ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১২

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১২
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

প্রিথম পরিণিতাকে উদ্দেশ্য করে আফসোসের সুরে বলল, “আবিদ ছিল বলে এসএসসিতে তুই টেনে-টুনে পাস করেছিস। কিন্তু এইচএসসিতে যদি প্লাস না পাস, তাহলে তোকে রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেব।”
পরিণিতার হাসি-হাসি মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। সে মুখ বাঁকিয়ে বলল, “বিয়ে দেওয়ার জন্য এসএসসিতে ফেল করতে হবে কেন? এক্ষুনি দিয়ে দাও, কে বারণ করেছে? আমি তো এক পায়ে রাজি! এমনিতেও এই সব আজাইরা প্যাঁচাল পড়তে ভাল লাগে না।”
প্রিথম চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তোর লজ্জা নেই, তাই না?”
পরিণিতা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, “তোমার বন তো!”

প্রিথম কপালে বাজ ফেলে বলল, “কি বলতে চাস? আমি তোর মতো সব সাবজেক্টে ডাব্বা মারিনি! আমি এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি! শুধু আমি কেন, তুই ছাড়া আমাদের বংশের সবাই গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে! কিন্তু তুই তোর মতো এমন এক পিস ও আমাদের বংশে আগে কখনো জন্মায়নি। কারও এমন দারুণ বাধিয়ে রাখার মতো রেকর্ড নেই! কিন্তু তুই? সব সাবজেক্টেই বাঁধিয়ে রাখার মত মার্ক পেয়ে ফেল করেছিস !”
পরিণিতা নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “ঈশ! আমার আরও অনেক কাজ আছে। এইসব অকাম করে সময় নষ্ট করার সময় নেই! শুধু মাস্টারমশাই, আব্বু আর বড় দাদানের ভয়ে এখনো এইসব আজাইরা প্যাঁচাল পড়ে যাচ্ছি, নাহলে এসব মানুষে পড়ে ছেহ!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রিথম মাথায় গাট্টা মেরে বলল, “তোর মতো সব সাবজেক্টে ডাব্বা মারা মেয়েকে রিকশাওয়ালাও বিয়ে করবে না!”
পরিণিতা লজ্জা-লজ্জা ভাব করে মনে মনে বলল, রিকশাওয়ালা কেন বিয়ে করবে? আমার মাস্টারমশাই আছে না! কত সুন্দর, কত শিক্ষিত! আমাদের ছেলে-মেয়েরা ওদের বাবার কাছেই পড়বে। আমার এত লেখা পড়া করা লাগবে না! ‘এ ফর আপেল, বি ফর বল’ পড়াতে জানলেই হবে! বাচ্চা মানুষ করার জন্য এর থেকে বেশি পড়ে কী হবে!
প্রিয়তা পরিণিতার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বিরক্ত হলো। ঝাঁকিয়ে বলল, “পাগলের মতো হাসছিস কেন?”
এমন ঝাঁকুনিতে পরিণিতার ভ্রম ছুটে গেল! চোখ-মুখ কুঁচকে প্রিয়তার দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে বলল, “আমার ভালো, তোর সহ্য হয় না জানি!”

এমন কথা শুনে প্রিয়তা আকাশ থেকে পড়ল। ভাবল, সে আবার কখন ভালো সহ্য করতে পারল না!
প্রিথম একটা ছোট একতলা বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করালো। বাড়ির ভেতর থেকে একটা কিউট, হালকা গোলুমোলু মেয়ে বেরিয়ে এলো।
প্রিথম বাঁকা হেসে তার দিকে তাকালো। ইনায়া গিয়ে প্রিয়তার পাশে ধপাস করে বসে পড়ল।
চোখ-মুখ গরম করে প্রিয়তার চুলের বেনি টেনে বলল, “এই, তোর আসার সময় হলো? জানিস, কতোটা দেরি হয়েছে!”
হঠাৎ করেই প্রিয়তার চোখে জল চলে এলো। ইনায়া বুঝলো না যে সে কাঁদার মতো কী বলল! প্রিয়তার হাতে হাত রেখে বলল,

— “কি হয়েছে, প্রিয়?”
প্রিয়তা বাঁ হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছলো। মানুষটার মলিন চেহারাটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না! চোখ বন্ধ করলেই চোখের পাতায় ভেসে উঠছে… কী যে এক জ্বালা!
পরিণিতা পিছনে ঘুরে দেখলো—ওরা মুখ কালো করে বসে আছে। সে ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— “কেমন আছিস, গোলুমোলু গোল আলু?”
ইনায়া মুখ ছোট করে বললো,
— “আপু-উ-উ-উ!”
পরিণিতা হেসে উঠলো।

প্রিথম কলেজের বাইরে গাড়ি পার্ক করলো। ওরা অলরেডি ২০ মিনিট লেট! পরিণিতা আর প্রিয়তা গাড়ি খুলে একপ্রকার দৌড় দিলো, কারণ ওদের দুজনের ফার্স্ট ক্লাস—যে দুইজন প্রফেসর নেন, তাদের সাথে ওদের জন্মের শত্রুতা আছে বললেও ভুল হবে না! হয়তো দেখা গেল, দুজনকে পুরো কলেজের সামনে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিল!
ওরা চলে যেতেই প্রিথম গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। ইনায়াও নামতে যাবে, ঠিক তখনই সে গাড়ির ব্যাকসিটে চলে গেল। ইনায়া ছুটে বেরোতে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে প্রিথম গাড়িতে ঢুকে পড়াতেই তার বলিষ্ঠ বুকে ধাড়াম করে বাড়ি খেলো! এত জোরে খেয়েছে, তার মনে হচ্ছিল, সে হয়তো ওই কানে আর জন্মেও শুনতে পারবে না!
প্রিথম মোহাবিষ্টের ন্যায় চেয়ে আছে, যেন সে ইহজগৎেই নেই। ইনায়া তেতে উঠে বললো,

— “এটা কী করলেন?!”
প্রিথম নেশাভরা কণ্ঠে বললো,
— “কী করলাম?”
ইনায়া বললো,
— “কত ব্যথা পেয়েছি, জানেন?!”
প্রিথম ঘোরলাগা কণ্ঠে বললো,
— “ব্যথা দিয়েছি আমি, আদরও দেবো আমি! বেশি কথা বলবে না, নাহলে…”
ইনায়া বললো,
— “নাহলে কী?”

