ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৮

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৮
সাইয়্যারা খান

রোদ আদ্রিয়ান আর বাচ্চাদের নিয়ে ঈদের পর দিন কাটিয়ে আসলো নিজের বাসায়। রাতে সেখান থেকে ঘুরে এরপর বাসায় আসলো। আদ্রিয়ান ওইদিনই ফ্লাটে ফিরতে চেয়েছিলো কিন্তু মা’য়ের জোরাজোরিতে থেকে গেলো তাও কঠোর ভাবে জানিয়েছে, শুধু একদিন আর থাকবে। আদ্রিয়ানের মা’ও মেনে নিয়েছে ছেলের কথা। একদিন থাকবে তাই ঢের তার কাছে। এতসবে রোদ ঘাড়ত্যাড়ার মতো বেঁধে আছে। ওর কথা যাবো ই তো এক সপ্তাহ থেকে যাই। আদ্রিয়ানও নাছোরবান্দা।

এখানে রাখবে না আর এটা যে শুধু মাত্র এলাকার মানুষের জন্য না তা এবার রোদ ক্লিয়ার হয়ে গেল। আদ্রিয়ানকে হাজার খোঁচালেও মুখ খুলে নি বান্দা। রোদ আড়ালে যতটুকু শুনেছে তাতে ওর সন্দেহ হচ্ছে কেউ আসবে এখানে যার কারণে আদ্রিয়ান ওদের এখানে রাখতে নারাজ। কিন্তু কে সে যার জন্য আদ্রিয়ান নিজের বাসায় নিজের বউ,বাচ্চা রাখছে না? রোদের প্রশ্নের উত্তর হাজারবার জিজ্ঞেস করলেও পাওয়া গেলো না। রেগে লাল হয়ে রোদ রুমে ডুকে চেঞ্জ করে মিশিকে নিয়ে মিশানের রুমে ডুকে দরজা লক করে দিলো। মিশিকে ঘুম পাড়ানোর সময় মিশানও একটা বালিশ নিয়ে রোদের কোলে রেখে মাথা দিয়ে দিলো। রোদ হেসে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— ঘুম পাড়ানীর গান গাইবো নাকি আব্বাজান?
— চাইলে গাইতে পারো। আমার সমস্যা নেই।
–আল্লাহ কি বলো? তোমার বাবা দেখে তোমার বিয়ের স্বপ্ন আর তুমি এখন মা’য়ের কাছে ওয়া ওয়া করো?
মিশান রেগে উঠেই গেল। রোদ ওর হাত ধরতেই বললো,
— তুমিও বাবার মতো। কথা নেই তোমার সাথে।
রোদ হেসে বললো,

— আচ্ছা আচ্ছা রাগ করে না। আসো রোদ মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে।
মিশান আবারও শুয়ে পরতেই রোদ ওর মাথায় বেশ কিছু সময় হাত বুলিয়ে দিলো। মিশান রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলো রোদের সাথে। স্কুলে কে আছে,বন্ধু কে কে, কে কেমন, কি করে সহ নানা আলোচনা তার মা’কে বলতে ব্যাস্ত। রোদও মিশানের সব কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাঝে মধ্যে হু হা উত্তর দিচ্ছে। এত কথার মাঝেই হুট করে মিশান এটাও বলে উঠলো,

— জানো মিসেস.মাইশা দেখা করতে আসে প্রায়। আমি করি না কখনো। বাবা বলেছে অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে না। উনি ও তো আমার অপরিচিত। বলো?
এই প্রথম মিশানের মুখে নিজের মা’য়ের জন্য এমন সম্মোধনে রোদ কিছুটা অবাক হলো। মিশি তো কখনোই মাইশার কথা বলে না। ছোট্ট পরিটা আদৌও মা’কে চিনে কি না, কখনো দেখেছে কি না সন্দেহ। মিশানের ও মাইশাকে নিয়ে কথা বলার সময় তেমন একটা আবেগ দেখা গেলো না। সে নিজের মতো আবার অন্য কথা বলতে ব্যাস্ত। রোদ মিশানের কপালে, গালে হাত বুলিয়ে বললো,

— মা’কে মিস করো?
মিশান রোদের হাত ধরে সোজা ভাবেই উত্তর দিলো,
— এই তো তুমি। আমার এত কাছে। মিস কেন করবো?
রোদ একটা ঢোক গিলে শুকনো গলায় বললো,
— মাইশা আপুকে?

