বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪৪+৪৫

বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪৪+৪৫
রোজা রহমান

অন্যান্য দিনের থেকে আজ সকালটা যেন অতি রোমাঞ্চকর, মনোমুগ্ধকর। অন্তর জুড়ানো শীতল ফুরফুরে সমীরণ। শরীর শিরশির করছে বাতাসে। চারিদিকে কিচিরমিচির শব্দ তুলে পাখিরা তাদের নীড় ছাড়ছে। ধরণীতে অন্ধকার কেটে আলো ফুটেছে। চারিদিকে পরিষ্কার। গ্রামের সকালটা এত সুন্দর হয়! কোনো সোরগোল নেই শুধু পাখিদের ডাক৷ নিরিবিলি প্রকৃতি।

আলো ফুটতেই কুয়াশার ঘুম হালকা হয়ে এলো। কিছুক্ষণের মাঝে ভেঙেও গেল৷ পিটপিট করে তাকাল। সামনে শিশিরের লোমশ বুক দেখতে পেল। সে এখন শিশিরের কোলের ভেতর। রাতে হয়তো শিশির একপাশে শুইয়ে নিয়েছে। দু’জনেই কাৎ হয়ে শুয়ে। কুয়াশার মাথা শিশিরের বাহুতে। শিশির বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমচ্ছে। একটা বালিশে আর জায়গা হয়নি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কুয়াশা ভালোভাবে দেখল শিশিরের নগ্ন শরীর। হয়তো গরমে শার্ট খুলে ফেলেছে। মাথা তুলে শিশিরকে দেখল৷ মুখটা দেখতেই আনন্দরা, খুশিরা, সুখরা এসে ভিড় জমাল। এই বুকটা অতি শান্তিময় জায়গা। এই বুকে শুয়ে সারাটা জীবন অনায়েসে পাড় করে দেয়া যাবে। সামনে এই ছেলেটা তার পূর্ণতা৷ তার স্বামী, তার জীবনসঙ্গী, তার অর্ধাঙ্গ। প্রণয়ের উতালপাতাল ঢেউ৷ এই ছেলেটাকে দেখলেই এখন সুখ সুখ লাগে সাথে অনুরাগ জাগে। আগে যেমন দেখলে হিংসে আসত সেসব কাজই করে না আর। আচ্ছা কেন করে না হিংসা কাজ? সে এখন তার মনের মানুষ বলে? তার অনুরাগ বলে? তার প্রণয়ের পূর্ণতা বলে? নাকি তিন কবুল বলা অর্ধাঙ্গ বলে! হুঁ এই সমষ্টি জিনিসই বলে আর আগের মতো হিংসাত্মক নজর আসে না মানুষটার প্রতি।

শুধু ভালোবাসা পেতে মন চাই৷ মন চাই এই ছেলেটা তাকে মন উজাড় করে ভালোবাসুক তার বুকে এভাবেই চিরকাল আগলে রাখুক৷ ভেবেই মিষ্টি হাসল৷ মাথা নিচু করে শিশিরের নগ্ন লোমশ বুকে গভীর, গাঢ় করে ঠোঁট ছুঁয়ে চুমু আঁকল৷ নড়ে উঠল শিশির। দুহাতে বউকে সে বন্দি করে রেখেছে।

কুয়াশা আবার মিষ্টি হাসল। মাথা তুলে অনিমেষ অবলোকন করতে থাকল স্বামীকে। রাতের কথা মনে উঠল। শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল৷ শিরশিরে অনুভূতি হলো৷ সেই শিরশিরানি অনুভূতিতে স্বামীর বুকে আরেকটু ঢুকে যেতে চাইল।
শিশির বুকের মাঝে নড়াচড়া পেয়ে ঘুম হালকা করল৷ চোখে প্রকৃতির আলো পড়তেই ঘুম ভাঙল। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ কানে ভেসে এলো। নিজের বাহুতে বুকের মাঝে বউকে অনুভব করল। বিড়াল ছানার মতো করে কাঁচুমাচু করছে। যেন সে জোর করে কোলের ভেতর আঁটকে রেখেছে আর বিড়াল ছানাটা ছু্টতে চাইছে৷

মস্তিষ্ক কথাগুলো ধারণ করতেই চোখ বন্ধ অবস্থায় ঠোঁটে হাসির রেখা আসল৷ ঠোঁট দুটো টানটান হলো হাসিতে৷ আপন হাতে আরেকটু শক্ত করল বাহুবন্ধনী। সে-ও যেন তার ঝগড়ুটে, আহ্লাদী, বিড়াল ছানা বউটাকে আরেকটু ঢুকিয়ে আগলে নিতে চাইল বুকের মাঝে। এইটা তার প্রাপ্তি, তার পূর্ণতা, তার অর্ধাঙ্গনী, তার সুখ। পরিবারের সকলে সত্যি জীবন সাজিয়ে দিয়েছে। এর থেকে আপনময়, সুখময়, রঙিনময় অনুভূতি আর দু’টো হয়! উহু হয় না। বড্ড আপনময় অনুভূতি।

আসলে এ দু’জনের এত জলদি প্রণয়ের টান বোঝা শুধু আর শুধু মাত্র একে ওপরের প্রতি খাঁটি অধিকারবোধের জন্য, তিন কবুলের জোরে, প্রবিত্রতার সম্পর্কের নামে, প্রবিত্রার ছোঁয়াতে। নিজ দায়িত্বে অধিকারবোধ দেখিয়ে প্রণয়ে পরিপূর্ণ করতে পেরেছে। এই বিয়ে নামক বন্ধনে যদি দু’জনে আঁটকা না পড়ত তবে কি প্রণয়ের ছোঁয়া এদের মাঝে এসে হানা দিতে পারত? উহু পারত না। কখনো পারত না। কারণ তারা জনম শত্রু ছিল। আর এখন যে ঝগড়া, চুলোচুলি করে সেটা পুরোটা অভ্যাসে করে। কোনো হিংসে থেকে না। হিংসা তাদের কাজ করে না কারণ সম্পর্কে তাদের নমনীয়তা এসেছে। একে অপরকে ভালোবাসা বলে দাবি করতে শিখেছে। তাদের সম্পর্কে একটা অধিকারবোধের নাম এসেছে। তারা অধিকার খাঁটিয়ে বলতে পারবে তারা স্বামীস্ত্রী। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জোর একটা আল্লাহ প্রদত্ত জোর। আদিম নিয়মের আদিম জোর।

শিশির চোখ খুলে তাকাল৷ মাথা নিচু করে বাহুবন্ধনীতে থাকা বউয়ের দিকে তাকাল৷ বুক থেকে মুখটা সরিয়ে বউয়ের সদ্য ঘুম ভাঙা মুখটাতে নজর দিল। যেটা রোজকার অভ্যাস হয়েছে তার। ঘুম ভেঙে জোরে নিঃশ্বাস টেনে আগে বউয়ের গলার মধ্যভাগের সুবাস নেবে এরপর মুখ অবলোকন করবে৷ শিশিরের নড়াচড়া টের পেয়ে কুয়াশা মুখ তুলে তাকাল। নজরে নজর পড়ল। কুয়াশার বুক ধুক করে উঠল। নতুন নতুন প্রণয়ের সঙ্গী তো এই মানুষটা-ই! যা এতগুলো বছরে কেউ দখল করতে পারেনি।
শিশির মুচকি হাসল। সালাম দিল বউকে। কুয়াশাও সালাম নিয়ে সালাম দিল। বউয়ের সালামের জবাব দিয়ে মুচকি হেসে ললাটে অধর চুম্বন করল বউয়ের৷ এরপর জিজ্ঞেস করল,

