বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৫৫+৫৬
রোজা রহমান
রাতের অন্ধকার কেটে আলো ফুটেছে৷ কিন্তু মালিথা ভিলায় অন্ধকার কাটেনি, আলো ফুটেনি৷ তারা অন্ধকারেই তলিয়ে রইল। এক একটা সদস্য এখন অন্ধাকেরর মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।
ভোরের আলো ফুটতেই জাকিয়া আবার কান্না শুরু করেছেন৷ তিনি হসপিটালে যাবেন৷ স্বামীকে দেখবেন। নামাজ পড়ে তিনি এই একটা কথা-ই শুধু বলে চলেছেন। কেউ আঁটকে রাখতে পারছে না। ইয়াসমিন যখনি জানিয়েছে চাচুর জ্ঞান ফিরেছে সুস্থ আছেন এই কথা শোনার পর থেকে আরো অস্থির হয়ে উঠেছেন৷ তিনি নিজে চোখে দেখতে না পারলে শান্তি পাবেন না। এক প্রলাপ বলে চলেছেন। আজমিরা এত করে বলছেন তুষার এসে নিয়ে যাবে তবুও থামাতে পারছে না কেউ। অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। সকলে জাকিয়ার অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলেছে। বৃষ্টি কাঁদতে বলল,
” ও আম্মু একটু শান্ত হও। তোমার ছেলে আসবে এসে নিয়ে যাবে। তুমি একা যেতে পারবে না। একটু শান্ত হও! ”
এটা শুনে তিনি আবার এক প্রলাপ বলতে লাগলেন,
” কখন আসবে আমার ছেলে? কখন আসবে? আমার ছেলেরা কখন নিয়ে যাবে? তুষার কখন আসবে? এত দেরি করছে কেন? শিশির! শিশির কই? আমার শিশিরকে বলো আসতে। আমার তুষার আসতে পারছে না। শিশির তো পারবে আসতে। ও’কে বলো এসে নিয়ে যাক৷ তুষার ওর বাবার কাছে থাক। কখন আসবে ওরা? শিশিরকে বলো ওর মা ওর বাবাকে দেখবে। এখনি দেখবে।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
একভাবে বলে চলল কথাগুলো। জাকিয়াকে এখনো বিস্তারিত বলা হয়নি জাকির মালিথার বিষয়ে। ভোর থেকে এই পর্যন্ত অস্থির হয়ে শুধু প্রলাপ বকছেন। ইয়াসমিন শিশিরের কথা শুনে আম্বিয়ার দিকে তাকাল৷ এবার আম্বিয়া কেঁদে উঠল শব্দ করে। কী অবস্থা তার জা’য়ের? ছেলের কথা শুনলে কি করবে?
হিমেল মা’কে বলল সে বড় চাচুকে দেখতে যাবে৷ একা যদিও যেতে পারবে কিন্তু আজমিরা মানা করলেন৷ বললেন পড়ে যেতে৷
এদিকে শশীরা শুনে সকালেই সকলে রওনা দিয়েছে। জিনিয়া, শশী কেঁদে কেটে অস্থির। তারা শিশির আর জাকির মালিথার কথা সব জানে। দুই দুইটা মানুষের উপর দিয়ে এত বড় ঝড় চলে গেছে সেটা সকালে জানতে পারল। নীহার কাল এতটাই ব্যস্ত ছিল যে শশীদের জানাতে পারেনি। বাড়ির কেউই জানানোর মতো জ্ঞানে ছিল না। শশীকে রাতে কল না দেয়াতে সকালে সে নিজেই কল দিয়ে সব শুনে কান্না করে দিয়েছে। তার খালু, ভাইয়ের এত বড় বিপদ শুনে ঠিক থাকতে পারেনি৷ জিনিয়া একমাত্র দুলাভাই আর ছেলের এমন করুন অবস্থা মানতে পারছে না। সৌরজরা সকলে মিলে বুঝিয়ে শুনিয়ে বের হয়েছে। সৌরজই মামাদের ফোন করে জাকির মালিথার খবর দিয়েছে। জাকিয়ার ভাইরাও আসছেন দেখতে।
বৃষ্টি রাতে তার বাবাদের ফোনে সব জানিয়েছে। স্মৃতি রিজভীর থেকে রাতেই সব শুনেছে। রাতে আসতে চাইলে রিজভী সকালে আসার কথা বলেছে।
সকাল নয়টার দিকে হসপিটালে তুষাররা হালকা পাতলা নাস্তা করে সকলে বসে আছে। বাড়িতে যাবার কারো সাহস হচ্ছে না। কি বলবে বাড়িতে গিয়ে? কোন মুখে বলবে সত্যিটা? সব শুনলে মা’কে কি ঠিক রাখা যাবে? বাঁচানো কষ্ট হয়ে যাবে। তারা ছোট থেকে দেখে আসছে তার মা, বাবার বন্ডিং কতটা স্ট্রোং। এসব শুনলে মায়ের অবস্থা কী হতে পারে এই ভেবে পাগল হচ্ছে। জাহিদ মালিথাকে তুহিন বাড়ি যেতে বলল। কাল এসে পর্যন্ত এখানে তিনি। উনারও বয়স হয়েছে। এত কিছু সহ্যক্ষমতা তারও কম। কখন না তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
তুষার, নীহারও একই কথা বলল। জাহিদ মালিথা রাজি হলেন না। তিনি ভাইয়ের সাথে কথা বলে যাবেন বললেন৷ শিশির ঘুমচ্ছে তাই কেউ এখনো ডাকেনি। তার শরীরের অবস্থাও সকলের চিন্তার কারণ।
জাকির মালিথা ঘুমে আছেন। উনার সাথে এখনো কেউ দেখা করার সুযোগ পায়নি।
শিশিরের পায়ের এক্সরের রিপোর্ট দিয়েছে। গিড়ার হাড়ে হালকা ফ্র্যাকচার হয়েছে। ডক্টর জানিয়েছে দেড়-দুই মাস বেড রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে৷ ব্যান্ডেজ করা হয়েছে পায়ে৷
শিশির রিপোর্ট এখনো পায়নি। সব ভাইদের কাছেই জানিয়েছেন ডক্টররা।
সকাল দশটার দিকে শিশিরের ঘুম ভাঙল। কুয়াশা এতক্ষণ জেগে ছিল। শিশির ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমচ্ছিল বলে ডাকেনি।
নড়েচড়ে উঠে গলার মাঝে থেকে চোখ খুলে তাকাল। মাথা তুলে কুয়াশাকে দেখল। কুয়াশা চোখের কোণে পানি। বুঝল কাঁদছিল৷ কুয়াশাও তাকাল। ভাঙা ভাঙা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” শরীর কেমন লাগছে এখন? ব্যথা করছে আর? ”
শিশির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
” নাহ্, ঠিক আছি আমি। ”
” ওঠো অনেক বেলা হয়েছে। কিছু খেয়ে ঔষধ খাবে ”
বলতে বলতে উঠে বসল। শিশির বলল,
” ভাইয়াদের ডাক, নার্স এসে সব ঠিক করে দেবে। কল দে নীহার ভাইকে ”
কুয়াশা কিছুটা রাগল। বলল,
” নার্স কেন লাগবে? আমি আমার স্বামীর সেবা করতে পারব ”
বলে নেমে পড়ল। ফোন নিয়ে কল দিল নীহারকে। শিশির তাকিয়ে রইল৷ এখন তার বউয়ের দায়িত্ব পালনের দিন এসেছে। শিশির এতদিন তার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন কুয়াশার পালা স্বামীর দায়িত্ব নেবার৷
কুয়াশা কথা বলল। শিশিরকে ফ্রেশ করাতে একা পারবে না৷ সাহায্য লাগবে। কিছুক্ষণ পর নীহার এলো। রিজভী বাড়িতে গেছে একটু পর আবার আসবে। নীহার এসে নার্স ডেকে হুইল চেয়ারের আনাল। নীহার আর কুয়াশার সাহায্যে নেমে হুইল চেয়ারে বসল। কুয়াশা এই দৃশ্য দেখে কেঁদে দিল। তার জলজ্যান্ত সচল স্বামী আজ হুইল চেয়ারে? এর থেকে বাজে দৃশ্য আর কি হতে পারে?
শিশির নীহার বুঝল কান্নার কারণ। নীহার বোনকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে আশ্বাস দিল। জানাল,
” ডক্টর রিপোর্ট দিয়েছে। জানিয়েছে দেড়-দুই মাস রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে ”
শিশির নরম স্বরে বলল,
” চুপপ, ঠিক হয়ে যাবে সব ”
নীহার নিয়ে যেতে চাইল শিশিরকে। কিন্তু কুয়াশা নিতে দিল না। সেই নিয়ে গেল। নীহার সাহায্য করল শুধু৷ কুয়াশাই শিশিরের মুখ ধুয়ে দিল৷ তোয়ালে দিয়ে শরীর সহ হাত, পা মুছিয়ে দিল। কাল থেকে গোসল না করে আছে। তাই শিশিরই বলল শরীর মুছিয়ে দিতে। হসপিটালের জিনিস দিয়েই সব কাজ করছে। বাড়ি থেকে কিছুই আনা হয়নি। তাই মুখটা নিজের ওড়না দিয়ে মুছিয়ে দিল৷ শিশির শুধু তাকিয়ে রইল৷ তার ছোট্ট আহ্লাদী বউ-ও দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। শিশির নিজের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে একবারে ফ্রেশ হয়ে বেরলো। কুয়াশাও ফ্রেশ হয়ে নিল।
নীহার খাবার এনেছে। শিশির আসতেই আবার বসিয়ে দিল। নীহার বলল,
” খেয়ে ঔষধ খেয়ে নে ”
সে-সময়ে তুষার এলো। তুহিনও এলো। জাহিদ মালিথা ওদিকেই বসে আছেন৷ এদিকে আর এলেন না। বার বার উপর নিচ করলে সমস্যা হবে উনারও। শিশিরের হালচাল জিজ্ঞেস করল ভাইরা৷ কুয়াশাকেও খেয়ে নিতে বলল। দু’জনেই খেল অল্প করে। খেয়ে দেয়ে তুষারকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করল শিশির। কুয়াশাও অস্থির হলো এবার। জানাতেই হবে তাই আর কিছু লুকাল না। তুষার সবটা বলল। কথা তার জড়ানো।
এদিকে তুষার সবটা তো বলল কিন্তু কুয়াশা পানি ঢালতে ঢালতে সব শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তার চাচু আর চলতে পারবে না? তাকে চিনবেও না? কুহেলি মা বলেও ডাকতে পারবে না? এর থেকে নিঠুর যন্ত্রণা আর কি হতে পারে? বাবার মৃত্যুতে সে ভেঙে পড়েছিল বড় চাচু আগলে রেখেছিল। দায়িত্ব নিয়ে নিজেরই ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে কাছে রাখবেন বলে। আর আজ তার এ কী পরিণতি? বুক ভেঙে এলো এবার। আশার আলো নিভে গেল। ভেবেছিল সব ঠিক থাকবে। কিন্তু আর ঠিক নেই। সব শেষ হয়ে গেল। চাচুকে অচল অবস্থায় দেখার আর সাহস নেই তার। সহ্য হলো না তুষারের বলা কথাগুলো। না মস্তিষ্ক নিতে পারল আর না শরীর। ছেড়ে দিল এবার শরীর। কাঁদতে কাঁদতে শরীর ছেড়ে দিল। অজ্ঞান হয়ে গেল। কাল দুপুর থেকে এত কিছুর স্বীকার হলো মেয়েটা তবুও স্ট্রোং ছিল। চাচুর মেজর ব্রেইন স্ট্রোক শুনল, স্বামীর এক্সিডেন্ট শুনল এবং তা নিজের চোখেও দেখল৷ এখন চাচুর পরিণতি আর নিতে পারল না শরীর, মন কোনোটায়। পড়েই প্রায় গেছিল। কিন্তু নীহার, তুষার, তুহিন তিন ভাই পড়তে দিল না। তিনজনই আঁকড়ে ধরল বোনকে।
এদিকে শিশির বাবার কথা শুনে তো অথব্য মেরে বসে ছিলই কিন্তু কুয়াশাকে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল কুয়াশা বলে। নিজেও নেমে যেতে নিয়েছিল কিন্তু আর প্রয়োজন হলো না। ভাইরা আগলে নিয়েছে। সে তড়িঘড়ি করে বলল,
” ভাই এখানে দাও ও’কে। আর ডক্টর ডাকো জলদি ”
তুষার শিশিরের কথা শুনে সেটাই করল। এখানেই ডাকুক ডক্টর৷ তুষার কোলে তুলে শিশিরের পাশে শুয়ে দিল৷ নীহার ডক্টর ডাকতে গেল। শিশির কুয়াশাকে আগলে ধরল কোলের মাঝে ডাকতে লাগল৷ মুখে চাপ্পড় দিয়ে দিয়ে ডাকতে লাগল,
” কুয়াশা! এ্যাই কুয়াশা? কুশু! শুনছিস? ”
কোনো রেসপন্স দিল না। তুহিনও ডাকতে থাকল। কিন্তু কাজ হলো না৷ পানি ছিটা দিল তবুও হলো না৷ ভাইদের বলল,
” একে আগেই কিছু জানানো ঠিক হলো না। কাল থেকে এমনিতেই বাবার জন্য দূর্বল ছিল। ”
ওরাও কথাটা ভাবেনি। একমাত্র মেয়ে চাচুকে বাবার আসনে বসিয়ে ভালোবাসে৷ বাবা নেই। সেই মেয়ে সহ্য করেই কি করে? আবার সেই বাবা মা-রা যাবার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। শিশির বলল,
” ভাই উঠছে না তো! ”
তুষার, তুহিন আশ্বাস দিল শিশিরকে৷ কাকে ছেড়ে কাকে আশ্বাস দেবে সব? কুয়াশারই এই অবস্থা হলো না জানি মা’য়ের কী হয়! এই ভয়ে এখনো মা’কে আসল কথা বলা হয়নি আর না আনা হয়েছে৷ শিশির অস্থির হয়ে উঠল আরো। একে তো বুকে জ্বালা করছে বাবার জন্য। বাবার নিথর দেহ পড়ে আছে সেসব ভাবলেই ভেতর পর্যন্ত বিষিয়ে আসছে৷ এখন আবার বউ অজ্ঞান হলো। মা শুনেছে এসব? তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করল,
” ভাই, আম্মুকে জানিয়েছ এসব? ”
” না বাড়িতে বলার সাহস পায়নি। বাবার শারীরিক অবস্থা বলেছি শুধু। কিন্তু আম্মু আসার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। তোর কথাও যানে না। এসব আর নিতে পারবে না৷ আমার আম্মুকেও আর বাঁচাতে পারব না৷ কীভাবে সহ্য করবেন?”
