ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৮
তাজরীন ফাতিহা
ঘড়ির কাটা রাত এগারোটার এপাশ ওপাশ। ইনাবা নকল মারওয়ানের সঙ্গে হম্বিতম্বি করে তাকে আইসক্রিম আনাতে বাধ্য করেছে। তার নাকি আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে। যদি আইসক্রিম না খাওয়ানো হয় তাহলে খুনাখুনি করে ফেলবে। নকল মারওয়ান নিজের মেজাজ যথেষ্ট সংবরণ করে বডিগার্ডকে আইসক্রিম আনার তাগিদ দিয়েছে। কথার খেলাফ হলে বস রেগে যাবে সেজন্য নিজের পুঞ্জীভূত ক্রোধ দমিয়ে রেখেছে। বডিগার্ডকে আইসক্রিম আমার নির্দেশ দিয়ে রুম অন্ধকার করে রকিং চেয়ারে দুলছে। বডিগার্ড ভ্যানিলা, চকোবার, কফি অ্যান্ড কোণ সব পদের আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। তবে ইনাবাকে শুধু কোণ আইসক্রিম দিয়ে বডিগার্ড দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেছে। ইনাবা কোণ আইসক্রিম ছিঁড়ে নাহওয়ানের হাতে দিল। নাহওয়ান গোল গোল চোখে চেয়ে আছে। জিনিসটা কি তার মাথায় ঢুকছে না। নাহওয়ানকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে বলল,
“আইসক্রিম খাবে?”
নাহওয়ান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। চোখের সামনে নতুন জিনিসটি দেখে তার আকর্ষণ ও কৌতূহল কাজ করছে। বাবা, মা কোনোদিন এই জিনিস তাকে খাওয়ায়নি। ইনাবা ওর হাতে দিয়ে নিজেরটা ছিঁড়ে খেতে শুরু করল। কোণ আইসক্রিম তার বরাবরই পছন্দের। নাহওয়ান ইনাবাকে খেতে দেখে নিজেও গুলুমুলু দুই হাত দিয়ে ধরে খাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু খেতে গিয়ে পুরো মুখ ভরিয়ে ফেলল। বাচ্চাটা খেতে না পারায় ‘বাবা বাবা’ করে ডেকে উঠল। ইনাবা নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে নাহওয়ানকে খাওয়াতে চাইলে বাচ্চাটা মুখ ঘুরিয়ে নিল। অর্থাৎ বাবার হাত ছাড়া কারো হাতেই বর্তমানে সে খাবে না। ইনাবা কয়েকবার চেষ্টা করেও পারল না। তারপর পরাজিত ভঙ্গিতে বডিগার্ডকে ডেকে নকল মারওয়ানকে ডেকে আনতে বলল। বডিগার্ড বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“স্যার তো এখন এই সময়ে একা থাকেন। ওনাকে এই মুহূর্তে ডাকা যাবে না।”
ইনাবা রাগে ফেটে পড়ে বলল,
“তোমার স্যারকে ডাকবে নাকি ঘরের সবকিছু তছনছ করে ফেলব? কেমন বাপ সে? নিজের সন্তানের কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেসবও জানে না? খালি মাস্ক লাগিয়ে ঘোরে? বুঝলাম না চেহারা পরিবর্তন করার মানে কী? আমি তো তার আসল চেহারা দেখেছিই। তাও চেহারা হাইড করার রিজন কী? কোন ফন্দি আঁটছে আবার?”
ইনাবার সন্দিহান কন্ঠস্বর। বডিগার্ড থতমত খেয়ে বলল,
“ম্যাম সেটা তো আমি বলতে পারব না। আপনি বরং স্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আমি ডেকে আনছি।”
“এই খবরদার পালাবার চেষ্টা করবে না। তুমি হলে ওই লোকের ডান হাত আর তুমিই জানো না এমন উদ্ভট কাজ কর্মের মানে কী? ঘটনা খুলে বলবে নাকি তোমার চাকরি নট করার ব্যবস্থা করব?”