” সারারাত যে আমর শরীরের উপর রাজ করে রাত কাবার করলি। তা রাণীসাহেবার ঘুম কেমন হলো এই রাজার রাজমহলে? ”
কুয়াশা খিলখিল করে হেসে ফেলল তা শুনে। দাম্ভিকতার সাথে উত্তর করল,
” যে রাজা সর্বদা তার রাণীকে বুকে আগলে রাখে সে রাণীর ঘুমটাও কি খারাপ হতে পারে? ”
মুচকি এবং প্রশান্তিময় হাসি ফুটল ঠোঁটে। হাসল কুয়াশাও অমায়িক। বলল,
” ছাড়ো, অনেক সকাল হয়ে গেছে ”
শিশির শুনে হাতের বাঁধন আলগা করে দিল। কুয়াশা এবার উঠে বসল৷ আজ কাজা নামাজ আদায় করতে হবে দুপুরে৷ ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল৷ শিশিরের বাম হাতটা অবস হয়ে গেছে। তাই ঝাড়া দিতে লাগল৷ কুয়াশা দেখে বলল,

” বালিশ দিতে পারতে ”
” একটা বালিশে হত না ”
কুয়াশা কিছু বলল না আর। বলল,
” লজ্জা করছে আমার। বাহিরে যাব কি করে?”
শিশির নজর তুলে তাকাল কুয়াশার চোখের দিকে। তাকিয়ে থেকে বলল,
” তুই আগে চলে যা। আমি বালিশ নিয়ে আসব। সমস্যা হবে না। আর এত লজ্জারই বা কি আছে? অদ্ভুত!! আমি কি তোর বয়ফ্রেন্ড? স্বামী তোর। ”
” তবুও বড়দের সামনে পড়লে লজ্জা পাব। ঘর রেখে ছাদে শুতে এসেছ। তোমার তো আবার শখ জেগেছিল। শখেরও বলিহারি। ”

বলে উঠে পড়ল। ফোন, ওড়না তুলে নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে ধাপধুপ করে পা ফেলে স্থান ত্যাগ করল। দরজা খুলতেই সকলের কথার সোরগোল শোনা গেল। সকলে উঠে গেছে! ইশশ কী লজ্জা জনক পরিস্থিতি! সে সিঁড়ির উপর থেকে শশীকে কল করে এক মিনিটের মধ্যে সিঁড়িঘরের কাছে আসতে বলল। যাতে লজ্জাটা কম হয়। দেখলেও যেন কোনো প্রশ্নের মুখে না পড়া লাগে। হাজার স্বামী হোক। বড়দের কাছে অতি লজ্জাজনক এটা।
এদিকে শিশির আহাম্মকের মতো বউয়ের ঝাঁঝ ওয়ালা বাণী গিলল।
যাক বাবা! যার জন্য সারারাত চুরি করল সেই চোর বলে গেল? বুকে শুয়ে রাত কাটাল এখন সেই ঝাঁঝ নিয়ে বলে গেল! এই বউজাতিগুলো বড় অদ্ভুত! সারাজীবন সংসার করেও বোধহয় মন বুঝতে পারবে না। ভেবে বিড়বিড়াল সে,

” গিরগিটি একটা।”
বলে পাশে থেকে শার্ট তুলে নিয়ে গায়ে জড়াল। বোতাম লাগাতে লাগাতে মিষ্টি পরিবেশটা অনুভব করল। শীতল বাতাসটা অতিশয় মিষ্টি লাগছে। খোলা আসমানের নিচে শুয়ে, বসে রাত, সকাল অনুভব করল। ইশশ কী রোমাঞ্চকর অনুভূতি!! ভেবেই হাসল৷ আল্লাহর কাছে দোয়া চাইল ভবিষ্যতের দিন গুলো যেন এর থেকে সুখময় হয়।

সকাল নয়টা। সকলকে খেতে ডাকা হয়েছে। সকালের জন্য হালকা পাতলা নাস্তার আয়োজন করা হয়েছে। ভাত করে নি৷ রুটি, পরেটা, আলু ভাজি, ডিম ভাজি মাংস রান্না ছিল সেটা জ্বলানো হয়েছে। রাতের মতো করে আবার পাটি বিছানো হয়েছে। একে একে সকলে এসে খেতে বসল। শিশির এলো। সে নিচে নেমে গোসল করে নিয়েছে। শরীরে কেমন ঘামে চিপচিপে ভাব লাগছিল এছাড়া ধুলোও লেগেছিল আর তার থেকে বড় কথা নিজের কাছে কেমন কেমন যেন লাগছিল। রাতের কথা ভেবে গোসলই করে নিয়েছে। সকলে বসতেই খাবার দিল জিনিয়ারা। শিশিরের সাথে চোখাচোখি হলো কুয়াশার।
এদিকে রিজভীরা মিটমিট করে হাসছে। নীহার শিশিরকে দেখছে, খাচ্ছে আর হাসছে। শশী কুয়াশার পাশে বসেছে। অন্যপাশে স্মৃতি। কুয়াশা সকলের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই বিচ্ছুবাহিনীরা সকলেই টের পেয়ে গেছে সে ঘরে ছিল না।
শিশির নীহারের হাবভাব দেখে ভ্রু কুঁচকাল৷ বলল,

” কিছু বলবি?”
” বুঝলি কি করে?”
” তুই যে একটা ফাজিল তা আমার থেকে ভালো কে জানে? ”
নীহার দাঁত কেলাল শব্দহীন৷ তারা ফিসফিস করে কথা বলছে। শিশিরের আরেকপাশে রিজভী বসা৷ নীহারের পাশে শান্ত। নীহার বলল,
” বলেছিলাম না? এবার ঠোঁটে কামড় কনফার্ম খাচ্ছিস! আমার কথা ফলে গেছে। তোর ঠোঁটে কামড় খাওয়া ডান। মিষ্টি বিলা। ”
শিশির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল৷ রাতের কথা মনে হলো৷ কুয়াশা তো কামড় দিয়েছিল! সেটার কথা এরা জানল কি করে? কেটে টেটে গেছে নাকি? কই সে তো কিছু বুঝল না? আবার দেখলও না! ভড়কানো কন্ঠে বলল,

” কী যা তা বলছিস? ”
পাশে থেকে রিজভী মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” আমিও স্পষ্ট দেখতে পারছি দোস্ত। তোর ঠোঁট কাটা।”
আরো ভ্যাবাচ্যাকা খেল শিশির। কী একটা জ্বালা! এদের জন্য একটু রোমান্স করেও শান্তি নেই। ঈগলের মতো সব টের পেয়ে যায়। ঐ বে-য়াদবটার জন্য সবসময় এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। বে-য়াদবটাকে আস্তে দিলাম উল্টে সে আবার জোরে দিল। ভেবে কুয়াশার দিকে কিড়মিড় করতে করতে কটমট নজরে তাকাল। কুয়াশা ভ্রু কুঁচকাল।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে সকলে বিশ্রাম নিতে বসল। বড়রা অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে দিল। রান্না বান্নার জন্য একটা লোক আনা হলো। কারণ মানুষ বেশি না হলেও আবার কমও না। এতগুলো মানুষের রান্না বাড়ির লোক দিয়ে করা সম্ভব হবে না। তাই হানিফ সাহেব বাবুর্চি আনলেন। বাড়ির উঠানে আয়োজন করলেন রান্নার। জিনিয়া, সৌরজ, মিহির, শশীর ভাবি সিমী সকলে সাহায্য করছে৷

