বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬৫+৬৬
রোজা রহমান
ভালোবাসার দহন সকলকেই পুড়ায়। তেমনি পুড়াচ্ছে আরো একজোড়া হৃদয়কে৷ দূরে যাবার কষ্টে পুড়ছে স্মৃতি, রিজভীও৷ তারা তো এক সাথে থাকত না। বিয়ের পর এক সপ্তাহ বাদে হোক আর দুই সপ্তাহ বাদে হোক সময় কাটাত একসাথে। রিজভী শ্বশুরবাড়ি যেত৷ এছাড়া ফোনালাপেই তাদের সংসার৷ এই জন্য কিঞ্চিৎ হলেও কম তাদের কষ্টটা৷ শিশির, কুয়াশা ছোট থেকে একসাথে থেকেছে বিধায় তাদের দূরত্বের বিরহটা অতিব। তবুও স্মৃতি রাতে কান্নাকাটি করেছে৷ রিজভীও জানিয়েছে সব কমপ্লিট করেই আসবে৷
এই জন্য তারও কষ্টের মাত্রাটা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এতদিন এক সপ্তাহ হোক আর দুই সপ্তাহ হোক পরে দেখা হতো, ভালোবাসা বাসি সহ আদর সোহাগ হতো৷ কিন্তু এখন দীর্ঘ দূরত্বটা স্মৃতিও মানতে পারেনি৷ ভালোবাসার বিয়ে তাদের। মন দেয় নেয়া আগে থেকেই। কষ্ট তো হবেই!
রিজভী গতকাল রাতে শিশিরের সাথে সব ঠিকঠাক করে বাড়িতে গোছগাছ করে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। রাতটা তার রসমালাই বউয়ের সাথে কাটাবে বলে৷ সেখানে রাত থেকে সে ভোরের দিকেই শ্বশুরবাড়ির সকলের থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ি চলে আসে। কারণ এখানেই ওর সব ছিল৷ এছাড়া মা বাবার থেকে দোয়া নিয়ে যাত্রা শুরু করবে ভাবনায় রেখেছিল৷ ভোরে স্মৃতির কান্না থামিয়ে আদর করে অভয় দিয়ে এসেছে। কুয়াশার মতো পাগলামি না করলেও সে-ও ঠিক নেই। স্বামী দূরে গেলে কষ্ট সবারই হয়৷
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রিজভীর বাড়ির সামনে শিশির সহ গাড়ি এসে থামল। রিজভী অপেক্ষায় করছিল। রিজভীর মা, বাবা সহ বড় বোন, ভাগ্নি,ভাগিনা দাঁড়িয়ে। শিশির নেমে সকলের সাথে কথা বলে বিদায় নিল রিজভী আর ওঁ। দু’জনই গাড়িতে উঠে বসল। রিজভীর মা সকালে ছেলেকে ধরে কেঁদেছেন। কারণ একমাত্র ছেলে ওনার। রিজভীও এই প্রথম বাহিরে যাচ্ছে। মা’য়েরা সন্তানদের কাছ ছাড়া করতে কষ্টই পায়।
বিদায় নিয়ে রিজভীর বাড়ির সীমানাও অতিক্রম করল গাড়ি। এরপর রোডে উঠল চলতে লাগল গাড়ি তার আপন গতিতে। গাড়ির গতির সাথে গাড়ির ভেতরে থাকা দু’টি মনের বিষাদের গতিও বাড়তে লাগল৷ আপন মানুষ ছেড়ে আপন জায়গা ছেড়ে ভিন্ন মানুষের মাঝে ভিন্ন জায়গায় পাড়ি জমাল স্বপ্ন পূরণের আশায়।
শিশির, রিজভী দুইজন দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। মনের অবস্থা করুন৷ দুই’জন দুই’জনের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কেন যেন দু’ইজনই হেসে ফেলল শব্দ করে৷ কষ্টের মাঝেও হাসি পেল বিষয়টা অদ্ভুত!!
রিজভী বলল,
” জীবনেও আর বিয়ে করতাম না দোস্ত! ”
শিশির হেসে বলল,
” আর আমি তো সব ভাইদের সাজেশন দেব ব্যাচেলর লাইফে যেন বিয়ে টিয়ে না করে। আর ব্যাচেলর লাইফ কেন পড়াশুনো শেষ টেষ না করেই যেন বিয়ের কথা মুখেও না আনে৷ জীবন এক্কেবারে তেজপাতা৷ সাথে আরো বলব ডিফেন্স জবও যেন কেউ না করে ও হ্যাঁ আর যেন বিদেশেও না যায় কেউ ভাই, বাবাহ্ রে বাবাহ্!! ”
শিশিরের কথা শুনে রিজভী সহ ড্রাইভারও হেসে দিল৷ রিজভী হাসতে হাসতে বলল,
” কী একটা অবস্থা রে দোস্ত! মনে হচ্ছে বইসা বইসা মনির খান, আসিফের গান শুনি। লাইক, ‘ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ ফিলিংস আসছে আমার ভাই! ”
শিশির আবার হাসল৷ ড্রাইভার সামনে থেকে বলল,
” ভাই’রা নতুন বউ রাইখি প্রথম যাইতিছ বুঝি?”
” হয় ভাই, বহুত ঝামেলা বউজাতি আর বিয়ে টিয়ে।”
শিশির, রিজভী দু’জনই একসাথে বলে উঠল কথাটা। ড্রাইভার খেঁক খেঁক করে হেসে বলল,
” ঝামেলা না গো ভাইরা। নতুন নতুন সবারি কষ্ট হয়। বিয়ের পর আমিও প্রথম যখন কাজে বাইর হইছিলাম আমার বউও মন খারাপ কইরি বসি থাইকত। ভাড়ার গাড়ি চালাতাম। যখন সুমাই সুযোগ পাতাম বাড়ি যাতাম। বউ আমার কাইনত৷ কি আর করার কও? পেটের দায়ে তো কাজ করাই লাগবি তাই না? ”
শিশির, রিজভী দু’জনই শুনল আর দীর্ঘ শ্বাস ফেলল দুইজনই৷ বিষাদেরা গলায় এসে বিঁধল। কেউ আর কথা বলল না৷ আপন মানুষদের ছাড়া দিন কেমন কাটবে কে জানে! যদিও ব্যস্ততায় দিন পাড় হবে তবুও কি ছটফট করবে না? হুম করবে। খুব করবে!
