বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪৮+৪৯
রোজা রহমান
শিশির কুয়াশাকে শশীর পাশের ঘরটা দেয়া হয়েছে। সেখানে কুয়াশাকে কোলে করে নিয়ে শুয়ে দিল। ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে। গরম পানি করতে দেয়া হয়েছে। একটু গরম সেঁক দিলে ব্যথা কমবে। কুয়াশা দাঁত মুখ শক্ত করে এক পাশ হয়ে শুয়ে রইল৷ শিশির বকেই যাচ্ছে থেকে থেকে। সেগুলো গিলছে৷ এখন কী আর করার? দোষ যে করেছে সে!
ঘরে আপাতত কেউ নেই। কেউ আর এ ঘরে আসেনি। কাল সকাল সকাল চলে যাবার চিন্তা করেছেন সকলে। রাত দশটা পাড় হয়ে গেছে। শিশির শার্ট খুলে একটা ঢিলাঢালা সাদা শার্ট পরে নিল আর প্যান্ট পাল্টে টাউজার পরল। গিয়ে কুয়াশার পাশে আধশোয়া হয়ে বসল বিছানায়। কুয়াশা চোখ মুখ খিঁচিয়ে রেখেছে৷ নরম স্বরে বলল,
” সবসময় যে পণ্ডিতি করিস, উড়নচণ্ডী হয়ে বেড়াস এখন এই যে কষ্টটা পাচ্ছিস কে নিচ্ছে এটার ভাগ? সেই তো নিজেই কষ্ট পাচ্ছিস! সবসময় বলা হয় সাবধানে থাকবি তবুও শুনিস না। আর হয়ে গেছে অসাবধানতায় সেটা মানলাম বিকেলে কেন জেদ ধরে গেলি ঘুরতে? তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তবুও বললি না কেন?”
কুয়াশা টলমল চোখ খুলে তাকাল৷ ভাঙা কন্ঠে বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
” বিকেলে কম মনে হচ্ছিল৷ ভেবেছিলাম সেরে যাবে৷ কিন্তু এখন এমন হবে বুঝি নি।”
বলে সে এবার স্বামীর কাছে আদুরে ভোল ধরল। একটু আহ্লাদী হলো আহ্লাদ পাবার জন্য। মাথা তুলে আধশোয়া হয়ে বসে থাকা শিশিরের বুকের উপর গিয়ে মাথা সমেত শরীর এলিয়ে দিল৷ শিশিরও আদুরে, আহ্লাদী বউকে বুকের সাথে আগলে নিল৷ এক হাত পিঠে রাখল অন্য হাত মাথায়। চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল স্বামীর বুকে। শিশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কুয়াশা এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল,
” ব্যথা করছে খুব। ”
শিশিরের বুকটা ভারী হয়ে এলো এমন ভাবে বলতে শুনে৷ মেয়েটাকে কত করে মানা করে তবুও শুনবে না। বড় হয়ে গেল তবুও উগ্রস্বভাব গেল না৷ বউয়ের মাথার উপরিভাগ চাঁদিতে চুমু এঁকে হাত বুলানো অবস্থায় বলল,
” ঠিক হয়ে যাবে। ঘুমোনোর চেষ্টা কর। কাল শহরে গিয়ে আগে ডক্টরের কাছে নেব। এখানে ভালো ডক্টর পাব না।”
কুয়াশা প্রত্যুত্তর করল না। শিশিরের পেট জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে পড়ে রইল৷ রাতটা কষ্ট করে চলে যাক।
এরই মাঝে জাকিয়া এলেন। বাইরে থেকে ডাকলেন,
” শিশির, আব্বু..! ”
” আম্মু আসো। ”
দরজা ভিড়ানো ছিল। জাকিয়া ভেতরে গিয়ে এত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখে চোখ জুড়ালেন৷ তাদের ছেলে মেয়ে দু’টোর সুখ দেখলেন। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখলেন। কে বলবে? এরা দুই মাস আগেও একে অপরের জনম শত্রু ছিল!! এখন দেখো দিব্ব্য একে অপরের ঢাল হয়েছে। একজন ব্যথায় কাতরাচ্ছে তো একজন ঢাল হয়ে পাশে আছে। হৃদয়ের কোথাও একটা শান্তিময় আনন্দ টের পেলেন জাকিয়া৷ ভালোবাসতে শিখে গেছে এরা এখন শুধু দু’চোখ ভরে দেখবেন এদের পরিপূর্ণ সংসার সাজানো।
জাকিয়া গরম পানি আর তোয়ালে নিয়ে এসেছেন। আজ জাকিয়াকে দেখেও কুয়াশা প্রতিক্রিয়া করল না৷ শিশিরের সাথেই লেপ্টে রইল। মূলত শিশিরের গতকাল রাতে বলা কথাটা সে-ও পরিবারের লোকের কাছে উপস্থাপন করতে চাইছে। জড়তা কাটিয়ে তুলুক আস্তে আস্তে। কতকালই বা লুকোচুরি করবে? জাকিয়া মুচকি হেসে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” কিছু বলছে আর? ”
” বলল তো ব্যথা করছে। কিন্তু দেখো চোখ মুখ খিঁচিয়ে শান্ত হয়ে আছে৷ এখন শান্ত হয়ে কি হবে? এই শান্তটা আগে থেকে হলে এখন কষ্ট করতে হতো?”
শেষ কথাটা একটু গরম নিয়ে বলল শিশির৷ কুয়াশা কিছু বলল না৷ চোখ বন্ধ করেই রইল। জাকিয়া শব্দহীন হেসে বললেন,
” থাক আর বকিস না। ভুল করে ফেলেছে। অনেক সময় না বুঝেই ভুল হয়ে যায়। দূর্ঘটনায় হাত থাকে না কারো। ”
শিশির কিছু বলল না৷ কাছে এগিয়ে কুয়াশাকে জিজ্ঞেস করল,
” মা’রে যন্ত্রণা হচ্ছে? ”
” হ্যাঁ আম্মু। কটকট করছে৷ হাড়ের মাঝে টনটন করছে।”
শিশির ‘আম্মু’ ডাক শুনে অবাক হলো৷ তাকাল কুয়াশার দিকে। কিন্তু পুরো মুখ দেখতে পেল না৷ জাকিয়ার দিকে তাকাল। জাকিয়া বললেন,
” কোমড়টা মাটির সাথে অনেকটা জোরে আঘাত পেয়েছে৷ যার জন্য এমন হচ্ছে। কাল সকাল সকাল চলে যাব। রাতটা কষ্ট করে একটু কাটিয়ে দে। ”
বলে শিশিরকে বলল,
” সেঁক তুই দিবি নাকি আমি দিয়ে দেব?”
” রাখো আমি করছি। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। রাত হয়েছে অনেক। ”
জাকিয়া দ্বিরুক্তি করলেন না। বললেন,
” কখনো তো তাকিয়েও দেখিস নি তোর এই আহ্লাদীর অসুখ হলে কী করে! এখন দেখে নে। সকলের অবস্থা কীরকম নাজেহাল করে। ”
বলে মুচকি হাসলেন৷ শিশির বলল,
” হ্যাঁ, হারে হারে টের পাচ্ছি। ”
কুয়াশা চোখ খুলে মাথা উঁচু করে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল শিশিরের দিকে৷ শিশির পাত্তা দিল না তা৷ জাকিয়া হাসলেন। বললেন,
” এখনো ছোট আছে, মানুষ করে নে আগে এটাকে।”
জাকিয়া সময় বুঝে ভালোই মজা করেন ছেলের সাথে৷ মা হিসেবে অমায়িক। শিশির হাসল ঠোঁট প্রশারিত করে শব্দহীন তা। তার মা বেস্ট৷
এরকম কয়টা মা ফ্রিলি কথা বলে ছেলে আর ছেলেবউয়ের সাথে? আমার মনে হয়, শাশুড়ীরা এমন নমনীয়তা দেখালে সমাজে বউ, শাশুড়ীতে কোনো বিবাদ সৃষ্টি হতো না। আর সকল বউদেরও একটু বুঝ থাকলেও শাশুড়ীরা কখনো খারাপ ব্যবহার করে না। নিজের মায়ের মতো ভাবতে পারলে ক্ষতি কি? মা তো তারাও হয়! দু’জন সামান্য বুঝ নিয়ে চললেই সংসার মধুর মিষ্টি হয়৷
জাকিয়া সব ঠিক ঠাক করে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। শিশির বলল,
” ওঠ, সেঁক দিই৷ ভালো লাগবে। ”
বলে কুয়াশাকে তুলে শুয়ে দিয়ে সে দরজা বন্ধ করে এলো৷ এরপর বলল,
” উপর হয়ে শো ।”
কুয়াশা প্রত্যুত্তর ছাড়া উপর হয়ে শুলো। শিশির বিছানায় কুয়াশার পাশে গিয়ে বসল৷ এরপর কুয়াশার কোমড়ের কাছে থেকে জামা সরাল অনেকটা৷ কোমড় সহ একটু পিঠও আলগা করল। লাইটের আলোই হলুদাভ কোমড় সহ মসৃণ পিঠ শিশির দেখল৷ কুয়াশা উপর হয়ে শুয়েই শিশিরের দিকে তাকিয়ে গভীর দৃষ্টি দিয়ে। শিশির তাকালে সে লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। শিশির ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল নিঃশব্দে। কুয়াশার কানের কাছে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
” আর কত পরীক্ষা নিবি আমার? বড্ড জ্বালাচ্ছিস। সুযোগ হোক একবার সোধ না নিয়ে ছাড়ব না কিন্তু!”
