল না৷ সকলে আরেকদফা হাসল৷ এভাবে শিশির কুয়াশার ঝগড়া শুনতে শুনতে তারা শশীদের বাড়িতে পৌঁছে গেল৷

পর পর দু’টো গাড়ি থামতে দেখে গ্রামের মানুষের কৌতূহল বাড়ল। তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে ভিড় জমাল৷ গ্রামের মানুষ এমনি কেউ একজন হাঁক ছেড়ে ‘এ্যাই’ বললেও তাদের কৌতূহলের শেষ থাকে না।
গাড়ি হর্ণের শব্দ ও গাড়ি থামার শব্দ পেয়ে শশীর বাড়ির সকলে বেড়িয়ে এলো। আনন্দে আটখানা শশী। মেয়েটাকে বোধহয় শাসানি দেয়া হয়েছে এই জন্য বাড়ির সামনে ভেতরে উত্তেজনা থাকলেও বেশি লাফাল না৷
হানিফ সাহেব সহ মিহির, শশীর বড় ভাই এগিয়ে গেল। সকলকে সাদরে গ্রহণ করে নিলেন৷ কোলাকুলি করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। নীহার নেমে দূর থেকে শশীকে দেখল। তার ইঁচড়েপাকা সেখানে দাঁড়িয়েই আনন্দে ভেঙে পড়ছে৷ হাসল ক্ষীণ৷ নীহারের বন্ধু শান্ত পাশে এসে গুঁতো দিয়ে বলল,

” কিরে ভাই…! অনুভূতি কীরকম আমাদেরও একটু বল! ”
নীহার মেকি রাগ নিয়ে চাটি মেরে বলল,
” শালা চুপ থাক ”
শান্ত হাসল দাঁত বের করে। শিশির নেমে নীহারের পাশে এসে দাঁড়াল। এখন শিশির একটু জ্বালাবে। সে সুযোগ পেয়েছে। বলল,
” এ ভাই, তোর শ্বশুড়বাড়ি দেখ। কী রাজকপাল রে তোর? বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি চলে এলি? ফিলিংস বল!”
শান্ত হেসে উঠল৷ বলল,
” শিশির মাত্র এটা জিজ্ঞেস করেছি বলে বেদ্দপটা মারল ”

নীহার বেশ ভালোভাবে বুঝল এদের আজ সময় এসেছে। এতদিন সে সুযোগ নিয়ে এসেছে। এখন তার পালা। ভেবে কিছু আর বলল না৷ তবে সে-ও দ্বিগুণ টিপ্পনী কেটে বলল,
” ফিলিংস আমার, বাসর ঘরে যাবার আগের মুহূর্তের মতো বুঝলি! কিন্তু হায় আফসোস তোর বোনটা তো ল্যাদা বাচ্চা। এখনো দুইটা বছর আমার আঙুল চুষতে হবে৷ আর রাজকপাল কই পেলি? বল হতভাগা কপাল। তা না হলে কি শ্বশুরবাড়ি এমন বসে থাকতে আসি? ”
তা শুনে শিশির, শান্ত দু’জনেই হেসে দিল৷ একই সুরে বলল দু’জন,
” আহারেহ্ বেচারা..! ”

বলে আবার হাসল। নীহার কিছু বলল না৷ সেসময়ে রিজভী, হিম এসে দাঁড়াল পাশে। এরপর সকলকে বাড়ির মধ্যে যাবার জন্য বললেন হানিফ সাহেব। সকলের রাস্তা ছেড়ে বাড়ির খোলা অংশ যাকে গ্রামে বলা হয়, ‘খোলা’ সেখানে পা দিল। বেশ বড় জায়গা খোলা বাড়ির সামনে। শশীরা এখানে নতুন বাড়ি করেছে৷ ওদের দাদার বাড়িটা কিছুটা দূরে৷ ওর দাদা দাদি নেই। চাচাদের সাথে সম্পর্ক ভালো নেই৷ জমি জায়গা নিয়ে ঝামেলা হওয়ার পর ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে এখানে বাড়ি করে। এটা অবশ্য দাদাদের থেকে পাওয়া জমি। প্রথমে টিন দিয়ে আপাতত ছিল। এরপর একতালা বিশিষ্ট ফ্ল্যাট করেছেন হানিফ সাহেব। এটাও বেশ পরিশ্রমে করা৷ গত সাত-আট বছর ধরে পুরোটা কমপ্লিট করেছেন৷ দু’বছর মতো হচ্ছে সম্পূর্ণ করেছেন৷ শশীর বড় ভাই ব্যাংকে জব করেন। আর হানিফ সাহেব ছোট খাটো একটা সরকারি চাকুরীজীবি৷

ওরা শশীদের কাছে যেতেই শশী আগে কুয়াশাকে সহ বৃষ্টি, ইয়াসমিনকে জড়িয়ে ধরল আনন্দে উত্তেজনায়। এরপর ঈশা, স্মৃতিকে ধরে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করল। জিনিয়া বোনের সাথে, জা’দের সাথে কথা বললেন৷ শশীর ভাবিও বেশ হাসিখুশি মনের৷ তবে একটু হিংসুটে আছে৷ শশী আর তার সম্পর্ক খুব একটা মাখোমাখো না৷ সে শশীকে বেশি একটা কাছে টানে না আর শশীও তেমন একটা যায় না।
এরপর শশী আর নীহারের চোখাচোখি হলো। হাসল দু’জন অমায়িক৷ সকলে না থাকলে বোধহয় এতক্ষণ জড়িয়ে ধরে উত্তেজনা বুঝিয়ে দিত ইঁচড়েপাকাটা৷ ভেবেই হাসল নীহার। শশী সকল ভাইদের সাথে কথা বলল। তুষার, তুহিন ড্রাইভারকে সব জিনিস পত্র বের করতে বলে বাড়ির মধ্যে নিয়ে আসতে বলল।
এবার জিনিয়া সকলকে ভেতরে ঢুকতে বললেন। গ্রামের লোক সকলে চেয়ে আছে। তারা কেউ কেউ জানে কেউ কেউ জানে না। সব কৌতূহল নিয়ে চেয়ে রইল।

বাড়িটা গ্রামে হলেও বেশ ভালোই সৌখিনতা আছে৷ হানিফ সাহেব সুন্দর করেই তৈরি করেছেন৷ টু-পাটিশন বাড়ি। মাঝে চলাচল রাস্তা। দুই পাশে তিনটা তিনটা করে ছয়টা রুম, সামনে একটা ডাইনিং এবং পাশে একটা কিচেন রুম৷
গ্রাম অঞ্চলে হাজার ফ্ল্যাট বাড়ি হলেও উঠান থাকে। বাড়ির উঠানেও কাজের জন্য অনেক কিছুই থাকে৷ তেমনি শশীদের বাড়িতেও। ভেতরে ঢুকে ঘর পেরিয়ে উঠানে গেলে মাটির চুলার রান্নাঘর সহ টয়েলট, চাপ-কলতলা আছে৷ ভেতরে বাহিরে দুই জায়গাতেই আছে৷ এরপর উঠান পেরিয়ে ডানে গেলে কিছুটা চিকন রাস্তায় হাটলে বাঁধায় করা শানের ঘাট বিশিষ্ট পুকুর৷ এটা হানিফ সাহেব করেছেন৷ মাছ চাষ করেন তিনি৷ সেখান থেকে বেশ ভালো আয় হয় উনার৷ এছাড়া আবাদি জমিও আছে৷
সকলে ঘুরেফিরে দেখল বেশ৷ শিশিররা শেষবার এসেছিল তখন এবাড়ি পুরোটা করা হয়েছিল না৷ কুয়াশা বৃষ্টিকে বলল,