দুপুর বারটা৷ শশীকে কুয়াশারা গোসল করিয়ে তৈরি করছে৷ শাড়ি পরানো হচ্ছে শশীকে৷ অনুষ্ঠান নামাজ পর শুরু হবে। কুয়াশারাও গোসল করে নিয়েছে। এক ঘরে তৈরি হচ্ছে সব। শশীর কাজিনরা চাচারা সকলেই এসেছে। কাজিনরাও এসে কুয়াশাদের সাথে যোগ দিয়েছে। পাড়ার কিছু মহিলারা সকাল থেকে এসে বার বার ঘুরপাক পাড়ছে৷ গ্রামের মানুষ বলে কথা৷ তারা সব বিষয়েই কৌতূহল বেশি দেখায়।
সাড়ে বারটার দিকে আজান দিলে বড় থেকে ছোট সকল ছেলেরা গোসল করে জুম্মার নামাজে চলে গেল৷
কুয়াশা আজ শাড়ি পরেছে। গাঢ় সবুজ রঙের সিল্ক-জামদানি শাড়ি। অসম্ভব সুন্দর শাড়িটা। অল্প কিছু জায়গায় কালো রঙের কাজ করা৷ ঈশা, স্মৃতিও শাড়ি পরেছে। বৃষ্টি, ইয়াসমিনও পরেছে। খুব বেশি গর্জিয়াস কেউ সাজেনি আবার ড্রেসআপও কেউ গর্জিয়াস পরেনি। সবটায় সিম্পল। অনুষ্ঠান অনুযায়ী সকলের সাজগোজ সহ আয়োজন।

নামাজ শেষ করে সকলে চলে এসেছে। আয়োজনও জমজমাট হয়ে গেছে। শশীকে সুন্দর একটা লাল শাড়ি পরানো হয়েছে। হালকা মেকাআপ সাথে সিম্পল কিছু জুয়েলারী। মায়াবী শ্যামবর্ণা মুখটা অপূর্ব লাগছে৷ গোলগাল বাচ্চা সুলভ মুখশ্রী যে দেখবে সেই মাশাআল্লাহ বলবে। চিকন ফিনফিনে শরীরটা এখনো গায়ে বাড়ল না। বড় বড় ডাগর আঁখি গুলো কাজলে রাঙানো। সকলে শশীকে তৈরি করার পর একসাথে বলে উঠল,
” মাশাআল্লাহ। ”
শশীর লজ্জায় চিবুক বুকের সাথে নূয়ে গেল। কিছুক্ষণ মেয়েরা ঘরে বসে গল্প করল৷

শিশিররা সকলে মিহিরের ঘরে বসে আছে৷ কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান। ওরা পাঞ্জাবি, পাজামা পরেছে৷ শিশিরের পরনে কালো রঙের পাঞ্জাবি। নীহার সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। উপস্থিত সকল ছেলেকে আকর্ষনীয় লাগছে।
দুপুর তিনটা বেজে গেছে। জাকির মালিথা, জাহিদ মালিথা, হানিফ সাহেব অনুষ্ঠান শুরু করার কথা জানালেন৷ নীহারদের ডাকা হলো। শিশির মুচকি হেসে নীহারের হাত ধরল। এরপর নিয়ে এগুলো ডাইনিং রুমের দিকে। ঘরটা বড় সেখানেই এক সাইটে সোফা দিয়ে, চেয়ার দিয়ে বসার আয়োজন হয়েছে৷ নীহাররা বাবাদের পাশে গিয়ে বসল। একটুপর শশীকে আনা হলো। শশীরা ঘর থেকে বেড়িয়ে সেখানে পা দিতেই সকলে অপলক চাইল। শিশিররা তো হা ই হয়ে গেছে তাদের এক একজনের বউ, প্রেমিকা, হবুবউকে দেখে। সকলে শাড়ি পড়েছে। মনে হচ্ছে কয়েকটা পরী আসমান থেকে জমিনে নেমে এসেছে। শান্ত তো শশীর একটা চাচতো বোনের উপর পিছলাই খেল৷ মেয়েটা শশীর মতো চিকনচাকন। কিন্তু শশীর দেড় বছরের বড় নাম শোভা৷ মেয়েটা সুন্দরী নিঃসন্দেহে।
শিশির হা করে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। গাঢ় সবুজে পুরোই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। আপন মন বলে উঠল,

” ইশশ বউটা আমার সত্যি অপূর্ব অপ্সরা। কী অপূর্ব লাগছে!! ”
শশীকে দেখে নীহার তাকিয়েই রইল৷ লাল শাড়িতে কী দারুন লাগছে! আজই বিয়ে করে ফেলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু খারুজ শ্বশুরটা আবার শর্ত জুড়ে রেখেছে। ভেবেই বিরক্ত হলো নীহার। রিজভী স্মৃতিকে দেখে পুরোই হা৷ লাগছে কখন মাছি ঢুকে যাবে৷ শিশির গুঁতো দিয়ে আস্তে করে বলল,
” হা বন্ধ কর বেদ্দপ, মাছি ঢুকে যাবে। ”
” দোস্ত আমি বিয়ে করব। ”

শিশিরের ফিসফিস করে বলেছিল কিন্তু রিজভী একটু জোরেই বলে ফেলেছে কথাটা৷ প্রায় অনেকেই শুনে নিয়েছে। শুনেই সকলে দম ফাটা হাসিতে মত্ত হলো। স্মৃতিরা অবশ্য শুনে নি তাই হাসির কারণটা অজানা তাদের। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল সব। ঈশা, বৃষ্টি, ইয়াসমিনকেও অসম্ভব সুন্দরী লাগছে৷ মিহির ঈশাকে এভাবে শাড়িতে দেখে আরো মুগ্ধ হলো। ছেলেটার অনুভূতিকে পাত্তা দেয় না এই মেয়ে৷ নাহ্ এর একটা বিহিত করতেই হবে। ভাবল মিহির৷
শশীকে নীহারের পাশে বসানো হলো। মেয়েটা লজ্জায়, উত্তেজনায় কাঁপছে। সাথে নার্ভাসনেস তো আছেই। সব মিলে রীতিমতো তার হাইপোথার্মিয়া হয়ে যাচ্ছে। এত পরিমাণে কাঁপছে! নীহার বোধহয় টের পেল শশীর উত্তেজনা। মনে মনে হাসল সে। কিন্তু সকলের সামনে কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল পাশে থাকা হুবু বউয়ের দিকে।
জাকিয়ার কথা অনুযায়ী নীহার শশীর আঙুলে আঙটি পরানোর জন্য হাতটা তুলে নিল। কিন্তু অতিরিক্ত পরিমাণে মেয়েটা কাঁপছে। বুঝে শশীর হাতটা শক্ত হাতে শক্ত করে ধরল আশ্বাস দিতে। মৃদু ফিসফিস করে বলল,

