বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৭৩+৭৪
রোজা রহমান
শীতের দিন, রাত সবই ঠান্ডা, শুষ্কতা বিরাজ করে। বিকেল হয় ঠান্ডা মৌসুম। সুর্যহীন এই বিকেলে দু’জোড়া চোখ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের মেঘ সহ, প্রকৃতির গাছপালা দেখতে ব্যস্ত৷ পাখপাখালিরা শীতের প্রকটতা থেকে বাঁচতে জলদি তাদের নীড়ে ফিরছে৷ সারাদিন নিজেদের কাজে ব্যস্ত থেকে দিন পাড় করেছে৷
চোখ জোড়া যেমন ব্যস্ত প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত তেমনই তার মস্তিষ্কও চিন্তায় মগ্ন। ভাবনারা লুটোপুটি খাচ্ছে কিছু কথা হানা দিয়ে। ভাবনায় তার আসছে, ইশশ যদি ঐ পাখিগুলোর মতো তার আপন মানুষটাও দিন শেষে যদি তার কাছে আসত? এমন সারাদিন পর যদি রাতটায় তার সঙ্গ পেত? রাতের একলা ঘরের নিঃসঙ্গতা যদি কাটাতে পারত? একা যে রাত কাটানো বড় দায়! দিন তো যেমন তেমন চলে যায়, কিন্তু রাত? রাতে কি প্রিয় ভালোবাসার মানুষটাকে না ছাড়া যায়!! কতশত স্মৃতিরা দৌড়ে বেড়ায়৷ একাকিত্ব আঁকড়ে ধরে রাখে৷ খোঁজে পাশে ভালোবাসার মানুষটিকে৷ বাহিরে নিজেকে শক্ত দেখালেও, সে কি আদৌ শক্ত থাকতে পারে ভেতরে? সকলের সাথে দিনে তো চলে যায় কিন্তু রাতে তো প্রিয় সঙ্গীটাকে খোঁজে! মানুষটা শক্ত হতে শিখিয়ে গেছে সে-ও হয়েছে। কিন্তু কতটুকু হতে পেরেছে শক্ত?
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আজ কত মাস হলো তাকে কাছে পায় না? ভাবনার মাঝেই সংখ্যার হিসেবটা মিলিয়ে নিল। এক না দুই না তিন না পুরো সাতটা মাস পাড় হয়ে গেল৷ এই সাতটা মাস কি খুব সহজ? উহু, অতিশয় কঠিন। নীহারের যাওয়া সাতটা মাস হয়ে গেল। আর কত দিন, সপ্তাহ, মাস অপেক্ষা করতে হবে? নাকি বছরের পর বছরও অপেক্ষা করতে হবে আপন মানুষটার জন্য! অপেক্ষা জিনিসটা যে খুব কঠিন!! অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়না, কাটে না দিন-রজনী৷
প্রিয় মানুষটার সাথে কাটানো ঐ কয়েকটা দিনের কথা মনে এখনো কাঁটা দেয় শরীরে, শিহরণ হয় শরীর৷ কতই না মধুর ছিল! আবার কবে পাবে ঐভাবে কাটাতে? ভালোবাসা, সুখ, শান্তি, আনন্দময় ছিল কয়টা দিন৷ আর যেদিন গেল সেদিন? সেদিনের কথা মনে উঠলে তো বুকটা এখনো কাঁপে। শরীরটা ভারী হয়ে আসে৷ পা যেন অবস হয়ে যায়। মানুষটার চলে যাওয়া তার হৃদয়ের সুক্ষ্ম ব্যথার কারণ৷ এই ব্যথা ততদিন স্থায়ী যতদিন মানুষটা তার থেকে দূর থেকে বহু দূর রবে৷
নীহারের ঘরের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবনায় মত্ত শশীর ভাবনা আবার উল্টে গেল নীহারের যাবার দিন সহ ক্ষণিকের কাটানো মূহুর্তে চলে গেল৷ বিয়ের পর যে দিনগুলো কাছে পেয়েছিল, কাছে ছিল সে-কটা দিন সব সুখ ছিল তাদের মাঝে৷ মানুষটা আদরে, আহ্লাদে ভরিয়ে রেখেছিল৷ বাড়িটা মেতে ছিল খুশিতে। যেদিন গেল কতই না পাগলামি করল তবুও একা রেখে চলে গেল৷ একটু মায়া-দয়া করল না৷ ভাবলনা কষ্টে তার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল৷ ভালোবাসা শুধু পুড়ায়৷ তাদের ভালোবাসায় শুধুই দূরত্ব। সে প্রথম থেকে দূরত্ব এখনো সেই দূরত্ব। তফাত বিয়ে আগে আর পরে৷ কবে আসবে সে!!
” কবে আসবেন আপনি? আমার অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ করবেন? আমার যে আর একলা রজনী কাটে না! আপনার আদর, ভালোবাসা বড্ড প্রয়োজন। কেন আমাদের ভালোবাসায় এত দূরত্ব! সূদরে কি আপনি ভালো আছেন আমায় ছেড়ে! আমি যে ভালো নেই। কবে ফিরবেন আপনি! ”
কথাগুলো ঠোঁটজোড়ার নিচে বিরবির করে আওড়াতে আওড়াতে কান্নায় ভেঙে পড়ল শশী। রেলিঙের পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে গুঙিয়ে, ডুকরে উঠল। গায়ের শাল চাদরটা একপাশ নিচে খসে পড়ল সেদিকে খেয়াল করল না। চোখের পানি ফেলতে লাগল স্বামীর জন্য, ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে না পাবার কষ্টে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো ধরণীর বুকে। আজান দেবে দেবে ভাব। আরো একজোড়া চোখ সূদুরে অবলোকন করছে৷ কিচিরমিচির করে শহুরে পাখিরা নীড়ে ফিরছে। সে একজনের উপর রাগ, অভিমান পুষে নিয়ে দিব্যি দিন কাটাচ্ছে। রাগ করার তার অধিকার। করবে সে রাগ। কারণ ছাড়াই করবে। বউ সে, রাগ করবে না তো কে করবে? সে-ই করবে এবং ভাঙাবে ঐ মানুষটা। অভিমানে মন সিক্ত করল আরো। আসলেও কথা বলবে না। ভাবনার মাঝে চারিদিকে আজানের ধ্বনি কানে ভেসে এলো কুয়াশার কানে। বেলকনি থেকে সে ঘরে এলো৷ ধীর পায়ে। ঘরে গিয়ে ওজু করে নিল। মাগরিবের নামাজ আদায় করে সে ঘর থেকে বের হলো।
শশী ঘরের দিকে গেল। দরজা ভিড়ানো ছিল। ঘরে ঢুকে পেল না৷ বেলকনিতে গেল৷ দেখল এই শীতের মাঝে বেলকনিতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। হাসল কিঞ্চিৎ। এগিয়ে গিয়ে পেট ধরে হালকা ঝুঁকল কুয়াশা৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকল,
” শশী…! ”
মুখ তুলে তাকাল শশী। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেঁদেছে প্রচুর। মলিন সে-ও হাসল। মেয়েটার কষ্ট সে বুঝল৷ নতুন নতুন সে-ও তো এমন পাগলামি করত!! কত রাত দিন বসে বসে কাঁদত৷ এখন আর কষ্ট হয়না সয়ে গেছে। পুরুষরা তো সব সময় চাইলে ঘরে বউয়ের কাছে বন্দী হয়ে থাকতে পারে না! তাদের বাহিরে যেতেই হয় কাজের জন্য। কিছু করার নেই। কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়তে হয়৷ কুয়াশা বলল,
” ওঠ, নিচে চল। আমি কাঁদতে মানা করি না? তবুও কেন কাঁদিস? ”
” কি করব বুবু? সহ্য হয় না আমার৷ তোমার ভাইকে ছাড়া সব শূণ্য মনে হয়”
আবারও কিঞ্চিৎ হাসল কুয়াশা৷ মেয়েটা আর বড় হলো না৷ এই দূরন্তপনা মেয়েটার যখন মন ভালো থাকে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে আর যখন মন খারাপ থাকে তখন এমন একা বসে কাঁদবে। বলল,
” ওঠ, তুই না আমার স্ট্রোং বোন? তো এখন এমন অবুঝপনা কেন? জলদি আসবে ভাইয়া। আর কাঁদিস না সোনা৷ আমরা আছি তো! চল নিচে যায়। আমারও ভালো লাগছে না৷”
শশী দেখল কুয়াশা এখনো ঝুঁকে আছে৷ সে তৎক্ষনাৎ চোখ মুছে নিয়ে বলল,
” আরেহ্ বুবু তুমি ঝুঁকে আছো কেন? সোজা হও৷ ওর কষ্ট হবে ”
বলতে বলতে ঝটপট উঠে দাঁড়াল৷ চাদরটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” চলো এখানে অনেক বাতাস, ঠান্ডা লাগবে তোমার ”
কুয়াশা মুচকি হাসল। মেয়েটা নিজের চাপা কষ্ট ভুলে তার খেয়ালে ডুবল৷ তার কোনটাতে সমস্যা হবে সেই খেয়ালে৷ শশী আবার তাড়া দিলে পা বাড়াল৷ দু’জনে বেড়িয়ে গেল৷ সিঁড়ি দিয়ে সাবধানতা বজায় রেখেই নামল৷ অল্প থেকেই অতি সাবধান সে৷
বসার ঘরে সকলেই আছে৷ এই সময়টা আগাগোড়াই মা’য়েরা, বউরা নামাজ পড়ে নিচে থাকে৷ বৃষ্টি, বর্ষণ, ইয়াসমিন, জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা সকলে বসে আছে৷ বর্ষণ আগের থেকে আরো চঞ্চল হয়েছে। পাকা কথা বলে এখন৷ বলবে না? তিনটা বছর পাড় করে এসেছে সে৷ সোফায় বসে চিপস খাচ্ছিল সে। কুয়াশাকে দেখে লাফ দিয়ে নেমে ফুপি ফুপি করতে করতে ঝাঁপটে ধরল পা৷ কুয়াশা হেসে হাত ধরল। বলল,
” কি খাচ্ছিস তুই এগুলো? ”
” চিপত। ”
” ও, চিপত খাচ্ছিস? দে আমায়?”