দু’জনই গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিল৷ চোখ বন্ধ করল৷ রাতে কেউ ঘুমায়নি৷ এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল৷ লং জার্নি জেগেও কাটানো সম্ভব নয়৷
শিশির চলে গেলে কুয়াশাকে কেউ আর ঘরে যেতে দেয়নি। বসার ঘরে নিয়ে বৃষ্টি আর ইয়াসমিন বসেছে। জানে ঘরে গেলে বসে বসে কাঁদবে৷ তার থেকে বরং একটু আড্ডা দিক হালকা হবে৷ বৃষ্টির কোলে বর্ষণ ছিল কুয়াশা নিয়ে বসেছে৷ নীহার বাহিরে চলে গেছে। হিম শুধু বাড়িতে। জাহিদ মালিথা, তুষার, তুহিন, আম্বিয়াও বের হয়ে গেছে। আজমিরা সব গোছগাছ করছে। জাকিয়া স্বামীর কাছে।
ইয়াসমিন বলল,
” এত ভালো কবে কবে বাসলি রে! চোখ মুখ ফুলিয়ে বেগতিক করেছিস? আর বুকে ওমন আঁচড় কেন তোর? ”
কুয়াশা বর্ষণের হাত ধরে নাড়াচাড়া করছিল। ইয়াসমিনের কথা শুনে বুকের দিকে তাকাল। দেখল আঁচড় লাগা দেখা যাচ্ছে ওড়না সরে গিয়ে। তড়িঘড়ি করে ঢেকে নিল। আমতাআমতা করে বলল,
” এমনই লেগে গেছে। ”
” লেগে গেছে? ”
বৃষ্টির হেয়ালি প্রশ্ন। কুয়াশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। ভাবিদের সাথে বন্ধুর মতোই সম্পর্ক তার। বলল,
” রাগে, কষ্টে, অভিমানে করেছি৷ কি করব বলো? একটুও সহ্য হচ্ছে না৷ বাড়িটা কেমন খা খা করছে দেখেছ? তেমনই আমার বুকটা খা খা করছে ”
কুয়াশার কথায় দুইজন দুইজনের দিকে দৃষ্টি বুলাল। এরপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। ইয়াসমিন উঠে কুয়াশার পাশে বসল৷ বলল,
” প্রথম একটু খারাপ লাগবে। পরে সয়ে যাবে। এত ভেঙে পরিস না৷ জানি সবারই খারাপ লাগে। তোর ভাই কিছু ঘন্টার জন্য বাহিরে থাকে তাতেই আমার খারপ লাগে। নানান চিন্তা হয়। এটা স্বাভাবিক৷ কষ্ট পাস না ”
বৃষ্টি বলল,
” তোমাদের দেখি আর অবাক হয় বিশ্বাস করো! যারা এমন কোনো দিন ছিল না যে ঝগড়া আর মা-রা মা-রি না করে ভাত খেয়েছে। এখন তারা একে অপরকে ছাড়তেও পারে না! অবিশ্বাস্য!! বাবা আর চাচুর প্রতিটা কথা সত্যি ফলে গেল। তোমরা দায়িত্ব কখনো এড়াও নি আর না অধিকার ছেড়েছ। ঠিক বুঝে নিয়েছ নিজেদের অধিকার। আর সেই অধিকারবোধ থেকেই ভালোবাসা হয়েছে৷ এখন তোমাদের এই দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক সাথে সংসার দেখলে সত্যি খুশি লাগে আনন্দ লাগে। চিরজীবন এমনই থাকো। তোমাদের দূরত্বের দীর্ঘতা জলদি শেষ হোক৷ তোমাদের সব সময় ঝগড়া আর চুলোচুলি আমরা মিস করি এমনকি আস্ত মালিথা ভিলাও করে। ”
কুয়াশার চোখ টলমল করতে লাগল। ইয়াসমিন মাথাটা এলিয়ে নিল টেনে। জা’য়ের আগে বড় বোন সে। কুয়াশা বলল,
” তোমাদের দেবরের মতো স্বামী পাওয়া ভাগ্যর বিষয়। কপাল করে পেয়েছি। রাজকপাল বলব৷ সালাম আমার চাচুদের, জোর করে নিজেদের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে জীবন রাঙিয়ে দিয়েছেন। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে দায়িত্ববান, স্ট্রোং ব্যক্তিত্বের জীবন সঙ্গী পেয়ে। একদম বড় চাচুর মতোই হয়েছে। যখন থেকে প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে নিয়ে বোঝা ধরেছিলাম তখন শুধু চাচুকে দেখতাম যে একটা মানুষ এতটা পারফেক্ট কি করে হয়? আমার চাচু একা হাতে সংসার গোছাত সাথে বড় আম্মু সঙ্গী। চাচু একা হাতে সকলের খেয়াল রাখত৷ দাদু তো ছিল না।
আমার কোন জিনিস লাগবে না লাগবে, মাস শেষে টিউশন ফি সহ স্কুল, কলেজের খরচবাবদ সব চাচু আর মেজো চাচু দিয়েছেন বাবা চলে যাওয়ার পর। কিন্তু মেজো চাচু তো বাড়িতে থাকে না! তাই ভালোমন্দ বড় চাচু করেছেন৷ তুষার ভাইকে আদেশ দিয়েছিলেন আমার সব জিনিসের খেয়াল রাখতে তাদের নাকি একমাত্র মেয়ে আমি। তাই বড় চাচুর প্রতি আমার মুগ্ধতা ক্ষণে ক্ষণে বাড়ত৷ একটা মানুষ এতটা ভালো হয়? আজ কাল ভাইয়ের মেয়ের এতটা যত্ন কে করে? বাবা মা-রা যাবার পর চাচুকে বাবার আসনে বসিয়েছিলাম। আর মনে স্বপ্ন বুনেছিলাম চাচুর মতো ব্যক্তিত্বের ছেলেকে বিয়ে করব। এমন ছেলেকে বিয়ে না করতে পারলে জীবন রঙিন হবে না। মেয়েরা বাবার মতো ব্যক্তিত্বের স্বামী চায় সব সময় কারণ সব মেয়েদের কাছে তাদের বাবা থাকে বেস্ট এবং সুপার হিরো।
আমিও বড় চাচুর মতো ব্যক্তিত্বের জীবনসঙ্গী চেয়েছিলাম। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে চাইতামও আল্লাহ্’র কাছে। আল্লাহ আমর চাওয়া, আশা, স্বপ্নটা যে এভাবে কবুল করে নিবেন আমার কল্পনার বাহিরে ছিল। এই বাড়ির প্রতিটা ছেলেকে চাচু নিজে হাতে গড়েছেন৷ মেজো চাচু, বাবা, ভাইদের সকলকে। সেই জন্যইতো আমাদের ভাইগুলো এক একটা দায়িত্ববান তৈরি হয়েছে। তোমাদের দেবরকে পেয়ে আমি ধন্য। আমাকে ভালোবাসার গভীরতা সে-ই বুঝিয়েছে। আমাকে বিয়ের পর ভালো না বাসলেও কখনো অসম্মান করেনি।
বরং জানো! বিয়ের দিন রাতে আমার থেকে সময় চেয়ে নিয়েছিল। সেই সময় নিয়ে আস্তে আস্তে অপছন্দ, হিংসা কাটিয়ে ভালোবেসেছে, যত্ন নিয়েছে, দায়িত্ব পালন করেছে। অসুস্থ হলে নিজে হাতে সেবা, যত্ন করেছে। ভালোবাসা ছিল না কিন্তু তবুও দায়িত্ব পালন করেছে বউয়ের৷ আমি সেই সবেই মুগ্ধ হয়েছি, ভালোবেসে ফেলেছি। তাহলে বলো! এত এত আদর, যত্ন, ভালোবাসা ছেড়ে কি করে দিন কাটবে আমার? ”
কুয়াশা একভাবে কথাগুলো বলে থামল৷ শিশিরকে নিয়ে মনের অনুভূতিগুলো শেয়ার করল। বৃষ্টি, ইয়াসমিন মুগ্ধ হয়ে শুনল। সত্যি বুঝদার এ দুটো। ভালোবাসা ছিল না সময় নিয়েছে কিন্তু পিছিয়ে যায়নি। অত্যাচার করেনি৷ সময় নিয়ে ভালোবেসেছে। এদের ভালোবাসা আর সম্পর্ককে স্যালুট জানাতে হবে। এরাই সেই বুনো ওল বাঘা তেঁতুল যারা কিছুতেই কেউ কারো থেকে কম না। ঝগড়া, মা-রা মা-রি, চুলোচুলি, ভালোবাসা সব কিছুতে সমানে সমানে। খাঁটি দম্পত্তি৷ বৃষ্টি, ইয়াসমিন কথাগুলো ভাবনায় আপনাআপনি চলে এলো। হাসল অমায়িক। এবার বৃষ্টিও উঠে কুয়াশার পাশে বসল। বলল,
” আল্লাহ এভাবেই তোমাদের সম্পর্ক চিরজীবন অটুট রাখুক। মুগ্ধ হলাম আমার দেবরের প্রতি৷ মেয়েদের সে আগাগোড়ায় সম্মান করে। শুধু তোমাকে স্বভাব দোষে সহ্য করতে পারত না। ”
” হুঁ, কিন্তু কখনো অসম্মান করেনি আমাকে। পতিতালয় থেকে এসেছিলাম কোনো দিনও এটা নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেসা বা কিছু বলে নি৷ অবহেলা করেনি৷ আগে বোন হিসেবে সম্মান করেছে পরে বউ হিসেবে সম্মান আর ভালোবাসা দিয়েছে। পাড়ার চাচি কথা শুনিয়েছিল আর ওঁ কি বলেছিল জানো? আমি ওর ‘পবিত্র পুষ্প’। আমাকে কখনো হেরে যেতে মানা করেছিল। সাহস যুগিয়েছিল। পাশে থেকে স্বামীর জোর দেখিয়েছিল। ওর জন্যই আমি আমার জীবনের কালো রাতটা ভুলতে পেরেছি। লড়তে পেরেছি সমাজে। ভেঙে যেতে দেয়নি আমাকে। আমার সেরা স্বামী সে। তাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসব না? কষ্ট পাব না?”
ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হলো বৃষ্টি, ইয়াসমিন। বৃষ্টি মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল,
” তুমি আমাদের জা’য়ের থেকে ননদ বেশি। তোমার সুখ দেখে শান্তি পেলাম। বাবারা যেই দায়িত্ব পালন করেন সেটা তোমার চাচুরা করেছেন৷ সঠিক ছেলে নির্বাচন করেছেন তোমার জন্য। ”
কুয়াশা বৃষ্টির কথায় বাতাসের সাথে নিঃশ্বাস ছাড়ল দীর্ঘ একটা৷ আল্লাহ এই সুখ চিরস্থায়ী করুক৷ স্বামী তার সফল হয়ে ভালোই ভালোই বাড়ি ফিরুক৷ ঐ বুক বড্ড মিস করবে সে। শূন্যে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবল৷
এদিকে পেছন থেকে আজমিরা সহ জাকিয়া সব শুনলেন। আজমিরার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে একমাত্র মেয়ের সুখের কথা শুনে৷ জাকিয়া মুগ্ধ ছেলে আর ছেলের বউয়ের উপর৷ জাকিয়া আজমিরাকে আশ্বাস দিতে ধরলেন৷ অমায়িক হাসলেন৷ আজমিরা এবার শব্দ করে কেঁদে জাকিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন৷ বললেন,
” বুবু, বুবু গো তোমাদের লাখ লাখ শুকরিয়া। আল্লাহর কাছে আমি বান্দা কীভাবে শুকরিয়া আদায় করব? এত শান্তি, সুখ কই রাখব আমি? আমাকে তিনি সর্বস্রান্ত করেননি। আমার মেয়ের জন্য ভাইজানরা এতটা চিন্তা করেছেন এত ভালো ছেলের হাতে দান করেছেন আমি ধন্য। বড় কৃতজ্ঞ তোমাদের উপর। ”
জাকিয়া কিছু বললেন না। শুধু শুনলেন৷ কুয়াশারা কান্না পেয়ে তখনি পিছন ঘুরে মা’য়েদের দেখে৷ মা’কে দেখে বর্ষণকে বৃষ্টির কোলে দিয়ে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। নিরবে চোখের পানি ফেলল৷ তার মা’য়ের কষ্ট আজ হারে হারে বুঝতে পারছে সে৷ তার মা’য়ের পথ চলা কতটা কঠিন ছিল আজ বুঝছে। তার মা-ও সেরা। আজমিরা কুয়াশার সারা মুখে চুমু আঁকলেন। বললেন,
” আমার মা। আমার মা’টা আজ কত সুখী! আমার শান্তিতে বুক ভরে উঠল। ”
কুয়াশা ঠোঁট প্রশারিত করে হাসল শুধু। জাকিয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,
” এভাবেই চিরসুখী হয়ে থাকিস আমার ছেলেকে নিয়ে। আমার ছেলের দায়িত্ব তোকে দিয়ে দিলাম। ”
“চিরজীবন পালন করব তা।”
বলে কুয়াশা আবেশে জাকিয়াকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখল। সকলের মুখে অমায়িক হাসি আর বুকে প্রশান্তি। এই দুটো হাম সেপাইরা এভাবেই খুঁনসুটিতে সংসার করে জীবন পাড় করুক।
সারাটা সকাল, দুপুর বিষন্নতায় কাটাল কুয়াশা। টুকটাক গল্প আর শুয়ে, ঘুমিয়ে৷ পড়াশুনোয় মন বসেনি৷ শিশির এখনো ফোন দেয়নি৷ বলেছিল পৌঁছে সব ঠিকঠাক করে ফ্রি হয়ে রাতে ফোন দেবে৷ তার আগে যেন সে না দেয়। কারণ ব্যস্ত থাকবে। কথা মেনে সে-ও দেয়নি। কিন্তু ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে। কখন একটু দেখবে বা কন্ঠ শুনবে।
বিকলের দিকে স্মৃতি কল দিল৷ স্মৃতির কল পেয়ে স্মৃতির কথা মনে হলো৷ মনে হলো স্মৃতিও তো তারই গোয়ালের! তারা তো একই গোয়ালের গরু! তৎক্ষনাৎ কল রিসিভ করল। হ্যালো বলতেই স্মৃতির কথা শোনা গেল। তার কন্ঠও নির্জিব শোনাল। কুয়াশার কেন জানি এবার একটু হাসি পেল। হাসল-ও ফিক করে। হেসে নিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করল আগে। এরপর বলল,
” তুই-ও কি স্বামী শোকে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিস নাকি? ”
ওপাশ থেকে স্মৃতি বলল,
” নাওয়া খাওয়া বন্ধ করিনি কিন্তু কাইন্দা কাইন্দা চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছি৷ ”
স্মৃতি মজা করেই বলল নাকি দুঃখে বলল বুঝল না কুয়াশা। তবে হেসে ফেলল সে। হেসে নিয়ে বলল,
” আর কাইন্দস না সখী। স্বামী আমাগো বিদেশ, ফিলিংস তেমনই আইতাছে।”
ওপাশ থেকে স্মৃতিও শব্দ করে হেসে দিয়েছে। কুয়াশাও হাসল৷ দুই জনে এমন নানান কথা বলতে লাগল৷ অনেকটা সময় কথা চালিয়ে গেল৷ মনটাও দুই বান্ধবীর হালকা হলো৷ কথায় বলে না! রতনে রতন চেনে এদের হয়েছে তেমন। দুইজনের কষ্ট দুু’জন উপলব্ধি করতে পারছে। তারা যে একই গোয়ালের গরু!!
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। কুয়াশা নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে স্বামীর সুস্থ, এবং ভালো থাকা নিয়ে দুই হাত তুলে ফরিয়াদ করল।
নামাজ শেষে উঠে তার আপন ঘর অর্থাৎ শিশির ও তার ঘরের দিকে গেল। আজ সারাদিন সে ঐ ঘরে পা রাখেনি। ঘরে কেন সামনেও আসে নি। ঘরের সামনে আসতেই বুকটা কেঁপে উঠল। আবার খা-খা করতে লাগল বুকটা। শূন্যতা আঁকড়ে ধরল। সারাটা দিন গেল মানুষটার মুখটা দেখা হয়নি। এমনকি কন্ঠটাও শোনা হয়নি। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে ঘরে৷ বুকের ভেতর জ্বলতে লাগল৷ আজ থেকে আর এই ঘরে মানুষটাকে পাবে না৷ ভেবেই চোখটা জ্বলে যেতে লাগল৷
ভেতরে ঢুকল। সারা ঘরে শিশিরের শরীরের গন্ধ ছড়িয়ে আছে তা নাকে এসে বাড়ি দিল। চোখ বন্ধ করে বড় নিঃশ্বাস টেনে নিল। পুরো শরীর শীতল হয়ে গেল। মনে হলো শিশির তাকে জড়িয়ে ধরল পিছন থেকে। অদ্ভুত শিহরণ হলো। পুরো ঘরে চোখ বুলাল। তার আর শিশিরের খুঁনসুটি, ভালোবাসার এক একটা স্মৃতি দৌড়ে, দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে কী বলেছে, কী করেছে সব৷ এগিয়ে এসে ফ্যান চালু করে ফোনটা বিছানার পাশে রেখে বিছানায় বসে শরীরটা ছেড়ে দিল। চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং দেখতে লাগল।
বিছানার চাদর থেকেও শিশিরের শরীরের গন্ধ আসছে৷ বুকের ব্যথা ক্রমেই বারতে লাগল। নিঃসঙ্গতায় ছেয়ে গেল পুরো শরীর, মন। রাতের একএকটা স্মৃতি মনের, চোখের মানসপটে ভেসে উঠতে লাগল। শিশিরের বলা কথা, কন্ঠ সব কানে বাড়ি খেতে লাগল। সারা শরীর জ্বলে উঠল। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল৷ সেগুলো গড়িয়ে চোখের কোল বেয়ে বিছানায় পড়তে লাগল। নিঃসঙ্গতা কুঁড়ে কুঁড়ে আঁকড়ে ধরল ক্রমেই। চাদর খামচে ধরল মুঠোর মাঝে৷ ঝগড়া, চুলোচুলি মিস করছে বড্ড। যেটা নিয়মমাফিক না করলে শান্তি লাগে না৷ কিন্তু করবে কার সাথে?