” ভাবি বাড়ি সহ আশপাশটা অপূর্ব সুন্দর। এমন গ্রামেই তো বাড়ি করতে হবে দেখছি”
” হ্যাঁ, তুমি আর তোমার বর মিলে বাড়ি বানিয়ে সংসার করিয়ো ”
কুয়াশা ভড়কে গেল৷ বলল কী আর বুঝল কী? এদের কাছে এখন আর কিছুই বলা যায় না।
কুয়াশাদের আপাতত এক ঘরে দেয়া হলো আর বড়োদের এক ঘরে৷ শিশিরদের মিহিরের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ছয়টা ঘরের চারটা ঘর মিলিয়ে শশীরা থাকে৷ দুইটা পড়ে থাকে৷ দুপুর তিনটা বেজে গেছে। সকলকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলা হলো। দুপুরের খাবার দেয়া হবে একেবারে। আগামীকাল এঙ্গেজের অনুষ্ঠান হবে ছোটখাটো৷ জাকিয়ার ভাইরা আগামীকাল আসবে বলেছেন।
কুয়াশারা বোরকা খুলে উঠানের চাপকল তলায় গেল। ওরা ইচ্ছে করেই গেল৷ ভেতরে ওয়াশরুম আছে কিন্তু তাদের ইচ্ছে হলো নিচে আসার। এমন ইচ্ছে শিশিরদেরও হলো। ওরাও নিচে এসেছে। শশী, মিহির সব দেখিয়ে দিচ্ছে। নীহার জিজ্ঞেস করল,

” শশী, পুকুরটা কাদের?”
” আমাদের। আব্বু করেছেন৷ মাছ ছাড়েন প্রতি বছর।”
” বাহ্.. শ্বশুর বাড়ির মাছ খেতে হবে তো তাহলে।”
শশী লজ্জা পেল। সকলে হাসল।
মিহির বলল,
” হ্যাঁ, অনেক প্রজাতির মাছই আছে৷ বর্শি দিয়ে তো ধরি আমরা। ”
” আমিও ধরব মিহির ভাই। ”
হিমের কথায় মিহির বলল,
“আচ্ছা কাল তো হবে না পরশু ধরব।”
কুয়াশা হিমের উদ্দেশ্যে বলল,
” তোর আবার পুকুরে বর্শি ফেলে মাছ ধরতে শখ জাগল? সুযোগ বুঝে তো আমাদেরই টপ দিস। ”
সকলে হেসে ফেলল। শিশির বলল,

” এ্যাই মিহির..! গোসল করা যাবে না? ”
” হ্যাঁ, ভাই করি তো আমরা। ঘাট বাঁধা আছে। ”
” আচ্ছা গোসল করব। ”
” এখন? ”
” হ্যাঁ, বিকেলে নামব। ”
শিশিরের সাথে নীহার, শান্ত, রিজভী, হিম ও সাথ বাঁধল। কুয়াশা চোখ ছোট ছোট করে শিশিরের দিকে তাকিয়ে রইল৷ শিশির তা দেখে মাথায় চাটি মে-রে বলল,
” ওভাবে কি দেখছিস? তোর বর যে হ্যান্ডসাম সকলে জানে। তাই দেখতে হবে না এত।”
হা হা করে সব হেসে দিল। কুয়াশা মাথা ডলতে ডলতে শিশিরের গায়ে মুখের পানি ফুড়ুৎ করে ফেলে দিয়ে দৌড় দিল। কারণ ওর মুখে পানি ছিল তখন৷ কুলকুচি করছিল৷ সেই সময়ে মে-রেছে শিশির। সেও সুযোগ বুঝে কুলিটা গায়েই দিল। সকলে মিটিমিটি করে হাসছে। এদের এই স্বভার আর গেল না৷ কোথাও একসাথে গেলেই এভাবে দু’জনের ঝগড়া, মা-রা মা-রি দেখতে দেখতে দিন যায়।
এদিকে শিশির কুয়াশার চোদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। কতত বড় বে-য়াদব!! সকলে হাতমুখ ধুয়ে চলে গেল উপরে।

বিকেল হয়ে গেছে। গ্রামের বিকেলটাও মনোমুগ্ধকর। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে সকলে বিশ্রাম করছিল। শশীর তিন চাচা। তার মাঝে এক চাচা মা-রা গেছেন আর দুইটার মাঝে একজনারা কথা বলেন না। ঝামেলা হবার পর থেকে। আর একজন কথা বললেও বেশি একটা আসেনা। তবে হানিফ সাহেব সকলকেই বলে এসেছেন জাকির মালিথাদের সাথে যেন দেখা করতে আসে। শশীর কাজিনরা প্রায় সকলেই বিবাহিত। যারা আছে তারা এসে দেখা করে গেছে।
বিকেলে সকলে পুকুরে নামবে বলে ঠিক করল শিশিররা। কারণ গরম লাগছে সকলের। এছাড়া জার্নি করে এসেছে শরীরটাও কেমন লাগছে। গোসল করলে ভালো লাগবে।

কথা অনুযায়ী সকলে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলো। তুষার, তুহিন এদিকে নেই। তারা বাবা, চাচুদের সাথে সব সময় থাকে। বাবাদের সাহায্য করে। শিশিরদের বেড়িয়ে যেতে দেখে কুয়াশারাও বের হলো। পুকুর পাড়ে একটু ঘুরাঘুরি করা হবে।
শশী সকলকে নিয়ে গেল পুকুর পাড়ে। অসাধারণ জায়গা। বড় বড় আম গাছ দুটো পুকুরের ধারে। পরিবেশটা অসম্ভব সুন্দর। বিকেলের মৃদু সূর্যে আলো পড়ছে পুকুরের পানিতে তাতে জ্বল জ্বল করছে পানি। সূর্যের তেজ নেই কিন্তু আলোটা লালাভ হয়ে এসেছে৷ চারিদিকে সবুজ প্রকৃতি। সকলে মুগ্ধ হলো দেখে৷ শশীর পাশে নীহার এসে দাঁড়াল৷ আস্তে করে বলল,

” নাহ্.. বউয়ের থেকে শ্বশুর বাড়িটাই বেশি সুন্দর দেখছি। ঘরজামাই থাকতে হবে তো! ”
শশী চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। এদিকে নীহার আস্তে বললেও বৃষ্টি, ইয়াসমিন, কুয়াশা শুনে নিল কথাটা৷ ওরা হেসে উঠল। কুয়াশা জোরে করে বলল,
” তাহলে ভাইয়া শ্বশুরের মেয়ের সাথে বিয়ে না করে বাড়ির সাথে করো। ঘরজামাই থাকার চেয়ে ঘরকেই বউ বানিয়ে সংসার করতে রয়ে যাও। যুক্তি কিন্তু সেই দিলাম!”
কুয়াশা যুক্তি তো দিল কিন্তু তার যুক্তি দিতে না দিতেই মাথায় চা-টি পড়ল। সেটা অবশ্যই শিশির দিয়েছে। বলল,
” তোর এসব ফালতু লজিক কোথায় পাস তুই? এমন ফালতু লজিক দিয়ে লয়ার হবি তুই? আবার বড় বড় লেকচার মা-রিস আমার সাথে কেচ লড়ে হারাবি আমায়! তোর এইসব ফালতু লজিক তো আমি তুরি মে-রে উড়াব। ”
” এ্যাই…! তোমার কি মনে হচ্ছে আমার মাথাটা সরকারি জায়গা? যখন তখন হাত চালাচ্ছ? আর ভুল কি বললাম আমি? ”