” নাও।”
বলেই প্যাকেট এগিয়ে দিল৷ কুয়াশা হেসে ফেলল। বলল,
” না বাবা, তুই খা৷ ”
সে হাসল৷ চিপস তুলে মুখে পুরল। সে জানে ফুপু খায় না শুধু বলেই৷ শশীকে দেখে বলল,
” শশামা খাবে? ”
শশীকে সে শশামা বলে। প্রথম প্রথম ডাকতে পারত না৷ পরে যখন শিখল তখন সকলের মুখে শশী নাম শুনে শুনে সে ছছা (শশা) ডাকত শুধু। তার সাথে কিছু যোগ করত না৷ সকলে কী না হাসি এ নিয়ে! শশী অবশ্য মুখ ফুলিয়েও থাকত৷ এরপর যখন দেখল এই ছেলে এই ডাক বন্ধ করবে না হাজার বলেও তখন, শশীই ওকে শশার সাথে মা শিখিয়েছিল। প্রথম প্রথম ডাকত না ছছা-ই বলত৷ এরপর আস্তে আস্তে ছছমা বলা ধরেছিল। এখন কথা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে অনেক কথা স্পষ্ট আসে অনেক কথা আসে না৷ তোতলা হয়। যেমন ছছা থেকে শশা হয়েছে। এখন নিয়মিতই ডাকে শশামা বলে৷ সকলে প্রথমে মানা করলে শশী বলেছিল এখন ছোট ডাকছে ডাকুক কয়েকবছর গেলে বুদ্ধি হয়ে গেলে ঠিক করে শিখে যাবে।
” না রে পাকনা তুই-ই খা তোর চিপত। ”
বলে কোলে তুলে নিল৷ বসল সোফায়। চা নাস্তা করছে সকলে৷ আজমিরা হেসে কুয়াশাকে বলল,
” শরীর কি আর খারাপ লাগছে? ”
” না আম্মু। ”
জাকিয়া বললেন,
” ফলগুলো খা। ”
” খেতে মন চাচ্ছে না৷ রাখো পরে খাব। ”
জাকিয়া চোখ পাকিয়ে তাকালেন৷ তা দেখে একটা কমলা তুলে নিল৷ ছিলতে ছিলতে বলল,
” দেখো খেতে পারি না তবুও কেন জোর করো।? ”
বৃষ্টি বলল,
” আর আমার তো খিদে পেত। কিন্তু পেটে রাখতে পারতাম না। ”
” তুমিই ভালো ছিলে৷ ”
ইয়াসমিন পাশে থেকে শুনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল গোপনে৷ তার ভেতরের সুপ্ত ব্যথাটা নিরাময় হয়না৷ কুয়াশা কমলা ছিলে অর্ধেকটা বর্ষণের হাতে দিয়ে দিল৷ সে অর্ধকেটা নিল৷ টুকটাক গল্পের মাঝে হিম এলো। তার পড়ার চাপ প্রচুর। রোজ বাড়িতে আসতে এমন রাতই হয়৷ সামনেই তার এইচএসসি পরীক্ষা। স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে সর্বদা খেঁটে চলেছে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে। হিম এলে বর্ষণ চেঁচিয়ে উঠল,
” কুটি তাচু..! ”
বলেই নামতে নিলে সে তড়িঘড়ি করে বলল,
” বসো বসো চাচু, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। শরীর নোংড়া। ”
বলেই এগিয়ে এসে একটা ব্রিটানিয়া কেকের প্যাকেট দিল বর্ষণের হাতে। দিয়ে চলে গেল৷ বর্ষণের জন্য রোজ আনবে কিছু না কিছু হাত খরচের টাকা থেকে৷ বর্ষণ এত এত খাবারের মাঝে থেকে রোজ চাচুর আনা এই জিনিসগুলো খুব পছন্দ করে। অনেক আনন্দ পায়৷ এই জন্য হিম এই সময় বাড়িতে এলেই সে দৌড়ে যাবে৷ ছোট ছেলেপেলের মন কীনা!! খাবার জিনিস পেলেই আনন্দিত।
রাত নয়টার পরে জাকির মালিথা, তুহিন, হিম সহ তিন জা আর বউরা সকলে খেতে বসেছে। বাড়িতে উপস্থিত বর্তমান সদস্যই এরা। খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার ঘরে চলে গেল৷ কুয়াশার ঘরে শশী থাকে। দু’জনে একা থাকবে ভেবে জাকিয়া বলেছেন একসাথে থাকতে৷
পরেরদিন সকাল দশটার দিকে খাওয়া দাওয়া করে সকলে একটু দুপুর টাইমের অলসতা কাটাতে যে যার ঘরে আছে৷ সেই সময়ে বাড়ির বেল বাজতে শুনে শশী গিয়ে খুলে দিল। খুলেই চেঁচিয়ে উঠল,
” ভাইয়া…! ”
শিশির হাসল। বলল,
” কেমন আছিস বুড়ি? ”
” আমি ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো?”
” হ্যাঁ ভালো আছি”
“কেমন ঘুরলে বন্ধুদের সাথে? সব বলতে হবে কিন্তু? ছবিও দেখব সব খানের। ”
শশীর কথা শুনে হেসে ভেতরে ঢুকল। দুইজনে হেঁটে আসতে আসতে বলল,
” হ্যাঁ সব বলব। ছবিও দেখাব। আগে বল তোর বুবু কেন কাল ফোন ধরেনি? কি হয়েছে আহ্লাদীর? আচ্ছা খুব রেগে আছে নাকি রে? ”
” হ্যাঁ বহুত রেগে। এতটাই রেগে আর অভিমানে আছে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না৷ আর তোমার উপর আহ্লাদী অভিমান করে কি কাজ করেছে সেটাও যখন জানবে তখন বুঝবে ”
শিশির মাত্রই সিঁড়িতে পা দিতে যাচ্ছিল৷ শশীর কথা শুনে সে ভ্রু কুঁচকাল৷ পেছন ঘুরে বলল,
” কি করেছে? ”
” উপরে যাও দুই-তিন সপ্তাহের নাম করে মাসের বেশি কাটিয়ে এলে! ”
” আসলে ওরাই এমন লেট করল। সকলে মিলে অনেকদিন পর একসাথে হয়েছিলাম এই জন্য ”
” আচ্ছা যাও আহ্লাদীর আগে রাগ ভাঙাও গিয়ে। দেখো গিয়ে তোমার জন্য সারপ্রাইজ নিয়ে বসে আছে ”
শিশির শশীর কথা বুঝতে পারল না। তবে অনেক কিউরিসিটি বাড়ল। সেই কৌতুহল থেকেই উপরে গেল আর কিছু বলতে না দিয়ে৷ শশী মিটমিট করে হাসল। সে-ও উপরে নিজের ঘরে চলে গেল৷
কুয়াশা জেগে ছিল। ঘুম খুব কম হয়৷ জেগেই ছিল৷ বেলের শব্দ পেয়ে সে উঠেছিল৷ নেমে বের হয়ে শশী দরজা খুললে শিশিরের কথা পায়। শিশির এসেছে শুনে আনন্দে মন নেচে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণে মনটা অভিমানী হয়ে ওঠে। তাই নিচে না যেয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়৷ এখানে রোদ আসে সকালের দিকে। শীতের রোদ মিষ্টি লাগে।
শিশির ঘরে এলো আহ্লাদী কাল থেকে কল ধরছে না তার মনটা অনেক উত্তেজিত। বউটাকে আজো কাছ ছাড়া করে থাকতে পারে না। তবে কি আর করার? সব সময় তো আর বউয়ের কথা ভাবলে হয় না! ঘর কুনো পুরুষ হলে চলবে না। বউ বউয়ের জায়গায় আর কাজ কাজের জায়গায়। ঘরে নেই তাই ডাকল,
” কুয়াশা, এ্যাই কুয়াশা! ”
কুয়াশা বেলকনি থেকে এলো৷ স্বামীর অবাধ্য হতে ইচ্ছে হলো না৷ অভিমানী মন নিয়ে ভেতরে এলো গুটি গুটি পায়ে৷ কুয়াশা আসতেই শিশিরের চোখের দৃশ্যপটে কিছু একটা দৃষ্টিয়মান হয়ে সেখানেই থমকে গেল সে। মাত্রই ব্যাগ রেখে শার্ট খুলতে খুলতে কুয়াশাকে ডাকছিল। আর কুয়াশাকে এই রূপে, এই ড্রেসে, এই ভাবে দেখে তার মাথায় কিছু একটা বাড়ি দিল৷ থমকে শুধু দাঁড়িয়েই আছে। কুয়াশা শিশিরের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলানো ভাব করে এগিয়ে গেল কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়াল সে। শিশির কুয়াশার মুখের দিকে একবার তাকাল একবার পেটের দিকে। বার কয়েক দেখে হতবাক হয়ে গেল। এগিয়ে গেল বিস্ময় নিয়ে৷ কিছুক্ষণ কথা এলো না মুখে। হাত পা কেন যেন কাঁপতে লাগল৷ অনুভূতি কেমন যেন কাঁপন ধরিয়ে দিতে লাগল৷ মাথায় একটা শব্দই বাড়ি দিতে লাগল, সে বাবা হতে যাচ্ছে কী!!