গুঙিয়ে কেঁদে দিল। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে লাগল। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। শান্তির বুকটা লাগবে। কিন্তু হায় আফসোস! সেটা সে চাইলেও আর পাবে না। ভেবেই কাৎ হয়ে শুয়ে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠল। আঁটকানো কন্ঠে আস্তে আস্তে বলল,
” প্লিজ আসো! আমি সহ্য করতে পারছি না। বড্ড প্রয়োজন তোমায়। একটু আদর দিয়ে যাও! তোমার ঐ বুক লাগবে আমার।”
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। এক হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে৷ নিস্তব্ধ ঘরে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল, শুধু ফুঁপানির আওয়াজ। কিছুক্ষণ কান্নার পর হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। চমকে উঠল সে। তড়িঘড়ি করে ফোনে চোখ বুলাল। কাঙ্ক্ষিত মানুষটা ফোন দিয়েছে! ভেবেই তড়িৎ চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করল। কেঁদে কন্ঠ বসে গেছে। সেটা ঠিক করার চেষ্টা করতে করতে ফোন রিসিভ করল। সালাম দিতে ওপাশ থেকে সালামের উত্তর পাওয়া গেল। আহ্ শান্তি!! শরীর, মন শীতল হয়ে উঠল। শিহরণ হলো হৃদয়ে। ঠোঁটের কোনে সুক্ষ্ম হাসির রেখা ভেসে উঠল। সারাদিন পর এই কন্ঠ শুনল।
ওপাশ থেকে শিশির বলল,
” ভিডিও কল দিচ্ছি রিসিভ কর।”
বলেই ফোন কেটে দিল৷ কিছু সেকেন্ডের মাঝেই হুয়াট্স আপে আবার ভিডিও কল এলো। কুয়াশা চোখ মুখ মুছে নিল ভালোভাবে। রিসিভ করল। সে বিছানায় বসেছে উঠে। রিসিভ করতেই সারাদিন যেই মুখটা দেখেনি সেটা দেখতে পেল৷ ইশশ প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। ছলছল চোখে চেয়ে রইল।
শিশির তার বউকে দেখল সারাদিন পর। বুকটা এতক্ষণ খা-খা করছিল। চেয়ে রইল। অনিমেষ অবলোকন করল বউটাকে৷ ঠোঁটে আলত হাসি ফুটাল।
দু’জন দু’জনকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলল না। এরপর একসময় শিশির বলল,
” কাঁদছিলি কেন? ”
” এই ঘরে আমাকে নিঃসঙ্গতা কুঁড়ে ধরেছে। সারাদিন আসিনি একটু আগে আসলাম৷ তোমার গন্ধ ঘর, বিছানায় পাচ্ছি৷ কন্ঠ কানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ”
শিশির বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল৷ বুকটা ভারী হয়ে এলো। এখন কাছে থাকলে কি করত? জড়িয়ে ধরত নাহ্? তার বউটা তার বুকে মাথা রাখত নাহ্? সে-ও যত্ন করে ধরে কপালে চুমু আঁকত নাহ্? ভেবেই বুকে ব্যথা অনুভব হলো৷ সেই বুকে বউয়ের মাথাটাকে খুব মিস করল৷ তাকিয়ে থেকে বলল,
” সোনা..! ”
আহ্, বুকের গভীরে বাড়ি দেয়া সম্মোধন। কুয়াশার চোখ বন্ধ হয়ে এলো শিহরণে। চোখ খুলে আবার তাকাল। ঠোঁট কামড়ে ফুঁপিয়ে বলল,
” খুব মিস করছি তোমায়। ”
” আমিও। ”
শুনতেই ঝরঝর করে কেঁদে দিল কুয়াশা। শিশিরেরও কেন যেন এবার চোখটা ভিজে এলো৷ কিছু বলল না কাঁদতে দিল কিছুক্ষণ। সে-ও দেখল বউয়ের কান্না৷ মেয়েটা তাকে কতটা ভালোবাসে দেখল৷ আবার কিছুক্ষণ পর ডেকে উঠল,
” এ্যাই আমার সোনা…!”
কুয়াশা মাথা তুলে তাকাল৷ সে বলল,
” আর কাঁদিস না সোনা। জলদিই ফিরব তোর কাছে। ”
কুয়াশা তবুও ফুঁপাতে লাগল। বলল,
” তোমার বুকটা লাগবে আমার।”
শিশিরের সব এলোমেলো হয়ে এলো৷ এই মেয়ে বার বার তাকে ইমোশনাল করে দিচ্ছে। যত চাচ্ছে শক্ত হতে তত আবেগী করে তুলছে। এ এতটা ইমোশনাল কবে থেকে হলো? আগে তো কখনো দেখেনি! বলল,
” আমারও এই বুকে আমার আহ্লাদীকে লাগবে। তবে খুব জলদিই আমি তাকে এই বুকে নেব। আর কাঁদিস না লক্ষ্মীটি। এবার একটু স্বাভাবিক ভাবে কথা বল! ”
শিশিরের কথায় স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল বাধ্য মেয়ের মতো। কিছুক্ষণ সময় নিল। এরপর দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে আবার ছেড়ে দিল। শিশির তাকিয়ে রইল। কুয়াশা বলল,
” কোথায় উঠেছ? ”
” আপাতত হোটেল ডি মেরিডিয়ান লিঃ এ উঠেছি।”
” এটা কোথায়? ”
” ঢাকা, উত্তরায়। ”
” ও, রিজভী ভাইয়া নেই? ”
” হ্যাঁ আছে, ও-ও কথা বলছে স্মৃতির সাথে।”
বলে মুচকি হাসল। ফোন ঘুরিয়ে দেখালও সেটা৷ দেখল বিছানায় শুয়ে কথা বলছে সে। অবশ্য ভিডিও কলে না। কুয়াশা দেখে মুচকি হাসল। হাসিটা দেখে একটু শান্তি লাগল শিশিরের। বলল,
” খাওয়া দাওয়া করেছিস ঠিক মতো সারাদিন? ”
” হ্যাঁ, তুমি খেয়েছ তো? ”
” হ্যাঁ দুপুরে খেয়েছি। একটু আগে কফি খেয়ে এসেছি। রাতের খাবার নয়টার পরে খাব। ”
” ভালোভাবে নিয়ম করে খাওয়া দাওয়া করবা কিন্তু! আমার স্বামী যেন শুকিয়ে না যায়! যেমন পাঠিয়েছি তেমনই যেন পাই! ”
শিশির ঠোঁট টিপে হাসল। বলল,
” আচ্ছা, তেমনই থাকার চেষ্টা করব। তবে বউয়ের আদরের অভাবে যদি শুকিয়ে যায় আমার কিন্তু দোষ নেই! বউয়ের আদরের ভিটামিনের প্রয়োজন পড়বে তখন। বাড়ি গেলে সেই ভিটামিন যেন বউ পূরণ করে দেয়! ”
” ফালতু কথা! ”
ইশশ সারাদিন পর শুনল ডাকটা। মনটা আনন্দিত হলো। কুয়াশা-ও ফাজলামো করা ধরল এবার। বলল,
” রাতের ডোজ গুলোই দুই বছরের বেশি লাস্টিং করবে তাই আমার মনে হয়না বউয়ের আদরের ভিটামিনে ভুগবা! ”
এই কথা শুনে শিশির তড়িৎ ঘুরে পাশে তাকাল৷ রিজভী শুনে নিল কিনা দেখল৷ নাহ্ সে-ও বউয়ের সাথে মজে আছে। তাই রুমের ডিভান থেকে উঠে দূরে চলে গেল। গিয়ে সেখানে জানালার উপর বসল। রাতের ব্যস্ত ঢাকা শহর নজরে এলো। গাড়ি-ঘোড়া পরিপূর্ণ রোড। হরেকরকম লাইট,বাতি। সেদিকে একবার দেখে বউয়ের দিকে তাকাল৷ উত্তর করতে বলল,
” হ্যাঁ, দুই যুগেও মিটবে না। ঠোঁটের অবস্থা যে করেছিস কিছুই খেতে পারছি না। জ্বলে যাচ্ছে। সকালে কতটা আনইজি লাগছিল সকলের সামনে জানিস? ”
” ঠিক করেছি। দেখবা আর মনে করবা ঘরে তোমার বউ আছে। তারই চিহ্ন তোমার বুকে, ঠোঁটে ”
কুয়াশার স্বভাব সূলভ কথার ধাঁচ পেয়ে শান্তি পেল। সে-ও বলল,
” ফাজিল! পিঠ, বুক সব ব্যথা করে এখন আবার বলছিস ঠিক করেছিস! ”
” হ্যাঁ, ঠিক করেছি! ওগুলো আমার সিলমোহর। বাহিরের মেয়েদের নজর থেকে আমার স্বামীকে রক্ষা করার কালো টিকা!”
