বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৫৭+৫৮
রোজা রহমান
কুয়াশাচ্ছন্ন আঁধারিয়া ভোর। চারিদিকে আজান দিচ্ছে। প্রকৃতিতে শীতকাল ঋতু জেঁকে বসেছে। শীতের সকালে ওঠা আলসেমির কাজ৷ মন, মস্তিষ্ক উষ্ণতা পেলে বলে আরো কিছুক্ষণ লেপ, কম্বলের নিচে শুয়ে থাক। চেয়েও যেন উঠতে ইচ্ছে হয়না।
‘প্রকৃতি কুয়াশা আচ্ছন্ন। ঘাসে ঘাসে শিশির জমেছে। গাছের পাতায়, ঘরের চালে, বড় বড় অট্টালিকার ছাদে নীহার পড়ছে। হিমেল হাওয়া হিম ঠাণ্ডা তুহিনের মতো প্রকৃতির মাঝে শুধু তুষার বৃষ্টির কমতি।’
আজানের ধ্বনি কানে ভেসে আসেতেই কুয়াশার ঘুম ছুটে গেল। নিজেকে নড়াতে সক্ষম হলো না। কারণ তার পুরো শরীরটা শিশিরের আয়ত্তে। কম্বলের নিচে গুটিশুটি হয়ে কুয়াশাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে সে। সে উপর হয়ে ডান হাত দ্বারা কুয়াশার পেটে জড়িয়ে, মুখ গলার মাঝে ডুবিয়ে এবং অর্ধেক শরীরের ভর কুয়াশার শরীরের সাথে দিয়েছে। কুয়াশা চিৎ হয়ে শুয়ে। সে পিটপিট করে তাকাল মাথা কাৎ করে স্বামীর দিকে। হুলুদাভ মৃদু আলোয় দেখল স্বামীকে। কী কিউট লাগছে ঘুমন্ত স্বামীটকে! ভেবেই মুচকি হাসল৷ স্বামীর শরীরের গরম উষ্ণতা তার শরীরও উষ্ণ করে রেখেছে৷ রাতের একএকটা মূহুর্ত চোখের পাতায় ভেসে উঠল। শিউরে উঠল এই শীতল ভোরে। খলবলিয়ে নড়ে উঠল৷ মাথাটা এগিয়ে নিয়ে চুমু আঁকল স্বামীর বন্ধ চোখের পাতায়।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
নড়াচড়া পেয়ে শিশির বিরক্ত হলো৷ ঘুমের মাঝে ভ্রু কুঁচকাল৷ তা দেখে হাসল। বালিশের সাথে মাথার একপাশ ঠেকিয়ে ঘুমচ্ছে যার ফলে ঠোঁট গোল হয়ে আছে। যেটা কোনো বাচ্চাদের থেকে কম লাগছে না। কুয়াশা এবার নড়াচড়া বাড়িয়ে দিল৷ ডাকল,
” এ্যাই, ওঠো! ছাড়ো আমায় ”
শিশিরের ঘুম হালকা হলো৷ কিন্তু উত্তর এলো না৷ পুরোপুরি ছুটেনি। কুয়াশা একহাত বের করার চেষ্টা করল শিশিরের হাতের নিচে থেকে৷ বলল,
” আরেহ্ ছাড়ো আজান দিয়েছে। এ্যাই খাটাশ বেটা!”
” ফাজিল, সকাল সকাল মার না খেতে চাইলে ভাষা ঠিক কর আর ঘুমোতে দে আমায়।”
ঘুম জড়ানো কন্ঠে বিরক্ত, ভারী স্বরে স্বাভাবিক ভাবেই বলে উঠল কথাগুলো। চোখ তার বন্ধ। যেটা কুয়াশার কাছে অতি নেশালো মনে হলো। শিশিরের নগ্ন পিঠে একটা হাত তুলে বিচরণ করল৷ শিশির ঘুম ছুটল। পিটপিট করে তাকাল৷ কুয়াশা মুচকি হাসি দিল৷ আর শিশিরের তা দেখে হৃদয়, চোখ দু’টোয় জুড়াল৷ আহ্ সকাল সকাল চোখ খুলে বউয়ে মিষ্টি হাসির সাথে সাক্ষাৎ হলো। শিশিরের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখা দিল৷ সালাম দিল কুয়াশা। শিশির সেই জড়ানো কন্ঠে উত্তর করল। নিজেও ফেরত সালাম দিল। দিয়ে আবার মুখ গুঁজে দিল গ্রীবাদেশে। সুবাস নিল টেনে। কুয়াশা টের পেয়ে অমায়িক হাসল। বলল,
” ছাড়ো এবার। উঠতে হবে। আজান দিয়ে দিয়েছে। ”
বলে উঠতে নিল৷ শিশির আঁটকে দিল৷ কুয়াশার মাথা আবার বালিশে রাখতে হলো৷ বিরক্ত হলো খুব।
শিশির মুখ তুলল৷ পেটের উপরের হাতটা কোমড়ের দিকে গলিয়ে আরেকটু কাছে টেনে নিল৷ মাথা তুলে তাকাল৷ ফোলা চোখ, মুখ, ঠোঁট দেখে নিল। কুয়াশা বলল,
” ছাড়ো। এই শীতে এখন মেজাজটা গরম হচ্ছে। ”
শিশির শুনে হাসল৷ টিপ্পনী কেটে বলল,
” তোর দোষ সব৷ আচ্ছা শোন একটা বুদ্ধি দিই। শরীর গরম করে নে।”
কুয়াশা ভ্রু কুঁচকাল৷ শিশিরের চোখেমুখে স্পষ্ট দুষ্টুমি খেলা করছে৷ প্রশ্ন করল,
” কীভাবে?”
” আরেকবা….”
