ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৩

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৩
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

প্রিয়তা কফির মগ নিয়ে শুদ্ধর ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নক করলো, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো উত্তর আসলো না। সে আবারও কয়েকবার জোরে জোরে নক করলো, কিন্তু এবারও কোনো শব্দ আসলো না। প্রিয়তা ভাবলো, ‘কি হল! একটু আগেই তো ভাইয়া কফি চাইলেন।’ সে ভাবলো, শুদ্ধ হয়তো কোথাও চলে গেছে। তাই প্রিয়তা ঘুরে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তন্ময় এসে বললো,
— আপু, এই আপু দাঁড়াও!
প্রিয়তা তাকালো।

_তোমাকে শুদ্ধ ভাইয়া কফি নিয়ে ছাদে যেতে বলেছে।
প্রিয়তা কিছুটা বিরক্ত হলো। তার অনেক কাজ আছে, তাই কফির মগটা তন্ময়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
— ভাই, তুই দিয়ে আয়।
তন্ময় ছোট ছোট চোখে তাকালো আপু কি তাকে অর্ডার করলো সে আবার কফির মগটা প্রিয়তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
— আমি তোমার মত না! আমার অনেক কাজ আছে। নিজের কাজ নিজে করো— হুহ!
বলে সেই একটা ভাব নিয়ে চলে গেল।
প্রিয়তা এমন কথায় বেকুব বনে গেল। কিছুক্ষণ ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। পর মুহূর্তেই তেতে উঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— বেয়াদব! বিচ্ছু কোথাকার!
বলেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।
শিকদার বাড়ির বিশাল ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে শুদ্ধ। আকাশে চিকন এক ফালি চাঁদ ঝুলছে। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে, ছাদে লাগানো বাহারি ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। এমন মনোরম পরিবেশে প্রিয়তমাকে পাশে নিয়ে শুদ্ধের মন খুলে গান ধরতে ইচ্ছে হলো।
গান নামক প্রতিভাটা শিকদার বাড়ির সবারই কম-বেশি আছে। তবে প্রণয় আর শুদ্ধ একটু বেশিই ভালো গায়। দূরের পানে চোখ নিবদ্ধ করে বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে নেত্রদ্বয় বন্ধ করে নিল শুদ্ধ। চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সুশ্রী একখানা নীল চোখের সুশ্রী মায়াবী মুখ।
সে চোখ বন্ধ রেখে গান ধরলো—

লিখবো তোমার হাতে
আমি আমার মরণ।
আমি তোমার কাছেই রাখবো
আজ মনের কথা হাজার,
দিয়ে তোমার কাজল আঁকবো,
আজ সারা দিনটা আমার।
তুমি বৃষ্টি হয়ে নামলে,
তুমি বৃষ্টি হয়ে নামলে,
আর কমলো চিন্তা আমার।
প্রিয়তা কফির মগ হাতে পাশে এসে দাঁড়াল। শুদ্ধ প্রিয়তার উপস্থিতি অনুভব করল। প্রিয়তা পিছন থেকে ডেকে বললো, “ভাইয়া, আপনার কফি।”
শুদ্ধ পাশ ফিরে পূর্ণ দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে চাইল। পানপাতা মুখে কোনো প্রসাধনীর রেশ পর্যন্ত নেই, তবুও সে অপরূপা, অনিন্দ্য সুন্দর। রাতের অন্ধকারেও ঝিলিক দিচ্ছে তার নূরানী চেহারা! শুদ্ধ হাত থেকে কফি মগটা নিয়ে বলল,

“থ্যাঙ্ক ইউ, রেড চেরি।”
প্রিয়তা একটু হাসার চেষ্টা করল। শুদ্ধ হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিন্তু…”
প্রিয়তা জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু কি?”
শুদ্ধ বললো, “এটা আমি খাব না।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল, “কেন? আপনি তো তখন কফি খেতে চাইলেন।”
শুদ্ধ ভাব নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, চেয়েছি। কিন্তু আমি একজন সচেতন ডাক্তার হিসেবে খাবারের মান যাচাই না করে কিছু খেতে পারি না এটা আইনবিরুদ্ধ ।”
আর ডক্টর আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ আইনের বিরুদ্ধে তো আর যেতে পারে না।
প্রিয়তা চোখ বড় বড় করে বলল, “এ্য?”

শুদ্ধ বলল, “হুঁ! এই কফিতে দেওয়া উপকরণগুলো যে মেয়াদোত্তীর্ণ নয়, তার প্রমাণ কি?”
প্রিয়তা বিস্ময় বলল আমি কেন আপনাকে মেয়াদ উত্তীর্ণ জিনিস খাওয়াতে যাব? আজব।
তাও বিশ্বাস নেই সচেতন ডাক্তার শুদ্ধ চৌধুরী ছোটখাটো রিক্সা ও নেয়না।
প্রিয়তা অবাক হয়ে ভাবলো, ‘এই লোকের মাথায় কি কোনো গণ্ডগোল আছে?
মেকি রাগ দেখিয়ে প্রিয়তা বলল, ” এই, কফিতে মেয়াদোত্তীর্ণ কিছু দেওয়া নেই। নিশ্চিন্তে খেতে পারেন।”
কিন্তু শুদ্ধ নাছোড়বান্দা। সে বলল, “এইভাবে কোয়ালিটি টেস্ট না করে আমি খাব না।”
প্রিয়তা শুদ্ধর জেদ দেখে বিরক্ত হয়ে বলল, “কিভাবে টেস্ট করতে হবে, বলেন?”
শুদ্ধ মুচকি হেসে বলল, “বিশেষ কিছু না। এটাতে কোনো ভেজাল নেই, তা প্রমাণ করার জন্য তোমাকেও খেতে হবে।”