” শশী! নিজেকে সামলাও। আমি আছি তো।”
শশী একটু শান্ত হলো এই কথাটুকুতে। হাসল নীহার তা বুঝে। এরপর আঙটি পড়িয়ে দিল নীহার৷ হানিফ সাহেবও নীহারের জন্য আঙটি বানিয়েছেন। সেটা শশী পড়িয়ে দিল৷ মেয়েটার চোখ ছলছল করছে। আনন্দে, উত্তেজনায়। নীহার তা দেখে মুচকি হাসল। চোখের ভাষায় সব বুঝিয়ে দিল। আজ থেকে সে তার নামে করা। এখন শুধু তিন কবুল বলে ঘরে তোলা বাকি। তার ইঁচড়েপাকাকে তার নামে নামকরণ করে ফেলেছে। শশীর কী যেন হলো নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারল না। কেঁদে দিল শব্দ করে। সকলে হতভম্ব হয়ে গেল। কুয়াশারা তড়িঘড়ি করে শশীর কাছে এসে থামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু মেয়েটার কান্নার জের বাড়ল বয়ে কমল না। নীহার এবার না পেরে হানিফ সাহেবের উদ্দেশ্য করে বলল,

” খালু, শশীর সাথে আমি একটু একা কথা বলতে পারব? ”
এরপর মায়ের উদ্দেশ্য বলল,
” আম্মু?”
জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” বড়আম্মু? ”
বড়রা বুঝল মেয়েটাকে থামাতে এখন নীহারই পারবে। তারা শশীর কান্নার কারণটা বুঝেছে এও বুঝল এদের একটু একা কথা বলতে দেয়াও উচিত। নিজেদের আনন্দটাকে একটু নিজেদের মতো উপভোগ করুক। ভেবে জাকিয়া, জিনিয়ার দিকে তাকালেন এরপর জাকির মালিথার দিকে তাকালেন। দু’জনই সম্মতি দিলেন৷ জাকিয়া মুচকি হেসে বললেন,

” যাহ্ থামিয়ে আন।”
নীহার মুচকি হাসল। শশীর হাত শক্ত করে ধরে সেখান থেকে উঠে চলে এলো শশীর ঘরে। সকলে মুচকি হাসল। ছেলে মেয়েগুলো সব হয়েছে পাগল।
শশীর ঘরে এসে দরজা ভিড়িয়ে দিল। এরপর বিছানায় শশীকে বসিয়ে দিল। নিজেও পাশে বসল। কান্না করেই যাচ্ছে ফুঁপিয়ে। তা দেখল কিছুক্ষণ নীহার৷ দেখল আর মিটমিট করে হাসল। দু’হাতে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
” এটা তো দেখি হাই লেভেলের ইঁচড়েপাকা। এভাবে আমার সাথে একা সময় কাঁটানোর জন্য কাঁদলে? নাকি কোনো ড্রামা,সিরিয়ালে দেখেছ এমনটা? ”

শশী এবার নীহারকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল। আবার কেঁদে দিল। নীহার নিঃশব্দে হাসল। মেয়েটা ছোট হলেও অনুভূতিগুলো ছোট না। সব বুঝে। পাকনা একটা। ভেবে আবার ঠোঁটে হাসি ফুটাল। সে-ও মেয়েটাকে আলত হাতে আগলে নিল। শশী বলল,
” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এসব৷ সত্যি আমি আপনাকে পেতে চলেছি? আপনার বউ হব আমি? আমার স্বপ্ন পূরণ হবে? ”
কতটা পাগল ভাবা যায়? নীহার হেসে বলল,
” হ্যাঁ রে পাগলী তুই আমার হতে চলেছিস। আমার বউ হতে চলেছিস৷ তুই আমার নামে লিখিত এখন শুধু তিন কবুল বলা বাকি। ”

শশী আবার কেঁদে দিল নীহারের কথা শুনে৷ শক্ত হাতে গলা জড়িয়ে ধরে রাখল৷বলল,
” আমাদের সম্পর্কের নামকরণ হলো আজ৷ তুমি আমার হবু বউ। এখন থেকে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে আমি তোমার হবু স্বামী, বুঝেছ ইঁচড়েপাকা মেয়ে? ”
কথাগুলো বলতে বলতে নীহার শশীকে তুলল৷ এরপর চোখ মুছিয়ে দিল৷ কপালে চুমু খেল৷ নাকে নাক ঘষে বলল,
” কী অপূর্ব লাগছে আমার না হওয়া বউটাকে! আর কেঁদে সব নষ্ট করে দিলে?”
লজ্জা পেল শশী। হাসল নীহার। বলল,
” আর কেঁদো না মেয়ে। খুব জলদি দু’বছর কেঁটে যাবে। ইনশাআল্লাহ দু’বছর পর আমার ঘরে বউ করে নিয়ে যাব। ”
শশী কোনো উত্তর করল না। শুধু আনন্দে আটখানা হলো। মুচকি হাসল৷ মাথা নূয়ে রাখল৷ নীহার অপলক, অনিমেষ অবলোকন করল শশীকে। শক্ত করে হাতের ফাঁকে হাতে গলিয়ে দিয়ে উঠে আবার ডাইনিং রুমে চলে গেল৷
সকলে খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকাল তখন চারটা বেজে পাড়। খাওয়া দাওয়া করে সকলে বিশ্রাম নিল টুকটাক গল্প করার মাধ্যমে।

বেলা গোধূলি লগ্নে। সূর্য ডুবে ধরণী লালাভ রঙ ধারণ করেছে। কিছুক্ষণ পরে সন্ধ্যা নামবে। গ্রামে এই সময়টা অসম্ভব মিষ্টি হয় দেখতে। তেমনি আজও মিষ্টি লাগছে। শিশিররা সকলে ছাদে সেসবই উপভোগ করছে। তারা আশেপাশে ঘুরতে যাবার প্ল্যান করেছিল আজ কিন্তু ক্লান্ত লাগছে বলে কাল যাবে ঠিক করেছে। এই গোধূলি বেলাটা ছাদে কাটাচ্ছে সকলে। শশীর ভাবিও যোগ দিয়েছে আজ৷ তুষার, তুহিন সৌরজের সাথে গেছে হাঁটতে।
একপাশে মেয়েরা একপাশে ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছে। দাঁড়িয়েই আছে কেউ, কেউ চেয়ারে বসা তো কেউ রেলিঙের উপর বসা। এমনই সময়ে শিশিরদের আড্ডার মাঝে নীহার পাশ থেকে শিশিরের কাঁধের উপর হাত দিয়ে ডাকল,

” শিশির..!”
শিশির উত্তরে তাকালে সে বলল,
” ভালোবাসতে পেরেছিস? ”
শিশির কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করল৷ রিজভী, শান্ত, মিহির, হিম তাকিয়ে আছে। ওদের কথোপকথন শুনছে৷ শিশির বুঝল সময় নিয়ে। মুচকি হাসল বুঝতে পেরে। তার পরিবার যে তাদের দু’জনকে নিয়ে চিন্তা করে সেটা ভালোই বুঝতে পারে৷ শিশির মুচকি হেসে মাথা উপর নিচে করল,
” হুঁ। ”

বলে নীহারকে জড়িয়ে ধরল। নীহার আনন্দ পেল খুব৷ ভাইকে আগলে ধরল৷ তাদের বিশ্বাস ছিল এরা পারবে মানিয়ে নিতে। সময় নিয়ে ঠিকই মানিয়ে নিয়ে ভালোবাসতে পেরেছে। তাও এত জলদি? নীহার বলল,
” এত জলদি কিভাবে? বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার। ”
শিশির ছেড়ে দিয়ে বলল,
” ভালোবাসার জন্য অনেক কারণ দিয়েছে তোর বোন। বউ হিসেবে খারাপ না। ”
নীহার মুচকি হাসল। বলল,
” বলেছিলাম না? ”
” হুঁ, ওর প্রতি আমার নমনীয়তা ছিল না৷ যার জন্য ওর উগ্রস্বভাব আমার কাছে আটকে ছিল। তবে এখনো অভ্যাস রয়ে গেছে। সেদিনও মেরেছে জানিস? ”
নীহার সহ রিজভীরাও হেসে দিল। নীহার বলল,