বলতে বলতে চোখের পানি ছেড়ে দিল তুষার। একটা স্ট্রোং পুলিশ অফিসারও আর সহ্য করতে পারছে না। তুহিন ভাইকে আগলে ধরল৷ শিশির মা’য়ের কথা চিন্তা করে আরো ভেঙে পড়ল৷ ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে লাগল৷
ডক্টর এসে কুয়াশাকে চেকআপ করে জানাল অতিরিক্ত মানসিক চাপে দূর্বল হয়ে গেছে। চাইলে স্যালাইন দিয়ে নিতে পারে৷ শিশির দিতে বলল। ডক্টর অন্য রুমে সিপ্ট করাতে বলল সে মানা করল৷ বলল,
” নাহ্, এখানেই ব্যাবস্থা করেন। এখানেই হবে৷ ”
ডক্টর মানল কিন্তু বলল আলাদা বেড দিতে৷ শিশির সেটাও মানা করল। এক বেডেই হবে৷ তার বউকে কোথাও দেবে না। চোখের সামনে রাখবে। এমনিতেও হাঁটতে পারছে না। অন্য ঘরে দিলে দেখতে যেতেও পারবে না৷ ডক্টর একটু অবাকই হলো বটে। আজ কাল এমন ভালোবাসা কি পাওয়া যায়? চাইলেই যায় বোধহয়৷ একজন স্বামী চাইলে সব হয়৷ স্বামীরা বউদের আগলে রাখতে পারলেই যায়৷
কুয়াশাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ ঘুমোবে জানাল। সাথে স্যালাইনও দিয়ে গেল। কী অদ্ভুত না! একটা মানুষের জন্য এতগুলো মানুষ ভেঙে তো পড়েছেই সাথে অসুস্থও হয়ে যাচ্ছে। তুষার, তুহিন, নীহার মুগ্ধ হয়ে শুধু শুনল আর দেখল। জাহিদ মালিথাকে ফোন করে সব জানাল।
তিনি এসে কুয়াশাকে দেখলেন। কী অবস্থা হয়েছে ছেলে মেয়েগুলোর? এসব বাবা, চাচু হয়ে কীকরে সহ্য করবে?
সব ঠিকঠাক করে এগারটার দিকে শিশিরের কেবিন থেকে সকলে চলে গেল৷ জানিয়ে গেল বিকেলে নিয়ে গিয়ে বাবাকে দেখিয়ে আনবে। এখন ঘুমচ্ছে৷ ওরা চলে গেল। শিশির কুয়াশার দিকে তাকাল। সে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। কুয়াশা শুয়ে। স্যালাইন দেয়া। শরীর অনেক দূর্বল হয়ে গেছে৷ ছোট্ট শরীরে আর কত কিছুই বা নিজের চোখে সহ্য করবে!
দরজা আঁটকানো৷ শিশির পাশে আলগোছে শুলো। কুয়াশার বুকে মাথা রেখে চোখের পানি এবার ছেড়ে দিল৷ এতক্ষণ নিজের কষ্টটা আঁটকে রেখেছিল৷ বাবার জন্য সে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল৷ বাবা তার শক্তি৷ বাবার জোরে সে এতদূর এসেছে। এত বড় হয়েছে তবুও ছেলেদের উপর কিচ্ছু চাপিয়ে দেয়নি। সব একা হাতে সামলেছে৷ বিয়ে দিয়েও বউয়ের দায়িত্ব নিতে দেয়নি। সব কিছু তিনিই সামলাতেন৷ সকলকে জ্ঞান দিতেন৷ দুই ছেলেকে আগলে রেখেছেন। সব সময় সঠিক বুদ্ধি ও জ্ঞান দিয়েছেন। পাশে থেকে মনোবল হয়েছেন, ঢাল হয়েছেন। মাথায় সর্বদা দোয়ার হাত রেখেছেন৷
শিশির এতগুলো বছরেও বাবার সঙ্গছাড়া হয়নি। তাহলে এখন কি করে মেনে নেবে এসব? যে হাত দিয়ে সেদিনও জীবনে এগিয়ে যাবার জন্য দোয়া করল সেই হাত আজ অলচ হয়ে পড়ে আছে। পায়ে পা মিলিয়ে চলতে সাহায্য করা পা টা আজ অচল হয়ে পড়ে আছে। শক্ত মনোবল দেয়া মানুষটা পুরোই নিথর হয়ে পড়ে আছে। আর সব থেকে কষ্টের মা এসব জানলে, দেখলে কি করে সহ্য করবে? কুয়াশা ঘুমে। সে এসব ভাবল আর চোখের পানি ফেলতে থাকল৷ স্ট্রোং পার্সোনালিটির শিশিরও বাবার করুণ অবস্থায় ভেঙে গেল। বাবার জন্য যেকোনো স্ট্রোং ছেলেই হোক না কেন ভাঙবেই। বাবার ছায়া যে কতটা মূল্যবান একটা ছেলের জন্য সেটা শুধু সেসকল ছেলেরা জানে, বুঝে যারা বাবার ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷
কাঁদতে কাঁদতে কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরল৷ কিচ্ছু ভালো লাগছে না। সব ঠিক হয়ে যাক। স্বপ্ন হয়ে যাক। আবার আগের মতো হাসি খুশি হয়ে যাক সকলে। আল্লাহ আবার আগের মতো করে দিক সব৷
বারটার দিকে শশীরা এলো মালিথা ভিলায়৷ জাকিয়ার ভাইদের আসতে বিকেল হবে। জিনিয়াকে দেখে জাকিয়া আবার কেঁদে দিলেন। জিনিয়াও বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন৷ মা, বাবা যাবার পর বোনই আগলে রাখত৷ আর এখন বোনের সংসারে এতবড় ঝর উনিও সহ্য করতে পারছেন না।
শশী ইয়াসমিনকে ধরে কাঁদতে লাগল৷ কাঁদতে কাঁদতে শশী শিশিরের কথা বলে উঠল। ইয়াসমিন আৎকে উঠল৷ কিন্তু যা শোনার শুনে নিল সকলে। শশীরা কেউ জানে না যে শিশিরের কথা এখনো জানানো হয়নি৷
আজমিরা, বৃষ্টি, হিম, জাকিয়া শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন৷ জাকিয়া কাঁদতেও ভুলে গেলেন। আজমিরা মুখে আঁচল চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন এবার। তার মেয়ে তো হসপিটালে শিশির খবর কি জানে? কি করছে সে? বাড়ির ছেলেও মৃত্যুর মুখ থেকে ঘুরে এসেছে তারা এখন শুনছে? কেউ কিচ্ছুটি বলেনি?
বৃষ্টি শুনে বলল,
” শশী এসব কি বলছ? ”
শশীরা সকলে অবাক হলো। জিনিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
” নীহার তো এটাই বলেছে শশীর কাছে ”
এবার জাকিয়া হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। আল্লাহ তাকে এ কী পথে নিয়ে দাঁড় করালেন? এত কিছু মানবে কি করে? তার বুকের ধনও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে? তার বুক এবার আরো ভেঙে এলো। আর সহ্য করার ক্ষমতা হচ্ছে না৷ আম্বিয়া কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না৷ তিনি শুধু কিছু কথা বলে জাকিয়াকে বোঝাতে লাগলেন,
” বিপদ আল্লাহ দিয়েছেন আল্লাহই ঠিক করে দেবেন। সব আবার আগের মতো হবে৷ বুবু তুমি শান্ত হও। নিজেকে শক্ত রাখো৷ বড় ভাইজানকে তুমি নিজে শক্ত থেকে সেবা করবে। ছেলেকে দেখবে। তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। তুমি নিজেকে শক্ত করো৷ আমাদের দুঃখ সময় কাটবে। ও বুবু! শান্ত হও ”
আজমিরাকেও আর আঁটকানো যাচ্ছে না। আগলে রাখা মানুষটার অবস্থা খারাপ তারউপর এখন তার মেয়ের সংসারেও বিপদ৷ মেয়ে-জামাই আল্লাহর কৃপায় বেঁচে এসেছে! এটাই যেন দম বন্ধকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। বৃষ্টি কেঁদে কেঁদে তুষারের কাছে ফোন দিল। সব জিজ্ঞেস করল এবং বাড়ির পরিস্থিতিও জানাল৷ তুষার সব শুনে এখনি আসছে জানাল৷
ওদিক থেকে তুষার, তুহিন আসছে। ততক্ষণে সকলকে শান্ত করতে ব্যস্ত হলো সব। এতক্ষণ যদিও সহ্য করতে পারছিল কিন্তু শিশিরের এত বড় বিপদের কথা শুনে আরোই সহ্য হলো না। মিহির আসতে পারেনি। সৌরজ এসেছে সাথে বাবা। শশীর ভাবিও আসেনি।
শশী ইয়াসমিনকে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” ভাবি আমি জানতাম না এসব। আমাকে ক্ষমা করো। তোমাদের দেবর এসব জানায়নি আমাকে। তাহলে আমি বলতাম না। বিশ্বাস করো। আমার জন্য আরো পরিস্থিতি বিগড়াল ”
ইয়াসমিন আশ্বাস দিল। জানাল এসব নিয়ে না ভাবতে। এমনিতেও সবাই জানত।
আধাঘন্টার মাঝে ওদিকে ঠিকঠাক করে তুষার, তুহিন এলো। এসে মা’কে শান্ত করল। জানাল শিশির সুস্থ আছে৷ বাবাও সুস্থ। জাকিয়া ছেলেকে পেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদল। তুষার মা’কে বুকে আগলে নিয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলল। তার মা’য়ের অবস্থা সহ্য হচ্ছে না। তুষার বলল,
” আম্মু! ও আম্মু! তুমি না আমার স্ট্রোং আম্মু? তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে কি করে হবে? আমাদের, বাবাকে কে সামলাবে? বাবার পাশে এখন তোমাকে থাকতে হবে। শক্ত হয়ে বাবার সেবা করতে হবে। তুমি আমাদের শক্তি না? বাবার অসুখ করেছে এখন তুমি আমাদের ঢাল, মনোবল। তুমি আমাদের সকলের একসাথে খেয়াল রাখবে। আমার আম্মু তো এমন ছিল না! আমরা তো দেখেছি ছোট থেকে আমার আম্মু একা সব সামলেছে। একা এত বড় সংসার গড়েছে৷ তবে আজ কেন আমার আম্মু ভেঙে পড়ল? ”
জাকিয়া কাঁদল আর ছেলে কথা শুনল, বুঝল৷ কান্নার রেশ কমিয়ে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” তোদের বাবাকে আমি সব সময় সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। আমার শক্ত মনোবল তোদের বাবা। তিনিই আমার ঢাল হয়ে পাশে থেকেছেন। এই সংসার গড়তে সাহায্য করছেন। সব কাজে সঙ্গ দিয়েছেন। এখন তোদের বাবাকে ছাড়া আমি কি করে এত কিছু সামলাব? কে আমার ঢাল হবে? মনোবল হবে? আমি তাকে ছাড়া কি করে দিন পাড় করব? আমার এ সংসার যে তাকে ছাড়া তুচ্ছ, অসম্পূর্ণ ”
মা’য়ের কথায় তুষার বলল,
” আমরা হব তোমার ঢাল, তোমার মনোবল, তোমার সঙ্গী। আমরা সকলে তোমার সাথে আছি। আমরা সকলে মিলে তোমার পাশে থাকব৷ তুমি শুধু মন শক্ত করো। তুমি ভেঙে পড়লে যে আমরাও ভেঙে পড়ব! বাবা অসুস্থ হয়েছে এখন একমাত্র তুমি আমাদের শক্ত ভিত। তুমি সকলকে আঁকড়ে ধরো। আম্মু দুঃখ সময় যেমন আসে ঠিক দুঃখ সময় কাটিয়ে সুখের সময়ও আসে। আমাদের এই পরিবার আবার আগের মতো হবে। আল্লাহ যেমন বিপদ দেন তেমন ঠিকও করেন। তুমি পারবে না বলো আম্মু? বলো তুমি ঠিক করতে পারবে না? শক্ত হাতে আমাদের আঁকড়ে ধরতে পারবে না? ”
জাকিয়া ছেলের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদলেন অনেকক্ষণ৷ তুষার মা’কে বাচ্চাদের মতো করে ধরে আছে। কাঁদতে দিল একটু। নিজেকে হালকা করুক আর বুঝুক কথাগুলো। তাহলে বাবার কথা জানলে শক্ত থাকতে পারবে। জাকিয়া নিজেকে শক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন৷ তুষারের কথাগুলো তিনি মেনেছেন। নিজেকে শক্ত রেখে সব সামলাতে হবে। নিজেকে স্বামীর সেবা করে আবার আগের মতো ঢাল তৈরি করতে হবে। ছেলেকে সামলাতে হবে। তার এখন অনেক দায়িত্ব। শক্ত ভিতটা নড়বড়ে হয়ে গেছে এখন তাকে ঢাল হতে হবে। তার পুরো পরিবারকে আঁকড়ে ধরতে হবে৷ তার ভেঙে পড়লে চলবে না। এতগুলো বছর এই সংসার সামলেছে৷ শাশুড়ী নিজে হাতে সংসার তুলে দিয়েছিলেন। স্বামীর সাথে তা সামলেছে এখন পরিবারের সাথে সামলাতে হবে। সে একা নয়। তার পুরো পরিবার তার পাশে আছে। সে পারবে আবার আগের মতো করতে।
জাকিয়া কিছুক্ষণ কেঁদে নিজেকে সামলালেন। এরপর বললেন,
” তোদের বাবাকে দেখাবি না আমায়?