বেশ দাম্ভিকতার সাথে বলল কুয়াশা। শিশির হেসে ফেলল শব্দ করে। সারাদিন পর হাসল। এই মেয়েটার জন্যই সে কষ্ট পাচ্ছিল আবার এই মেয়েটার জন্যই হাসল৷ কী অদ্ভুত সম্পর্ক নাহ্! কুয়াশাও শিশিরের হাসিতে হেসে দিয়েছে। মনটা অনেকটা হালকা হলো সারাদিন পর। শিশির কুয়াশার হাসি দেখতে দেখতে বলল,
” ফাজিল।”
” তুমিও!”
এরপর কিছুক্ষণ চুপ রইল। কুয়াশা জিজ্ঞেস করল,
” আম্মুর সাথে কথা বলেছ? বাড়ির কাউকে জানিয়েছ তুমি পৌঁছেছ? ”
” হ্যাঁ সকলকে জানিয়েছি৷ আম্মুর সাথেও কথা হয়েছে৷ আম্মুর সাথে, বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে তোকে কল দিয়েছি৷ নীহার ভাইকেও দিয়েছিলাম৷ কাল সকালে সকলের সাথে ভিডিও কলে কথা বলব৷ আজ আর বলছি না। ”
” আচ্ছা।”
এরপর আবার নিস্তব্ধতা বিরাজ করল। দুইজন দুইজনের দিকে অনিমেষ চাইল৷ কুয়াশা বলল,
” ভালোবাসি!”
” আমিও ভালোবাসি।”
মুচকি হাসল কুয়াশা৷ আবেগী হয়ে উঠল হঠাৎ আবার। দুটি মনেরই এক অবস্থা হলো৷ এটাই স্বাভাবিক। নতুন নতুন এমন হবেই৷ সময় গেলে ঠিক হয়ে যাবে৷ এতদিন এরা কাছে ছিল। কাছে থেকে সব করত এখন দূরে গেছে তাই দূরত্ব পুড়াবেই। আরো কিছুক্ষণ গল্প করল দুইজন। গল্প করে নয়টা বাজাল৷ একসময় শিশির বলল,
” যাহ্ খেতে যা। নয়টা বেজে গেছে। পড়ে আবার কল দেব৷ সময় মতো খাবি আর পড়াশুনো করবি। ”
কুয়াশার মনটা বেজার হয়ে গেল। এভাবেই সারাক্ষণ কথা বললে কি ক্ষতি হবে? খুব বেশি ক্ষতি হবে কী? তাহলে তো আর নিঃসঙ্গতা আঁকড়ে ধরে না! মনে হবে মানুষটা দূরে তো কি হয়েছে? এই তো তবুও কাছে৷ সূদুরে থেকেও অতিব নিটকে!! কিন্তু হায় আফসোস! সারাদিন কি আর এভাবে কথা বলা সম্ভব? অতিশয় বাচ্চামি ভাবনা না? শিশির বুঝল কুয়াশার মনের অবস্থা। বলল,
” মন খারাপ করিস না সোনা৷ কষ্ট করে দুইটা বছর চলে গেলে ইনশাআল্লাহ সব ভালো হলে আবার বাড়িতে চলে যাব। তখন আর দূরে থাকতে হবে না৷ যেখানে থাকব দূজন একসাথে। এটা শুধু ক্ষনিকের দূরত্ব। আমরা কখনো আলাদা ছিলাম না আর থাকবও না। সবাই বলে নাহ্ আমরা ‘বুনো ওল বাঘা তেঁতুল’? তো তুই বল এরা কি আলাদা হতে পারে? নাকি থাকতে পারে? নাকি লোক মুখেই আলাদা হয়? তেমনই শিশিরের কথা এলে কুয়াশার কথা আগে আসবে। আমরা কখনো আলাদা হব না। লোকমুখের কথার মতো আমরণ এক থাকব। আমরণ আমাদের অন্তরেরও মিলন রবে৷ আমরা অর্ধাঙ্গ অর্ধাঙ্গিনী সব সময় এক আত্নায় বাঁধা থাকব৷ দূরে থেকে মন থেকে কাছে থাকব। আর মন খারাপ করে থাকিস না। ক্ষণিকের জন্য মেনে নে। বি নরমাল, সব ঠিক হয়ে যাবে আবার। ভালো থাকবি কেমন? ”
আহ্ কী সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল! মনটা শান্তিতে ভরে গেল৷
“আমরা আলাদা কখনো হব না৷ কখনো না।”
কথাটা মনে মনে আওড়াল কুয়াশা৷ বলল,
” হুঁ, মানব৷ আর ভালো থাকব৷ তুমিও ভালো থাকবে কেমন? ”
” থাকব। ”
এরপর বিদায় নিয়ে কল কেটে দিল শিশির৷ দীর্ঘ শ্বাস ফেলল একটা৷ আপন মানুষদের থেকে এ দূরত্ব জলদি ঘুচুক।
কাক ডাকা ভোর, মৃদুমন্দ বসন্তের বাতাবরণ, বসন্তের কোকিলের ডাক, আলোআঁধারিতে ঘেরা চারিকোণ সব মিলিয়ে পরিবেশ রোমাঞ্চকর।
চারিদিকে আজানের ধ্বনি কানে ভেসে আসল কুয়াশার। সারারাত ছটফট করেছে একটা শক্ত হাতের স্পর্শের জন্য, একটা শক্তপক্ত লোমশ বুকের জন্য, একটু মাদকতায় মেশানো শরীরের জন্য, একটু আফমিমের ন্যায় শরীরের গন্ধের জন্য। ছটফট করেছে বুকের মাঝের আগলে রাখা হাতের জন্য। কিন্তু হায় আফসোস! সে পায়নি ঐ সমষ্টি জিনিসের মালিকটাকে৷ চেয়েও সারারাত পায়নি সেই মানুষটাকে। বুকের মাঝের চাপা ভারী কষ্টে গলা কাটা মুরগীর ন্যায় তড়পিয়েছে। তড়পিয়েছে কী? এখনো তড়পাচ্ছে।
ঘুম তো তার সব সময়ই হালকা। কিন্তু রাতে যেন ঘুম তার আসেই নি৷ না ঘুমানোর মতোয়৷ রাতে খাবার খেয়ে পড়তে বসেছিল৷ কিন্তু পড়া তার হয়নি। শুয়ে পড়ে ছটফট করছিল৷ এগারোটার পর শিশিরকে আবার কল দেয় সে। শিশির রিসিভ করে। কথা হয় অনেকক্ষণ। শিশিরেরও রাতে ঘুম হচ্ছিল না বিধায় গল্প করে অনেকটা রাত৷ গল্প করতে করতে সময় একটা পাড় করে। অনেক রাত হওয়াতে শিশির কুয়াশাকে ঘুমাতে বলে৷ কুয়াশা উচ্চবাচ্য করে না। ভাবে হয়তো শিশির ক্লান্ত তার ঘুমের প্রয়োজন লং জার্নি করেছে৷ এসব ভেবে সে-ও সম্মতি দিয়ে ফোন রাখে। কিন্তু ফোন রাখতেই আবার আগের মতো বুকের ব্যথা বাড়ে। কী নিদারুণ, নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে। কাউকে না দেখাতে পারে আর না বলতে পারে।
রাতে শিশিরের ঘরেই শুয়েছে সে। এই ঘর ছাড়া তার রাতে শোয়া অসম্ভব মনে হয়েছে। রাতের আঁধারে ঘরের লাইট বন্ধ করলে তাকে আরো নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বতা আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরে। এতগুলো মাস যে মানুষটার বুক ছাড়া ঘুমায়নি সে এই অসহ্য, কঠিন রাত পাড় করতে পারে না। শরীরের সাথে লেপ্টে থেকে যে উষ্ণ ছোঁয়ায় শান্তির ঘুম দিয়েছে আজ রাত সে একা কাটাতে কষ্ট পেয়েছে৷ এই রাত যেন লেগেছে জনম জনম, বছর বছরের দীর্ঘতম রাত। বিয়ের দিন রাত থেকে শিশিরের বুকে রাত কাটায়। প্রথম প্রথম নিজে থেকে না গেলেও দূরে থাকলেও শিশির নিজেই টেনে টেনে বুকে নিত। সকালে সে শিশিরের বুকের মাঝে ছোট্ট আদুরে বিড়াল ছানার মতো করেই গুটিশুটি হয়ে ঘুমাত। খারাপ লাগত না বরং অভ্যাস তৈরি হয়েছিল। আর পরে তা বদঅভ্যাসে পরিণত হলো। না শিশির থাকতে পারত আর না সে৷
ছটফট করে তিনটা পাড় করে। শিশির যেখানে যেপাশে ঘুমাত সেপাশে ঘুরে শিশিরের বালিশ আঁকড়ে ধরে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। মাঝে মাঝে বুক ডলতে থাকে হাত দিয়ে ব্যথা কমানোর জন্য। এ কী অভ্যাস করে দিয়ে গেল মানুষটা?