শিশির কিছু বলতে যাবে রিজভী বলল,
” ভাই তোরা ঝগড়া কর আমরা গেলাম। ”
শিশির কুয়াশাকে রাগী নজর দিয়ে সে-ও চলে গেল। আর নীহার যাবার আগে শশীর কানের কাছে ঝুঁকে মুখ নিয়ে বলল ,
” বিয়ের পর রাতে সুবিধা হবে দেখছি শ্বশুরবাড়ি এলে। শ্বশুরের এত বড় পুকুর থাকতে বাথরুমের প্রয়োজন পড়বে না। ”

শশী জমে গেল। নীহার যেতে যেতে দুষ্টু নজরে দুষ্টু হাসি দিতে দিতে চলে গেল। কুয়াশা ভ্রুর মাঝে রাগ নিয়ে এগিয়ে গেল। মেয়েরা সকলে বাঁধায় করা শানের উপর বসল। গল্প করতে। শিশিররা সকলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছে। সকলে শার্ট খুলে পুকুরে ঝাপ দিল। শিশির ওর নানিদের ওখান থেকে সাঁতার শিখেছিল। নীহারেরও শেখা আছে। হিমও পারে টুকটাক। শিশির নেমে টান দিয়ে শার্ট খুলে ফেলল। এদিকে বৃষ্টিরা গল্পে মগ্ন কিন্তু কুয়াশা শিশিরকে দেখতে ব্যস্ত।
শিশিরও শার্ট খোলার পর কী মনে করে যেন পেছনে তাকাল৷ দেখল কুয়াশা তাকেই দেখছে অনিমেষ। তা দেখে হাসল সে। সকলের অগোচরে চোখ টিপল। কুয়াশা লজ্জা পেল কিন্তু চোখ সরাল না। তাকিয়ে রইল। এই ছেলে সব অনুভূতিগুলোকে এক জায়গায় বেঁধে ফেলে। শিহরণ জাগানোর ওস্তাদ। শার্টহীন উজ্জ্বল হলুদ পেশিবহুল শক্ত-পোক্ত পিঠ থেকে কোমর অবধি অতি আকর্ষণীয়। শিশির দাঁত বের করে হাসতে হাসতে নিচে নেমে ঝাঁপ দিল৷ বউ তার এক্কেবারে ম-রেছে।

কুয়াশা ভাবিদের সাথে গল্প করছে আর শিশিরকে দেখছে। অতি দক্ষতার সাথে সাঁতার কাটছে। দুই রাউন্ড দিয়ে সকলেই হাঁপিয়ে গেছে। তাই একে একে এসে সিঁড়িতে বসল। টুকটাক কথা বলছে। শশীর এবার নীহারের দিকে চোখ গেল। উল্টো ঘুরে আছে। পিঠ দেখা যাচ্ছে। একে একে স্মৃতি, ঈশাও তাকাল। স্মৃতি রিজভীকে দেখল। তারা রিলেশনে আছে এখন। ঈশাকে মিহির প্রপোজাল দিয়েছে। কিন্তু তেমন ভাবে আগায়নি তারা। এত কম বয়সের ডিফারেন্স এইজন্য ঈশা আগাচ্ছে না। তবুও ভালোলাগা আছে। পরে কী হবে জানা নেই। ওদের এক একটাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বৃষ্টি, ইয়াসমিন হেসে বলল,

” এভাবে গিলে খাচ্ছ কেন তোমরা বেচারাদের? ডায়রিয়া হবে, কম করে খাও।”
সকলে ভড়কে গেল। চোখ ফিরিয়ে নিল। ওরা দু’জন হেসে ফেলল৷ কুয়াশা সকলের অগোচরে আবার তাকাল। আজ তার কী হলো কে জানে! কখনো শিশিরকে এমন গোসল করা অবস্থায় দেখেনি। আজ দেখে খুবই আকর্ষণীয় লাগছে। নিয়ন্ত্রণহীন হচ্ছে কী!!
কিছুক্ষণ গোসলের পর সকলে উঠে পড়ল। বৃষ্টি, ইয়াসমিন চলে গেছে। তাদের ডেকেছে। কুয়াশারা হাঁটাহাঁটি করছে পুকুরের সামনে আম গাছের নিচে। আর গল্প করছে। এমন সময় আবারও শিশিরের দিকে নজর চলে গেল কুয়াশার। এ মেয়ে আজ নির্লজ্জ হয়ে গেছে। ভাবটা এমন জীবনে শিশিরকে দেখেনি। শরীরে পানিগুলো সূর্যের লালাভ আলোয় জ্বল জ্বল করছে। নাহ্ আর তাকানো যাচ্ছে না৷ চোখ ফিরিয়ে নিল।
শিশির কুয়াশার হাবভাব সবই দেখল। দেখে দেখে মুচকি মুচকি হাসল৷ ভালোই জব্দ করা যাচ্ছে দেখি!

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারিদিকে নিঃস্তব্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে। গ্রামের সন্ধ্যাটাও কী সুন্দর! চারিদিকে আজানের ধ্বনি কানে আসছে।নামাজের কিছুক্ষণ পর কারেন্ট চলে গেল। গ্রামে এই একটা জ্বালা বেশি। কারেন্ট অতিরিক্ত যায়। একে তো গরম আর কারেন্ট চলে গেল! সকলে হা-হুতাশা করতে লাগল। জিনিয়া আর শশীর ভাবি রান্নার আয়োজন করছিল সাথে জাকিয়ারা তিন জা সাহায্য করছিল। শশীরা সেখানে চার্জার দিয়ে সকলে মিলে ছাদে চলে গেল। এই গরমে ঘরে থাকা বড্ড কষ্টদায়ক। জাকির, জাহিদ, আমিনুল হককে নিয়ে হানিফ সাহেব চেয়ার পেতে বসলেন উঠানে৷

ছাদে পাটি বিছিয়েছে সকলে। মৃদু আলো শুধু। লাইট টাইট কিছু আনেনি। পূর্ণ জোৎস্না রাত না হলেও অন্ধকারটাও ততটা গভীর না। সকলে সকলকে হালকা আলোয় দেখতে পারছে। হাত পাখা নিয়ে বসল। সকলের কাছে নেই অবশ্য। শিশিরের কাছে পাখা ছিল না। কুয়াশার কাছে আছে৷ সে গিয়ে কুয়াশার কোলের উপর শুয়ে পড়ল। বলল,
” জোরে জোরে বাতাস কর৷ প্রচন্ড গরম লাগছে ”
সকলের সামনেই শুয়েছে। কুয়াশা কিছুটা ভড়কে গেল। মিটিমিটি হাসল সকলে ওদের কাণ্ড দেখে। তুষার, তুহিনও আছে। ইয়াসমিন হাসতে হাসতে বলল,

