ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৩

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৩
সাইয়্যারা খান

রোদের সামনেই কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিশান আর ওকে ধরে আছে রোহান৷ মিশানের কপাল বেয়ে বেয়ে র*ক্ত পড়ছে। হাত দিয়ে চেপে ধরায় আঙুলের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে চুয়ে চুয়ে র*ক্ত গড়িয়ে পরছে। আদ্রিয়ান প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। রোদ সাইড হয়ে দাঁড়িয়েই আছে। এমনিতেই র*ক্তে ওর হালকা পাতলা ফোবিয়া কাজ করে। এ নিয়েই টেনশনে থাকে মেডিক্যালে এনাটমিতে কি করবে তাই ভেবে পায় না রোদ। এখানে মিশানের এমন অবস্থা দেখে ওর মাথা যেন ঘুরে উঠলো। আদ্রিয়ান তারাতাড়ি মিশানকে নিয়ে সোফায় বসালো। রোহান বিচলিত আদ্রিয়ান’কে দেখে বলে উঠলো,

— ভাইয়া ডক্টর আসছে। নিচে ফার্মেসীতে বলে এসেছি।
আদ্রিয়ান মিশানের কপালে পাশে থাকা রোদের উরনাটা চেপে ধরে বললো,
— বাবা বেশি ব্যাথা করছে?
— অল্প।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিশান ধীর কন্ঠে উত্তর দিলো। মাথায় আঘাত লাগাতে ওর মাথা ঝিমিয়ে উঠছে যেন। রোদ তারাতাড়ি এগিয়ে বরফ নিয়ে এলো। ডক্টর এখনো আসছে না দেখে আদ্রিয়ান বিচলিত হলো। রোদ মিশানের মাথায় ভেজা তুলা দিয়ে পুরোটা মুছতেই দেখলো বেশি কাটে নি। সামান্য কিন্তু ব্লাড বেশি বের হয় হ’য়েছে। রোদ নিজেই পুরোটা ক্লিন করে দিলো কিন্তু ব্যান্ডেজ ছাড়া হবে না এটা। মিশান আদ্রিয়ানের কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছে। আদ্রিয়ান ছেলেকে শক্ত করে ধরে আছে। ততক্ষণে ডক্টর এলো। ব্যান্ডেজ করতে করতে জানতে পারলো, সাইকেল চালাতে গিয়ে পরে গিয়ে এটা হ’য়েছে।রোদ রোহানের উপর চটে গেল। এই ছেলে’ই মিশান’কে নিজের সাইকেল দিয়েছে। মিশানের ব্যান্ডেজ করা শেষ। আদ্রিয়ান রোদকে থামানোর চেষ্টা করে বললো,

— রোদ এতে রোহানের দোষ নেই।
রোদ চোখ ঘুরিয়ে আদ্রিয়ান’কে দেখে নিয়ে বললো,
— উনি সাইকেলটা না দিলে তো এমন হতো না তাই না?
আদ্রিয়ান রোদ’কে চুপ থাকতে বললেও কাজ হয় নি। মিশানকে টিটিনাস দিতে হবে। একথা শুনেই এত বড় ছেলে কেঁদে কেটে অস্থির। আদ্রিয়ান শক্ত করে বুকে চেপে ধরে রাখলো ওকে। রোদ পাশে বসে হাত ধরে বললো,

— বাবা কিছু হবে না। কাঁদে না।
মিশান বাবা’কে ছেড়ে রোদকে ধরে কেঁদে দিয়ে বললো,
— আমি সুই দিব না। কিছু হবে না।

রোদ আদ্রিয়ানের দিকে তাকালো। আদ্রিয়ান উপায়ন্তর না দেখে শক্ত করে মিশানকে বুকে চেপে ধরলো। রোদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডক্টরকে ইশারা করতেই উনি পুশ করে দিলেন।যেই না পুশ করলো ওমনি গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো মিশান। এই ছেলে যে ইনজেকশন এত ভয় পায় তা রোদ ভাবেও নি। মিশানের কান্নার শব্দে মিশি দৌড়ে বাইরে এলো। ভাইকে এভাবে মা-বাবার আদর খেয়ে খেয়ে কাঁদতে দেখে ছোট্ট মিশিও কেঁদে উঠলো। মিশির কান্না কানে আসতেই মিশান থেমে গেল। হিচকি তুলতে তুলতে মিশান বললো,