মানুষ সত্যি অভ্যাসের দাস। আজ যদি কুয়াশার মা’য়ের বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি বলে কিছু থাকত তাহলে এতটাও কষ্ট করতে হতো না। কারণ বিয়ের পর স্বামী ছাড়া মা’য়ের বাড়ি কাটাতে পারত। কিছুটা হলেও অভ্যাস থাকত। কিন্তু কুয়াশার ক্ষেত্রে একদম ভিন্ন। সে না পেয়েছে আলাদা মা’য়ের বাড়ি আর না পেয়েছে আলাদা শ্বশুরবাড়ি। শিশিরও কখনো কাছছাড়া করেনি। শশীদের বাড়িতে একা থাকতে হবে বলে সে ছাদে পর্যন্ত থাকতে রাজি ছিল তবুও কুয়াশাকে ছাড়া থাকেনি। তাহলে কতটা কষ্ট হতে পারে চিন্তা করা যায়!!
রাতে অভাবেই কাঁদতে কাঁদতে চোখের পাতায় ঘুম নামে চারটার দিকে। এরপর কিছুক্ষণ নায় ঘুমোতে আজান কানে আসে৷ আবার ঘুম ভেঙে যায়। আজানের পরেও কতটা নিঃসঙ্গতা লাগছে একমাত্র সে জানে। রোজ হয় ও ডাকবে শিশিরকে না হয় শিশির ওকে ডাকবে৷ এরপর সালাম বিনিময় করে শিশির ও’কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে নেক স্মেল নেবে৷ যেটা তারও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নেক স্মেল না নেয়া অবধি শিশির ছাড়ত না আর সে-উঠত না। এইসবই ঘুম ভেঙে মনে পড়ল। আর পাশে শিশিরকে খুঁজল।
এ-ও ভাবল শিশির আজ কোথায় পাবে তার গ্রীবাদেশের সুবাস! মিস করছে কী তাকে? সে-ও কি তার জন্য ছটফট করছে? ভাবতে ভাবতে আবার টপটপ করে পানি ফেলল চোখ থেকে৷
ভাবনার কিছুক্ষণের মাঝে ফোন ভাইব্রেট হলো। তড়িৎ পিছন ঘুরে দেখল ফোন বাজছে। শিশিরের ফোন তাও আবার ভিডিয়ো। তড়িৎ উঠে লাইট জ্বালাল। রিসিভ করল কল। সঙ্গে সঙ্গে শিশিরের মুখ ভেসে উঠল। শিশির দেখল বউ তার কাঁদছিল তাকে না পেয়ে। চোখের পাপড়ি ভেজা। কোনো কথা না বলে তাকিয়ে রইল। শিশিরেরও চোখ মুখ লাল। হয়তো ঘুমোয়নি। কুয়াশাকে কথা বলতে না দেখে সে-ই আগে সালাম দিল,
” আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ্ আমার আহ্লাদী বউ! ”
” ওয়া আলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ্। আসসালামু আলাইকুম আমার প্রিয় স্বামী ”
” ওয়া আলাইকুমুসসালাম। বাহ্ ডাকটা নতুন মনে হচ্ছে! ”
কুয়াশা ঠোঁট টিপে মুচকি হাসল। বলল,
” হুঁ, তোমার আহ্লাদী বউয়ের প্রিয় স্বামী তুমি। একদম ব্র্যান্ড নিউ ডাক! ভাবলাম তোমার জন্য নতুন কিছু ট্রাই করি!”
শিশির ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসল। বলল,
” হুঁ পছন্দ হলো বেশ। তো এটার জন্য তোকে কিছু দিতে ইচ্ছে করছে। কি দেওয়া যায় বল তোহ্? ”
” তা তুমি জানো! ”
” তোর ঠোঁটে পুরো দশ মিনিটের চুমু দিলাম যাহ্! ”
শোনা মাত্র কুয়াশা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলে কী এই বুনো ওল!! মানে এটা আবার কেমনে কি? এভাবে দশ মিনিটের চুমু! আশ্চর্য! কুয়াশার রিয়াকশন দেখে শিশির এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। আর পাশে থেকে রিজভী চেঁচিয়ে উঠল। কিছু একটা বলল যেটা কুয়াশা শুনল না। কারণ শিশির এয়ারফোন নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু শিশির বলল,
” এ্যাই বেয়াদব তুই বউয়ের সাথে লুতুপুতু করছিস কর নাহ্ এদিকে কি তোর? কান সামলাহ্! ”
রিজভীকে কিড়মিড় করতে করতে ধমকে কথাগুলো বলল সে৷ রিজভীও একই সুরে বলে উঠল,
” বউরে তুমি এইভাবেই দশ মিনিটের চুমু দিচ্ছ আর আমি কইলেই দোষ? শালা এখন আমি-ই যত দোষ নন্দ ঘোষ হয়ে গেলাম!”
” চুপ থাক বেয়াদব! ”
বলে কুয়াশার দিকে ঘুরল কুয়াশা শুধু শিশিরের কথাগুলো শুনল। লজ্জায় মরিমরি সে। বলে উঠল,
” এ্যাই, এসব কী হ্যাঁ? ইশশ লজ্জায় নাক কাটা গেল আমার! ”
” কী আবার চুমু! তোর অয়েড এটা। ”
মানে কী সব কই এ! এ ভাবে তার পাওনা মেটাচ্ছে! কিড়মিড় করতে করতে বলল,
” অসভ্য ফাউল! ”
” যাক বাবাহ্ আমিই অসভ্য হয়ে গেলাম! এই জন্য বলে মানুষের ভালো করতে নেই”
” হ্যাঁ ভালো করে উদ্ধার করে দিলে নাহ্! অসভ্য ঠোঁট কাটা পুরুষ লোক! ”
শিশির ঠোঁট টিপে টিপে হাসল শুধু বউ তার ঝগড়া রূপে ফিরেছে। একে স্বাভাবিক করতেই তো এমন ফাজলামিগুলো করল। সে বেশ ভালোরকমই জানে তার বউ সারারাত তার মতোই ছটফট করেছে বুকে ঘুমানোর জন্য। সে-ও তো তার বিড়াল ছানাটাকে বুকে না পেয়ে ছটফট করেছে। স্মেল না নিতে পেরে বুক সহ মাথা পর্যন্ত ঝিমঝিম করছে। যেমনটা হয় নেশা সেবন করতে না পারলে! ঠিক তেমন। এজন্যই তো আজানের সময় উঠে আগে কল দিয়েছে। বুকটা তার সারারাত শূণ্যতায় পড়ে ছিল। এখন মুখটা দেখে কিঞ্চিৎ হলেও কমল। ঘড়ি দেখল৷ পাঁচটা বেজে আসছে। বলল,
” যাহ্ নামাজ পড়ে নে৷ পাঁচটা বেজে আসল৷ আমিও উঠব ”
কুয়াশা দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। ধরা কন্ঠে বলল,
” সারারাত ঘুম হয়নি জানো! তোমার বুক খুঁজে বেড়িয়েছি। তোমার হাত খুঁজে বেড়িয়েছি। তোমার শরীরের স্মেল খুঁজে বেড়িয়েছি। ”
শিশির শুনে চুপ করে থাকল। শুধু তাকিয়ে থেকে ভেতরে ভেতরে জ্বলতে লাগল। নিজেকে প্রকাশ করল না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলল একটা৷ বলল,
” একটু কষ্ট সহ করে নে সোনা। আবার আগের মতো হয়ে যাবে সব ”
” কবে হবে? তুমি চলে আসো না প্লিজ! ”
বলেই কেঁদে উঠল। কী বাচ্চামি কথাবার্তা বোঝো তো! এই মেয়ে শুধু কাঁদে। আচ্ছা এ তো এত কাঁদত না ফেচফেচ করে! এমন কান্না কবে থেকে শিখল? ভালোবাসা এতটায় পাগল করে দিল তাকে!!