কুয়াশা কিছু বলল না৷ ঢিপঢিপ বুক নিয়ে মুখ ঢেকে রাখল৷ শিশির পাত্রটা থেকে গরম সেঁক নিয়ে নিয়ে কুয়াশার কোমড়ে ধরতে থাকল। গরম ভাঁপটা আরামদায়ক মনে হলো কোমরে। কুয়াশা একটু উষ্ণ আরাম পেয়ে বলল,
” ভালো লাগছে।”
” লাগবেই তো! পতি তার পত্নী সেবা করছে যে! জলদি সুস্থ হ , এবার তোর পতি সেবা করতে হবে।”
কুয়াশা আরো লজ্জায় মিয়েই পড়ল। বিছানার চাদর খামচে ধরে শুয়ে রইল৷ শিশির টের পেল। হাসল নিঃশব্দে। একই ভাবে অনেকটা সময় নিয়ে সেঁক দেবার পর কুয়াশা বলল,
” শুনো…! শুয়ে পড়ো৷ ”
” যন্ত্রণা করছে আর? ”
” কমেছে।”
শিশির আর কিছু বলল না৷ এটা সারবে না। বিধায় বাদ রাখল। কাল এখান থেকে যেতে পারলে ভালো ডক্টরের কাছে নেবে আগে। ভেবে সেঁক দেয়া বন্ধ করে দিল। ঝুঁকে কুয়াশার কোমড় ও পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে চুমু আঁকল দুটো। নরম পিঠে দাঁড়ি সমেত ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠল সে৷ ঘুরে তাকাল শিশিরের দিকে। শিশির কুয়শার দিকে তাকাল৷ কুয়াশা উপর হয়ে শোয়া অবস্থাতে ঘুরার ফলে পেটের উপর থেকে জামা সরে গেল। পেট আলগা হয়ে গেল কিঞ্চিৎ। হলুদ ফর্সা পেটটা নজর এড়াল না শিশিরের। কুয়াশার পেটের সৌন্দর্যতা দেখে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল তার। নিজেকে দমাল না একচুল পরিমাণ। বাসনা পূরণ করে নিল৷ ছুঁয়ে দিল ঠোঁট কুয়াশার মসৃণ, নরম তুলোর মতো পেটে৷ ঠোঁট দাবিয়ে দিয়ে চুমু আঁকল কুয়াশার পেটে। আবার ভেঙে এলো কুয়াশার শরীর। শিরশির করে কেঁপে উঠল পুরো কায়া, অন্তর৷ কাঁটার ন্যায় বিঁধল লোম। ব্যথাময় শরীরে স্বামীর একটু ভালোবাসাময় আদর পেয়ে শরীর জড়িয়ে এলো তার৷ এত ভালোবাসা কই রাখবে সে?
শিশির মুখ তুলতেই সে লজ্জায় ভেঙে পড়ল। শিশির মুচকি হেসে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। কুয়াশাকে কাছে টেনে নিতে নিতে ফিসফিসিয়ে বলল,
” আহ্লাদী বউ! জলদি সুস্থ হয়ে যাহ্। ”
কুয়াশা স্বামীর বুকের মাঝে জড়োসড়ো হয়ে শুলো। মুখ গুঁজে রাখল গলার মাঝে। শিশির দু’হাতের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখল। ভালোবাসার পরশ দিয়ে ব্যথা ভুলাতে চাইল বউয়ের। কয়টা স্বামী এমন করে আগলে রাখে? বউয়ের ব্যথার ঢাল হয়? ভালোবাসায় তা নিরাময় করতে চায়? সকল স্বামী করে কি এমন? জানা নেই তা কুয়াশার। সে শুধু আর শুধু মাত্র তার ভাষায় বুনো ওল নামক স্বামীর ভালোবাসা চিনেছে।
“আম্মুকে, আম্মু ডাকা কবে থেকে ধরলি?”
” আজ থেকে, পুকুরে গোসল করার জন্য আমার আম্মু রাজি হচ্ছিল না তাই তোমার আম্মুকে আম্মু ডেকে রাজি করিয়েছি ”
গলায় মুখ গুঁজে রেখেই উত্তর করল সে। শিশির মেকি বিস্মিত হয়ে বলল,
” কতত বড় চালাক চিন্তা করা যায়! এ্যাই তুই আমার আম্মুকে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আম্মু বলে পটিয়েছিস? এই জন্য বলি গোসল করার অনুমতি কে দিল! ”
কুয়াশা ফিসফিস করে হেসে দিল। বলল,
” স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ডাকি নি। মন থেকেই ডেকেছি আম্মু বলে। বড় আম্মুই আমাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছেন৷ মেজো আম্মুও অনেক ভালোবাসেন কিন্তু মেজো আম্মুর স্কুলের জন্য বেশি বাড়িতে থাকতে পারত না দেখতাম সেটা। ”
” তোর বড় হওয়া চোখের সামনে দেখলাম। সকলের এত আদরের ছিলি বলে দু চক্ষেও সহ্য করতে পারতাম না আর সেই তুই এখন আমার কোলের মধ্যে, বুকে শুয়ে রাজ করে এক একটা রাত পাড় করিস। কী দিন এলো আমার জীবনে চিন্তা কর তাহলে! ”
” আল্লাহ তোমার হিংসাকে ভালোবাসায় পরিণত করবে বলে আমাদের ভবিষ্যত, ভবিতব্য এটা করেছিলেন ”
শিশির কিছু বলল না। এখন এই মেয়েটায় তার আপন। ভেবে বুকে চেপে ধরল তার বউকে।
রাত এগারটা বেজে পাড় হয়ে গেছে। বারটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। শশী নীহারকে এখনো ছাড়েনি। তারা ছাদে নিজেদের মতো সময় কাটিয়েই চলেছে। কাল চলে যাবে এটায় দু’জনের বুক ভারী করে তুলেছে। আবার শুরু হবে দূরত্ব। এই দূরত্ব কতদিনের জানা নেই। আবার কবে দেখা করতে পারবে দু’জন জানা নেই। অনুভূতিরা বিষাদময় হয়ে নিঃশ্বাসের সাথে বের হচ্ছে। ভালোবাসা জিনিসটা খুবই অদ্ভুত! দূরে থাকলে ব্যথা দেয় কাছে থাকলে মন ক্ষুদ্ধ হয়৷ এই যে নীহার আর শশীর ভালোবাসায় মাঝে দূরত্বটাই বেশি শোভা পায়। এভাবে কী ভালোবাসা বাসিতে মন ভরে? তাদের ভরে না।
নীহার এগারটার দিকে শশীকে ডেকে আনে ছাদে৷ শশী এসে আবেগঘন হয়ে নীহারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়৷ বাচ্চাদের মতো আবদার করে, তাকেও যেন কালই নিয়ে যায় সাথে করে। তাকে ছাড়া ভালোলাগে না তার। সে চলে গেলে থাকতে পারবে না। নীহার শুনে আলতো হেসেছে সেটা মন থেকে হাসি না। বিষাদময় সেই হাসি। কষ্ট তারও হচ্ছে। এই মেয়েটাকে ছেড়ে থাকতে এখন তারও কষ্ট হয়৷ রোজ যদি চোখের সামনে দেখতে পেত? কাছে পেত? নিজের কষ্টময় আবেগগুলো দমিয়ে শশীকে শান্ত করেছে। অনেক রকম করে বুঝিয়েছে। এও বলেছে পড়াশুনোর পাশাপাশি পরীক্ষা টরীক্ষার চাপ না থাকলে যেয়ে ঘুরে ঘুরে আসতে। শশী তা শুনে শুনে একটু শান্ত হয়েছে। কিন্তু নীহারকে সে ছাড়ে নি। নীহার না পেরে শশীকে নিয়ে ছাদের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে বসেছে। শশী একদম আবেগী হয়ে উঠেছে। বাচ্চামো মন কী আর এত কিছু ভাবে? না মানে? শশীও মানে নি,ভাবে নি। সে নীহারের বুকে মাথা রেখে পড়ে আছে। নীহারও নিজের কষ্ট দমিয়ে তার হবুবউকে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে। মাথায় হাত রেখে বুলিয়ে দিচ্ছে। আজ আকাশের চাঁদটা বড়। তাই আলোকিত হয়েছে বেশ প্রকৃতি। নীহার বলল,
” শশী!”