” শিশির তোর জায়গা হলো না? বউয়ের কোলের উপর শুতে হলো? ”
” না হয়নি। বউ আমার সো বউয়ের কোলও আমার। তোমরা তোমাদের কাজ করো। ”
এমন কথায় আবার হাসল সবাই। বৃষ্টি টিপ্পনী কেটে বলল,
” বাবাহ্ এখন সব তোমার? কে যেন বলেছিল, ‘তোর মতো গোবর ঠাসাকে বিয়ে করার থেকে রাস্তার পাগলকে বিয়ে করা ভালো!’ ”
শিশির ভড়কে গেল৷ এরাই যত নষ্টের গোড়া৷ একটু বউয়ের প্রতি অধিকারও দেখাতে পারে না। আগে যা করেছে করেছে তাই বলে এখন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলতে হবে! শিশির কুয়াশার দিকে তাকাল৷ সে তার দিকেই তাকিয়ে। ভেঙচি কাটল কুয়াশা৷ বলল,

” বুনো ওল বলেছিল।”
সবাই হেসে ফেলল। তবে সত্যি সত্যি বাতাস করতে লাগল কুয়াশা৷ ভালোই লাগছে শিশিরের৷ আহ্ কী রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার৷ বউয়ের কোলে শুয়ে বউয়ের হাতে পাখার বাতাস খাচ্ছে। কুয়াশা বাতাস করতে করতে একটা হাত শিশিরের চুলের মধ্যে সহ, গলা, বুকে চালাচ্ছে, কখনো আবার কপালেও স্লাইড করছে। শিশির অনুভবে বুঝল তা৷ এটাও বুঝল বউ তার কতটুকু গরম লাগছে মাপার চেষ্টা করছে। ঘামও মুছিয়ে দিচ্ছে কপাল থেকে হাতের পিঠে, তালুতে করে। কুয়াশা অন্ধকারে সকলের অগোচরে শিশিরের শার্টের বুকের উপরের বোতাম গুলো খুলে দিল একে একে৷ খুলে বুক আলগা করে দিল। শিশির অনেক আপ্লূত হলো বউয়ের এহেন কাজে। সকলের অগোচরে কুয়াশার হাতের ফাঁকে হাত গলিয়ে দিল। ঠোঁটে ধরে গাঢ় একটা চুমু খেল হাতের পিঠে। কুয়াশা নড়ে উঠল একজোড়া তপ্ত ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে। হালকা আলোয় নজরে নজর পড়ল দু’জনের৷ হাসল দু’জনে অমায়িক। একজনের দুষ্টু হাসি তো একজনের লজ্জাময় হাসি। দু’জন দু’জনকে বুঝিয়ে দিল একে অপরে ঝগড়া করুক আর চুলোচুলি করুক অনুভূতি, ভালাবাসা তাদের মাঝে কতটা গভীর।

চারিদিকে বেশ নিঃস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। কিন্তু রাত মাত্র আটটা৷ গ্রামের রাত এমনই৷ সন্ধ্যার পর পরই নিঃস্তব্ধতায় ছেয়ে যায়৷ শহরের মতো তো আর গ্রামেও সবসময় গাড়িঘোড়া চলে না! এছাড়া গ্রামে অধিকাংশ মানুষ অতি জলদি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। যারা একটু লেখাপড়া করে তারা রাত জাগে। আর পুরুষগণ দোকানপাটে বসে গল্পগুজব সহ টিভি দেখে রাত দশটা-এগারটা বাজায়৷ এই গ্রামের রাত জাগা৷
তবে শশীদের গ্রামটা এখনো আগের রেশ ধরেই আছে৷ এখানে তেমন আধুনিকতা আসেনি এখনো। যার জন্য এত জলদি নিঃস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে।

কারেন্ট এলো মাত্র। গল্পের মাঝেই এসেছে। ওদিকে জিনিয়া সকলকে ডেকে পাঠিয়েছেন। জানিয়েছেন এসে খেয়ে নিতে আগে৷ নয়তো আবার কারেন্ট গেলে খেতে সমস্যা হবে৷ কারেন্ট থাকতে থাকতে খেয়ে নিক৷ যখন তখন আবার চলে যাবে। সকলে বিষয়টা বুঝল৷ কথা খারাপ না। কিন্তু এত জলদিও খাবার অভ্যাস নেই৷ শহর অঞ্চলের মানুষ বলে কথা! তবুও সকলে উঠে নিচে চলে গেল।

খাবার খেতে সকলে নিচে পাটি বিছিয়ে বসেছে৷ এতগুলো মানুষের ডাইনিং টেবিলে জায়গা হবে না। আর টেবিলে বসলেও বার বার বসতে হবে কয়েকজন করে করে। এই ভেবে ছোট, বড় পুরুষ সহ কুয়াশারা, বৃষ্টিরা বসেছে৷ পরিবেশন করার দায়িত্বে আছেন জিনিয়া, শশীর ভাবি, জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা।

খাবার সকলে তৃপ্তি করে খাচ্ছে৷ গ্রামের সব ফরমালিন মুক্ত ফ্রেশ সবজি পেয়ে সকলে আপ্লূত। দুপুরে তেল মসলার খাবার রান্না করা হয়েছিল মেহমানদের জন্য। এখন সেগুলো আছে কিন্তু সেগুলো কেউ তাকিয়েও আর দেখছে না৷ জিনিয়া রাতের জন্য রান্না করেছেন, নিজেদের বাড়ির ধানের চাউলের ভাত, ডাউল, পটলের চপ ভাজি, বেগুনের চপ ভাজি, আলু ভাজি, লাল শাক ভাজি, নিজেদের পুকুরের রুই মাছ ভুনা সহ টুকটাক আরো কয়েকটা পদ৷ এগুলো খেয়ে সকলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শহরে শাক-সবজি কিনে খায় সেগুলোর স্বাদই পাইনা সকলে মনে হয়৷ আর এগুলো কী মজাদার!! শিশিররা, কুয়াশারা সমানে বলে যাচ্ছে তা। তা শুনে সকলে হাসছে। নীহার তো বলেই ফেলল,

” নাহ্, এখানেই থেকে যাব তো। এত মজাদার খাবার ছেড়ে থাকা যাই! ”
সকলে শুনে খাবার মাঝে জোরে জোরে হেসে দিয়েছে। আম্বিয়া বললেন,
” কেন রে তোর ঘরজামাই থাকার শখ আছে নাকি? ”
” আরেহ্ আম্মু থাকলে কি সমস্যা? শাশুড়ীর হাতের মজাদার সব খাবার খেতে পারব। রোজ রোজ শ্বশুরের পুকুরের মাছ, ক্ষেতের টাটকা সবজি খেতে পারব ”
সকলে আবার হাসল। আম্বিয়া বললেন,
” পাজি ছেলে ”
জিনিয়া বললেন,

” একমাত্র মেয়ে-জামাইকে ঘরজামাই রাখতে সমস্যা হবে না আমাদের। থাকতে পারো নীহার”
শশী এসব শুনে লজ্জায় নূয়ে পড়ল। নীহার আঁড়চোখে তাকাল শশীর দিকে। হানিফ সাহেব হেসে বললেন,
” তবে আর কি? জামাই, শ্বশুর মিলে একসাথে মাছ ধরে বাজারজাত করব আর মাঠে ফসল সহ শাক-সবজি আবাদ করব। কি চলবে না নীহার? ”
” দৌড়বে। আমি রাজি ”
সকলে আবার হেসে কুটিকুটি হলো। শিশির পাশে থেকে নীহারের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” এখন পটালেও কাজ হবে না ভাই৷ সময় এখনো দুই বছর…। এর আগে বউ পাচ্ছিস না। তোর শ্বশুর তোকে নাকানিচুবানি খাইয়েই মেয়ে দেবে। ”

