ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৪

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৪
সাইয়্যারা খান

অচেনা জায়গায় সহজে ঘুম হয় না রোদের। সারারাত মেয়েটা এপাশ ওপাশ করেছে। শেষ রাতে আদ্রিয়ানের বুকেও কতক্ষণ মোচরা মোচরি করে পরে ঘুমালো। মিশি উঠে নিজেকে অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করে মায়ের বুকে ডুকে এদিকে ওদিকে তাকালো। রোদ শেষ রাতে ঘুমালেও ঘুম ছুটে গেলো। উঠতেই দেখলো আদ্রিয়ান ঘুম এখনও। রোদ মিশিকে ফ্রেশ করিয়ে দিলো। ওকে নিয়েই বের হলো রুম থেকে।

কিচেনে ডুকে পাশে উঁচু জায়গায় মিশিকে বসিয়ে রোদ ফ্রিজ হাতালো কতক্ষণ। কাল তো সব আনাই হ’য়েছে। কি দরকার আদ্রিয়ান উঠে বাইরের নাস্তা আনার তার থেকে রোদ নিজেই নাস্তা বানানোর কাছে লেগে গেলো। পরটা, ডিম ভাজা, কফি। রোদ আর কিছু করতে পারলো না এত তাড়াতাড়ি। পরটা বানানোর সময় মিশি বায়না ধরলো সেও বানাবে। রোদ একটু আটা মিশির হাতে দিয়ে দিলো। ছোট্ট মিশি ছোট ছোট দুইটা রুটি বানালো ত্যারা ব্যারা করে। রোদ সেগুলোও ভেজে দিলো। টেবিলে সব রাখছিলো তখনই আদ্রিয়ান বেরিয়ে এলো। পরণে এখনও রাতের পোশাক। রোদ তাকিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— ফ্রেশ হয়ে আসুন একেবারে।
আদ্রিয়ান ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
— তুমি কেন এসব করতে গেলে?আমি ই তো আনতাম।
আদ্রিয়ানের পুরুষনালী ঘুম জড়ানো কন্ঠটা বেশ লাগলো রোদের নিকট। কেমন নেশালো কন্ঠ। মন মাতানো কন্ঠ। রোদেকে আকর্ষণ করলো আদ্রিয়ানের এমন কন্ঠ। আসলে ভালোবাসার মানুষের সবই ভালোলাগে। আকর্ষণীয় লাগে।
উত্তর না পেয়ে আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে মিশিকে কিচেন থেকে কোলে তুলে বললো,

— কি হলো রোদ?
চমকালো রোদ। কি লজ্জা! কি লজ্জা! কারো ঘুম জড়ানো কন্ঠও কাউকে আকর্ষণ করে? রোদের গাল দুটো গরম হয়ে গেল। আদ্রিয়ানের দিকে না তাকিয়েই বললো,
— ঘুম ভেঙে গেল তাই বানিয়ে নিলাম আমরা।
বলে মিশিকে টেবিলে বসিয়ে দিলো। আদ্রিয়ান চলে গেল রুমে। রোদ চুলায় আবার দুধ গরম বসালো মিশির জন্য। আদ্রিয়ান এসে বসেই ডাকলো,

— রোদ?
— কি?
— আসো। কি করছো?
রোদ দুধ হাতে আসতেই মিশি বাবাকে বললো,
— বাবাই আমি রুটি বানিয়েছি।
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকালো রোদের দিকে। রোদ বসে আদ্রিয়ানের প্লেটে তেরাবেকা ছোট্ট একটা রুটি দিয়ে বললো,
— আপনার রাধুনি মেয়ে বানিয়েছে।