— ওহ্ তার কথা বলছো। সে তো আমার মা না। তুমি আমার মা। আমার রোদ মা। আর রইলো মিস করা? তাকে আমি কখনো মিস করি না। যেদিন চলে গিয়েছিলো সেদিনের পর থেকে বাবার কাছেই মা-বাবার আদর পেয়েছি। এখন তো আদর বাড়লো তুমি আসাতে। মিস করার তো প্রশ্নই ওঠে না। আই লাভ ইউ মা। তুমি ছেড়ে যেও না তাহলেই হবে।

প্রথম কথাগুলো বেশ স্বাভাবিক ভাবে বললেও শেষের লাইন দুটো বলার সময় মিশানের কন্ঠনালী কাঁপছিলো এটা টের পেয়েছে রোদ। ওর নিজের চোখেও পানি চলে এসেছে। রোদের ছোট্ট মনটা নিমিষেই উতলা হয়ে উঠলো। কিভাবে মা’য়ের আদর দিবে ও মিশানকে? কি করবে ও যাতে মিশানের না পাওয়া আদর ও দিতে পারে? রোদের আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই মিশান ওর হাত ঝাঁকিয়ে বললো,

— বলো যাবে না।
রোদ মিশানের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
— কখনো যাবে না রোদ মা। সবসময় থাকবে তার মিশান,মিশির কাছে।
বেশ সময় লাগিয়ে ঘুমালো মিশান। রোদের অনেক মায়া লাগে মিশানকে। কোন মা কিভাবে পারে তার সন্তানদের ফেলে যেতে? পরক্ষণেই রোদ আবার ভাবলো,ভালোই হয়েছে মাইশা চলে গিয়েছে নাহলে রোদ কিভাবে ওদের পেতো? আদ্রিয়ানকে পেতে?

হঠাৎ দরজায় নক হতেই রোদের চিন্তায় ভাটা পরলো। অপর পাশ থেকে আদ্রিয়ান ডাকছে,
— মিশান তোমার মা কি এখানে?
মিশান তো ঘুম। এই আদ্রিয়ান ও থেমে নেই অনবরত ডেকেই যাচ্ছে। না পারতিকে রোদ ফোন হাতে কল করলো আদ্রিয়ানকে। রিসিভ হতেই আদ্রিয়ান ঝটপট করে বললো,

— রোদ কোথায় তুমি? ছাদে ও খুঁজে এলাম। কোথায়?
— আমাকে দিয়ে আপনার কি হ্যাঁ?
— কি মানে। তোমাকে দিয়েই তো সব। রুমে আসো। কোথায় তুমি?
— আসবো না আমি। যেখানে থাকার ওখানেই আছি।
— আচ্ছা রাগ করে না সো…

টুট টুট শব্দ হতেই আদ্রিয়ান দেখলো রোদ কল কেটে দিয়েছে। এই মেয়ে কেন বুঝে না? আদ্রিয়ান যা করছে ভালোর জন্যই তো করছে। কি মনে করে আবার মিশানের রুমের নব ঘুরাতেই দেখলো লক করা তখনই খটকা লাগলো। মিশানতো কখনো লক করে ঘুমায় না। আদ্রিয়ান নিজের রুমে ডুকে চাবি এনে লক খুলে চোরের মতো ডুকে পড়লো। ড্রিম লাইটের আলোতে দেখা গেলো শান্তিময় দৃশ্য। দুই বাচ্চা নিয়ে ঘুমাচ্ছে রোদ। লোভী আদ্রিয়ান নিজেও দরজা লাগিয়ে রোদকে ঘেঁষে শুয়ে জড়িয়ে ধরলো। রোদ কিছুটা সজাগ ই ছিলো। নিজেও আদ্রিয়ানের দিকে ফিরে জড়িয়ে বুকে ডুকে পড়লো।

জারবা আর ইয়াজের আংটি বদল হবে। ঈদের ছুটিতেই তা সেরে ফেলতে চাইছে দুই পরিবার। জারবা কেঁদে কেটে বাড়ি ঘর একাকার করে দিয়েছে। ফুপিকে কাঁদতে দেখে মিশি আর আলিফ ও কেঁদে উঠলো। জারবার কান্না দেখে সবাই যেন বেআক্কেল হয়ে গেল। এই মেয়ে এনগেজমেন্টেই এই অবস্থা করলে বিয়ের দিন কি করবে? জারবার মা প্রথমে প্রথমে মে’য়েকে সান্ত্বনা দিলেন কতক্ষণ। বুঝালেনও কিন্তু জারবা জারবাই। ও কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে আর বারবার বলছে,