প্রিথম ইনায়াকে একটানে নিজের বুকে টেনে নিলো! ইনায়া আবার ধাক্কা খেলো, কিন্তু এবার ব্যথা পেলো না! প্রিথম ইনায়াকে নিজের কোলের ওপর বসালো। কানের কাছ থেকে ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে গালে আর গলায় পরপর ২০-২৫টা চুমু খেয়ে বললো,
— “ব্যথার তো সবে শুরু, মাই ডিয়ার রসগোল্লা! ফিউচারে তোমার ছোট্ট দেহের প্রতিটি ইঞ্চিতে ব্যথা বানিয়ে ছাড়বো। এই প্রতীক শিকদার প্রিথম তোমাকে নিশ্বাস নেওয়ারও সময় দেবে না!”
বলে, নাকের সাথে না ঘষলো।
লজ্জায় ইনায়ার গালদুটো পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেল! সে মনে মনে বললো, ছি! এই নষ্ট লোকটা এসব কী বলছে? বেহায়া, বেসরম লোক!
প্রিথম আবারও বললো,
— “আমারও ভীষণ ইচ্ছে হয়, রসগোল্লাটাকে এক কামড়ে খেয়ে ফেলতে! কিন্তু এই সব বালের নিয়মের জন্য পারছি না!”

প্রিথমের কণ্ঠে স্পষ্ট মাদকতা! সে আবারও ঘোরলাগা কণ্ঠে বললো,
— “চল না, রসগোল্লা! আজি বিয়ে করে ফেলি! এমন আদুরে বউ রেখে আর দূরে থাকতে ইচ্ছে করে না !”
ইনায়া হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিথমের নীলাভ চোখের দিকে! প্রিথম বিরক্ত হয়ে বললো,
— “কি দেখছো, বউ? এভাবে তাকালে আমি বিয়ের আগেই বাসর সেরে ফেলবো! যা আমি একদমই চাইছি না, তাই আমাকে একদম উসকাবে না!”
ইনায়া আহাম্মকের মতো চেয়ে আছে! সে আবার এসব কখন বললো?! ইনায়া লজ্জায় চটফটিয়ে উঠলো,
— “ছাড়ুন আমায়! লেট হচ্ছে!”
প্রিথম আরও একটু চেপে ধরে গলায় নাক ঘষতে বললো,

— “তুমি যদি এখন সবার সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো, তাহলে এই প্রতীক শিকদার প্রিথমের মান-সম্মান কোথায় থাকবে, বলো তো?”
তুমি আমার না হয়া বউ।
ইনায়া অবাক হয়ে বললো,
— “কান ধরবো কেন?!”
প্রিথম শয়তানি মার্কা হাসি দিয়ে বললো,
— “তুমি অলরেডি ৩৫ মিনিট লেট জান!”
ইনায়া ঢোক গিলল!
প্রিথম ব্যাকসিট থেকে বেরিয়ে ফ্রন্টসিটে বসতে বসতে বললো,
— “সামনে এসে বসো, রসগোল্লা।”
ইনায়া বললো,

— “কেন?”
প্রিথম বললো,
— “আদর করতে মন চাচ্ছে, তাই! তারাতারি আসো।”
ইনায়া জেদ দেখিয়ে বললো,
— “যাবো না!”
প্রিথম ঠান্ডা গলায় বললো,
— “এইভাবে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলার কী দরকার? সোজা বলো না, কোলে চড়তে মন চাইছে! জাস্ট ওয়েট, এখনই আসছি!”
ইনায়া লাফিয়ে উঠে বললো,
— “না! না! না! আসছি, আসছি!”
প্রিথম বাঁকা হাসলো।
ইনায়া সামনে এসে বসল, কিন্তু প্রিথমের মনে হয়, এটা পছন্দ হয়নি। তাই সে ইনায়াকে টেনে হিচড়ে নিজের কোলে বসালো। ফুলো-ফুলো দুই গালে টুকুস টুকুস করে দুটো চুমু খেয়ে বললো,

— “চুপ করে বসে থাকো।”
তারপর ফোন বের করে রাজকে কল দিলো।
— “ভাই, আমার আজ অফিসে যেতে লেট হবে।”
ভাইকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা অফ করে দিলো!
আবার দুটো চুমু খেয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
শিকদার বাড়ির বাগানে, পাতা সাদা চেয়ারে ফোন হাতে বসে আছে সাদাফ। সামনের ছবিটির পানে সে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে। ছবিটিতে পার্পেল শাড়ি পরিহিতা এক অপরূপ সুন্দরী রমণী, যার চোখ-মুখ জুড়ে হাজারো মায়ার বিচরণ! এই মুখের পানে কিছুসময় তাকিয়ে থাকলে সাদাফের নেশা ধরে যায়!
সে ঘোরলাগা কণ্ঠে বিড়বিড় করে আওড়াল,

— “জান্নাতের হুর তুমি, আমার ভালোবাসার পরী তুমি! আমার মনের রানী তুমি! বোকা মেয়ে তুমি! ভালোবাসা বুঝো না তুমি! কেন বোঝো না বলো? সবকিছু কেন তোমাকে বলে বুঝাতে হবে তোমাকে ? ভালোবাসি তোমাকে! বড্ড ভালোবাসি! তোমার ভালোবাসায় শিক্ত করতে চাই নিজেকে, ভালোবাসা দিয়ে সবার থেকে আড়াল করে নিতে চাই তোমাকে। চাইলেই কি সবকিছু পাওয়া যায়?”
আচমকা এমন কথায় চমকালো সাদাফ। পাশে চেয়ে দেখলো, শুদ্ধ বসে বসে ফোন টিপছে! পরিণীতার খেয়ালে এতটাই ডুবে ছিলো যে, পাশে একজন এসে বসেছে, সেটা ও টের পায়নি!
কিন্তু শুদ্ধ এটা কী বললো?!
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,