— বাবা মিশি কাঁদে কেন?
রোদ উঠে মিশিকে কোলে তুলে নিলো। আদর করে থামিয়ে রুমে দিয়ে এসে বললো,
— সব ফুল আনোতো মা। মাম্মা এখনই আসছি।
আদ্রিয়ান টাকা এনে ডক্টর’কে বিদায় করলো। রোহান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মিশানও দুর্বল কন্ঠে বললো,
— মা রোহান ভাইয়ার দোষ নেই। আমি জোর করে নিয়েছিলাম। তাকে বকো না প্লিজ।
রোদ মিশানের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না আর। আদ্রিয়ান আসতেই রোহান বিদায় নিলো নিচু স্বরে। আদ্রিয়ান দরজা পর্যন্ত যেতে যেতে বললো,

— কিছু মনে না।
— প্রচুর রেগে আছে।
রোহান মিনমিন করে বললো। আদ্রিয়ান হেসে ওর পিঠ চাপড়ে বললো,
— একটু পর কি নিয়ে রেগেছে সেটাই ভুলে যাবে।
রোহান ও এবার হেসে দিলো। আদ্রিয়ান দরজা লাগিয়ে এসে দেখলো রোদ মিশানের হাত-পা চেক করছে। মিশান বারবার বলছে,

— সত্যি আর কোথাও ব্যাথা পাই নি তো।
রোদ সন্দিহান গলায় বললো,
— সাইকেল থেকে পড়ে শুধু মাথায় নিশ্চিত মাথায় ব্যাথা পাও নি।
মিশান ঢোক গিললো। আদ্রিয়ান এসে মিশানকে কোলে তুলে নিলো। রুমে নিতে নিতে রোদকে বললো,
— মিশিকে দেখো তো। এখনও বারান্দায় মনে হচ্ছে।
রোদ তখনও সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইলো। পরপর হাটা দিলো মিশিকে দেখতে।
আদ্রিয়ান মিশানকে বেডে শুয়ে দিয়ে বললো,

— এবার সত্যি করে বলো আর কোথায় ব্যাথা পেয়েছো?
মিশান মুখটা একটু করে উত্তর দিলো,
— হাটুতে আর কুনুই’তে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আদ্রিয়ান বললো,
— মা’কে কেন বললে না?
— এমনিতেই কাঁদছিলো। এটা দেখলে আমার খবর করে ছাড়তো।
আদ্রিয়ান হাসলো শব্দহীন। আলমারি থেকে মিশানের ড্রেস বের করে চেঞ্জ করতে সাহায্য করলো। এসিটা অন করে দিয়ে বললো,

— চোখ বন্ধ করে থাকো। আসছি আমি।
আদ্রিয়ান যেতে যেতেই রোদ ফট করে রুমে ডুকলো। হাতে এনটিসেপ্টিক। রুমে ডুকেই দেখলো মিশান থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়া। ছিলে যাওয়া হাটু স্পষ্ট দেখতে পেলো রোদ। পাশে বসে মলম লাগাতে নিলেই মিশান ফট করে চোখ খুললো। রোদকে দেখে চমকে তাকাতেই রোদ শান্ত কন্ঠে বললো,
— আর কোথায়?

মিশান কুনুই দেখালো। রোদ আলতো হাতে মলম লাগিয়ে কিছু না বলে উঠে যেতে নিলেই ওর ওরনার কোনা চেপে ধরলো মিশান। রোদ ঘুরে তাকিয়ে বললো,
— কিছু বলবে?
মিশান ছলছল চোখ করে বললো,
— কথা বলো না কেন?
রোদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এই ছেলের সাথে রেগে থাকা যায় না। একদম বাবার মতো হ’য়েছে। রোদ পাশে বসে গাল ফুলিয়ে বললো,

— আমি তো কেউ না। বাবাকে ব্যাথা বলা যায়। আমাকে না?
মিশান রোদের কোলে মাথাটা তুলে দিয়ে বললো,
— তুমিতো কাঁদছিলে তাই।