প্রিয়তা নাক কুঁচকে বলল, “আমার তেতো পছন্দ না, আমি এসব খাই না।”
শুদ্ধ বলল, “এসব আমি শুনবো না। তুমি বানিয়েছ, তাই তোমাকেই এর মান যাচাই করতে হবে।”
প্রিয়তা ভাবলো এ নিশ্চয়ই পাগলের ডাক্তার।
তাই পাগলের সাথে ঝামেলা করে লাভ নেই!’
সে শুদ্ধর হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে নিজের টকটকে লাল ওষ্ঠের ধারা ছোট্ট একটা চুমুক দিল।
সাথে সাথেই মুখের আকৃতি বিকৃত হলো! মুখের কফিটুকু আর গিলতে পারল না। এত তেতো স্বাদ! চোখ গুলগুল করে ভাবলো, ‘এমন উচ্ছে করলার চেয়েও তেতো জিনিস কারও পছন্দের তালিকায় কিভাবে থাকতে পারে!’
শুদ্ধ প্রিয়তার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে মনে মনে বাঁকা হাসলো। ছোঁ মেরে প্রিয়তার হাত থেকে কফির মগটা ছিনিয়ে নিল। প্রিয়তার ঠোঁট ছোঁয়া একই জায়গায় সে নিজেও চুমুক দিল।
পরম তৃপ্তিতে তার হৃদয় জুড়িয়ে যাচ্ছে —এরকম মিষ্টি স্বাদের কফি সে আগে কখনো খায়নি! কফি মগ থেকে স্ট্রবেরির মিষ্টি স্মেল বেসে আসছে।

সাথে জিভে অন্যরকম কিছু একটাএ স্বাদ অনুভূত হলো।
প্রিয়তার যে জায়গায় ঠোঁট ছুয়েছিল সেই জায়গা থেকে স্ট্রবেরি ফ্লেভার লিপজেলের সুবাস আর স্বাদ যেন এক অন্যরকম মাদকতা ছড়াচ্ছে শুদ্ধের মাঝে
কফি শেষ করে শুদ্ধ মগটা প্রিয়তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওর নীল চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘এমন লিপজেল মিশানো তেতো মিষ্টি স্বাদের কফি বিয়ের পর সকাল-বিকাল খেয়ে হবে with bow ।’
শুদ্ধ আবারও মুচকি হেসে প্রিয়তার লাল টকটকে ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ভাবল, ‘ওই কোমল ঠোঁট ছুয়ানো সামান্য লিপজেল এত মিষ্টি , না জানি ওই তুলতুলে নরম ঠোঁট দুটো কত মিষ্টি হবে! উফফ, আমার তো এখনই স্বাদ নিতে ইচ্ছা করছে!’

নিজের চোখ নামিয়ে অদৃশ্য হাতে মাথায় চাটি মেরে নিজেকেই বলল, “কন্ট্রোল, শুদ্ধ চৌধুরী, কন্ট্রোল!”কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ।
প্রিয়তা ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল, “বিশ্বাস হয়েছে, আপনাকে বিষ খাওয়াইনি?”
শুদ্ধ মনে মনে বলল, ‘যদি তুমি নিজের হাতে বিষ দাও, সেটাও অমৃত ভেবে এই আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ পরম তৃপ্তি সহকারে গ্রহণ করবে।’
কিন্তু মুখে বলল, “আসলে আমার তো শত্রুর অভাব নেই। বলা যায় না, কখন কে কী মিশিয়ে দেয়! তাই সবসময় যাচাই করেই খাই। বাই দ্য ওয়ে, ভাবছি, এরপর থেকে ফুড টেস্টিং-এর চাকরিটা তোমাকেই দেব।”
প্রিয়তা ভেংচি কেটে বলল, “আমার বয়েই গেছে!” বলে চলে যাচ্ছিল।
শুদ্ধ পেছন থেকে ডাক দিল, “রেড চেরি!”

প্রিয়তা পিছিয়ে ফিরে তাকালো। শুদ্ধ এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে সোজা ওর নীল চোখে চোখ রাখলো। শুদ্ধ ওই সমুদ্র নীল চোখের পানে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারে না—পাগল পাগল লাগে, মাতাল মাতাল লাগে, নিজেকে আউট অফ কন্ট্রোল লাগে নেশা ধরে যায় । তারপর ও ওই চোখে গভীর দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে, প্রিয়তার তুলতুলে নরম হাতটা ধরে একটু কাছে টানলো।
প্রিয়তা তো আকাশ থেকে পড়লো! হঠাৎ এমন ব্যবহারে সে বিস্মিত হয়ে বললো, “কিছু বলবেন ভাইয়া?”
শুদ্ধ কিছু বললো না, শুধু নিজের তর্জনী আঙুল দিয়ে প্রিয়তার ঘন ভারী চোখের পাপড়ি ছুঁয়ে আঙুলটা চোখের সামনে ধরলো। আঙুলের মাথায় নুনা পানির অস্তিত্ব টের পেলো।
প্রিয়তা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। শুদ্ধ আরও একটু কাছে এনে গভীর সুরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে, রেড চেরি?”

বিস্মিত স্বরে প্রিয়তা বললো, “কি হবে?”
শুদ্ধ একটু কঠিন গলায় বললো, “কেঁদেছো কেন? চোখ ভিজে কেন? মুখ শুকনো কেন? লাবণ্যময় চেহারায় মলিনতা কেন?”
প্রিয়তা আরও বিস্মিত হয়ে ভাবলো—’এত কিছু কীভাবে বুঝলেন শুদ্ধ ভাই? এখন কি বলবো?’
সে আমতা আমতা করতে লাগলো। আসলে সে কাউকে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না। সে মিথ্যা বললে মিথ্যাটা ধরা পড়ে যায়।