— “মানে?”
শুদ্ধ হেসে বললো,
— “অতশত মানে বুঝে কী লাভ? শুধু বলবো—যত দেরি করবেন, ততই লস! কথায় আছে না, শুভস্য শীঘ্রম! যাকে চান, তাকে নিজের করে নিন! পরে দেখা গেল, সেই সুযোগটি আর পেলেন না! বা এমনও হতে পারে, দেখা যাবে কার ভালোবাসা কার ভাগ্যে পিছলে যায়, তা তো আর বলা যায় না!
দিনকাল ভালো না ।
আমি আবার কারো খারাপ চাই না!”
— “এই যে আমাকেই দেখো! পিচ্চি একটা মেয়েকে ভালোবেসে কী দশা হয়েছে! কিছুতেই নিজের করতে পারছি না! অন্য একজন শক্ত করে একটা দিক ধরে রেখেছে! আমার আর আমার ভালোবাসার মাঝে শক্তপোক্ত দেওয়াল তুলে দিয়েছে! তেমনিই তোমারও যদি অপনেন্ট চলে আসে, তখন কী করবে?”

— “তাই যত তাড়াতাড়ি পারো, কাজটা সেরে ফেলো!”
বলে, বাঁকা হেসে গান গাইতে গাইতে চলে গেলো শুদ্ধ।
সাদাফ ভাবনায় পড়ে গেলো! তার গলাটা কেমন শুকিয়ে আসলো! সে হাঁসফাঁস করে বললো,
— “এগুলো কী বলে গেলো?! তার পরিণীতা অন্য কারও হয়ে যেতে পারে—এই ভাবনাতেই বুকের ভেতরে হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো!”
সে ছবিটার দিকে পুনরায় চেয়ে বললো,
— “তুমি শুধুই আমার! অন্য কারও নও! এই সাদাফ সাখাওয়াত তোমাকে কখনোই অন্য কারো হতে দেবো না! তুমি শুধুই আমার হবে! এই সাদাফ সাখাওয়াতের!”
শুদ্ধ দূরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। মনে মনে বললো,

— “এই আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধর কাছে সবাই শিশু!
ব্রেনের খেলায় আমাকে টক্কর দেওয়ার মতো আমার চিরশত্রু ছাড়া আর কেউ নেই!
এরা সবাই আমার হাতের গুটি! এমনভাবে সাজাবো যে, আবরার শিকদার প্রণয় বাধ্য হবে আমার হাতে নিজের প্রাণটা তুলে দিতে!
আর নাহলে…
আমি যদি নিজের ভালোবাসাকে না পাই, তাহলে অন্যরা কেন পাবে?
আমি যেমন প্রতি সেকেন্ড ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণায় তোড়পাই, ঠিক তেমনই সবাই তোড়পাবে! সবাই!
ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট বুকে চেপে বাঁচতে হবে আজীবন!
আমি ভালো নেই, তার মানে কেউ ভালো থাকবে না!”

বিকেল ৩টা।
চৈত্রের দাবদাহ কমার কোনো নামগন্ধ নেই! বাড়ির ছেলে-মেয়েরা লাল পাকা টমেটো হয়ে বাড়ি ফিরেছে। ফর্সা মুখে গরমের উত্তাপ যেন সৌন্দর্যের আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছে!
প্রিয়তা গরমে অতিষ্ঠ! তাকে এখনই শাওয়ার নিতে হবে! সে ছুটে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় পিছন থেকে কেউ ডাক দিলো!
প্রিয়তা পিছনে ফিরে দেখলো—শুদ্ধ প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে স্টাইলিশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
ব্ল্যাক টি-শার্টের সাথে ব্ল্যাক ট্রউজারে বেশ সুদর্শন দেখাচ্ছে, কিন্তু যথারীতি এক পুরুষে আসক্ত প্রিয়তা এসব লক্ষ্যই করল না!
শুদ্ধ অপলক চেয়ে আছে। ঘর্মাক্ত লাল মুখশ্রীতে প্রিয়তা বললো,

— “কিছু বলবেন, ভাইয়া?”
শুদ্ধ কাছে এসে বললো,
— “এক কাপ স্ট্রং ব্ল্যাক কফি বানিয়ে দেবে, Red Cherry?”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,
— “আমি প্রিয়তা!”
শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,
— “জানি! কিন্তু ‘প্রিয়তা’ নামটা বড় কঠিন লাগে, তাই ছোট করে দিলাম! তাছাড়া, তোমাকে এখন Red Cherry থেকেও লোভনীয় লাগছে!”
কিন্তু শেষের কথাটুকু মনে মনে বললো!
প্রিয়তা একটু ইতস্তত করলো।
শুদ্ধ আবার বললো,

— “প্লিজ! বানিয়ে দেবে? মামিরা নিজেদের ঘরে, তাই তাদের ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছে হলো না!”
প্রিয়তা আবার কাউকে ‘না’ বলতে পারে না! তাই শুদ্ধকেও না বলতে পারলো না। মিষ্টি হেসে বললো,
— “ঠিক আছে! তাহলে ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে!”
এই হাসিটা যেন সোজা গিয়ে শুদ্ধর বুকে গেঁথে গেলো!
শুদ্ধ বললো,
— “অবশ্যই!”
প্রিয়তা নিজের ঘরে চলে গেল। গোসল-টোসল পরে হবে!
আগে তাকে তার নিষিদ্ধ পুরুষের খবর নিতে হবে!
সে কলেজ ব্যাগটা ছুঁড়ে মেরে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

প্রণয়ের ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। দরজায় হাত দিয়ে হাল্কা ধাক্কা দিলো। দেখলো দরজা—ভিতর থেকে লক!
সে নক করবে কি করবে না, ইতস্তত করছিল, তখনই হঠাৎ করে দরজা খুলে গেল!
প্রণয় ঢুলু ঢুলু চোখে প্রিয়তার দিকে চেয়ে আছে! চুলগুলো এলোমেলো, পরনের টি-শার্ট কুঁচকে আছে।
চোখ-মুখে ঘুমের রেশ লেপ্টে আছে!
২৮ বছরের যুবককে প্রিয়তার কাছে বড্ড আদুরে বাচ্চা লাগলো!
কী যে মারাত্মক সুন্দর লাগছে!
প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ২০-২৫টা ক্রাশ নামক বাস খেলো!
কি আশ্চর্য!