বডিগার্ড মাথা নুইয়ে ফেলে চুপ করে রইল। ইনাবা আবার তাগিদ দিতে চাইলে নাহওয়ান কেঁদে উঠলো। ইনাবা চট করে তাকাতেই দেখল আইসক্রিম গলে গলে পড়ছে বাচ্চাটার হাতে। সে তড়িঘড়ি করে বডিগার্ডকে তার স্যারকে ডেকে আনতে ইশারা করল। বডিগার্ড চুপচাপ বেরিয়ে যেতেই ইনাবা নাহওয়ানের হাত থেকে আইসক্রিম নিতে চাইলে নাহওয়ান দিল না। হাতে মুঠ করে ধরে রাখল।
অন্যদিকে নকল মারওয়ানকে গুরতর ঘটনা ঘটে গেছে এই কথা বলে বডিগার্ড নিয়ে আসল। লোকটা দ্রুত গতিতে রুমে ঢুকতেই দেখল নাহওয়ান, ইনাবা বসে আছে। রুমে অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পেল না। নাহওয়ান তাকে দেখতেই বাচ্চাটা ডেকে উঠল,
“বাবা বাবা।”
ইনাবা ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে বলল,
“ওকে আইসক্রিমটা খাইয়ে দিন দ্রুত। পুরো গলিয়ে ফেলছে।”
লোকটার ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। চেহারার ভাঁজে ভাঁজে বিরক্তি বিদ্যমান। ইনাবা আবারও তাগিদ দিতে লোকটা এবার শক্ত গলায় বলল,
“তুমি আমাকে অর্ডার করছ?”
“আপনার সন্তানকে খাওয়াবেন। এতে আমার অর্ডার করার কি আছে? আশ্চর্য!”
লোকটা নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল,
“ওকে খাইয়ে দিতে হবে কেন? তুমি আছো কি করতে?”
“আমার হাতে খেলে নিশ্চয়ই আপনাকে ডাকা হতো না?”
ইনাবার ত্যাড়া প্রশ্ন। লোকটা কথার বিপরীতে কথা না বাড়িয়ে বিরক্তি চেপে নাহওয়ানের পাশে বসে আইসক্রিম খাওয়ানোতে মনোযোগ দিল। নাহওয়ান খাচ্ছে আর মাথা নাড়িয়ে বলছে,
“আইক্কিম মুজা মুজা।”
নকল মারওয়ান বিরক্তি চেপে খাওয়াচ্ছে। খাওয়ানো শেষ হতেই নাহওয়ানের কাশি উঠে গেল। কাশতে কাশতে বাচ্চাটা অস্থির হয়ে উঠল। ইনাবা চিন্তিত হয়ে বুক, পিঠ ডলে দিতে লাগল। পাশেই লোকটা মুখ কুঁচকে সবকিছু হজম করছে। রাগ তার শরীরে টগবগ করে ফুটছে। সাইফারের বাচ্চার সমস্যা কি? এখনো ছেলের কোনো খোঁজ খবর নিতে এল না। কোন কুবুদ্ধি পাকাচ্ছে ওই ডেডলি সাইলেন্সারটা। তবে ওর কোনো মুভমেন্ট কেন দেখছে না? কি চাচ্ছে এই সাইফার! এমন চুপচাপ কি করে থাকতে পারে একজন পিতা? বউ, সন্তানের প্রতি এক বিন্দু মায়াও কি তৈরি হয়নি? ভেবেছিল খেলা এবার জমবে এখন তো মনে হচ্ছে অপরপক্ষের নীরবতায় খেলা শুরুই হচ্ছে না। দিস ইজ ঠু অ্যান্নয়িং!