শুদ্ধ গালে হাত রেখে নরম সুরে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে, রেড চেরি? বলো আমাকে।”
প্রিয়তা টলটলের চোখে শুদ্ধের দিকে তাকালো। মেয়েটা একেবারেই নরম—নরম মন, নরম ব্যবহার, নরম স্বভাব। কেউ একটু আদর করে কিছু বললে সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। শুদ্ধের এমন আল্লাদ মাখা কথা শুনে ভিতরের চাপা কষ্টগুলো পুনরায় জ্বলে উঠলো। এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা কান্নাগুলো ঠেলে ঠুলে বেরিয়ে আসতে চাইলো। চোখের পাপড়ি আবার ভিজে উঠছে। সে কাঁপা কণ্ঠে বললো, “কিছু না,” বলে আবার চলে যেতে নিলো।
শুদ্ধ আবার ওর হাত ধরে ফেললো। এবার টান দিয়ে আরও কাছে নিয়ে এল। একটু জোরে চেপে ধরতেই নরম হাতে লাল দাগ হয়ে যাচ্ছে অনুভব করতেই হাতের বাঁধন নরম করে নিজেদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব রেখে আরও কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, রেড চেরি? বলো আমাকে।”
কি কারনে কষ্ট পেয়েছো।

প্রিয়তা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। কোমল মেয়েটা সব দিক দিয়ে নরম—কোনো কুটিলতা, কঠিনতা, ছলচাতুর্যের ছিটেফোঁটাও নেই। শুদ্ধের এমন প্রশ্রয়ধ্বনি শুনে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। নীল চোখের নদী থেকে উপচে পড়া তরল গড়িয়ে শুদ্ধর হাতে পড়লো।
শুদ্ধর মনে হলো, এটা শুধু চোখের পানি নয়—বিষ মাখানো বাণ, যা তার হৃদপিণ্ড বরাবর আঘাত এনেছে। সে প্রিয়তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। কি হয়েছে, সেটা তো সে এমনিতেই জেনে যাবে। তাই নিজের পুরুষালি হাতে নরম গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা অশ্রুটা সযত্নে মুছে দিলো।
কিন্তু না, আবারও গড়িয়ে পড়তে লাগলো! এইভাবে কয়েকবার চলার পর, শুদ্ধ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।
সে আর না পেরে প্রিয়তার মুখটা নিজের হাতে তুলে আদুরে গলায় বললো,

“কেঁদো না, প্লিজ।”
মনে মনে বললো,
“আমি নিষ্ঠুর মনের কঠিনতম পুরুষ, যার মনে দয়া-মায়া নেই। কিন্তু মেয়ে তো মেয়ে আমার থেকেও বেশি নিষ্ঠুর নিষ্ঠুরতম পুরুষের চরম সর্বনাশ করে দিয়েছো।
আমার বক্ষে গহীন ক্ষতের সৃষ্টি করেছো। ভালোবাসা তো দাও না এক ফোটা, তবে থামো মেয়ে ! চোখের জল ফেলে আর বাড়িও না ব্যথা।”
প্রিয়তার এতক্ষণ ধরে হাজারো চেষ্টায় চাপা দেওয়া যন্ত্রণা এবার আর থামতে চাইলো না। সে ছুটে ছাদ থেকে নেমে গেল।
শুদ্ধের মন প্রাণে এক অদ্ভুত অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে । মুহূর্তেই তার সুদর্শন চেহারায় কোমলতা সরে গিয়ে হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতা জায়গা করে নিলো।
সে কাউকে ফোন দিয়ে বললো,

“জাস্ট ৫ মিনিটের মধ্যে ছাদে আসো,”
বলে ফোন কেটে দিলো।
প্রণয় নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে কালচে লাল ঠোঁটে চেপে ধরল।
নিজের বুকের বাঁ পাশটা হাত দিয়ে ঢলে বলল,
“আর কত পড়বি তুই?”
চোখ বন্ধ করতেই আবারও চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সেই পানপাতা মুখ। সে চোখ বন্ধ করে আওড়াল,
“তোার জন্য এই হৃদয়টা কবেই জ্বলে-পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। তবু ও পুড়া থামছে না
তার চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে—সে এই সবকিছু থেকে মুক্তি চায়। এত জটিলতা আর নিতে পারছে না। পারছে না নিজের ভালোবাসার নীলাঞ্জনার কাছ থেকে দূরে থাকতে। তার এই শিকল পোড়ানোর জীবন আর সহ্য হচ্ছে না মন চাইছে সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে প্রিয়তমার হাত ধরে দু’জন মিলে কোনো এক দূর দেশে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে, যেখানে তাদের কেউ চিনবে না।

কিন্তু এখানেও সে নিরুপায় বড্ড অসহায় । সত্যিটা একবার জানাজানি হয়ে গেলে সে তার নীলাঞ্জনাকে পৃথিবীর কোথাও সুরক্ষিত রাখতে পারবে না। তার এলোকেশির জন্য হলেও তাকে এসব সহ্য করে নিতে হবে।
কিন্তু মানুষ তো আর কতটুকুই বা সহ্য করতে পারে?যন্ত্রণা তো তারও হয়,, সেও তো চায় ক্লান্তি মাখা দিনের পর প্রিয় মানুষের বুকে সুখ খুঁজে পেতে। কিন্তু সে সেটা পায় না।
তার হৃদয় খুব করে বলছে—তার নীলাঞ্জনা কাঁদছে। প্রতিটা সেকেন্ডে, প্রতিটা মিনিটে তার হৃদয়ে তীব্র অসহ্য যন্ত্রণা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
এটা আর সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রিয়তার ঘরের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। বন্ধ দরজার পানে চোখ রেখে বিড়বিড়িয়ে বলল,

