ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
শিকদার বাড়িতে বিয়ের ধুম পড়েছে। শিকদার পরিবারের দ্বিতীয় কন্যা প্রমিতা শিকদারের গায়ে হলুদ। মেয়েটি বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের অধিকারী—তার গায়ের রং খুব একটা ফর্সা নয়, আবার একেবারে শ্যামলাও বলা চলে না। এই মেয়েটি ছাড়া পুরো বংশের সবাইই গৌরবর্ণের। যাই হোক, মেয়েটিকে মায়াবী বলা চলে।
শিকদার বংশের একটি কঠোর নিয়ম রয়েছে—শিক্ষা সম্পন্ন না হলে বিয়ে দেওয়া হয় না। প্রমিতা এই বছরই মাস্টার্স শেষ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছে। পাত্র পূর্বনির্ধারিত—রফিক তালুকদারের একমাত্র ছেলে, সাদিক তালুকদার। ব্যবসায়ী পরিবার, সবদিক থেকেই ভালো হওয়ায় প্রমিতার বাবা খালিদ শিকদারের কোনো আপত্তি ছিল না।
এইদিকে ষোড়শী কন্যা প্রিয়তা—আমাদের গল্পের নায়িকা—পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পেছনেই তার চাচাতো বোন পরিণীতা। তারা প্রায় একই বয়সী, তাই সম্পর্কটা বোনের চেয়েও বেশি বন্ধুত্বের।
পরী বললো, “প্রিয়, ধীরে দৌড়া! পড়ে যাবি তো!”
প্রিয়তার এতে কোনো হেলদোল নেই। সে নিজের মনে ছুটতে ছুটতে বললো, “বলবো তো!”
তনয়া শিকদার—প্রিয়তা পড়ে না বলেই দৌড়ে গিয়ে মেজো আপুর রুমে ঢুকে গেল।
এই বাড়ির সবচেয়ে আদরের সদস্য, বিশেষ করে এই বাড়ির কর্তা সাদমান শিকদারের সবচেয়ে প্রিয় কন্যা হলো প্রিয়তা। সাদমান শিকদারের কাছে প্রিয়তা তার প্রয়াত মা আনজুম নাহার বেগমের প্রতিচ্ছবি। প্রিয়তার চেহারা, চোখ-মুখ, চলাফেরা, ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ধরন, চঞ্চলতা—সবকিছুই তার মায়ের মতো। তাই তিনি প্রিয়তাকে নিজের মায়ের আসনে বসিয়েছেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সাদমান শিকদার গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ হলেও প্রিয়তার কাছে তিনি একেবারেই নরম স্বভাবের!
শিকদার বংশের মান-মর্যাদা বর্তমানের চেয়ে অতীতে অনেক বেশি ছিল। তার মূল কারণ হলো শিকদার বংশের পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন। একসময় গুটা রায়পুরের জমিদার ছিলেন সাদমান শিকদারের বাবা জিহাদ শিকদার। বর্তমানে জমিদারি প্রথা না থাকায় তাদের জমিদারি নেই, তবে জমিদারসুলভ মান-মর্যাদায় এক বিন্দুও ভাটা পড়েনি। শিকদাররা এখনো অতীতের মতোই সম্পদশালী, তার চেয়েও বেশি আত্মমর্যাদাশীল, চলাফেরায় তেজস্বী ও ব্যক্তিত্ববান। জমিদারসুলভ সুদর্শন চেহারাও এখনো বিদ্যমান।
বর্তমানে রায়পুরের ২০০ বছরের পুরোনো জমিদার বাড়িটি আর নেই। ২০ বছর আগে পুরোনো জমিদার বাড়িটি ভেঙে সেখানে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেন সাদমান শিকদার।
পুরোনো জমিদার বাড়ির চেয়েও বড় পরিসরে আধুনিকভাবে নির্মিত চারতলা বিশাল বাড়িটির প্রতিটি কোণায় অভিজাত্য ও তেজ ছড়িয়ে আছে। সেই সুবিশাল বাড়িটির নাম “প্রণয় কুঞ্জ”।
প্রণয়—সাদমান শিকদারের বড় ছেলে। তাই এই প্রজন্মের বড় সন্তানের নামেই এই বাড়ির নামকরণ করা হয়।
প্রণয় কুঞ্জের সুবিশাল বাড়ির পেছনে অবস্থিত ২০০ বছরের পুরোনো বিশাল পুকুর, যার গভীরতা ৪০ ফুট! আরও চার প্রজন্ম আগে নির্মিত এই পুকুরটির নাম “রক্তপদ্ম পুকুর”।
এমন অদ্ভুত নামকরণের কারণ হলো, এই পুকুরে ১২ মাস রক্তের মতো গাঢ় লাল রঙের পদ্মের সমাহার থাকে!