শিশিরের শরীরের লোমগুলো খাঁড়া হয়ে উঠল৷ বিঁধল তা কাঁটার ন্যায়। অনিমেষ চেয়ে রইল পেটের দিকে৷ এরপর কুয়াশার মুখের দিকে তাকাল আবার৷ কুয়াশা নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিশির ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিল। বলল,
” বলিস নি কেন? ”
” কেন বলব?
একদম কাটকাট উত্তর। শিশির ভ্রু কুঁচকাল৷ কুয়াশা আবার বলল,
” কে তুমি? আমাদের চিন্তা করো তুমি? তুমি যেখানে খুশি সেখানে যাও। আমার আর প্রয়োজন নেই তোমাকে। আমার একাকিত্বের সঙ্গী আমি পেয়ে গেছি। ”
শিশির কুয়াশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল চোখ মুখ কুঁচকে। মাথার উপর চাটি মে-রে বলল,
” আচ্ছা? আমিই এখন কে? আর আমাকেই এখন প্রয়োজন নেই? ”
কুয়াশা ফুঁসে উঠল। একে তো রেগে ছিল তারউপর মুড সুইং হয়। এখন মারাতেই রাগ উঠল। মনের মতো শিশিরকে মে-রে নিল। মিটিয়ে নিল গায়ের ঝাল। রাগ, অভিমান ঝেরে পেটের উপর হাত দিয়ে বলল,
” দেখেছিস বাবু তোর বাবা আমায় মারছে? শুধু মারে আমায় জানিস? ”
ঝঙ্কার তুলল শিশিরের শরীরে৷ অনুভূতিরা এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে, কি করে প্রকাশ করবে এই অনুভূতি?
” তোর বাবা। ”
শব্দটা বুকের গভীরে গিয়ে তীরের ন্যায় বিঁধল। এক লহমায় আবেগী হয়ে উঠল সে। বাবা হবার আনন্দ আর বাবার স্বত্ত্বা জেগে উঠল। হাঁটু মুড়িয়ে বসে পড়ল তৎক্ষনাৎ। আনন্দে কেন যেন চোখটাও জ্বালা করে উঠল৷ বসে চোখের দৃষ্টি পেটের উপর রাখল। আজ এতদূর পাড়ি দিয়ে বাড়িতে এসে কি জেনেছিল সে বাবা হবে এই খবর শুনবে? আবেগী হাত বাড়িয়ে দিল পেটের দিকে। ছুঁলো সেখানে৷ আহ্! এ কী অনুভূতি!! তার সন্তান, তার অস্তিত্ব এখানে? কুয়াশা মুচকি হাসছে কিন্তু শিশিরকে দেখাতে নারাজ সে৷ কুয়াশার শরীরে ঢিলাঢালা ম্যাক্সি পরিহিত। সেই ম্যাক্সির উপর হাত রেখেছে। যদিও এখনো ম্যাক্সি পরার মতো হয়নি তবুও সপ্তাহ খানেক আগে থেকে পরে। খুবই অস্থির লাগত থ্রিপিচের পাজামায়। পেটে কেমন টান অনুভব হতো। এই জন্য ম্যাক্সি পরার নির্দেশনা দিয়েছেন জাকিয়া।
শিশির হাত বুলিয়ে দিল এরপর পেটের উপর রেখেই কুয়াশার দিকে তাকাল ফ্যালফ্যাল নয়নে। বলল,
” কতদিনের ও? ”
” চার মাস পড়বে সপ্তাহ বাদ।”
চমকে উঠল আবার সে। চার মাস!! শিশির হতভম্ব হয়ে গেল৷ এতদিন পর সে জানতে পারছে? এটা কি করে সম্ভব? এবার কিছুটা রূঢ় হলো। কপট রাগ দেখিয়ে বাহুতে এটা চাপ্পড় বসাল৷ বলল,
” গোবর ঠাসার বাচ্চা! তুই আমাকে আজ জানাচ্ছিস? আমি আজ জানতে পারছি ওর আসার কথা? মনটা তো বলছে! ”
” বাবুর লাগছে তো বার বার মারছ! ”
থেমে আবার বলল,
” বাবু লেগেছে তোর? দেখ তোর বাবা পঁচা৷ তুই নাই-ই আসতে মারছে। কথা বলব না আমরা একটুও হুম? ”
শিশিরের কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে সে বাবুর সাথে আহ্লাদী বাণী ছুড়ল। শিশিরের রাগ পড়ে গেল। কুয়াশার হাত ধরে একদম সামনে নিল। তৎক্ষনাৎ জড়িয়ে ধরল কোমড়। কোমড় জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ছোঁয়াল। একপাশ করে মাথা রাখল কুয়াশার পেটের উপর। বলল,
” স্যরি বাবা, আর মারব না। লেগেছে তোমার? প্রমিস আর মারব না। আমার বাবা তুমি বাবার কাছে জলদি চলে আসো অন্নেক আদর দেব তখন তোমায়। ”
কুয়াশা মিটমিট করে হাসল। শিশির ওভাবেই থেকে বলল,
” কুশুরে.. আমার এত আনন্দ লাগছে কেন? অতিরিক্ত সুখ লাগছে যে..! ”
” তো আবার কি? নাচো তা ধীন ধীন করে। ”
” সত্যিই নাচতে ইচ্ছে করছে। ”
” হ্যাঁ, তা তো করবেই এখন। রাজি তো হচ্ছিলে না৷ এখন আসবা না খবরদার অধিকার দেখাতে! ”
শিশির দুইহাতে কোমড় জড়িয়ে রাখা অবস্থাতেই মাথা তুলে উপরে তাকাল কুয়াশার দিকে। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
” দেখ এখন মারতে পারছি না। আমার বাবাকে প্রমিস করেছি তাই। সো, উল্টা পাল্টা করিস না সব জমিয়ে রেখে এবারে শোধ তুলব। এমনিতেই না জানিয়ে বড় অপরাধ করেছিস। ”
” বার বার যে গোবর ঠাসা বলছ, ও কিন্তু শুনে নেবে।”
কুয়াশার কথায় নজর পেটের উপর দিয়ে আবার তাকাল কুয়াশার পানে বলল,
” সুযোগের সৎ ব্যাবহার করছিস? ”
কুয়াশা খিলখিল করে হাসল। শিশির আবার পেটে মাথা রাখল৷ অনেকক্ষণ কথা বলল না কেউ। শুধু অনুভব করল এই ক্ষণ, এই অনুভূতি। বলার মতো না তা৷ বাবার হবার সুখে শরীর কাঁপছে। কুয়াশা বোধহয় টের পেল৷ এবার একহাত পিঠে রাখল আর এক হাতে শিশিরের মাথায়৷ চুলের মাঝে আঙুল চালিয়ে দিল৷ শিশির বলল,
” এ্যাই বউ! কেন আমায় আরো আগে জানালি না? ”
” ঠিক করেছি। তুমি শুধু আমায় একা ফেলে ফেলে চলে যাও তাই জানায়নি। এখন আমি ডাবল হয়ে গেছি। ওর জন্য আর আমার একা মনে হয় না ”
” সোনা! এই অনুভূতি সত্যি আমি প্রকাশ করতে পারছি না।”
” আমিও পারি নি। তুমি যেদিন এলে ঢাকা থেকে তার দুইদিন আগে টেস্ট করে পজেটিভ পাই। তোমাকে সামনে থেকে বলে নিজের চোখে অনুভূতি দেখব ভেবে জানাতে চেয়েছিলাম তুমি আসলে৷ কিন্তু তুমি আমাকে আগেই রাগিয়ে দিলে৷ আমার মন বিষয়ে দিলে৷ তাই আমিও বলি নি। ”
শিশিরের মনে পড়ল ঢাকা থেকে শেষ আসার পর কুয়াশার অস্বাভাবিক আচরণ। নিজেকে গুটিয়ে রাখা, মুখ ফিরিয়ে থাকা এই ঘরে অধিকাংশ না কাটানো আর অসুস্থও মনে হওয়া। কিন্তু সে তো এটার নোট কখনো করেই নি৷ ভেবেছিল সে ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে বলে এমন করছে। না বললে বুঝবে কি করে? সে কী আগে কখনো বাবা হয়েছে নাকি! ব্যস্ততায় এত কিছু খেয়ালও করেনি। আচ্ছা সেটা না হয় বাদ যে, অভিমান করে জানায়নি কিন্তু বাড়ির লোক? বাড়ির কেউই কি একবারও জানাতে পারে নি? ভেবেই আবার মুখ তুলে বলল,
” বাড়ির কেউ-ই কেন জানাল না আমায়?”