এদিকে শিশিরের ভাবনার মাঝে কুয়াশার ওমন কথা আর কান্নাতে একটা গান মনে পড়ে গেল৷ আছে নাহ্ একটা গান!
— তুমি গেছ বিদেশে আমায় রাইখা বাড়িতে! ও নাহ্ থুড়ি শিশির তো ঢাকায়! কথাটা এমন হবে,
“”— তুমি গেছ ঢাকাতে আমায় রাইখা বাড়িতে!
— চইলা আসো বাড়ি আমার টাকার দরকার নাই!
— চইলা আসো বাড়ি আমার টাকার দরকার নাই! “”
ঠিক এই গানটায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যায়হোক এদের এমন ইমোশনাল মোমেন্টে গান টান আর না গাই!
শিশির এবার একটু কঠিন ভাবে বলল,
” শক্ত, হ কুয়াশা। এমন তো ছিলি না তুই? বুঝদার থেকে এমন পাগলামি কেন করছিস? কী সব পাগলামি কথা বার্তা বলছিস! আমি যেন আর কাঁদতে না দেখি তোকে। আর একবার চোখের পানি দেখলে ফোন টোন আর দেব না৷ তখন থাকিস তোর ফেচফেচ কান্না নিয়ে৷”
কুয়াশা কান্না থামিয়ে দিল৷ মনটা একটু খারাপ হলো এমন রূঢ় আচরন আর কথা শুনে তার। তবে কিছু বলল না৷ শক্ত হয়ে চোখ মুছে নিল। বলল,
” রাখলাম৷ নামাজ পড়ব৷ ভালো থেকো, আল্লাহ হাফেজ।”
বলেই শিশিরকে কিছু বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দিল। শিশিরের একটু খারাপ লাগল। তবে নিজের খারাপ লাগাটা দমিয়ে নিয়ে বড় একটা শ্বাস ফেলল।
ওভাবে বলতে চায়নি সে। না বললেও হচ্ছিল না৷ আর কতই বা কাঁদবে? কাল থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। দূরে থেকে এসব দেখলে খারাপ লাগা আরো বাড়বে না?উঠে পড়ল। নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। রিজভী অনেকক্ষণ আগেই উঠে গেছে। সে ওজু করে বেড়িয়েও এসেছে। শিশির ঢুকল। কিছুক্ষণের মাঝে বের হয়ে নামাজ আদায় করে নিল।
মালিথা ভিলায় সকাল আটটার দিকে সকলে নাস্তা করছে৷ জাকিয়া জাকির মালিথার জন্য খাবার রেডি করে নিয়ে উপড়ে চলে গেলেন৷ ইয়াসমিন, বৃষ্টিও একসাথে বসেছে। চেয়ার পড়ে আছে আজ। জাহিদ মালিথা নেই, জাকির মালিথা ঘরে খান, শিশির নেই তো চেয়ার পড়ে থাকবে না? সকলেই শিশিরকে মিস করল৷
নীহার বার বার শিশিরের চেয়ারটাতে তাকাতে লাগল৷ চেয়ারটায় আজ কেউ আর বসে নি। নীহার খুব করে মিস করছে শিশিরকে। ভাইটার সঙ্গ সে অধিকাংশ সময়ই পেত। খাবার টেবিলেও চুপচাপ, সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। যারা ঝগড়া, চুলোচুলি করে জমিয়ে রাখত তারাই তো নেই! তারা বলতে একটা মানুষই তো নেই! তাই অপরজনও নিরব। বাড়িতে শিশির, কুয়াশাই ছোট দের মতো মাতিয়ে রাখত। তারাই ছোট ছিল মনে হতো। হিম আগাগোড়া-ই নিরব। প্রয়োজন ছাড়া চঞ্চলতা দেখায় না।
কুয়াশা চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল৷ কলেজে যাবে সে আজ। বাড়িতে আর থাকতে পারছে না। এই কলেজে যাওয়া নিয়েও শিশিরকে মনে পড়ল। তারই তো বাইকে যেত!! ঐ ছেলেটা তার সব কিছুতে জড়িয়ে আছে।
সাড়ে আটটার দিকে কুয়াশা বের হয়ে গেল৷ সকলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। নিরব কুয়াশাকে মানাচ্ছে না একটুও৷ শিশির ভিডিয়ো কল দিল সেসময়ে বাড়িতে মায়ের ফোনে৷ তুষার, তুহিন, আম্বিয়া বের হবে একটু পর। শিশিরের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে তারাও চলে গেল৷ সে বসার ঘরে নীহার, হিম, বৃষ্টি, ইয়াসমিন, আজমিরা আর জাকিয়ার সাথে কথা বলতে লাগল৷ আড্ডা দিল অনেক সময়। কুয়াশার কথা জিজ্ঞেস করলে জাকিয়া জানালেন কলেজে চলে গেছে৷ শিশির কিছু আর বলল না কুয়াশাকে নিয়ে৷ বউয়ের জায়গা বউয়ের জায়গায়৷ এখন সময় পরিবারের। একসময় বাবার কাছে নিয়ে যেতে বলল। জাকিয়া নিয়ে গেলেন৷ বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখল। বাহিরে বের হতে হবে। এই বলে ফোন রাখল।
দুপুর আড়াইটার দিকে কুয়াশা বাড়িতে এলো। কলেজে স্মৃতির সাথে গল্প করে মনটা হালকা করেছে৷ সাথে ঈশা, রনিও ছিল৷ আড্ডা, হাসাহাসি হয়েছে। ঈশা আর রনি স্মৃতিকে আর ওকে বেশ রাগিয়েছে আর মজা নিয়েছে। তারাও বলেছে স্বামী তাদের বিদেশ। এই নিয়ে ঈশা আর রনি অনেক মজা উড়িয়েছে। তারাও ধাপধুপ পি-টিয়েছে দুটোকে। বেলাটুকু বেশ ভালোই গেছে৷
বাড়িতে এসে আবার নিঃসঙ্গতা কুঁড়ে ধরেছে। ঝগড়া না করতে পারলে ভালো লাগছে না বুনো ওলটার সাথে। চুলোচুলি, কেঁচাকেঁচি মিস করছে। মালিথা ভিলায় তারা শালিক পাখির ন্যায় কিচিরমিচির করত। এমন নিরবতা কেমন ভূতের বাড়ি লাগছে।
কুয়াশা এসে গোসল করে নিল। সারাদিন শিশিরের ঘরে ঢুকছে না সে। শুধু রাতে থাকবে ওর ঘরে মনস্থির করেছে৷ নিজের ঘরেই গোসল সহ সারাদিনের কাজ করছে৷ দরকারি জিনিস ডাবল করে নিয়েছে দুইঘর মিলে। গোসল করে নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে এলো। কিছুক্ষণ ঘরে থেকে বৃষ্টির ঘরে চলে গেল৷ বর্ষণের সাথে সময় কাটাবে। সকালের পর আর কল করেনি শিশির। সে-ও করেনি। তার ইমোশনটাকে একটুও মূল্য দিল না সে? অভিমান করল আর সব বউদের মতো সে-ও। আর দেখাবে না ভালোবাসা হুহ্। থাকুক সে একা৷
বেলা ক্ষয়িষ্ণু আলোয় লালিত। চৈত্র মাসের সূর্যের তাপ সারাদিন প্রচণ্ডরকম তেজে ছিল। এখন তার তাপ কমেছে, তেজও কমেছে৷ নেতিয়ে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। লালাভ আলো প্রকৃতিতে বিরাজমান। বিকেলের দিকে কয়েকটা কোকিলের ডাক শোনা গেল। কুয়াশা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ছাদ থেকে কিছুটা দূরে একটি শিমুল ফুলগাছ আছে সেটাই দেখা যাচ্ছে যেটাতে লাল শিমুলে টকটক করছে পুরো গাছে ডালপালা। কুয়াশা সেদিকেই তাকিয়ে রইল।
কী যে একা একা লাগছে! এই বিকেলটাতেও সে শিশিরকে পেত৷ আজ আর পাচ্ছে না। তাই ছাদে চলে এসেছে। শিশির এখনো আর কল দেয়নি৷ ফোন হাতে করে এসেছে৷ যদি দেয়!! তারও তো একটা ভাবা উচিত এই সময় কতটা মিস করতে পারে তার আহ্লাদী বউ!!