কয়েক মিনিট আগেই পরিপাটি সুদর্শন লোকে শুদ্ধ ওর নজরেই পড়লো না!
অথচ, এখন এলোমেলো চুলের অগোছালো প্রণয় ওর কাছে বড্ড সুদর্শন লাগছে!
হা করে তাকিয়ে আছে সে!
প্রণয়ের দিকে!
ভুলেই গেছে, সামনে দাঁড়ানো পুরুষটা ওর নয়! বরং অন্য কারও দলিল করার স্বামী !
প্রণয় ঘুম থেকে উঠতেই নিজের জানটাকে সামনে দেখে প্রণয়ের হৃদপিণ্ডে শীতল ভালো লাগার স্রোত বয়ে গেল!
ঘর্মাক্ত লাল মুখশ্রীতে চোখ পড়তেই নজর আটকে গেল লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগায় লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামে!
সে ঢোক গিললো!
মনে মনে আওড়ালো,

— “সর্বনাশা মেয়ে তুমি! তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটাও সর্বনাশা! যা একদিন সবকিছুর জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে!”
প্রণয়ের লাল লাল গালগুলো দেখে ইচ্ছে হলো টুপটাপ চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিতে! ভালোবাসার চাদরে মুড়ে নিতে!
এই যে নীল ভাসা ভাসা চোখ দুটো দিয়ে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে—প্রণয়ের যে বড্ড ইচ্ছে করছে একটু বেপরোয়া হতে!
জীবনের সব হিসেব-নিকেশে একটু ভুল করতে!
সকল শর্ত ভুলে যেতে!
প্রিয়তা ঘোরের মাঝেই এগিয়ে এসে প্রণয়ের গালে হাত দিলো!
প্রণয় ওর থেকে অনেকটাই লম্বা!
ও প্রণয়ের হৃদপিণ্ড বরাবর!
তাই একটু এগিয়ে এসে প্রণয়ের পায়ের পাতায় পা রেখে উপরের দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিলো!
মোহনীয় কণ্ঠে বললো,

— “আর ব্যথা আছে, প্রণয় ভাই?”
প্রণয়ের হৃদপিণ্ড থমকে গেলো!
প্রিয়তা তার এতটাই কাছে দাঁড়িয়ে আছে যে,
তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা মাদকীয় সুগন্ধ প্রণয়ের সকল চিন্তা এলোমেলো করে দিচ্ছে!
এই দেহের পাগল করা, মাতাল করা ঘ্রাণ প্রণয়ের জন্য বিদেশি মাদকদ্রব্যের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর নেশা চড়িয়ে দেয়!
সে এই গন্ধে বড্ড আসক্ত!
তাইতো প্রিয়তা না থাকলেও তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ছাড়া প্রণয় থাকতে পারে না!
শরীরের গন্ধের সঙ্গে ঘামের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত মিষ্টি সুবাস এসে প্রণয়ের নাক দিয়ে সোজা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে!
প্রণয়ের ইচ্ছে করছে,

নিজেদের মধ্যে থাকা সেন্টিমিটার সমান দূরত্ব মুছে ফেলতে!
সেই সুগন্ধের উৎসে নাক-মুখ ডুবিয়ে দিতে!
হঠাৎই প্রিয়তার হুঁশ ফিরে এলো…
যে সে কি করছে?
বুঝে আসতেই প্রিয়তা লাফিয়ে উঠে দূরে সরে গেল!
মাথা নিচু করে বললো,
— সরি, প্রণয় ভাইয়া! আমি… আমি বুঝতে পারিনি! ভুল হয়ে গেছে! সরি!
প্রণয় বিরক্ত হলো। কত সুন্দর সে নিষিদ্ধ মাধব দ্রব্য সেবন করছিল, কিন্তু প্রিয়তার যেন তার এই সুখ সহ্য হলো না! সে প্রিয়তার হাতটা নিজের মাথায় ঠেকিয়ে বললো,

— আমি ঠিক নেই! আমার হাতের ব্যথায় জ্বর এসে গেছে!
প্রণয়ের শরীরের উত্তাপ গায়ে লাগতেই প্রিয়তা চমকে উঠলো! শরীর কি প্রচণ্ড গরম!
একটু আগেই সে ছুঁয়েছিল, কিন্তু অনুভূতির সাগরে ডুবে থাকার জন্য সে তা বুঝতে পারেনি!
সে ছুটে আবারও কাছে চলে এলো। নিজের নরম হাতটা দিয়ে প্রথমে কপাল, তারপর গলা, বুক—সব জায়গায় জ্বর চেক করলো!
তার শরীর কেঁপে উঠলো!
প্রিয়তা ধরে আসা গলায় বললো,
— বড় আপু কোথায়? আপনার এত জ্বর!
প্রণয় ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,

— জানি না!
প্রিয়তা বললো,
— ওষুধ খেয়েছেন?
প্রণয় গাল ফুলিয়ে বললো,
— না!
প্রিয়তা আবার বললো,
— খাবার খেয়েছেন?
প্রণয় আবার বললো,
— না!
প্রিয়তা এবার তেতে উঠলো! রাগে, দুঃখে, কষ্টে কান্না পেতে লাগলো! চিকন সরু নাকটা ফুলে ফুলে উঠছে।
সে বললো,
— তাহলে কী করেছেন? শুধু আমাকে জ্বালাতেই জানেন, তাই না?
প্রণয় চোখ ছোট করে বললো,
— তোকে জ্বালাই আমি?
প্রিয়তা কিছু বললো না।
প্রণয় ওর দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকলো, তারপর বললো,