” ওর মনের মানুষ হতে পেরেছিস? ”
” হ্যাঁ পেরেছি। তোর বোন সবটাতেই ফাস্ট বুঝলি৷ ভালোও সে আগে বেসেছে। আমিই লেট করেছি”
প্রশান্তিময় হাসল৷ বলল,
” সুখী থাকবি সবসময়। বোন দিয়েছি যত্ন করবি। আমাদের একমাত্র আদর ও ”
শিশির ভাইকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল,
“জীবন সুন্দর ভাই, জীবনের রঙ সুন্দর।
পরিবার কখনো খারাপ চাই না ভাই। আর আমাদের পরিবার তো আরোই না৷ ”
নীহার আগলে ধরে বলল,
” হুঁ, আওয়ার ফেমিলি ইজ দ্যা বেস্ট ফেমিলি ইন দ্যা ওয়াল্ড। ”
সকলে হাসল। হিম বলল,
” পারমানেন্টলি তাহলে দুলাভাই হয়ে গেছ তো? এখন ডাকতে পারব দুলাভাই বলে?”
শিশির হিমকে বগলদাবা করে মেকি রাগ নিয়ে বলল,
” শা-লাবাবু বেশি পেকে গেছিস? নাকানিচুবানি সকলকে ভালোই দিতে পারিস। ”
সকলে হেসে ফেলল। হিমও দাঁত বের করে হাসল।

সন্ধ্যা শেষ হয়ে বেশ অনেকটায় রাত হয়ে গেছে। রাতের খাবার খাওয়া দাওয়ার পার্ট সবেই শেষ হয়েছে। এখানে কারোরি তেমন কাজ নেই এক বসে থাকা ছাড়া আর গল্প করা ছাড়া। তো সকলের এখন ব্যস্ততাও নেই তাই গল্প করছে। এরই মাঝে নয়টার দিকে কারন্ট চলে গেল। অতিরিক্ত গরম তারউপর কারেন্ট গেলে কি আর ঘরে থাকা যায়? তাই কেউ আর ঘরে থাকল না৷ উঠান সহ ছাদে চলে গেল৷
ছোটরা ছাদেই এসেছে। রিজভী স্মৃতিকে নিয়ে দূরে একপাশে টেনে এনেছে। এই পর্যন্ত এখানে এসে বেচারা রিজভী তার প্রেয়সীটার সাথে একা কথা বলার সুযোগই পাচ্ছে না৷ সকলে ওদের কথা যানে তাই কেউ সেসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করল না। অন্যরা অন্যদিকে আড্ডাতে মগ্ন। এদিকে স্মৃতি, রিজভী প্রেম করতে মগ্ন।

” এটা কি হলো? ”
” কি হলো?”
স্মৃতির কথার গা ছাড়া জবাব রিজভীর৷ স্মৃতি ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। এ যে পাক্কা শিশিরের মতো স্বভাবা সেটা বুঝে গেছে এতদিনে। বলল,
” সকলের মাঝে থেকে টেনে আনলেন, কী ভাবল ওরা? ”
” কি ভাববে? আমি আমার রসমালাইকে এনেছি এতে কে কি ভাববে?”
স্মৃতি জমে গেল। এই একটা ডাক সে প্রথমদিন শুনেছিল যেদিন রিজভী ও’কে প্রেম নিবেদন করেছিল। এখনো মনে পড়লে হাসি আসে স্মৃতির সাথে লজ্জা তো আছে! শিশির কুয়াশার বিয়ের রাতে ছাদের ডেকেছিল রিজভী। সেখানে গেলে রিজভী অকপটে বলে দিয়েছিল,

” এ্যাই রসমালাই শুনো! তোমাকে আমার ভালো লাগে। ভালোবাসতে চাই তোমাকে। এটার সুযোগ করে দাও। এত জলদি দিতে হবে না। আগে নিজের মনের ঘরে আমার জন্য জায়গা করো এরপর সুযোগ দাও। আমি অপেক্ষা করব প্রবেশ করার জন্য। কিন্তু জায়গা তোমার করতেই হবে, বারণ, মানা শুনব না৷”
স্মৃতি যদিও পছন্দ করার কথা শুনেছিল কিন্তু সেদিন এমন কথা শুনে সে লজ্জায় মরি মরি হয়েছিল। মেয়েটা শান্ত প্রকৃতির৷ কুয়াশার মতো দূরন্তপনা নেই৷ স্মৃতি সেদিন সবটা জানিয়েছিল রিজভীকে৷ কুয়াশার ক্রাশ খাওয়া থেকে শিশিরের কথা সব বলেছিল। সব শুনে রিজভী দম ফাটা হাসিতে মত্ত হয়েছিল। এরপর স্মৃতি সময় চেয়েছিল। সময় রিজভী দিয়েছিল। কিন্তু খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি রিজভীর। ওদের রিলেশনে আসাও প্রায় দেড় মাস হয়ে এসেছে। স্মৃতি বলল,

” হুঁ, আপনার তো শুধু এক ডায়লগ, ‘আমার রসমালাই’ কবে না সুগার হয়ে যায় আপনার।”
রিজভী শুনে জোরে জোরে হেসে দিল। বলল,
” তুমিও এটা বললে? এমনটা শিশিরও বলেছিল। ”
একটু থেমে স্মৃতিকে কাছে টেনে নিল। কেঁপে উঠল স্মৃতি। এই পর্যন্ত রিজভী তার হাতটাও ধরেনি। শুধু বাইকে উঠলে যতটুকু কাছে যাওয়ায়াওয়ি হয়। রিজভী স্মৃতির কোমড়ে হাত রাখল৷ আরেকটু টেনে নিল। যেটাতে স্মৃতি আরো জমে গেল। ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,
” কি করছেন? ”
” হুঁশশ, সুগার হবে না আমার। কারণ এখনো রসমালাই টেস্টই করেই দেখিনি আমি। খেলে তো সুগার হবে আমার? ”
স্মৃতি আরো বরফ হয়ে গেল।রিজভীর এমন লাগাম ছাড়া কথা শুনে৷ নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেল। মাঝে মাঝে এমন লাগাম ছাড়া কথা ফোনে বলে রিজভী৷ রিজভী স্মৃতির অবস্থা টের পেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে ঠোঁট টিপে। আবছা আলোয় দু’জন দু’জনের অনেক কাছাকাছি। স্মৃতি নজর ঝুঁকিয়ে রেখেছে। দুই হাত রিজভীর বুকে। সে আবার বলল,
” তবে বিয়ের পর হলেও হতে পারে। সুগাররর.. ”
শেষ শব্দটা টেনে বলল সে। তা শুনে আরো নূয়ে গেল স্মৃতি। রিজভী মিটমিট করে হাসছে। সে আগের ন্যায় আবার বলল,