আর বলতে দিল না৷ এক ঝটকায় শিশিরকে দূরে সরাল৷ শিশির ধারাম দিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ল। কুয়াশা রেগেমেগে বলল,
” অসভ্য ইতর লোক।”
বলেই উঠে পড়ল বল প্রয়োগ করে। তবে দু’ই পায়ের উরুর উপরিভাগে একটু ব্যথা অনুভব হলো। টনটন করে উঠল তলপেট। চোখ মুখ খিঁচিয়ে ফেলল৷
এদিকে শিশির শব্দ করে হেসে চলেছে কথাটা বলেই৷ কুয়াশা নিজেকে সামলে চোখ পাকিয়ে তাকাল। মাথার নিচে থেকে বালিশ তুলে বার কয়েক বাড়ি দিল৷ শিশিরের শরীর থেকে কম্বল সরে গিয়ে নগ্ন শরীর দৃশ্যমান হয়েছে। বাড়ি দিয়ে কিড়মিড় করতে লাগল সে। শিশির হেসে নিয়ে বলল,
” থাক, বউ আমার একদিনে এত ডোজ সহ্য করতে পারবে না। ”
কুয়াশা দ্বিগুণ রাগল। আর শিশির তাকে রাগানোর জন্য যত প্রকার ফাজলামো আছে করে যেতে লাগল। কুয়াশাও আনলিমিটেড মেরে ধাপধুপ করে নেমে পড়ল৷ নামতেই আবার পেট চেপে ধরল। শিশির হাসি থামিয়ে দিল। তাকাল বিছানার পাশে। যা বুঝার বুঝল৷ কুয়াশা চলে গেল রাগের মাথায় বাথরুমে৷ ধারাম দিয়ে দরজা আঁটকাল৷ শিশিরও আর দেরি করল না৷ উঠে পড়ল। পরনে শুধু টাউজার৷ সে নেমে নিজেই বিছানার চাদর তুলে নিল৷ সেটা হাতে করেই হাঁটা ধরল। বাথরুমের কাছে এসে ডাকল,
” কুয়াশা…! ”
উত্তর দিল না৷ আবার ডাকল,
” এ্যাই গোবর ঠাঁসা! দরজা খোল!”
কুয়াশা চেঁচিয়ে বলল,
” চোখ নেই তোমার? আমি বেরবো এরপর আসবে। যাও এখন! ”
বিরক্ত বাড়ল। থাবা দিল দরজায় জোরে একটা। বলল,
” খোল বেয়াদব, নয়তো মার একটাও মাটিতে পড়বে না। ফাজিল দেখছিস না লেট হচ্ছে! ”
দরজা খুলল কুয়াশা বলল,
” আমি গোসল করব, তারপর আসবে। সরো৷ ”
” বেয়াদব, ওভাবে দেরি হয়ে যাবে। ”
কুয়াশা ভাবল কথাটা। সত্যি দেরি হয়ে যাবে। কথা বাড়াল না। দরজার মুখ থেকে সরে গেল৷ শিশির ঢুকে দরজা আঁটকে দিল। ভেতরে একটা বালতিতে বিছানার চাদর রাখল। কুয়াশা দেখল৷ তাকাল শিশিরের দিকে। লজ্জরা ভিড় জমাল৷ মুচকি হাসল শিশির। তবে কিছুক্ষণ পর কেন জানি কুয়াশা ফুঁপিয়ে উঠল। শিশির ভড়কে গেল৷ তড়িঘড়ি করে কাছে এগিয়ে গেল৷ দু’হাতের আজলায় কুয়াশার মুখ ধরে তুলে অতিশয় নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” এ্যাই.. বউ কি হয়েছে? ”
শিশিরকে জড়িয়ে ধরল। বুকে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপাতে লাগল৷ ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
” আমি সতীত্ব হারায়নি বিয়ের আগে। প্রমাণ পেলে তো!”
” কুয়াশা…!”
কথাটা শোনা মাত্রই ধমকে উঠল শিশির মৃদু শব্দ করে
কুয়াশা আরো শক্ত করে ধরল শিশিরকে। শিশির আগলে নিল বউকে৷ বুকের সাথে চেপে ধরল। বলল,
” আর কখনো যেন এমন সব কথা না শুনি। তোকে সেদিন কী বলেছিলাম আমি? তুই আমার পবিত্র পুষ্প। তোকে কখনো এসব নিয়ে কিছু বলেছি? ”
” না ”
ফুঁপানো উত্তর তার।
” তবে এমনটা বললি কেন? আমার এসব জানার প্রয়োজন নেই। তুই বিয়ের আগে যতই আমার অপছন্দের ছিলি না কেন তবুও তুই এই বাড়ির সম্মান আর আমার চাচতো বোন ছিলি৷ তাহলে তোকে অসম্মান করি কি করে? তোকে অপছন্দ করতাম অসম্মান না।”
কুয়াশা উত্তর করল না। শক্ত করে ধরে রাখল। এরপর মুখ তুলে তাকাল শিশিরের দিকে৷ শিশির একহাতে চোখ মুছিয়ে দিল৷ বলল,
” নামাজের দেরি হবে। ফটাফট গোসল করে নে। ”
বলে কুয়াশার শরীর একটু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিল। আর কুয়াশা চেঁচিয়ে উঠল। শাওয়ারের ঠান্ডা পানি পেয়ে কুয়াশা শীতে কেঁপে তো উঠলই সাথে শিশিরের চোদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগল। শিশির শব্দ করে হাসল। কুয়াশা এবার বালতিতে থাকা সারারাতের অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি মগে তুলে শিশিরের নগ্ন গায়ে ঢেলে দিল। চেঁচিয়ে উঠল শিশির। এবার কুয়াশা খিলখিল করে হেসে দিল। বলল,
” অনুভূতি বলো? ঠান্ডা পানির..! ”
” ফাজিল! ”
কিড়মিড় করতে করতে কটমট নজরে তাকিয়ে বলল কথাটা। কুয়াশা আবার হাসল শিশির কুয়াশার ভেজা চুল টেনে দিল। এভাবেই খুঁনসুটিতে দু’জন গোসল সারল।
ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে শিশির কুয়াশা নামাজ পড়ে উঠল দু’জনে এক সাথে মাত্রই। জায়নামাজ গুছিয়ে শিশিরেরটা হাত থেকে নিয়ে দু’টোই রেখে এলো কুয়াশা। মাথার হিজাব খুলল। শুকনো তোয়ালে দিয়ে ভালো করে চুল মুছল। হেঁটে মিররের সামনে দাঁড়াল। দু’জনের শরীরে সোয়েটার। চুল মুছে চুলে চিরুনি করল। শীতের টুকটাক কিছু প্রসাধনি মাখল। শিশির পিছে এসে দাঁড়াল। কুয়াশা ঘুরে তাকাল শিশিরের দিকে। নূয়ে পড়ল লজ্জায়৷ শিশির ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,
” পুরোটাক্ষণ যার অস্থিরতা আর নেশা ছাড়া এক ছিঁটেফোঁটাও লজ্জা পেলাম না সে এখন লজ্জায় নূয়ে পড়ছে? বাহ্ ইন্টারেস্টিং! ”
” থামো… এখন লজ্জা পাচ্ছি আমি। ”
বলেই শিশিরের পেটের উপর হাত গলিয়ে দিয়ে পিঠে নিয়ে গিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। কপাল ঠেকিয়ে দিল শিশিরের বুকে৷ লজ্জা মাখা হাসি ঠোঁটে তার। কেন যেন এখন শিশিরের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। শিশির শব্দ করে হেসে দিল। পিঠে এক হাত দিয়ে আগলে ধরল। শীতল মৌসুমে দু’টি মন উষ্ণতা পাচ্ছে। তারা আজ পরিপূর্ণ, সুখী দম্পতি। কুয়াশা বলল,
” চাচুদের ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে। জোর করে বিয়ে না দিলে জানতেই পারতাম না তুমি পুরুষটা একটা মেয়ের জন্য এতটা পারফেক্ট। ”
” আচ্ছা?”