বলেই কুয়াশাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার মুখের কাছে গিয়ে ডাকল,
” আম্মু, আম্মু! ”
বার কয়ে ডাকলে জাকিয়া উত্তর নিতে নিতে বেড়িয়ে এলেন। ছেলে এসেছে তার কখন? ঘুম থেকে মাত্রই উঠে ছেলের কন্ঠ পেলেন তিনি। শিশির এরপর ডাকল,
” ছোট আম্মু, ছোট আম্মু! ”
আজমিরাও বেরিয়ে এলেন। শিশির এমন চেঁচিয়ে ডাক শুনে বৃষ্টি, ইয়াসমিন, শশীও বেরিয়ে এলো। শিশির ডেকে আবার ঘরে এলো। কুয়শাকে হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল। জাকিয়া এসে প্রশ্ন করলেন,
” আব্বু কখন এলি তুই? ”
” একটু আগে৷ ফ্রেশ হয়ে যেতাম দেখা করতে। কিন্তু তোমাদের এই আহ্লাদী তো তা হতে দিল না। এসব কি আম্মু? ”
জাকিয়া বুঝলেন কী বলছে ছেলে। এমনকি সবাই-ই বুঝল। মুচকি হাসলেন তিনি৷ ছেলের প্রশ্নের উত্তরে বললেন,
” আহ্লাদীর আহ্লাদীপনা৷ আমাদের প্রথমে না টের পেতে দিয়েছে আর তা বলেছে। তোর বউ জেদ করে তোকেও বলতে দেয়নি। এমনকি নীহার, তুষারেও জানাতে দেয়নি। আমরাও আহ্লাদীর আহ্লাদটাতে সায় দিয়েছি। ইচ্ছেটা পূরণ করে দিয়েছি।”
” তোমরা কি করে এই বেয়াদবের এত বড় আহ্লাদটা মেনে নিলে? ”
” কি করব? যতই হোক দ্বিতীয় বারের মতো দাদি হতে যাচ্ছি কিনা? তাই আবদারটা রেখেই দিলাম৷ আচ্ছা তা যাক, আমি দাদি হব নাকি নাকি নানি হব এটাই আজ এতদিনে জানতে পারলাম না! আব্বু তুই বলত কি হলে ভালো হয়? ”
সকলে হেসে ফেলল। শিশির ভড়কে গেল। কুয়াশা লজ্জা পেয়ে গেল। শিশির বলে উঠল,
” আম্মু! তুমিও? ”
সকলে আবার হাসল। শশী বলল,
” আমি কিন্তু ফুপু হব ভাইয়া। তোমার বোন আমি। চাচি হব না আমি। ডিল ফাইনাল করেছি বুবুর সাথে। ”
শিশির কি বলবে বুঝল না৷ এখানে নীহারকে এই সময় খুব মিস করল শিশির। এমনই হয়ে আসছে আজ কয়েকটা মাসে৷ ভাইকে সে খুব মিস করে৷ তার ভাই থাকলে নিশ্চিয়ই বলত,
” তোমরা কে কি হবে আমার দেখার বিষয় না, আমি মামা হচ্ছি এটাই কনফার্ম ”
ইশশ কতদিন ভাইটার সাথে আড্ডা, মজা করা হয় না। শিশির দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। আজমিরাকে বলল,
” ছোট আম্মু তুমি কি হতে চাও? তোমারও কি কিছু হওয়া নিয়ে কনফিউশন আছে?”
” একদম নাহ্ আমি তো নানি হচ্ছি! ”
সকলে আবার হাসল। বৃষ্টি, ইয়াসমিন একসাথে বলে উঠল।
বৃষ্টি বলল,
” চিন্তা করো না দেবরজী আমি বড় আম্মুই হব। ”
ইয়াসমিন বলল,
” আমি মেজো আম্মু হব এত ভাবিস না। ”
শিশির কুয়াশার দিকে তাকাল৷ সে হাসছে। শিশিরও হাসল কিঞ্চিৎ। জাকিয়া এগিয়ে এসে ছেলের গালের উপর হাত রেখে বললেন,
” অভিনন্দন আমার ছোট মানিক। এভাবেই সুখী থাক তোরা। আমরা কোনো ভুল কাজ করিনি। তোদের সুখী হওয়া দু’চোখ ভরে সামনে থেকে দেখতে পেরে শান্তি লাগে৷ তোদের পরিবার এইভাবেই পূর্ণ হোক৷ কানায় কানায় সুখ, খুশি ছেঁয়ে আসুক। আমাদের একমাত্র মেয়ে আজ আমার ছেলের কাছে সুখী এর থেকে শান্তির কি হয়? তোর বাবা, চাচু কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি দেখেছিস তো? ওনারা তোর কাছেই আমাদের মেয়ে সুখী হবে বলে মনে করেছিলেন৷ আমার ছেলে যে রত্নখনি! তোর বাবা,চাচু ঠিকই চিনেছিল তোকে। তোরা স্বাভাগত ঝগড়া করতি কিন্তু সুপ্ত শ্রদ্ধা, সম্মানও ঠিক ছিল আর টানও ছিল৷ আমি, আজমিরা কখনো এসব ভাবিই নি কিন্তু তোর বাবা ভেবেছিলেন। মানুষটা কখনো আমাকে সেটা বলেও নি। তোদের বিয়ের পর রোজ চিন্তায় থাকতাম, মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিলাম না তো নিজ হাতে? আমার ছেলে যতই হোক সে আর মেয়েকে সহ্য করতে পারে কিন্তু কুয়াশাকে না সে মানতে পারবে তো? এসব হাজারো চিন্তা হতো৷ কিন্তু বিয়ের মাস খানেক পর থেকে তোদের অনেক পরিবর্তন পেয়ে আনন্দে ভেঙে পড়তাম৷ আজমিরাকে সব সময় অভয় দিতাম বলতাম, দেখিস আমার ছেলেই পারবে। এখন আমার কথা সত্যি হয়েছে৷ আমার ছেলেই পেরেছে। আমি মাথা উঁচু করে বলব, ‘আমার ছেলেই তোর মেয়ের জন্য যোগ্য আজমিরা। আমার ছেলেই তোর মেয়ের সুখের কারণ দেখে নে দু’চোখ ভরে’ ”
আজমিরার চোখ টলমল করে এলো৷ কুয়াশারও চোখ ভিজে এলো৷ শিশির মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল৷ জাকিয়া ছেলের মাথা ঝুঁকিয়ে নিয়ে কপালে চুমু আঁকলেন৷ বললেন,
” আমাদের ছেলেরা এক একটা রত্নখনি। ”
শিশির অমায়িক হাসল। এরপর আজমিরা শিশিরের কাছে এসে মাথা হাত রেখে বললেনন,
” তোর কাছে শুধু একটাই আবদার। আমার মেয়েটাকে নিয়ে চিরজীবন সুখে থাকিস আর ওকে সুখে রাখিস ”
” সর্বদা। ”
তৎক্ষনাৎ উত্তর করল শিশির৷ সকলে মুগ্ধ হলো৷ কুয়াশার চোখ ভরে এলো৷ এরপর আরো কিছু কথা বলে চলে গেল সকলে। শিশির দরজা আটকে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে কাটখোট্টা স্বরে বলল,
” শো চুপচাপ, আমি গোসল করে আসছি।”
বলে চলে গেল বাথরুমে। কুয়াশা ভেঙচি কাটল। শুয়ে পড়ল কম্বলের নিচে৷
কিছুক্ষণের মাঝে শিশির বেরিয়ে এলো। নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করে একটা এ্যাশ কালারের ফুল স্লিভের টিশার্ট পড়ে কুয়াশাকে বলল,
” সরে শো। ”
কুয়াশা বীনা বাক্য সরে গেল৷ সে-ও তৎক্ষনাৎ শুয়ে পড়ল। শুয়ে কুয়াশাকে টেনে নিল৷ কম্বল ভালো করে জড়িয়ে নিল দু’জনের শরীরে। পেটের উপর আলতো করে হাত রাখল৷ কাৎ হয়ে শুয়ে কুয়াশার যেন না লাগে সেভাবে শুয়ে গলায় মুখ গুঁজে দিল। বড় নিঃশ্বাস টেনে নিল। কুয়াশা কিছু বলল না। কিন্তু একটু চেপে গেল৷ টের পেয়ে মুখ গুঁজে রেখেই বলল,
” লেগে যাবে তো পেটে।”
” লাগবে না। ”
বলে শিশিরের গালে চুমু দিল ওমনই। ফিসফিস করে বলল,
” কংগ্রাচুলেশনস অ্যাডভোকেট শিশির মালিথা আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।”
শিশির মুখ তুলল তৎক্ষনাৎ। তাকাল কুয়াশার পানে। চোখ লাল তার। আবেগে ভেসে যাচ্ছে সে বোঝায় যাচ্ছে। প্রথম বাবা, মা হবার আনন্দ তারা টের পাচ্ছে৷ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কুয়াশার কপালে চুমু দিল, চোখের পাতায় দিল, দুই গালে দিল, নাকে দিল এরপর ঠোঁটে একটা গাঢ় চুমু খেয়ে বলল,
” থ্যাঙ্গ ইউ সো মাচ উডবি অ্যাডভোকেট কুয়াশা মালিথা। আমরা ডাবল থেকে ট্রিপল হতে চলেছি৷ আপনি মা আর আমি বাবা।”
” উহু মিস্টেক হলো একটু তুমি বুনো ওল বাবা! ”
” আর তুই বাঘা তেঁতুল মা?”