বেশ সময় নিয়ে মিশান ঘুমোতেই রোদ উঠলো। পা বাড়িয়ে বাইরে যেতেই আদ্রিয়ানের সাথে ধাক্কা খেলো। হকচকিয়ে যেতেই কারো শক্ত বন্ধনীতে আবদ্ধ হলো। সুপরিচিত সেই আলিঙ্গনে আপ্লুত হয়ে গেল রোদ। আদ্রিয়ান যেন নিজের বুকে পিষে ধরলো রোদকে। রোদ ও দুই হাতে ঝাপটে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিলো। আদ্রিয়ান রোদের কোমড় চেপে উঁচু করে নিলো। হেটে হেটে সোফার রুমে যেতেই রোদ ফট করে বললো,
— নামান আমাকে। মিশি এখানে না?

আদ্রিয়ান কথাটা যেন শুনলোই না। পা তার থেমে নেই সোজা ড্রয়িং রুমের বরাবর বড় থাইটা খুলে দিলো। রোদকে নিয়ে ওখানে গিয়ে নামিয়ে দিলো। রোদ নামতেই আদ্রিয়ান দেয়ালে পিঠ এলিয়ে বসে পরলো পা ছড়িয়ে। রোদের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিলো এমন ভাবে যেন কোন বাচ্চা’কে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। রোদ নজর এদিক ওদিক ঘুরালো। মিশির দেখা পেলো না। চঞ্চল পায়ে ছুটে এলো। নিজেও নিচে বসলো কিন্তু ফ্লোরে না। প্রিয় পুরুষটার কোলে। বুকে মাথা দিতেই আদ্রিয়ান দু-হাত ভরে জড়িয়ে নিয়ে বুকে পুরে নিলো রোদ’কে। বেশ খানিকটা সময় পর শোনা গেলো আদ্রিয়ানের তৃপ্তির কন্ঠ,

— তুমি এতো ভালো কেন রোদ? তোমার মনে কোন ময়লা নেই কেন রোদ? এতো ভালো না হলে কি হতো?
রোদ প্রতিত্তোরে নীরবতাই গ্রহণ করলো। মন দিয়ে আদ্রিয়ানের নিঃশ্বাস গুলো গুনছে যেন৷ আদ্রিয়ান উত্তর দিতে তাড়া দিলো আবারও। রোদ ছোট করে উত্তর দিলো,
— আমি মা না?
আদ্রিয়ান হাসলো মন ভরে। রোদ বুকে থেকেই বললো,

— মিশি কোথায়?
— জারবার কাছে।
— জারবা?
রোদ চমকে মুখ তুললো। আদ্রিয়ান ওর ফোলা ফোলা গাল দুটো টেনে চুমু খেয়ে বললো,
— মাত্রই এলো।
— ঐদিনের কথা তো আর বললেন না।

— ঐদিন বাসার ভিতরে ঐ জা*নো*য়া*র টা ছিলো জারবার সাথে। বিশ্রী হাতের ছোঁয়া দিয়েছিলো আমার বোনকে কিন্তু বেশি কিছু করার আগেই আমি ডুকে পরি। অনবরত দরজায় কড়া নাড়ায় উনি খুলে দেয়। আমি দেখি আমার বোনটা কাঁদছিলো। গায়ের র*ক্ত তখন ছিলো টগবগে। আমিও হাত তুলে ফেললাম কু*ত্তার বাচ্চা’র উপর। কিন্তু সমাজ বড্ড নিষ্ঠুর বুঝলে। কিছুসময় চাইলেও ন্যায় বিচার পাওয়া যায় না আবার কিছু সময় পরিবার’ই সত্যির বিপক্ষে থাকে। যেমনটা আমাদের।

একসাথে শান্ত স্বরে এতগুলো কথা বলে থামলো আদ্রিয়ান। রোদের দিকে তাকাতেই টলমলে চোখ জোরা দেখতে পেলো। আদ্রিয়ান দেখলো রোদের চোখে আরো প্রশ্ন লুকিয়ে কিন্তু সেসবের উত্তর আপাতত দিতে চাইছে না আদ্রিয়ান। এতোক্ষণের শান্ত কন্ঠে দুষ্টোমী ঢেলে বললো,
— একটু আদর করো তো?
রোদ পলক ঝাপটালো কয়েকবার। না বুঝার ভঙ্গিতে বললো,