” হুঁ।”
” তা এটা কি রাতের জন্য মনে হয়েছে? আগে টের পাসনি?”
কুয়াশা শিউরে উঠল। মুখ তুলে শিশিরের বুকে কি’ল বসাল আলতো করে৷ বলল,
“ধুর! ”
শিশির হেসে ফেলল। কুয়াশাকে কোলে তুলে নিল। কোলে নিয়েই বিছানায় বসল। কম্বল তুলে কুয়াশা সমেত নিজেকেও ঢেকে নিল ভালো করে৷ বেড সাইড টেবিলের ডয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে সেখান থেকে একটা পেইন কিলার নিল৷ খুলে কুয়াশার মুখে ঢুকিয়ে দিল নিজেই। ফ্লাক্স থেকে হালকা গরম পানি গ্লাসে ঢেলে নিয়ে কুয়াশার মুখে ধরল। কুয়াশা বিনা বাক্যে খেল। সে যানে তার স্বামী কতটা দায়িত্ববান। তাই এসবে এখন আর অবাক না হয়ে শুধু মুগ্ধ হয়। শিশির গ্লাস রেখে বলল,
” বাহিরে গেলে ঔষধ এনে দেব। ”
” আর লাগবে না এতেই হবে। ”
” আমি পেইন কিলারের কথা বলি নি।”
থেমে কুয়াশা চুল গুলো ভালো করে এলিয়ে দিল৷ গালের উপর ঠান্ডা ডান হাতটা রাখল। এরপর বলল,
” কুয়াশা এখনও আমাদের অনেক এগুতে হবে। আমি নিজেই এখন অবধি তোর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারলাম না তার মাঝে বেবি কি করে নিব? দুই-তিন বছর অপেক্ষা কর। আর তুই নিজেও ওসবের জন্য অনেকটা ছোট। এছাড়া সামনে তোরও চাপ বাড়বে পড়াশুনোর৷ আগে নিজের স্বপ্ন পূরণ করে নে৷ আমি সবসময় পাশে থাকব তোর।”
কুয়াশার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল। থেমে কুয়াশার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিল। বোঝার চেষ্টা করল কুয়াশা কীভাবে নিল কথাগুলো। ভুলটুল বুঝল কিনা সেই দ্বিধায়। কুয়াশা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” আমি নিজেই এটা বলতাম তোমায়৷ তুমি নিজের ক্যারিয়ারে আগে ফোকাস করো। তাড়াহুড়ো কিসের এত? ”
শিশির মুচকি হাসল। কপালে চুমু দিল বলল,
” এইজন্যই তোর প্রেমে এত জলদি পড়লাম আমি। তুই অনেক বুঝদার। সব কিছু ভেঙে বোঝানো লাগে না। নাদান না তুই। না বলতেই বুঝে নিস ইঙ্গিত করলে। ”
কুয়াশা উত্তর করল না। কম্বলের নিচে দুই হাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরল। কোলের উপর শুয়ে সে। মাথা রাখল বুকে। শিশির দুইহাতে আগলে রাখল। শিশির কুয়াশার ভেজা চুলগুলো নাড়িয়ে বলল,
” হেয়ার ড্রায়ার নেই তোর? ”
” নাহ্।”
ভ্রু কুঁচকাল শিশির। এতদিন বিয়ে হয়েছে আর আজ খেয়াল করল! কখনো বলেওনি মেয়েটা তার এটা লাগবে কিংবা ওটা লাগবে৷ তার কাছে বলেও না অবশ্য। মেয়েটা সত্যি শুধু তার কাছেই উগ্রতা দেখাত। বলল,
” নেই কেন? ”
” কখনো প্রয়োজন মনে করিনি আর প্রয়োজনও হয়নি৷ গরমের দিনে দুপুরে গোসল করে ফ্যানের নিচে বসলেই শুকিয়ে যেত৷ আর শীতের দিনে ছাদের রোদে গেলে নয়তো এমনিই শুকিয়েছি৷ এমনিতেও ততটাও বড় না আমার চুল, তাই প্রয়োজন হয়নি। ”
শিশির কুয়াশার মুখের দিকে চেয়ে রইল কিছুপল৷ আরেকটু টেনে নিল তার বউকে। বলল,
” আজ থেকে প্রয়োজন হবে। বাহিরে গেলে ওটাও কিনে আনব। এখন থেকে গোসলের পর সাথে সাথে শুকিয়ে নিবি৷ ”
থেমে কুয়াশার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
” ইভেন আজ থেকে রোজ প্রয়োজন পড়বে। ভেজা চুলে বাহিরে যেতে পারবি না৷ আর তুই বাড়িতে মাথায় ওড়না দিয়েও ঘুরিস না সো, প্রয়োজন পড়বে না? ”
কুয়াশার শীতের হিমেল হাওয়া গায়ে লাগার মতো কাঁটা দিল শরীর। মাথা উঁচু করে তাকাল শিশিরের দিকে। আবার লজ্জায় নূয়ে পড়ল। তবে অভিভূতও হলো স্বামীর প্রতি। তাকে নিয়ে এতটা চিন্তা করতে দেখে। কখনো প্রয়োজন হয়নি বলে বলেও নি বাড়িতে। সব প্রয়োজন তুষারকে জানাত। আর গোপন জিনিস জাকিয়াকে জানাত৷ জাকিয়া টাকা দিয়ে দিত৷ এছাড়া তার অতি প্রয়োজন ছাড়া কখনো অপ্রয়োজনীয় জিনিসে নজর দেয়নি। সে জানত যতই ভালোবাসুক তবুও তারা এই সংসারের উপর বসে খায় সেখানে বিলাসিতা কি করে করবে? এটাই সব সময় মনে করত। ছলছল করে উঠল চোখজোড়া তার। এখন তার জোর হয়েছে এই বাড়িতে। এই বাড়ি তার স্বামীর বাড়ি। শিশির দেখল তা এবং বুঝলও। বলল,
” এখন থেকে যা প্রয়োজন পড়বে আমায় জানাবি। আমাকে এসে বলবি। তোর স্বামী ইনকাম করা ধরে নি ঠিকই, কিন্তু কম নেই৷”
কুয়াশা বুকে মাথা রেখে পড়ে রইল। কি মনে করে মুখ তুলে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” হুহ্, মনে আছে আমার। সেদিনের ঘড়ি কেনা নিয়ে ঘটনাটা। ভুলি নি কিচ্ছু। একটা ঘড়ি কিনে দিতে গিয়ে অপমান করেছিলে। ”
শিশিরের মনে পড়ল। বলল,
” ওটা আমার পছন্দ হয়েছিল৷ আর তখনের সম্পর্ক কি ছিল আমাদের?”