আদ্রিয়ান অবাক চোখে তাকালো মেয়ের দিকে। মিশি বাবার প্রশংসার আশায়। আদ্রিয়ান একবারে একটু ডিম দিয়ে পুরোটা মুখে পুরে নিলো। ওর মনে হচ্ছে এটা হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু রুটি ছিলো। আদ্রিয়ানের নিজের মেয়ে বানিয়েছে বলে কথা। ছোট আরেকটা আদ্রিয়ান নিতে গেলে রোদ আদ্রিয়ানের হাতে আলত চাপড় মেরে বললো,
— এই এটা ধরেন ক্যান হ্যাঁ? ছোঁচা নিজেরটা খেয়ে আমারটায় নজর দেয়।
— আমি ছোঁচা?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আদ্রিয়ান। রোদ মুখ ভেংচি দিয়ে ঐ টা নিজের মুখে ভরে আদ্রিয়ানকে খাবার বেরে দিয়ে মিশিকে খায়িয়ে দিলো। আদ্রিয়ান খেতে খেতে বললো,
— ছুঁচি।

— মাম্মা তোমার গলায় লাল লাল কি?
আদ্রিয়ান অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো এমন সময় মিশির কথায় আদ্রিয়ান ও ঘুরে তাকালো পরক্ষণেই আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। রোদ আয়নায় নিজেকে দেখেই কটমটিয়ে আদ্রিয়ান দিকে তাকিয়ে বললো,
— এগুলো কি করেছেন?
— বাইট দিয়েছি।
আদ্রিয়ান এমন সোজা উত্তর পছন্দ হলো না রোদের। মিশি আবারও জিজ্ঞেস করতেই রোদ বললো,
— তেলাপোকা কামড়ে দিয়েছে মা।
মিশি ভয় পেয়ে বললো,

— মাম্মা মিশি এখানে থাকবে থাকবে না। আমি ভয় পাই তেলাপোকা।
আদ্রিয়ান চোখ রাঙিয়ে তাকালো। ওকে কি না এই মেয়ে তেলাপোকা বানালো শেষ মেষ? এই ছিলো জীবনে? রোদ আদ্রিয়ানের দৃষ্টিতে পাত্তা না দিয়ে বললো,
— এটা পঁচা বড় তেলাপোকা ছিলো মা। আমি রাতেই ফেলে দিয়েছি। আর নেই।
তবুও মিশির ভয় কমলো না ততটা। মায়ের গলায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। আদ্রিয়ান রোদের কানে ফিসফিস করে বললো,
— রাতে দেখাবো এই তেলাপোকা আর কি কি করতে পারে।
রোদ পাত্তা না দিয়ে বললো,

— আজ নাহয় আমার ক্লাস নাই কাল কি করবেন?মিশিকে কে রাখবে?
— কালকের টা কালকে দেখা যাবে। এই বুয়া এখনও আসছে না কেন?
তখনই ফোন এলো। জানতে পারলো বুয়া আসবে না যাকে রান্নার জন্য বলার হয়েছে। হতাশ হলো আদ্রিয়ান। রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমি দুপুরের খাবার নিয়ে আসবে নে আজ।
রোদ অসন্তুষ্ট হয়ে বললো,
— রোজ রোজ এগুলো খাওয়াই এরপর মিশি অসুস্থ হোক।
— আচ্ছা আচ্ছা রেগে যাচ্ছো কেন? আমি এসে রান্না করব নে।
রোদ হালছেড়ে দিলো। বেডে বসে বললো,

— আমি ই পারবো কিন্তু তবুও বলছি এইসব অহেতুক কাজ করে কি লাভ হচ্ছে আপনার?
আদ্রিয়ান উত্তর দিলো না। এগিয়ে এসে মিশিকে চুমু খেয়ে রোদের হাত ধরে দরজা পর্যন্ত যেয়ে বললো,
— কেউ আসলে খুলবা না আর আশেপাশের কারো সাথে কথা বলার দরকার নেই। আমি দুপুরেই আসব।
রোদ মাথা নাড়লো। আদ্রিয়ান ওর ঠোঁট টেনে দিয়ে বললো,
— ভালো বউ।