খিলখিল করে হাসল কুয়াশা৷ বলল,
” হ্যাঁ। ”
শিশির কুয়াশার পেটে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কুয়াশার বুকের উপর একটা চুমু দিল। কুয়াশা বলল,
” অনুভূতি বলো!”
” এর পরেও জানতে চাচ্ছিস অনুভূতি? ”
কুয়াশা তা শুনে শিশিরে বুকে চুমু দিয়ে বলল,
” আমরা-ই কি সেই? যারা আজ সব কিছু ফেলে এসে মা, বাবা হতে চলেছি? ”
” হ্যাঁ, আমরা-ই সেই।”
কুয়াশা আবার হাসল। জড়িয়ে ধরল শিশিরকে বুকে মুখ গুঁজল। শিশিরেও মুচকি হেসে কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
” সেই কাপড়ের টুকরোর মাঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখা আমার আহ্লাদী বউ আজ নিজেই মা হতে যাচ্ছে, ভাবা যায়!! ”
তা শুনে কুয়াশা বুকে মুখ গুঁজে রাখা অবস্থাতেই শিশিরের পেট গলিয়ে পিঠে রাখা হাতটা উঠিয়ে কিল বসিয়ে দিল পিঠের উপর। বলল,
” ধেৎ! ”
শিশির হাসল ঠোঁট কামড়ে। মাথায় চুমু দিয়ে আগলে নিল তার বউকে।
এরাই সেই চুলোচুলি করা দম্পতি যারা আজ দাম্পত্য জীবনে এতটা দূর এগিয়ে এসেছে। তারা ঝগড়া, চুলোচুলি কিন্তু এখনো কমায়নি! আজকে খুশির খবর পেয়েও তারা আগে ঝগড়া করে নিল এরপর মারা মারিও করে নিল৷ সে-সব বজায়ই রেখেছে এবং সেটা বজায় রেখেই তারা আজ দুই থেকে তিন হতে যাচ্ছে। তারা একে অপরের স্বত্ত্বাকে নিজের মাঝে ধরে রেখে বাবা, মা হতে যাচ্ছে। সময় কথা বলে। সময়ের সাথে সাথে কতকিছু মেনে নিয়ে মানিয়ে চলে পরিবর্তন হলো তাদের!
সেই দুটোর বিয়ে হলো, একে অপরকে নতুন রূপে চেনা ধরল, প্রেমে পড়ল, ভালোবাসা বাসি হলো, কাছে আসাআসি হলো অতঃপর তারা সংসার করতে লাগল এবং সেই সংসার আলো করে আজ পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। তাদের মিলন ঘটিয়ে আজ চমৎকার এক প্রাণের জন্ম হতে যাচ্ছে। যেটা সেই ভালোবাসার প্রতীক, সুখ, শান্তি।
সাত মাস আগে নীহারের বউভাতের অনুষ্ঠানের দিন, সেই রাতে কুয়াশার ওমন অস্বাভাবিক আচরণ করার কারণ ছিল। যেটা সে শিশিরের থেকে লুকাতে চেয়েছিল। সে জানত তার স্বামী কেউ কোনো কটু কথা বললে আগে প্রতিবাদ করবে। সে বউ হোক আর পরিবার হোক৷ বাড়িতে কোনো ঝামেলা চায়ছিল না বলে কুয়াশা শিশিরের থেকে কথাটা লুকিয়েছিল। কিন্তু খুব বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারেনি৷
সেদিন বসার ঘরে সকলে রেস্ট করার পর জাকির মালিথারা অর্থাৎ পুরুষরা সকলে উঠে গেলে থাকে শুধু মেয়েরা। গল্প গুজবের মাঝে আম্বিয়ার বোন জিজ্ঞেসা করেন কুয়াশাকে,
” এত বছর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তোমরা বাচ্চা নিচ্ছ না কেন? ”
কুয়াশা চমকে উঠে। বাড়ির সকলের বিব্রত হয় সাথে কুয়াশাও লজ্জা সহ বিব্রততে পড়ে৷ কিন্তু গুরুজন হয়ে এমন প্রশ্ন করেছে বলে কিছু বলতে পারে না তার উপর আত্নীয়। আম্বিয়া বোনের কথায় চোখ রাঙিয়ে উত্তর দেন,
” আশা..! এসব কি কথা? ওরা এতদিন লেখাপড়া করছিল জানিস না? শিশির পড়াশুনোর জন্য বাহিরে ছিল৷ ”
এই কথাতে তিনি বোধহয় একটু নত হয়েছিলেন কিন্তু তবুও আরো কিছু কথা বলেছিলেন। যেমন;- জলদি বাচ্চা নিতে, দেরি হলে সমস্যা হয় এমন আরো কিছু কথা৷ এবং সেই কথার সাথে তিনি নিজের মেয়ের তুলনা করেন৷ অনি নাকি বছর নাই-ই গড়াতে বাচ্চা নিয়েছে এমনটাও বলেন৷ আর তিনিই নাকি নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে জলদি বাচ্চা নিতে। বাচ্চা নাকি একটা সম্পর্কের ভিত। কুয়াশা রাগ তো হয়েছিল কিন্তু প্রচুর আঘাত লেগেছিল কথাগুলোই৷ একটা মেয়েকে এমন মুখের উপর বললে কতটা কষ্ট, আঘাত লাগতে পারে? আর রাগ হয়েছিল উনার মেয়ের সাথে তুলনা করাতে। মেয়েরা আর যায় হোক অন্যকারো সাথে নিজেদের তুলনা কখনো মানতে পারেনা৷ কুয়াশা কেন যেন সেদিন কোনো উত্তর করতে পারেনি। জড়তাতেই পারেনি নাকি সে চায়নি সেটা বোঝা যায়নি। তবে প্রতিবাদ আম্বিয়া করেন৷ বোনকে তিনি অনেক ধমক দেন। আম্বিয়া শহরের মেয়ে শহরের বউ। আর আশা শহরের মেয়ে হলেও বিয়ে গ্রামে হওয়াতে ট্রিপিক্যাল সব চিন্তা ভাবনা উনার মাঝে আছে৷ গ্রাম জিনিসটাই এমন।
তখনি সে ওখান থেকে উঠে আসে৷ তার সহ্য হচ্ছিল না৷ খারাপ লাগার সাথে কষ্ট হচ্ছিল এবং কিছু কথা বুকে বিঁধছিল। সত্যি কি একটা সন্তান একটা সম্পর্কের ভিত? ভালোবাসা, মায়া, অধিকার এসব কিছুই না? শিশিরকে সে খুব ভালোবাসে, খুব। কখনো তাকে সে হারাতে পারবে না। অন্যকারো সাথে দেখা কেন? কারো সাথে পাশেই সে মানতে পারবে না। তার একমাত্র প্রিয় স্বামী সে। সন্তানই যদি সম্পর্কের ভিত হয় তো তাই হোক! তার সন্তানই লাগবে। তবুও সে শিশিরকে হারাবে না। ভেবে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে৷ নিজে শক্ত এবং স্বাভাবিক করে ঘরে ঢোকে। তার কষ্ট নেভাতে একমাত্র তার স্বামীকে প্রয়োজন ছিল ঐ সময়ে৷ তাই এসে আহ্লাদী আহ্লাদ করতে লেগেছিল শিশিরের কাছে।