” দেখাব। কিন্তু তুমি বলো আগে বাবাকে দেখতে গিয়ে ভেঙে পড়বে না, কান্না করবে না? নিজেকে শক্ত রাখবে? ”
” হ্যাঁ মানুষটাকে দেখব শুধু একটু। কাল থেকে দেখিনি আমি ”
শেষ কথাটা কতটা কষ্ট মেশানো? ভাবা যায়! কাল থেকে দেখে নি সেটা বাচ্চাদের মতো করে জানাল৷ তুষারের বুকটা ভার হয়ে এলো সাথে উপস্থিত সকলের। নিরবে চোখের পানি ফেলল সকলে৷ তুষার মা’কে আশ্বাস দিল। বলল,
” আম্মু! আমি জানি আমার আম্মু শিক্ষিত, বুঝদার, বুদ্ধিমতি। এখন কিছু কথা বলব সেগুলো নিশ্চয়ই বুঝবে? ”
জাকিয়া উত্তর করলেন না৷ নিরবতা সম্মতি ধরে নিল। তুষার সকলের দিকে একবার করে নজর দিল। তুহিন তা দেখে বড় আম্মুর আরেক পাশে বসল। তুষার বলল,
” আম্মু, আব্বু ব্রেইন স্ট্রোক করেছিলেন ”
আৎকে উঠলেন জাকিয়া। ছলছল করে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন৷ তুষার আরেকটু আগলে নিল। আবার বলল,
” শান্ত হও। আল্লাহ আমাদের বাবাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এতেই খুশি হয়ে শুকরিয়া আদার করো না হয়! এখন বলি বাবার অসুস্থতার কথা। আম্মু জানো তো ব্রেইন স্ট্রোক করলে বিভিন্ন সমস্যা হয়? বাবারও হয়েছে। বাবার ডান পাশ প্যারালাইসড হয়েছে, মস্তিষ্ক কিছুটা অচল হয়েছে, আর কথা বলাতে সমস্যা হয়েছে। বাবার আমাদের এখন দেখলে চিনতে সমস্যা হবে। তুমি সেটাতে ভেঙে পড়ো না৷ আম্মু আল্লাহ যেমন অসুখ দেন বান্দাদের তেমনই তা নিরাময়ও করেন। আল্লাহ ঠিক নিরাময় করবেন দেখে নিয়ো। আমরা সর্বস্ব চেষ্টা করব৷ আমরা সকলে মিলে বাবার সেবা করব৷ বাবা আবার আগের মতো হবে।
প্রয়োজনে দেশের বাহিরে নেব তবুও বাবাকে সুস্থ করব ইনশাআল্লাহ। এখন একটা জিনিস তোমার কাছে চাওয়ার, তুমি নিজেকে শক্ত করে বাবার পাশে ঢাল হয়ে থাকো আমরা তোমার শক্তি হব৷ আমরা জানি তুমি পারবে। শিশিরও সুস্থ আছে। একটু কাটা ছেঁড়া হয়েছে। আর বাম পা টা একটু ফ্র্যাকচার হয়েছে। ডক্টর জানিয়েছেন দেড়-দুই মাস বেড রেস্টে থাকলে সেরে যাবে। আর তোমার ছোট বউমা কী করেছে শুনবে? পাগলীটা বাবার কথা শুনে জ্ঞান হারিয়েছিল। এখন স্যালাইন চলছে। শিশিরের কেবিনে ওর কাছে আছে। আম্মু আর কেঁদো না৷ কাল থেকে এত কেঁদেছ তুমিও অসুস্থ হয়ে যাবে৷ শুধু আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো। সকলে বেঁচে আছে, আমাদের কাছে আছে এটাই যথেষ্ট। এখন আমাদের করণীয় হবে, সকলে মিলেমিশে সবটা ঠিক করার এবং আগের মতো করার। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ সহায় হবেন আবার। বাবাকে সপ্তাহ পরে ঢাকায় নেব আমরা। সেখানে বড় ডক্টর দেখাব। ”
সকলে সবটা শুনল। বুঝল। কিন্তু তবুও কেউ নিরবে কাঁদল কেউ ফুঁপিয়ে উঠল পরিবারের পরিণতির কথা শুনে। জাকিয়া মুখ ঢেকে ফুঁপাতে লাগলেন। স্বামী তার হাঁটতে পারবে না, চিনতে পারবে না কথা বলতে সমস্যা হবে এসব কি করে মেনে নেবেন তিনি? গতকাল সকালেও রান্না করে খাইয়ে ভালো মানুষকে বাহিরে দিয়েছেন সেই মানুষকে আজ অচল অবস্থায় কি করে সহ্য করবেন তিনি? এটা কি কোনো স্ত্রী মেনে নিতে পারবে? যে স্বামী উপার্জন করে এনে তার হাতে তুলে দেন সেই উপার্জনের হাত অচল। যে স্বামীর বুলিতে আদেশ, উপদেশ মানেন তিনি আজ কথাও বলতে পারবেন না। যে স্বামীকে এতকাল ভালোবেসে আসছেন আদর, যত্ন করে আসছে আজ তিনি তাকেও চিনতে পারবেন না? এর থেকে নিদারুণ, নিষ্ঠুর যন্ত্রণা হতে পারে? উহু পারে না। তিনি যতবার স্বামীকে অচল অবস্থায় দেখবেন ততবার যন্ত্রণায় ভুগবেন৷ একটা স্বামী যে তার স্ত্রীর কাছে কতটা মূল্যবান হয় তা শুধুমাত্র স্ত্রীরা-ই জানে৷ আর স্বামী যদি হয় জাকির মালিথার মতো তবে তো কথায়-ই নেই!
জাকিয়া কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কেঁদে নিজেকে শক্ত করলেন৷ সব ঠিক করবেন। শক্ত মনোবল নিয়ে চোখ মুছে বললেন,
” আমি গোসল করে, নামাজ পড়ে বের হচ্ছি। নিয়ে চল তোদের বাবার কাছে। আর তোরাও গোসল করে খেয়ে নে। ”
সকলে জাকিয়ার শক্ত কথায় খুশি হলো৷ মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করল। তুষার মায়ের কপালে চুমু দিয়ে সম্মতি দিতেই জাকিয়া উপরে চলে গেলেন। সকলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদার করে শুধু চাইল সব যেন আবার আগের মতো হয়ে যায়। আজমিরা জিজ্ঞেস করল,
” তুষার, আব্বুরে শিশির ঠিক আছে তো?”
” হ্যাঁ ছোট আম্মু ঠিক আছে৷ যেমনটা বললাম তেমনটায় লেগেছে ”
বৃষ্টি বলল,
” কালই কুয়াশাকে পাঠিয়ে দিতে পারতে”
” আসে নি৷ জেদ ধরে বসে ছিল৷ ভেবেছিলাম শিশিরের কথা জানাব না। কিন্তু নিজেই খোঁজ করে জেনেছিল ইয়াসমিনের থেকে। শুনে কান্না করে অবস্থা খারাপ করেছিল৷ দূর্বল হয়ে আজ বাবার কথা শুনতেই অজ্ঞান হয়ে যায়। ”
সকলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। হিম ফুঁপিয়ে বলল,
” ভাই চাচুকে একটু দেখতে নিয়ে যাবে? ”
” যা তৈরি হয়ে নে। সকলের যাবার দরকার নেই। একে একে যেয়ো৷ এত জন ভিড় করলে সমস্যা হবে। ”
সম্মতি দিল সকলে৷ সকলে কান্না কাটি থামিয়ে হালকা পাতলা রান্না করে খেয়ে দেয়ে দুইটার পর তৈরি হলো যারা যাবে৷ আর হসপিটালের জন্য খাবার নিল। কাল থেকে কিসব খাচ্ছে। ঠিক করল জাকিয়ার সাথে দুই জা যাবে, শশী, হিম হানিফ সাহেব, সৌরজ যাবে৷ হানিফ সাহেব আর সৌরজ দেখে এসে চলে যাবেন। জিনিয়া, শশীকে রেখে যাবে। ওনারা গেলে মিহির আসবে। বৃষ্টি যেতে চাইল তুষার জানাল বিকেলে নিয়ে দেখিয়ে আনবে। এখন এত চাপ নিতে হবে না৷ সে যেন চিন্তা না করে আর খাওয়া দাওয়া ঠিক করে করে। ইয়াসমিনকে দায়িত্ব দেয়া হলো বৃষ্টির খেয়াল রাখার জন্য। পাঁচ মাস চলছে তার।
হসপিটালে সবাই পৌঁছে জাকির মালিথার কাছে আগে গেল। তিনি উঠেছেন৷ এখন জেগে আছেন। ডক্টর জানাল দুই-একজন করে যেতে। প্রথমে তুষার আর জাকিয়া ঢুকল। মা’কে শক্ত বাহু বন্দী করে ঢুকল। জাকিয়া ঢুকে স্বামীকে দেখে ছলছল করে তাকালেন। চোখের পানি নিরবে ছেড়ে দিলেন৷ তুষার নিজেকে শক্ত করে নিল৷ বুক জ্বলে যাচ্ছে বাবাকে এই অবস্থায় দেখে। জাকিয়াকে নিয়ে এগিয়ে গেল। নিথর দেহ নিয়ে শুয়ে আছে স্বামী তার৷ তুষার মা’কে পাশে বসিয়ে দিল৷ সে দাঁড়িয়ে রইল। জাকিয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে অচল ডান হাতটা তুলে নিজের হাতে মুঠোয় নিলেন৷ আজ ত্রিশ-পয়ত্রিশটা বছর এক সাথে সংসার করছেন। ডাকলেন,
” শুনছ? ”
জাকির মালিথা ঘুরে তাকানোর চেষ্টা করল৷ মাথাটা নড়াচড়া করতে কষ্ট হচ্ছে। তুষার সাহায্য করল৷ তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। মুখটা কালো হয়ে গেছে। জাকির মালিথার শরীরের রঙ শিশিরের সাথে মেশে। সেই হলুদ ফর্সা মুখটা ফেকাসে হয়ে কালো হয়ে আছে। একদিনে ওজন বোধহয় দশ কেজি কমে গেছে ভাবে লাগছে। শুকনো মুখটা মা ছেলে দেখতে পেল৷ হু-হু করে উঠল বুকটা। তুষার ডাকল,
” ও..বাবা! ”
তবুও উত্তর নিলেন না। চিনতে সমস্যা হচ্ছে বোধহয়। চোখটা জ্বলে উঠল তুষারের। এর থেকে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা আর কী হতে পারে? বাবা ছেলেকে চিনছে না। জাকিয়া বললেন,
” আমি জাকিয়া, তোমার ছেলেদের মা, তোমার বউ। চিনছ আমায়? ”
কাঁদতে কাঁদতে বললেন তিনি৷ জাকির মালিথা অস্পষ্ট স্বরে আঁটকে আঁটকে মাথা নাড়িয়ে উত্তর করলেন,
” না ”
ফুপিয়ে উঠলেন জাকিয়া। টলমল চোখে মা’কে ধরল তুষার। নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে কপাল ঠেকিয়ে দিল স্বামীর বুকে। জাকির মালিথা শুধু চেয়েই রইলেন। তুষার জোর দিতে মানা করল। জানাল আস্তে আস্তে চিনবে৷ সময় নিক৷ আরো কিছুক্ষণ থেকে জাকিয়াকে নিয়ে বেরলো৷ একে একে জাহিদ মালিথা, আজমিরা, আম্বিয়া, শশী, নীহার, তুহিন, হিম, হানিফ সাহেব, সৌরজ দেখে এলেন৷ কেউ কোনো কথা বলল না। এরপর শিশিরের কাছে গেল সকলে। জাহিদ মালিথা শিশিরকে একবার দেখে চলে গেলে বাড়িতে। তার শরীরেও আর কুলচ্ছে না৷ তিনি একায় চলে গেলেন।
জাকির মালিথাকে দেখে সকলে শিশিরের কেবিনের সামনে এলো। জাকিয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আরেকটু শক্ত করে নিলেন৷ ভেঙে পড়লে চলবে না। তার বুকের ধন ফিরে এসেছে এতেই শুকরিয়া আদায় করেছেন। আল্লাহ তাকে একেবারে নিঃশেষ করেননি৷ কিঞ্চিৎ হলেও আশার আলো রেখেছেন৷
দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে দরজা খুললেন তিনি নিজেই। দেখলেন কুয়াশা ঘুমিয়ে আছে। স্যালাইনও প্রায় শেষের দিকে। শিশির পাশে শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। কপাল বরাবর ভালো হাতটা দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে। দরজা খুলার শব্দ পেয়ে শিশির চোখ খুলে ঘুরে তাকাল৷ মা’কে দেখল৷ বুকটা হু-হু, খা-খা করে উঠল৷ জ্বলে উঠল বুকের মাঝে। দম আঁটকে আসল৷ গলার মাঝে কান্না আঁটকে গিয়ে ব্যথা অনুভব হলো৷ বুকেও ভারী কিছু চাপার মতো অনুভব হলো৷ কথা বলতে পারল না মায়ের শুকনো ফোলা মুখ দেখে৷ চোখ মুখের অবস্থা বেগতিক। একটা সন্তান কি মায়ের এমন করুণ দোষা সহ্য করতে পারে? মায়ের কষ্ট কি নিজে চোখে দেখে ঠিক থাকতে পারে? নাকি সহ্য-ই করতে পারে।
ছলছল চোখে মায়ের দিকে চেয়ে রইল। জাকিয়া এগিয়ে গেল ছেলের কাছে। পিছনে আজমিরা নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। ছেলে মেয়েগুলোর এ কী অবস্থা! সকলে পিছনে আছে৷ জাকিয়া ছেলের কাছে দাঁড়িয়ে মুখে হাত দিয়ে ধরলেন দুই হাতের আজলায়৷ চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। এলোপাতাড়ি চুমু খেলেন সারামুখে ছেলের৷ শিশির নির্বিকার। একটা মা কি করে ছেলের এমন অবস্থা সহ্য করেন? শিশির কষ্টে উঠে বসে মা’য়ের কোমড় জড়িয়ে ধরল একহাতে। পেটে মুখ গুঁজে দিল। কাঁদছে বোধহয়। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। জাকিয়া ছেলেকে আগলে নিলেন। নিরবে কেঁদে দিলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, পিঠ ডলে দিতে লাগলেন। আজমিরা, আম্বিয়া এগিয়ে এলেন। কুয়াশাকে আগেই কেউ তুলল না। শিশিরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ মা’য়ের থেকে ছাড়িয়ে আম্বিয়া কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
” আব্বু, আমরা আছি না? জলদি সুস্থ হয়ে যাবি ”
শিশির মেজো মা’কেও জড়িয়ে ধরল। তার একটু বড়দের আদর, ভালোবাসার প্রয়োজন। আজমিরা মাথায় হাত রেখে তিনিও কপালে চুমু আঁকলেন। কাটা হাতটা আলগোছে তুলে নাড়িয়ে দেখলেন। বললেন,
” সেরে যাবে। খুব বেশি লেগেছে আব্বু? ”
আজমিরা এমন ভাবে বললেন যেন শিশির তিন-চার বছরের ছোট অবুঝ ছেলে তার লেগেছে সেটা দেখে মা’য়েরা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ভুলাচ্ছে। মাথা নাড়িয়ে উত্তর করল শিশির,