” বুনো ওল বাঘা তেঁতুল। ”
শিশির হেসে ফেলল। বলল,
” এখনি কম কিসে? রাতে আমার আদর করাতেও বাঁধা দিয়েছিস তুই আর সারা পিঠ তো বোধহয় ফাঁকা রাখিস নি! সাথে কামড় তো ফ্রিতে খাই অল টাইম। ”
বলে কুয়াশার নাকের উপর কামড় দিল৷ কুয়াশা খিলখিল করে হাসল। বলল,
” ঠিক করেছি।”
” ফাজিল ”
” জীবন রঙিন করেছ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি ”
শিশির মুচকি হাসল। শিশিরের কিছু মনে পড়ল যেন। সে কুয়াশাকে নামিয়ে আলমারির কাছে গেল। গিয়ে কিছু একটা বের করল। এগিয়ে এসে আবার একই জায়গায় বসল৷ একটা ছোট্ট বক্স বের করল। কুয়াশা হাতে দিল৷ বলল,
” জন্মদিনের গিফট। আরো বড় কিছু দিতাম কিন্তু জানিসই তো পরিস্থিতি! তাই পরবর্তীতে দেব। আর তোর স্বামী যখন ইনকাম করবে তখন আরো দেব। ”
কুয়াশা অবাক হয়ে গেল। এক্সাইটেড হয়ে খুলল রেপিং করা বক্সটা। খুলে দেখল হিরার ছোট্ট একটা নাকফুল৷ বক্সটার মাঝে জ্বল জ্বল করছে। অবাক হলো খুব৷ শিশিরের দিকে তাকাল। বলল,
” এত টাকা খরচ করার কি দরকার ছিল? এমনি বাড়িতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে এখনো লাগবে! ”
” অত চিন্তা করতে হবে না তোর। এমনিতেও বিয়ের পর কিছুই দিই নি তোকে। এক ড্রেসে বিয়ে করেছি তারউপর ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইলাম সেটাও হলো না৷ কিছু করি না বলেকি বউকে এই সামান্য কিছু দিতে পারব না? এটা তুই যতটা দামি মনে করছিস ততটাও না। এত ভাবতে হবে না। আর এই টাকা আমার একাউন্টের। সেখানের টাকা বাড়িতে কখনোই লাগবে না৷ ভাইর, চাচুর, বাবারটাই নেবে। বুঝলি? ”
বলে নাকের উপর টোকা দিল হাত দিয়ে। বলল,
” পরিয়ে দিই দে! ”
” একটা আছে তো! ”
” খুলে রাখ ওটা ”
কুয়াশা শিশিরের হাতে বক্সটা দিয়ে নাক থেকে সোনার নাকফুলটা খুলল। সেটা খুলতেই শিশির অতি সাবধানে হাতের টা পরিয়ে দিল। টিকালো নাকে হিরার নাকফুলটা পরাতেই মুখে অন্যরকম এক সৌন্দর্য এসে ভিড় জমাল৷ জ্বলে উঠল নাকফুলের সাথে কুয়াসার হলুদাভ বর্ণের বদনখানি। শিশির পুরো মুখে অবলোকন করল৷ মুগ্ধ হলো৷ বলল,
” তুই সত্যি আমার অপ্সরা! ”
কুয়াশা লজ্জা পেল। মিষ্টি হাসল। শিশির বলল,
” অপূর্ব লাগছে আমার বউটাকে ”
বলে নাকে পরিহিত নাকফুলটার উপর চুমু দিল৷ কুয়াশা আপ্লূত হয়ে গলা জড়িয়ে ধরল শিশিরের সামনে থেকে। ডান গালে চুমু দিয়ে বলল,
” ধন্যবাদ মিস্টার শিশির মালিথা।”
শিশির হাসল। উত্তর করল,
” ওয়েলকাম মিসেস শিশির কুয়াশা মালিথা। ”
অমায়িক হাসল কুয়াশা। তার শিহরণ হয় যখন এই নামে ডাকে যে কেউ৷ শিশিরের সাথে জুড়িয়ে ‘শিশির কুয়াশা’। হায় কী সুন্দর লাগে শুনতে!! গলা জড়িয়ে রেখেই বলল,
” দেনমোহরের টাকা থেকে কিছু টাকা তুলে দিয়ো তো।”
” কী করবি? ”
” আমার স্বামীর জন্য কিছু কিনব। জানো তো তারও আজ জন্মদিন৷ সে সব সময় বলে তার লেজ ধরে দুনিয়ায় এসেছি। কিন্তু আফসোস জীবনেও তার লেজটা খুঁজে পেলাম না৷ আচ্ছা কোথায় লুকিয়ে রাখে বলো তো? ”
শিশির ভ্রু ম্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। কী বলে এই মেয়ে? সে তো কথার কথা বলে! আর এই পাগলা কি সত্যি খুঁজে বেড়ায়? কতত বড় ফাজিল ভাবা যায়! বলল,
” এ্যাই ফাজিল আমি তো কথার কথা বলি! ”
কুয়াশা শরীর দুলিয়ে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে শিশিরের কাঁধের উপর কপাল ঠেকিয়ে দিল। গলা সে এখনো জড়িয়ে ধরে আছে৷ শিশির তার পাজি বউয়ের কার্বারের মুচকি হাসল। এই মেয়েটা তাকে হাসায় শুধু। বলল,
” লাগবে না গিফট। রাতে যে গিফট দিয়েছিস এতেই খুশি আমি। আজীবন এভাবে সঙ্গী হয়ে রয়ে যাস। ”
কুয়াশা মুখ তুলে তাকাল। শিশির মুচকি হাসল। আবার কোলের উপর উঠে বসল সে৷ শিশির কম্বল তুলে ঢেকে নিল দু’জনকে৷