— আমি বিয়ে করব না। যাব না কেথাও। তোমরা না করে দাও।
এবার আদ্রিয়ানের মা গেলেন চটে। এটা তো না যে জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন। বেশ কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললেন,
— যখন কথা বলতি তখন মনে ছিলো না এই বাড়ী ছেড়ে যেতে হবে?
জারবা এবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। সাবা কত সান্ত্বনা বাণী শুনালো তাতেও তেমন একটা লাভ হলো না। আদ্রিয়ান আর আরিয়ান বাসায় ছিলো না। মূলত এনগেজমেন্টের কিছু কাজেই বাইরে ছিলো। বাসায় আসতেই বোনের এহেন কান্না দেখে দুই ভাই এসে দুই দিকে বসে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে? ও কাঁদছে কেন?
আদ্রিয়ান মা এবার ভয়াবহ রেগে বললেন,
— একে সরা আমার সামনে থেকে। মাথা খেয়ে ফেললো আমার।
আরিয়ান ভ্রু দিয়ে ইশারায় সাবাকে জিজ্ঞেস করতেই সাবা বললো,
— এনগেজমেন্ট করতে চাচ্ছে না।
আদ্রিয়ান দুষ্টামি করে বললো,
— তাহলে কি ডিরেক্ট বিয়ে করতে চাস?

ওর কথায় সবাই হেসে উঠলো। জারবার কান্নার শব্দ বাড়লো। আরিয়ান বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আদ্রিয়ান মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— বুড়ী তোকে এত তারাতাড়ি বিদায় দিব না। কাল শুধু ওরা আসবে। আংটি পরিয়েই চলে যাবে।
— না করে দাও ছোট ভাইয়া। আমি বিয়ে করব না।
রোদের ফোনে তখনই ইয়াজের কল আসলো। বেচারা মাত্রই ডিউটি শেষে জারবাকে কল দিচ্ছিলো কিন্তু এজ এলওয়েজ জারবা ধরে নি। রোদ ফোন ধরে একটু জোরেই বললো,

— তোর কাল এনগেজমেন্ট হবে না রে। জারবা সোজা বলে দিয়েছে ওর নাকি তোর চেহারা ভালো লাগে নি। তোর লম্বা নাকের দুই ইঞ্চ কাটতে হবে।
ইয়াজের মাথা গরম হয়ে গেল। এই পাগল জারবাকে ভালোবেসে নিজেই এখন পাগলা গারদে যাওয়ার উপক্রম হ’য়েছে। রোদের কথা শুনার পর পরই জারবার কান্না থেমে গেল। ফুলা ফুলা চোখ দুটো গোল করে তাকিয়ে বললো,

— ছোট ভাবী কার সাথে কথা বলছো?
— আর কে? তোমার না হওয়া ফিঅনসে ইয়াজ পিয়াজ।
জারবার চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। ও তো ইয়াজকে অনেক ভালোবাসে। লোকটা ওকে কত আদর লাগিয়ে সব বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলে কিন্তু জারবা ই বা কি করবে? ওর তো বিয়ের কথা মনে পরলেই কান্না পায়। রোদ কিছু বলবে তার আগেই ইয়াজ কল কেটে দিলো। আদ্রিয়ান রোদকে জিজ্ঞেস করলো,

— ইয়াজ কি বলছে?
— কল কেটে দিলো।
জারবার এবার দুঃখে কান্না আসছে। ইয়াজ কি তাহলে কাল আসবে না? ভাবতেই জারবার কান্না বাড়লো।

আদ্রিয়ান আজ যাওয়ার জন্য বেশ তাড়া দিচ্ছে। রোদের কথা কাল তো আবার আসতেই হবে তাহলে আজ কেন যাব? আদ্রিয়ান জানে ভালো কথা এখন রোদ শুনবে না। অতি আদরে ওর সাহস বেড়েছে ইদানীং। আদ্রিয়ান শেষ বার ঠান্ডা মেজাজে বললো,
— আমি মিশিকে নিয়ে আসছি। বোরকা পড়ে রেডি হও। আর কোন কথা না।
রোদ ত্যাড়ামি করে বললো,