“আমার জীবনের এক প্রহর কেটেছে স্বপ্নের মতো,
বাকি জীবনটা কাটবে তুমি হীনা দুঃস্বপ্নের মতো।
এমন জীবন থেকে তো মৃত্যুই শ্রেয় ছিল।
অন্তত এটুকু তো বলতে পারতাম—তুমি ছাড়া আমি আর কোনো নারীকে ছুঁয়ে দেখিনি।
অন্তত আমার জীবনে সে বিষাক্ত রাতগুলো ঘুরে ফিরে আসতো না!”
সে অভিযোগের সুরে বলল,
“কেন, নীলাঞ্জনা? কেন তুমি সাধারণ হলে না?”
সে আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করল না, বেরিয়ে গেল শিকদার বাড়ি থেকে।
পরিণিতার মনটা খুব খারাপ। সে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আবিদের হোয়াটসঅ্যাপে মেসেঞ্জারে শত শত মেসেজ করেই যাচ্ছে। অথচ সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আবিদ অফলাইন। তা-ও নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
ঠিক তখনই মিসেস তনুশ্রী বেগম পরিণিতাকে ডেকে বললেন,

“যা, তোর বোনকে ডেকে নিয়ে আয়। আজ রাতের রান্না সে করবে বলেছে।”
পরিণিতা মেজো চাচির দিকে তাকিয়ে বললো,
“কোন বোন?”
তনুশ্রী বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
“প্রিয়তাকে ডেকে নিয়ে আয়।”
পরিণিতার মনটা একটু খুশি হলো। ভাবলো, তাহলে সেও যোগ দেবে। দুই বোন মিলে আজ অনেক কিছু এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে।
সে দৌড়ে চলে গেল প্রিয়তার ঘরের দিকে। বাইরে দাঁড়িয়ে দরজায় ঠকঠক করে ডাক দিলো,
“প্রিয়, দরজা খোল!”
প্রিয়তা কথা বলল না।

পরিণিতা পুনরায় কয়েকবার ডাক দিলো।
ভিতর থেকে ভাঙা গলায় প্রিয়তা বললো,
“তুই যা আপু, এখান থেকে।”
পরিণিতা থমকে গেল কয়েক সেকেন্ড। তারপর আরও জোরে জোরে দরজা ধাক্কিয়ে বললো,
“তারাতারি খোল, খোল বলছি! কাঁদছিস কেন? খোল, না হলে আব্বুকে ডেকে আনবো!”
প্রিয়তা তবুও দরজা খুলছিল না দেখে পরিণিতা সাদমান শিকদারের নাম ধরে ডাক দিলো—
“আব্বু!”

প্রিয়তা দৌড়ে এসে দরজা খুলে পরিণিতার মুখ চেপে ধরলো।
পরিণিতা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। হাঁটু অবধি চুলগুলো এলোমেলো, কান্নার তোপে ফর্সা মুখখানা টকটকে লাল। চোখের সাদা অংশও লাল হয়ে গেছে। এখনো অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে নোনা তরল।
পরিণীতা বুঝলো, মেয়েটা আবার ও ওর ভাইয়ের কারণে কষ্ট পেয়েছে। পরিণীতা মুখের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালো। ভিতরে ঢুকে গিয়ে গালে হাত দিয়ে নরম গলায় বললো,
“আর কত কাঁদবি, বোন?”

প্রিয়তা ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিণীতার বুকে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। পরিণীতার চোখের কোনেও পানি চিকচিক করছে। সে এই ব্যথা বুঝবে না কারণ তার মাস্টার মশাই তাকে পুতুলের মতো রেখেছে, কখনো দুঃখ-কষ্টে ছিলে ফুটাও রাখতে দেয়নি। তাই সে এই ব্যথা সত্যিই বুঝবে না, কিন্তু সেও তো তার মাস্টার মশাইকে এমন পাগলের মতোই ভালোবাসে। আর সেই ভালোবাসার সঙ্গে অন্য কাউকে সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তাই ধরে নিলো, ওর ছোটো বোনের ব্যথাটা ও অনুভব করতে পারবে না— সত্যিই পারবে না। কারণ যে যে পরিস্থিতিতে পড়ে, সে ছাড়া অন্য কেউ সেটা উপলব্ধি করতে পারবে না।

পরিণীতা পুনরায় ভাবলো, এতটুকু মেয়ে কীভাবে চব্বিশ ঘণ্টা চোখের সামনে সহ্য করে, সেটাই বুঝে আসে না পরিণীতার।
পরিণীতা মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
“শান্ত হ, বোন। এভাবে কাঁদিস না।”
প্রিয়তা ক্রন্দনরত কণ্ঠে হেঁচকি তুলে তুলে বললো,
“আপু, আমার সহ্য হচ্ছে না! আমার সহ্য হচ্ছে না! আমার… আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, আপু!”
এমন ছোট ছোট প্রলাপ বকছে প্রিয়তা। পরিণীতা ওর মুখটা তুলে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু প্রিয়তা শুনলো না। বরং আরও জোরে জড়িয়ে ধরে আবার ভাঙা গলায় বললো,
“আমি পারছি না তাকে ছাড়া থাকতে!”

কথাগুলো পরিণীতার বুকে বিঁধছে। সে প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“বড় দাদান তো ভীষণ ভালো আছে, তার জন্য আর কতো চোখের পানি ফেলবি ? সে তো তোকে ভালোবাসে না। তাহলে কেন তার জন্য গোপন কলঙ্ক গায়ে মাখছিস? সে কখনোই তোর হবে না। ভুলে যা তাকে।”
প্রিয়তা বিষাদময় এক হাসি দিয়ে বললো…
গোলাপে কাটা আছে, তবুও গোলাপ ভালোবাসার প্রতীক। চাঁদে ও দাগ আছে, তবু ও চাঁদ দেখতে ভালো লাগে সুন্দর লাগে
ইলিশে অন্যান্য মাছের তুলনায় একটু বেশিই কাঁটা, তবু ও ইলিশ সবচেয়ে সুস্বাদু মাছ। এই পৃথিবীর কোনো কিছুই পারফেক্ট নয়, আমিও পারফেক্ট নই। তাই থাকুক না এতটুকু কলঙ্ক, এই কলঙ্কটুকুই আমার বেঁচে থাকার শেষ আশ্বাস।

পরিণীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমার তোকে কিছু বলে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই, বোন। আর এখন এটা বলারও সাহস নেই যে—তুই আমার ভাইকে ভুলে যা। আমি জানি, এটা তুই পারবি না। তাই এটা করতে বলবো না—শুধু বলবো, নিজেকে একটু শক্ত কর। তোর ভেতরে যা-ই চলুক, বাইরে থেকে যেন সেটা বোঝা না যায়। কেউ যেন তোর দুর্বলতা চিহ্নিত করতে না পারে। ভেতর থেকে শক্তিশালী হতে তুই পারবি না, কিন্তু বাইরে থেকে হওয়ার চেষ্টা কর। বড় দাদান যেন তোর মাঝে কোনো দুর্বলতা না দেখতে পায়।”
যদিও এটা ঠিক না—একতরফা ভালোবাসা বড় যন্ত্রণাদায়ক।
কিন্তু এই ব্যাপারটা তো হৃদয়ের—এখানে ঠিক-ভুল নেই, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো মাপকাঠি নেই। মন যা বলে, তাই। কিন্তু তোকে শক্ত দেখাতে হবে, বোন। দেখি, আমার দিকে তাকা আর একদম কাঁদবি না।”
পরিণীতা চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।

প্রিয়তা বড় বড় শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। পরিণীতা প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো—
“ঘর থেকে বেরোনোর পর ভিতরে কী হয়েছে, সেটার রেশ যেন না থাকে, বোনু।”
সে অনেক কষ্টে প্রিয়তাকে ওয়াশরুমে পাঠালো। প্রিয়তা কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। পরিণীতা চোখে-মুখে পানির বিন্দু ছাড়া বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখলো না। সে তোয়ালে এনে নিজের হাতে চোখ-মুখ মুছে দিলো। সাথে সাথে আবার গড়িয়ে পড়লো নোনা জল।
পরিণীতা এবার রেগে গিয়ে ধমক লাগিয়ে দিলো—
“প্রিয়, এবার তুই মার খাবি! তোকে তখন থেকে কাঁদতে বারণ করছি।”—কথাটা পরিণীতা তুলনামূলক উঁচু স্বরে বললো।

প্রিয়তা হালকা ভয় পেলো। সে কী করবে? সে তো আর ইচ্ছে করে চোখে পানি ফেলছে না।
পরিণীতা রাগী রাগী ভাব ফুটিয়ে তুলে আবার ওর চোখ মুছে দিলো। চুলগুলো আচড়ে বেণী করে দিলো। চোখের দিকে তাকিয়েই ভাবলো—এই চোখ দেখে যে কেউ সন্দেহ করবে, তখন কী জবাব দেবে? আমার বোন—তাই সে একটু গাঢ় করে চোখে কাজল দিয়ে দিলো, কপালে একটা টিপ পরিয়ে দিলো। মাথায় ওড়না দিয়ে চাইলো—এবার কিছুটা ঠিক লাগছে।
পরিণীতা বললো, “চল।”
প্রিয়তা কিছু না বলে পরিণীতার পিছু নিলো।

ড্রয়িং রুমে তন্ময় বসে বসে ডোরিমন দেখতে দেখতে চিপস খাচ্ছে। রাজ আর প্রেম, দুজনেই অফিস থেকে মাত্রই ফিরলো। দুজনেই ভীষণ ক্লান্ত, তাদের এখন একটু এন্টারটেইনমেন্ট দরকার। তাই তারা তন্ময়কে দেখতেই দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানি হাসি দিলো। তারপর দু’জন গিয়ে তন্ময়ের দুই পাশে বসে আচমকা চিপসের প্যাকেটে হামলা চালিয়ে দিলো।
হঠাৎ আক্রমণে তন্ময় লাফিয়ে উঠলো। দুই পাশে দুই দাদানকে দেখে এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো, “কি ব্যাপার! তোমরা দুজন আমার চিপস নিলে কেন?”
রাজও একইভাবে এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“চিপসের গায়ে কি তোর নাম লেখা ছিল?”

তন্ময় চোখ সরু করে বললো, “নাম নেই তো কি হয়েছে? আমার আব্বু আমার জন্য এনেছেন।”
রাজ বললো, “আমার চাচ্চু এনেছেন, আমি খেতেই পারি,” বলে আরেকটা চিপস তুলে মুখে পুরে দিলো।
তন্ময়ের নাকের পাটা ফুলে গেলো। রেগে বললো, “একদম আমার চিপসে হাত দিবা না!”
রাজ ওর কথায় পাত্তা দিলো না।
প্রেম ওর ফুলানো ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে ব্যঙ্গ করে বললো, “আচ্ছা ভাই, তুই যে দিন দিন তরমুজ হচ্ছিস, তোর চিন্তা হয় না?”
তন্ময় ছোট দাদানের দিকে তাকিয়ে বললো, “চিন্তা হবে কেন?”
প্রেম দ্বিগুণ চিন্তিত হওয়ার ভান ধরে বললো, “তুই যে দিন দিন গ্যাস বেলুনের মতো ফুলছিস, এর পরে তোকে কি আর কেউ বউ দেবে?”
রাজও চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, “ঠিক বলেছিস ভাই, এটা তো চিন্তার বিষয়!”
দুজন এমন ভাব করছে, যেন তারা ভীষণ চিন্তিত।
তন্ময় নাক ফুলিয়ে বললো, “আমি তোমাদের মতো না। আমার বউ অনেক সুন্দরী হবে!”
প্রেম গা-জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো, “এমন ফুটবল মার্কা চেহারা হলে তোকে টুনির মা ও মেয়ে দেবে না! হুহ, আসছে!”