আচমকা কাশতে কাশতে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে নাহওয়ান আশপাশ হাতড়াল। হাতে মেয়েলি অবয়ব ঠেকায় ছোট্ট হাত দিয়ে মা মনে করে জড়িয়ে ধরে ডেকে উঠল,
“মা, মা।”
নরম কোমল মোলায়েম স্পর্শে ইনাবার ঘুম ভেঙে গেল। জড়িয়ে ধরে নমনীয় গলায় বলল,
“এইতো মা।”
নাহওয়ান মাকে অনুভব করতে চাইল কিন্তু পারল না। এ শরীরে মায়ের গন্ধ নেই। মায়ের গন্ধ, কণ্ঠ সবই তার মুখস্ত। দেখতে নারী হলেও চিরপরিচিত সেই মায়ের গন্ধটা নেই কেন এই শরীরে? ছোট্ট অবুঝ শিশুর মনে মাকে দেখার, ছোঁয়ার প্রবল তৃষ্ণা জেগে উঠল। কতদিন মাকে দেখে না, ছোঁয় না, অনুভব করেনা। মায়ের শরীরের মমতা মিশ্রিত শান্তির গন্ধটা আর নাসারন্ধ্রে আসে না। কী মিষ্টি মিষ্টি গন্ধটা! অন্ধকারে অবুঝ নাহওয়ান ফোঁপাতে ফোঁপাতে বারবার নারীটি হতে সেই গন্ধ নিতে চাইল কিন্তু শত চেষ্টা করেও তা পেল না। তার নাসা গহ্বরে কেমন একটা সুন্দর সুবাস ঠেকছে তবে সেই মায়াময় মিষ্টি ‘মা মা ‘ ঘ্রাণটার অস্তিত্ব কোথাও পেল না।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খুঁজিয়া কেহ পাইবে জননীর প্রাণ?
কোথা গেলে পাইব সে-ই মাতাল করা ঘ্রাণ?
ধরিত্রী খুঁজিয়া পাতাল ভেদিয়া খুঁজি যে তাহারে,
সে লুকাইয়া রইয়াছে মোর চক্ষুদিগের আড়ালে।
প্রাণ সঞ্চয়িনী একস্মিন দর্শন দাও অধমেরে,
তোমাবিহীন কুলঠা ঘুরি গো দ্বারে দ্বারে।
অস্তিত্ব হারাইয়া টিকিয়া রইয়াছি দিবারাত্রি
কবে পাইব তব সত্তা দর্শন হে গর্ভদাত্রী?
~তাজরীন ফাতিহা
সকাল সকাল বসের আগমনে সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত। হুট করেই কাউকে ইনফর্ম না করে এভাবে কখনোই বসের পা পড়ে না এখানে। সকলের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। বসের চেহারা মারাত্মক গম্ভীর এবং কঠোর। নকল মারওয়ানকে ইনফর্ম করা হলে সে হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করল। দেখল বস মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসে আছে। লোকটা এগিয়ে এসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম বস। ইনফর্ম ছাড়া হঠাৎ? অ্যানি প্রবলেম?”
বস কপাল থেকে হাত সরিয়ে লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে চাইল। তারপর ভারিক্কি গলায় বলল,
“সাইফারের পুত্র কোথায়?”
“আছে। বহাল তবিয়তেই আছে।”
কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট বিরক্তি। বসের চেহারা কুঁচকে গেল।
“বহাল তবিয়তে আছে মানে?”
“আপনি যেমন নির্দেশ দিয়েছেন তেমনই আছে।”
বস এবার নড়েচড়ে বসে বলল,
“তুমি নাকি কোন মেয়ে তুলে এনেছ?”
লোকটা এই প্রশ্নে আকাশ থেকে পড়ল যেন।
“আমি কোন মেয়েকে তুলে এনেছি?”
“সেটা আমার থেকে নিশ্চয়ই তোমার ভালো জানার কথা।”
“আপনার নির্দেশের বাইরে কোনো কাজ এখন পর্যন্ত কোনোদিন করিনি ভবিষ্যতেও করব না। আপনি যাকে বলেছেন তাকেই শুধু তুলে আনা হয়েছে এবং সেও বহাল তবিয়তেই আছে।”
বস এবার গলার স্বর আগের থেকে আরও ভারী ও মোটা করে ভ্রু সংকুচিত করে বলল,
“আমি আবার কোন মেয়েকে তুলে আনতে বলেছি?”
“কেন আপনার পরিচিত একজন মেয়েকে তুলে আনার অর্ডার দিলেন না?”
“কবে, কোনদিন? সাইফারের পুত্র ছাড়া কাউকে আনার তো কোনো অর্ডার আমি দেইনি।”
বসের নীরব অথচ উঁচু গলার আওয়াজ। আশপাশের সকলেই বসের এই ভারী ঠান্ডা কণ্ঠে ভীত। নকল মারওয়ান ঢোক গিলে বলল,
“বস আপনি কি মজা করছেন আমার সঙ্গে?”