” হুঁ ”
” চলো নিচে, গিয়ে শুবে। এভাবে আমরা একসাথে এত রাতে আছি জানলে সকলে খারাপ ভাববে। আমরা নিজেদের ভালোবাসার জোরে এতটা কাছে এসেছি৷ কিন্তু আমাদের সম্পর্কে এখনো কোনো পবিত্রতা আসেনি শশী। যেদিন পবিত্রতা আসবে সেদিন সবটা উজার করে দিয়ে তোমাকে কাছে টানব, ভালোবাসব। ততদিন অপেক্ষা করো, আর কষ্ট সহ্য করো। আমি আছি তো তোমার সাথে পাখি। যখন মন চাইবে কল দেবে, ভিডিও কল দেবে কথা বলব৷ পাখি আমরা দূরত্ব বজায় রেখেও নিকটে থাকব একে অপরের৷ ”
শশী বুক থেকে মাথা তুলে নীহারের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো বলল,
” ডাকটা ভালো লাগছে আমার ”
” কোন ডাক? ”
” পাখি।”
নীহার হেসে ফেলল। কপালে চুমু আঁকল। বলল,
” তুই তো আমার পাখিই রে ”
” এটায় ডাকবেন, ওসব ইঁচড়েপাকা টাকা বলবেন না ”
” উহু, তুমি আমার ইঁচড়েপাকা পাখি। ছোট্ট পাখির ছানা। ”
বলে মুচকি হেসে নাক নাক ঘষে দিল শশীর৷ আবার বলল,
” এই পাখির ছানাটাকে একবার শুধু কাছে পায়, তারপর আর উড়তে দেব না। একদম আমার বক্ষখাঁচায় বন্দি করে রাখব। ”
শশী লজ্জা পেল। আবছা অর্ধচাঁদের আলোয় তা দেখল নীহার। সে-ও আলতো হাসল। আরো কিছুক্ষণ গল্প করে তারা নিচে চলে গেল।
ভোর ছয়টা। সকলে উঠে পড়েছে। মালিথা ভিলার সকলে বাড়ি ফিরবে সেটারই তোড়জোড় চলছে। জিনিয়া, সীমি উঠে রান্না বান্নার কাজ করা শুরু করে দিয়েছেন। জাকিয়া, আজমিরা, আম্বিয়া সাহায্য করছেন। জাকির মালিথারা হানিফ সাহেবের সাথে কিছু দরকারী কথা সারছেন।
‘
শিশিরের মাত্র ঘুম ভাঙল। অনেকটা রাত জেগে ছিল দু’জন। কুয়াশার ব্যথা নিয়ে ঘুম হচ্ছিল না সেই সাথে শিশিরও ঘুমতে পারেনি। কুয়াশা ঘুমে এখনো৷ গুটিশুটি মে-রে কোলের মধ্যে ঘুমচ্ছে সে। শিশির রোজকার মতো করে কিছুক্ষণ দেখে কপালে চুমু খেয়ে কুয়াশাকে ছেড়ে উঠে পরল। এই ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম আছে৷ শিশির গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। যেহেতু সময় ছিল তাই নামাজও পড়ে নিল৷ কুয়াশাকে ডাকল না। সে বাহিরে চলে গেল।
সব ভাইরা উঠে গেছে। শিশির যেতেই কুয়াশার কথা জিজ্ঞেস করল সকলে৷ উত্তরে সে জানাল অনেকটা রাত ব্যথায় ককিয়েছে৷ গিয়ে আগে ডক্টর দেখাতে হবে।
তুহিন তা শুনে সাথে সাথে ওর একটা অর্থোপেডিস্টও বন্ধুকে ইনফর্ম করে দিল। তার পরিচিত একটা বন্ধু অর্থোপেডিক সার্জন অর্থাৎ মানবদেহের অস্থি বা হাড়, অস্থি সন্ধি, লিগামেন্ট এবং মাংসপেশীর বিভিন্ন সমস্যায় চিকিৎসা দেবার কাজটি অর্থোপেডিক সার্জন করে থাকেন।
কথা বলে ফোন রাখলে তুহিন জানাল বিকেল চারটার মধ্যে যেতে বলেছে। শিশির বলল এখান থেকে গিয়ে আগে হসপিটালেই যাবে এরপর বাসায় উঠবে৷ সকলে সম্মতি দিল৷
সকালের নাস্তা খেয়ে জিনিয়া কিছুতেই বেরতে দিলেন না। দুপুর পর্যন্ত আঁটকে রাখলেন৷ জানালেন খুব বেশি দূরের পথ না এত তাড়াতাড়ি করার দরকার নেই। তিনি আয়োজন করলেন দুপুরের জন্য। সকলে মানা আর করল না। এত সকালে যাওয়াটাও ভালো লাগছিল না কারো।
কুয়াশাকে হাঁটা হাঁটি করতে দিচ্ছে না কেউ। নিজের প্রয়োজন ছাড়া বিছানা থেকে নামেনি সে। ঘরেই খাওয়া দাওয়া করেছে৷ আজমিরা মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে গেছে। স্মৃতিরা তার পাশে বসে গল্প করছিল। সকাল দশটার দিকে শিশির ঘরে এলে সকলে বেড়িয়ে গেল। শিশির বউয়ের হালচাল জিজ্ঞেস করে পাশে বসল। সেসময়ে জাকিয়া এলেন। সকাল থেকে আসার সময় হয়নি। বাহিরে বোনের সাথে একটু বেশিই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। এসে কুয়াশার হালচাল জিজ্ঞেস করলেন তিনিও। এরপর হাতে থাকা পিঠার প্লেট শিশিরের কাছে দিয়ে বললেন,
” কাল তোদের পিঠা দেয়া হয়নি৷ ভুলে গেছিলাম কুয়াশার চিন্তায়৷ এখন খেলে খাইস৷ তাল পিঠা ”
শিশির শুনে প্লেট নিয়ে মা’কে বসতে বলল। জাকিয়া কাজের চাপ দেখি আর বসলেন না। এখনো অনেক কিছু গোছগাছ করতে হবে৷ শিশির একটা পাকান তুলে নিয়ে বলল,
” খাবি তুই এগুলো? ”
” একটা পাকান দাও। বেশি খাব না ”
শুনে শিশির একটা পাকান দিল হাতে। শিশির হেলান দিয়ে বসে কুয়াশা পাশে শিশিরের মুখোমুখি উঠে বসল। বসতে কষ্ট হচ্ছে শুয়েই বেশি থাকছে সে৷ শিশির খাচ্ছিল কুয়াশা খেতে খেতে শিশিরের দিকে তাকাল দেখল শিশিরের ঠোঁটে পাকানের তেল লেগে ঠোঁটজোড়া ভিজে উঠেছে চিকচিক করছে। হায় কী সুন্দর লাগছে তার বরটাকে! ভেবে মিটমিট করে হাসতে লাগল। শিশির প্রথমে টের না পেলেও এবার টের পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল,
” আজাইরা হাসছিস কেন পাগলের মতো? ”
” তোমার ঠোঁটজোড়া যা লাগছে না!! খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ”
কুয়াশার অকপটে বলা লাগামহীন কথা শোনা মাত্র-ই শিশির ভ্যাবাচ্যাকা তো খেলো-ই সাথে কাশি উঠে গেল বেচারার৷ কাশতে কাশতে শহিদ হয়ে যাবার যোগার হলো বেচারার। তার বউয়ের এমন ধারা কথা শুনে। চোখে পানি এসে গেল। এদিকে কুয়াশা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে৷ খুঁনসুটিতে এ দু’জনকে কী যে মিষ্টি লাগে! তা যদি তারা জানত!
শিশির কিছুক্ষণ কেশে চোখ বড় বড় করে কুয়াশার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকাল। কুয়াশা যে এমন ধারার কথা বলতে পারে তার ধারনা ছিল না। অবশ্য সে ভুলে কেন যায় এটা গোবর ঠাঁসা? এর দ্বারা সব সম্ভব। কুয়াশা হেসেই চলল। শিশির তা দেখে কুয়াশার মাথায় একটা চাটি মা-রল। বলল,
” এতটা ফাজিল কবে কবে হলি তুই? ”
” হয়নি, আগে থেকেই ছিলাম। তুমি বুঝতে লেট করে ফেলেছ ”
” আচ্ছা তাই নাহ্?”
” হ্যাঁ ”
বলে ঠোঁট টিপে হাসল। শিশির এবার নিজেও একটু দুষ্টুমি করা শুরু করল। হাতের পিঠা রেখে কুয়াশার কোমড়ের উপরিভাগে পেট বরাবর দুইহাতে দুই পাশে সাবধানে ধরে উঁচু করে নিজের কোলের উপর বসিয়ে নিল। হেলান দিয়ে বসা অবস্থাতেই আছে সে। কুয়াশা চমকে তড়িঘড়ি করে বলল,
” আরে কি করছ? কেউ এসে যাবে!”
” আসবে না৷ দরজা ভিড়ানো। আর সকলে যানে আমরা স্বামী স্ত্রী এক ঘরে আছি আসলেও নক করে আসবে ”
কুয়াশা কিছু বলল না আর। সে পিঠায় কামড় দিল। শিশির তা দেখে কুয়াশার পিঠাটা কেঁড়ে নিল। বলল,
” হ্যাঁ এবার বল কী ইচ্ছের কথা যেন বললি? আমার ঠোঁট কামড়ে খেয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে? ”
কুয়াশা শিশিরের বলা ধরণ দেখে লজ্জা পেয়ে গেল। কারণ শিশিরের বলাটা কেমন আবেদনময় লাগল। শিশির তাকিয়ে থেকে এবার কুয়াশার অর্ধ খাওয়া পিঠাটা নিজের মুখের সামনে ধরে বলল,
” নেহ্ শুরু কর! পিঠা থেকে শুরু কর৷ ইচ্ছে কখনো জমিয়ে রাখতে নেই৷ ইচ্ছে করলেই তা সুযোগ পেলে পূরণ করে ফেলতে হয়৷ আমি নিজেই সেই সুযোগ করে দিলাম৷ আফটার অল আ’ম ইউর হাজব্যান্ড! বউদের সকল ইচ্ছে পূরণ করা স্বামীদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য৷ সো, সোনা কাম ফাস্ট। ”
বলা শেষ করে সাথে সাথে পিঠার টুকরোটা মুখে ভরে ঠোঁট দ্বারা চেপে ধরল।
কুয়াশা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। মানে এ ছেলে সত্যি সত্যি ভেবে নিয়েছে? সে তো জাস্ট ফান করল! কে জানত এ তার ইচ্ছের উপর মাত দেবে? হায় রে! নিজের বেকুবি কথায় নিজেই ফেঁসে গেল। সে বলল,
” আরেহ্, আমি তো জাস্ট মজা করেছি৷ ঠোঁট আবার কামড়ে খাওয়া যায় নাকি? ”
পিঠা মুখে রেখেই আধো আধো ভাবে উত্তর করল শিশির,
” কেন যাবে না? সেদিন না কামড় দিলি?”
” কী নির্লজ্জ মার্কা কথা বার্তা বলো? দাও পিঠা দাও ”
বলে হাত দিয়ে পিঠা নিতে গেল সে মুখ সরিয়ে নিল৷ বলল,
” উহু, তোর ইচ্ছে পূরণ না করিয়ে আমি ছাড়ছি না। শুরু কর! ”
কুয়াশার এবার নিজের গালে নিজেরই চাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে। কেন যে এমন একটা কথা এই নির্লজ্জা মার্কা লোকের কাছে পেশ করতে গেল!! এখন বুঝো ঠ্যালা কেমন লাগে! শিক্ষা হয়ে গেছে আর জীবনেও বলবে না। নাক কান মলে উঠল সে। শিশির কুয়াশাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার ইশারা করল। কুয়াশা বলল,
“এমন খেতে পারব না আমি। ”
” খেতে হবে তোর!”