সকাল আটটার দিকে কুয়াশা আজ একটু অন্যরকম ভাবে তৈরি হলো৷ শাড়ি পরল আজ প্রথম বিয়ের পর বাড়িতে৷ সে কালো ব্লাউজের সাথে পুরো কালো একটা সুতি শাড়ি পরল। এটা ইয়াসমিন দিয়েছিল। সে নিজের জন্য কিনতে গিয়ে এনেছিল। শাড়ির সাথে জাকিয়ার দেয়া সেই মোটা বালা জোড়া পরল। হাতে সব সময় চিকন বালা থাকে। সেটা আজ খুলে রাখল৷ গলায় সোনার চেইন পরল৷ ছোট্ট সেই দুল জোড়া পরল। চুলটা এখনো ভেজা হালকা তবুও হাত খোঁপা করে ফেলল৷ চোখে হালকা কাজল দিল৷ ব্যস আর কিচ্ছু না। এতেই যেন চোখ ঝলসে যাবে। যাকে বলে সিম্পলের মাঝে গর্জিয়াস। কালো শাড়ির সাথে সোনার চকচকা গহনাগুলো হলুদাভ শরীরের সাথে জ্বল জ্বল করতে লাগল। পেছনে শিশির শুয়ে ফোন টিপছে৷ মিররে দেখল তা। শিশির টুংটাং শব্দ পাচ্ছে কখন থেকে৷ কিন্তু ফোনে ব্যস্ত। কি মনে করে তাকাল কুয়াশার দিকে। আর চমকে উঠল। এ শাড়ি কখন পরল?
কুয়াশা দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিল। ডাকল,
” এ্যাই…! ”
কুয়াশা পেছন ঘুরল। আরো অবাক হলো। এ তো আসমানের পরী সেজেছে! ডাকল,
” এদিকে আয়। ”
কুয়াশা এগিয়ে গেল। শিশির অনেকটা সময় ধরে অবলোকন করল একে একে। ঘোর লাগল। নেশা জাগল৷ নিজেকে সামলাল৷ বলল,
” এত সেজেছিস কেন? ”
” ইচ্ছে হলো তাই। ”
কুয়াশা ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত ঝরা স্বরে উত্তর করল। শিশির উঠে বসে পড়ল। হাত ধরে টেনে বসা অবস্থায় কোমড় জড়িয়ে ধরল দুই হাতে। মাথা তুলে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল,
” কিন্তু আমার তো এখন তোর সাজ নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে! ”
কুয়াশা কথার মর্মার্থ বুঝে দিল চাপ্পড় শিশিরের বাহুতে। এরপর দুইহাতে চুল ধরে টেনে মাথা সমেত ঘুরিয়ে দিল। তৎক্ষনাৎ ছিটকে সরে এসে বলল,
” অসভ্য শয়তান ছেলে!”
বলেই ধেই ধেই করে ধাপধুপ পা ফেলে স্থান ত্যাগ করল। শিশির হেসে দিল। আজ বড্ড সুখ সুখ লাগছে। অন্তরে নানান রঙের প্রজাপ্রতিতার উড়ছে। নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে। সেই সুখের দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। জীবনের রঙ এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরুক।
মালিথা ভিলার সকলে ঘুম থেকে উঠে গেছে। শীতের দিন তবুও আজ একটু জলদি উঠেছে। বাড়িতে মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। সে-সবরই তোড়জোড় চলছে। রান্না বান্নার কাজ সহ পেন্ডেল করা হচ্ছে বাহিরে। পাড়া-প্রতিবেশী সহ আত্মীয়-স্বজনরা আসবে। মসজিদের জামাতের লোকও ডাকা হবে এছাড়া কিছু এতিমদেরও ডাকা হবে। অনেক সংখ্যক লোক হবে বিধায় পেন্ডেলের আয়োজন৷
বসার ঘরে ছোটরা সকলে বসে আছে। নেই শুধু বৃষ্টি। এত শীতের মাঝে সে বাহিরে আসে না। কুয়াশা নামতে নামতে দেখল রিজভীরা গল্প করছে সাথে চা- কফি নাস্তা। কুয়াশাকে নামতে দেখে সকলে মুগ্ধ হয়ে গেল। কালো শাড়িতে মেয়েটাকে তো অপূর্ব লাগছেই সাথে নাকে হিরার নাকফুল দূর থেকে জ্বল জ্বল করছে। আর সাজাতেও অপূর্ব লাগছে। শশী তা দেখে দৌড়ে কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
” বুবু, শুভ জন্মদিন। তোমাকে কী অপূর্ব যে লাগছে! বলার মতো না। ”
কুয়াশা অমায়িক হাসল। সে-ও সৌজন্যে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিল। হিম এসে বোনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল। একে একে রিজভী, স্মৃতি, ঈশা, মিহির সহ সবাই জানাল উপস্থিত। নীহার গিফট দিয়ে শুভেচ্ছা জানাল৷ তুষার, তুহিন শুভেচ্ছা জানাল৷ ইয়াসমিন জানিয়ে বৃষ্টিকে আনতে গেল। কুয়াশা সকলেকে হাসি মুখে ধন্যবাদ জানিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পরে জাকিয়া এলেন। বাটিতে পায়েশ নিয়ে। এক চামচ মুখে তুলে দিয়ে বললেন,