” না, ছোট আম্মু। অল্প লেগেছে ”
একে একে সকলে এগিয়ে এলো। শশী এগিয়ে এসে ডাকল,
” ভাইয়া..! ”
তাকাল শিশির। কান্না করা বোনকে কাছে ডাকল। সে যানে তার এই বোনটা তাকে খুব ভালোবাসে৷ শিশির একটু জায়গা দিয়ে শশীকে বসিয়ে বলল,
” আমি ঠিক আছি রে ”
শশী শিশিরের কাঁধে মাথা রেখে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। শশীর কান্নার শব্দে কুয়াশা জাগল। শিশির আশ্বাস দিল বোনকে। হিমও চোখের পানি ছেড়ে দিল৷ বলল,
” ভাই..! খুব ভয় পেয়েছিলাম ”
হিমকেও কাছে ডেকে কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিল। বলল,
” জলদিই সুস্থ হয়ে যাব আবার। চিন্তা করিস না ভাই ”
নীহার এগিয়ে এসে বলল,
” কেঁদো না শশী। ঠিক হয়ে যাবে সব ”
কুয়াশা তাকাল৷ চোখের সামনে পরিচিত মুখগুলো দেখল। কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে চেয়েই রইল। এরপর জাকিয়াকে ডেকে উঠল,
” বড় আম্মু! ”
বলেই কেঁদে উঠল। সকলে ঘুরে কুয়াশার দিকে তাকাল। জাকিয়া, আজমিরা এগিয়ে কুয়াশার সাইটে গেলেন৷ কুয়াশার পাশে জাকিয়া বসলেন। মেয়েকে মাথায় হাত বুলিয়ে বিভিন্ন আশ্বাস দিলেন। তিনি নিজেকে শক্ত করে এখন ছেলে মেয়েদের আশ্বাস দিতে লাগলেন। কুয়াশারও সারা মুখে চুমু দিলেন৷ কুয়াশা জাকিয়ার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল৷ স্যালাইনের সুঁই একহাতে। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে জাকিয়ার শক্ত মন এবং বুঝানোর কথা শুনে কুয়াশা নিজেকে সামলাল। কান্না থামিয়ে মা’কে বলল,
” খাবার এনেছ আম্মু? তোমার জামাইকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দাও ”
সকলে অবাক চোখে চেয়ে রইল। নিজে অসুস্থ অথচ স্বামীর চিন্তা ছাড়ে নি! বউরা বোধহয় এমনই হয়৷ স্বামীর চিন্তা সবসময় করে। তারা নিজের স্বামী ঘরের বাহিরে গেলেও চিন্তার শেষ থাকে না৷ সেখানে শিশির তো অসুস্থ। আজমিরা বললেন,
” এনেছি। তুষার, তুহিন খেয়ে এসেছে। তোদের জন্য এনেছি। ”
নীহার বলল,
” আমি খেয়েছি ছোট আম্মু। রিজভী খাবার এনেছিল। কেউ ছিল না আমি আর বাবা খেয়েছি। এখন একটু বাড়ি যাব। গোসল করতে হবে আমার। ”
আম্বিয়া বললেন,
” গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিস। এখানে তুহিনরা আছে ওরা দেখবে। ”
নীহার সম্মতি দিল৷ সৌরজ বলল,
” আমরাও তবে যায় নীহারের সাথে। ”
হানিফ সাহেবও বললেন এক কথা। তারা চলে গেল। শশী কুয়াশার কাছে থাকল। স্মৃতি এসেছিল দুপুরে রিজভীর সাথে। কিন্তু সে কাউকে দেখতে পায়নি৷ খাবার নিয়ে নীহারদের খাইয়ে চলে গেছে। সন্ধ্যার পর আসবে জানিয়ে গেছে। রিজভী ওকেই রাখতে গেছে।
আজমিরা খাবার নিয়ে শিশিরকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলেন। জাকিয়া ছেলের কাছেই রইলেন৷ আম্বিয়াও সেখানে বসে থাকলেন৷ শশী, হিম টুকটাক কথা বলছে কুয়াশার মন ভালো করার জন্য। স্যালাইন শেষ হয়ে গেলে নার্স এসে খুলে দিয়ে গেল। শিশিরের কেবিনেই অনেকটা সময় পাড় করলেন সকলে৷ শিশিরের সকল প্রয়োজনীয় কাজে আজমিরা আর আম্বিয়ায় সাহায্য করলেন। তুষার, তুহিন বাবার কেবিনের সামনে গেছে।
বিকেল পাঁচটার পর কুয়াশা সুস্থতাবোধ করল। উঠে নিজের মতো চলতে ফিরতে পারল। জাকিয়ারা এখনো আছেন। কুয়াশা জানাল বড় চাচুকে দেখবে। শিশিরেরও বাবাকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল। তুষারকে ডেকে আনা হলো। নীহার এখনো আসেনি। হয়তো একটু রেস্ট নিচ্ছে৷ তুষার এসে সাহায্য করে। হুইল চেয়ারে বসাল শিশিরকে। সকলেই গেল পিছে।
জাকির মালিথার কেবিনের সামনে গিয়ে সকলে দাঁড়াল। নার্সকে ডেকে জিজ্ঞেস করল ঢুকা যাবে কিনা। তিনি অনুমতি দিলেন৷ তুষার শিশির আর কুয়াশাকে ঢুকতে বলল। কিন্তু জাকিয়াও যেতে চাইলেন। তুষার মানা করল না। তিনজনই ঢুকল। কুয়াশা শিশিরকে নিয়ে গেল ভেতরে। তিন জনই দরজার কাছে থেকে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকা জাকির মালিথাকে দেখলেন। শিশির, কুয়াশার বুকটা ছিঁড়ে গেল। জাকিয়া ছলছল করে আবার চেয়ে রইলেন। হু-হু করছে বুকটা। খালি খালি লাগছে।
কুয়াশা ফুপিয়ে কেঁদে দিল। শিশির ভালো হাতটা বউয়ের হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরল। এগিয়ে গেল ওরা নিঃশব্দে। কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ শিশির পাশে হুইল চেয়ারে বসা। অপলক, অনিমেষ অবলোকন করল বাবাকে। সেই লম্বা চওড়া, শক্তপক্ত, বলিষ্ঠ দেহ কি এটা? কেমন নিথর হয়ে মিশে আছে হসপিটালের বেডের সাথে! এর থেকে বাজে দৃশ্য আর হয়! শিশিরের বুকটা জ্বলে যেতে লাগল। বার কয়েক বুকের উপর হাত দিয়ে ডলা দিল। ভেঙে যাচ্ছে বুকটা। চোখটা ভিজে গেল আবার৷ ভালো হাতটা তুলে আলতো করে বাবার মুখের উপর রাখল। হাত বুলিয়ে দিল মুখে। জাকির মালিথা নড়েচড়ে উঠে তাকালেন পিটপিট করে।
কুয়াশা ফুঁপাচ্ছে সাথে জাকিয়াও নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। কুয়াশা অন্য পাশ থেকে বড় চাচুর শিথানের কাছে বসল সাবধানে। চাচুর সারামুখে হাত বুলিয়ে দিল। বুকের উপর হাতটা রেখে বুলাল। এই বুকে কত মাথা ঠেকিয়ে রাত, দিন পাড় করছে সে। এখনও খুব ইচ্ছে করছে মাথা রাখতে। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে এভাবে চাচুকে পড়ে থাকতে দেখে।
জাকির মালিথা একে একে সকলকে দেখল। কোনো কথা বলতে পারলেন না। চিনতেই তো পারছেন না। তো কি কথা বলবেন তিনি? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন শুধু৷ এবার কেন যেন উনিও চোখের পানি ফেলছেন। হয়তো বুঝছেন এরাই উনার পরিবারের কেউ। এবং তার এই করুণ দোষার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। তিনি বুঝতে তো ঠিকিই পারছেন। শুধু মস্তিষ্ক বিকল। শিশির ডাকল,
” বাবা..! আমাকে চিনতে পারছ? ”
কোনো উত্তর করলেন না। শুধু চেয়ে রইলেন। শিশির চোখ থেকে এবার পানি গড়িয়ে পড়ল। বলল,
” বাবা আমি তোমার ছোট ছেলে শিশির। চিনছ না? ”
তিনি এবার কিছু বলার চেষ্টা করলেন। বহু কষ্টে মুখ থেকে একটা বাক্য বের করলেন,
” শি…শি ”
শিশির সহ কুয়াশা, জাকিয়া চমকে উঠল। শিশির মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
” হ্যাঁ বাবা, তোমার শিশির। তোমার ছেলে। ও বাবা চিনতে পারছ আমায়? ”
আবারও বহু কষ্টে টেনে টেনে আঁটকে বললেন,
” না ”
হতাস হলো। তিনি মূলত চাচ্ছেন সকলকে চিনতে আর কথা বলতে কিন্তু হায় আফসোস! তিনি পারছেন না। আল্লাহ এ কি দিন নিয়ে এলেন? জাকিয়া শাড়ির আঁচল চেপে ধরলেন মুখে। কুয়াশা ফুঁপিয়ে উঠল। বলল,
” ও বড় চাচু..! তোমার কুহেলি মা’কেও চিনছ না? তোমার মেয়ে আমি দেখো ”
কুয়াশার দিকে ঘুরলেন৷ তাকিয়ে রইলেন। বলার চেষ্টা করলেন,
” কু…লি, চি….ন…ছি.. না ”
কুয়াশা আবার কেঁদে দিল। এই যন্ত্রণা কি করে সহ্য করবে তারা? যে মানুষটা কাল সকাল অবধিও ভুরি ভুরি আদেশ, উপদেশ দিয়ে অফিসে গেছিলেন তিনি আজ কাউকে চিনতে পারছেন না৷ এটার থেকে আর কি বড় কষ্টদায়ক কিছু হয়? কেউ আর কোনো কথা বলল না৷ মস্তিষ্কে চাপ দেবার দরকার নেই৷ শিশির আঁটকানো কন্ঠে বলল,
” বাবা, আমার বাবা ”
বলে নিচে থেকেই বাবাকে জড়িয়ে ধরল। মাথা রাখল বুকে। চোখের পানি ছেড়ে দিল৷ জাকিয়া ছেলের মাথা হাত রাখলেন৷ কুয়াশা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চাচুর আরেক পাশে মাথা রাখল৷ সে-ও জড়িয়ে ধরল আলতো করে। তিনি চিনতে পারছেন না৷ কিন্তু তার তো ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। এই যে কতগুলো মানুষ তার জন্য তড়পাচ্ছে, যন্ত্রণায় ভুগছে। জাকির মালিথার চোখ থেকে পানি পড়ল। কিছুই মনে পড়ছে না৷ কুয়ায়া চাচুর কপালে চুমু দিল৷ শিশির মাথা তুলে বাবার বিকল হাতটা তুলে হাতের পিঠে অসংখ্য চুমু আঁকল ঠোঁটের ধরে। বলল,
” আমরা তোমাকে আবার সুস্থ করে তুলব বাবা৷ একটুও চিন্তা করো না। আমরা-ই তোমার পরিবার তোমার আপন৷ সুস্থ হয়ে তুমি আমাদের চিন্তে পারবে, কথা বলতে পারবে, চলতেও পারবে ইনশাআল্লাহ। আমার বাবাকে আমরা আবার সুস্থ করে তুলব৷ ”
তাকিয়ে রইলেন জাকির মালিথা রুগ্নমুখে। তরতাজা মানুষটাকে এ রূপে একটুও মানাচ্ছেনা৷ জাকির মালিথাকে তো হাসিখুশি, অমায়িক ব্যবহারে, সকলকে আদেশ উপদেশ দেবেন, খেয়াল রাখবেন, রাগলে রূঢ়, ভারিক্কি লাগবে, সকলকে একা হাতে আগলে রাখবেন, খেয়াল রাখবেন, সকলকে সামলাবেন এমনভাবেই মানায় ওনাকে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। অন্ধকারে ঢেকে আসতে লাগল ধরণী। স্মৃতি, রিজভী এলো সেই সময়। বৃষ্টি এসেছে একটু আগে। এসে শ্বশুরকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছে মেয়েটা। তবে সকলে শান্ত করতে বার বার অনাগত বাচ্চার কথা চিন্তা করতে বলেছে। সে আবার একটু পর চলে যাবে। ইয়াসমিন কাল আসবে সাথে জিনিয়া, ওর মা, ঈশা এসে দেখে যাবে। ইয়াসমিন বাড়িতে শ্বশুরের সেবা করছে৷
জাহিদ মালিথা বাড়িতে গিয়ে হাউমাউ করে আবারও কেঁদেছেন৷ বাড়িটা শূণ্য মনে হয়েছে ওনার কাছে। ভাই ছাড়া বাড়িটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে। ভাই হসপিটালের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। প্রতিবার বাড়িতে আসলে আগে ভাইয়ের সাথে কথা বলতেন তবেই শান্ত হতেন। কত কিছুর খোঁজ নিতেন, উপদেশ দিতেন কিন্তু সেই মানুষটা আজ চিনতে পারলেন তাকে আর না কথা বলতে পারলেন। শুক্রবারে একসাথে নামাজ পড়তে যেতেন, বিকেলে দুই ভাই একসাথে হাঁটতে বের হতেন কিন্তু আর হবে না। কখনো আবার এসবের সৌভাগ্য, সম্ভব হবে কিনা সেটাও জানা নেই। কষ্ট তো হবারই নাহ্? এত কিছু করতেন সেখানে ভাইকে না পেয়ে তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না৷ একটা ভাইকে হারিয়েছেন এবার বড় ভাই মাথার ছায়াটা যদি নিঃশেষ হয়ে যায় তবে তিনিও নিঃশেষের পথে চলে যাবেন৷
বৃষ্টি এসে সবটা বলল। আম্বিয়ারা শুনে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। ওনারা শিশিরের কেবিনে আছেন৷ একটু পর সকলে চলে যাবে। জাকিয়া, আজমিরা খুব করে থাকার কথা বলেছেন কিন্তু কেউ রাজি হয়নি। তুষার একদম কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এমনিতেও থাকার প্রয়োজন নেই৷ জাকিয়া জানিয়েছেন তবে শিশিরের কাছে থাকতে দিতে সেটাও রাজি হয়নি৷ তুষার জানিয়েছে তারা করে নিবে সব। প্রয়োজন পড়লে ভাইদেরই ডেকে নেবে। কুয়াশাকেও নিয়ে যেতে বলেছে। কুয়াশা রাজি না। সে বলেছে শিশিরের কাছে থাকবে সে। এটাতে কেউ আর কিছু বলেনি। কারণ ওদের বিষয়ে সব জানে সবাই। এছাড়া রাতে শিশিরের পাশে একজনকে এমনিতেও লাগবে৷ সেটা না হয় কুয়াশায় হোক!