আদ্রিয়ান যেতেই রোদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই পুরো একটা ফ্লাটে মিশিকে নিয়ে একা ও। কি আর করবে এই খাটাস ব্যাটার আলাদা সংসার করার সখ জেগেছে। মিশিকে সোফায় বসিয়ে রোদ টুকটাক কাজ শুরু করলো। মিশি উঠে আবার মায়ের কাছেই ঘেঁষছে। এতবছর জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থেকে হুট করে একা একা থাকাটা রোদই মানতে পারছে না সেখানে মিশি তো ছোট বাচ্চা। আলিফের সাথে সারাদিন খেলতো। রোদ ফোন দিলো সাবাকে। বললো যাতে আলিফকে এখানে পাঠিয়ে দেয়। সাবার সুবিধাই হলো। কয়েকদিন ধরে ছেলেটা মনমরা হয়ে থাকে।

আলিফকে আরিয়ান দিয়ে চলে গিয়েছে। হসপিটালে ডিউটি আছে ওর। রোদের চিন্তা কিছুটা কমলো। আলিফ আর মিশি খেলতে ব্যাস্ত। রোদ রান্না বসিয়ে দিলো। পাক্কা গৃহিণী লাগছে এই মুহূর্তে ওকে। গরমে রোদের গোল চেহারায় ফোলা ফোলা গাল দুটো লাল হয়ে গেলো। তখনই কলিং বেল বাজলো। মাথায় উরনা দিয়ে রোদ না দেখেই দরজা খুলে দিলো। সামনে দাঁড়িয়ে এক ২৪/২৫ বছরের যুবক। ছেলেটা বেশ চটপটে। রোদকে দেখেই বললো,

— হ্যালো মিস. চিনি হবে? আসলে কফি খাব। চিনি নেই। আম্মুও বাসায় নেই।
রোদ মিষ্টি করে হেসে বললো,
— ইটস মিসেস। আর কফি করাই আছে চাইলে দিতে পারি।
ছেলেটা খুশিই হলো। কফি ও নিজেও বানাতে পারে না কিন্তু এই মুহূর্তে ভিষণ দরকার। রোদ ওনাকে দরজায় দাঁড়াতে বলেই ফ্লাস্কে থেকে এক মগ কফি ঢেলে ছেলেটাকে দিলো। ছেলেটা ধন্যবাদ দিয়ে আরো কিছু বলতে চাইলেই রোদ বললো,

— কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে ভাইয়া। বায়।
ছেলেটা যেতেই রোদ দরজা লাগিয়ে দিলো।
সব কাজ শেষ করে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে নিজেও গোসল করে নামাজ পড়ে নিলো তবুও আদ্রিয়ানের আতা পাতা নেই। ফোন হাতে নিলো কল দিবে বলে তখনই দেখলো আদ্রিয়ানের চারটা মিসড কল। রোদ ব্যাক করতেই আদ্রিয়ান বললো,

— কখন থেকে কল করছি?
— খেয়াল করি নি।
— কে এসেছিলো?
রোদ অবাক হলো। আদ্রিয়ান কিভাবে জানলো? তবুও বললো,
— পাশের ফ্ল্যাটের কেউ। চিনির জন্য।
— ওহ্। আমি কিন্তু খুলতে না বলেছিলাম।
রোদ জিহবায় কামড় দিয়ে বললো,

— সরি ভুলে গিয়েছিলাম।
— আচ্ছা সোনা তুমি খেয়ে নাও। আমার আজ দুইটা মিটিং পরে গিয়েছে। লেট হবে।
— খেয়েছেন?
— খাব। তুমি খেয়ে নাও।
— আচ্ছা।
কল কেটে রোদ একা একাই খেতে বসলো। এই প্রথম হয়তো জীবনে ও একা খাচ্ছে। চেয়েও তেমন খেতে পারলো না। রুমে ডুকে বই নিয়ে বাচ্চাদের পাশে বসে পড়ায় মনোযোগ দিলো।