” শুভ জন্মদিন মা। আমার বৌমাটাকে কী দারুন লাগছে শাড়িতে সেজে! নাকফুল আমার ছেলের পক্ষ থেকে গিফট বুঝি? ”
” হ্যাঁ ওটাকেই সব শুভেচ্ছা জানাও। আর আমি তো বানের জলে ভেসে এসেছি! ও’কে নিয়ে তোমাদের সবার আদিক্ষেতা আর গেল না। কোনো ভালোবাসা নেই আমার এ-বাড়িতে।”
শিশির নেমে আসতে আসতে কথাগুলো বলল। কুয়াশা জাকিয়ার কথার উত্তর করতে গিয়েও থেমে ঘুরে শিশিরের কথাগুলো শুনছিল আর চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে৷ শিশির একপলক তাকিয়ে দেখেও পাত্তা দিল না। সে গিয়ে রিজভীর পাশে জায়গা ছিল সেখানে বসে পড়ল।
কুয়াশা বলল,
” হ্যাঁ, সে-তো তোমারও যায়নি আমাকে নিয়ে হিংসে করা। হিংসুটে একটা। ”
কিড়মিড় করতে করতে বলে মুখ ঝামটাল। শিশির কিছু বলতে যাবে নীহার ধমকে থামাল। বলল,
” আরে থামত! তোদের এই জন্মদিন নিয়ে প্যাচাল জীবনেও যাবে নাহ্? এবারও করতে হবে? ”
” হ্যাঁ, করতে হবে। কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। আমাদের ঝগড়ার পরম্পরা ধরে রাখতে হবে। ”
শিশির, কুয়াশা একসাথে বলে উঠল। এদিকে সকলে মাথা চাপড়ে বসে রইল। মানে ঝগড়ারও পরম্পরা ধরে রাখতে হবে? ওটারও কী বংশ টংশ আছে নাকি? এ’দুটোর কথা শুনে তো তাই-ই মনে হচ্ছে! কুয়াশা মুখ বাঁকাল জোড়া কথা বলতে দেখে৷ শিশিরও পাত্তা দিল না। সে কফি ঢেলে নিয়ে খাওয়া ধরল। শশী শিশিরকে পেছন থেকে গিয়ে কাঁধের উপর হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” শুভ জন্মদিন ভাইয়া।”
শিশির হাসল অমায়িক। ঘুরে শশী মুখের উপর হাত রেখে ধন্যবাদ জানাল৷ একে একে হিম সহ সকলে শিশিরকে শুভেচ্ছা জানাল৷ জাকিয়া উঠে ছেলের মুখে পায়েশ তুলে দিয়ে বললেন,
” আমার ছেলে বানের জলে আসেনি। সে আমার মূল্যবান কোহিনূর। ভাগ্যিস আজকের দিনে সেই কোহিনূরকে আমি কোল জুড়ে পেয়েছিলাম। ”
শিশির মুখ খুলে অমায়িক হাসল। মা’কে পাশে বসাল। কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
” ভাগ্যিস সেই কোহিনূরের হয়ে এই মালিকের পেটে এসেছিলাম? নয়তো হিরার মতো মা আমি কোথায় পেতাম? ”
জাকিয়া হেসে দিলেন। মুচকি হাসল শিশির। সকলেই হাসল। শিশির মা’কে জড়িয়ে ধরল। আজমিরা, আম্বিয়া এলেন। জাকিয়ার থেকে বাটি নিয়ে শিশিরের মুখে তুলে তুলে দিয়ে শুভেচ্ছা জানাল। এদিকে তা দেখে কুয়াশা ফুলে ঢোল হলো৷ ঢং করে বলল,
” কেউ আমাকে ভালোবাসে না৷ আমি কারো কেউ নাহ্।”
বলেই উঠে হাঁটা ধরল উপরে বড় চাচুর ঘরের উদ্দেশ্যে। সে এখন বড় চাচুর কাছে নালিশ জানাবে আর আদর খাবে একাই। আজমিরা, আম্বিয়া আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলেন। আম্বিয়া বললেন,
” যাক বাবাহ্ ওর কাছে তো যেতেই পারলাম নাহ্? আগেই আহ্লাদীর অভিমান হয়ে গেল?”
সকলে হেসে দিল। শিশির কফি খেতে খেতে মুচকি হাসল। তার ওটা সত্যি আহ্লাদ করে৷ তিন জা চলে গেলেন রান্না ঘরে। বৃষ্টিকে নিয়ে এলো ইয়াসমিন। মিহির আর ঈশা পাশা-পাশি বসে আছে। এদের সম্পর্কের কথা অনেকেই জানে না। শুধু জানে এরা বন্ধু হিসেবে ক্লোজ৷ অবশ্য স্মৃতি, কুয়াশা, শিশির, রিজভী জানে। নীহার, শশী, ইয়াসমিন, বৃষ্টি এরা জানে না। ঈশা কুয়াশাকে মানা করে রেখেছে। জানিয়েছে আরো দুই-এক বছর পর জানাবে। বৃষ্টিকে নামতে শশী গিয়ে সাহায্য করল। অত বড় পেট নিয়ে অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে নামতে একটু বেশিই কষ্ট হয়। বসল এসে। সকলের সাথে কথা বলতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে কুয়াশা নেমে এলো। এসে ধাপ-ধুপ করে বৃষ্টির পাশে বসল। শিশির দেখে বলল,
” এ্যাই, বেয়াদব ওমন ধাপ-ধুপ করে হাঁটছিস কেন? আহ্লাদ বেশি বেড়ে গেল?”