সেদিন শিশিরকে কিছু না বলে পরেরদিন রাতে সকলে চলে গেলে সে শিশিরকে জানায় তার বেবি চায়। শিশির অতি স্বাভাবিকভাবে জানায় এলএলবিটা যেন কমপ্লিট করে নেয়৷ নয়তো চাপ পড়বে প্রচুর৷ শিশির চায়নি কুয়াশা চাপ নিক। কিন্তু কুয়াশা এতটাই অস্থির হয়ে জেদ ধরে যে শিশির রীতিমতো বিস্মিত হয়৷ হঠাৎ বেবি নেবার প্রতি এতটা টান কেন হলো? সে তো লেখাপড়া করবে এখন তাহলে? সেদিন রাতেও কোনো কথা বের করতে পারে না শিশির বউয়ের মুখ থেকে৷
কিন্তু যতদিন যাচ্ছিল কুয়াশার জেদ বাড়তে লাগে। অতিরিক্ত ভাবে অধৈর্য হয়ে উঠে যেটা শিশিরকে রাগিয়ে তুলত। ধমকে, বকেও কিছু হচ্ছিল না। শিশিরের এক কথা এলএলবি কমপ্লিট করেই বেবির চিন্তা করবে৷ কুয়াশা কেঁদে কেটে অস্থির। রাগে শিশির চড়ও বসায় ওমন বেহায়া আচরণে। অবুঝপনা তার একটুও সহ্য হয়নি৷ মে-রে অনেক ধমকিধামকি দেয়। কুয়াশা তখন না পেরে শিশিরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে ওঠে৷ কাঁদতে কাঁদতে বলে,
” আমি তোমাকে কারো সাথে দেখতে পারব না৷ হারাতে পারব না তোমায়। ভালোবাসি খুব তোমায়। একটা সম্পর্কের ভিত নাকি সন্তান হয়! যদি তাই-ই হয় তো আমার সন্তানই লাগবে। তবুও তোমাকে হারাব না। প্লিজ মেনে নাও! ”
শিশির বিস্মিত হয়ে হতবাক, হতবুদ্ধি হয়ে যায় তা শুনে৷ তার এত এত ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই এই মেয়ের কাছে? যে সম্পর্ক টিকাতে সন্তান লাগবে তার!! জাস্ট এমন কথা আসে মাথায়৷
কুয়াশার সব কথা রেখে তার কাটকাট, ভারী প্রশ্ন হয়,
” এসব কে বলেছে তোকে? ”
” কেউ না। তুমি মেনে নাও প্লিজ! ”
” আমি জানতে চেয়েছি কে বলেছে তোকে এসব? ”
কুয়াশা বলতে চায় না। কিন্তু কুয়াশা বলতে না চায়লেই কি শিশির মেনে নিয়ে আপস করা পাত্র? উহু সে শুনেই ছাড়ে৷ কুয়াশা না পেরে বলে,
” আগে বলো কোনো হাঙ্গামা করবা না? ”
” তোর কাছে এত কথা জানতে চেয়েছি আমি নাকি জ্ঞানই চেয়েছি? ”
কুয়াশা স্বামীর অতি কঠোরতা টের পায়৷ কথা এতটায় রূঢ় ছিল যে কুয়াশা কেঁপে উঠতে লাগে। অতিরিক্ত ভারী লাগে কথাগুলো৷ কুয়াশা নত হয়ে নিভানো, নির্জিব কন্ঠে উত্তর দেয়,
” আশা আন্টি বলেছে। ”
চোয়াল সঙ্গে সঙ্গে শক্ত এবং কঠিন হয়ে আসে। সে বুঝেছিল ঐ মহিলা এই সামান্য কথা বলেনি আরো কিছুই বলেছিল যেটাতে কুয়াশার গায়ে লেগেছিল নয়তো এই মেয়ে লোকের কথা কানে তোলার মেয়ে না। উচিত জবাব দিয়ে আসত এবং লোকের কথায় গা ভাসাত না।
বউ তাকে এতটা ভালোবাসে ভেবেও শান্তি পায়। সংসার ভাঙবে না, তাকে হারাবে না ভেবে লোকের কথায় গা ভাসিয়ে সন্তান নিতেও মরিয়া সে? ভেবেই নিজের রাগ ফেলে সেদিন তার আহ্লাদী বউকে আগলে ধরে বুকের সাথে৷ মেয়েটা তার একমাত্র আহ্লাদী বউ। তাকে ছাড়া সে আর কারো চিন্তা করতেই পারবে না। সন্তান যদি আজীবনেও না হয় তবুও এই মেয়েকে সে ফেলতে পারবে না। ডায়লগটা টিভি সিরিয়ালের মতো লাগল কী? হয়তো লাগল৷ কিন্তু তাদের ভালোবাসা এতটাই স্ট্রোং হয়েছে যে এমন কথাই মাথায় আসে৷ তাদের শত্রুতার মতোই ভালোবাসাও স্ট্রোং। সে-দিন কুয়াশাকে অনেক আদর দিয়ে সবটা বুঝায়। আর বউয়ের ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেয়। পূরণ করতে রাজি হয়৷ যদিও কুয়াশার কথার মানে তার কাছে কোনো মূল্য ছিল না৷
নীহারের ছুটি শেষ হলে সে চলে যায় তার কর্মস্থলে। সেই নিয়ে মন খারাপ করে সকলেই। ছেলেটা বাড়ি মাতিয়ে রাখে।
শিশির নীহারের প্রতি অনেক আকৃষ্ট৷ ভাই তার চলে যাওয়াতে মন খারাপ করে। ভাইকে খুব মিস করবে৷ ঢাকায় থাকতেও খুব মিস করত৷ ছোট থেকে ভাইটা তার সঙ্গী।
আম্বিয়া ছোট ছেলেটাকে দূরে দিয়ে ভালো থাকেন না৷ চলে যাবার দিন একটু চোখের পানি ফেলেন যদিও তিনি একটি শক্ত মনের তবুও মায়ের মন কিনা!!
কুয়াশা আরো একটা প্রিয় ভাইকে দূরে রেখে থাকতে পারেনা৷ বড় ভাইয়ের পর নীহারই তাকে বেশি আদর, ভালোবাসা দেয়৷ তুহিনও দেয় কিন্তু তুহিন আগে থেকেই সব সময় শান্তশিষ্ঠ এই জন্য সে ভালোবাসা কারো প্রতি বেশি প্রকাশ করে না প্রয়োজন ছাড়া৷ কুয়াশা নীহারের সাথে ফ্রিলি কথা বলতে পারে। সেই ভাইটা চলে যাবার দিন কান্না করে অনেক।
বাড়ির প্রতিটা সদস্য নীহারকে মিস করে। দূরে গেলে বাড়িটা শূণ্যতার পড়ে থাকে৷ বিশেষ করে আড্ডার সময়ে খুব মিস করে সকলে৷ সে সূদূরে গিয়ে সময় পেলে মাঝে মাঝে ফোন দেয়৷ কয়েক সপ্তাহ বাদে ভিডিয়ো কল দিয়ে পরিবারের সাথে আলাপচারিতা করে৷ কিন্তু শশীর সাথে পার্সোনালি কথা খুব কম বলে৷ শশীকে যাওয়ারদিন সবটাই বলে গেছিল৷ মেয়েটা শক্ত করার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছিল।
যে কদিন নীহার ছিল শশী তো রোজ এসব নিয়ে নীহারের কাছে কাঁদত। বিশেষ করে তাদের দাম্পত্যর বিশেষ সময়টাতে ফুঁপিয়ে কাঁদত৷ নীহার কখনো ধমকে বোঝাত তো কখনো আদরে বোঝাত৷ মেয়েটা নিজেকে শক্ত করার খুবই চেষ্টা করত৷ নীহারের তা দেখে খারাপই লাগত৷ দীর্ঘ শ্বাসের সাথে বিষাদ উড়াত৷ মস্তিষ্ক শুধু একটা কথা বাড়ি দিত, থাকবে কি করে সে তার বউপাখিটাকে ছাড়া!!