” তবে এখন টেস্ট করে দেখল কী সমস্যা হবে? নাকি একটু ছুঁয়ে দেখব? ”
স্মৃতি কথার মর্মার্থ ধরে ফেলেছে৷ আর সেটা বুঝেই নূয়ে গেল আরো। কেঁপে উঠল সর্ব শরীর৷ স্মৃতি কিছু বলতে যাবে রিজভী আবার বলল,
” তুমি যেটা বলবে সেটা করব। বলো কোনটা করব! টেস্ট করব নাকি ছুঁয়ে দেখব? ”
স্মৃতি এবার হতভম্ব হয়ে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
” নাহ্… এখন কিছুই করতে হবে না৷ ছাড়েন৷ কী লাগাম ছাড়া সব কথা বার্তা বলেন আপনি! ”
রিজভী ফিসফিস করে হেসে ফেলল। এটা সত্যি রসমালাই। মন চায় টুপ করে ধরে গিলে খেয়ে ফেলতে। সে এবার দুষ্টুমি করে বলল,

” কিন্তু আমি তো যে কোনো একটা কিছু করবই! টেস্ট না করি ছুঁয়ে তো দেখবই আমার স্বাধের রসমালাই।”
বলে স্মৃতির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে চুমু আঁকল। আবার কেঁপে উঠল স্মৃতি। তবে মনে আনন্দ অনুভূতির সঞ্চার ঘটল। লজ্জাময় হাসি ফুটল ঠোঁট। রিজভীর বুকের উপরের শার্টটা মুঠো পাকিয়ে ধরল। রিজভী চুমু দিয়ে তাকাল তার রসমালাইয়ের দিকে। লজ্জায় নূয়ে পড়েছে একেবারে। হাসল রিজভী। মেয়েটা অতিরিক্ত লজ্জাবতী, নরম সরম। স্মৃতি এবার নিজে থেকে রিজভীর বুকে মাথা রাখল, পিঠে হাত রাখল। আলত হাতে জড়িয়ে ধরল। রিজভী বুঝে খুশি হলো। সে-ও স্মৃতিকে আরেকটুখানি আগলে নিল।

রাত প্রায় এগারোটা। কারেন্ট চলে এসেছে৷ নীহার জানাল নিচে যাবে। ক্লান্ত লাগছে শুবে সে। কথা শুনে শিশির কুয়াশার দিকে তাকাল। কুয়াশা ভেঙচি কাটল। সে নিচে যেতে প্রস্তুত৷ বলল,
” ভাইয়া আমার ঘুম লাগছে। আমি গেলাম তোমরা থাকো।”
বলে যেই হাঁটা ধরবে ওমনি শিশির খপ করে হাত পেড়ে ধরে। শক্ত করে ধরেছে। মনে হচ্ছে হাতটা আজ ভেঙে দেবে৷ কুয়াশা ব্যথা পেল৷ শিশিরের দিকে তাকাল সে কটমট নজরে তাকাল৷ বলল,
” এ্যাই! এভাবে হাত ভাঙতে চাইছ কেন আমার? ছাড়ো..!”
এদিকে সবই দেখল সকলে বুঝলও। হেসে ফেলল সব৷ লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে কুয়াশার। এই লোকটার না হয় হায়া ,লজ্জা কিছুই নেই, তাই বলে কী তারও নেই! বৃষ্টি বলল,
” কুশু, তোমার বউ পাগল বরমশাইর ঘুম হবে না তোমাকে ছাড়া৷ তাকে সঙ্গ দাও। আমরা গেলাম। ”
কুয়াশা এবার লজ্জা তো পেলই আবার বেজায় রেগেও গেল। শিশিরের হাতে খামচি দিয়ে ধরল এবার কটমট করতে করতে বলল,

” ছাড়ো…!”
” চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক বেয়াদব।”
দাঁতে দাঁত চেপে বলল শিশির। ছাড়ল না সে। নীহার বলল,
” হুঁ ভাবি, কে জানি বিয়ে না করতে চেয়ে ধর্মঘট করেছিল। আর এখন দেখো, রাতে আবার একাও থাকতে চায় না। নাটকবাজ একটা! ”
শেষ কথাটা কিড়মিড় করে বলল নীহার। শিশির শুনে বলল,
” এ্যাই রাজ-কারের বংশধর! বেশি না বুঝে যা তোহ্। থাকব না আমি বউ ছাড়া শুনেছিস? যাহ্ এবার সব কয়টা দূর হ তোহ্! ”
সকলে শুনে দম ফাটা হাসি হাসল। কুয়াশা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। কতটা নির্লজ্জ চিন্তা করা যায়? ভাগ্যিস তুষার ভাই, তুহিন ভাই নেই৷ তা না হলে এখানে লজ্জায় ঢুকে যেতে ইচ্ছে করত৷
শিশির এবার শশীর উদ্দেশ্যে বলল,
” শশী কালকের মতো বালিশ আর, কয়েল দিয়ে যাবি। আর তার আগে তোর এই ফাজিলটাকে নিয়ে বিদেয় হ, যাহ্! ঈগলটা জ্বালিয়ে খেল জীবনডা আমার। ”
সকলে আবার হাসল। নীহার দুষ্টুমি করে বলল,
” ঈগল উপাধি যখন দিয়েই দিলি তবে কাল সকালের জন্য আবার অপেক্ষায় রইলাম। আমার চোক্ষু জোড়া তোমারো প্রতীক্ষাতে রহিবে… ”

কতটা ঠোঁটকাটা চিন্তা করা যায়! নীহার সুর ধরে শেষ কথাটা বলল। শিশির কটমট করে তাকাল। কুয়াশা কিছু অবশ্য বুঝল না। কিন্তু যারা বুঝল তারা জোরে হেসে দিল। এরপর আর কী করার? সকলে নেমে গেল একে একে। ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে হাসতে। এবার যেই না ছাদ ফাঁকা হয়ে গেল ওমনি কুয়াশা শিশিরের উপর হামলে পড়ল৷ শিশির যেই হাতটা ধরে রেখেছে সেটা ধরা-ই আছে অন্য হাতে এলোপাতাড়ি চাপ্পড় সহ চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার পণ করল শিশিরের। আর একেরপর এক বলতে লাগল,
” বেয়াদব, অসভ্য, ফাজিল খচ্চর লোক এ্যাই তোর লজ্জা করল না? এতগুলো মানুষের সামনে বউকে নিয়ে থাকবি বলে হাত ধরে রাখতে? ছিঃহ্ আমার তো লজ্জায় জীবন যাচ্ছে। তুই বউ পাগল হয়ে গেছিস শয়তান বেটা।”
বলতে বলতে শিশিরের চুল গুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলছে৷ শিশির কিছু বলল না৷ শুধু হেসে গেল দাঁত বের করে। কুয়াশা এবার হাসি দেখে আরো ক্ষেপে উঠল। ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে শিশিরের শার্টের কলার টেনে ধরল। ঝুঁকিয়ে নিল শিশিরকে৷ চোখে চোখ রাখল আগুণ ঝড়া। অ’গ্নি শিখার মতো চোখ করেছে। রাগে ফুঁসছে সে৷ শিশির মিটমিট করে হাসছে৷ কুয়াশা বলল,

” খুব মজা লাগছে নাহ্? ইশশ কাল সকলের সামনে যেতেই পারব না আমি। এমনি আজ সকলে টের পেয়ে গেছিল বলে সকলের থেকে আমি দূরে দূরে ছিলাম। ”
শিশির এবার কুয়াশার কোমড় ধরে উঁচু করে রেলিঙের উপর বসিয়ে দিল৷ নিজে একদম কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল৷ দু’হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরল। এরপর হাসি হাসি মুখ করেই বলল,