পুরো অধিকারমূলক কথা তার। কুয়াশা উপায় না পেয়ে মাথা এগিয়ে ঝুঁকে শিশিরের ঠোঁট দিয়ে ধরে রাখা পাকানে এক কামড় দিল৷ শিউরে উঠল শরীর। অনুভূতিরা প্রজাপতির ন্যায় উড়ছে৷ শিশির মিটমিট করে হাসছে। একে আজ শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে। পাকনামি বের করবে আজ। দু’জন দু’জনের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে অবলোকন করছে। কুয়াশা মুখের টুকু চিবিয়ে খেয়ে আবার পূনরায় কামড় দিল পিঠায়৷ শিশির ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
” পিঁপড়ার মতো খাচ্ছিস কেন? জোরে খা!”
কুয়াশা কয়েক কামড় খেয়ে এবার শেষ কামড় আছে কারণ পিঠা ফুরিয়ে গেছে৷ তাকে থেমে যেতে দেখে শিশির বলল,
” হা করে কি দেখছিস? এই টুকু আমি খাইয়ে দেব? ”
কুয়াশা তড়িঘড়ি করে দুই পাশে বার কয়েক মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর করল,
” না না আমিই খাচ্ছি। ”
শিশিরের ভেতরে দম ফাটা হাসি আসছে। জব্দ যাহ্ করতে পারছে নাহ্! ভেবেই আনন্দ লাগছে তার। কুয়াশা শেষ কামড়টা নিতে গিয়ে একদম ঠোঁটের কাছে গিয়ে থামল। একবার শিশিরের ঠোঁটের দিকে তাকাল তো একবার চোখের দিকে। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে। শিশির হাসছে। কুয়াশা শিশিরের ঠোঁট সাথে ঠোঁট দিয়ে পিঠার টুকরো টা কেঁড়ে নিল নিজের মুখের মাঝে কিন্তু মুখ না উঠিয়ে জোরে সোরে একটা কামড় দিল শিশিরের ঠোঁটে। আজ কামড়টা উপরিভাগে দিল না। কামড় দিয়ে ভেবেছিল মুখ তুলে নেবে কিন্তু তার চালাকিতে মাত দেবার জন্য তো স্বয়ং বুনো ওল আছেই? সে কি কম যায়? এরা কেউ কারো থেকে কম না৷ তাই কুয়াশা যখনই কামড় দিয়ে উঠে আসতে নিল ঠিক তখনই শিশির কুয়াশার মাথার পেছনে খপ করে পেড়ে ধরল। এরপর কুয়াশার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে একটা গভীর, গাঢ় চুমু খেল। খেয়ে তৎক্ষনাৎ একটা জোরে সোরে কামড় বসিয়ে দিল৷ কামড়টা সে দিল একদম পারফেক্ট জায়গায় যেটা ঠোঁটের ভেতরের অংশ যা বাহির থেকে বোঝা যাবে না৷
কুয়াশা গুঙিয়ে উঠল। কেটে গেল বোধহয়। ছেড়ে দিল কুয়াশাকে। মুখ উঠিয়ে দুই ঠোঁট দ্বারা তেল মুছতে মুছতে মিটমিট কারে হাসল। এরপর নিজের দুই হাত থেকে ধুলো ঝাড়ার মতো করে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
” আইছে, আমার সাথে পাঙ্গা নিতে। ”
কুয়াশা নিজের মুখের মধ্যেকার পাকান টুকু চিবিয়ে খেতে খেতে বলল,
” ওরে আমার বাহাদুর রেহ্! ”
” দেখিয়েই তো দিলাম আমার বাহাদুরি! ”
” হাহ্। ”
বলে মুখ ঝামটিয়ে কুয়াশা গাল ফুলিয়ে বসে থাকল৷ শিশির হাসল তা দেখে। কুয়াশাকে টেনে বুকের উপর ফেলল। বলল,
” তা ডাবল মিষ্টিতে টেস্ট কেমন পেলি পিঠায়? ”
তা শুনে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কী নির্লজ্জ মার্কা লোক গো তুমি? ”
শিশির এবার জোরে জোরে হেসে দিল। কুয়াশা শিশিরের ডান পাশে বুকে মাথা রেখে বাম মুখো মুখ করে দুই হাতে শিশির কে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে রাখল আর মিটমিট করে সে-ও হাসতে লাগল৷
দুপুর একটা। খাওয়া দাওয়া করে প্রায় রেডি হয়ে গেছে সকলে৷ সেদিনের গাড়ি দুটোকে তুষার কল করে আবার আনিয়েছে সকালের দিকে।
‘
এদিকে মিহির ঈশাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে এসেছে। ঈশা কিছুটা বিরক্ত। এখন সকলে চলে যাবে এই সময় এমন টেনে আনার মানে আছে? যা বলার ফোনেও তো বলা যেত? বলল,
” সকলে বের হয়ে গেছে, খুঁজবে আমাকে যা বলার জলদি বলো”
” এ্যাই ধানিলঙ্কা! তোর এত দেমাগ কেন রে? অনুভূতি বুঝিস না? আজ এতদিন ধরে বলে যাচ্ছি পাত্তায় দিচ্ছিস না। সমস্যা কী তোর? ”
” তুমি জানো না? আমাদের এ্যজ ডিফারেন্স মাত্র ওয়ান ইয়ার। এত কম এ্যজ ডিফারেন্সে সম্পর্কের ভবিষ্যত কী হবে? তোমার সেটেল্ড হতে হতে আমার অন্য ঘরে সংসার করার বয়স হয়ে যাবে ”
” মানুষ সেম ইয়ারে রিলেশন করে না?”
” করে কিন্তু সেসব আমার কাছে ভিত্তিহীন লাগে। বিয়ে করে বউ খাওয়াতে পারে না আর পারলেও বাপের টাকায় নয়তো সেটেল্ড হয়ে বিয়ে করতে করতে বয়স হয়ে যায়। তোমার কী মনে হয় আমার বাবা এত দিন বিয়ে না দিয়ে আমাকে রেখে দেবে? বুবুকে রাখার কারণ ফুপুর জন্য। আমাকে এতদিন রাখবে না বলেছে”
” একটা সুযোগ তো দিতে পারিস নাকি? আমার জন্য একটু সেক্রিফাইজ করতে পারবি না রে ধানিলঙ্কা?”
এমন ভাবে বলল মিহির ঈশার মায়া হলো অনেক৷ তাছাড়া এতদিন কথা বলতে বলতে সুপ্ত একটা অনুভূতিও কাজ করে কিন্তু সেটাকে দমিয়ে রেখেছে ঈশা৷ সে আবার বলল,
” তোর বিয়ে দিতে চাইলে বলবি, তুই অনার্স কমপ্লিট করে বিয়ে করতে চাস। ততদিনে আমি একটা কিছু করে ফেলতে পারব ইনশাআল্লাহ। বিএসসি টা করেই বিসিএস দেবার চেষ্টা করব। ততদিন একটু অপেক্ষা করে নে না! প্রয়োজনের দু এক বছর পর বাড়িতে জানিয়ে দেব আমি। তোদের বাড়িতেও কথা বলাব৷ শুধু শশীর বিয়েটা হয়ে গেলে সব করতে পারব৷ বোন পাড় না করে কিছু বলতে পারব না বাড়িতে! একটা সুযোগ দে ধানিলঙ্কা! ”
ঈশা গভীর নজরে চেয়ে রইল মিহিরের দিকে। মিহির আবার বলল,
” সত্যি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি। আগে অনেক মেয়ের সাথে কথা বলতাম এখন সেটাও বলি না। বিলিভ মি! ”
ঈশা এবার মিহিরের কাছে এগিয়ে গেল৷ এরপর মেকি রাগ নিয়ে মিহিরের টিশার্টের কলারের সামনে বাম হাতে মুঠো পাকিয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে ডান হাতের তর্জনী তুলে শাসানি ভঙ্গিতে বলল,
” এরপর থেকে আর কারো সাথে কথা বললে খু–ন করে রেখে যাব বলে দিলাম!”