নীহার চলে যাবার মাস খানেক পর রিজভী আর স্মৃতির বিয়ে উঠানো হয় বড় করে৷ ঢাকা থেকে আসার পর লেট করার কারণ রিজভীর একটা বোন ছিল না৷ সে আসলে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়৷ মালিথা ভিলার সকলকেই দাওয়াত করেছিল রিজভীরা৷ সকলেই তা হাসি মুখে ইনজয় করে আসে৷
রিজভীর বিয়ে উঠানো দেখে জাকির মালিথা শিশিরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তারা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পূরণ করতে চায় কিনা! শিশির সহ কুয়াশা মানা করে দেয়। এ নিয়ে বাড়িতে কেউ কথা বাড়ায়নি আর৷
নীহার যাবার পর তিন মাসের মাথায় শিশিরের একটা কেস আসে। আর সেটা ঢাকায় গিয়ে হ্যান্ডেল করতে হবে৷ কারণ কেসটা ওর একটা ঢাকার বন্ধু ওর কাছে হস্তান্তর করে৷ বন্ধুটা তার ঢাকায় গিয়ে হয়৷ পড়াশুনোর জন্য ঢাকায় থাকাকালীন ওর আর রিজভীর তিনটা ভালো বন্ধু হয়। বেশ ভালোই বন্ধুত্ব হয়৷ বন্ধুটা কেস পেয়েছিল কিন্তু কোনো কারনে সে কেসটা না নিয়ে শিশিরকে দেয়। অবশ্য শিশিরের বুদ্ধি, বিচক্ষণতা সম্পর্কে তারা সকলেই জানত এবং ভরসা করে শিশিরই পারবে। তো সেই কেস শিশির নেয়। যেতে হয় তার কাজের জন্য ঢাকায়। ঢাকায় ওঁ প্রথমে গেছিল কেসটার জন্য। আদালত যেদিন থাকত সেদিন ডাকায় যেত কিন্তু এমন ওর সমস্যা হতে দেখে বন্ধুটা ওকে নিজের বাসায় থাকার অফার করে। সে অবিবাহিতই ছিল। পরিবার সহ তাদের বাড়ি ওটা নিজস্ব। ধনী লোকই তারা৷ রাজিও হয় এবং সেখানে কেস হ্যান্ডেল করতে করতেই আবার সে কেস পায়। সেটা সরকার থেকে দেয়া হয়। দুইটা কেস একসাথে সল্ভ করতে গিয়ে তার বাড়ি আসা খুব কমই হচ্ছিল। দুই বার আসে আর ঢাকায় সে দুই মাসের বেশি সময় থেকে কেস দুইটা সল্ভ করে৷ ছোট ছোট কেস খুব বেশি সময় লাগে না৷
কেস সল্ভ করার পর সেই বন্ধু অফার করে শীতে তারা ট্যুর দেবে একটা৷ ঐ বন্ধুর কয়েকটা বন্ধু এবং শিশির সহ রিজভী আর কুষ্টিয়ারই আরো একটা বন্ধু। মোট আটজনের ট্যুর ছিল। আর প্ল্যানটা করে ইন্ডিয়ায় যাবে তারা। শিশির, রিজভী প্রথমে রাজি হয়না। বউদের কথা ভেবে। কারণ ঐ ব্যাচেলর বন্ধুদের মাঝে শুধু ওরা দুইজনই বিবাহিত ছিল আর গুলোর বউয়ের চিন্তা না থাকলেও ওদের ছিল৷ কিন্তু ওরা এতটায় চেপে ধরে যে শিশির, রিজভী ভাবতে বাধ্য হয়। কেস ট্রান্সফার করা বন্ধুটা শিশির, রিজভীকে ট্রিট হিসেবে ট্যুরের যাবার খরচ দিতে চায় এবং জোরও করে নিতে। কিন্তু শিশিররা রাজি হয়না৷ তবে ট্যুরে যাবার জন্য রাজি হয় আর সেখানে গিয়ে একদিনের খাবার ট্রিট নিতে রাজি হয়৷ বন্ধুটাও মানে৷
সেদিন রাজি হয়েও শিশির, রিজভী চিন্তায় পড়ে বউরা তাদের ছাড়া পাগলী হয়ে ঘুরে বেড়ায় বন্ধুদের সাথে কি ভ্রমনে যেতে দেবে? না দিলেও কিছু করার নেই। সব খানে তো আর বউয়ের চিন্তা করতে গেলে চলে না! কিছু সময় স্পেসয়ের প্রয়োজন পড়ে। কখনো পড়াশুনোর মাঝে দেশের বাহিরের কোথাও যাবার সুযোগ পায়নি। এখন বিয়ে না হলে পড়াশুনো শেষে ব্যাচেলর লাইফটা ইনজয় করতে পারত। কিন্তু বউ হয়েছে বলে কি বাঁধা হয়ে থাকতে হবে? যদিও বউ ছাড়া কষ্ট তাদেরও হয় তবে কিছু সপ্তাহের জন্য তো আর খুব বেশি সমস্যা হবে না? ম্যানেজ করে নেবে শুধু বউদের মানাতে হবে। প্রয়োজনে দেশে এসে দেশের কোথাও বউকে নিয়ে ঘুরতে যাবে৷ ওটা ছিল বন্ধুদের ট্যুর নয়তো বউ নিয়ে যাবার প্ল্যান করা যেত। ব্যাচেলরদের ভেতরে তো আর বউ চলে না!!
এদিকে শিশিরের ঢাকায় কেস হ্যান্ডেল করে যেদিন একবারে ফিরবে তার দুইদিন আগে কুয়াশা জানতে পারে সে অন্তস্বত্বা। তার শারীরিক পরিবর্তন সে বুঝতে পারে না। পিরিয়ড মিস বেশি দিন হয় না। কিন্তু খাবার প্রতি অরুচি, মাথা ঘুরানো, আর দিনে রাতে দুই-তিনবার বমি এই নিয়ে সে টেস্ট করে। যদিও ভয়ে ছিল কারণ তার আগে প্রেগন্যান্সির আশায় টেস্ট করে ফলাফল নেগেটিভ পায়। যেটাতে কান্না করে অনেক। মনে ওর একটা বিশাল ভয় ঢুকে যায়৷ আম্বিয়ার বোনের কথা শুধু মাথায় বাড়ি দিত। শিশিরকে বললে শিশির ধমক দেয় অবান্তর সব কথা বলাতে। মানে মেয়েটা ঐ কয়মাসে এতটায় পাগলামী করে যে শিশির রীতিমতো বিরক্ত আর সামলাতেও হিমশিম খায়৷ শুধু অবান্তর, অবাস্তব কথা বলে রাগিয়ে তুলত শিশিরকে৷ কুয়াশা বকা শুনে চুপ তো করত কিন্তু নিজেকে শান্ত করতে পারত না৷ আল্লাহর কাছে শুধু দোয়া করত।
এরপর যখন জানতে পারল সে মা হবে আর মেডিক্যাল টেস্টেও যখন জানল ভ্রুনের বয়স প্রায় সাত সপ্তাহ তখন আনন্দে স্মৃতিকে জড়িয়ে ধরে হসপিটালেই কান্না করে৷ একমাত্র স্মৃতিই সর্বপ্রথম জেনেছিল৷ এরপর শিশিরকে জানাবে ভাবে। কিন্তু শিশির দুইদিন পর ফিরবে তাকে জানায়। এরজন্য সে উত্তেজনা নিজের মাঝে আঁটকে রাখে তার বুনো ওল স্বামীটার খুশি সে সামনে থেকে দেখার চিন্তা করে৷
বাড়ির কেউ সেটা ধরতে পারে না যদিও অসুস্থ মনে হতো কিন্তু প্রশ্ন করতেই বলত না। অন্য অযুহাত দেখাত৷ ঘরেই সবসময় থাকত পড়াশুনোর অযুহাতে পরীক্ষাও চলছিল তাই কেউ ঘাতট না৷ এভাবেই বাড়ির সবার থেকে লুকিয়ে যেদিন শিশির এলো দুপুরের দিকে এবং সে এসেই কুয়াশাকে কাছে ডেকে ইন্ডিয়ায় ট্যুরে যাবার কথা জানায় যেটাতে কুয়াশার প্রচুর রাগ ওঠে। রাগের সাথে অভিমান জন্মায়। তার উত্তেজনায় ভাটা পড়ে যায় শিশিরের ঘুরতে যাবার কথায়। কোনো কথা বলে না আর মানাও করে না৷ বলতে গেল কোনো প্রকার রা করে না৷ শিশির বুঝেছিল অভিমান কিন্তু বেশি কিছু বলেনি। এরপর শিশিরের থেকে দূরে দূরে ছিল, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলত না৷
শিশিররা ঢাকা থেকে আসার তিন সপ্তাহ পর ইন্ডিয়ায় ট্যুরের জন্য রওনা হয়। কারণ ভিসা নিতে দুই সপ্তাহ মতো লেগেছিল। পাসপোর্ট তার, রিজভীর এমনকি সবারই করা ছিল৷ তাই পার্সপোটের ঝামেলায় কারোরই যেতে হয়নি। দুই মাসের ভিসায় তারা ট্যুর দিতে যায়। ইন্ডিয়ার দার্জিলিং, কাশ্মীর, আগ্রার তাজমহল, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম, কেরালা, গোয়া ইত্যাদি দার্শনিক জায়গাতে ঘুরে এসেছে এক মাসের বেশি সময় নিয়ে। বলে গেছিল সপ্তাহ তিনেকের মাঝেই চলে আসবে।