” তুই কি জানিস আমার এই কাজে তোর বাড়ির লোক কতটা খুশি হয়েছে? তারা চায় আমরা সব জলদি মেনে নিই। জলদি সব ঠিক করে ফেলি। হ্যাঁ লজ্জা তোর লাগতেই পারে, কিন্তু এতে অনেক খুশি হয়েছে ওরা। আমরা একে ওপরকে মানতে শিখে গেছি, একে ওপরের প্রতি দরদ দেখাতে শিখে গেছি, একে অপরকে ভালো বাসতে শিখে গেছি৷ এসব দেখে আর শুনে ওরাও খুশি। তোকে নিয়ে, তোর ভাগ্য নিয়ে অনেক চিন্তা করত সকলে। ভাবত হয়তো আমি মানতে পারব না তোর লাইফটা সকলে মিলে নষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু এমন কিছু হয়নি। আমি মেনে নিয়েছি। এখন এই ছোট ছোট ভালোবাসা গুলো ওদের নজরে পড়লে ওরা খুশি হবে। বুঝলি গোবর ঠাঁসা? ”

শিশিরের কথা শুনে কুয়াশা ঠান্ডা হয়ে গেল। রাগ পড়ে গেল। মুগ্ধ হলো শিশিরের কথায়। কথা তো মন্দ বলে নি! সত্যি তো! পরিবারের লোক খুবই চিন্তা করে তাদের নিয়ে। এখন এসব জানলে খুশি ছাড়া আর কিছু হবে না৷ কুয়াশাকে শান্ত হতে দেখে শিশির এবার বলল,
” না বুঝে যে এতগুলো মারলি এবার আমি কি করব? ”
কুয়াশা শুনে বাচ্চাদের মতো করে আহ্লাদ করে বলল,
” আদর করো। মেরো না।”
শিশির শুনে শব্দ করে হেসে ফেলল। এটাকে নিয়ে কি করবে সে? বলল,
” তাই! আদর চায় তোর?”
” মারের থেকে আদর ভালো।”
লজ্জা মাখা কথা কুয়াশার৷ শিশির আবার হেসে ফেলল। কুয়াশা শিশিরের কাঁধে মাথা রাখল৷ সে তার বউকে আলত হাতে জড়িয়ে ধরল।

কাক ডাকা ভোর। শিশিরের বুকে ঘুমচ্ছে কুয়াশা আসমানের নিচে। খোলা আসমানের নিচে তাদের জীবনের দুই রাত কেটে গেল। আজ শিশিরের আগে ঘুম ভাঙল৷ তাকাল বউয়ের দিকে। কী সুন্দর লাগছে সকালের পবিত্র ফুটফুটে আলোয় বউটাকে। পবিত্র পুষ্প তার৷ ভেবে হাসল। চুমু আঁকল ললাটে। দু’হাতে বাহুবন্দী করে রেখেছে।

সকাল আটটা। সকলে খাবার খেয়ে গল্পে মেতেছে। এমন সময় হিম বলল,
” মিহির ভাই মাছ ধরব, চলো”
” আচ্ছা চল। দাঁড়া বর্শি নিয়ে আসি বড় আব্বাদের বাড়ি থেকে। আমাদের চারটা আছে। সকলের হবে না”
সম্মতি পেয়ে মিহির বর্শি আনতে চলে গেল৷ শিশিররা সকলে উঠে বের হলো৷ ছেলেরা যেতেই মেয়েরা মাছ ধরা দেখবে বলে বের হলো।
যেতে যেতে বৃষ্টি আর ইয়াসমিন কুয়াশাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে করতে হাঁটতে লাগল। বৃষ্টি ডাকল,

” কুশু? ”
” হুঁ ভাবি! ”
” তোমরা সম্পর্কে এগিয়েছ? ”
কুয়াশা থেমে গেল৷ তাকাল বৃষ্টির দিকে৷ ইয়াসমিন জিজ্ঞেস করল,
” কতটুকু এগুতে পেরেছিস? ”
কুয়াশা মাথা নিচু করে নিল৷ লজ্জা নাকি পরিবারের এত এত চিন্তা করা নিয়ে ভেবে আনন্দ পেয়ে বোঝা গেল না৷ আর ভাবিরা সেই চিন্তা থেকেই কী জানতে চাচ্ছে সেটাও বুঝল। বলল,
” ভালোবাসা বাসি পর্যন্ত হয়েছে৷ এর বেশি না৷ তবে জড়তা কাজ করত এতদিন৷ সেটাও কেটে যাচ্ছে। ”
মুচকি হাসল বৃষ্টি সহ উপস্থিত সকলে৷ এরা যে এতটা বুদ্ধিবান ধারণা ছিল না। যে হারে একে অপরকে অপছন্দ করত কখনো ভাবেই নি ধরে বেঁধে বিয়ে দিলে এরা এত জলদি মানতে পারবে৷ বৃষ্টি ইয়াসমিন জড়িয়ে ধরল কুয়াশাকে৷ ইয়াসমিন বলল,

” আমরা তোকে অনেক ভালোবাসি কুশু৷ তোর লাইফ নিয়ে অনেক চিন্তা হতো৷ একমাত্র মেয়ের সুখের চিন্তা করে। যদিও শিশির লাখে একটা তবুও তোরা হিংসা, অপছন্দ কাটিয়ে ভালোবাসা দিয়ে সংসার করতে পারবি কি না সেটা নিয়ে অনেক ভাবতাম৷ তোর ভাইয়া তোদের বিয়ের দিন থেকে তোকে নিয়ে অনেক চিন্তা করে৷ তোর সুখের কথা ভাবে৷ তুই মানতে পারবি কি না শিশিরকে এসব। কিন্তু আল্লাহর শুকরিয়া। তোরা অনেক বুঝবান। ”
কুয়াশা মুচকি হাসল৷ বলল,
” তোমাদের দেবর স্বামী হিসেবে একজন পারফেক্ট পার্সোন৷ ভালো না বেসে কেউ থাকতে পারবে না৷ দায়িত্ববান, যত্নবান, ভালোবাসতেও মন দিয়ে পারে৷ আর সব থেকে বড় কথা পরিবার আমাদের খারাপ চায় নি৷ আমরা ভেবেছি চেষ্টা করলেই সব হবে৷ চেষ্টা করলেই হিংসাকে দূরে ঠেলতে পারব৷ সেটায় করেছি। কারণ আমরা দু’জন দু’জনের ভবিতব্য। মানতেই হতো৷”

আপ্লূত হলো বৃষ্টিরা৷ ছেলে মেয়েটা স্বভাব দোষে ঝগড়া করত। বড় দু’জনই হয়েছিল আর বুদ্ধিমানও৷ ভেবে বৃষ্টি, ইয়াসমিন কুয়াশার মাথা হাত রাখল। বৃষ্টি বলল,
” দোয়া করি জীবনে আরো এগিয়ে যাও। তোমাদের সংসারে ভালোবাসা কানায় কানায় পূর্ণতা পাক। ”
মুচকি হাসল কুয়াশা। এমন পরিবার কী খারাপ চাইতে পারে? যেখানে ভাবিরাই এত ভালো! এবার ইয়াসমিন একটু মজা নিল। বলল,
” কিন্তু কাল যে দেখলাম তোর ভালোবাসার চিহ্ন শিশিরের ঠোঁটে? ”
এই কথায় কুয়াশা এবার নূয়ে পড়ল৷ বৃষ্টি, স্মৃতি, ঈশা, শশী জোরে জোরে হেসে দিল। কুয়াশা লজ্জা পেয়ে বলল,
” ধেৎ….!”
বলেই দৌড় দিল পুকুর পাড়ের দিকে৷ এখানে আর থাকা যাবে না৷ এখন সব মজা উড়াবে বোঝা হয়ে গেছে৷ ভাবিরা খুবই পাঁজি হয়৷ লাগামহীন সব৷ কুয়াশা যেতেই সকলে হাসতে হাসতে পুকুর পাড়ের দিকে এগুলো