” এ্যাই, থামো তোহ্! ”
বলেই বৃষ্টির সাথে কথা বলতে লাগল। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করল। এদিকে ওরা গল্প করছে আর শশী রান্না ঘরে গেছিল কী যেন করতে। এসে বসে থাকা নীহারের দুই গালে ঠান্ডা বরফওয়ালা হাত চেপে ধরে বলল,
” এ্যাই দেখেন দেখেন আমার হাত কত গরম! ”
নীহার ঠান্ডার প্রকোপে চেঁচিয়ে উঠল। বলল,
” এ্যাইহ্…! এ কী অবস্থা তোমার হাতের? এত ঠান্ডা কেন? আবার বলছ কত গরম! ফাজিল মেয়ে একটা।”
শশী খিলখিল করে হেসে দিল। নীহারকে ঠান্ডার প্রকোপে তিড়িং বিড়িং করে নাচতে দেখে। শিশির হেসে বলল,
” শশী, এক মগ টাঙ্কির পানি নিবি সাথে আইস কিউব মেশাবি কয়েকটা। মিশিয়ে এনে ঢেলে দে যাহ্ পারমিশন দিলাম। ”
শিশিরের কথা শুনে সকলে হাসল। শশী হেসে আনন্দে আটখানা হয়ে গদগদ হয়ে বলল,
” এ্যাই ভাইয়া এটা তো ভেবে দেখি নি! সেই বুদ্ধি দিলে তোহ্! এখনি যাচ্ছি…!”
নীহার হতবাক হয়ে গেল।শশীর হাত পেরে ধরল তড়িঘড়ি করে। মানে কী! এই ফাজিল ভাই-বোন দুটো তার পেছনে পড়ল কেন? তাকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে লাগল! নীহার রেগেমেগে চেঁতে উঠে বলল,।
” এ্যাই বেয়াদব! তোর পারমিশন কেন শুনবে আমার বউ? খবরদার যদি আজেবাজে পোকা ঢুকিয়েছিস তোহ্!”
বলে শশীকে ধমকে বলল,
” বসো এখানে চুপচাপ! ”
” বাহ্ ভয়ে ভাই আমার বউয়ের সুর তুলছে!”
শিশিরের কথায় নীহার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আর সকলে হেসে ফেলল। নীহারও এবার শিশিরকে জব্দ করতে বলল,
” এ্যাই.. কুশু! ”
যেই না শুনল কুয়াশাকে ডাকছে নীহার অমনি শিশির তড়িঘড়ি করে বলল,
” এ্যাই..! তুই আমার বউকে ডাকছিস কেন? খবরদার তোর ঐ পাজি রা-জাকার মার্কা বুদ্ধি আমার বউয়ের মাথায় ঢুকাবি নাহ্!”
লেও ঠ্যালা! এরা একে অপরের বউ নিয়ে ঝগড়া শুরু করল। সকলে বিনা পয়সায় লাইভ বিনোদন নিতে থাকল৷ কুয়াশা ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
” তোমার বউ কে? আমার ভাইকে তুমি একা পেয়ে নাকানিচুবানি খাওয়াবে আমি চুপ করে দেখব? ”
নীহার এবার দাম্ভিকতার হাসি দিল। শিশির চোখ গরম করে কিড়মিড় করতে লাগল। নীহার মেরুদণ্ড সোজা করল৷ কলার ঝাকানোর মতো করে বলল,
” শোন কুশু! রাতে যখন ঘুমাতে যাবে তখন এক বালতি পানি নিবি আর সাথে আইস কিউব নিবি নিয়ে পুরোটা ঢেলে দিবি। তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল! অন্যের বউয়ের কানে কুমন্ত্রণা দেয়ার কত ঝাল! ”
কুয়াশা তো শুনে সেই খুশি হলো। একে নাকানিচুবানি খাওয়াতে পারলেই তার আনন্দ। সে কিছু বলতে যাবে শিশির বলল,
” ভুলেও এসব ভাবিস নাহ্, আমি তুলে নিয়ে গিয়ে একদম বালতির মধ্যে চুবিয়ে আসব এরপর ফ্রিজিং করব।”
কুয়াশা ফুঁসে উঠল। নীহার বলল,
” আর আমি কী হারিয়ে যাব?”
শিশির সে-কথার পাত্তা দিল না। শশী চোখ ছোট ছোট করে এগিয়ে গিয়ে বসল। নীহার ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসল। সকলে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। আরো কিছুক্ষণ আড্ডা, হাসি মজা চালিয়ে গেল৷ অনেকদিন পর সকলে একসাথে হয়েছে। মালিথা ভিলায় এমন মজা, হাসি ঠাট্টা না থাকলে মানায়? উহু, একটুও মানায় না৷ মালিথা ভিলা মানেই একরাশ আনন্দ, হাসি, ঠাট্টা, খুশি সর্বপরি একরাশ প্রশান্তি।
একটুপর ভালোভাবে রোদ উঠলে শিশির সহ নীহার, হিম, রিজভী, মিহির বাহিরে হালচাল দেখতে চলে গেল। থাকল শুধু মেয়েরা। ওদের আপাতত কাজ নেই। আড্ডা দিতে লাগল। শশী প্রশ্ন করল,
” বললে না তো বুবু! এই নাকফুল ভাইয়া দিয়েছে গিফট?”
” হ্যাঁ তোর ভাইয়া-ই দিল৷ জন্মদিন উপলক্ষে। ”
” আরে বাহ্! কী উন্নতি তোদের? জন্মদিন যারা মানত না এবার আবার গিফটও দেওয়া নেওয়া হচ্ছে? ”
ইয়াসমিনের কথায় কুয়াশা ভরকে গেল। লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে নিল৷ বৃষ্টিরা হাসল। স্মৃতি বলল,
” অসাধারণ মানিয়েছে ওটাতে তোকে। ”
প্রশংসা পেয়ে আরেকটু লজ্জা পেল৷ উত্তরে শুধু হাসল। বৃষ্টি বলল,
” থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। তোমরা যে চুলোচুলির থেকে সংসারে মন দিয়েছ এতে সকলের স্বস্তি, আনন্দ। ”
ইয়াসমিন টিপ্পনী কেটে বলল,
” আজ তুই একটু বেশি গ্লো করছিস ব্যপার কী বলতো! আবার একটু বেশি-ই স্পেশাল লাগছে! কাহিনী কি? ”
কুয়াশা ভরকে গেল। থতমত খেয়ে বলল,
” আজ আমার জন্মদিন সাথে প্রথম স্বামীর থেকে গিফট এবং উইশ পেয়েছি। আর সেই গিফট আমার নাকে শোভা পাচ্ছে তো গ্লো করব না? স্পেশাল তো লাগারই কথা! এসব কিছু তোমাদের দেবরের কামাল, বুঝছ!”