রাজ আবারও তাল মিলিয়ে বললো, “ঠিক বলেছিস ভাই।”
তন্ময় একবার রাজের দিকে তাকায়, তো একবার প্রেমের দিকে তাকায়। ওরা দুজন কথা বলার পাশাপাশি দু’হাতে টপাটপ চিপস মুখে পুরছে।
তন্ময়ের মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। কেঁদে দেবে-দেবে ভাব। চিপসও শেষ!
হঠাৎ রাজ ফোন কানে ধরে “আসছি, আসছি” বলে ছুটে গেলো। ভাবখানা এমন, যেন কেউ ওর পিছে পাগলা সাড় লেলিয়ে দিয়েছে।
প্রেমও কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বললো, “হ্যাঁ, আমাকে এখনই পেন্টিং করতে হবে,” বলে সেও চুপচাপ কেটে পড়লো।

তন্ময় বউ না পাওয়ার দুঃখ মনে নিয়ে চিপসের প্যাকেটে হাত দিতেই দেখলো—পুরো ফাঁকা!
বউ না পাওয়ার দুঃখের সাথে চিপস চুরি হয়ে যাওয়ার দুঃখও যোগ হলো। সে এত দুঃখ নিতে না পেরে পুরো ড্রয়িং রুম কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
কোমরে ওড়না গুঁজে গিন্নি-গিন্নি ভাব নিয়ে রান্না করছে পরিণীতা। চুলগুলো উপরে উঠিয়ে বড় একটা ক্লাচার দিয়ে খোঁপা করে নিলো। সে সুনিপুণভাবে কাটিং বোর্ডে ছুরি চালাচ্ছে। পেঁয়াজ-মরিচ কুচি-কুচি করতে গিয়ে চোখের পানি, নাকের পানি এক করে ফেলছে। নাক টেনে টেনে প্রিয়তাকে বললো—

— “বনু, কাতলা মাছটা ধুয়ে দে।”
প্রিয়তা নাক সিঁটকে বললো—
— “আমি মাছ ধোবো?”
পরিণীতা বিরক্ত হয়ে বললো—
— “হ্যাঁ, তারাতাড়ি দে।”
প্রিয়তা বললো—
— “ইয়াক! ছিঃ, কি আসটে গন্ধ! আমি পারবো না।”
পরিণীতা বিরক্ত হলো। সে-ও মাছ ধুতে পারবে না, তার-ও ভীষণ ঘেন্না লাগে। সে ফুঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো।
সাদাফ ফোনে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো। পরিণীতা বিরক্ত চোখে সামনে তাকাতেই সাদাফকে দেখে ওর মাথায় একটা দুষ্টু আইডিয়া এলো। সে সাদাফকে ডাক দিলো। মিষ্টি কণ্ঠে বললো—

— “ভাইয়া, শুনছেন?”
সাদাফ ফোন থেকে মুখ তুলে পরিণীতার দিকে তাকালো। রান্নাঘরের গরমে মেয়েটার ফর্সা মুখ লালচে-গোলাপি হয়ে গেছে। কালো ওড়নাটা কোমরে গুঁজে দেখতে কিছুটা বউ-বউ লাগছে। হায়! সাদাফ এখুনি আরেকবার পরিণীতার প্রেমে মুখ থুবড়ে পড়লো।
পরিণীতা আবার ডাকলো—
— “ভাইয়া, একটু শুনবেন?”
সাদাফ ফোনটা ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে এগিয়ে গেলো। হাসি-হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো—
— “বলো, ফুলপরী।”
পরিণীতা গলায় আরও একটু মধু ঢেলে বললো—
— “আম্মু, ছোট আম্মু— আজকে রান্নার দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন। উনারা কেউ আশেপাশে নেই।”
সাদাফ হেসে বললো—
— “ভালো তো! তাহলে আজকে নতুন স্বাদের রান্না ট্রাই করবো।”
পরিণীতা বললো—

— “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু…”
সাদাফ বললো—
— “কিন্তু কী?”
পরিণীতা বললো—
— “একটা ছোট সমস্যা হয়ে গেছে।”
সাদাফ একভ্রু তুলে বললো—
— “কী সমস্যা?”
পরিণীতা বললো,
— “ওই যে, আমাদের দুজনের কেউই মাছ-মাংস ধোয়া পছন্দ করি না, মানে গন্ধ লাগে। আপনি যদি একটু ধুয়ে দিতেন?”
সাদাফের হাসি-হাসি মুখটা নিভে গেলো। মনে-মনে বললো, এই জন্যই এত তেল দেওয়া হচ্ছিলো! দ্য গ্রেট সায়েন্টিস্ট সাদাফ সাখাওয়াত মাছ পরিষ্কার করবে কিন্তু হবু বাচ্চার মা যেহেতু বলেছে করতে তো হবেই । সে বললো

— “দিয়ে দিতে পারি, কিন্তু I have a small condition.”
পরিণীতা বললো,
— “কী শর্ত?”
সাদাফ বললো,
— “আমি যা চাই, তাই দিতে হবে।”
পরিণীতা বললো,
— “আমার কী আছে দেওয়ার মতো?”
সাদাফ বললো,
— “আছে।”
পরিণীতা বললো,
— “তাহলে ঠিক আছে, যা চাইবেন, দেবো।”
সাদাফ বাঁকা হেসে বললো,
— “কোথায় ফিশ?”
পরিণীতা রুই মাছ, কাটলা মাছ, ইলিশ মাছ, পাবদা মাছ, মুরগির মাংস, গরুর মাংস, খাসির মাংস— সবগুলোর প্যাকেট সাদাফের সামনে রাখলো। প্রিয়তা আহাম্মকের মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছে পরিণীতার দিকে।
সে অতি মিষ্টি সুরে বললো,