দিশা ইদানীং ভয়াবহ ভাবে জ্বালিয়ে মারছে রাদকে। রাদ যে ওকে এতটা রাগ দেখায় তাতে এই মেয়ের কোন হেলদুল নেই। বিয়ে করবে রাদ এনিয়ে দুই দিন শোক পালন করেছে এই মেয়ে। এখন আবার যেই লাউ ওই কদু। আসলে দিশা শেষ চেষ্টা করছে যদি আবার পরে আফসোস হয় যে কেন আরেকটু চেষ্টা করলাম না? করলে হয়তো রাদের মনে ওর জন্য ভালোবাসা জন্মাতো। কিন্তু ইহকালেও এটা হবার নয়। রাদের চোখে দিশা নিজের জন্য কিছুই দেখে না।

না কোন অনুভূতি। না কোন চাওয়া-পাওয়া। অথচ দিশার পুরো সত্তা জুড়ে এই বদ ছেলের বসবাস। এই যে দিশা এমন ছটফট করে,অতিরিক্ত কথা বলে,এত অপমানিত হয়েও রাদের পিছু ছাড়ে না তা বুঝি এমনিই? মানুষ যখন অতিরিক্ত দুঃখে থাকে তখন কেউ কেউ নীরবতাকে নিজের সঙ্গী করে নেয় আবার কেউ কেউ বাঁচাল হয়ে যায়। দিশা নীরবতা নয় বরং অতিরিক্ত কথা বলে নিজের অনুভূতিগুলো ডাবিয়ে রাখে নাহলে কবেই ভাঙা মন নিয়ে প্রস্থান ঘটতো ওর।

রাদ বিয়ে করবে এ নিয়ে পুরোবাড়ী মাতামাতির মধ্যে আছে। রোদ তো শুনেই মহা খুশি। ভাঙতে ভাঙতে গড়েছে এই বিয়ে। রাদের মতো বোন পাগল ভাই কখনোই মামির ওমন আচরণের পর জাইফাকে বিয়ে করত না। রোদ কতশত বুঝানোর পর ইমোশনাল ব্লেকমেল করে রাজি করিয়েছে ওকে।

আলিফ চলে গিয়েছে সেই কখন। আরিয়ান বাসার যাওয়ার সময় নিয়ে গিয়েছে। রোদ রেখে দিতে চাইলেও আরিয়ান রাখে নি। এতটুকু তো আরিয়ানও জানে রোদ মিশিকে সামলাতেই দুই একসময় হিমশিম খায় সেখানে আজ সারাদিন দুইটা বাচ্চা সামলানো তো মুখের কথা না। রোদকে বুঝিয়ে বলাতে রোদও আর জেদ করে নি। গাল ফুলিয়ে ছিলো আলিফ। রোদ বলে যাতে আবারও দিয়ে যায়।
মিশিকে সাথে নিয়ে বেশকিছুক্ষণ ভিডিও কলে কথা হলো মিশানের সাথে। মিশান এসবের কিছুই জানতো না অবশেষে জারবাকে বলে,

— পুত্তি তুমি যদি সত্যি করে বলো তাহলে তোমাকে আর পুত্তি ডাকবো না আমার বায়োলজি সাবজেক্টের কসম।
সহজ সরল জারবা প্রথমে দেনামনা করলেও মিশনের কথায় গলগলিয়ে সব বলে দেয়। সবশুনে মিশান বললো,
— আচ্ছা পুত্তি এখন রাখি।
জারবা রেগে লাল হয়ে বললো,
— আবার পুত্তি?
— আমার বায়োলজি পরিক্ষা শেষ। পরিক্ষা ভালো দিয়েছি তাই ফেল করার চান্স নেই।
— মিশাইন্না!

মিশান কল কেটে দেয়। জারবা রাগে ফুসতে থাকে। ও এত বোকা কেন? ইয়াজও ওকে বোকা প্রেমিকা বলে ডাকে। এক জায়গার রাগ জারবা উঠালো আরেক জায়গায়। ইয়াজের কল ধরলো না। যার ওকে বোকা বলে এমন কারো সাথে কথা বলবে না জারবা। ইয়াজ পরলো ঝামেলায়। কল দিলো রোদকে। রোদ রিসিভ করতেই কানে এলো ইয়াজের রাগান্বিত স্বর,
— এই তোর ননদ কল ধরে না ক্যান? শ্যালার ছোট মেয়ের সাথে প্রেম করেই পাপ হইসে আমার। ফোন দে ওরে।
রোদ প্রথমে অবাক হলেও পরেই দাঁত কিড়মিড় করে হেসে বললো,