” ওওও আচ্ছা..! আমাদের দেবরকা কামাল! ”
বৃষ্টি, ইয়াসমিন এক সাথে কথাটা সুর ধরে বলে উঠল। কুয়াশা আবার ভরকাল৷ তবে বুদ্ধির সাথে উত্তর দিতে পেরে সে-ও চুপ থাকল। স্মৃতি ঠোঁট টিপে হাসল।
কুয়াশা আর কিছু বলল না। এরা ডেঞ্জা-রাস পাবলিক। এদের সাথে বেশি কথা বলা যাবে না। লাগামহীন পাবলিক এক্কেবারে! এরপর টুকটাক গল্প করল।
সকাল দশটার দিকে জাকির মালিথাকে নিচে নামিয়ে আনা হলো। সকালের খাবার সকলে নিচে খেলেও জাকির মালিথাকে উপরে খাওয়ানো হয়েছে। জাকিয়া জাকির মালিথাকে নিয়ে বাহিরে রোদের উপর গেলেন। সেখানে গিয়ে গরম তেল মালিশ করতে লাগলেন হাতে, পায়ে, শরীরে। ম্যাসাজ সহ হাত পায়ের ব্যায়াম করাতে লাগলেন। কুয়াশা বাহিরে এসে তা দেখে শাশুড়ীকে বলল,
” আম্মু, আমি করব দাও ”
” থাক, তোকে করতে হবে না। আমি করে নেব। ”
” আম্মু, চাচুর দায়িত্ব একা তোমার না, আমাদের সকলের। তুমি ভেতরে যাও। আজ থেকে ব্যস্ততা না থাকলে এই কাজ আমার।”
জাকিয়া হাসলেন। জাকির মালিথা হেসে কাছে ডাকলেন৷ ভালো হাতটা মাথায় রেখে বললেন,
” দেখলে জাকিয়া! আমার ছোট ছেলের জন্য আমি যোগ্য মেয়ে খুঁজেছি! আমার মেয়েটা বড়ও হয়ে গেছে কত! ”
স্বামীর কথায় মুচকি হাসলেন জাকিয়া। বললেন,
” হ্যাঁ আমার ছেলে বউ পাক্কা গিন্নী হয়েছে। আজ তার ঊনিশতম জন্মদিন। একা হাতে আমার ছেলেকে সুস্থ করেছে৷ দেখভাল করেছে। আমি তো আমার ছেলের দেখভাল করতে পারিনি।”
কুয়াশা একটু লজ্জাবোধ করল এভাবে বলাতে। আসলে এমন সব কথা শুনে সে অভ্যস্থ না। জাকির মালিথা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। একটা ঝড়ে সব উলোটপালোট করলেও উড়িয়ে নিয়ে যায়নি একেবারে। ওসব কথা রেখে বললেন,
” জাকিয়া, আমার মা’টাকে কিন্তু সত্যি গিন্নী লাগছে! শাড়িতে কী সুন্দর মানিয়েছে দেখো! মেয়েটা আমার এত বড় কবে হলো? দেখতে দেখতে আঠার বছর পূর্ণও হয়ে গেল। সেদিনও কোলে করে নিয়ে ঘুরলাম মনে হচ্ছে। ”
কুয়াশা লজ্জা পেয়ে গেল আবার। শাড়ি পরেও বিপদে পড়ে গেল। সত্যি কী এতটাই সুন্দর লাগছে তাকে! জাকিয়া বললেন,
” হ্যাঁ অপূর্ব লাগছে। কখনো পরে না আজ পরেছে একজন্য আরো সুন্দর লাগছে৷ ”
তেল মালিশ করতে করতে উত্তর করলেন। কুয়াশা শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে বাটি থেকে তেল নিয়ে চাচুর পায়ের কাছে বসে পড়ল। মালিশ সহ পায়ের ব্যায়াম করতে লাগল। জাকিয়া কিছু আর বললেন না৷ জাকির মালিথা অমায়িক হাসলেন। এই দৃশ্য দূর থেকে শিশির দেখল৷ সে দেখে প্রশান্তিময় একটা শ্বাস টানল সাথে হাসি। কী সুন্দর একটা দৃশ্য! বাড়ির সকলকে ছায়া দেয়া মানুষটা সবার মাঝে আছে এতেই সকলের আনন্দ, প্রশান্তি৷
দুপুরে নামাজ পর হুজুর ডাকা হলো৷ সকল আত্নীয়রা এসেছে। জিনিয়ারা সহ বৃষ্টি বাবা, মা জাকিয়ার ভাইরা সকলেই এসেছে৷ আম্বিয়ার বোন আর বোনজামাই এসেছে৷ অনিরা আসেনি। তারা এই বাড়িতে আর আসতে চায় না। অয়নও সেদিন শিশির, কুয়াশার থেকে ওমন কথা পেয়ে আর কথা তো বলেই না আসতেও চায় না৷ যতোই হোক সেটা পুরোটাই অপমান ছিল৷ সে-তো আর জেনেছিল না যে শিশির কুয়াশার বিয়ে হয়েছে! সে দিনের করা ব্যাবহারটা একটু বেশি হয়ে গেছে৷ যদিও গায়ে পড়া টাইপ ছিল বলে শিশির, কুয়াশা কেউই পছন্দ করত না। কিন্তু এখন সেদিনের করা কাজটাতে নিজেরা ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিতবোধ করে। আজ দু’জনেই যখন ওদের না আসা নিয়ে শুনল তখন বুঝল বিষয়টা। ভাবল এটা নিয়ে সময় করে কথা বলে নিতে হবে।
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৫৫+৫৬
দুপুর তিনটার পর সকল মেহমানদের খাওয়া দাওয়া হলো। মিলাদ পড়ানোও হয়ে গেছে। আত্মীয়রা জাকির মালিথাকে দেখে দোয়া করে ভালো মন্দ কথা বলল৷ কিছুক্ষণ থেকে সন্ধ্যার আগে অনেকেই চলে গেল।
স্মৃতি রিজভীরাও চলে গেছে৷ শশীরা আজ থাকবে। আগামীকাল যাবে। মিহির থাকছে বলে ঈশা রয়ে গেল৷