বলা শেষ করে মিহিরের পাতলা চিকন শশীরটা ধাক্কা দিল। মিহির হাসল। ঈশা বলেই হাঁটা ধরল। মিহির হাসতে
হাসতে বলল,
” এ্যাই ধানিলঙ্কা..! ভালোবাসি রে ”
ঈশা শুনেও না শোনার মতো করে নিঃশব্দে হাসতে হাসতে চলে গেল।
সকলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। কুয়াশা আস্তে আস্তে বৃষ্টিদের সাথে এগিয়ে গেল। নীহার শশীর সাথে কথা বলছে। সকলে এ নিয়ে কিছু বলেনি। বিদায় বেলায় একটু কথা বলে নিক। তারা এখনো বাড়ির মধ্যে। শিশির গাড়ির কাছে এসে তুষারকে বলল,
” ভাইয়া এক ঘন্টার বেশি রাস্তা কুয়াশা বসে থাকতে পারবে এতক্ষণ? ”
” বুঝছি না৷ এছাড়া কোনো উপায়ও নেই একটু কষ্ট করে যেতেই হবে ”
শিশির আর কিছু বলল না৷ সকলে সকলের থেকে বিদায় নিল। আজমিরা, আম্বিয়া জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলেন। জাকির মালিথারা হানিফ সাহেবের কাছ থেকে হাসি মুখে বিদায় নিলেন। সৌরজ, সিমী, মিহিরের থেকে সকলে বিদায় নিল৷ এরই মাঝে শশী কান্না মুখ করে নীহারের সাথে বেরিয়ে এলো। শশী আসতেই আম্বিয়া, আজমিরা, জাকিয়া, কুয়াশারা সকলে জড়িয়ে ধরে ধরে সান্ত্বনা দিল৷ এ-ও বলল খুব জলদি নিয়ে যাবে তাদের কাছে। শশী এবার আর নিজেকে দমাল না কেঁদে দিল ঝরঝর করে বৃষ্টিদের জড়িয়ে ধরে। বৃষ্টিরা মুচকি হেসে সান্ত্বনা দিল। নীহারের মন ভার। সে কিছু বলল না। এরপর সকলে একে একে গাড়িতে উঠে বসল। নীহার শশীর দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে মুচকি হাসির রেখা টেনে গাড়িতে উঠে পড়ল। আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না৷ অনুভূতিরা বিষাদময় হয়ে উঠেছে। অন্তর জ্বলে যাচ্ছে। ভালোবাসার প্রিয় মানুষের থেকে দূরে থাকা যে কতটা কঠিন যারা থাকে তারাই একমাত্র এর জ্বালা বুঝে।
শিশির আজ কুয়াশার পাশে বসল। বৃষ্টি শ্বশুরদের গাড়িতে উঠল। আজ আর ঠাসাঠাসি করে বসতে ইচ্ছে করল না৷ সকলে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল। সকলে গাড়ির ভেতর থেকে বিদায় নিল আরো একবার। এ যাত্রাটা সকলের জন্য কষ্টের মনে হচ্ছে। দুইদিন থেকে অনেক স্মৃতি তৈরি হয়ে গেছে। রিজভী মিহির, সৌরজকে আরো একবার বলল। তারপর চলে গেল গাড়ি তার গন্তব্যে আপন গতিতে। রেখে গেল গাড়ির মধ্যে থাকা এক একটা মানুষের এই গ্রামের প্রকৃতিতে নানান রকম ভালোলাগা ছোট বড় অনুভূতি ও স্মৃতি। আবার সুযোগ হলে আল্লাহ চাইলে দেখা হবে এই অপূর্ব গ্রামটাকে। শশী টলমল চোখে চেয়ে রইল যতদূর দেখা গেল৷ নীহার গাড়ির ভেতর থেকে মুখ বের করে তাকিয়ে ছিল। গাড়ি অদৃশ্য হতেই শশী আর দাঁড়াল না। তার ছোট্ট হৃদয়টা বড্ড পাগলামি করছে। কষ্ট হচ্ছে অনেক।
ধরিত্রীতে সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারিদেকে আজানের ধ্বনিতে মুখরিত। শিশির কুয়াশাকে নিয়ে কুষ্টিয়ার পুপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিঃ এর লিফট থেকে বেরিয়ে নেমে বাহিরে এলো। সাথে নীহার, তুষার, তুহিন আছে। বাকিরা বাড়িতে চলে গেছে।
নীহার গিয়ে দু’টো সিএনজি ডাকল। একটাতে শিশির কুয়াশা উঠল শুধু, অন্যটাতে ওরা তিন ভাই।
কুয়াশাকে নিয়ে তারা তিনটার দিকে হসপিটালে আসে এরপর ডক্টরকে দেখালে কোমড় এক্স-রে সহ এমআরআই করতে দেয়। সে-সব করে ডক্টরের সাথে কথা বলে সকল ফর্মালিটি পূরণ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
কুয়াশা মেরুদণ্ডের কোমড়ের হাড়ে আঘাত পেয়েছে সাথে মাংসপেশির উপরিভাগে আঘাতটা পাশে থাকা শানের সাথে আঘাত পায় এর কারণে মাংস সহ হাড়ে আঘাত লাগে এছাড়া উপর থেকে নিচে শক্ত মাটিতে পড়ার কারণে মেরুদণ্ডের কোমড়ের হাড়ে ভালোমতোই আঘাতটা লেগেছে। শুধু মাংসে লাগলে এতটা সমস্যা হতো না যেহেতু মেরুদণ্ডের হাড়ে লেগেছে এজন্য ব্যথাটা মারাত্মক রূপ নিয়েছ। হাঁটা সহ বসাতেও সমস্যা করছে। হাড়ের ব্যথা সব থেকে বেশি যন্ত্রণাদায়ক। কুয়াশাকে টোটালি তিন সপ্তাহ বেড রেস্টে থাকতে বলা হয়েছে। সেখানে দুই সপ্তাহ তো মাস্ট থাকতেই হবে। প্রয়োজন ছাড়া হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। এছাড়া বাড়িতে প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসাও নিতে বলেছে৷ সেটা গরম পানি ঢালা বা গরম পানির সেঁক দেয়া৷
উপরক্ত কথাগুলোই সিএনজির মধ্যে শিশির কুয়াশাকে বলতে বলতে বাড়ি ফিরছে। কুয়াশা মুখ বুজে গিলছে৷ বসতে সমস্যা হচ্ছে বলে এক পাশ করে শিশিরের বুকে হেলান দিয়ে আছে। শিশির বকবক করছে। একসময় কুয়াশা বলে উঠল,
” একটা ইন্টারেস্টিং কথা শুনবা? ”
শিশির বেজায় বিরক্ত হলো৷ সে বলছে গুরুত্বপূর্ণ কথা আর ফাজিল মেয়েটা আছে ইন্টারেস্টিং কথা নিয়ে? এতক্ষণ সে যে বকবকগুলো করল সেগুলো কি আদৌ শুনেছে এ? ধমকে বলল,
” এ্যাই! তোকে যে আমি এতগুলো ইম্পরট্যান্ট কথা বলছিলাম শুনেছিস একটাও? ”
কুয়াশা চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
” শুনেছি, রাখো তো ওসব৷ বাড়ি গিয়ে শুনব আবার।”
শিশিরের মনটা চাইল এটাকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে৷ বিরক্ত নিয়ে চুপ করে রইল। কুয়াশা আবছা আলোয় শিশিরের মুখটা দেখার চেষ্টা করল মাথা তুলে। গাড়ির ভেতর তারা দু’জনই শুধু৷ সামনে ড্রাইভার। শিশির সামনে তাকিয়ে আছে। কুয়াশা বলল,
” হসপিটালে একটা নার্স কী বলছিল শুনবে? ”
শিশির প্রত্যুত্তর করল না। কিন্তু সামনে তাকিয়ে কুয়াশার বলতে চাওয়া কথাটা শোনার জন্য কান পেতে রাখল৷ কুয়াশা বুঝে উঠে বলল,
” আমি বসে ছিলাম তোমরা ছিলে না কেউ তখন। একটা নার্স এসে বলল, আপা আপনি একা বসে আছেন কেউ নেই সাথে? আমি বললাম, হ্যাঁ আছে তো আমার ভাইয়ারা আছে। মেয়েটা বলল, ও তো কোথায় গেছেন উনারা? আমি উত্তরে বললাম, ডক্টরের সাথে কথা বলছে৷ মেয়েটা খুব চালাক ছিল বুঝেছ মেয়েটা তোমাদের দেখেছেও বুঝেছেও আমি একা নই তোমরা ছিলে। কিন্তু মেয়েটা মেবি ক্রাশ খেয়েছিল। তবে কার উপর বুঝি নি। তো মেয়েটা আমার সাথে কিছুক্ষণ খোঁস গল্প করে সব ভাই কী করে না করে জিজ্ঞেস করতে লাগল৷ এও জিজ্ঞেস করল সকলে সিঙ্গেল কিনা৷ আমি তো তখনি বুঝে গেলাম ঘাপলা আছে মেয়েটার মনে। এরপর তোমরা বেড়িয়ে অন্য সাইটে গেলে না? তখন সে আবার তাকিয়ে দেখে তোমার কথা বলল আপা আপনি একটা মাত্র মেয়ে সব ভাই কইটা কী সুন্দর যত্ন নেয় আপনার। আপনি খুব লাকি ইত্যাদি, ইত্যাদি। উত্তরে মাথা নাড়িয়ে হুঁ বললাম শুধু। ওমা পরক্ষুণে মেয়েটা তোমাকে দেখিয়ে বলে আপা আপনার ঐ ভাইটা কী সিঙ্গেল নাকি মিঙ্গেল? আমি শোনা মাত্র চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। মেয়েটা বোধহয় ভয় পেয়েছিল৷ যায়হোক আমি কী উত্তর দিছি যানো? ”
শিশির এতক্ষণ বেশ আগ্রহ নিয়েই শুনছিল কুয়াশার ইন্টারেস্টিং গল্পটা৷ প্রশ্ন পেয়ে বুকের দিকে কুয়াশার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কি? ”
কুয়াশা উত্তর পেয়ে বেশ খুশি হলো বুঝল শিশির আগ্রহ নিয়ে শুনছে গল্পটা। তাই সে-ও আবার বলা শুরু করল,
” আমি বললাম, সেটা যেনে কী করবেন? মেয়েটা বলল, জানতে চাইলাম আরকি। আমি বললাম, ছেলেটা খুব বাজে বুঝলেন! আমাকে শুধু মা-রে আর প্রচুর ঝগড়াইট্টা মাইয়াগো মতো ঝগড়া করে শুধু৷ জীবন আমার তেজপাতা করে দিল। এটার জন্য জীবন আমার ফাটা বাঁশের চিপকায় চিপকাইয়া যাবার মতো হয়েছে৷ আফসোস আমার জীবনের প্রতি। ঐ বুনো ওল আই মিন ওটার থুক্কু ঐ ছেলেটার সাথে আমাকে ধরে বেঁধে চিপকায় দেয়া হয়েছে আই মিন বিয়ে দেয়া হয়েছে। ঐ তিনটা আমার ভাই হলেও ঐ ব্ল্যাক শার্ট পরা অতি সুদর্শন ছেলেটা না? ওটা আমার স্বামী। এখন বলেন সিঙ্গেল নাকি মিঙ্গেল? সব শুনে মেয়েটার মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল বুঝলে! কিন্তু আমি বুঝলাম না মেয়েটা ফাটা বেলুনের মতো ওমন চুপসে কেন গেল? আর তৎক্ষনাৎ উঠেই বা গেল কেন? কী সুন্দর কথা বলছিল আমার বেশ ভালোই লাগছিল। একা একা বোর ফিল করছিলাম। আচ্ছা যায়হোক সে ওমন এক্সপ্রেশন কেন দিল গো বলতে পারবা? ”
শিশির এতক্ষণ ভ্রু ম্রু কুঁচকে কুয়াশার গল্প শুনছিল কিন্তু শেষ কথাগুলো শুনে কুয়াশার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে জোরে জোরে হেসে ফেলল। কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে কুয়াশার দিকে তাকাল৷ কুয়াশাও মিটমিট করে হাসছে। সে বলল,
” তুই এত দুষ্টু কেন রে?”