বস এবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার সামনে এসে চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“মজা আমি নয় তুমি করছ। আর সেই মজায় তোমাকে চুবিয়েছে সাইফার। তুমি ওর টোপে খুব সুন্দর করে পা দিয়ে ফেলেছ?”
লোকটা ঢোক গিলে বলল,
“এটা কি করে সম্ভব বস? আপনার নম্বর থেকে কল এল। আমি ধরলাম। আপনি অর্ডার করলেন তাহলে আপনি অর্ডার না দিলে কে দিয়েছে সেটা?”
বস ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে বলল,
“যেমনভাবে আমরা তাকে ফাঁসিয়েছি ঠিক তেমনভাবে সেও আমাদের সবাইকে ফাঁসিয়েছে। এটা বুঝতে এতক্ষণ লাগে তোমার? আমার নাম্বার হ্যাক করে তোমাকে ওরা ঘোল খাইয়েছে। তুমি কি ভেবেছ একমাত্র তুমিই জালিয়াতি, কণ্ঠ নকল করতে পারো আর কেউ পারে না?”
লোকটা চড় খেয়ে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে সব শুনে বলল,
“তাহলে সাইফারের পুত্রকে আপনি খাতির যত্ন করে রাখতে বলেননি?”
“এখনো জিজ্ঞেস করছ? ওকে আমি খাতির যত্ন করতে বলব কোন আক্কেলে? শত্রুর যত্ন করতে বলে কোন পাগলে? ভাগ্যিস সারফেজ খবরটা আমাকে পৌঁছেছিল নয়তো ওই সাইফার আরও কি কি ঘটাতো সেসব ভেবেই অস্থির লাগছে। তোমাদের কারো সন্দেহ লাগেনি ওর নিশ্চুপতায়? সন্তান হারিয়ে এমন ঠান্ডা থাকতে পারে?”
একজন বলল,
“বস আমার সন্দেহ হয়েছিল তবে তার মুভমেন্ট তো একেবারেই সাইলেন্ট ছিল। সকলের মাইন্ড ডাইভার্ট করে ফেলেছে সাইফার। ওকে আমার প্রথম থেকেই যথেষ্ট সন্দেহ হয়। ডেডলি সাইলেন্সার খেতাব এমনি এমনি নিশ্চয়ই পায়নি? তাছাড়া ওর নামের সংক্ষিপ্তও কিন্তু আজারাক সাইফার ওরফে এসি। ভুলে গেলে নিশ্চয়ই চলবে না।”
নকল মারওয়ানের শিরা, উপশিরা, ধমনী সবকিছুতে তীব্র ক্রোধ তুমুল বেগে বাহিত হচ্ছে। সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এতবড় ধোঁকা তাকে দেয়া হলো? এ হার কিছুতেই মেনে নিতে পারল না তার পরাজিত সত্তা। সে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে রুম থেকে নাহওয়ানকে টেনে হিঁচড়ে এনে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিল। বাচ্চাটা কেঁদে উঠে ‘বাবা বাবা’ ডেকে উঠতেই লোকটা দ্বিতীয়বার হাত ওঠাতেই ধারালো ছুরি তার হাত বরাবর গেঁথে গেল। সে চিৎকার দিয়ে কাতরে উঠল। সকলে থতমত খেয়ে গেল। চোখে মুখে আতঙ্ক বিরাজ করছে। লোকটার নাহওয়ানকে ধরা ওপর হাতেও একই ভাবে ছুরি বিদ্ধ হলো। লোকটা চেঁচিয়ে বলল,
“কে ছুরি মারলি? সাহস থাকলে সামনে আয়? বাস্টার্ড!”