— আপনি যান। আমি বাচ্চাদের নিয়ে এখানেই থাকবো। একা একা সংসার করুন যেয়ে।
আদ্রিয়ান এবার বেশ জোরে ধমকে উঠলো। রোদ দুই পা পিছিয়ে গেল ভয়ে। আদ্রিয়ান ওর হাত টেনে ধরে দাঁত চেপে বললো,
— বড়দের কথা শুনো না কেন? বেয়াদব হচ্ছে দিন দিন। বেশি লাই দিয়ে ফেলেছি। আর একবার তর্ক করলে কানের নিচে খাবা একটা।

রোদের নাকের পাটা ফুলছে। চোখ জ্বলছে। কান্না আটকে রাখলো রোদ। কিছুতেই আদ্রিয়ানের সামনে কাঁদবে না ও। মাথা নিচু করে রেখে হাত ছাড়াতে চাইছে। আদ্রিয়ান তখনও ওর হাত ছাড়ে নি। রোদ জিদ্দি বাচ্চাদের মতো করে মাথা নিচু করে হাত মোচড়াচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকাচ্ছে আদ্রিয়ান। ধমকটা মোটেও মন থেকে দেয় নি। এই মেয়ে কথা শুনে না। আদ্রিয়ান এবার রোদের গোল কালো করা মুখ দেখে না হেসে পারলো না। বেশ শব্দ করে হেসে আগলে নিলো রোদকে বুকের মাঝে। রোদ ঠাই দাঁড়িয়ে। না জড়িয়ে ধরেছে আর না ই সরতে চেষ্টা করছে।

আদর পাগল এই মেয়ে। এই যে এখন আদ্রিয়ান থেকে আদর খাওয়ার জন্য ঠাই দাঁড়িয়ে কিন্তু মুখে বলছে না। আদ্রিয়ান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রোদের কাঁধে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো,
— কতটা আদুরে তুমি জানো এটা? পাগল হয়ে যাব তো আমি বউ।
— ছাড়েন।
— মন থেকে বলো।
— মন থেকেই বলছি।
— মিথ্যা। তোমার মন এখন চাইছে আমার থেকে আরো বেশি বেশি আদর পেতে।

রোদ চুপ রইলো। আসলেই এখন একটু আদর দরকার ওর। মাত্র বকা খেলো একটু আদর এখন হক ওর। আদ্রিয়ান হেসে রোদকে কোলে নিয়ে বেডে বসে চুমু খেয়ে বললো,
— আচ্ছা তোমার আবদার রাখলাম। কাল যাব। কিন্তু আমার কিছু কথা মেনে চলাবা ঠিক আছে?
রোদ বুক থেকে মুখ তুলে বললো,

— কি কথা।
আদ্রিয়ান মুখটা যথেষ্ট গম্ভীর করে বললো,
— আজ বাসায় কিছু গেস্ট আসবে। তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। কথা বলার দরকার নেই তেমন একটা। তাদের সামনেও যাবে না। কিছু বললে মুখের উপর উত্তর দিয়ে দিবে।
রোদ ভ্র কুচকে আগ্রহী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— এমন কে আসবে?
— আমার ফুপ্পি আসবে তার পরিবার নিয়ে।
— তাহলে এসব…
রোদের কথা কেড়ে নিয়ে আদ্রিয়ান বললো,
— আর কোন কথা না। যা বলেছি মনে রাখবে। ওকে জাদুপাখি?
— আচ্ছা।

সন্ধ্যার দিকেই আদ্রিয়ানের ফুপি হাজির পরিবার সমেত। দুই ছেলে মেয়ে সমেত হাসবেন্ড। ছেলে মেয়ে দুইজনেরই বয়স সেম সেম। রোদের বড়ই হবে দেখে আন্দাজ করলো রোদ। ফুপি বেশ গোছানো এবং দাম্ভিক দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে দুইজন আবার মিশুক আর উৎফুল্ল কিছুটা। এসেই আলিফ,মিশি আর মিশানের সাথে কথা বলছে হেসে হেসে। রোদ এসব এতক্ষণ কিচেন থেকে লক্ষ করছিলো হঠাৎ সাবার কন্ঠে ধ্যান ভাঙলো ওর। সাবা কিছু স্নেক্স বানাতে বানাতে রোদকে বললো,