রাত আটটার দিকে তুষার সকলকে নিয়ে চলে যাবে বলল। তুহিনকেও বলল বাড়িতে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে আসতে। আবার দশটা-এগারটার দিকে আসবে। নীহার থাকবে এই সময়ে। রিজভী শুনে জানাল সে-ও থাকবে রাতে। স্মৃতিকে রেখে আসবে একটু পর। তুহিন, তুষার বৃষ্টিকে সহ মা,দুই চাচি, শশী, হিমকে নিয়ে চলে গেল। কাল সকালে প্রয়োজনে আবার আসবে তবুও রাত থাকতে দেবে না। এখানে কষ্ট হবে সকলের।
জাকির মালিথার কেবিনের সামনে আপাতত কেউ নেই। ওখানে এখন তেমন প্রয়োজনও নেই। কারণ তিনি ঘুমচ্ছেন। শিশিরের কেবিনে নীহার, রিজভী, স্মৃতি বসে টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা বলছে। বাবাকে ঢাকায় নিয়ে যাবার বিষয়ে৷ একটু শারীরিক সুস্থ করেই সব ঠিকঠাক করে এক সপ্তাহের মধ্যে নিয়ে যাবে।
রাত দশটার দিকে শিশিরকে কুয়াশা খাইয়ে দিচ্ছে। পাশে রিজভী আর নীহার আছে। তুষাররা এখনো আসেনি। রেস্ট নিয়ে আসবে বলেছে৷ নীহার চাচুর কাছে গিয়ে দেখে দেখে আসছে৷ স্মৃতিকে রেখে এসেছে রিজভী৷ নীহার রাতের খাবার এনেছে সেগুলোই খাচ্ছে।
শিশির খাবার মাঝে মাঝে কুয়াশাকে অপলক দেখছে। বউয়ের হাতে খাবার স্বভাগ্য হয়েছে তার। এই মেয়েটার হাতে খাচ্ছে ভাবতেই তার দিন শেষ হয়ে যায়। যেটা কিছুমাস আগেও কল্পনাতীত ছিল। কুয়াশা নিজের কাজ করে চলেছে আপন মনে। ফোলা চোখ মুখে কী মায়াময়ী লাগছে বউটাকে! শিশির মুগ্ধ হয় এখন ক্ষণে ক্ষণে৷
শিশিরের খাওয়া হলে একই প্লেটে নিজের জন্য নিয়ে সেই হাতে খাওয়া ধরল৷ শিশির সবটা মনোযোগ সহকারে দেখল। বউ যে পুরোটায় তার। কী সুন্দর একটা শব্দ নাহ্! ‘বউ’ যেটা স্বামীর অর্ধেক অঙ্গ সেখানে এঁটো প্লেট আবার কী? শিশির কুয়াশার খাওয়া দেখল আর টুকটাক গল্প করল।
কুয়াশার খাওয়া হয়ে গেলে শিশিরের ঔষধ খাইয়ে দিল। তার কিছু ঔষধ আছে সেগুলো নিজেও খেল৷ স্যালাইন দেবার পর থেকে শরীরটা ভালোই সুস্থ হয়েছে৷
রাত বারটার দিকে। শিশির, কুয়াশা দুইজনই জেগে আছে। কথা বলছে। স্বামীর কোলের মাঝে সে। কথার মাঝে কুয়াশা বলল,
” তোমার হাতের, মাথার ব্যান্ডেজ কবে খুলবে? ”
” কাল খুলবে বোধহয়। ড্রেসিং করে আবার করে দেবে ”
” এখানে কতদিন রাখবে? ”
” জানি না। ভাইরা জানে। তুই কাল বাড়ি যাবি৷ প্রয়োজনে বিকেলে আসবি ”
” হ্যাঁ যাব৷ আজ গোসল না করে খারাপ লাগছে খুব৷ ”
” হুঁ, বাড়ি গিয়ে ভালো করে ঘুমিয়ে আসবি৷ ”
কুয়াশা উত্তর করল না। তাকিয়ে রইল শিশিরের দিকে। দুই হাতে শিশিরের শার্টের বুকের বোতামগুলো খুলে দিল। দিয়ে সেখানে মুখ ডুবিয়ে দিল। শিশির চমকাল। কুয়াশা আলতো স্বরে বলল,
” শান্তি এখানে খুব ”
” কেন আজ গন্ধ লাগছে না? কাল থেকে গোসল করিনি কিন্তু! ”
” উহু, নেশা… আফিম.. ”
শিশির হাসল একটু দু’ঠোঁট প্রশারিত করে। কালকের পর থেকে হাসতেই ভুলে গেছিল। ভালো হাতটার উপর কুয়াশা শুয়ে। সেই হাতটা পিঠের উপর দিয়ে টেনে নিল একটু। শরীর ব্যথা তাই বেশি বল প্রয়োগ করতে পারল না৷ কুয়াশা মুখ ডুবিয়ে রেখে বলল,
” কাল তোমার জামা-কাপড় আনব সাথে প্রয়োজনীয় জিনিস ”
” আনিস ”
কুয়াশা নাক ঘষল বুকে। স্বামী এক মাত্র শান্তির জায়গা বোধহয়। যেখানে সব সুখ পাওয়া যায়। এই যে এখন কাল থেকে ভারী হয়ে থাকা বুকটা হালকা হয়ে গেল৷ আর সেই স্বামীটার যদি কিছু হয়ে যেত? ভাবতেই আবার শিউরে ওঠল। আর এসব ভাববে না। শুধু শুকরিয়া আদায় করবে৷ মুখ তুলে তাকাল প্রগাঢ় দৃষ্টিতে শিশিরে মুখের দিকে। শিশিরও নিচু হয়ে তাকাল। শিশিরের মুখের উপর হাত রাখল। বুলিয়ে দিল হাত। বলল,
” আমার আল্লাহ্’র কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া তিনি আমার স্বামীকে আমার কাছে রাখার সুযোগ দিয়েছেন। ”
শিশির অভিভূত হলো। বলল,
” তোকে বিয়ের আগে দেখে কখনো মনে হতো না তোর মাঝে এতটা ভালোবাসা, মায়া-মমতা, আদর আছে। শুধু জেদি আর ঝগড়ুটে ভাবতাম। এই জন্য বিয়ে করতে রাজি হয়নি, ভেবেছিলাম কপাল পুড়বে আমার। একটা ছেলে কখনো জেনে শুনে এমন মেয়েকে লাইফপার্টনার করতে চাইবে না। কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। একটা আদর্শ বউ হবার সব গুণ তোর মাঝে আছে। আমার বউ খুব ভালোবাসতে যানে আর সেটাও মন দিয়ে। এই জন্য বলা হয়, ‘মানুষকে মন দিয়ে চিনতে শিখো, চোখ দিয়ে না’ জীবন রাঙিয়ে দিয়েছিস আমার। আমি মন খুলে বলব, আমি সুখী এই আহ্লাদী মেয়েটাকে নিয়ে।”
কুয়াশার চোখ থেকে পানি পড়ল। বলল,
” আমিও এটাই ভাবতাম৷ ভাবতাম হয়তো তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসবে না। আর বাসতেও পারবে না৷ একটা মেয়ে কি জেনে শুনে এমন ছেলেকে বিয়ে করতে চাইবে? মেয়েরা হয়, ভালোবাসার পাগল, স্বামীর ভালোবাসার পাগল হয়। আদর, যত্ন চায়। তারা চায় একটা স্বামী তার বউয়ের উপর সব সময় পজেসিভ থাকুক৷ সারাক্ষণ আদর, যত্নে ভরিয়ে রাখুক। একটা মেয়ের জন্য যে স্বামীর ভালোবাসা পাওয়াটা কতটা সুখের, কতটা আনন্দের কতটা শান্তির সেটা যেই মেয়ে পায় সেই মেয়ে বোঝে। স্বামীর ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যর বিষয়। আর আমি সেই ভাগ্যবতি হতে পেরেছি। আমি সেই সাধনা অর্জন করতে পেরেছি৷
যানো তো? কেউ একজন বলেছিলেন,
‘পুরুষের ভালোবাসা পাওয়া সাধনার বিষয়। দেহদানের পর যে নারী বলে পুরুষের ভালোবাসা পেয়েছি সে নারী নির্বোধ। পুরুষের বিশ্বাস, মন ছুঁইয়ে তবেই দেহ ছুঁতে হয়। শরীর তো ব্য** দেয়!’
কিন্তু আমি সক্ষম। আমি তোমার মন ছুঁতে পেরেছি। এটা সব থেকে বড় পাওয়া আমার। ”
শিশির মুগ্ধ হয়ে শুনল। বলল,
” আমার ছোট্ট, আহ্লাদী বউ যে এটা জ্ঞানী জানতাম না তো? মাথায় গোবর ঠাঁসা ছাড়াও জ্ঞানও বহুত আছে। এত ছোট বয়সে এসব পাকনা কথা কোথা থেকে শিখলি?”
” আমি আঠার প্লাস। ছোট নেই। আর ভবিষ্যত লয়ার হব। জ্ঞান না থাকলে চলে? ”
” আচ্ছা?”
” হুঁ। ”
” তো আমি কি দেহ না ছুঁয়ে হৃদয় ছুঁতে সক্ষম হয়েছি? ”
” সে তো কবেই হয়েছ! তোমার মতো পুরষকে ভালো না বেসে থাকা যায় না”
” কিন্তু শরীর তো ছুঁয়ে দেখতে পারলাম না আজো!”
কুয়াশা শিউরে উঠল। শিশির হাসল। কুয়াশা শিশিরের কন্ঠ মনিতে চুমু এঁকে বলল,
” আমি পুরোটায় তোমার ”
” জানিতো ”
কুয়াশা তাকাল শিশিরের গভীর চোখে। ছলছল করছে চোখ৷ নিরবে চোখের পানি ছেড়ে দিল আবার। শিশির আগলে নিল৷ বলল,
” সব ঠিক হয়ে যাবে আবার। চিন্তা করিস না। ”
” চাচু আগের মতো হাঁটতে পারবে আবার কখনো?”
“আমরা সর্বস্ব চেষ্টা করব। আল্লাহ সহায় নিশ্চয় হবেন।”
” আজ আমার বুক ছিঁড়ে এসেছে। আমার চাচু আমাকে চিনল না! ডাকল না কুহেলি মা! ”
বলেই ফুঁপিয়ে উঠল। শিশিরের বুকে জ্বালা শুরু হলো৷ বাবা যে তাকেও চিনল না। দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে কষ্ট দমাল৷ কুয়াশার কপালে চুমু আঁকল। বলল,
” জলদি সুস্থ হয়ে উঠবেন ইনশাআল্লাহ আমাদেরও চিনবেন”
কুয়াশা কাঁদতে কাঁদতে শিশিরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবাল। চুমু খেল একটা গভীর করে সময় নিয়ে। শিশির নির্বিকার৷ বউয়ের কষ্টে সঙ্গ দিল শুধু। দু’জন দু’জনের কষ্ট নিজেদের মাঝের ভাগ করে নিল৷ দু’জনকে আগলে রেখে ও আদর ভালোবাসা দিয়ে। একেই বলে স্বামীস্ত্রী।
কেটে গেল সপ্তাহ খানেক৷ জাকির মালিথাকে নিয়ে আজ ঢাকায় রওনা হবেন। সব কিছু গোছগাছ করা হয়ে গেছে৷ আজ মালিথা ভিলার সকলে হসপিটালে যাবে। জাকির মালিথাকে হসপিটাল থেকেই নিয়ে যাওয়া হবে।
জাকির মালিথার সাথে যাবে, জাকিয়া, আম্বিয়া, তুহিন, নীহার। তুষার আজ গিয়ে সব ঠিকঠাক করতে সাহায্য করেই চলে আসবে আবার। তুষার, জাহিদ মালিথা এদিকে থেকে সামলাবেন। তারা বাড়ি সহ নিজেদের ডিউটিতে নিয়োজিত হবে৷ তুষার বলেছে সময় পেলেই ঢাকায় যাবে। তুহিন ছুটি নিয়েছে অনেক কষ্টে কয়েক মাসের। আম্বিয়া স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে কয়েক মাসের জন্য।
জাকিয়ার সাথে একজন লাগবে আর সেটার সঙ্গ আম্বিয়া দেবেন। শিশির এখন আপাতত পারবে না। আগে সে সুস্থ হয়ে নিক। আজমিরা বাড়ি সহ সংসার এবং মেয়েকে সঙ্গ দেবেন। মেয়ে-জামাইয়ের দেখভাল করবেন সাথে বাড়ির ছেলে মেয়ে, বউগুলোর৷ ইয়াসমিন কুয়াশাকে সহ বৃষ্টিকে সঙ্গ দেবে৷ শশীরা এই এক সপ্তাহ ছিল। আজ জিনিয়া চলে যাবেন কিন্তু শশী আরো কিছুদিন থাকবে বলেছে৷ জিনিয়া অমত করেনি। হবু শ্বশুরবাড়ি সাথে খালার বাড়িতে না হয় একটু সঙ্গ দিক! ছোট্ট হিমেরও এখন অনেক দায়িত্ব পরিবারের প্রতি। মালিথা ভিলার প্রতিটা সদস্যের এখন প্রচুর দায়িত্ব। তারা এখন মিলেমিশে সেসব দায়িত্ব পালন করবে। সবাই মিলে জাকির মালিথাকে সুস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। আল্লাহ সহায় হলে আবার সুস্থ হবেন জাকির মালিথা৷ সকলের হাসির কারণ আবার সুস্থ হবেন ফিরিয়ে আনবেন আবার সেই হাসি খুশি মালিথা ভিলা৷
সকলে খুব ব্যস্ত। গোছগাছ করে ফেলেছে। শিশিরকে আজ বাড়িতে আনা হবে। বাবাকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার জন্য বিদায় দিয়ে বাড়ি আসবে। সকলে বেড়িয়ে গেল। তুষার এসেছে নিতে সকলকে৷ তুহিন,জাহিদ মালিথা, নীহার ওদিকে আছে।
সকাল দশটার দিকে হসপিটালে পৌঁছে সব ঠিকঠাক করে জাকির মালিথাকে এম্বুলেন্সে তোলা হলো৷ নীহার আর তুহিন এম্বুলেন্সে যাবে। তুষার, জাকিয়া, আম্বিয়া কারে যাবেন। সকলে নিরবে চোখের পানি ফেলে হাসি মুখে বিদায় দিল। আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়ে সুস্থ হয়ে ফেরার দোয়া করল৷ সকলের প্রত্যাশা বাড়ির বট গাছটা যেন কিঞ্চিৎ হলেও সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। সকলকে চিনতে পারেন৷
দুপুর বারটার দিকে শিশিররা সকলে এলো বাড়িতে। রিজভী, মিহির, হিম শিশিরকে উপরে উঠতে সাহায্য করল। সপ্তাহবাদ আল্লাহর কৃপায় বাড়িতে পা রাখার সুযোগ হলো৷ নিজের ঘরে এলো। জানাল আগে গোসল করবে৷ আজ এক সপ্তাহ গোসল নেই তার। শুধু শরীর মুখে হালকা পাতলা মাথা ধুয়ে দিন গেছে৷ কপাল কাটার জন্য গোসলও করতে দেয়নি। ঘাঁ টা একটু শুকিয়ে উঠেছে৷ ওখানে না ভিজিয়ে, হাত না ভিজিয়ে গোসল করবে৷ সকলে মানল। রিজভীরা বাথরুমে দিয়ে এলো। কুয়াশা ঢুকল গোসল করাতে।
শিশিরের সবকিছু কুয়াশাই করেছে এই এক সপ্তাহ। মেয়েটা সব দায়িত্ব নিজে হাতে পালন করছে। বাথরুমে ঢুকে শিশিরে শার্ট খুলে দিল। গোসল করাতে আজ একটু আনইজি ফিল হচ্ছে। শিশির হাসল৷ বলল,
” কিরে, লজ্জা পাচ্ছিস? ”
” ধুর ফাজিল, চুপ করো তো। লজ্জাই পাচ্ছি আমি ”
শিশির আবার নিঃশব্দে হাসল৷ টুলের উপর সে। এবার শাওয়ার ছেড়ে দিল সে। কুয়াশা সহ সে-ও ভিজে গেল। কুয়াশা রেগে উঠল৷ বলল,
” কি করলে এটা? ”
” একসাথে গোসল করব তাই। এদিকে আয় ”
বলে কুয়াশার হাত ধরে টেনে নিল৷ কুয়াশা বেজায় রাগল। এখানে জামা-কাপড় আনেনি সে৷ শিশির বলল নে শুরু কর। কিড়মিড় করতে করতে শিশিরকে সাবান মাখাল, শ্যাম্পু করাল। শিশির মিটমিট করে হাসল। রাগাতে ভালো লাগে একে৷ অনেকদিন পর আজ একটু শান্তি লাগছে৷
কুয়াশা পুরো ভিজে জুবুথুবু। ওড়না কোমড়ের বাঁধা। পাক্কা গিন্নি লাগছে বউটাকে। শিশির নিখুঁতভাবে সব পর্যবেক্ষণ করল৷ শিশির টুপ করে কুয়াশা গালে চুমু দিল। কুয়াশা চোখ পাকিয়ে তাকাল। শিশির আবার অন্য গালে দিল৷ কুয়াশা এবার এক ধাপ এগিয়ে গেল। সে শিশিরে ভেজা ঠোঁটে দিল কামড়। শিশির ইশশ করে উঠল। ঠোঁট ধরে চেক করল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল,
” এটা কি হলো? ”
কুয়াশা দাম্ভিকতার সাথে বলল,
” আরো দাও চুমু এবার! ঠোঁট দেখ সারাদিন ধরে। আমাকে আমার কাজ করতে দাও। ”
বলে শিশিরের শরীর ডলা ধরল। সাবান ডলে আবার শাওয়ার ছেড়ে দিল। কুয়াশা যেইনা সরে আসতে নেবে অমনি কুয়াশা হাত ধরে বসিয়ে ঠোঁট ঠোঁট ডুবাল৷ কিছুক্ষণ অধর চুম্বন করল ঝর্ণার নিচে। শিশির ছেড়ে দিয়ে বলল,
” সেই স্বাদ।”
কুয়াশা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল৷ ভড়কানো কন্ঠে বলল,
” কিহ্…!”