— মানে?
— এই যে।
বলেই রোদ’কে আদর দিলো আদ্রিয়ান। দু’জনের ওষ্ঠাধরে বিনিময় চললো ভালোবাসার। আদ্রিয়ান দু’হাতে রোদকে জড়িয়ে রাখলো। রোদ ওর কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে শ্বাস নিলো বারকয়েক। এমনিতে সারাদিন আদ্রিয়ান থেকে এটেনশন পেতে মন চায় অথচ সামনাসামনি একটু আদর করলেই রোদ পাল পিটিশন খারাপ হয়ে যায়। কথাটা ভাবতেই একটু শব্দ করে হাসলো আদ্রিয়ান।

রাতুল আর দিশা বসে আছে হসপিটালে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে তা আবার ছেড়ে দিলো রাতুল। যদিও ও নিজেই দিশা’কে এখানে ডেকেছে কিন্তু এখন নিজের’ই কেমন আনইজি লাগছে। এখানে দিশা’র সাথে কেবিনে বসে থাকা’র মানে’ই হলো বাইরে সবাই জেনে যাওয়া যে রাতুল আর দিশার মাঝে কিছু আছে। দিশা কফিটা শেষ করে বললো,

— এত আনকমফোরটেবল ফিল করার কিছু নেই। আমি চলে যাচ্ছি।
— আরে কি বলো। প্লিজ ডোন্ট সে দ্যাট। আমি আসলে…
–ঠিক আছে আর বলতে হবে না।
— দিশা?
— বলুন।
— আমি সরি ঐ দিনের জন্য।

দিশা নিজেও মাথাটা নিচু করে নিলো। আবেগের বশে রাগ করে ঐদিন কি থেকে কি হয়ে গেল। জীবনের প্রথম চুম্বনটা হয়েই গিয়েছিলো তাও আবার রাতুলের সাথে। রাদের ভালোবাসা না পেয়ে সেই উন্মাদনায় পরে রাতুল যখন প্রথম এগুলো তখন দিশা ও যেন সকল দিশা ভস্ট্র হয়ে গিয়েছিলো।

দুজন প্রেমে ব্যার্থ প্রেমিক প্রেমিকা একে অপরকে আঁকড়ে ধরেছিলো কিন্তু কেন জানি সেটা’তে দু’জনের ই আক্ষেপ হচ্ছে এখন। না রাদ’কে দিশা ভুলতে পারছে আর না ই রোদকে রাতুল। দু’জন এখনও আটকে আছে অতীতে। লোকচক্ষুর অন্তারালে ভালোবেসে যাচ্ছে দুই জন দুই অন্য মানব-মানবী’কে। তৃষ্ণা না মেটা পিপাসীত দুইটি প্রাণ ভালোবাসার কাঙাল হয়ে ঘুরছে। চোখের সামনে তাদের ভালোবাসা রং বেরং এর সাজে সজ্জিত হচ্ছে অথচ তারা বেরঙ’টাই আঁকড়ে ধরে আছে।

দিশা উঠে যেতে নিলো। আর কতক্ষণ বসে থাকবে এখানে? কাপটা রেখে উঠে দরজা পর্যন্ত যেতেই রাতুল হঠাৎ করে পেছন থেকে হাত চেপে ধরলো। দিশা ভ্রু কুচকে পিছনে ঘুরতেই রাতুল হুট করে দু’জনের ওষ্ঠাধর এক করে দিলো। দিশা বাঁধা দিলো না। ওর ও তো ভালোবাসা পেতে মন চায়। রাদকে যখন এত কাছ থেকে পায় তখন একটু জড়িয়ে ধরতে মন চায় কিন্তু আফসোস হয়ে রয়ে গেল সব। অবহেলার অতল গহীনে আজ তুচ্ছ সেই ভালোবাসা।
রাতুল দিশাকে ছেড়ে দাঁড়ালো। দিশা ঠাই দাঁড়িয়ে। সবসময় দুরন্ত থাকা মেয়েটা এখন কদাচিৎ কথা বলে। রাতুল দিশার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। পানি দিতেই দিশা এক ঢোকে খেয়ে বললো,