— রোদ পুডিংটা বের করে টেবিলে রেখে আয় তো।
রোদ একবার সাবার দিকে তাকিয়ে পুডিং টেবিলে রাখতে গেলো তখনই ফুপির সাথে নজর মিলে গেলো। বেশ অসস্তিতে পরলো রোদ। আদ্রিয়ান তো কথা বলতে নিষিধ করেছে কিন্তু এভাবে সামনা সামনি পড়লে অন্তত সালামটা তো দেয়াই যায়। রোদ হালকা হেসে বললো,
— আসসালামু আলাইকুম ফুপি।
রোদ আশ্চর্য হলো যখন সালাম দেয়াতে ফুপি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। বেপারটা সবাই খেয়াল করলো। তখনই ফুপা বলে উঠলেন,

— ওয়ালাইকুম আসসালাম মামনি। আমাদের আদ্রিয়ানের বউ না? মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর তুমি মামনি। কেমন আছো?
রোদ যেন অসস্তি থেকে বের হলো। হেসে ঘাড় দুলিয়ে বললো,
— আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?
— এই তো মামনি তোমাকে দেখেই ভালো হয়ে গেলাম।
আদ্রিয়ানের ফুপাতো ভাই বোন দুইজন জারা আর জুরাইন ও বেশ মিশুক। রোদের সাথে অনেক কথা বললো। রোদ যেন আদ্রিয়ানের নিষেধাজ্ঞা ভুলেই গেলো। ফুপি বাদে বাকিরা এতটা সুন্দর আচরণ করলে কথা না বললে নিশ্চিত বেয়াদবি হয়ে যাবে।

সবাই টেবিলে খাচ্ছে। জুরাইন ঠান্ডা পানি চাইতেই রোদ গেলো কিচেনে আনতে। যেহেতু শুধু পানি আনবে তাই রোদ আর কিচেনের লাইট অন করলো না। ফ্রিজ খুলার আগেই হঠাৎ কোমড়ের দিকে পুরুষের হাতের বাজে স্পর্শ পেয়ে ঝটাক মে’রে চিৎকার করে উঠলো রোদ। রোদের চিৎকারে ছুটে এলো সবাই কিচেনে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই রোদ ঘামতে লাগলো। কিভাবে ই বা বলবে? এখানে কেউ তো ছিলো না তাহলে? রোদ পরিস্থিতি সামলাতে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

— তেলাপোকা উঠেছিলো পায়ে।
জুরাইন দুষ্টামি করে বললো,
— মেডিক্যালের স্টুডেন্ট ককরোচ ভয় পায়? হায় আল্লাহ।
রোদ কিছুটা তোতলাতে তোতলাতে বললো,
— হুট করে পায়ে উঠে গিয়েছিলো তাই।

সবাই বিশ্বাস করলো। বের হলো কিন্তু ফুপি কপাল কুচকে অবিশ্বাসের চোখে তাকালো রোদের দিকে। রোদ সে দিকে তাকিয়েই নজর ফিরিয়ে নিলো। রোদ তখনও ঠাই দাঁড়িয়ে আছে কিচেনে। বাসায় পুরুষ মানুষ বলতে আরিয়ান,শশুড়,জুরাইন আর ফুপা। আদ্রিয়ান গিয়েছে ডেকোরেশন এর কথা বলতে। তাহলে এটা কে ছিলো? ঘৃণায় যেন রোদের গা গুলিয়ে এলো। গটগট পায়ে রুমে ডুকে ফ্রকটা পাল্টে নিলো। মাথায় কিছুতেই ডুকছে না কে হতে পারে এটা। কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছে না। একবার ভাবলো সাবাকে জিজ্ঞেস করবে পরক্ষণেই আবার সেই চিন্তা বাদ দিলো। রাতে আদ্রিয়ানকে বলবে ভেবে নিলো রোদ।

আদ্রিয়ানকে সেই কথা বলবে ভাবলেও রাতে বেশ ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ডুকে আদ্রিয়ান। রোদ আদ্রিয়ানের সেই অবস্থায় সব ভুলে এগিয়ে এসে আদ্রিয়ানের শার্ট খুলে দিয়ে টাওয়াজ আর টাওয়াল ওয়াসরুমে রেখে বললো,
— আসুন। চেঞ্জ করে নিন।
আদ্রিয়ান ডুকতেই রোদ বের হতে নিলো ওমনিই আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে আটকে দিলো। রোদ তাকাতেই আদ্রিয়ান দুষ্ট হাসলো। রোদ বেশ জোরেই বললো,