” চেঁচাচ্ছিস কেন? তোর ঠোঁট না৷ শাওয়ারের পানি সেই স্বাদ। ”
কুয়াশা রেগেমেগে দিল এলোপাতাড়ি কয়েকটা চা-প্পড় থা-প্পড় শিশিরের বাহু সহ বুকে, পিঠে৷ শিশির শব্দ করে হাসল একটু৷ অনেক দিন পর নিজেদের সত্ত্বায় ফিরে এসেছে দু’জন৷ এমনই হাসিখুশি থাকবে আবার কাঁদবে৷ এটা হচ্ছে জীবন৷ সুঃখের পরে আসে দুঃখ আবার দুঃখ গিয়ে আসে সুখ। জীবনের গতিপথ এমনই সুখ-দুঃখের চক্রে ঘোরে
সময় বহমান কথাটা চিরন্তন সত্য। সময় চলে তার আপন গতিতে। তেমনি চলে গেল দুইটা মাসের বেশি সময়। এই দুইটা মাসে অনেক কিছুই পাল্টেছে। মাস, দিন, ক্ষণ, বার সবই পাল্টেছে। পাল্টেছে মালিথা ভিলার রঙ৷ হাসি খুশি মালিথা ভিলা যেন মরুভূমি হয়ে ছিল। বাড়ির আসল প্রাণগুলো না থাকায় মরুভূমিতে পরিণত হয়ে ছিল৷ প্রাণের সঞ্চার ঘটানো সদস্যের জন্য বাড়িটা মৃত্যুপুরি হয়ে ছিল। সব সময় যে মালিথা ভিলায় হাসিখুশি বিরাজমান থাকত সেই হাসি মালিথা ভিলায় দুই মাসে কালেভদ্রে দেখা যেত। মন চাইলে একটু প্রাণখুলে হাসত না চাইলে বিরস বদনে দিনযাপন করত।
এই দু’মাসে সকলে এক একটা দিন গুণেছে বাড়ির আসল প্রাণগুলোর ফিরে আসার৷ আসল ছায়াটাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসার৷ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুধু ফরিয়াদ করেছে তাদের হাসি খুশির কারণ যিনি তিনি যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন৷ আবার আগের মতো চলতে চায় সকলে।
দুই মাসের বেশি সময় গিয়ে মাসের নাম পাল্টে এসেছে ডিসেম্বর মাস৷ বাংলা মাসের নাম পরিবর্তন হয়ে এসেছে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাস। ঋতু নাম পরিবর্তন হয়ে এসেছে শীতকাল। আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে হয়েছে ঠান্ডা,শুষ্ক।
ডিসেম্বরের ত্রিশ তারিখ। আজ মালিথা ভিলা উৎসবমুখর মনে হচ্ছে। হবে না-ই বা কেন? বাড়ির বট গাছটা যে ফিরছে। আল্লাহ সেই বট গাছকে সুস্থতা দান করেছেন। জাকির মালিথা এখন অনেকটা সুস্থ। তিনি এখন সকলকে চিনতে শিখেছেন, কথা পরিষ্কার করে বলতে শিখেছেন৷ প্যারালাইড পাশটাও নিয়ন্ত্রণে এসেছে৷ তবে এখনো ঠিক হয়নি৷ নাড়াচাড়া করতে পারেন কিন্তু তুলতে পারেন না।
ঢাকায় বড় হসপিটালে নিয়ে বড় বড় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বড় বড় চিকিৎসক দিয়ে জাকির মালিথার চিকিৎসা করানো হয়েছে। সেখানে উন্নত চিকিৎসক ও উন্নতমানের চিকিৎসায় জাকির মালিথা সুস্থ হয়েছেন অনেকটা৷ চিকিৎসকের বিভিন্ন রকম থেরাপি সহ বিভিন্ন পরামর্শ জাকির মালিথাকে দেয়া হয়েছে। কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি। আল্লাহর মর্জিতে তিনি সুস্থতা পেয়েছেন৷ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম সহ সব ধরনের সেবা জাকির মালিথাকে দেয়া হয়েছে৷ আর এইসব কিছু শুধু আর শুধু মাত্র মালিথা ভিলার কৃতিত্বে। জাকিয়া স্বামীকে নিয়ে এক মূহুর্ত অবহেলা করেননি। আর না স্বামীকে নিয়ে হাঁপিয়ে ওঠেছেন। কোনো কষ্ট মনে করেননি সর্বদা স্বামীর সেবায় নিয়জিত ছিলেন। পাশে ছিলেন আম্বিয়া, নীহার, তুহিন। জাকিয়া একা হাতে সব সামলেছেন। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে তিনি সব কাজ নিজে হাতে করে গেছেন।
আম্বিয়া পাশে থেকে জা’কে সঙ্গ দিয়েছেন। নীহার, তুহিন মা, চাচি, চাচুকে আগলে রেখেছে। ডক্টরের যত প্রকার রুটিন, সেবা, পরামর্শ নেয়া এসব কিছু নীহার, তুহিন করেছে। আজ তারা ঢাকা থেকে ভোর ছয়টায় রওনা হয়েছে। এবার বাড়িতে এসে চিকিৎসা চালাবে৷ ডক্টরের পরামর্শ নিয়ে সেই অনুযায়ী বাড়িতেই সেবা দেয়া হবে জাকির মালিথাকে।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল আটটা। মালিথা ভিলাতে আনন্দের জোয়ার নেমেছে৷ সকলে হাসি মুখে দৈনন্দিন কাজ করছে। সোরগোল, দৌড়ঝাপ করে কাজ করছে। রান্না বান্না সহ গোছগাছ করছে৷
শিশির সপ্তাহ খানেক আগে থেকে হাঁটাচলা করে৷ সপ্তাহখানেক আগে নিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজ সহ আবার এক্সরে করে আনা হয়েছে। ডক্টর জানিয়েছেন এখন সুস্থ। আর কোনো অসুবিধা হবে না। হাঁটাচলা করতে পারবে।
বাড়িতে বউ এবং শাশুড়ীর সেবায় জলদি সুস্থ হয়েছে। কুয়াশা এক মূহুর্তের জন্য কাছ ছাড়া হয়নি। সর্বদা স্বামী সেবায় নিয়জিত ছিল৷ আজমিরা নিজের সংসার সহ মেয়ের সংসারের খেয়ালও রেখেছন৷ কুয়াশাকে সবকিছু দেখিয়ে, বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ মেয়ে তার পাক্কা গিন্নি তৈরি হয়েছে৷ শিশির সেসব দেখে দেখে শুধু মুগ্ধ হয়েছে। রোজ গোসল করানো, তিন বেলা খাওয়ানো সাথে সময় মতো ঔষধ খাওয়ানো সবকিছু একা হাতে সামলেছে। শাশুড়ীর মতো সে-ও স্বামী সেবায় নিয়জিত ছিল৷ দুই শাশুড়ী বউ মিলে স্বামী সন্তানকে সুস্থ করেছে৷ একেই তো বলে স্বামীর প্রতি দায়িত্ব।
ইয়াসমিন আজমিরাকে সাহায্য করেছে সাথে বৃষ্টিকে সব সময় সঙ্গ দিয়েছে। বৃষ্টির এখন সাত মাস চলছে। পেট অনকটা বড় হয়েছে তার। হাঁটা চলা করে না বেশি। সব সময় ঘরেই থাকে। আজমিরা বৃষ্টিকে একটুও নিচে নামতে দেন না। উনার কথা বাড়িতে দুঃখ সময়ের অভাব নেই। আর কোনো দূর্ঘটনা যেন না হয় সে-সব দিকেই খেয়াল রাখেন। তুষার বউ বাচ্চা সহ নিজের ডিউটি, সংসার, এবং বাবার জন্য সব ধরনের করনীয় কাজ সামলেছে৷ বাড়ির বড় ছেলের দায়িত্ব সে নিজে হাতে পালন করেছে। ছোট্ট হিম ভাইদের সকল কাজে সাহায্য করা শিখে গেছে। অনেক দায়িত্ব বুঝতে শিখে গেছে। বাস্তবতা চোখের সামনে মেলে ধরতে শিখেছে।
সকাল এগারোটার দিকে শশী, মিহির এলো জিনিয়ারা কাল আসবে৷ আজ শশী জোর করে চলে এসেছে। সে আগে খালুকে দেখবে৷ শিশির ভাই সুস্থ হয়েছে সেটা শুনে আরোই থাকেনি৷ ঈশা, স্মৃতি, রিজভী প্রায় এসে এসে কুয়াশা, শিশিরকে সঙ্গ দিয়ে গেছে। আজ বিকেলে তারাও সকলে আসবে।
দুপুর দেড়টার দিকে জাকির মালিথাকে নিয়ে এম্বুলেন্স এসে মালিথা ভিলার সামনে থামল। তুষার, শিশির দৌড়ে এগিয়ে গেল। জাকিয়ারা কার থেকে নেমে দাঁড়াল। ছেলেরা সকলে আদরে৷ আহ্লাদে ভেঙে পড়ল বাবাকে দেখে৷ ছলছল চোখে চেয়ে রইল। জাকির মালিথাকে এম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে বসানো হলো। শিশির, তুষার এক সাথে হুইল চেয়ারে থেকে বাবাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল,
” বাবা..! কেমন আছো বাবা?”
জাকির মালিথা ছলছল চোখে কান্না ভেজা কন্ঠে ঠোঁটে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে তুললেন৷ ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললেন,
” আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?”
” আলহামদুলিল্লাহ ”
দুইভাই এক সাথে বলে উঠল। এরপর শিশির বলল,
” আমরা তোমাকে দেখে আরো ভালো হয়ে গেছি বাবা৷ বুকটা এতদিন ফাঁকা ফাঁকা ছিল। এখন শান্তি লাগছে ”
জাকির মালিথা অমায়িক হাসলেন। চোখ ঘুরিয়ে উপস্থিত সকলকে দেখলেন৷ কয়েকজন নেই এখানে। আর সব থেকে বড় পাগলীটাও নেই। ভেবেই হাসলেন। জাহিদ মালিথার দিকে তাকিয়ে কাছে ডাকলেন৷ জাহিদ মালিথা নিচে বসে পড়লেন এগিয়ে এসে৷ ভাইয়ের পায়ের কাছে বসে ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন৷ তার ভাই হাঁটতে পারছে না। জাকির মালিথা ভালো হাতটা তুলে মাথার উপর দিয়ে আদর করলেন। বললেন,
” আমি আবার হাঁটতে পারব দেখিস। তোদের জন্য আবার হাঁটব৷ আমার এতবড় সংসার আর ভালোবাসা কখনো বিফলে যাবে না। তোদের ভালোবাসায় আবার সুস্থ হব ”
নিরবে কেঁদে দিল সব৷ শশী ফুঁপিয়ে এগিয়ে এসে বলল,
” খালু, আমাকে চিনতে পারছেন তো?”
” এই ছোট্ট মিষ্টি মামনিটাকে না চিনলে চলে? এদিকে এসো ”
শশী গিয়ে কাছে বসতেই আদর দিলেন জাকির মালিথা। হিম এগিয়ে এসে চাচুকে জড়িয়ে ধরল। চাচু ছোট ছেলেটাকে অনেক আদর করল। সকলে মুচকি হাসল। জাকিয়া বললেন,
” চলো ভেতরে গিয়ে রেস্ট নেবে আগে ”
সকলে জাকিয়ার দিকে তাকাল। কতটা শুকিয়ে গেছে! স্বামীর জন্য দিনরাত এক করেছিলেন তো শুকোবে না? চোখের নিচে কালি পড়ে দেবে গেছে চোখজোড়া। বয়সটা যেন বেড়ে গেছে৷ শিশির এগিয়ে গিয়ে মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মা’য়ে গন্ধ কতদিন পর পেল সে! আহ্ প্রাণটা জুড়িয়ে গেল৷ তার মা সেরা মা৷ বাবার জন্য সব ছেড়ে ছুড়ে কোথায় পড়ে ছিল!
তুষার গিয়ে বাবার হুইল চেয়ার ধরে বাড়ির মধ্যে এগিয়ে গেল। সকলে পিছন পিছন গেল৷ দরজার মুখে যেতেই আজমিরা দৌড়ে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে পায়ের কাছে বসে পড়লেন৷ কেঁদে দিলেন ঝরঝর করে। জিজ্ঞেস করলেন,
” ভাইজান, কেমন আছেন আপনি?”