— এখন যাই?
— আরেকটু থাকো।
— আচ্ছা।
রাতুল কি বলবে ভাবতেই লাগলো। দিশাই হঠাৎ বলে উঠলো,
— আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?
রাতুল চমকে তাকালো। না বিয়ে করার কারণ নেই কিন্তু? দিশা রাতুলের দিকভ্রান্ত নজর দেখে হেসে বললো,

— এরপর থেকে আর চুমু দিবেন না। বিয়ে ছাড়া এসব করা হারাম বুঝলেন।
কথাটা বলেই দিশা উঠে গেলো। নিজে আর কত নিচে নামবে? ভালোবাসায় যতটা নীচে নামা যায় ঠিক ততটা নিচেই আজ দিশা অথচ হাতে দেখো। সেটা খালি। কোন কিছুই ওর হাতে ধরা দেয় না। মেঘের ছায়া যেন ওর জীবনের ভালোবাসার সকল রং ঢেকে দিয়েছে।

এদিকে রাতুল নিজের চুল খাঁমচে ধরে বসে আছে। ঐদিন নাহয় আবেগে কিন্তু আজ কি দরকার ছিলো দিশাকে কিস করার? আর বিয়ে? রোদ ছাড়া তো আজও কিছু ভাবতে পারে না ও। প্রথম ভালোবাসা ভুলা বুঝি এতই সহজ? হোক না সেটা এক তরফা।

মিশানের খবর শুনে এ বাড়ীর ও বাড়ীর সবাই এসে হাজির। দুই পক্ষেরই বড় নাতী ও। আজ সাবার মা ও এসেছে। রোদ ওনাকে দেখে একটু সরে সরে গেলো। হাজার হোক ওনার মেয়ের যায়গায় আজ রোদ। রোদের জায়গায় তো আজ মাইশার থাকার কথা। না চাইতেই রোদের চোখ ভিজে উঠলো। এই আদ্রিয়ান এই দুটো বাচ্চা এগুলো শুধু মাত্র রোদের। কাউকে দিবে না ও। কিছুতেই না। জারবা কিচেনে ডুকে বললো,

— ছোট ভাবী চায়ের ট্রেটা কি টেবিলে নিয়ে রাখব।
রোদ নিজেকে সামলে বললো,
— নিয়ে যাও। তোমার ভাইয়াকে কফিটা দিও।মাথা ব্যাথা করছে ওনার।
“আচ্ছা” বলে জারবা চলে গেল। তখনই কিচেনে আসলেন মাইশার মা। রোদ হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
— কিছু লাগবে আন্টি?

ভদ্র মহিলা মুখে কিছু বললেন না। শুধু রোদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— এভাবেই আমার আদ্রিয়ান আর নাতি,নাতনীকে ভালোবাসা দিও মা।
রোদ হাসলো। এটা যেহেতু ওপেন কিচেন তাই মাইশার মা আর কিছু বললেন না।পাশের সোফায় বসে অবশ্য আদ্রিয়ান সব দেখেছে।

ব্যাথায় রাতে জ্বর উঠলো মিশানের। আদ্রিয়ান গিয়েছে নীচে ডক্টর ডাকতে। এই বিল্ডিং এ ই ডক্টর আছে।জারবা থেকে যাওয়ায় শুবিধা হলো বটে। মিশি’কে জারবার কাছেই রাখা হয়েছে। ভাইকে অসুস্থ দেখে ছোট্ট মিশি কেঁদে কেঁদে শেষে রোদের বুকে ঘুমালো। রোদ আপাতত মিশানের কপালে জ্বল পট্টি দিচ্ছে। বারবার অস্পষ্ট স্বরে মিশান ডেকে উঠছে,
— মা…মা।
— হ্যাঁ মা। এই যে মা আছি তো আমি।

মিশান রোদকে কপালে পট্টিও দিতে দিচ্ছে না। রোদকে উঠতেও দিচ্ছে না। রোদের হাত বুকে চেপে ধরে আছে। বা হাত দিয়েই রোদ যতটুকু পারছে করছে। আদ্রিয়ান ডক্টর নিয়ে আসতেই দেখলো মিশান কাঁপছে জ্বরে। ডক্টর চেক করতেই দেখলো জ্বর একশত তিন ডিগ্রি ফারেনহাইট। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল রোদ আদ্রিয়ানের।