বলে কুয়াশার ডান গালে আলত কামড় বসিয়ে দিল। এরপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” কারণ তোর ব্ল্যাক শার্ট পরা অতি সুদর্শন স্বামীর উপর ক্রাশ খেয়েছে মেয়েটা বুঝলি? তোর স্বামীর পাওয়ার কী দেখেছিস? ”
বলে কুয়াশা সেই কানের লতিতে ছোট্ট কামড় দিল। আবার বলল,
” তবে বেচারিকে এভাবে ছ্যাঁকা না দিলেও পারতি। অন্যভাবে বলতি। ডোজটা গভীর হয়ে গেছে। ”
” ঠিক করেছি। হুহ্ আইছে আমার স্বামীর উপর নজর দিতে। মেজাজ তো আমার তখনি চড়ে গেছিল তোমার কথা জিজ্ঞেস করাতে। মনডা চাইছিল চোখ দুটো তুইল্লা নিয়া মার্বেল খেলি। কতত বড় সাহস আমার স্বামীর উপর ক্রাশ খেয়ে আবার আমার কাছেই আসে!”
শিশির আবার হাসল৷
” তো বুঝে শুনে ডোজটা দিয়েছিস? ”
” হ্যাঁ, কী ভাবো আমায়? আমি বোকা? ”
” না তো, তুই গোবর ঠাঁসা।”
কুয়াশা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। শিশিরের কাঁধ বরাবর বাহুর উপর দাঁত বসিয়ে দিয়ে কামড় দিল৷ জোরে আর দেয় নি। স্বাভাবিক মতোই দিল। শিশির হাসল। বলল,
” তবে এতটাও ঠিক না। একটা মেয়ের ভালো লাগতেই পারে। এতে এত হিংসাত্মক হবার কিছু নেই। সে পছন্দ করলেই কী তোর স্বামী করছে? নাকি চলে যাচ্ছে? আর তোরও বলার ভুল প্রথমে ছিল। তুই ভাইয়ারা বলেছিলি। ফাজিল আমাকেও ভাইয়া বানিয়ে দিয়েছিলি! ”
কুয়াশা দাঁত বের করে হি হি করে হাসল৷,
” ভাইয়া-ই তো তুমি। এখন না হয় ভাইয়া থেকে সাইয়া হয়েছ! ”
শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল কথাটা। শিশির চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইল। কুয়াশা এবার টুপ করে শিশিরের গালে চুমু খেল। শিশির সামনে তাকিয়ে দেখল ড্রাইভার দেখল কিনা। কারণ সে কামড় দেবার সময় অন্ধকারে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আলোকিত। শিশির কুয়াশার দিকে তাকিয়ে মেকি রাগ নিয়ে বলল,
” ফাজিল হচ্ছিস দিন দিন। চল আগে বাড়ি যেয়ে নিই। এরপর কত চুমু দিতে পারিস দেখব।”
কুয়াশা পাত্তা দিল না৷ বুকের সাথে লেপ্টে রইল। কিছুক্ষণের মাঝে ওরা পৌঁছেও গেল৷ গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির মধ্যে গেল। সকলে শিশিরদের অপেক্ষাতেই ছিল। ওরা আসতেই সকলে কুয়াশার অবস্থা জিজ্ঞেস করল৷ শিশির সবটা বলল। জাকিয়া শুনে বললেন,
” সিঁড়ি ভেঙে বারবার উঠা নামা করবি না। আজ উঠবি এরপর আর নামবি না। সব উপরেই করবি। মেনে চললে জলদি সেরে যাবে”
কুয়াশা সম্মতি দিল। বলল,
” আর বসতে পারছি না আম্মু, ঘরে যাব আমি ”
সকলে সম্মতি দিলে সে চলে গেল। সিঁড়ির কাছে যেতেই শিশির অতি সাবধানে কোলে তুলে নিল। কুয়াশা চিল্লিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। পিছনে দেখল সব ওদের দিকেই চেয়ে আছে। কোলে করে নিয়ে যাবার বুদ্ধি জাকিয়া দিয়েছেন। এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে উপরে গেলে ব্যথা বাড়বে বয় কমবে না।
শিশির গা ছাড়া ভাব নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠছে। কুয়াশা বলল,
” এসব কী ধরণের ফাজলামি? ছিঃহ্ বাড়ির লোক কী ভাবছে? লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার ”
” তো মরে যাহ্।”
কুয়াশা চোখ বড় বড় করে আবার তাকাল। সে আবার বলল,
” ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, তোকে কোলে নেবার কথা তোর শাশুড়ীই আমাকে বলেছে। নয়তো তোর মতো আলুর বস্তাকে নিয়ে এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে ওঠার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার”
কুয়াশা বেজায় রাগল। কয়েকটা কি-ল, ঘু-ষিও দিল। শিশির হেসে ঘরে গিয়ে বসিয়ে দিল। বলল,
” শুয়ে থাক। অকারণে বসে থাকিস না। ”
কুয়াশা শুনে বোরকা খুলে বিছানার উপর রেখেই শুয়ে পড়ল। শিশির কুয়াশার বোরকা তুলে নিয়ে কর্ণার আলনার উপর রেখে নিজেও চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এলো। এসে বলল,
” ফ্রেশ হবি না? ”
” একটু পর যাচ্ছি, ব্যথা করছে বসে থাকতে থাকতে ”
শিশির কিছু বলল না। ঘর ছেড়ে চলে গেল।
এদিকে নীহার এসে নিচে আর বেশিক্ষণ থাকল না৷ তার ভেতরে ঝড় শুরু হয়েছে। সেই ঝড় আগে থামাবে এরপর কথা। সে নিজের ঘরে জলদি গিয়ে চেঞ্জ টেঞ্জ না করেই আগে শশীকে সরাসরি ভিডিও কল দিল। শশী বোধহয় নীহারের কলের অপেক্ষাতেই ছিল। কিছু সেকেন্ড না পেরুতেই রিসিভ হলো। সাথে সাথে নীহার তার পাখির মুখটা দেখতে পেল আর ভেতরের সব ঠান্ডা হয়ে গেল। এতক্ষণ প্রলয় হচ্ছিল তা নিমেষে থেমে গেল৷
কিছুক্ষণ দেখল শশীকে। চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। দেখেই মুচকি হাসল৷ কী পাগলী মেয়েটা ভাবা যায়! এই বয়সে একে তো প্রেম করেছে তারউপর আবার এঙ্গেজও করেছে এখন আবার বরের বাড়ি আসার জন্য নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে। ভেবেই আবার হাসল। মেয়েটা বাচ্চা কিন্তু আবেগুলো খাঁটি। ভালোবাসা কতটা গভীর হলে এই সদ্য সতের বছরের মেয়ে এমন করতে পারে? ভাবতেই প্রশান্তিতে অন্তর, কায়াতে ছেয়ে গেল।
দু’জনেই দু’জনকে আগে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে নীহার বলল,
” কেঁদেছ কেন এত? ”
” কষ্ট হচ্ছে আমার। ”
নীহার কী বলবে? বুঝল না। তারও তো একই অবস্থা! সে এসব কথা রেখে বলল,
” খাওয়া দাওয়া করেছ? ”
” কারেন্ট নেই, আসলে খাব। আপনি খেয়েছেন? ”
” না মাত্রই বাড়িতে এলাম৷ তোমাদের ওখান থেকে কুয়াশাকে নিয়ে হসপিটালে গেছিলাম। একটু আগে আসলাম। না চেঞ্জ করেছি আর না ফ্রেশ হয়েছি।”
কথাটা বলে নীহার নিজেও একটু অপ্রস্তত হলো। মেয়েটা এমনি কষ্ট পাচ্ছে তারউপর এমন কথা বলাটা ঠিক হলো না। সে-ও কী শশীর মতো আবেগে বাচ্চা হয়ে গেল? কথার খেই হারিয়ে ফেলছে কেন? কী সব পাগলামো করছে! নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু ওদিকে ফোনের ওপাশে যা হবার তা হয়েই গেল। শশী নীহারের কথাটা শোনা মাত্রই কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঝরঝর করে কেঁদে দিল আবার। নীহারের এবার নিজের গালে নিজেরই থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে। একেতো একটা বাচ্চার প্রেমে পড়ে জীবন তার ত্যানা ত্যানা তারউপর এখন আবেগে সে নিজেও হাবুডুবু খাচ্ছে।
তড়িঘড়ি করে শশীকে থামাতে লাগল। কিছুক্ষণ মিষ্টি মধু বাণী দিয়ে যখন কাজ হলো না তখন ধমক দিল। শশী ধমক খেয়ে থামল। নীহার নরম স্বরে বলল,
“এ্যাই পাখি কেঁদো না আর। আমরা এই দেখো এক সাথে আছি! আর এমন আবেগী হয়ে যদি পড়াশুনোর ক্ষতি করো তো বিয়ে কিন্তু ক্যান্সেল! সো পড়াশুনোয় মন দাও। কারেন্ট আসলে খেয়ে পড়তে বসবা ঠিক আছে? ”