জাকির মালিথা আজমিরার মাথার উপর হাত দিয়ে সালামের জবাব দিয়ে অমায়িক হেসে বললেন,
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি৷ তোমরা সকলে কেমন আছো? ”
” আমরাও ভালো আছি ”
এরপর কিছু কথা বলে বসার ঘরে সোফায় বসিয়ে দেয়া হলো জাকির মালিথাকে। অনেকদিন বাদে নিজের বাড়িতে পা রেখে, নিজের আপন জনদের দেখে আপন সত্ত্বায় ফিরে এসেছেন তিনি। সকলে জাকির মালিথাকে নিয়ে ব্যস্ত হলো। বৃষ্টি ইয়াসমিনকে নিয়ে আলগোছে নেমেছে৷ বৃষ্টিকে দেখে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর দিলেন৷ ইয়াসমিনকেও একই ভাবে আদর দিলেন৷ সকলের মুখে প্রশান্তিময় হাসি৷ জাহিদ মালিথা ভাইয়ের পাশে আগের ন্যায় বসলেন। ঠিক যেমন আগে বসত তেমন। টুকটাক কথা বলে তিনি চোখ ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না৷ জিজ্ঞেস করলেন,
” আমার মা কই? ”
সকলে বুঝল কার কথা বলছে৷ তাকিয়ে দেখল সে নেই৷ শিশির জবাব দিল,
” তোমার আহ্লাদী কাঁদছে বোধহয় ঘরে বসে ”
” যাও নিয়ে এসো আমার মা’কে। আমার মা’কে দেখার জন্য আমার বুকটা খা-খা করছে ”
সকলে মুচকি হাসল৷ শিশির শশীকে বলল কুয়াশা ধরে আনতে। আহ্লাদী সবকিছুতে আহ্লাদ করে। শশী গিয়ে কুয়াশাকে জোর করে আনল। সে আসবে না। অভিমান করেছে চাচুর উপর। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ফুঁপাতে ফুঁপাতে এগিয়ে এলো৷ চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে৷ চাচুকে কতদিন পর দেখল? কতটা শুকিয়ে গেছে! সেই মানুষটা আর নেই। জাকির মালিথা একমাত্র মেয়েটাকে দেখলেন৷ জাকিয়ার থেকে পরে সব শুনেছিলেন তিনি যে কাউকে চিনতে পেরেছিলেন না৷ শিশিরের এক্সিডেন্টের কথাও শুনেছিলেন। ডাকলেন,
” কুহেলি মা..! ”
আহ্! কতদিন পর ডাকটা শুনল। প্রাণ জুড়িয়ে গেল সাথে শব্দ করে হাউমাউ করে কেঁদে চাচু পাশে বসে বুকে মাথা রেখে কেঁদে দিল। ঝরঝর করে কাঁদতে থাকল। চাচু তাকে চিনেছে। চাচু তাকে আবার ডেকেছে। এর থেকে আনন্দের আর কি হয়? এটা আনন্দের কান্না৷ জাকির মালিথা মুচকি হেসে মেয়েকে আগলে নিলেন৷ বললেন,
” আমার মা ”
” চাচু, ও চাচু কেমন আছো তুমি?”
” আমি ভালো আছি মা৷ আমার এই কুহেলি মা’কে দেখে আরো ভালো হয়ে গেলাম। বুকে শান্তি লাগছে৷ আমার চঞ্চল মা’য়ের দৌড় ঝাপ দেখলে আরো সুস্থ হয়ে যাব ”
কুয়াশা ঝরঝর করে কাঁদল। কোনো কথা বলল না৷ অনেকক্ষণ কেঁদে চোখ মুছে চাচুর শরীরের গরম শাল চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দিল। এরপর বাড়ির সকলকে দেখল। শাশুড়ীকে দেখে জড়িয়ে ধরল। হাসল জাকিয়া৷ মেয়েটাকে আগলে ধরল। কী অবস্থা হয়েছে মানুষটার! সেই ফর্সা, লম্বা, একহারা শরীরের সুন্দরী মহিলাটার কী হাল হয়েছে? বলল,
” আম্মু! কেমন আছো তুমি?”
” আমি ভালো আছি মা ”
এরপর টুকটাক কথা বলে সকলে ফ্রেশ হয়ে দুপুরে খাবার খেল একসাথে। অনেক দিন পর আবার আগের মতো এক টেবিলে বসে। তুষাররা বাবাকে বাবার সেই চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। তিনি হাত দিয়ে খেতে না পারুক একসাথে বসতে তো পারবে? মনে তো হবে সেই শক্ত ভিতটা এখনো পাশে আছেন! আজকে কুয়াশা খাইয়ে দিল চাচুকে। জাকিয়ার দায়িত্ব কমল৷ এখন সকলে মিলে দেখবেন জাকির মালিথাকে।
খাবার খেল আর টুকটাক গল্প সাথে হাসি মজাও চালাল। আহ্ সকলের বুকটা নিমেষেই শান্তি তো মিলেছেই সাথে ভারী পাথর নেমে হালকা হয়েছে৷ মালিথা ভিলা আবার আগের সত্ত্বায় ফিরে এসেছে। কানায় কানায় হাসিখুশিতে ভরে গেছে৷ আবার হাসতে শিখেছে মালিথা ভিলা৷
বিকেলে স্মৃতি, রিজভী, ইয়াসমিনের বাবারা এলেন। বাড়িটা ভরে গেল। আগামীকাল সকল আত্মীয়রা আসবে জাকির মালিথাকে দেখতে। আগামীকাল মিলাদ পড়ানো হবে বড় করে। সেসবের আয়োজনও করা হলো। জাহিদ মালিথা সহ তুষাররা করছে
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। সকলে রেস্ট নিয়ে আজান দিলে নামাজ আদায় করে নিল। বসার ঘরে বসে আছে সকলে। স্মৃতিরা আজ থাকবে। শিশির জোর করে আঁটকে রেখেছে। বসার ঘরে সব আড্ডাতে মেতেছে। বৃষ্টিকেও আনা হয়েছে৷ বৃষ্টিকে ছাড়া যেন সকলের আড্ডা জমে না। বড় ভাবি হিসেবে খুবই ফ্রি সে৷ সকলের ভালোবাসার একটা ব্যক্তি। জাকির মালিথাকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিন জা রান্না করছেন৷ অনেকদিন পড়ে আবার তিন জা একসাথে হয়েছেন।
রাত এগারটা। আজ সকলে ক্লান্ত। তাই খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকিয়ে সকলে শুতে চলে গেছে। একটু আগেই সব খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে৷
কুয়াশা ওদিকে সামলে ঘরে এলো। শিশির বই পড়ছে কম্বলের নিচে বসে৷ সে অসুস্থ থেকে ঘরে বসেই পড়ত৷ পরীক্ষা তার জানুয়ারিতে। কুয়াশা এসে ভ্রু কুঁচকাল। খিটমিট করছে চোখমুখ। বুনো ওলটা কী সব ভুলে গেছে! দরজা শব্দ করে আঁটকাল৷ এগিয়ে এসে শরীরের চাদরটা খুলে রেখে এলো৷ বলল,
” এ্যাই যে পড়ুয়া বুনো ওল! আপনি কী পড়েই যাবেন?”
মুখ তুলে তাকাল শিশির। ভ্রু কুঁচকাল। তো কি করবে সে? প্রশ্ন করল,
” তো এখন কি করব আমি? সাত তারিখ থেকে পরীক্ষা আমার। তাই পড়ছি। তুই ঘুমো ”
কটমট করে উঠল কুয়াশা। রেগেমেগে বলল,
” ওরে আমার পড়ুয়া ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রে .. পড় তুই বুনো ওলের বাচ্চা! পড়তে পড়তে মঙ্গলগ্রহে যাহ্। তারপর সেখান থেকে লয়ার হয়ে ফিরিস। ”
বলতে বলতে রেগেমেগে ধাপধুপ করে বিছানায় উঠে কম্বলের নিচে শুয়ে চোখমুখ ঢেকে শুয়ে পড়ল৷ সবকিছু এত জলদি হলো যে শিশির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। যাক বাবাহ্ সে কি করল? এই গোবর ঠাঁসার আবার কি হলো? পড়তেই তো ছিল! এতে এমন রাগের কি হলো!
” আমি কি করলাম? ”
” কিছু করিস নি। পড় তুই ”
” এ্যাই তুই তুকারি করছিস কিন্তু! ”
” জানি আমি। ”
কতত বড় ফাজিল চিন্তা করা যায়! তবে শিশির মিটমিট করে হাসল। আরো কিছুক্ষণ পড়ল। এরপর ঘড়ি দেখল। মুচকি হাসল। বই রেখে সোয়েটার খুলে ফেলল। শরীরে শুধু ফিনফিনে পাতলা একটা সাদা শার্ট পরিহিত। অতিরিক্ত লাইট অফ করে দিল। জিরো লাইট জ্বালাল৷ তাকাল কুয়াশার দিকে। ঘণ হয়ে এসেছে নিঃশ্বাসের শব্দ। ঘুম এসে গেছে বোধহয়। হাসল আবার মুচকি।
আরো একবার ঘরের পূূর্ব দিকে সৌখিন ওয়াল ঘরিটার দিকে তাকাল আবছা আলোয়। এক মিনিট বাকি। এগিয়ে গেল কুয়াশার কাছে। কাছে একদম অতি কাছে। কুয়াশার চুলের শ্যাম্পুর ঘ্রাণ নাকে এলো। ঝুকে কাৎ হয়ে অন্যপাশে মুখ করে শুয়ে থাকা কুয়াশার মুখের উপর দৃষ্টি দিল৷ আবছা হলুদাভ আলোয় বউয়ের মুখটা মায়াময়ী অপ্সরা লাগছে৷ মন, মস্তিষ্ক আওরাল,
” আমার অপ্সরা আহ্লাদী বউ।”
ভাবতে ভাবতে তার শরীর উত্তপ্ত হয়ে এলো৷ শরীর এলোমেলো হয়ে এলো৷ বহু প্রতিক্ষার কিছু চাওয়া পাওয়া শরীর, মন, মস্তিষ্কে জেঁকে বসল। এমন তো হয় না! আজ কেন হচ্ছে? এতগুলো মাস এক সাথে এক বিছানায় থেকে বুকে নিয়ে শুয়েছে তবুও এতটা উত্তেজিত হয়নি৷ মরুভূমির ন্যায় খা-খা করছে হৃদয়। উত্তাপে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে শরীর সহ অন্তর। এ কী অবস্থা হচ্ছে! তার ভাবনারা কি লুটোপুটি খাচ্ছে? যেটা সে সপ্তাহ খানেক আগে ভেবেছিল? মাথা সহ পুরো শিরা উপশিরা দপদপ করছে ঠিক যেমনটা বিয়ের রাতে হয়ে উঠেছিল। অশান্ত, অস্থির।
বড় নিঃশ্বাস টেনে কুয়াশা গ্রীবাদেশের কাছে মুখ নিয়ে ঘ্রাণ নিল। নিজের শীতল, ঠান্ডা ডান হাতটা কম্বলের নিচে দিয়ে কুয়াশার কামিজ জামার মাঝে গলিয়ে দিল। অবাধ্য হাত স্লাইড করতে করতে গভীরে গেল। কুয়াশা ঠান্ডা হাত পেয়ে কেঁপে উঠেছে। ঘুম হালকা হয়ে গেছে৷ যখন বুঝল একটা হাত তার পেটে বিচরণ করছে তখন ঘুম ছুটে গেল। শিশির ঝুঁকে থেকে পিছনে তাকাল। ঠিক বারটার কাঁটার কাছে সেকেন্ড, মিনিট ও ঘন্টার কাঁটা ঠেকল। কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ছেড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে সে বলল,
” এ্যাই..আমার অপ্সরা আহ্লাদী বউ! শুভ জন্মদিন। আঠারটা বছর পাড় করে এলি আমার লেজ ধরে দুনিয়ায় এসে। আরো হাজার বছর আমার বুকে শুয়ে কাটানোর আহ্বান করছি। ”
কুয়াশার পুরো শরীরে বিদ্যুৎের সঞ্চার হলো৷ ঝটকা দিল৷ শিরা উপশিরা, নিউরনে নিউরনে কথাগুলো বাড়ি দিল। শরীরের রগ সহ লোম অবধি তরতাজা হয়ে উঠল৷ উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল৷ তড়াক উঠে বসে পড়ল। শিশিরও উঠে বসল। হলুদাভায় বউয়ের দিকে তাকাল। কাঁপা-কাঁপি সহ হাঁপড়ের মতো বুক উঠা নামা করছে। সেদিকে সুক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে শিশিরের আরো উন্মাদনা বাড়ল৷
কুয়াশা স্বামীর দিকে তাকাল। এই প্রথম শিশির তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল যা আজ গত আঠার বছরেও করেনি। প্রতি জন্মদিনে মারা মারি চুলোচুলি বাঁধত একটা জিনিস নিয়ে। আর সেটা তাদের জন্মদিন একই মাসে এবং একই তারিখ হওয়াতে। শিশিরের উইশ করার বদলে একটাই ডায়লগ ছিল,
” গোবর ঠাঁসা তুই আমার লেজ ধরে দুনিয়ায় এসেছিস”
কান পঁচে গেছে তার শুনতে শুনতে। এই কথা শোনা মাত্র ঝগড়া, মারা মারি, চুলোচুলি বেঁধে যেত। আর সেটাও ঘুম থেকে উঠে। প্রতি জন্মদিন এভাবেই কাটত তাদের। কেউ কাউকে সহ্য করত না এই দিনটাই। এতটাই ঘৃণীত ছিল যে জীবনে কখনো জন্মদিন উপলক্ষে কিছু করতেও নারাজ হতো৷ নিজেরা তো কিছু করতই না উল্টে বাড়ির কোনো সদস্যকে কিছু করতে দিত না৷ শুধু ঝগড়া আর চুলোচুলি। গেল বছর জন্মদিনেও ঠিক সেটাই হয়েছিল। আর এবার জন্মদিনে? সেই বুনো ওল নিজে উইশ করছে? কতটা পরিবর্তন এটা, ভাবা যায়! তারা স্বামী স্ত্রী এখন। ভাবতেই আবার উত্তেজিত হলো অন্তর। বলল,
” তুমি উইশ করলে আমায়? ”
শিশির হেসে ফেলল। তাদের পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল৷ জন্মদিনে কখনো উইশ করেনি কেউ কাউকে। আজ এমনটা হবারই। হেসে কুয়াশার দিকে গভীর দৃষ্টি দিল৷ আজকের দৃষ্টিটাও কেমন উত্তপ্ত যেন কুয়াশাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দেবে। কুয়াশা সেই চাহনীতে কেঁপে উঠল৷ শিশির উপর নিচ বার কয়েক মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। অর্থাৎ হ্যাঁ করেছে সে উইশ। তাদের সম্পর্ক আজ অন্যরকম। আর সেই ঝগড়ুটে কুয়াশা শিশির নেই৷ কুয়াশার মনে প্রজাপতিরা উড়ল। এগিয়ে একদম কাছে ঘনিষ্ঠ হলো সে। ফিসফিসিয়ে বলল,
” শুভ জন্মদিন টু তোমার আহ্লাদী বউয়ের সুদর্শন স্বামী। আঠারোটা বছর আমাকে সহ্য করেছ এখন হাজারটা বছর সহ্য করার জন্য প্রস্ততি নাও। তোমার লেজ আমি ছাড়ছি না। মৃত্যুই হবে বিচ্ছিদের একমাত্র অস্ত্র।”
সহসা শিশির কেঁপে উঠল। মৃত্যুর কথা শুনে চমকে উঠল। তাকাল কুয়াশার দিকে। টেনে নিল কোমড় ধরে। শিশির কিঞ্চিৎ কুয়াশার মুখের দিকে মুখ করে ছিল৷ এবার পুরোটা ঘুরে গেল। দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল আবছা আলোয়। শীতল পরিবেশ কিন্তু অন্তর তাদের মরুভূমি৷ উত্তপ্ত দা-বালনের ন্যায় জ্বলছে। আগুনের শিখার ন্যায় জ্বলে পুড়ে ধোঁয়া উড়ছে। পাঁজরে থাকা হৃৎপিণ্ড বাড়ি দিচ্ছে ধরাস ধরাস করে। দু’জন বোধহয় শব্দ শুনে নিচ্ছে। উত্তাপ নিঃশ্বাস পড়ছে একে অপরের মুখে। নিঃশ্বাসের বাতাস যেন অনল শিখা। পুড়িয়ে দিচ্ছে একে অপরকে।
শিশিরের অস্থির মন আরো অস্থির হলো। বহু অপেক্ষাকৃত বাসনা পূরণের জন্য অন্তর, কায়া আন্দোলন শুরু করল। লোমকূপ গুলো জানান দিল প্রয়োজন তোর প্রয়োজন এই সামনে থাকা মেয়েটিকে নিজের করে, আপন করে। আর অপেক্ষা কিসের? কিসের এত দ্বিধা? মন মিলেছে, ভালোবাসা হয়েছে এখন শরীর তো চাইবেই আকাঙ্ক্ষিত জিনিস। যা অতি আদিমকাল থেকে তার নিয়মে চলে আসছে৷ শুকনো খরখরা হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টির নামে চাইছে মন। শিশির ঠোঁট গোল করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঠোঁট ভিজাল। নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করবে ভেবে পাচ্ছে না। আশ্চর্য! রোজ তাকে বুকে নিয়ে শোয় এছাড়া ছোঁয়া ছুঁই যে একদমই হয়নি তাও না। তবুও এতটা উত্তেজনা কীসের জন্য! বুঝল না সে। শিশির নিজের দাবানলের ন্যায় পুড়তে থাকা শরীরের একটি অঙ্গ অর্থাৎ হাত কুয়াশার কপোল গলিয়ে দিল৷ কুয়াশা কাঁপল। স্বামীর প্রতিক্ষিত ছোঁয়াতে। সায় দিতে চাইল। জড়িয়ে এলো। অন্তর তারও পুড়ল৷ শিশির ফিসফিস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিঃশ্বাসের সাথেই বলল,
” কুয়াশা, আই ক্যান্ট রেসিস্ট মাইসেল্ফ! ”
সহসা চমকে উঠল কুয়াশা। স্বামী তার কী বুঝাতে চাইল এবং কী বলল তার বুঝতে একটুও দেরি হলো না। এই শীতল ঋতুতে দু’টি মন উত্তপ্ত। কুয়াশা কিয়ৎক্ষণ শিশিরের প্রগাঢ় দৃষ্টিতে অবলোকন করল। এরপর ঝুঁকে শিশিরের বুকে কপাল ঠেকিয়ে দিল। লজ্জায় দিল নাকি সম্মতিতে দিল বোঝা গেল না৷ শিশিরের অন্তর জুড়াল। পাতলা সাদা শার্টটার বুকের কাছের দুই-তিনটা বোতাম খোলা। সেই হালকা হালকা লোমশ বুকে মুখ ডুবিয়ে দিল৷ নাক ঘষতে থাকল৷ শিশির আরো উন্মাদ হলো৷ হাসল সহসা৷ জিজ্ঞেস করল,
” আজ গন্ধ লাগছে না? ”
” উহু, নেশা… আফিম..!”