— যা, তুই! আমি ঘুমোবো!
প্রিয়তা চিৎকার দিয়ে বললো,
— না!
প্রণয় বললো,
— কেন?
প্রিয়তা বললো,
— আপনি এখন ভাত খেয়ে ওষুধ খাবেন!
প্রণয় জেদ দেখিয়ে বললো,
— খাবো না!
প্রিয়তা প্রণয়কে পাত্তা না দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল!
প্রণয় এমন হঠাৎ প্রস্থানে অবাক হয়ে গেল!
মনে মনে বললো,

— কি হলো ব্যাপারটা? আমার এত জ্বর! পেটে কিছু নেই! এটা জেনেও সে চলে গেল?
বড় অভিমান হলো প্রণয়ের!
সে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো!
প্রিয়তা নিজের ঘরে গেল। ওয়ার্ডরোব থেকে একটা পিঙ্ক কালারের লং স্কার্ট আর হোয়াইট ফুল স্লিভ টপস বের করলো।
চুলের বেণিটা খুলে ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে গেল!
২ মিনিটের মধ্যে চেঞ্জ করে হাত-মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এলো!
গোসল করার সময় নেই!

সে কোমর অবধি লতানো চুলগুলো নিজের হাতে পেঁচিয়ে খোঁপা করলো!
একটা পিঙ্ক ট্রান্সপারেন্ট ক্লাচার দিয়ে খোঁপা শক্ত করে আটকে নিলো!
এমনিতেই ওর আর পরিনিতার চুল ছোট ক্লাচারে আটকায় না!
সে কপালে একটা ছোট্ট টিপ পরলো, উড়না নিয়ে কিচেনে গেল!
একটা বড় প্লেটে করে যা যা রান্না হয়েছিল, সব একটু একটু করে নিলো!
প্রণয়ের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিলো!
প্রণয় এমনিতেই প্রচুর রেগে আছে! বেচারা মনে ও ভীষণ দুঃখ পেয়েছে!
তার মধ্যে এমন দরজা ধাক্কাধাক্কিতে চরম বিরক্ত হলো!
সে রেগে দরজা খুললো!

কিছু কঠিন কথা শোনাতে যাবে, তার আগেই…
দৃষ্টি আটকে গেল প্রিয় রমনির পানে!
কি ভীষণ সুন্দর একখানা মুখ!
অমন নীল চোখে চেয়ে থাকলে প্রণয় কি আর কিছু বলতে পারবে?
তার কণ্ঠনালী দিয়ে আর কিছু বেরোল না!
কিন্তু অভিমান তো আছেই!
সে কিছু না বলে সোফায় গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসলো!
প্রিয়তা অবাক হলো!
সে প্লেটটা নিয়ে প্রণয়ের পাশে গিয়ে বসল!
তার মুখের সামনে ধরে বললো,
— খেয়ে নিন!
প্রণয় মনে হয় আরও রেগে গেল!
রাগে খিটমিট করে বললো,

— নিজের হাতে যদি খেতে পারতাম, তাহলে কবেই খেয়ে নিতাম! না খেয়ে বসে থাকতাম না নিশ্চয়ই!
প্রিয়তা একটু থমকালো!
ওর মনে পড়লো, আসলেই তো!
প্রণয় ভাইয়া অন্যের হাতে খাবার খান না! এটা ওনার পছন্দ না!
সে প্রণয়ের গভীর মুখশ্রী দিকে নজর রেখে ভয় ভয় বললো,
— আমি খাইয়ে দেই?
প্রণয় কেমন চোখে যেন তাকালো।
প্রিয়তা ইতস্তত করে বললো,
— সারাদিন আপনি কিছু খাননি। এর পর আরো অসুস্থ হয়ে যাবেন! আর কিছু না খেলে ওষুধও খেতে পারবেন না!
প্রণয় কিছু না বলেই হা’ করলো।
প্রিয়তা একটু থমকালো।

সে বিশ্বাস করতে পারছে না, প্রণয় ভাইয়া ওর হাতে খেতে রাজি হয়ে যাবেন!
সে ফটাফট গোস্ত দিয়ে ভাত মেখে, নিজের অদক্ষ হাতে এক লোকমা ভাত প্রণয়ের গালে তুলে দিলো।
প্রণয় খাবারটা মুখে নিয়ে চরম তৃপ্তিতে চোখ বুজলো।
এক লোকমা ভাতে যে এত পরিমাণ মানসিক শান্তি নিহিত থাকতে পারে, আগে তার জানা ছিল না!
তার মনে পড়ছে না, এত মজার ভাত সে এর আগে কবে খেয়েছে!
আজকের এই ভাত তার পেট ভরাতে পারবে কিনা জানা নেই, কিন্তু মন কানায় কানায় ভরে গেছে!
প্রিয়তা আবার নরম হাতে ভাত মেখে আরেক লোকমা প্রণয়ের মুখে তুলে দিলো।
প্রিয়তার ভেতরটা কেমন কাঁপছে।
অতীব বিষাদময় অনুভূতির মাঝে একটা সুখের অনুভূতি উঁকি দিচ্ছে।
প্রিয়তা ভাবলো—

“এতো সুখও বুঝি আমার কপালে ছিল?”
প্রিয়তা এক প্লেট ভর্তি খাবার প্রণয়কে খাইয়ে দিল। প্রণয়ও বিনা বাক্যে খেয়ে নিল। শেষ লোকমা মুখে তুলে দিয়ে বললো,
— “শেষ!”
প্রণয়ের মনে হলো কথাটা পছন্দ হয়নি। সে ঝাড়ি দিয়ে বললো,
— “এতো কম আনলি কেন? আমি কি? তুই যে এক পাখির খাবারে পেট ভরে যাবে!”
প্রিয়তা ভীষণ খুশি হয়ে বললো,
— “তাহলে আরেকটু নিয়ে আসি?”
প্রণয় তার চিকন, নরম আঙুলগুলো মুখে পুঁড়ে বললো,
— “দরকার নেই, পেট ভরে গেছে।”
হঠাৎ প্রণয়ের জিহ্বার ছোঁয়া পেতেই প্রিয়তার সকল অঙ্গ ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠলো।
প্রণয়ের হাতে থাকা হাতটাও কেঁপে উঠলো।
প্রণয় জহুরির চোখে প্রিয়তার অবস্থা পরখ করে মনে মনে বাঁকা হাসলো। ইচ্ছে হলো, ওই লজ্জায় রাঙা মুখশ্রিতে আরো একটু লজ্জার প্রলেপ দিতে!
কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়!
প্রিয়তা নিচু স্বরে বললো,