“হ্যাল্লো অ্যা ব্যাকস্ট্যাবার প্লেয়ার।”
বডিগার্ড, গার্ড সকলেই পজিশনে দাঁড়ালো। কণ্ঠটা দরজা অভিমুখ থেকে আসছে। মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়াতে ছাড়াতে কালো লং হুডি পরিহিত আজারাক সাইফারের প্রবেশ। লোকটা রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। রিভলবার তাক করা প্রতিটা হাতের দিকে চেয়ে সাইফার হো হো করে হেঁসে উঠল। মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছড়িয়ে বসে পড়ল চেয়ারের উপর পায়ের উপর পা তুলে। বস নিজেও রাগ সংবরণ করতে চাইছে কিন্তু কোনভাবেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। শত্রুর এত ঔদ্ধত্য আচরণ কারোরই কাম্য ছিলনা। তাদের প্রত্যেকটি পরিকল্পনা কিভাবে যেন ভেস্তে দিল এই সাইফার। নিজেকে পরাজিতের অবস্থানে কোনোভাবেই দেখতে ইচ্ছুক নয় সে। এতবছরের করা পরিকল্পনায় এক মুহূর্তে জল ঢেলে দিয়ে কিছুতেই ভেস্তে দিতে চায়না সে।
সাইফারের সেদিকে একদমই মনোযোগ নেই। তার চোখ ছেলের দিকে স্থির। বাচ্চাটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে একবার নকল মারওয়ানকে দেখছে আরেকবার তাকে। সবাইকে ভয় পাচ্ছে এখন সে। চেহারায় আতঙ্কিত ভাব স্পষ্ট। গালে স্পষ্ট পাঁচ আঙুলের ছাপ ফুটে উঠেছে। লালিমা বর্ণ ধারণ করেছে। পাশে দাঁড়ানো লোকটার হাত বেয়ে টপাটপ লাল তরল গড়িয়ে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা মুখে পুড়ল। লাইটার দিয়ে বেশ সময় নিয়ে তার মাথায় আগুন ধরাল। ধোঁয়ায় কুন্ডুলী পাকিয়ে উঠল। কয়েকজন গার্ড তার মাথায় পিস্তল ঠেকালেও এতে তার বিন্দু পরিমাণ হেলদোল দেখা গেল না। সে নিজের মতো সিগারেট টানায় ব্যস্ত। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে উঠেছে। শিকার ধরার আগে বাজের চোখ যেমন থাকে ঠিক তেমন।
লোকটা নিজের হাত থেকে ছুরি বের করতেই গলগল করে রক্ত পড়ে ফ্লোর ভেসে যেতে লাগল। একজন ব্যান্ডেজ এগিয়ে দিতেই সে ব্যান্ডেজ পড়ে মারওয়ানের দিকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে চাইলে বস তাকে থামিয়ে দিল। বসের চোখ মুখ গম্ভীর কিন্তু চোখে ফুটে আছে চতুর মনোভাব। সে বলল,
“সমঝোতায় আসি। বলো কি চাও?”
সাইফার হাসল। যেন কোনো জোকস বলা হয়েছে। বস এবার নিজ থেকেই বলল,
“চলো একটা গেইম খেলি। দাবা খেলায় যে হারবে সে স্বইচ্ছায় সারেন্ডার করবে। পরাজিত পক্ষকে জিতা পক্ষ যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। তুমি রাজি?”
সাইফার ভ্রু কুঁচকে চাইল। বসের মুখে কুটিল হাসি।সাইফার মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছাড়াতে ছাড়াতে বাঁকা হেঁসে বলল,
“রাজি।”
মুখোমুখি দুই সত্তা। পার্থক্য শুধু টেবিলের এপার ওপার। আশেপাশে গার্ডরা দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলে দাবার বোর্ডে গুটি গুলো দাঁড়িয়ে আছে আগু পিছু ভাবে। একজনের চোখে জেতার তীব্র বাসনা অপরজন বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত। সে সিগারেট মুখে পুরে গুটি চালছে। মুখের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে বিরামহীন।
“দাবা খেলায় সবচেয়ে দুর্বল গুটি কোনটা জানেন?
মুখ থেকে সিগারেট বের করে গুটি চালিয়ে সাইফার জানতে চাইল। বস গম্ভীর বদনে থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে সাইফারের একটা গুটি খেয়ে বলল,
“সৈন্য।”
সাইফার এবার সিগারেটে লম্বা টান মেরে বলল,
“ভুল। সবচেয়ে দুর্বল গুটি রাজা।”
“কারণ?”