পুকুরটির পাশ ঘেঁষে সুবিশাল বাড়ির চতুর্দিক ঘিরে রয়েছে সুউচ্চ সুপারি গাছ, যা ১৫ বছর আগে লাগানো হয়েছিল। বাড়ির গেট থেকে শুরু করে মূল দরজা পর্যন্ত চওড়া টাইলস-বসানো রাস্তা, রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন নাম না জানা ফুলের গাছের সমাহার, যা লনের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
জমিদার বাড়ির চার কর্তার মধ্যে প্রধান কর্তা হলেন সাদমান শিকদার। আর বাকি তিনজন হলেন তার ছোট তিন ভাই—খালিদ শিকদার, সাজিদ শিকদার ও সোহেব শিকদার।
তাদের চারজনের স্ত্রীদের নাম যথাক্রমে—
১. অনুসরি বেগম (সাদমান শিকদারের স্ত্রী)
2. তনুশ্রী বেগম (খালিদ শিকদারের স্ত্রী)
3. অনন্যা বেগম (সাজিদ শিকদারের স্ত্রী)
4. অর্থী বেগম (সোহেব শিকদারের স্ত্রী)
তারা চারজন মূলত চার বোন, যারা চার ভাইকে বিয়ে করে এক বাড়িতে বধূ হয়ে এসেছিলেন!
সাদমান শিকদারের পাঁচ সন্তান—
১. আবরার শিকদার প্রণয় (২৯)
২. রাজন্য শিকদার রাজ (২৬)
৩. আহনাব শিকদার প্রেম (২৪)
৪. তনুজা শিকদার প্রেরণা (২১)
৫. অনুজা শিকদার পরিণীতা (১৭)
খালিদ শিকদারের চার সন্তান—
১. প্রহেলিকা শিকদার (২৭)
২. প্রমিতা শিকদার পৃথা (২৫)
৩. সমুদ্র শিকদার (২৩)
৪. অরণ্য শিকদার (২১)
সাজিদ শিকদারের দুই সন্তান—
১. প্রতিক শিকদার পৃথম (২৭)
২. তনয়া শিকদার প্রিয়তা (১৬)
সোহেব শিকদারর তিন সন্তান—
১. থিরা শিকদার (১৩)
২. তোরি শিকদার (১০)
৩. তন্ময় শিকদার (৮)
এই হলো বিশাল শিকদার বংশের বর্তমান অবস্থা। এই বিশাল বংশধরদের মাঝে মাত্র 3 বিবাহিত, বাকিরা সবাই অবিবাহিত।
সাদমান শিকদারের বড় ছেলে প্রণয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে খালিদ শিকদারের বড় মেয়ে প্রহেলিকার!
খালিদ শিকদারের দ্বিতীয় কন্যা পৃথার বিয়ে এখনো চলমান!
শিকদার বাড়িতে মানুষে গিজগিজ করছে। চারতলা বাড়ির কোথাও একটুও খালি জায়গা নেই—সব জায়গায় মেহমান।
শিকদার বাড়িতে সদস্যদের থাকার একটা নিয়ম রয়েছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকেন সিনিয়ররা, যেমন কর্তা-গিন্নিরা। ফাস্ট ফ্লোরে বাড়ির কাজের লোক ও অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা। সেকেন্ড ফ্লোরে মেয়েরা এবং থার্ড ফ্লোরে ছেলেরা থাকেন।
কিন্তু বর্তমানে সে সবের বালাই নেই! যার যেখানে জায়গা হচ্ছে, সে-ই সেখানেই ঢুকে পড়ছে!