— “আমি প্লেটটা রেখে ওষুধ নিয়ে আসি।”
প্রণয় তার সাদা ওড়নার কোণা দিয়ে মুখ মুছে নিলো। আসলেই তার ভীষণ ক্ষিদে লেগেছিল। সে কাল রাত থেকে না খেয়ে আছে, কিন্তু এখন তার পেটও তৃপ্ত, মনও তৃপ্ত।
প্রহেলিকা কতবার সেধেছে, খাইয়ে দেওয়ার জন্য! হাত দিয়ে না হোক, চামচ দিয়ে খাইয়ে দেবে!
কিন্তু প্রণয় সাফ ‘না’ করে দিয়েছে।
অনুস্রী বেগমও সেধেছেন। তাকেও ‘না’ করে দিয়েছে।
অথচ এখন!
প্রিয়তমার হাতে বড় এক প্লেট ভাত খেয়ে ওর পেঠ ভরছে না, আঙুল চেটে-পুটে খেতে হয়েছে!
প্রণয় মনে মনে আল্লাহকে বললো,

— “হে আল্লাহ! এমন অসুখ আমার রোজ হোক, যে অসুখে সে আমার এতো কাছাকাছি থাকবে! সেই অসুখ তো মহাসুখের! এমন অসুখে আমি ১২ মাস থাকতে চাই!”
প্রিয়তা প্লেট রেখে এসে জ্বরের ওষুধ নিয়ে প্রণয়ের কাছে গিয়ে বললো,
— “হা করুন।”
প্রণয় বিনা বাক্যে হা করলো।
প্রিয়তা ওষুধটা খাইয়ে দিয়ে পানি খাইয়ে দিলো।
প্রণয় বললো,
— “আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।”
আসলে তখন প্রণয়ের জাস্ট ঘুমটা লেগেছিল।
তখনই সাদাফ ফোন দিয়ে ওর কাঁচা ঘুম ভেঙে দিয়েছিল।
তখন ভীষণ রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ওই ব্যাটাকে একবার সামনে পেলে খান দশেক থাপ্পড় চটাস চটাস করে লাগিয়ে দিত!
কিন্তু এখন সে মত বদলেছে। এখন সাদাফকে কাছে পেলে একটা লম্বা ধন্যবাদ দিতে হবে!
প্রিয়তা বললো,

— “তাহলে আমি চলে যাই?”
প্রণয় তার হাতটা টেনে ধরে নিজের চুলের ভাঁজে দিয়ে বললো,
— “মাথা ব্যথা করছে, চুলগুলো টেনে দে।”
বলে প্রিয়তার দিকে আরেকটু মাথা এলিয়ে দিলো।
প্রিয়তার ভীষণ কষ্ট + মায়া হলো।
সে প্রণয়ের চুলের মাঝে নিজের হাত দুটো রেখে কেবল আস্তে করে একটা টান দিয়েছিল…
ঠিক তখনই!
প্রহেলিকা ঘরে প্রবেশ করলো।
প্রিয়তাকে প্রণয়ের এত কাছে দেখে রাগে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ করলো না। মিষ্টি হেসে বললো,

— “কি ব্যাপার, প্রিয়! তুই এখানে?”
প্রিয়তা কিছু বলবে, তার আগেই প্রহেলিকা ছুটে এলো। প্রণয়ের মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে হালকা চিৎকার দিয়ে বললো,তোমার মাথা ব্যাথা করছে।
— “কি হলো বল? তোমার খুব মাথা ব্যথা করছে? আমি এক্ষুনি টিপে দিচ্ছি!”
প্রণয় ভীষণ বিরক্ত হলো। সে প্রিয়তার দিকে তাকালো। প্রিয়তাও ওদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রহেলিকা প্রিয়তাকে দেখিয়ে আরও একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো।
প্রিয়তার নীল চোখ ইতিমধ্যেই জলে টলমল করছে।
প্রণয় সেই দৃশ্য দেখে হৃদপিণ্ডে ব্যথা অনুভব করলো।
সে প্রহেলিকাকে বললো,

— “আমি ঠিক আছি।”
প্রহেলিকা একটু কষ্টের অভিনয় করে বললো,
— “সে তো দেখতেই পাচ্ছি।”
বলেই আরও কাছে চলে এলো।
এরপর প্রহেলিকা প্রিয়তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— “জানিস তো বোনু, তোর দুলাভাই মানে ভাইয়া কত চাপা স্বভাবের! নিজের মুখে কিছু বলতেই চায় না। তাই তো আমাকে সব বুঝে নিতে হয়!”
কথাগুলোর ভাব এমন, যেন প্রণয় সম্পূর্ণভাবে ওর উপর নির্ভরশীল।
যা ওর কণ্ঠস্বরের দ্বারা প্রিয়তাকে বুঝিয়ে দিল—
— “আমি প্রণয়ের বউ। প্রণয় শুধু আমার, তোর কেউ না! তুই শুধুমাত্র আমাদের মাঝে বুঝার উপর শাকের আঁটি ছাড়া কিছু না!”