— প্রেম করার সময় আমায় বলসিলা চান্দু? এখন আসছে আমার কাছে আর গাধার বাচ্চা ননদ কই পাব এখন? আমার জামাই না তোকে দিয়েই আলাদা সংসার পাতালো আমার।
— তুই কিন্তু আব্বুকে গাধা বল্লি।
— উপস সরি। গাধার বাচ্চা না। আঙ্কেলের বাচ্চা গাধা হবে।
ইয়াজ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,
— বইন ওরে কল দে। আমার কল ধরে না ক্যান। কেমনটা লাগে বল? সারাদিন খেটে মরি আমি আর রাগ দেখায় ও।
রোদ এবার সিরিয়াস হয়ে বললো,

— আচ্ছা মন খারাপ করে না আমার একমাত্র বন্ধু। এখনই তেমার লাইলীকে কল লাগাচ্ছি।
ইয়াজ হাসলো। এই বান্ধবীটা ওর অনেক সখের। মন ভালো করার মাধ্যম একটা৷
রাত মোটামুটি ভালোই হলো তবুও আদ্রিয়ান আসছে না। না পেরে মিশিকে খায়িয়ে শুয়িয়ে রাখলো রোদ। বই পড়ছে সেই কখন থেকে তাই বই অফ করে কল দিলো আদ্রিয়ানকে কিন্তু অপরপাশ থেকে বজ্জাত মহিলা সুরেলা কণ্ঠে বরাবরই বলে যাচ্ছে, এই মুহূর্তে রোদের জামাইয়ের ফোনে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়। রোদের একটু একটু টেনশন হচ্ছে।

ঐ বাসায় এমন লেট হতো মাঝে মধ্যে কিন্তু তখন এতটা টেনশন লাগতো না যতটা আজ এই মুহূর্তে লাগছে। রোদ অতিরিক্ত টেনশনে নখ কাটছে দাঁত দিয়ে। হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই রোদ এক দৌড়ে গেলো দরজা খুলতে। নিশ্চিত আদ্রিয়ান এসেছে। রোদ পুরো দমে প্রস্তুত আদ্রিয়ানের বুকে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পরবে। যেই না দরজা খুললো ওমনিই যেন প্রবল ঝর এসে এক ধাক্কায় থামিয়ে দিলো রোদকে। ইশ কি লজ্জা। এ জন্যই আদ্রিয়ান বারবার বলে দরজা খুলার আগে দেখে নিতে।

রোদের সামনে হাতে কাপ নিয়ে, মুখে এক বস্তা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সকালের সেই ছেলেটা। রোদ অপ্রস্তুত হয়ে ইতস্তত করে বললো,
— জ্বি ভাইয়া চিনি লাগবে?
ছেলেটার হাসি বাড়লো আরেকটু। হাসিটা মারাত্মক সুন্দর। ঘড়ে একটু উঁকি দিলো ছেলেটা।রোদ চেপে দাঁড়ায়। চটপটে কন্ঠে ছেলেটা বললো,

— তোমার কফিটা অনেক ভালো ছিলো। মাথা ব্যাথা একদম ফুড়ুৎ হয়ে গিয়েছিলো। এই নাও কাপ। একদিন দাওয়াত দিয়ো কফিতে। অনেক ধন্যবাদ মিসেস…
ছেলেটা মনে করার চেষ্টা করলো রোদের নাম কিন্তু মনে পরলো না। পড়বে কিভাবে রোদ তো বলেই নি ওর নাম। ছেলেটা মাথা চুলকে কিছু ভাবছে তখনই পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে শুনা গেলো,