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। সূর্য ডুবে গেছে। পাখিরা কিচিরমিচির করে বেড়াচ্ছে। ফোন বাজল সে-সময়ে। শিশির কল দিয়েছে সারাদিন পর! অভিমান হলো খুব৷ সে তাকে কতটা মিস করছে প্রতিটা ক্ষণে জানে কী! তবুও রিসিভ করল। রিসিভ করে ফোন কানে ধরে সালাম দিল। সালামের জবাব নিতে শোনা গেল ওপাশ থেকে। কুয়াশা আর কথা বলল না। শিশিরই ওপাশ থেকে বলল,
” অভিমান হয়েছে বউটার? ”
কুয়াশা কোনো উত্তর করল না৷ ওপাশের শিশির মুচকি হাসল। বলল,
” সোনা! ”
এই ডাকটা সে প্রত্যাক্ষাণ করতে পারবে না। বলল,
” হুঁ? ”
শিশির আবার হাসল। বলল,
” ইশশ, আমার বউটার গাল ফুলানো দেখতে পারছি না তো!”
কুয়াশা কথা বলল না৷ সে আবার বলল,
” সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম৷ বাসার সন্ধ্যান করছিলাম৷ এতদিন হোটেলে থাকা যাবে না৷ অনেক টাকা খরচ হবে। অযথা টাকা খরচ করার ইচ্ছে নাই৷ এছাড়া আমি পারলে রিজভী পেরে উঠবে না৷ দু’জনকেই সবটা ম্যানেজ করে চলতে হবে বছরগুলো। তাই ওর এই উত্তরাই চাচতো খালার ফ্ল্যাটে গেছিলাম৷ ওনারা তিন তালার উপর ভাড়া থাকেন পুরো ফ্ল্যাট নিয়ে। আমাদের জানালেন চারতালাটা নাকি এখন ফাঁকা পড়ে আছে। বেশ ভালো সুবিধাই আছে ওখানে। পরশু ওখানে চলে যাব৷ আপাতত দুই-তিন মাস বাসাতেই থাকব। এইসবের জন্য ব্যস্ত ছিলাম। ”
” হুঁ, বুঝেছি। ”
” খেয়েছিলি দুপুরে? ”
” হ্যাঁ, তুমি খেয়েছিলে? ”
” হ্যাঁ, দুপুরে খেয়ে এসেছিলাম ওখান থেকে৷ ওনারা বেশ ভালোই সমাদর করেছেন৷ চারটার দিকে এসে একটু ক্লান্ত লাগছিল তাই গোসল করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ একটু আগে উঠে নামাজ পড়েছি। ”
” আচ্ছা, নিয়মমতো সব কোরো। ”
” গেছে অভিমান আমার আহ্লাদীর? ”
” হুঁ। ”
শিশির হাসল ঠোঁট টিপে। ডান কান থেকে বাম কানে ফোন নিয়ে বলল,
” কি করছিস এখন? ”
” ছাদে আছি। তুমি কি করছ? ”
” বসে আছি৷ এখন বাহিরে বের হব একটু ঘোরাঘুরি করতে। ”
” আচ্ছা। দেখেশুনে চলবে কিন্তু! ”
” পাকনি বউ আমার। আমাকেই উপদেশ দেয়! ”
কুয়াশা হাসল কিঞ্চিৎ। শিশির বলল,
” সন্ধ্যা নেমে গেছে নিচে যা সোনা৷ রাতে কল দেব৷ ”
কুয়াশা সম্মতি দিয়ে বলল,
” আল্লাহ হাফেজ। ”
” আল্লাহ হাফেজ। ”
বলে শিশির কল কাটল। কুয়াশাও শান্তির একটা নিঃশ্বাস টানল আর ফেলল গোধূলির আকাশে তাকিয়ে। এরপর নিচে নেমে গেল।
কেটে গেল একটা সপ্তাহের বেশি। মালিথা ভিলা একদম শান্তশিষ্ট হয়ে গেছে। কেমন যেন মৃ-ত্যুপুরি মনে হয়। কবে যে সব আবার আগের মতো হবে! আদৌ কি আর আগের মতো হবে? নাকি দিন পাল্টে, মাস পাল্টে, বছর পাল্টে সব রঙও পাল্টে যাবে? পাল্টে যাবে কী আড্ডা মজায় মেতে থাকা মালিথা ভিলা? সকলে কি চিরকাল এক থাকে? চাইলেই কি সম্ভব চিরকাল এক থাকা? উহু সম্ভব না। সময়, দিন, মাস, বছরের সাথে সাথে মানুষেরও পরিবর্তন আসে। বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বাড়ে ব্যস্ততা। হয়তো সেই ব্যস্ততা কাটিয়ে সময়টা কিঞ্চিৎ আগের মতো করে কাটানো সম্ভব হয় তবুও সেটা ক্ষণিকের জন্য।
এতকাল মালিথা ভিলার সকল সদস্য মিলেমিশে একে অপরের সাথে থেকে দিন, মাস, বছর পাড় করেছে। এখন সময় আসছে সবার সবটা নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নেবার। ভবিষ্যতের পেছনে দৌড়বার৷ তেমনই দৌড়েছে নীহারও। শিশির গেছে তার ভবিষ্যত গোছাতে। নীহারও চলে গেছে তার ভবিষ্যত গোছাতে।
সে ঢাকায় গেছে আজ চারদিন হলো। সেখানে নেভি স’শ’স্ত্র কমিশন অফিসার ক্যাডেট ব্যাচের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। পরীক্ষার কেন্দ্রস্থল ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা। সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রাথমিক সাক্ষাৎকার ও লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়া লাগবে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের আইএসএসবি (ISSB) কর্তৃক পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকার আন্তবাহিনী নির্বাচন পর্ষদ আইএসএসবি কর্তৃক পরীক্ষা এবং চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে পার্থী বাছাই করা হবে। এরপরই তাদের প্রশিক্ষণ৷
নীহার যাবার পর থেকে আরো খা-খা করে মালিথা ভিলা। সকলের দিন যাচ্ছে ঠিক কিন্তু রসকষহীনভাবে। শিশির নিজের ব্যস্ততার মাঝে কুয়াশার সাথে সহ বাড়ির সকলের সাথে সময় কাটায়। ঢাকায় নীহার পরীক্ষার দুইদিন আগে গেছিল৷ শিশিরের সাথে সেখানে গিয়ে আগে দেখা করেছে।
ভোর থেকে রাত পর্যন্ত শিশির বউকে আগের মতো করে সময় দেয়। আজানের পর ভিডিয়ো কল সহ সকালে মায়েদের সাথে কথা বলা এবং একদিন দুইদিন পর পর ভিডিয়ো কল করে। রাতে কুয়াশার সাথে গল্প করতে করতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬৩+৬৪
কুয়াশা আগের থেকে অনেক নরমাল হয়েছে। এখন আর কান্নাকাটি করে না। কিন্তু হাসিখুশিও বেশি থাকে না। থাকবেই বা কার সাথে? সেই মানুষগুলোই তো নেই৷ বৃষ্টি, ইয়াসমিনের সাথে ও বর্ষণকে নিয়ে যেটুকু হাসাহাসি করে৷ হিম বন্ধুদের সাথে আজকাল ঘুরাঘুরি সহ খেলাধুলা করে। পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে।
এভাবেই দিনগুলি কাটছে সবার৷