নাক ঘষতে ঘষতে অকপটে নেশালো কন্ঠে উত্তর তার। মুখ খুলে হেসে ফেলল শিশির৷ আবার সেই এক উত্তর। অথচ বলেছিল তার শরীরে দূর্গন্ধ। আর সে কী পাগলামিটায় না করেছিল! মনে উঠে হাসল আরেকটু৷ বলল,
” শরীরে নেশা বুঝি? ”
” হুঁ।”
” বলেছিলাম না? তোর ভাষায় আমার এই দূর্গন্ধযুক্ত শরীরের নেশা চড়াব! নেশা না চড়িয়ে ক্ষান্ত হব না৷ ”
কুয়াশার মনে পড়ল সেদিন দুপুরের কথা। ঘর্মান্তক শার্ট মুখে ফেলাতে নাক ছিটকিয়েছিল সে। অথচ এই শরীর তার এখন রীতিমতো নেশা। যা আফিমের ন্যায় টানে তাকে। ভেবে নিয়ে আবারো অকপটে উত্তর করল,
” হুঁ, তুমি সক্ষম। এই শরীর আমার নেশ। আফিমের ন্যায় টানে আমায়। ”
বলে বিড়াল ছানার মতো মুচড়াতে লাগল বুকের উপর। শিশিরের বুকে ঢুকে যেতে চাইল৷ কিন্তু শিশিরের সায় পেল না বলে সক্ষম হলো না। কুয়াশার সাপের ন্যায় মুচড়াতে দেখে শিশির মাথাটা তুলল বুক থেকে। ঘাড় গলিয়ে চুলের পিছনে হাত নিয়ে শক্ত করে মুঠোয় ধরল। কুয়াশার নজরে নজর দিল। মুখে, ঠোঁট চোখ বুলাল৷ বলল,
” আমার মতো বুনো ওলের জ্বালা মেটানোর জন্য তোর মতো এই বাঘা তেঁতুল কুয়াশারই প্রয়োজন আজীবন, আমরণ।”
কুয়াশা শিউরে ওঠল। সেদিনের সেই না বুঝে অকপটে বলা কথাটা যে আজ এই ভাবে সত্যি হয়ে যাবে সে কি ঘুনাক্ষরেও বুঝেছিল? সে তো ব্যস বলে দিয়েছিল৷ কিন্তু কথাটার মানে যে এতটা গভীর ছিল বা হয়েছিল তার মস্তিষ্ক ধারনই করেনি কখনো৷ আজ ভবিতব্য তাদের কতদূর এনেছে৷ কুয়াশা অস্থির কন্ঠে বলল,
” সেদিনের অকপটে বলা কথাটা এভাবে সত্যি হবে বুঝি নি৷ চিরন্তন সত্য এটা, বুনো ওলের জ্বালা মেটানোর জন্য বাঘা তেঁতুলেরই প্রয়োজন হবে আমরণ।”
” আমারও প্রয়োজন হবে।”
কুয়াশা লজ্জায় নূয়ে পড়ল৷ চোখ বুজে এলো। শিশির আর দেরি করল না৷ তার ভেতরে চলা তোলপাড় কুয়াশাকে বুঝিয়ে দিতে চাইল৷ চাইল তার অতি প্রতীক্ষিত বাসনা মেটাতে৷ কুয়াশার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল৷ গভীর, গাঢ় অধর চুম্বনে মিলন ঘটাল। কুয়াশা দু’হাতে আঁকড়ে ধরল স্বামীর ঘাড় সহ গলা৷ শিশিরের এক হাত কুয়াশার চুলে মাঝে একহাত কোমড়ে চেপে ধরল। টেনে নিল নিজের শরীরের সাথে৷ শরীরে শরীর মিলল, ঠোঁটে ঠোঁট মিলল দু’টি মানব মানবির৷ দু’জনে উন্মাদ হলো। নিঃশ্বাসের শব্দও হলো ঘণ, গাঢ়। সেই শব্দ বাড়ি খেতে লাগল আবছা আলো-আঁধারি ঘরে৷
শিশিরের অস্থির মন, হাত গভীর হতে লাগল৷ চাওয়া পাওয়া গভীর হতে লাগল৷ কুয়াশা এক চুল পরিমাণ আঁটকাল না৷ চুম্বন অবস্থারততেই কুয়াশা শিশিরের ঘাড় থেকে একটা হাত তুলে শিশিরের কান চেপে ধরল৷ আচ্ছা জোরে দিল ঘুরিয়ে। ব্যথা পেল শিশির৷ এমন বিশেষ সময়ে, বিশেষ মুহূর্তে কুয়াশার এই কাজটাতে প্রচুর বিরক্ত হলো সে। ঠোঁট ছেড়ে অস্থির হয়ে হাঁপানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কি করছিস? ”
” যেটা সবসময় করি। ”
কুয়াশার দুষ্টু নজরে দুষ্টু হাসিতে ফিসফিসানো উত্তর। শিশির ফিসফিস করে হেসে ফেলল মাথা ঝুঁকিয়ে। হেসে নিয়ে মুখ তুলে কুয়াশার ঘাড়ের পেছনের চুল টেনে দিল আচ্ছা জোরে৷ কুয়াশা ‘আহ্’ করে উঠল৷ শিশির মুচকি হেসে বলল,
” এটা তো সব সময়ই চলে এবং চলবে। আপাতত এখন যেটা চলছে সেটা চলতে দে। ডো’ন্ট ডিসট্রাব মি গোবর ঠাঁসা। ”
বলেই কুয়াশাকে কিছু বলতে না দিয়ে আবার অধর চুম্বন করল। কুয়াশাও আর কিছু বলল না। শিশিরের আদর মেশানো ভালোবাসা সামলাতে লাগল। চুম্বন অবস্থাতে শিশিরের শার্ট খুলতে ব্যস্ত হলো। একের পর এক বোতাম গুলো খুলে দিল৷ শিশির টান দিয়ে খুলে ফেলে সাহায্য করল৷ কুয়াশা শিশিরের ঠোঁট ছেড়ে দিল। মুখ তুলে তাকাল শিশিরের দিকে। কিছু পল দেখে ঝুঁকে শিশিরে সেই কামড় দেয়া ক্ষত স্থানে মুখ নামিয়ে নিল৷ যেখানে সে দুই দুই বার কামড় দিয়েছিল৷ বুকের উপর৷ সখানে ঠোঁট দাবিয়ে গাঢ় চুমু খেয়ে আদর দিল৷ শিশির কুয়াশাকে ধরল। মুখ নামিয়ে কুয়াশার উন্মুক্ত কাঁধের উপর নাক ঘষল।
কুয়াশা সেখানে চুমু দিয়ে আস্তে আস্তে সারা বুকে চুমু দিল ছোট ছোট। অস্থির করে তুলল শিশিরকে৷ শিশিরের কন্ঠ মনিতে চুমু আঁকল। সে কুয়াশার নরম শরীরটা দু’হাতের আঁজলায় নিয়ে নিল৷ ডুবিয়ে দিল কুয়াশার বক্ষবিভাজিকায় মুখ৷ সেখানে সহ গ্রীবাদেশে ছোট ছোট আদর দিল। কুয়াশা সাপের ন্যায় মুচড়াতে লাগল। বুঝল শিশির তা৷ নিয়ন্ত্রণে নিতে বউকে নিয়ে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল৷ পিষিয়ে ফেলতে চাইল কুয়াশার নরম শরীরটা নিজের শক্তপক্ত বুকের নিচে৷ কুয়াশা শিশিরের নগ্ন পিঠে নখ বসিয়ে দিল। শিশির কুয়াশার গ্রীবাদেশে চুমু আঁকল। এরপর কামড় দিল। অনেকটা জোরে। ব্যথাতে গুঙিয়ে উঠল কুয়াশা। ব্যথা সহ্য করতে আরো জোরে নখ বসাল স্বামীর পিঠে। সেদিকে হুস নেই শিশিরের। সে তার কাজে ব্যস্ত৷ এদিকে কুয়াশার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে অথচ মুখে তৃপ্তিময় হাসি। শিশিরের কাঁধের উপর চুমু দিল। ফিসফিস করে বলল,
” ভালোবাসি খুব। ”
শিশিরের কানে যেতেই থেমে গেল। গ্রীবাদেশ থেকে মুখ তুলে নিল৷ তাকাল বউয়ের দিকে। আজ প্রথম ভালোবাসি শব্দ পেল বউয়ের মুখ থেকে। আজকের সবকিছু স্পেশাল। দিন, রাত, ক্ষণ, তারিখ, মাস, সবকিছু স্পেশাল। শিশির মুচকি হাসল। পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখল কুয়াশার চোখে পানি। জিজ্ঞেস করল,
” চোখে পানি কেন? ”
” সুখে, তোমার সুখ আমাকে গ্রাস করেছে। সুখে মরছি আমি। ”
শিশির মুগ্ধ নয়নে চায়ল। এর থেকে সুখের আর কি হতে পারে একটা পুরুষের কাছে? তার বউ তার কাছে সুখী৷ শিশির মুচকি হাসল আবার। এবার সে-ও ফিসফিস করে বলল,
” আমিও ভালোবাসি আমার ঝগড়ুটে বউকে৷”
কুয়াশা রাগল এখন ঝগড়ুটে বলতে শুনে৷ ভ্রু কুঁচকে কামড় বসাল শিশিররের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িযুক্ত চিবুকে৷ শিশির ‘ইশশ’ করে উঠল। কুয়াশা খিলখিল করে হাসল। সেই হাসি বন্ধ করল ঠোঁটে কামড় দিয়ে। কুয়াশা ব্যথা পেল৷ বিরক্ত হলো৷ বলল,
” শুধু কামড় দেয়, খারাপ লোক একটা ”
” ঠিক করেছি, তুই দিলি কেন? ”
এই দুইটা জীবনেও শুধরাবে না৷ তারা রোমান্সেও চুলোচুলি তো করছেই সাথে এখন ঝগড়াও করছে। কতটা ফাজিল দু’টো চিন্তা করা যায়!
কুয়াশা কিছু বলতে যাবে তৎক্ষনাৎ গাঢ় একটা চুমু খেল কুয়াশার অধরে অধর ডুবিয়ে। এরপর গ্রীবাদেশে একটা গাঢ় চুমু আঁকল। কুয়াশা পিঠের নিচে দুই হাত গলিয়ে দিল৷ বিছানা থেকে কুয়াশাকে হালকা উঁচু করে বুকের সাথে চেপে ধরল। পিঠের নিচের একহাত কুয়াশার কামিজের চেইনের উপর নিয়ে গেল। খুলে দিল তা টান দিয়ে। টের পেয়ে কুয়াশা আঁকড়ে ধরল শিশিরকে৷
শিশির কাঁধ থেকে জামা সরিয়ে সেখানে চুমু আঁকল। একে একে তার চাওয়া গভীর থেকে গভীরে গেল। কুয়াশা সায় দিল। সামলাতে ব্যস্ত হলো। মিলল দুটি মানব মানবি৷ বহু অপেক্ষার পর, বহু প্রতীক্ষার পর। দুই মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির দেখা মিলল। ভেজাল দুটি অন্তর, শরীর। দু’টি উত্তপ্ত দেহ ভিজিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। তাদের অপেক্ষা শেষ হলো। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বর্গসুখ পেল৷ মিলন কালের সুখ দুটি মানব মানবি টের পেল। আদিম কালের আদিম চাওয়াতে তারা মত্ত হলো। সুখের শ্বাস-প্রশ্বাস বাড়ি খেতে লাগল চার দেয়ালে।
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৫৪
এরা দুটো আজ তাদের সত্ত্বাকে ধরে রেখেও সংসার জীবনে এগিয়ে গেল। সেই একে অপরকে এক চুল পরিমাণ ছাড় না দেয়া শিশির কুয়াশা আজ এক হয়েছে। মালিথা ভিলার দু’টি হাম সেপাই নিজেদের ভালোবাসতে শিখে গেছে। বুঝদার হয়ে সংসার সাজাতে শিখে গেছে৷ তাদের এই সংসার, এই ভালোবাসা, এই মিলন খুব সোজা ছিল না। অনেক কিছু পার করে এসে মিলেছে,
‘বুনো ওল বাঘা তেঁতুল’