শিশির ইন্ডিয়ায় গেলে বাড়িতে কুয়াশা জানায় তার প্রেগন্যান্সির কথা। জাকিয়ারা, বৃষ্টিরা শুনে প্রথমে কুয়াশার দিকে ভূত দেখার মতো করে তাকিয়ে থাকে। যেন কুয়াশা কোনো এলিয়েন আর সে মঙ্গলগ্রহে ফিরে যাবার কথা জানিয়েছে। সকলের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে লজ্জা তো পেয়েছিলই সাথে বিরক্তও হয়েছিল৷ আরে ভাই সে কি এমন কথা বলেছে যে এমন এক্সপ্রেশন দেওয়া লাগবে? মা-ই তো হবে আর তো কিছু না! ঠিক এমন একটা কথা আসে মন, মস্তিষ্কে৷
সকলে একসাথে বলে উঠে,
” কিহ্…! ”
কুয়াশা ভড়কে গিয়ে মনে মনে আবার রিপিট করে নিজের বলা কথাটা। সে ঠিকঠাক ভাবে বলেই নিউজ দিয়েছে তোহ্! পরক্ষনেই জাকিয়া বলে উঠেন,
” আমি আবার দাদি হব? ”
এরপর আজমিরা বলেন,
” আমি নানি হব? ”
শশী বলে,
” আমি ফুপু হব? ”
একে একে আম্বিয়া, বৃষ্টি, ইয়াসমিনও বলে ওঠে। নিউজ টা পেয়ে ওরা সব জাকির মালিথা, তুহিন, হিমের কাছে পৌঁছে দেয়৷ কিন্তু কুয়াশা জেদ ধরে বলে শিশিরকে যেন না জানানো হয়৷ একপ্রকার জেদ ধরে। সকলে কারণ জানতে সে কারণ বলে। জাকিয়ারা ছেলে, মেয়ের ওমন বাচ্চামিতে হাসবে নাকি কাঁদবে সেটাই ভুলে যান৷ তবে আহ্লাদীর আহ্লাদকে একটু প্রশ্রয়ও দেন৷
সেদিন আনন্দের ফোয়ারা আবার ঝরে মালিথা ভিলায়। খুশিরা কানায় কানায় পূর্ণ হয়৷ জাকির মালিথা আবার দাদু হবার আনন্দে মিষ্টি বিলান। এতিমদের জন্য টাকা দেন। তাদের সিদ্ধান্ত কোনো ভুল হয়নি। ছেলে মেয়েরা সব বাঁধা পেরিয়ে সংসার জীবনে এগিয়েছে। ঝগড়া, হিংসাকে তারা প্রাধান্য না দিয়ে ছেলে, মেয়েদের ভবিষ্যত গুছিয়ে দিয়েছিলেন৷ মৃত ভাইয়ের মেয়েটা নিজের ছেলের কাছে সুখী আছে ভেবে শান্তিতে হৃদয় ঠান্ডা করেছিলেন।
জাকিয়ারা দু’হাত ভরে দোয়া করেছেন। আজমিরা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙেছিলেন৷ তার সেদিনের মেয়ে জীবনের পথে কতটা এগিয়ে গেছে সেটা ভেবে আনন্দের অশ্রু ফেলে। বাবা ম-রা মেয়েটার এতটা সুখের জায়গা দেখে সব সময় দোয়ায় রাখেন যেন কোনো বদ নজর না লাগে। প্রথমবারের মতো নানি হবার আনন্দ পান তিনি৷ সেদিন স্বামীর কথা মনে হয়। অনেক কাঁদেন। সুখের দিনে মানুষটাকে পাশে পাবার বাসনা জেগেছিল।
ঘুম থেকে কুয়াশা বারোটার দিকে উঠে গোসল সেরে নেয়। শিশির তখনও ঘুমে ছিল৷ নামাজ সহ দুপুরে খাবার খেতে কুয়াশাকে ডাকে দেড়টার পর। শিশির উঠলে একসাথে দুইজন নামাজ আদায় করে নেয়। হাত তুলে দোয়া করে আল্লাহর কাছে তাদের জীবনের আরো একটা নতুন সূচনার জন্য। সবকিছু যেন ভালো হয় সেই দোয়া করে৷
নামাজ শেষ করে দু’টোর দিকে খেতে নামে। সকলে একসাথে খেতে বসে। শিশির খাবার টেবিলে জানায় সে কিছু গরীব ফকির এবং এতিম বাচ্চাদের খাওয়াতে চায়। মিষ্টি বিলানোর কথা বললে জাকিয়া জানান সেদিন দেয়া হয়েছে। শিশির শুনে বলে,
” তবে আত্নীয়দের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ো আগামীকাল এনে দেব। ”
জাকিয়া কিছু বললেন না। বাবা হবার আনন্দ সে-ও না হয় ছড়াক!! জাকির মালিথা বললেন,
” ফকির, এতিমদের কবে খাওয়াবে? ”
” পাঁচদিন পর তো শুক্রবার! শুক্রবারেই খাওয়াই? ”
” আচ্ছা আয়োজন করো। ”
” আচ্ছা বাবা। ”
বাবার কথায় উত্তর দিয়ে খাওয়ায় মন দিল সে। এদিকে কুয়াশার লজ্জায় জীবন যায় যায় অবস্থা। ব্লাশিং করছে সে। বৃষ্টিরা মিটমিট করে হাসছে। পাশে থেকে শশী ফিসফিস করে বলে ওঠে,
” বুবু, তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ? ”
চোখ পাকিয়ে তাকায় কুয়াশা শশীর পানে। শব্দহীন দাঁত কেলিয়ে শশী খাওয়ায় মন দেয়। শিশিরের সামনাসামনি বসা কুয়াশা। তাকালে শিশিরও তাকাল। শিশির খাবার মুখে নিতে নিতে ইশারা করল অর্থাৎ,
” কি? ”
কুয়াশা মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে খাওয়ায় মন দেয়৷
দুপুরের খাবার শেষ করে বসার ঘরে শিশির, কুয়াশা, শশী, বৃষ্টি, ইয়াসমিন সহ জাকিয়া, আজমিরা বসল। বর্ষণ ঘুমাচ্ছে। শিশির জানতে চায়লে বৃষ্টি জানাল। শশী শিশিরের লেপটপ এনে ইন্ডিয়াতে ঘুরার সব ছবি দেখছে আর জিজ্ঞেসা করছে কোনটা কোন জায়গা। উপস্থিত সকলে শিশিরের মুখে সব গল্প শুনছে তারাও পিক দেখছে লেপটপে।
কিছুক্ষণের মাঝে তুষার কল দিল। রোজ তিন বেলা করেই কল দেয় বৃষ্টিকে। ছেলের, বৃষ্টি খোঁজ সহ বাড়ির খোঁজ নেয়৷ এছাড়া ভিডিয়ো কলে সবার সাথে প্রায় দিনই কথা বলে। তুষার ফোন দিলে আজ তুষারকে শিশির, কুয়াশার মা-বাবা হবার কথাটা জানাল বৃষ্টি। বৃষ্টি শিশিরের কাছে দিতে বলে তার সাথে কথা বলল। শিশির বলল,
” হ্যাঁ ভাই আমিও বাবা হব। ”
শুনে মিটমিটিয়ে হাসল সব। কুয়াশার কেন যেন আজ লজ্জারা বার বার ঘিরে ধরছে যেটা এতদিনেও হয়নি। এই অসভ্য বুনো ওলটার জন্য এমন লজ্জাময় ফিলিংস আসছে! এতদিন তো আসেনি? শিশির ভাইয়ের সাথে কথা বলে রাখল ফোন। ফোন রাখতেই বৃষ্টিরা জোরে জোরে হেসে দিল। তা দেখে শিশির, কুয়াশা আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল শুধু। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকল শিশির। আজব এমন হাসির কি হলো! অদ্ভুত!! আজব এক পাগলের কারখানা তার বাড়িটা!
(একটা গান আছে নাহ্? “বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা”
শিশিরের কথাগুলোতে গানটা মনে পড়ল আরকি)
এদিকে বর্ষণ উঠে চেঁচাতে লেগেছে। শশী গিয়ে নিয়ে এলো। এসে সে শিশিরকে দেখে এক লাফে কোলে উঠতে উঠতে বলতে লাগল,
” তাচু তাচু! তুমিইই…! কথন এতেছ? ”
বলতে বলতে লাফ দিয়ে উঠেছে। শিশির হেসে কোলে বসাল৷ চুমু দিল নরম গাল জোড়ায়। বর্ষণও গলা জড়িয়ে ধরে চুমু দিল শিশিরের দুই গালে। শিশির হাসল। বলল,
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৭১+৭২
” অনেকখন আগে আব্বু। তুমি ঘুমে ছিলে, তাই ডাকি নি।”
” আমাল থেলনা তই? ”
” এনেছি বাবা ঘরে আছে। অনেক খাবার জিনিসও এনেছি তোমার জন্য। চলো তোমায় বের করে দিই। ”
বলে বর্ষণকে কোলে নিয়ে সে উপরে চলে গেল৷ শশীরা গল্প করতে লাগল।