— “ধুয়ে দিন!”
সাদাফ বাঁকা হেসে প্রিয়তাকে বললো,
— “কিচেন অ্যাপ্রন কোথায় রাখা, আপু?”
প্রিয়তা পাশের ড্রয়ার দেখিয়ে দিলো। সাদাফ সেখান থেকে একটা অ্যাপ্রন বের করে পরে নিলো। পাশে গ্লাভস রাখা ছিল, বাঁকা হেসে দু’হাতে দুটো গ্লাভসও পরে নিলো।
প্রিয়তা আর পরিণীতা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। দুই বোন তর্কাতর্কি করতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিল যে, গ্লাভস পরেও মাছ ধোয়া যায়!
যদিও এরপরও হালকা হালকা গন্ধ থাকতে পারে।
সাদাফ একে একে সব মাছ-মাংস ধুয়ে দিয়ে পরিণীতার উদ্দেশ্যে বললো—
— “এখন আমি যা বলবো, তোমাকে তাই দিতে হবে।”
পরিণীতা ফ্যাসাদে পড়ে গেলো। কিন্তু কথা যেহেতু দিয়েছে, দিতে তো হবেই! সে বললো—

— “কি চান?”
সাদাফ বাঁকা হেসে বললো—
— “কালকে চাইবো বলে…”
পরিণীতার গালে একটা টোকা দিয়ে চলে গেলো।
প্রিয়তা মনে-মনে বললো, এবার দেখো, কেমন লাগে!

প্রিয়তা just মাংসে দই মাখাচ্ছিল, ঠিক তখনই তন্ময়ের ঘর কাঁপানো চিৎকার কানে এলো তাদের। দুই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে “চ” আকারের শব্দ উচ্চারণ করলো। দু’জন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলো, The Great তন্ময় শিকদার মেঝের নেভি-ব্লু কার্পেটের ওপর পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে।
প্রিয়তা মুখ কুচকিয়ে, চোখ-মুখ সিরিয়াস করে তন্ময়কে শুনিয়ে-শুনিয়ে পরিণীতাকে উদ্দেশ্য করে বললো—
— “আপু, এই ভাঙা রেকর্ডারটা ছোট চাচ্চু কোন কচু বন থেকে যেন কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল।”
পরিণীতা একই ভঙ্গিতে বললো—
— “ওই যে, রায়পুরের পুরোনো ভাঙা হাসপাতালের পাশের কচু বনে পাচু উল্টে পড়ে-পড়ে কাঁদছিল।”
অরণ্য আর সমুদ্র সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে পরিণীতার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অরণ্য বললো—
— “তখন ছোট চাচ্চু ওরে দেখতে পেয়ে কুড়িয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল।”
সমুদ্র ছুটে এসে ছোট ভাইকে উঠিয়ে মুখ কাঁদো-কাঁদো করে বললো—

— “এইটাই বাস্তব, ভাই!”
তন্ময় এবার পুরো শিকদার বাড়ি কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ওরা চার ভাই-বোন কান চেপে ধরলো, যেন এখনই কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসার উপক্রম!
গিন্নিরা ছুটে এলেন। ওরা চার ভাই-বোন নিষ্পাপ বাচ্চার মতো মাসুম চেহারা বানিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ভাবটা এমন, যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতেও জানে না।
অর্থি বেগম ছুটে এসে ছোট ছেলেকে তুললেন। অনুশ্রী বেগম গাল মুছে দিয়ে বললেন—
— “কি হয়েছে, আব্বু?”
তন্ময় নাকের সব সর্দি অনুশ্রী বেগমের শাড়িতে মুছে, নাক টেনে-টেনে বললো—

— “পরি আপু, প্রিয় আপু, ছোর্দাভাই, সেজদা ভাই সেজদাদান, ছোটদাদান— ওরা সবাই বলছে, আব্বু নাকি আমাকে কুড়িয়ে এনেছে! ওহ, বড় আম্মু, সত্যি তোমরা আমাকে কুড়িয়ে এনেছ?”
এত চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে রাজ আর প্রেমও বেরিয়ে এলো।
তন্ময়ের কথা শুনে ছয়জন ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে রেখেছে।
অনুশ্রী বেগম রেগে ছয় ছেলে-মেয়েকে জুড়ে ধমক দিয়ে বললেন—
— “তোমরা এখনো ছোট রয়েছো, যে সবসময় ছোট ভাইয়ের পিছে লেগে থাকো! শুধু হাত-পায়ের বড় হয়েছো। ভাই সবার ছোট, আদর করবে— তা না, সারাদিন সবাই মিলে পিছে পড়ে থাকো! আরেকবার আমার আব্বুর পিছে লাগলে কান মুলে দেবো সবার!”
ওসব কথা ওরা কেউ কানে তুললো না । হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে চলে গেল।
অবশ্যই, অরণ্য যেতে-যেতে তন্ময়কে ফিসফিস করে বললো—

— “একদম মিথ্যে কথা, কান দিও না। আমরা যা বলেছি, সেটাই সত্যি। হুঁ!”
যার যতই মন খারাপ থাকুক, তন্ময়ের পিছে লাগার সময় কারোরই মন খারাপ থাকে না। সবাই তখন চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
একটু শান্ত হওয়া তন্ময় আবারও জোরে কেঁদে উঠলো।
রাত ১১:৩০। পরিণীতা আর প্রিয়তা বিশাল ডাইনিং টেবিলে সব খাবার পরিবেশন করছে। দুই বোন যত পদ রান্না জানতো, সব করে ফেলেছে। খাবার দেখে মনে হচ্ছে বিয়েবাড়ির এলাহি রান্না বান্না! যেমন—ভাত, পোলাও, ফ্রায়েড রাইস, রুটি, লুচি, পরোটা, নান, কুলচা, সহি কাবাব, টাংরি কাবাব, রেশমি কাবাবসহ আরও কয়েক পদ কাবাব।
মাছের পদে রয়েছে—ইলিশ মাছ পাতুরি, ইলিশের লেজভর্তা, ইলিশ মাছ ভাজা, ইলিশ ভাপা, সরষে ইলিশ, কালোজিরে দেওয়া ইলিশের পাতলা ঝোল, রুই মাছের বুনা, কাতলা মাছের কালিয়া, দই কাতলা, পাবদা মাছের ঝোল, চিংড়ি মাছের মালাইকারি।

মাংসের পদে রয়েছে—চিকেন কোর্মা, চিকেন কারি, চিকেন ভর্তা, বাটার চিকেন, চিকেন দুপেঁয়াজি, চিলি চিকেন, গরুর মাংসের কালা ভুনা, খাসির মাংসের কোর্মা।
ডেজার্টে রয়েছে নিজে হাতে বানানো রসগোল্লা। বেশ, এইটুকুই! দু’জন পাক্কা সাড়ে চার ঘণ্টা লাগিয়ে সব রান্না করেছে। রান্নাঘরের অবস্থা তো যাচ্ছেতাই! সে যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে নিশ্চয়ই বলতো—”চেরে দে মা, কেঁদে বাঁচি!”