শুনে নীহার আফসোসের শ্বাস ফেলল। কিন্তু এদিকে হিম কথাটা বলেই ফেলল জোরে করে,
” কিন্তু নীহার ভাই তোমার এসবের জন্য এখনো দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। শ্বশুর পটিয়েও কাজ নাই। ”
কথাটা শোনা মাত্রই শিশির, নীহার দু’জনেরই নাকে-মুখে ভাত উঠে বেশম লেগে গেল৷ কাশতে কাশতে অবস্থা কাহিল হলো। মাত্রই কথাটা আলোচনা করছে তারা এই লিলিপুট তা বলেই দিল সকলের সামনে? হিমের কথা শুনে কুয়াশা সহ সকলে হা হা করে হেসে দিয়েছে৷ শশী আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে। নীহার কাশতে কাশতে চোখ বড় বড় করে তাকাল সকলের দিকে। কী লজ্জাজনজ কথাবার্তা!!
এদিকে শিশির হিমকে কটমট নজরে দেখল। শা-লা একটা পেয়েছে সে! বদের আড্ডি৷ ভাই-বোন দুটোই এক। জীবনডা জ্বালিয়ে খেল। টোপ টা এক্কেবারে সঠিক সময় মতোই ফেলেছে।
নীহার এবার হিমের দিকে তাকাল। কিড়মিড় নজরে কটমট করতে করতে৷ একপর শিশিরের কাছে বিড়বিড় করে বলল,

” শালা একটা পেয়েছিস তুই৷ ওর মতো একটা শা-লা থাকলে আর কিছুই লাগে না সকলের সামনে নাকানিচুবানি খাওয়ার জন্য”
শিশির শুনে মিটমিট করে হাসছে। এভাবে হাসাহাসি করতে করতেই আজ খাওয়া সম্পূর্ণ করল। বেশ আনন্দ লাগছে সকলের৷ নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ মনোমুগ্ধকর।
খেয়ে দেয়ে সকলে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় আবার কারেন্ট গেল৷ কী জ্বালা! খেয়ে উঠে সকলের আরো গরম লেগে গেছে বেশি। হানিফ সাহেব সকলকে বাহিরে গিয়ে বসতে বললেন চেয়ার পেতে। জাকির মালিথারা সহ এবার তুষার, তুহিন বাবাদের সাথে উঠানে বসল৷ শশীর বড় ভাই সৌরজও আছে। শিশির, নীহাররা বাবার সাথে বসতে গেল কিন্তু শশী বসতে দিল না। সে শিশিরকে টেনে নিয়ে এলো। ছাদে যাবে বলল। শিশিররাও আর মানা করল না। কারণ সেখানে বেশ ভালোই ফুরফুরে বাতাস বইছে৷

ছাদে সকলে বসল। আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার মাঝে দশটার দিকে ইয়াসমিন, বৃষ্টি উঠে চলে গেল। কারেন্ট আসার নাম নেই। কখন আসবে কে জানে! আড্ডার মাঝে শশীকে ডেকে নীহার একটু দূরে বসল। তারা তাদের মতো গল্প করছে তাই সেদিকে আর কেউ গেল না তা নিয়ে কথাও বলল না। কাটাক একটু সময় নিজেদের মতো করে৷

রাত এগারটার দিকে কারেন্ট এলো। সকলের আড্ডা ভেঙে নিচে যেতে চাইল। ঘুমও ধরেছে সকলের। কিন্তু, এদিকে শিশির আগের ন্যায় কুশার কোলের উপর মাথা রেখে ঘুমে কাঁদা। নীহার এসে শিশিরকে ডাকল কিন্তু সে বান্দার ওঠার নাম নেই। অনেকেই ডাকল বান্দা উঠছে না, আশ্চর্য!! নীহার এবার চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। রিজভীও বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু বুঝে উঠতে পারল না। শিশিরের ঘুম একটু গাঢ় আগাগোড়াই৷ কুয়াশাও আর ডাকতে দিল না। বলল,

” ভাইয়া থাক। একটু ঘুমিয়ে নিক। তোমরা গিয়ে শুয়ে পড়ো ”
” পাগল নাকি? বে-য়াদবটা ঘুমাবে আর তোকে একা এখানে বসিয়ে পাহারা দিতে রেখে যাব? ”
” সমস্যা হবে না ভাইয়া। তোমরা শুয়ে পড়ো। আমি ডেকে তুলে আনছি। বেশিক্ষণ থাকব না”
শশী বলল,
” বুবুর সাথে আমি থাকছি। আপনারা চলে যান”
” না তোমার থাকতে হবে না। আমি থাকছি। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে ”
এবার রিজভী বলল,
” নীহার ভাই, থাক এরা৷ চলো আমরা নিচে যায়৷ কুয়াশায় পারবে ও’কে ডেকে তুলতে। চেনোই তো ওদের!”
কথাটা নীহার ভাবল৷ কথা মন্দ না৷ কুয়াশা যেমনই হোক তুলে নেবে। রাতও ততটা গভীর হয়নি। ভেবে বলল,
” আচ্ছা, তবে বেশি লেট করিস না। বে-য়াদবটাকে তোল ডেকে। না উঠলে মে-রে উঠাবি। বে-য়াদব আরামের জায়গা পেয়েছে। দেখো কেমন নাকে তেল দিয়ে ঘুমচ্ছে ”

শেষ বাক্য দুটো বিড়বিড় করে বলল। কিন্তু রিজভী বিষয়টা ধরে ফেলেছে তাই মিটমিট করে হাসছে৷ স্মৃতিও ধরতে পেরেছে। রিজভীর দিকে তাকিয়ে হাসছে দু’জন ওরা চলে গেল একে একে। কুয়াশা এবার একটু ভয় পাচ্ছে। তবে শিশিরকে ডাকার ইচ্ছে হলো না কেন যেন৷ কোলের উপর মাথা রেখে ঘুমচ্ছে দেখতে কী সুন্দর লাগছে! কুয়াশা শিশিরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঘুমে তার স্বামীটাকে আবছা আলোয় কী সুন্দর লাগছে! ভেবে মুচকি হাসল। ইশশ এটাকে বিয়ে না করার জন্য কতশত বাহানায় না করেছিল! আর এখন মনে হচ্ছে নাহ্, বিয়ে না করলে এত সুন্দর ছেলেটা হাত ছাড়া হয়ে যেত। নিজ মনেই পাগলামী ভাবনা ভেবেই হেসে ফেলল একটু শব্দ করে।
তৎক্ষনাৎ শিশির কুয়াশার কোলের উপর থেকে মাথা তুলে এক ঝটকায় কুয়াশাকে টেনে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে গলার মাঝে মুখ গুঁজে দিল। ঘটনা গুলো এতটায় জলদি হলো যে কুয়াশা কিছু বুঝে ওঠার সুযোগই পেল না। হতভম্ব, হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চমকেও বেশ উঠেছে৷ শিশির গলায় মুখ গুঁজে দিয়েই বলল,