প্রণয়ের ভালো লাগলো না এসব।
প্রিয়তা প্রহেলিকাকে বললো,
— “সরি আপু!”
বলে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না।
সে বারবার কেন ভুলে যায়? বারবার কেন একই ভুল করে? বারবার কেন সে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়?
সে ছুটে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
বাথরুমের কল ছেড়ে দিয়ে নিচে বসে পড়লো।
কান্নায় রুদ্ধ গলায় আল্লাহকে বললো,

— “আল্লাহ! যাকে তুমি আমার জন্য রাখোনি, তার জন্য এত ভালোবাসা আমার হৃদয়ে কেন দিলে? আমায় যদি তার বা পাঁজরের হাড় দিয়ে না বানিয়ে থাকো, তাহলে কেন তাকে নিজে থেকে মন থেকে মুছে ফেলার শক্তি দিলে না? সে আমার সামনে আসলে কেন আমার পুরো পৃথিবী উলট-পালট হয়ে যায়?”
কেন মনে থাকে না, সে অন্য কারোর দলিল করা স্বামী!
ওর অন্তর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
— “উলট-পালট তো হবেই! তুই যে খারাপ মেয়ে! অন্যের সংসার ভাঙতে চাস! তোর লজ্জা করে না, অন্যের স্বামীকে ভালোবাসতে? প্রিয়তা! তোর এত অধঃপতন হয়েছে? ছিঃ! এখনো সময় আছে, মেনে নে… প্রণয় তোর নয়!”

প্রিয়তা চিৎকার দিয়ে কান চেপে ধরলো। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
— “সব মিথ্যে! আমি খারাপ নই! আমি কারো সংসার ভাঙছি না! আমি কারো সংসার ভাঙছি না!”
বলে বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লো মেয়েটা।
সন্ধ্যা ৬টা-৭টার সময় আবিদ আসবে পরিণিতাকে পড়াতে। এটা ওর রুটিন।
কিন্তু পরিণিতা তো পরিণিতা! এমনি এমনি তো আর তাকে পড়তে বসানো যায় না! তাই তাকে পড়ানোর জন্য আবিদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আবিদ যতক্ষণ মুখের সামনে ডান্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, ততক্ষণই পরিণিতার পড়া হয়। নাহলে পড়াশোনা নামক বাল তার মাথায় ঢোকে না। হাতুড়ি পিটিয়েও ওর মাথায় কেউ পড়াশোনা ঢোকাতে পারে না!
ওর মাস্টারমশাই আসবে একটু পর, আর এখনো কিনা সে তৈরি হয়নি!
মাস্টারমশাইয়ের সামনে বসতে হবে, তার জন্য তো একটু রেডি-সেডি হওয়ার ব্যাপার আছে!
পরিণিতা ওয়ার্ড্রোব খুললো। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ভাবছে, আজকে কী শর্ত দেবে মাস্টারমশাইকে পড়তে বসার জন্য?

— “কি করতে বলবো? চুল বেঁধে দিতে বলবো? সাজিয়ে দিতে বলবো? নাকি…”
নিজেই একটু লজ্জা পেলো, তারপর আবারও ভাবলো,
— “দুই-একটা চুমু খেতে বলবো? নাকি কোলে নিতে বলবো? উফফ! এত কনফিউশন হচ্ছে! ধুর! এসব পরে দেখা যাবে!”
সে একটা ব্ল্যাক ফুল-স্লিভ ত্রিপিস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল।
কলেজ থেকে এসে সে একবার গোসল করেছিল, এখন আবার করলো।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসল। নিজের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে বললো,
— “তুমি নারী, নাকি পরী?”
নিজেই হেসে বললো,

— “পরী! পরী! আমি আমার মাস্টারমশাইয়ের পরী!”
রিবন্ডিং করা চুলগুলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে খুলে রাখলো। চোখে একটু কাজল দিলো।
প্রীয়তার মতো পরিণিতার রূপেরও প্রধান আকর্ষণ তার চোখ। প্রীয়তা আর পৃথমের যেমন নীল বর্ণের চোখ, পরিণীতা আর প্রণয়ের তেমন গাঢ় বাদামি বর্ণের চোখ—যা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভারী পল্লবযুক্ত ডাগর চোখ যখন পলক ফেলে, যে কোনো পুরুষের প্রাণপাখি ফুরুৎ করে উড়ে যাবে!
সেখানে আবিদ আর কোনো ক্ষেতের মুলা!

পরিণীতা কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ দিল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপগ্লস দিলো। বেশ সুন্দর লাগছে তাকে। অপেক্ষা করতে করতে সে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। ৭:২৫ বাজে, এখনও মাস্টারমশাই আসার কোনো নামগন্ধ নেই! বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুম পার হয়ে সদর দরজার বাইরে এসে এদিক-সেদিক উঁকি দিল।
তাকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে সাদাফ এগিয়ে এলো, মাথায় আলতো ঠুকে বললো—
“কি ব্যাপার, ফুলপরী? এই রাতবেলা এদিক-ওদিক উঁকি দিচ্ছো? ভয় করছে না ভূত-প্রেতের?”
পরিণীতা ভাব নিয়ে বলল—

“ভূত-প্রেত আবার হয় নাকি?”
কথাগুলো বলার সময় গলাটা সামান্য কেঁপে উঠেছিল, যা সাদাফ ভালো মতো টের পেল। সে মনে মনে মজা পেয়ে গেল, তার ভীতু ফুলপরীকে ভয় দেখানোর আনন্দটাই আলাদা!
সাদাফ হাসতে হাসতে বললো—
“এমা! তোমার মনে নেই? তুমি তখন এইটুকু ছিলে! এই যে সামনের আমগাছটা দেখছো? ওটা কিন্তু ২০০ বছরের পুরোনো, জমিদারি আমল থেকে দাঁড়িয়ে আছে! আর এই গাছে এক ভয়ংকর ভূত আছে, যে কিনা তোমাকে ধরেছিলো!”
পরিণীতা ভয় ভয় একটু একটু করে সাদাফের গায়ের সঙ্গে চেপে দাঁড়ালো। সাদাফ সেটা লক্ষ্য করলো, ঠোঁট কামড়ে হাসলো। সে বললো—

“আর ওই ভূতের নাকি পরীদের খুব পছন্দ! কিন্তু এই বাড়িতে পরী তো একজনই—তুমি! তাই তো সে তোমাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে।”
পরিণীতা এবার খপ করে সাদাফের বলিষ্ঠ হাত ধরে ফেললো, কাঁদো-কাঁদো মুখে বললো—
“প্লিজ, আর ভয় দেখাবেন না!”
সাদাফ হঠাৎ চিৎকার করে বললো—
“ওই দেখো ভূত!”
পরিণীতা লাফিয়ে উঠে সাদাফকে জড়িয়ে ধরলো!