ডক্টর চিন্তা করতে না করে মাথায় পানি দিয়ে জ্বরের মেডিসিন দিতে বললেন কারণ এটা ব্যাথা থেকেই হয়েছে। ডক্টর শান্ত ভাবে বললেও শান্ত হতে পারলো না রোদ আদ্রিয়ান। মেডিসিন দিয়ে মাথায় পানি ঢালছে রোদ। আদ্রিয়ান ছেলের পা, হাত টিপে দিচ্ছে। জ্বরের মধ্যে ব্যাথা করছে ওর। মিশান জ্বালাচ্ছে প্রচুর। রোদকে বারবার ডেকে বলছে যাতে ওর পাশে বসে থাকে। রোদ ওর মাথায় পানি দিতে দিতে বললো,

— মা আছিতো বাবা। আরেকটু পানি দেই।
— ন…না। আমার কাছে আসো।
এমন করে করেই সারারাত জ্বালালো মিশান। শেষ রাতে যেয়ে ঘুমালো। রোদ ওর পাশে বসে বসেই ঝিমাচ্ছে। আদ্রিয়ান রোদের মাথায় হাত দিয়ে বললো,

— সোনা আমি আছি ওর কাছে। তুমি রুমে যেয়ে ঘুমাও।
— উহু। উঠলেই খুঁজবে আমাকে।
— আমি আছি তো।
— আমি ঠিক আছি। সত্যি।
— কোন কথা না। কাল না ইমপরটেন্ট ক্লাস আছে।যাও ঘুমাও।

কথাটা কিছুটা কঠিন গলায় বললো। নাহলে রোদ শুনবে না। আদ্রিয়ানের কঠিন গলায় কথার পর রোদ মুখটা নীচু করে নিলো। ও তো মিশানকে প্রমিজ করেছে পাশে থাকবে। এখন যদি মিশান উঠে দেখে রোদ নেই? তখন ভাববে না ওর মা মিথ্যা বলেছে? আদ্রিয়ান কি সেটা বুঝে? রোদকে উঠতে না দেখে আদ্রিয়ান আবারও তাড়া দিলো। রোদ উঠে দাঁড়ালো। সামনে যেতেই টান পরলো উরনায়।

উরনার এক কোনা হাতে পেচিয়ে মুঠ করে বুকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে মিশান। রোদের চোখ বেয়ে দু ফোটা পানি পরলো। যেই ডাক ওর কপালে নেই বলে এই বিয়ে সেই উদ্দেশ্য আজ স্বার্থক। এই যে রোদ মা। এত বড় মিশানের মা ও। রোদ তারাতাড়ি মিশানের পাশে গিয়ে বসে পরলো। আদ্রিয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এখন হাজার বলেও সরানো যাবে না রোদকে। আদ্রিয়ানও মিশানের পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।

সকাল ৭ টায় ঘুম ভেঙে গেল মিশানের। পাশেই মা-বাবা বসা ওর। হাসি মুখে তাকালো মিশান। আদ্রিয়ান মিশানের দিকে তাকাতেই দেখলো ও উঠে গিয়েছে। ব্যাস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো আদ্রিয়ান,
— বাবা এখন কেমন লাগছে?
রোদও তারাতাড়ি তাকালো। মিশান একটু হেসে বললো,
— ঠিক আছি আমি।
রোদ আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ওকে ফ্রেশ করিয়ে দিন। আমি কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি।
কথাটা বলেই মিশানকে একটু আদর করে রোদ দ্রুত পায়ে ছুটলো কিচেনে। মিশানের পছন্দের খিচুড়ি বসিয়েছে রোদ সাথে মুরগীর তরকারী মসলা ছাড়া। আলাদা পাতিলে পানি বসালো নাস্তার জন্য। আদ্রিয়ান সোফায় দিকে এসেই ঘ্রাণ পেয়ে বললো,