— মিসেস.আদ্রিয়ান। আর তুমি না আপনি হবে।
রোদ আর ছেলেটা দুইজনই মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। রোদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো আদ্রিয়ানকে দেখে। ছেলেটা হেসে কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান আবার বললো,
— গুড নাইট ম্যান।
আর কিছু বলার বাকি রইলো না ছেলেটার। মুখটা চুপসে গেলও আবারও হাসি দিয়ে বললো,
— গুড নাইট লাভ বার্ডস।

ছেলেটা পাশের ফ্ল্যাটে ডুকতেই রোদ ঝাঁপিয়ে পরলো আদ্রিয়ানের বুকে। ক্লান্ত আদ্রিয়ান দুই পা পিছিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে জড়িয়ে ধরলো ভালোবাসাকে। সারাদিনের ক্লান্তি যেন এখানেই শেষ হয়ে যায়। মরুর বুকে বৃষ্টির আবির্ভাব ঘটে। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলো আদ্রিয়ান। চেনা চেনা ঘ্রাণটা ভেসে আসলো নাসারন্ধ্রে। রোদের এক হাত ধরে বললো,
— ঘেমে আছি তো সোনা।
— তাতে কি?

রোদের সোজা উত্তর। আদ্রিয়ান প্রশান্তির হাসি হাসলো। রোদ ততক্ষণে ছেঁড়ে সরে দাঁড়ালো। গাল ফুলিয়ে বললো,
— এতক্ষণ লাগে আসতে? ফোন কেন অফ আপনার? টেনশন হয় না আমার।
বলে আদ্রিয়ানের হাত থেকে ল্যাপটপ ব্যাগটা নিজের হাতে নিলো। আদ্রিয়ান ভেতরে ডুকে দরজা লাগিয়ে সোফায় হেলান দিলো। রোদ ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা লেবুর শরবত এনে আদ্রিয়ানের হাতে দিলো। আদ্রিয়ান এক ঢোকে পুরোটা খেয়ে নিলো। এখন শান্তি লাগছে কিছুটা। রোদ বুঝলো আদ্রিয়ান ক্লান্ত তাই বেশি না ঘেটে বললো,
— আসুন ফ্রেশ হন।

আদ্রিয়ান উঠে ওয়াসরুমে ডুকতেই দেখলো ওর টাওয়াল,টাউজার রাখা সেখানে। আদ্রিয়ানের নিজেকে সুখী সুখী মনে হয় যখন রোদ আদ্রিয়ানের এই ছোট ছোট কাজ গুলো এগিয়ে রাখে। মায়ের পর আজ পর্যন্ত কে ই বা করেছে এইসব আদ্রিয়ানকের জন্য? আদ্রিয়ান রুমে ডুকেই মিশির সাথে শুয়ে পরলো। রোদ ততক্ষণে ব্যাস্ত পায়ে রুমে ডুকলো হাতে খাবার নিয়ে। আদ্রিয়ানকে শুয়ে থাকতে দেখেই খাবার সাইডে রেখে পাশে বসলো। ভেজা চুলের ভাজে আঙুল চালিয়ে দিলো। আদ্রিয়ান চোখ খুলে তাকাতেই রোদ দেখলো আদ্রিয়ানের ক্লান্তি মাখা মুখ। সেই মুখে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললো,

— খাবেন। উঠুন।
এমন আদর আদর কন্ঠে যেন আদ্রিয়ানের ভেতরটা ভালোলাগায় ভরে গেলো। আরেকটু আদরের লোভে মাথা তুলে দিলো রোদের কোলে। রোদ পাশ থেকে টাওয়াল তুলে মুছে দিলো আদ্রিয়ানের ভেজা চুল। আদ্রিয়ান ইদানীং বড্ড বেশি লোভী হয়ে যাচ্ছে। ও রোদকে আদর দিবে কি উল্টো ওর নিজের আদর খেতে মন চায় রোদ থেকে। রোদের এটেনশনে থাকতে চায় সারাক্ষণ। রোদের আদর লাগিয়ে বলা কথা শুনতে মন চায়।বাচ্চাদের মতো বায়না ধরতে মন চায় রোদের থেকে। সুখী সুখী খুনসুটিময় সংসার করতে মন চায়। রোদ আদ্রিয়ানের কপালে, গালে আদুরে হাত বুলিয়ে বললো,