“রাজা যদি দুর্বলই না হতো তাহলে তাকে বাঁচাতে এত সৈন্য, মন্ত্রী, হাতি, ঘোড়া, উট পাশাপাশি সামনাসামনি দাঁড়িয়ে থাকত না। সে দুর্বল দেখেই তাকে রক্ষা করতে এদের আগমন।”
বস কুটিল হেঁসে সাইফারের দিকে চাইল। সে যে তাকে এবং তার পাসেপাশের গার্ডদের মিন করেছে সেটা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয়নি তাকে। গুটি চালিয়ে বলল,
“চেক।”
সাইফার মুখ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে গুটি চালিয়ে বলল,
“চেকমেট।”
সোজা হয়ে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসল। বস লোকটা রাগান্বিত হয়ে উঠল। কোথা থেকে কিভাবে খেলা ঘুরিয়ে দিল এই সাইফার। ওর রাজাকে চেক দেয়া একটা ট্র্যাপ ছিল নিশ্চয়ই। দাবার বোর্ড উল্টে ফেলল সে। নিজেকে পরাজিত অবস্থায় কোনোভাবেই দেখতে ইচ্ছুক নয় সে। চিল্লিয়ে উঠলো সে। সাইফার বেশ মজা পাচ্ছে। শত্রুপক্ষকে নাকানিচুবানি খেতে দেখলে ভালোই লাগে।
“দেখলেন দাবা খেলায় সবচেয়ে দুর্বল গুটি রাজা। সৈন্য, সামন্ত ছাড়া সে একেবারেই অচল। ভেরি স্যাড। আপনাদের জন্য সমবেদনা প্রতিপক্ষ।”
বস নিজের চতুর চাহনি নিক্ষেপ করে কুটিল হেঁসে বলল,
“তোমার জন্যেও।”
সাইফার খেয়াল করল কতগুলো পিস্তল তার দিকে তাক করা। মোটেও ঘাবরালো না সে। যেন জানতোই এমন কিছু হবে। পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে বলল,
“অবাক হইনি মোটেও মিস্টার। পিঠ পিছে ছুরি মারা কিংবা বিশ্বাসঘাতকতায় আপনারা নোবেল প্রাপ্ত তা আমি জানি। সামনাসামনি যুদ্ধতে অলওয়েজ ফেল্টুস।”
বস এবার ক্ষিপ্রগতিতে সাইফারকে উঠিয়ে ঘুষি বসিয়ে দিল। নকল মারওয়ান নিজেও এসে কয়েক ঘা বসালো। তবে আজারাক সাইফার মোটেও বিচলিত হলো না। ঠোঁটের কোণে রক্ত মুছে হেঁসে বলল,
“গেইম স্টার্ট।”
আবারও মুখ বরাবর ঘুষি পড়তেই গুলির আওয়াজে সকলে থেমে গেল। সকল পিস্তল মুহূর্তের মাঝে কিছু গার্ডস, বস, নকল মারওয়ানের দিকে ঘুরে গেল। ইনাবাকে এতক্ষণ আটকে রাখা হয়েছিল। ছদ্মবেশী এজেন্ট দরজা খুলে দিতেই সে পিস্তল দিয়ে গুলি ছুঁড়েছে। পিস্তলের নল ফ্লোর বরাবর ধরে কয়েকবার সেখানে শুট করল। এ যেন এক ভিন্ন ইনাবা। মাথায় হিজাব কিন্তু পরনে ফর্মাল পোশাক অর্থাৎ শার্ট, প্যান্ট পরিহিত। সাইফারের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“Sir, please give the command.”
নকল মারওয়ান অবাক নয়নে চেয়ে আছে। তার সন্দেহ হয়েছিল ক্যারাটে স্কিল দেখেই এই মেয়ের মধ্যে ঘাপলা আছে। এখন তো সত্যিই দেখছে ঘাপলা আছে। বসের চেহারা লাল হয়ে উঠেছে।
“ইনাবা?”
ইনাবা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“Don’t call me Inaba. I’m sicret agent. It’s me Rubana Azmeri.”
বসের অস্ফুট গলার অবিশ্বাস্য প্রত্যুত্তর,
“রুবানা আজমেরী! সিক্রেট এজেন্ট!”