সাদাফের হাসি হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল, থমকে গেল সে। নিজের প্রিয়তমার প্রথম করা স্পর্শে তার পুরুষালী হৃদয় কেঁপে উঠলো! বুকে থাকা যন্ত্রটা যেন বুলেটপ্রুফ ট্রেনের গতিতে ছুটে চলেছে নিরন্তর!
পরিণীতা শক্ত করে সাদাফকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর সাদাফও ওকে আগলে নিলো।
দূর থেকে এতক্ষণ সব কাহিনী আবিদ দেখলো—পরিণীতার কাছে যাওয়া, হাত ধরা, আর সবশেষে জড়িয়ে ধরা! সবই দেখলো, কিন্তু তারা কী কথা বলেছে, সেটা সে শুনতে পায়নি।
তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল। শ্যামলা মুখশ্রীতে হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়লো। রাগে চোখের কোণে পানি এসে গেল। সে নিঃশব্দে জায়গা ত্যাগ করলো।
সাদাফ বললো—
“আমি কখনোই চাইবো না তুমি আমার বুক মাথা ওঠাও, কিন্তু এখন কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে!”
এই কথা কানে আসতেই পরিণীতা লাফ দিয়ে সরে গেল।
সাদাফ কী বললো, সেটা বোঝার চেষ্টা করলো না সে, বা বলা চলে সাদাফের কথাটা ওর ব্রেন ক্যাচ করতে পারল না।

লজ্জা পেয়ে সে দ্রুত বাড়ির ভেতর চলে গেল।
সাদাফ নিজের টি-শার্টটা নাকের কাছে নিলো। সেখান থেকে ভেসে আসছে মেয়েলি পারফিউমের সুগন্ধ। সে হাসলো।
সেখান থেকে অন্যদিকে হাঁটা দিলো।
আড়াল থেকে বের হয়ে এলো শুদ্ধ। তার ঠোঁটে এক ফালি রহস্যময় হাসি।
এটাই তো চেয়েছিল সে!
মনে মনে বলল—
“এই তো শুরু… পিকচার আভি বাকি হ্যায়!”
বলে চলে গেল।
তাকে কফি খেতে হবে!
চার ঘণ্টা হয়ে গেছে, তার ‘সুইটহার্ট’-এর হাতে বানানো কফি এখনো তার কপালে জোটেনি!
সে করিডোরে প্রীয়তাকে দেখে বললো—
“হেই, রেড চেরি!”
প্রীয়তা চোখ তুলে তাকালো।
শুদ্ধ বললো—

“৪ ঘণ্টা হয়ে গেছে! এখনও কি এই অধমকে এক কাপ কফি দেওয়া যায় না?”
প্রীয়তা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করলো, নিচু স্বরে বললো—
“এখনই নিয়ে আসছি…”
আসলে সে ভুলেই গেছিলো!
প্রিয়তা চলে যেতেই শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকালো। মনে মনে বললো, “কি হলো ব্যাপারটা? নীলাক্ষীর চোখ নীলের বদলে লাল কেন? আমার অগোচরে আবার কী হয়ে গেল?”
সে ফোন বের করে প্রহেলিকাকে কল লাগালো, কিন্তু প্রহেলিকা কল রিসিভ করলো না। বিরক্ত হয়ে মনে মনে বললো, “এই মেয়েটা কোনো কাজেরই না! শুধু বড় বড় কথা, বাণী ছাড়ে! একদম ইউজলেস!”
কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে ছাদের দিকে গেলো।
পরিণীতা বুঝলো, তখন সাদাফ ভাই তাকে বোকা বানিয়েছে। সে কি ভীতু? “ছি! সেই জায়গায় ওর মাস্টার মশাই কত সাহসী!” আবারও আবিদের কথা মনে পড়ল।

৮টা বেজে গেছে, আবিদ এখনো আসেনি দেখে তার খুব মন খারাপ হলো। মনে মনে বললো, “আজকে কি আর মাস্টার মশাই আসবেন না?”
সে ফোনটা হাতে নিয়ে আবিদের নম্বরে ডায়াল করলো। কিন্তু ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে ভেসে এলো, “আপনি যে নম্বরে ফোন দিয়েছেন, সেটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।”
পরিণীতা আরও মন খারাপ হয়ে গেল। পানির তেষ্টার মতো তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে মাস্টার মশাইকে দেখার জন্য। সে ছুটে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো। কিন্তু রাস্তাটা ফাঁকা—কেউ নেই সেখানে।
সে আরও কয়েকবার ফোন করলো, কিন্তু সুইচ অফ বলছে।
পরিণীতা ভাঙা কণ্ঠে বললো, “আপনি জানেন না মাস্টার মশাই, আপনাকে একদিন না দেখলে আমার কতটা কষ্ট হয়…”

প্রিয়তা কালো ওড়নাটা কোমরে গুঁজে কফি বানাচ্ছিলো।
অনুস্রী বেগম চোখ বড় করে বললেন, “এতো তেতো কফি তুই খাবি?”
প্রিয়তা নাক কুঁচকে বললো, “ছি! এসব আমি কখনো খাই?”
অর্থি বেগম বললেন, “তাহলে কার জন্য?”
প্রিয়তা নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলো, “শুদ্ধ ভাইয়ের জন্য।”
অনুস্রী বেগম “ওহ!” বললেন, আর কেউ কিছু বললো না।
শুধু অনন্যা বেগম বললেন, “তোর আব্বু, বড় আব্বু, চাচ্চুরা তোর হাতের ইলিশের পদ খেতে চেয়েছেন। তাই নিজে বাজারের টাটকা ইলিশ কিনে এনেছেন।”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১১

প্রিয়তা খুশি হয়ে বললো, “আমি কফিটা দিয়েই আসছি! আজকের রান্না আমি একাই করবো!”
বলে মা-চাচিদের আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কফি নিয়ে চলে গেলো।
হৃদয়ের ব্যথাটা কমছেই না। যদি এভাবে কিছুক্ষণ মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা যায়, তাহলে ক্ষতি কী?

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৩