” ঘুমা ”
মানে কী!! কুয়াশা বলল,
” এ্যাই…! তুমি ঘুমোও নি? তুমি না ঘুমে কাঁদা ছিলে? তোমাকে না ঘুম থেকে তোলা গেল না? আর এখন এসব কি? ”
” তোর অত বুঝে কাজ নেই। তুই ঘুমা৷ ওরা আমাকে আলাদা ঘরে শুতে দিত। আর আমার এখানের স্মেল না নিলে ঘুমই হবে না। তাই এই বুদ্ধি। বেশি না বুঝে ঘুমা। ”
কুয়াশা হতবাক হয়ে হা হয়ে গেল। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। মানে এই ছেলে এতক্ষণ ঘুমের ভান ধরে ছিল? তারজন্য এতক্ষণ ডেকেও বান্দা উঠে নি? কী চালাক লোক চিন্তা করা যায়!! বলল,
” তুমি ঘুমের ভান ধরে ছিলে এতক্ষণ? কী চালাক গো তুমি! একদম চতুর শৃগাল ”
শিশির মুখ গুঁজে রেখেই ফিসফিস করে হেসে ফেলল৷ বলল,

” হুঁ, ওরা আমার আহ্লাদী বউটাকে অন্য ঘরে শুতে দিত আর আমাকে অন্য ঘরে৷ ওমন ঘুমানো আমার পক্ষে সম্ভব না। এই দুই মাসে তুই আমার অভ্যাস হয়ে গেছিস। তোর নেক স্মেল না নিলে ঘুম ধরে না। এটা নেশা আমার। সকলে নেশাদ্রব্য সেবন করে আর আমি তোর নেক স্মেল সেবন করে ঘুমায়। সকলের সাথে শুতে পারব না আমি। ”
কথাগুলো আহ্লাদের সাথে বলে আরেকটু টেনে নিল কুয়াশাকে৷ কুয়াশা হাসবে নাকি অবাক হবে? সেটাই বুঝছে না। কতটা বউ পাগল হয়েছে চিন্তা করা যায়! কুয়াশা ভেবে বলল,
” তুমি তো দেখছি আস্ত একটা বউ পাগল হয়ে গেছ গো। শিশির মালিথা বউ পাগল? ভাবা যায়!! এ্যাই তুমি না আমাকে বিয়েই করতে চাইছিলে না! কী যেন বলেছিলে! ‘ তোর মতো গোবর ঠাঁসাকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছি না আমি, হুহ্। ”

শিশির মুখ তুুলে কুয়াশার দিকে তাকাল। চোখে চোখ রাখল আবছা আলোয়। সে-ও ভ্রু কুঁচকে বলল,
” সেতো তুইও বলেছিলি। অথচ এখন নিজেই সুযোগ বুঝে ছোঁচার মতো ছুঁকছুঁক করে আমাকে দেখিস। ভাবে লাগে গিলে খেতে পারলে বাঁচিস। পুকুর পাড় থেকে যেভাবে দেখছিলি। ভাগ্যিস আম্মু ছোট কালে নজর টিকা দিয়েছিল ”
শিশিরের কথা শুনে কুয়াশা ভড়কে তো গেল কিন্তু শেষ কথাটা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল। শিশিরও হাসল তা দেখে৷ চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা তার বউটাকে রাতের আবছা আলোয় অপূর্ব, অপ্সরার থেকে কম কিছু লাগছে না। এটায় তো চাঁদ। আর চাঁদের প্রয়োজন পড়বে? উহু পড়বে না।
কুয়াশা হাসি থামিয়ে আমতাআমতা করে মেকি রাগ দেখাল৷ ঝাঁঝ নিয়ে বলল,

” নিজে যে সি’ডি’উস করছিলে তারবেলায়?”
” আচ্ছা? আমি সি’ডি’উস করছিলাম?”
” তা নয়তো কি? ”
” হয়েছিলিস সি’ডি’উস? ”
” হুঁ, তুমি পুরোটা অতিশয় আকর্ষণীয় পুরুষ। ”
কথাটা অকপটে কুয়াশা শিশির চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে বলে দিল। শিশির তা শুনল। সে বউয়ের উপর পূর্ণ দৃষ্টি দিল এবার। ছাদের শানে একহাতে ভর দিয়ে শোয়া সে। কুয়াশা চিৎ হয়ে শোয়া৷ শিশির কুয়াশার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমার ঘরের অপূর্ব চাঁদ। ”
কুয়াশা লজ্জা পেল। লজ্জায় মুখ গুঁজে দিল শিশিরের বুকে। শিশিরও অন্য হাতটা দিয়ে কুয়াশা বুকের সাথে চেপে ধরল। হাসল সে। সুখ সুখ লাগে খুব। কিছুক্ষণ পর কুয়াশা বলল,
” সকলে কি ভাববে? ”
” কিছুই ভাববে না৷ আমি ম্যানেজ করে নেব। ”
” ছাদের দরজা খোলা। ”
” আটকে দিয়ে আয়। ”
কুয়াশা তা শুনে উঠে বসল। পাশে থেকে ফোন নিয়ে শশীকে কল দিল। একটা বালিশ আর একটা কয়েল নিয়ে ছাদে আসতে বলল। কথা বলে ফোন রাখল৷

এদিকে শশী কথা অনুযায়ী বালিশ আর কয়েল, লাইটার নিয়ে চুপিচুপি ছাদে যাচ্ছিল। কিন্তু সামনে নীহার বেঁধে গেল৷ নীহার ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” এসব নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? ”
ভড়কে গেল শশী। যতোই হোক কুয়াশা বোন তার৷ সে-ও বুঝেছে, তারা একা থাকতে চায়। তবুও আমতাআমতা করে বলল,

” শিশির ভাইয়া বলল ছাদেই ঘুমবে। তাই দিতে যাচ্ছি ”
নীহারের ভ্রু আরো কুঁচকে গেল। বলল,
” কুয়াশা এসেছে? ”
ধুর..এত প্রশ্ন করতে হবে কেন! ভড়কানো কন্ঠে সত্যিটায় বলল। নয়তো আরো প্রশ্ন করবে। নীহার শুনে ভড়কে গেল। শিশিরের মতিগতি এবার বুঝল৷ তবে আনন্দও পেল৷ বলল,
” চলো আমিও যাচ্ছি ”
” না না লাগবে না। আপনি থাকেন আমি দিয়ে চলে আসছি ”
নীহার তা শুনে শশীর হাত থেকে বালিশ নিতে নিতে বলল,
” এত বুঝো কেন তুমি? বড্ড বেশি পাকনা তুমি। ”
শশী লজ্জা পেল। কথা না বলে হাঁটতে লাগল। কিন্তু নীহার শশীর আঙুলে আঙুল গলিয়ে দিয়ে শক্ত করে হাত ধরল। বলল,

” চলো..”
শশী কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগল। এমন সময় নীহার বলে উঠল,
” ইঁচড়েপাকা মেয়ে অন্তর জ্বালিয়ে খাঁক করে দিচ্ছ কিন্তু! দুইটা বছর অপেক্ষা করা কিন্তু দায় হবে আমার। ছাই না হয়ে যাই আবার ”
শশী বরফ হলো তা শুনে। হাঁটার গতি কমিয়ে দিল। নীহার তাকিয়ে পেছনে দেখল। চোখে চোখ পড়ল। শশী নীহারের গভীর নজরে অনিমেষ তাকিয়ে। দহন বেড়ে গেল নীহারের। হাত ছেড়ে শশীর বাহু ধরে কাছে টানল। দূরত্ব অতি কম তাদের মাঝে৷ কিঞ্চিৎ ফাঁকা। তারা সিঁড়ির সামনে। এখনো একটা সিঁড়িও অতিক্রম করেনি। ডাইনিংএর আলো আসছে এদিকে। শশীর হাতে ফ্ল্যাস জ্বালানো ফোনের। নীহার শশীর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে চুমু আঁকল। বলল,
” জলদি বড় হও। আমার অপেক্ষার অবসান জলদি ঘুচাও। ”
শশী কি এতটাই ছোট? তার কি এলোমেলো লাগে না এসব শুনলে? সে-ও বুঝছে সব। তারও ভেতর এলোমেলো হচ্ছে। দহন বাড়ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। নীহারের কথা শুনে সে লজ্জায় কপাল ঠেকিয়ে দিল নীহারের বুকে। বলল,