— উঠুন এবার। খাবেন না? কয়টা বাজে?
— উহু।
বলেই রোদের পেটে মুখ গুজে দিলো। কেঁপে উঠল রোদের ভিতর। আদ্রিয়ানকে ঠেলে ঠুলে উঠিয়ে নিলো। নিজেই ভাত মেখে মুখে তুলে দিলো। আদ্রিয়ান মন ভরে খাচ্ছে আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে রোদকে। রোদ খাওয়ার মাঝে বললো,
— কেমন হয়েছে বললেন না?
আদ্রিয়ান মুখেরটুকু শেষ করে বললো,
— অনেক মজা।

রোদ প্রশংসা শুনে খুশি হলো। আদ্রিয়ানকে খায়িয়ে নিজেও খেয়ে নিলো। সব গুছিয়ে রেখে রুমে আসতেই দেখলো চোখ বন্ধ করে মিশির পাশে হেলান দেয়া। রোদ এগিয়ে এসেই বললো,
— পায়ে আবার ব্যাথা হচ্ছে?
চোখ খুললো আদ্রিয়ান। না বললেও রোদের কেন জানি বুঝতে দেড়ী হয় নি। নিজেই আদ্রিয়ানের পা পাড়িয়ে দিলো। মাথায় চুল টেনে দিলো। পুরো এক ঘন্টা বউয়ের সেবা পেয়ে আদ্রিয়ান যেন চাঙ্গা হয়ে গেল। রোদকে ধরে নিজের পাশে বসিয়ে বললো,

— আজ দুইটা মিটিং ছিলো ফরেইন বায়ারদের সাথে। এর উপর আবার কিছু ইনভেস্টরদের সাথেও কাজ ছিলো। আবার বিকেলে গেলাম সাইডে। এসব করতে করতে জান শেষ আজ।
রোদ মনোযোগ দিয়ে শুনলো সব। আদ্রিয়ান ওর তাকালো। কত মনোযোগ দিয়ে শুনছে এই মেয়ে। আবার গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— আজ কতকরে বলে গেলাম দরজা খুলতে না। দুই বার খুলেছো।
রোদ অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বললো,
— প্রথমবার ভুলে গিয়েছিলাম আর দ্বিতীয় বার ভেবেছি আপনি এসেছেন।
আদ্রিয়ান টেনে নিজের উন্মুক্ত বক্ষে নিয়ে নিলো রোদকে। ঠোঁটে বেশ সময় নিয়ে চুমু খেয়ে বললো,
— এর জন্য এমন মুখ কালো করতে হয়? বোকা আমার।

রোদ মুখ ডুবিয়ে দিলো আদ্রিয়ানের লোমশ বুকে। শ্বাস টেনে নিলো নিজের ভেতর। ওর এই আদ্রিয়ানকে দেখলেই আদর আদর লাগে। প্রচুর আকর্ষণ লাগে। শুধু ছেলেদের ই যে মেয়েদের প্রতি এমন আকর্ষণ হয় তা কিন্তু নয়। মেয়েদের ও প্রচুর আকর্ষণ হয়। আদ্রিয়ান শক্ত পুরুষ বলে নিজেকে আয়ত্তে রাখতে পারে অথচ রোদের অনুভূতি, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম আকর্ষণ সব এই আদ্রিয়ানকে ঘিরে।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৩

আদ্রিয়ান যে বুঝে না তা নয় কিন্তু ও সময় দিতে চাচ্ছে রোদকে। পরে না আবার এ নিয়ে আফসোস হয়। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে সামলে চলে আদ্রিয়ান কিন্তু ইদানীং রোদের এমন আচরণে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ে ওকে পরদে পরদে জ্বালিয়ে মারছে। এই যে এখনও বুকে শুয়ে শুয়ে আদর লাগাচ্ছে। এখন যদি আদ্রিয়ান বেসামাল হয়ে যায়? তখন দোষটা কার হবে?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৫