— এই ভিজাবেন না আমাকে এই রাতের বেলা।
কে শুনে কার কথা। আদ্রিয়ান সাওয়ার অন করে ভিজিয়ে নিলো দুজনকে। রোদ তখন পুরোটা লেপ্টে আদ্রিয়ানের উন্মুক্ত লোমশ বুকে। আদ্রিয়ান দুষ্টামি করে শুধালো,
— এমনিতে আদর চাও অথচ আমি রোমান্টিক হলেই তোমাকে আর পাওয়া যায় না। পারো না বুকে ডুকে যাও।
রোদ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। দুইজন ভিজে লেপ্টে গেলো একজন আরেকজনের সঙ্গে। কিছুটা মিষ্টি মধুর মুহূর্ত কাটালো দুজন।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা চুলগুলো মুছতে ব্যাস্ত রোদ। গলায় চোখ যেতেই মিনমিন করে কয়েকটা গালি আদ্রিয়ানকে উৎসর্গ করলো।
আদ্রিয়ান টাওয়াল পেচিয়ে এসে বললো,
— ক্ষুধা লেগেছে রোদ।
— আমার মাথা খান।
— আমি কি করলাম? রেগে যাচ্ছো কেন?
রোদ মুখ কুঁচকে গলায় ইশারা করতেই আদ্রিয়ান দুষ্ট হেসে বললো,

— খেতে দাও নাহলে তোমাকেই খেয়ে ফেলবো।
রোদ চুল ভালো মতো মুছে ঘোমটাটা টেনে রুম থেকে বের হতেই ফুপির সাথে ধাক্কা লাগলো। ভদ্রমহিলা মুখের তালা এখনও খুলেন নি। রোদই ঝটপট করে বললো,
— সরি ফুপি আমি খেয়াল করি নি।
ফুপি গভীর ভাবে রোদকে পর্যবেক্ষণ করে মাথার দিকে তাকিয়ে বললো,

— লাজ লজ্জা নেই। বেশরম মেয়ে কোথাকার।
রোদের সাথে প্রথমবারে কথায় ই যে উনি এমন কথা শুনাবে তা ভাবে নি রোদ। লজ্জায়, অপমানে চোখে পানি জমলো। আদ্রিয়ান তখন রুম থেকে বের হয়ে রোদকে ফুপির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ফুঁসে ওঠে। তেড়ে এসে বললো,

— তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি? যাও খাবার বাড়ো।
রোদ তারতাড়ি চলে গেল নাহলে কেঁদেই ফেলতো হয় তো। ফুপি নরম কন্ঠে আদ্রিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,
— কেমন আছিস বাবা?
— আলহামদুলিল্লাহ। নিজের খেয়ে পড়ে সুখে আছি।
— আদ্রিয়ান বাবা আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি..
— এসেছেন। থাকুন বিদায় নিন। যা খুশি করুন। আমার পরিবারে নজর দিলো চোখ তুলে নিব এবার। এটা আমার বাবার টাকায় করা বাড়ী। মনে যেন থাকে।
— বাবা শুন আমি..

আদ্রিয়ান আর দাঁড়ানো প্রয়োজন বোধ করলো না। ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল। রোদ বাচ্চাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছে। সাবা আজ কিছুটা অসুস্থ। আরিয়ান ওকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছে। আদ্রিয়ান আসতেই রোদ প্লেট এগিয়ে দিলো। জুরাইন বসতে বসতে শয়তানি করে বললো,
— কি ব্যাপার ব্রো বিয়ে করেই রোম্যান্টিক হয়ে গিয়েছো।