” এতটাও ছোট না আমি। এলোমেলো আমিও হই। এমন করে আর বলেন না প্লিজ। ”
নীহার হাসল৷ এই মেয়েটা তাকে পুরোই শেষ করে দেবে। থাক আর এসব বলে কাজ নেই৷ হুবু বউ তার পাকানা। অপেক্ষার প্রহর জলদি শেষ হোক। ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বলল,
” চলো। ”
শশী আর কথা বলল না। দু’জনেই সিঁড়ি ভেঙে উপরে গেল। শশী ছাদের দরজা নক করল। কুয়াশা উঠে এলো। দেখল নীহারও সাথে। ভড়কে গেল। লজ্জা পেল সে। নীহার তা বাদ দিয়ে দরজার মুখের কাছে থেকেই মৃদু চেঁচিয়ে বলল,
” এ্যাই বে-য়াদব, আমার বোনকে ছাড়া ঘুম হয় না, এটা বললেই পারতিস! ওমন নাটক করার কি ছিল? নাটকবাজ সব। ছোট থেকে তোর নাটক দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেলাম৷ ”
শিশির তা শুনে বলল,

” রাজাকা-রের বংশধর, দুইনাম্বারী করে বিয়ে দিয়ে এখন আবার বউয়ের থেকে আলাদা শুতে কইস? লজ্জা করে না তোদের? ”
” আচ্ছা? লজ্জা আমাদের পাওয়া উচিত?”
ওদের দু’জনের কথা শুনে শশী, কুয়াশা হতভম্ব হয়ে গেল। কুয়াশা তো লজ্জায় মিইয়ে গেল৷ শিশির বলল,
” এ ভাই, তুই এখানে কেন এলি রে? যা তো! কাল তোর বিয়ে দিয়ে দেব একেবারে। আর কাঁইন্দা বেড়াইস না।”
কী সব লাগাম ছাড়া কথা-বার্তা বলছে দুই ভাই? এরা এভাবেও কথা বলে? ওরা দুইজন হা করে চেয়েই রইল শুধু।
” আমার কাঁইন্দা বেড়ানোর কারণ তো তোর বোন। ওকে নিয়ে যত দুনিয়ার জ্বালা আমার।”
শশী কপাল চাপড়ে দাঁড়িয়ে রইল। কুয়াশা তৎক্ষনাৎ বালিশ নিয়ে নিল নীহারের থেকে। এরপর শশীর থেকে কয়েল। শশীও সুযোগ বুঝে নীহারকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। ওপাশ থেকে শিশির কিছু একটা বলল যা কান অবধি এলো না।

কুয়াশা গিয়ে মৃদু রাগ নিয়ে বলল,
” কীসব কথা বললে ভাইয়ার সামনে? ”
” তোর ভাই আমারও ভাই৷ আর ওর সাথে আগে থেকেই এভাবে কথা বলি আমি।”
” তবুও লজ্জা লাগল আমার। ”
কুয়াশা কথা বলতে বলতে কয়েল জ্বালিয়ে দিল। শিশির কিছু বলল না। সে বালিশ নিয়ে শুলো। নিরিবিলি প্রকৃতিতে রাত কাটাবে বউয়ের সাথে ইশশ কী সুন্দর অনুভূতি! তাকাল কুয়াশার দিকে। কুয়াশা আজ অদ্ভুত একটা কাজ করল৷ যেটা এই অবধি করেনি। শরীর থেকে ওড়না খুলে পাশে রাখল৷ এটা করা কারণ এখানে ফ্যান নেই শুধু প্রকৃতির বাতাস৷ মাঝে মাঝে গরম বেশি লাগছে। তাই ওড়না খুলে ফেলল। শিশিরের সাথে শুলেও সে ওড়না নিয়েই শুয়েছে এতদিন। আসলে সবকিছু জলদিও হয়না। এখন আস্তে আস্তে লজ্জা ভেঙে যাচ্ছে। তাই আজ পারল এমনটা।
এদিকে শিশিরের আবছা আলোয় তা দেখে পুরো শরীর ঝনঝন করে উঠল তার৷ কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল,

” এ্যাই! কি করছিস? এটা ছাদ। এভাবে আমার কাছে এসে মারবি নাকি? ”
কুয়াশা তাকাল৷ লজ্জা সে পাচ্ছে কিন্তু পাত্তা দিল না৷ দুষ্টু হেসে শিশিরের কাছে এগিয়ে গেল৷ চোখে মুখে কেমন যেন দুষ্টুমি খেলা করছে তার সাথে দুষ্টুমি হাসি তো আছেই। এগিয়ে গিয়ে শিশিরের একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” তোমাকে সিডিউস করছি। বিকেলে আমাকে করেছ না? এখন আমি করছি। শোধবোধ ”
বলে উঠে ঠোঁট টিপে হাসল শিশিরের চোখের দিকে তাকিয়ে৷
এদিকে শিশির তো শেষ! কুয়াশাকে এক ঝটকায় বুকে ফেলল৷ বলল,

” দিন দিন, ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। তুই যে এতটা পাকনা জানতাম না তো! দেখে তো মনে হতো ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানিস না৷ আহ্লাদী আহ্লাদ ছাড়া আর কিছুই জানিস না৷ বিয়ের পর তো আমি রীতিমতো চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু এখন তো দেখি আমার ভাবনা উল্টো ”
” বিশ্বাস করো, তুমি এখন যেটুকু ভাবছ তার থেকেও দ্বিগুণ আমি ”
শিশিরের শরীর আবার ঝনঝন করে উঠল৷ এ কি আজ মে-রে দেবে? এদিকে কুয়াশা শিশিরকে জব্দ করতে পেরে সেই আনন্দিত। সে কি কম? বিকেলে তাকে জ্বালিয়েছে। এবার তার পালা৷ নামের মান রাখতে হবে না? এমনি এমনি উপাধি পেয়েছে? শিশির এবার কুয়াশার বাহু ধরে শানের উপর ফেলে তার বুকের নিচে পিষিয়ে ধরল। কন্ঠে নিজের ব্যক্তিত্বের দাম্ভিকতা ফুটিয়ে তুলল শিশির৷ কুয়াশার ঠোঁটের উপর ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে লাগল। কুয়াশা কেঁপে উঠল। আবছা আলোয় কুয়শার ঠোঁট, মুখ, নাক, চোখে নজর দিতে দিতে কন্ঠে পুরো দাম্ভিকতা নিয়ে বলল,