পুকুর পাড়ে আম গাছের নিচে সব সারিবদ্ধ করে মাছ ধরছে। কিন্তু এত গুলো বর্শি এক সাথে এক জায়গায় ফেললে কি আর চতুর মাছ বাবাজীবন ধরা দিতে চাই? তাই মিহির বলল,
” এত গুলো মানুষ এক জায়গায় না বসে ভাগ ভাগ করে বসো শিশির ভাই।”
বলে সে দেখিয়ে দিল পুকুর পাড়ে দক্ষিণ সাইটে বড় একটা কড়ই গাছ আছে সেখানে দুজনকে যেতে বলল। উত্তর দিকে একটা ছোট খাটো কাঁঠাল গাছ আছে সেদিকে দু’জনকে বসতে বলল। আর দূরে দূরে বসতে বলল কয়েকজনকে। কথা অনুযায়ী শিশির আর রিজভী কড়ই গাছের নিচে গেল। তুষার, তুহিন দূরে সরে বসল। হিম, মিহির সেখানেই থাকল। নীহার, শান্ত কাঁঠাল গাছের নিচে গেল।

আহ্ বর্শি দিয়ে মাছ ধরার আনন্দটাই আলাদা৷ যারা ধরেছে তারাই এই আনন্দটা উপভোগ করতে পেরেছে৷ এই আনন্দে একটা শৈশব শৈশব ফিল আসে। মাছ ধরতে মিহির পটু৷ সে অলরেডি চার-পাঁচটা মাছ ধরে ফেলেছে৷ হিম তা দেখে হা হুতাশা করতে করতে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলার মতো করে ফেলেছে৷ তা দেখে ও শুনে সকলে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
এরই মাঝে শিশিরের বর্শিতে একটা বড় মাছ ধরা খেল। মাছটা বোধহয় রুই৷ এখনো তুলে নি৷ তা দেখে সকলে চেঁচিয়ে উঠল। শিশির তো একদম দাম্ভিকতার সাথে চেঁচিয়ে বলল,

” কিহ্ শা-লাবাবু দেখলি তো? তোর দুলাভাই কিন্তু সব দিক দিয়ে এক্সপার্ট। শুধু বোনটায় তোরা দিলি মাথা সহ পুরোটাই গোবরে ভরতি। তোর বোনের কাছেই বুনো ওল রয়ে গেলাম শুধু।”
তা শুনে সকলে হেসে উঠল৷ কুয়াশা কটমট করে তাকাল। এগিয়ে গেল মিহিরদের কাছে থেকে। হিমও চেঁচিয়ে বলল,
” তোমার বাঘা তেঁতুল যাচ্ছে। ঠ্যালা সামলাও এবার।”

বলে হে হে করে হেসে উঠল৷ সকলে হাসল। শিশির মাছটা তুলে নিল। অনেকটায় বড় মাছ। মিহির গিয়ে ছাড়াতে লাগল। কুয়াশা গিয়ে মাছটা দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে গেল৷ বড় বড় মাছ ধরা দেখলে কার না আনন্দ লাগে? সবারই লাগে। তাই কুয়াশারও লাগল সে শিশিরের একটু আগের খোঁটা দেয়া টা ভুলে লাফিয়ে মাছের কাছে বসে পড়ল। মিহির, শিশির, রিজভী হেসে ফেলল৷ স্মৃতিও গেল সেদিকে। কুয়াশা মাছটা হাতে ধরে উপরে তুলে বলল,
” আরেহ্ বাহ্ কত্ত বড় বড় মাছগো মিহির ভাই তোমাদের পুকুরে? ”
” এর থেকেও বড় বড় আছে৷ ”
মাছটা দেখতে হিম ও দৌড়ে গেল৷ গিয়ে সে মাছটার সাথে শেলফি সহ কয়েকটা ছবি উঠাল৷ ওর দেখাদেখি কুয়াশাও তুলল। শিশির বলল,

” কুয়াশা…! মাছ নিয়ে দাঁড়া ”
কুয়াশা শিশিরের কথামতো দাঁড়াতেই শিশির নিজের ফোনে কয়েকটা ছবি তুলে নিল৷ কুয়াশা খুশিতে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। এরই মাঝে নীহার, তুষার, তুহিন তিন জনেরই বর্শিতে এক সাথে বড় বড় মাছ ধরা দিল। সকলে তো আনন্দে এবার নেচেই উঠল। এক সাথে এতগুলো মাছ একবারে ধরা দেখে। এরপর একে একে রিজভী, শান্তও পেল। হিমও পেল বেশ বড়তা-ই সেটা ধরতে পেরে সেও শিশিরকে উল্টো খোঁটা দিতেও ভুলল না। অনেক মাছ হয়ে গেল বলে আর ধরল না কেউ। এত মাছ ধরে কি বা করবে! বড় বড় মাছই অনেক হয়ে গেল। তাই বাদ দিল সব মাছ ধরা। শিশির উঠে কুয়াশার কাছে গিয়ে কানের কাছে মুখ দিয়ে বলল,

” তোর স্বামী সব দিকে এক্সপার্ট ঘরে এবং বাইরে। মানতে শেখ। ”
বলে চোখ টিপল। কুয়াশা ভ্রু কুঁচকে কিড়মিড় করে উঠল। বলল,
” নিজের ঢোল নিজেই পেটাচ্ছ? ”
” আমার ঢোল পেটানো লাগে না। কাজেই সকলে বুঝে নেয়। ”
” অসভ্য লোক একটা তুমি। আর আমার কাছে তুমি আজীবন তাই ই থাকবে। ”
বলেই শিশিরকে দিল একটা ধাক্কা। শিশির পুকুরের কিনারাই ছিল৷ ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে পানিতে গেল ধপাস দিয়ে পড়ে। সকলে হতভম্ব হয়ে গেল। শিশির পুকুরের পানি থেকে মাথা তুলে বলে উঠল,
” গোবর ঠাঁসার বাচ্চা..! কি করলি এটা? খুব বাড় বেড়েছিস নাহ্? থাম তোর ডানা ছাটার ব্যবস্থা করছি। উঠি আগে আমি ”

কুয়াশা হাতের ময়লা ঝাড়ার মতো করে দু’হাত বাড়ি দিল। বলল,
” কিচ্ছু করতে পারবা না তুমি ”
বলে হাঁটা ধরল স্মৃতিকে নিয়ে। আর সকলে কপাল চাপড়ে বসে রইল৷ এরা জীবনেও শুধরাবে না৷ শিশির বলল,
” দেখা যাবে ”

বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪২+৪৩

বলে সে সাঁতার কেটে এই পাশে ঘাটে চলে এলো। দুুপুরই হয়ে গেছে মাছ ধরতে ধরতে তাই একবারে গোসলই করে নেয়া যাক! শিশিরের দেখা দেখি নীহার, হিম, রিজভী, শান্ত, মিহিরও নেমে পড়ল। তুষার, তুহিন ও নামল। তবে ওরা গোসল করেই উঠে গেল শিশিররা রয়ে গেল। তারা সারা পুকুর এক করে বেড়াচ্ছে।

বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪৬+৪৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here