” হুঁ, কুয়াশা বুবুকে কী বলেছে ডক্টর? ”
নীহার সবটা বলল। এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে নিজেদের মন শান্ত করে ফোন রাখল। ফোন রেখে নীহার ঢাস করে শুয়ে পড়ল। চোখ বুঝল৷ গত দুইদিন শশীর সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠতে লাগল।
ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত জিনিস। তার রঙ যে কেমন কেউ বলতে পারবে না৷ এক একটা মানুষের কাছে ভালোবাসার রঙের বর্ণনা এক এক রকম। সেই রঙ কখনো হাসি, খুশি, আনন্দ, সুখ দেয় তো কখনো ক্ষুদ্ধ রূপ নেই আবার কখনো বিষাদময় হয়। বিষাদময় রঙটা হয় কঠিন, গাঢ় ভারী যেটা হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। কিন্তু নীহার আর শশীর ভালোবাসার রঙ এখনো আনন্দের তারা পূর্নতা পেতে চলেছে। তাদের ভালোবাসার একটা নাম হয়েছে। কথাটা হঠাৎই চোখ বুঁজে পড়ে থাকা নীহারের মস্তিষ্কে এসে হানা দিল। তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে তাকাল। বাম হাতের অনামিকা আঙুলে নজর দিল। সেখানে রূপোর সাথে পাথরের কাজ করা অসম্ভব সুন্দর একটা আঙটি শোভা পাচ্ছে। আঙুলে একটা চুমু দিল, গন্ধ নিল এখানে শশীর ছোয়া সহ গন্ধ আছে মনে হলো তার কাছে। পরক্ষণেই নিজের করা কাজে নিজেই অবাক হয়ে গেল। তার করা পাগলামির কথা ভেবে হেসে ফেলল শব্দ করে। হেসে উপর হয়ে শুয়ে বালিশ আঁকড়ে ধরল। চোখ বন্ধ করে আওড়াল,
” নীহার তুই তো একদম গেছিস! পাগল হয়ে গেছিস তুই। একটা বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পড়ে তুই পাগল হয়ে গেছিস৷ ঐ বাচ্চা মেয়েটা তোকে ভালোবাসার অথৈ, অতল সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে আর ওঠার ক্ষমতা নেই তোর। এখন সারাজীবন তোর হাবুডুবু খেতে হবে আর সাঁতার কাঁটতে হবে। ডুবেডুবে বাঁচতে হবে তোর ভালোবাসা নামক ঐ অথৈ সাগরে ”
পরেরদিন কাক ডাকা ভোর। শিশির গত রাতেও কুয়াশাকে সেঁক দেয়া থেকে শুরু করে পেইন রিলিভার দিয়ে ম্যাসাজ করে দিয়েছে অনেকটা সময় নিয়ে। কুয়াশার ব্যথায় টনটন করছিল জায়গাটা। কোমড়ের ব্যথার জন্য দু’টো পাও ব্যথা হয়ে উঠেছে ভাবে লাগছে তার। পুরো অস্থিমজ্জায় ব্যথায় ছেয়ে গেছে। কী নিদারুণ কষ্ট, যন্ত্রণায় ভুগতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে দিন দিন ব্যথা বাড়ছে। কিন্তু বেশি কিছু বলতে পারছে না শিশিরের ভয়ে। এছাড়া আজমিরাও বেশ বকাবকি করে করে যাচ্ছেন। মেয়েটার হয়েছে যত জ্বালা। একটা ভুলের জন্য বকা শুনতে শুনতে কান পঁচে গেল। গত রাতেও অনেকটা রাত কাতরিয়েছে সে। সব রোগ তো আর একদিনে যায় না! রোগ মানেই ভোগান্তি। ভুগতে তো হবেই একটু!
শিশিরের ঘুম ভাঙল। কুয়াশা ঘুমে। চোখ খুলেই ঘুমন্ত কুয়াশাকে দেখতে পেল৷ তারই বুকের কাছে গুটিশুটি মে-রে ঘুমচ্ছে। কিছুক্ষণ দেখে কুয়াশার গলার মাঝে মুখ ডুবিয়ে গাঢ় একটা চুমু দিল। নড়েচড়ে উঠল কুয়াশা। হাসল তা দেখে৷ উঠে পড়ল সে।
সকাল আটটা। নিচে কুয়াশা বাদে সকলে খাবার খাচ্ছে। বৃষ্টি কনসিভ করার পর থেকে সকালেই খেয়ে নেয়। ঘণঘণ খিদে পায় তার কিন্তু অল্প খেতে পারে। এই জন্য শাশুড়ী ঘণঘণ খেতে বলেছে৷ বৃষ্টির দিকে জাকিয়া খুবই যত্নশীল। এছাড়া আজমিরা অনেক যত্ন নেন বৃষ্টির। সিঁড়ি ভেঙে বেশি ওঠা নামা করতে দেন না। আম্বিয়া স্কুলে থাকে বেশি কিছু করতে পারেন না। তবে এসে ফ্রিলি অনেক পরামর্শ দেন তিনি। প্রথম প্রেগন্যান্সিতে সব মেয়েরাই অজান্তা থাকে। সেগুলোই তিনি সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন। কীভাবে চলতে হবে না হবে সব বলেন কাছে বসিয়ে। আম্বিয়া মানুষটা ব্যবহার অমায়িক কিন্তু একটু ইন্টোভার্ট স্বভাবের। তবে খুব বেশি না।
এই বাড়িতে জা’য়েদের মিল ভাইয়েদের মেল বন্ধন ধরে রাখার একমাত্র কৃতিত্ব জাকিয়ার। তিনি সর্বপ্রথম এ বাড়িতে এসে এই বাড়ির প্রতিটি মানুষকে নিজে হাতে গড়েছেন, বেঁধেছেন৷ দুই জা যখন বিয়ের পর এসেছিলেন তিনি নিজে সব বুঝাতেন। সংসারে সকলের সাথে মিলেমিশে থাকার উপদেশ দিতেন এছাড়া তিনি নিজেও অমায়িক ব্যবহার করতেন৷ যা আম্বিয়া, আজমিরা কেউই উপেক্ষা করতে পারেন নি৷ আসলে কথায় বলে না? বড়দের দেখেই ছোটরা শেখে! আর সেই জিনিসটায় এই বাড়িতে ঘটেছে৷ জাকিয়া বড় জা তার থেকে বাকি দুটো শিখেছে। তিনিই বাড়ির প্রতিটি কোণা, দেয়াল, সদস্য নিজের মতো করে বেঁধে রেখেছেন। কখনো জা’য়েদের সাথে হিংসা বিবাদ করেননি, কাউকে করার সুযোগও দেননি৷ এভাবেই বছরের পর বছর চলতে চলতে এখন এত ভালো মেলবন্ধনটা এই বাড়ির অভ্যাস হয়ে গেছে।
জাহিদ মালিথা আজ চলে গেলেন৷ সকলে সকলের গন্তব্যে গেলেন। শিশির খেয়ে উপরে এলো। সে ক্যাম্পাসে যাবে। শনিবার থেকে পরীক্ষা তার৷ উপরে এসে দেখল আজমিরা খাওয়াচ্ছেন একমাত্র মেয়েকে। মেয়েটা অসুস্থ হলে এ ভাবেই তিনি মেয়ের যত্ন নেন আবার বকেন। মায়েদের মন কিনা! শিশির এসে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আজমিরার উদ্দেশ্যে বলল,
” ছোট আম্মু, তোমার মেয়ে যেন তিড়িং বিড়িং না করে বেড়ায়। আর নিচে যেন না যায়৷ প্রয়োজন ছাড়া নিচে নামতে দেবে না। ঘরেই যেন থাকে৷ ঔষধ গুলো ঠিকমতো খাইয়ে দিয়ো আর দুপুরে গরম পানির সেঁক সহ পেইন রিলিভার দিয়ো। আমার আসতে লেট হবে আজ৷ রাতও হতে পারে। ”
বলে এবার কুয়াশার উদ্দেশ্যে বলল,
” যেগুলো বললাম একটাও এদিক ওদিক করবি তো না ভাঙা কোমর আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে ভাঙব ”
বলে চলে যেতে যতে দু’জনেরই উদ্দেশ্যে বলে গেল৷ দাঁড়াল না আর। আজমিরা মিটমিট করে হাসছেন। আর কুয়াশা কাঁদো কাঁদো হয়ে বসে রইল৷ মানে সারাদিন এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে? এটা কী ভালো লাগে? বলল,
” হেসো না তো। ওর শয়তানটার সাথে বিয়ে দিয়ে জীবন আমার তেজপাতা করে দিয়েছ। অন্য ছেলের সাথে বিয়ে হলে এত শাসন শুনতে হতো না। ”
আজমিরা ধমকে বললেন,
” এ্যাই.. কথা ঠিক কর, স্বামী সে তোর! শাসন করার সে-ই করবে। ভালোবাসার মতো বাসবে শাসনও করবে৷ এটাই স্বামীদের অধিকার। বেশি এ্যাড়িত্যাড়ি করবি না৷ যা বলে গেল মানার চেষ্টা করবি৷ কতটা চিন্তা হয়েছে তোর প্রতি দেখেছিস? বলেছিলাম না ছেলে আমাদের লাখে একটা! মানতে পারলে সুখী হবি। মিলল তো! ”
কুয়াশা প্রত্যুত্তর করল না। মায়ের কাঁধে মাথা রাখল৷ বড়দের কথায় ফলে গেছে৷ মেনে নেবার পর থেকে জীবনের প্রতিটি দিন রঙিন হয়। আজমিরা কিছুক্ষণ কথা বলে ঔষধ খাইয়ে রিলিভার দিয়ে ম্যাসাজ করে দিয়ে চলে গেলেন। বলে গেলেন বৃষ্টিদের পাঠিয়ে দিচ্ছে গল্প করার জন্য।