” বিলিভ মি কুয়াশা, এটা ছাদ না হলে আজ দেখেই ছাড়তাম আমার ভাবনার থেকে কতটা বেশি তুই!”
কুয়াশার বুক ঢিপঢিপ করছে। শিশির ক্ষেপে গেছে৷ সে যে বাঘের সাথে লড়তে এসেছে! এই ছেলে যে তার থেকে দ্বিগুণ মাত দিতে পারে। তবুও নিজেকে দমাল না৷ বলল,
” হাহ্ জানা আছে। ”
শিশিরের ব্যক্তিত্বে গিয়ে লাগল কুয়াশার এমন ব্যঙ্গ করাটা। তার ভেতরের পুরুষত্ব চিৎকার করে বলছে কুয়াশা তার ব্যক্তিত্বকে, পুরুষত্বকে ব্যঙ্গ করছে। সে ভেতরে থেকে জ্বলে উঠল। কুয়াশার কথা তার সহ্য হলো না৷ দাম্ভিকতা ও রূঢ় স্বরে বলল,
” কমলার কোয়ার ন্যায় ঠোঁটজোড়া তোর। তোর এই ঠোঁটজোড়ার অধিপতি তোর ঠোঁটে তার আধিপত্য ঘটাবে এখন। মানা কী করে করিস দেখি ”

বলে কুয়াশাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না। ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল৷ শুরুতে একটু বুঝতে সময় নিল সে। বুঝে উঠে কেঁপে উঠল কুয়াশা৷ পুরো শরীর অবস হয়ে এলো। শরীর নেশায় বুদ হয়ে গেল। মাতালের ন্যায় শরীর পড়ে যেতে চাইল৷
অনেক প্রতীক্ষার পর এই ছোঁয়া। শুকনো খরখরা মাটিতে চৈত্রর এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়লে যেমনটা তরতাজা হয়ে ওঠে দু’জনেরই ঠিক তেমন অবস্থা হচ্ছে। চৈত্রর খরা কাটিয়ে ফসলগুলো প্রাণ ফিরে পাবার মতো অবস্থা দু’জনের অধরযুগলে। অনুভূতিরা এতদিন দলা বেঁধে ছিল৷ আজ যেন সকল বাঁধা অতিক্রম করতে চাইল।

কুয়াশা এই সামান্য ছোঁয়া হজম করতে পারছে না। বেগ পেতে হচ্ছে। শিশির পুরো নেশার মধ্যে। গভীর থেকে গভীরতর সেই অধর চুম্বন। কুয়াশা তালও মেলানোরও সময় পাচ্ছে না৷ এ ছেলের সব কিছু পারফেক্ট৷ কিসটাও করছে পারফেক্টলি৷ ভেবে নিয়ে কুয়াশা এবার দু’হাতে ঝাপটে ধরল শিশিরের ঘাড় সহ গলা৷ শিশির কুয়াশার রেসপন্স পেয়ে আরো গভীর হলো। পান করতে লাগল দু’জন অমৃত সুধা৷ দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দ অতি ভারী হয়ে এসেছে৷ কিন্তু এখনো অধর চুম্বনে তারা। চোখ বন্ধ দু’জনের। তারা তাদের কাজে মত্ত। কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখার নেই।
শিশির এবার অধর চুম্বন অবস্থাতেই কুয়াশাকে তুলে নিজের শরীরের উপর নিয়ে নিল। সে চিৎ হয়ে শুয়ে, কুয়াশা তার শরীরের উপর শুয়ে। এখনো ছাড়ে নি। ভাবটা এমন আজ কিস করেই রাত কাবার করবে৷ যেন আর কখনো পাবে না কেউ কাউকে৷ কুয়াশার একটা হাত শিশিরের গালের উপর। শিশির এক হাত কুয়াশার কোমড়ে রেখেছে অন্য হাত কুয়াশার গাল গলিয়ে চুলের পেছনে নিয়ে গিয়ে শক্ত করে মুঠো করেছে৷ কুয়াশা এই নেশায় বুদ হয়ে আছে বলে সেই ব্যথাকে পাত্তা দিচ্ছে না৷ অন্য সময় হলে এই ব্যথা দেবার শাস্তি দিয়ে দিত হয়তো৷ অন্যদিকে খেয়াল নেই। প্রণয়ের প্রথম ছোঁয়া অনুভব করতে ব্যস্ত সে।

শিশির এতক্ষণ পর এবার একটু আগের রাগটা কুয়াশার অধরে ঝারল। কামড় দিল ঠোঁটে। কুয়াশা গুঙিয়ে উঠল। সে-ও দিল। শিশিরের থেকে জোরে। কেউ কারো থেকে একচুল পরিমাণ কম না৷ শিশির ব্যথা পেয়ে এবার ছেড়ে দিল কুয়াশাকে। কুয়াশার মুখ সরিয়ে নিয়ে চোখ খুলে তাকাল কুয়াশার দিকে। কুয়াশাও তাকাল চোখ খুলে এবার। লজ্জারা দলা পাকাল এবার৷ শিশির হাসছে মিটমিট করে। হাঁপাচ্ছে সমানতালে দু’জন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে। অনুভূতির জোয়ার দু’জনের সমান৷ শরীরের উত্তপ্ততা দু’জনেই টের পাচ্ছে। কুয়াশার চোখে, ঠোঁটে নজর বুলাতে বুলাতে বলল,

” নাহ্, বউ আমার পারফেক্ট পার্টনার। চুমুতেই বুঝে গেলাম ”
তা শুনে কুয়াশা লজ্জায় লাল হলো। মুখ গুঁজে দিল শিশিরের গলায়৷ শিশির ফিসফিস করে হেসে উঠল। কুয়াশার পিঠ, কোমড়ে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সে কুয়াশাকে আরেকটু জব্দ করতে ফিসফিস করে বলল,
” কুয়াশা..! আ’ম ইমপ্রেসড বাই ইউর রেসপন্স। পারফেক্টলি ভেরি এট্রাক্টিভ ”
কুয়াশা আবার কেঁপে উঠল। মুখ গুঁজে রেখেই বলল,
” চুপ করো.. আমি লজ্জা পাচ্ছি ”
শিশির এবার জোরে জোরে হেসে ফেলল। মুখ ঘুরিয়ে চুমু খেল কুয়াশার মাথায়। বলল,

” আচ্ছা?”
” হুঁ ”
” ঘুমা ”
” ছাড়ো ”
” কেন? ”
” ঘুমাতে বললে!”
” এভাবে ঘুমা। নিচে শানের উপর ঘুমাতে পারবি না৷ আমি নিজেই শুতে পারছি না৷ তুই আরো পারবি না৷ অভ্যাস থাকা লাগে মেঝেতে শোবার ”

বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪০+৪১

কুয়াশা আপ্লূত হলো৷ আরকটু ঝাপটে ধরল শিশিরকে৷ মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল স্বামীর বুকে। আজ এই রাত সরণীয় রাত৷ গ্রামের রোমাঞ্চকর পরিবেশে খোলা আসমানের নিচে স্বামীর থেকে পাওয়া প্রথম প্রণয়ময় চুম্বন সাথে স্বামীর বুকে শুয়ে রাত কাটানোর স্বভাগ্য কয়জনের হয়?
শিশির মনমেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেছে৷ ঠোঁটে তৃপ্তিময় হাসির রেখা। বুকে থাকা মেয়েটা তার নিয়তি। জীবন রাঙিয়ে দিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে না সত্যি জীবন সুন্দর জীবনের রঙ সুন্দর।

বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪৪+৪৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here