তন্ময় দৌড়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো সবার আগে। এত মজার মজার খাবার দেখে তার জিভ দিয়ে পানি ঝরছে। একে একে বাড়ির চার কর্তা, চার গিন্নি, ছেলেরা আসলো। খাবারের গন্ধেই সবার খিদে আরও বেড়ে গেছে।
সদমান শিকদার এত খাবার দেখে প্রশংসা করে বললেন, “বাহ! আমার মেয়েরা রান্না করেছে? আজ এই খাবারের স্বাদই আলাদা হবে!” এতক্ষণে প্রিয়তার মুখে হালকা হাসি ফুটলো। এখন একটু ভালো লাগছে।
সবাই নিজ নিজ জায়গায় বসে পড়লো। অরণ্য ইনোসেক্ট ফেস বানিয়ে বললো, “কি জানি! কোন বিষ বানিয়েছে!”
পরিণীতা তেতে উঠে বললো, “তাহলে তোমার খাওয়া লাগবে না!”
অরণ্য বললো, “চেতছ কেন? আমি তো মজা করছিলাম! হি হি।”
সাদাফ আর শুদ্ধ তাদের প্রেয়সীদের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। শুদ্ধর ‘ওহ! ভালো লাগছে!’ প্রিয়তার মন কিছুটা ভালো দেখে, সেও একটু হাসলো।

পরিণীতা আর প্রিয়তা সবার প্লেটে খাবার তুলে দিলো। চার কর্তা ভাত নিলেন, চার গিন্নি রুটি-লুচি-পরোটা নিলেন, আর ছেলেরা তাদের পছন্দমতো—কেউ ভাত, কেউ পোলাও, কেউ ফ্রায়েড রাইস নিলো। সবাই প্রথম গ্রাস মুখে নিয়ে ওদের দু’জনের দিকে তাকালো।
পরিণীতা উৎসুক গলায় বললো, “কেমন হয়েছে?”
সবাই হেসে বললো, “বেশ ভালো হয়েছে!” সবাই হাসি-হাসি মুখে খাবার খেতে লাগলেন।
এখানে সবার থেকে প্রহেলিকাকে একটু বেশিই খুশি খুশি লাগছে ।
কেন কে জানে, হয়তো প্রিয়তাকে কষ্ট দিতে পেরেছে—তাই সে ভীষণ উৎসাহ নিয়ে খাচ্ছে। কিন্তু প্রিয়তার মন আবার অস্থির হয়ে গেলো। সে উশখুশ করতে লাগলো।
পরিণীতা ফিসফিস করে বললো, “এমন উশখুশ করছিস কেন?”
প্রিয়তা আশেপাশে, উপরে-নিচে নজর ঘুরিয়ে দেখলো—সবাই আছে, কিন্তু প্রণয় ভাইয়া নেই! সে মনে মনে বললো, “প্রণয় ভাইয়া কোথায়? আসবেন না?”

মাঝে মাঝে প্রিয়তার নিজেকে সর্বোচ্চ মাত্রার বেহায়া মনে হয়। কিন্তু এইসব ভাবনাকে তার মন বেশি সময় পাত্তা দেয় না। সে পা টিপে টিপে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আশপাশ দেখতে দেখতে প্রণয়ের ঘরে গেল, কিন্তু কোথাও কেউ তো নেই! তারপর পুরো বাড়ি খুঁজলো—বাড়ির কোথাও নেই প্রণয়!
প্রিয়তার চিন্তা হচ্ছে। সে বিড়বিড় করে বললো, “এতো রাতে অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় গেল মানুষটা?”
সবাই খেয়ে দেয়ে নিজ নিজ ঘরে চলে গেছে। পরিণীতা-ও নিজের ঘরে। প্রহেলিকা কাউচে বসে বসে ভাবছে—কি সমস্যা হলো? এতোগুলো মাস ধরে চেষ্টা করছে, কিন্তু হচ্ছেই না! মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললো, “ধুর! সব প্ল্যান মুখ থুবড়ে পড়েছে! কিন্তু এই প্ল্যানটা আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবো না। প্রণয়কে আমার করে রাখার, আমার দিকে মন ঘোরানোর এটাই শেষ উপায়!”
এসব ভাবতে ভাবতে সে প্রণয়কে ঊনত্রিশ নম্বর বার কল করলো। কিন্তু সেই প্রণয়ের ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেল।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১২

রাত ২:৪৫। শিকদার বাড়ির সকলে তন্দ্রাচ্ছন্ন। প্রহেলিকা-ও অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছে, হুশ নেই।
প্রণয় এখনও ফেরেনি।
ড্রইং রুমের সোফায় বসে অন্যমনস্কভাবে হাত কচলাচ্ছে প্রিয়তা। চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। ভয়ও হচ্ছে ভীষণ। “এতো রাত হয়ে গেল, প্রণয় ভাইয়া এখনও ফিরলেন না!”
সে অন্যমনস্কভাবে পায়চারি করছে। ওর চোখে এক ফোঁটা-ও ঘুম নেই।
২০ মিনিট পর কলিং বেল বেজে উঠলো…

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৪