রাত নয়টা বেজে পাড়। শিশির সেসময়ে বাড়ি এলো। এসে ঘরে ঢুকে দেখল কুয়াশা নেই। শিশিরের মেজাজটা গরম হয়ে গেল। ওকে বলা হয়েছে হাঁটাহাটি করবি না আর সেই কাজই বেশি করে করছে? চেঞ্জ না করেই ঘর থেকে বের হবার সময় দেখল কুয়াশা আসছে। শিশিরকে দেখে বলল,
” এত লেট হলো কেন আজ? ”
” তোকে মানা করা হয়নি হাঁটাহাঁটি করবি না? এ্যাই কার ভালোর জন্য আমি বলছি? আমার ভালোর জন্য? তোর কী ইচ্ছে হয়না একটা কথাও মেনে চলতে? চল তুই তোর মতো। যা ইচ্ছে কর। চোখের সামনে থেকে দূর হ। ”
রেগে, ধমকে কথাগুলো বলে ওয়াশরুমে চলে গেল। কুয়াশা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। সে তো হাঁটাহাঁটি সারাদিন করেই নি! সারাদিন শুয়ে থেকে পিঠ লেগে গেছিল বলে নিজের ঘরে গিয়ে উপন্যাস বই পড়তে ছিল সেটাও শুয়েই। এটুকু হাঁটাহাঁটি না করলে কীকরে হবে? মানা করেছে বলে কী পঙ্গু হয়ে বসে থাকতে হবে? আর কথা না শুনেই রাগ ঝেড়ে চলে গেল? তারও রাগ হলো। সে-ও গাল ফুলি বিছানায় শুয়ে পড়ল। থেকে থেকে ব্যথা ফিরছে শুধু। এখনো ব্যথা আসছে। তাই চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল।
শিশির শাওয়ার নিয়ে বেরলো। কুয়াশাকে শুয়ে থাকতে দেখে আবার মেজাজ তুলল,
” এখন শুয়ে আছিস কেন? যাহ্ ধেই ধেই করে বেড়া! ”
বলেই চলে গেল নিচে। রাতে এখনো খায়নি সে। কুয়াশা কোনো কথায় বলল না। শুয়ে রইল। খারাপ লাগছে অযথা বকা শুনে। দোষ যেখানে করেই নি সে! সুস্থ থাকলে বোধহয় এই না জেনে বকার শাস্তি দিয়ে দিত শিশিরকে। সবসময় বলা হয় সঠিকটা জেনে রাগ দেখাতে। তবুও এরকম করবে।
কিছুক্ষণের মাঝে শিশির এলো। দশটা বেজে গেছে। খেয়ে এসে পড়তে বসল। অনেক কিছু বাদ পড়ে আছে এই তিন-চারটা দিনে অনেকটা পিছিয়ে গেছে। মাথাটা এমনিতে সারাদিন রোদে রোদে ঘুরতে ঘুরতে গরম হয়ে ছিল তারউপর কুয়াশাকে নেচে বেড়াতে দেখে আরো গরম হয়েছে৷ রাগ নিয়ে দরজা দিয়ে টেবিলে বসল৷ কুয়াশা সবই দেখল৷ কষ্ট পেল কেন জানি এমন ব্যবহারে। যেটা এই পর্যন্ত হয়নি। ভালোবাসে বলে কী এমন হচ্ছে?
রাত এগারটার দিকে শিশির পড়ছে এখনো। সেসময়ে গোঙানির আওয়াজ পাচ্ছে। পেছন ঘুরে দেখল কুয়াশা কোমড় ধরে কাতরাচ্ছে। ব্যথা নিশ্চয়ই বেড়েছে! বাড়বেই তো ধেই ধেই করে বেড়াল এমন তো হবেই! মেজাজটা আবার গেল চড়ে তার। এই বে-য়াদের জন্য সে খেটে খেটে ম-রছে আর সে তার একটু কথাও শুনবে না। সারাটাদিন পর বাড়িতে এসে এখন এগুলো সহ্য করতে হবে? এই বে-য়াদবটাকে বিয়ে করে পর্যন্ত তার নানান চিন্তার শেষ নেই। এর জন্য ক্যারিয়ার গড়ার তোড়জোড় করতে হচ্ছে, নানান চিন্তা করতে হচ্ছে যেটা সে তার এতগুলো বছরেও করেনি। বাপের হোটেলে শান্তিতে খেয়েছে আর লাইফটা এনজয় করেছে। আর এখন এটাকে বিয়ে করে তার চিন্তার তো শেষ নিকো-ই সাথে লাইফটাকে প্যারাময় করে তুলেছে।
একে তো শনিবার থেকে পরীক্ষা সেসব চিন্তাও হচ্ছে। এখন আবার এর বসে বসে দায়িত্ব পালন করতে হবে? এসবই ভেবে শিশিরের মেজাজটা তরতরিয়ে বেড়ে উঠল।
এত আহ্লাদ কেন করতে হবে তার? কিসের এত আহ্লাদ তার? এত আহ্লাদ সহ্য হলো না। রাগের সাথে হাতের কলমটা টেবিলের উপর থাবা দিয়ে রেখে রাগে ফেটে পড়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ঝড়ের বেগে কুয়াশার কাছে গিয়ে এক ঝটকায় তুলে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। অনেকটা জোরে দিয়েছে৷ রাগে পুরো শরীরে রি-রি করছে তার। কুয়াশা ঝটকা দেয়াতে কোমড়ে ব্যথা তো পেলই সাথে থাপ্পড়ের রেশটাও সহ্য হলো না। টলমল চোখে চেয়ে রইল গালে হাত দিয়ে। শিশির চেঁচিয়ে বলল,
” এ্যাই, এখন এমন দাপাচ্ছিস কেন? সারাদিন যখন দাপাদাপি করেছিস তখন মনে ছিল না? গত দুইটা রাত আমাকে ঘুমাতে দিস নি। রাত জেগে তোর সেবা করেছি, অস্থিরতা দেখিয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করে চলেছি এসব কিছুই মনে হচ্ছে না তোর? কোনো মূল্য নেই? এত আহ্লাদ কীসের তোর? এতবড় মেয়ে হয়ে গেছিস তবুও তোর এসব কেন গেল না? কীসের আহ্লাদ দেখাস তুই? ”
বলে থেকে এবার নিজে নিজেই বলতে লাগল,
” জীবনটা আমার প্যারাময় করে তুলল এই আহ্লাদীকে ঘাড়ে গচিয়ে দিয়ে। এই বে’কুবের দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে আমার চিন্তার শেষ নেই। এক একটা দিন চিন্তা করতে করতে পাড় করতে হয়। লাইফটা আমার প্যারাময় করে দিয়েছে।”
রাগের মাথায় সে যে কীসের ভেতর কী বলে ফেলল সেটার হুশ নেই তার। রাগে, ক্ষোভে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে৷ আর এইরকম বার কয়েক হয়েছেও তার সাথে।
এদিকে শিশিরের মারের থেকে তার বলা শেষ কথাগুলো একদম বুকে গিয়ে লাগল কুয়াশার৷ বুকের ভেতর সব ভেঙে আসতে চাইল৷ কেউ যেন বুকটা ভেঙে দিতে লাগল৷ সুঁইয়ের ন্যায় ফুটতে লাগল বুকে। ভারী হয়ে গেল খুব বুকটা। খুবই লাগল কথাগুলো। তাকে ঘাড়ে গচিয়ে দিয়েছে? হাজার ভালোবাসা হোক না কেন কথাটা কুয়াশার বুকে পাথর সমান ভারী যন্ত্রণা দিল। টপটপ করে পানি পড়তে লাগল চোখ থেকে কোপল বেয়ে৷ শিশিরের দিকে ছলছল করে তাকিয়ে রইল। শিশির অন্যদিকে ঘুরে আছে। রাগ তার এখনো পড়ে নি। এবার সে বেলকনিতে চলে গেল।
কুয়াশা কোনো কথা-ই বলল না।
অশ্রুভরা নয়ন নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। ঝটকা দিয়ে তোলার কারণে টান লেগেছে আবার কোমড়ে সাথে কাঁধেও। এদিকে বুকের গভীর ব্যথা। বাবা বিহীন মেয়েটাকে দায়িত্ব দিয়েছে বাড়ির সকলে কিন্তু শিশির আজ তার সামনে বলল গচিয়ে দিয়েছে যেটা তার সহ্য হলো না ছোট মনে৷ সত্যি কী গচিয়ে দিয়েছে তাকে? চাইলে তো অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারত তাকে! আজ কেন জানি বাবার কথা খুব মনে পড়ল তার। আজ যদি তার বাবা থাকত! নিশ্চিয়ই দায়িত্ব নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিত? বাবার কথা ভাবতে ভাবতে তার বুক খসে পড়ে যেতে চাইল৷ গুমরে ভেতরে সব দলা পাকাতে লাগল। বার কয়েক তার মন, মস্তিষ্ক বাবা, বাবা ডাকটা আওরাল৷
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪৬+৪৮
কোমড় ব্যথা, কাঁধ ব্যথা, বুক ব্যথা সব মিলিয়ে সে ভেঙে যেতে চাইল৷ পা যেন আর তুলতে পারছে না। শরীরও উঠছে না ব্যথায়। চোখও টলমল কিছু চোখে দেখছে না৷ তবুও বহু কষ্টে ছোট ছোট পায়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল৷ বাবা নেই তো কী হয়েছে? তার মা তো আছে? সে এখনো এতিম হয়নি। কষ্টে, অভিমানে, ক্ষোভে বহু কষ্টে হেঁটে মায়ের ঘরের দিকে গেল সে।