সাইফার তাদের মুখের অবস্থা দেখে বলল,
“পিকচার আভি বাকি হ্যায়, ইয়েতো জাস্ট ট্রেইলার হ্যায়।”
তারপর চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে উঁচু কণ্ঠে ডাকল,
“জিএ ওরফে জিনান আদহাম।”
জিনান প্রবেশ করল। তাকে দেখে বস তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল। জিনানের ভাব ভঙ্গি মোটেও পরিবর্তন হলো না। সে পিছনে দুহাত নিয়ে দাঁড়ানো। বস উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“অভ্র তুমি?”
জিনান তাচ্ছিল্য হাসল। প্রত্যুত্তর করল না কোনো। নেওয়াজ শাবীরকে ডাকতে হলো না। সে নিজেই ঢুকে বলল,
“হায় টাক্কু বস আমি আপনাদের পরিচিত নই। মাথা বেশি খাটিয়েছেন তো এজন্যই মাথায় চুল নাই। পুরাই চান্দি ফাঁকা।”
সকলে একযোগে হেঁসে উঠল। হাসল না কেবল নকল মারওয়ান, বস এবং সাইফার। প্রত্যেকের চেহারাই গম্ভীর। সাইফার এবার নড়ে চড়ে বসে বলল,
“এবার যাকে দেখবেন ফিট হয়ে পড়েও যেতে পারেন দুজন। প্রতিপক্ষ এত সাধারণ হলে খেলে কোনো মজা আছে বলুন? নিজেদের শক্ত করুন। এই ঝটকা খেলে হার্ট এ্যাটাকও হয়ে যেতে পারে মিস্টার ব্যাকস্ট্যাবার। পক্ষ প্রতিপক্ষের সাথে পরিচয় করিয়ে তারপর মূল বিষয়বস্তুতে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”
বসের চেহারা ক্রোধে নাকি হেরে যাওয়ার গ্লানিতে লাল হয়ে উঠেছে বলা মুশকিল। সাইফার কিছুটা সুর দিয়ে ডাকল,
“এমজে ওরফে মুনতাজির জায়েদ।”
ধীর গতিতে পায়ের কদম ফেলে মুনতাজিরের প্রবেশ ঘটল। মাথা থেকে নিজের হুডি ফেলে দিতেই বস ও নকল মারওয়ান উভয়ের মাথায় বজ্রঘাত ঘটল। এ কাকে দেখছে তারা? বস নিজের বুকে হাত চেপে ধরে চোখ বড় বড় করে বলল,
“ইহাব! তুমি না ইজহার শ্যাডো?”
মুনতাজির হাসল। হেঁসে বলল,
“কেন ইজহার শ্যাডো নাম দিয়ে বন্ধুকে ধোঁকা দেয়া খুব সোজা তাই না মামু ওহহো দুঃখিত মিস্টার উমায়ের ভুঁইয়া ওরফে ব্ল্যাক ভাইপার অ্যান্ড এজেন্ট তাহমিদ ওরফে নাইটক্লস হান্টার।”
উমায়ের ভুঁইয়া চেয়ারে বসে পড়ল। মুনতাজির বলল,
“কী ভেবছিলে আমাদের বন্ধুত্ব ভেঙে তোমরা উল্লাস করবে? আমরা একে অপরের জানের শত্রু? সাইফার আমাকে ঘৃণা করে? দেখতে পারে না? একদমই ভুল। আমরা যা দেখিয়েছি তোমরা ঠিক তাই দেখেছ। সব ছিল নাটক। তোমাদের প্ররোচনায় পড়ে ইজহার শ্যাডো চরম অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। যে নামের প্রতি আমার তীব্র বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে সে নামে নিজেকে পরিচিত করতে কোনোভাবেই চাইনি।
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৭ (২)
তবে আজারাক সাইফারের প্ল্যান ভিন্ন ছিল। আমি মুনতাজির জায়েদ হলেও আমার উপাধি ইজহার শ্যাডোই ছিল যার অর্থ ‘উন্মোচিত ছায়া’। আমার মাধ্যমে তোমাদের পাপ কীর্তি উন্মোচন করতে চেয়েছিল বিধায় আমি উহ্য ইজহার শ্যাডো এবং এতদিন প্রতীক্ষা করে ছিলাম দেখে আজকের মুনতাজির জায়েদ অর্থাৎ ‘প্রতীক্ষাকারী’।
 