— রোদ?
— জ্বি।
কিচেন থেকেই উত্তর দিলো রোদ। আদ্রিয়ান কাছে এসে বললো,
— এতসব কি করছো?
— মিশানের না ঐদিন আমার হাতের খিচুড়ি মজা লাগলো। মনে আছে আপনার? ওটাই রান্না করছি।
আদ্রিয়ান জড়িয়ে ধরলো রোদকে। রোদ হাসলো। আদ্রিয়ান ওর মাথায় চুমু খেয়ে বললো,

— অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না?
— মায়েদের লাইফ তো এমনই। তাই না?
— তোমার এতসবের বয়স না রোদ।
— মা হতে বয়স লাগে না। আমার তো কোন কষ্ট ও লাগে নি। মায়েদের তো বাচ্চা ডেলিভারিতে কত্ত কষ্ট হয়। আমি তো কষ্ট ছাড়াই মা হয়ে গেলাম। এতটুকু ও যদি না করতে পারি তাহলে মা ডাক শুনার ও অধিকার থাকার কথা না।
আদ্রিয়ান শক্ত করে বুকে চেপে রাখলো রোদকে। কাঁধে ভেজা অনুভব হতেই রোদ ব্যাস্ত হয়ে বললো,

— এই আপনি…
কথা শেষ হওয়ার আগেই রোদের কানে এলো ভাঙা গলায় বলা আদ্রিয়ানের কন্ঠ,
— আমার মা ছাড়া বাচ্চা দুটো রোদ। অনেক আগলে আগলে রেখেছি। মিশিটাতো মা বুঝতো না কিন্তু আমার মিশানটা তো মা না পেয়ে রাত রাত কাঁদতো। আমার বুকে বুকে থাকতো। এই দুই হাতে এই দুই বাচ্চা পেলেছি আমি রোদ। আমার মিশান যে আবার কাউকে মা ডাকবে আমি ভাবতে পারি নি। তোমাকে অনেক ভালোবাসে ও। তাই বলে নিজের স্বার্থে তোমার ক্ষতি হোক তা চাই না আমি রোদ। আমি চাই তুমি ইজিলি লাইফ লিড করো। ঘড় সংসারের জন্য সারাটা জীবন পরে আছে।

— যদি তার আগে মরে যাই?
— রোদ!
— কি? হয়াৎ তো আল্লাহ জানে। আপাতত যা আছে তা নিয়ে শান্তিতে থাকতে চাই। আপনার কথায় নিজেকে পরপর মনে হয় আমার।
— আমি এভাবে…
–জানি আপনি ওভাবে বলেন নি। ছাড়ুন এবার। আমার খিচুড়ি পুড়ে যাবে?

আদ্রিয়ান ছেড়ে ওর মাথায় চুমু খেলো। নিজেকে হেল্প করছে রোদকে। রোদ সবার আগেই প্লেটে বেড়ে মিশানের রুমে ডুকে নিজ হাতে খায়িয়ে দিলো। মিশিও উঠে মায়ের কাছে এলো। বাকিরা একসাথে খেয়ে উঠতেই রোদ রেডি হয়ে মিশানকে আদর করে বললো,

— মা তারাতাড়ি আসার চেষ্টা করব।
— তোমার না আজ লেট হবে?
— চেষ্টা করব আসার। বাবা আর ফুপি আছে। খেয়াল রেখো।
মিশি মায়ের কাছে এসে বললো,
— মিশিও তো আছে।
রোদ হেসে বললো,
— হু হু মাম্মার মেয়ে ও আছে।

মেডিক্যালে আজ রোদের সন্ধ্যা হওয়ার কথা কারণ ব্যাচের সবাই বিকেলের পর একটা গেটটুগেদার করবে। রোদ আছে মিশানের চিন্তায়। ক্লাস শেষই রোদ কোনমতে সবাইকে সামলে বাসায় রওনা দিলো ইয়াজের সাথে। রোদকে দেখে আদ্রিয়ান অবাক হলো। রোদ ডুকেই মিশানের কাছে গেলো। ইয়াজ বসতে বসতে বললো,

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩২

— পাগল হয়ে গিয়েছে ও।
আদ্রিয়ান অপর পাশে বসে আপনমনে বলে উঠলো,
— এত সব সইবে তো?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৪