আদ্রিায়ান ফুপাতো ভাই বোনের সাথে বেশ হেসেই কথা বলছে। রোদের একবার জুরাইন’কে সন্দেহ হলো পরক্ষণেই আবার নিজের ধারণাতে পানি ফেলে মিশি, আলিফকে খায়িয়ে দিলো। মিশান এসেও বসে আছে। রোদ খেতে বললেও সে খাবে না। না পেরে রোদ বাচ্চাদের খায়িয়ে মিশানকেও খায়িয়ে দিচ্ছে। মেহমানরা এতে বেশ অবাক। আদ্রিয়ান খেয়াল করেছে, মিশান এমনি সময় খাবারের সবজি কিছুটা ফেলে খেতো, ভাত একটু কম খেতো। তা নিয়ে আদ্রিয়ান ধমকাতো অনেক কিন্তু কাজ হতো না অথচ রোদের হাতে দিব্ব্যি খাচ্ছে এসব। মা’য়ের হাতের খাবার বলে কথা।

সাবারা তখনও আসে নি। মিশান,মিশি, আলিফকে মিশানের রুমেই ঘুম পারিয়েছে রোদ। বের হতেই জারার সাথে দেখা হলো। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে নিচে যায় রোদ। শশুর,শাশুড়ী, ফুপি, ফুপা, আরিয়ান,সাবার সাথে খেতে বসেছে রোদ। জুরাইন টেবিলে বসেই ফোন ঘাটছে। আদ্রিয়ান সোফায় বসে জারার সাথে কথা বলছে। নিজের পায়ে কারো পায়ের স্পর্শ পেয়ে রোদ চমকে গেলেও ভাবলো হয়তো ভুলে লেগেছে কিন্তু না এটা ভুলে না বরং ইচ্ছেকৃত। বারবার লাগাচ্ছে। রোদ পা সরিয়ে নিলেও আবার লাগছে।কাকে সন্দেহ করবে রোদ? জুরাইন বাদে কাউকে সন্দেহ হচ্ছে না অথচ জুরাইন বেশ দূরে ওর থেকে। রোদ পা সরিয়ে এবার উঠেই গেল। রাগে, দুঃখে কান্না আসছে ওর। শাশুড়ী ওকে জিজ্ঞেস করলো,

— রোদ মা খেলি না তো।
— মামনি আর খাব না । ভালো লাগছে না।
বলেই রোদ চলে গেল কিচেনে। ফুপি তাকিয়ে রইলো কিন্তু কিছু বললো না। বেশ বিরক্ত হলেন যেন। আদ্রিয়ান একবার তাকিয়ে রোদকে দেখে উঠে কিচেনে ডুকে কাঁধে হাত রাখতেই রোদ চমকে গিয়ে হাতে থাকা চামচ দিয়ে জোরে একটা বাড়ি মারলো আদ্রিয়ানের হাতে। আদ্রিয়ান ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলো। বাড়িটা বেশ জোরেই লেগেছে। রোদ ভয় পেয়ে গেল। সরি সরি বলতে বলতে এবার মেয়েটা কেঁদেই দিলো। আদ্রিয়ান হাত ঝেঁরে ওকে ধরার আগেই রোদ ঠান্ডা পানি নিয়ে আদ্রিয়ানের হাতে ঢালতে লাগলো। আদ্রিয়ান রোদকে থামিয়ে বললো,

— ঠিক আছে। কি হয়েছে বলো তো। এভাবে হামলা করলা যে?
— আমি..
রোদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফুপি কিচেনে ডুকে পড়লো। রোদ আদ্রিয়ানের সাথে বেশ লেগে দাঁড়িয়ে ছিলো। ফুপিকে দেখে সরতে নিলেই আদ্রিয়ান রোদকে নিজের সাথে চেপে ধরলো। কঠোর ভাবে বললো,
— বাইরে যান। আমি আমার বউয়ের সাথে আছি দেখেও কিভাবে ডুকলেন?

ফুপি ধীর পায়ে চলে গেল। রোদ বেশ চমকালো এবার আদ্রিয়ানের ব্যাবহারে। আজ পর্যন্ত আদ্রিয়ানকে কারো সাথে এমন ব্যবহার করতে দেখে নি ও। বরং আদ্রিয়ান সবসময়ই ঠান্ডা মেজাজে থাকে। দুই এক সময় রেগে যায় যেটা মানুষের স্বাভাবিক আচরণ তাছাড়া এভাবে নিজের ফুপির সাথে কথা বলাটা মানতে পারছে না রোদ। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আদ্রিয়ান বললো,

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৭ শেষ অংশ 

— রুমে আসো। নিচে যেন না দেখি।
কথাটা বলেই চলে গেল আদ্রিয়ান। এদিকে রোদ চিন্তায় পড়ে গেলো।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৯