ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৪
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠল প্রিয়তা। মনে মনে বলল, “এত রাতে কে এসেছে? প্রণয় ভাইয়া নিশ্চয়ই!” এতক্ষণে চিন্তার রেশ কাটিয়ে মুখে হাসি ফুটল তার। আর কালবিলম্ব না করে ছুট লাগাল সদর দরজার দিকে। মেইন ডোরটা খুলতেই তার চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল। নীল চোখজোড়া স্থির হয়ে গেল দরজার পানে—প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে।
চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটো অসম্ভব লাল। নিজের পায়ে ঠিকমতো সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না, পা দুটো এদিক-ওদিক টলছে, চোখজোড়া কেমন জলজল করছে। পরনের সাদা শার্টের উপরের দিকের তিনটে বোতাম খোলা, চোখে-মুখে মলিনতা। সুদর্শন চেহারার কী হাল হয়েছে!
প্রিয়তা ছুটে গেল প্রণয়ের কাছে। উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল—
“আপনার এই অবস্থা কেন, প্রণয় ভাই? কী হয়েছে? আপনার শরীর ঠিক আছে? জ্বর এসেছে? আবার হাত ব্যথা করছে?”
এমন হাজারো প্রশ্ন!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রণয় একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিল না। শুধু নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে রইল পানপাতা মুখটার পানে।
প্রিয়তা আবার কিছু বলতেই যাচ্ছিল ঠিক তখনই, একেবারে হঠাৎ করে, আচমকা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো—
প্রণয় প্রিয়তাকে শক্ত করে বাহুবন্ধনে জাপটে ধরল। নিজের শক্তসমর্থ, বলিষ্ঠ পুরুষালি বুকে অতি যত্নে চেপে ধরল ছোট্ট-খাটো নরম দেহটাকে। প্রিয়তা যেন তার কাছে আস্ত একটা ননির পুতুল।
জড়িয়ে ধরা মাত্র প্রিয় নারীর দেহ থেকে আবারও সেই অতি পছন্দনীয় মাদকীয় সুগন্ধ ছুটে আসছে। এমনিতেই অতিরিক্ত নেশা করার ফলে মাথার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে—এর উপর সেই পাগল করা, মাতাল করা মাদকীয় ঘ্রাণ প্রণয়ের মস্তিষ্কের সকল সিস্টেম হ্যাং করে দিচ্ছে। সে আর নিজের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারল না।
, তাই আর ভেবে সময় নষ্ট করল না। ফটাফট মাথা নিচু করে প্রিয়তার গলায় মুখ গুঁজে দিল।
মুহূর্তেই প্রিয়তার পুরো পৃথিবী থমকে গেল। সারা শরীর ঝনঝন করে কেঁপে উঠল।মনে হল কেউ তাকে তীব্র বৈদ্যুতিক শখ দিল।
এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষের, অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে, অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
প্রায় ছয় বছর পর হঠাৎ করেই কোনো কারণ ছাড়াই প্রণয় তাকে জড়িয়ে ধরেছে! এটা তার বিশ্বাসই হচ্ছে না, বিস্ময় কাটছেই না!
তার ছোট্ট দেহটা প্রণয়ের পুরুষালি দেহের স্পর্শে আসতেই তিরতির করে কেঁপে উঠছে। এই পুরুষ আর কখনও তাকে বিনা কারণে জড়িয়ে ধরবে—এটা সে ভাবতেও পারেনি।
প্রণয়ের শরীর থেকে তীব্র অ্যালকোহলের গন্ধের সঙ্গে “ওয়াইল্ড মেন” পারফিউমের গন্ধ মিলে মিশে এক অদ্ভুত মাদকীয় ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে । প্রণয় প্রিয়তার মাথাটা আরও একটু শক্ত করে নিজের বুকে চেপে ধরল। নাকটা গিয়ে ঠেকল প্রণয়ের উন্মুক্ত বুকে। পুরুষালী গন্ধটা এবার প্রণয়ের শরীর থেকে নাসারন্ধ্রে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করছে।
প্রিয়তার নিজেকে কেমন মাতাল-মাতাল লাগছে।
বুকের ভেতরটা কেমন উতাল-পাতাল করছে। প্রিয়তার মনে হচ্ছে তার মস্তিষ্কে নিউরনগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে ধীরে ধীরে। এমন অনুভূতির সঙ্গে সে পরিচিত নয়। এর আগেও প্রণয় ভাইয়া তাকে কত শতবার জড়িয়ে ধরেছে, কিন্তু এসব অনুভূতি অনুভব করার পরিস্থিতি ছিল না তখন।
ছয় বছর আগেও প্রণয় ভাই যখন-তখন তাকে জড়িয়ে ধরত। তখন তেমন কিছু অনুভব হতো না।
এখন যেমন অদ্ভুত, দম বন্ধ করা অনুভূতি সারা শরীর কাঁপাচ্ছে, তখন এমন কাপাকাপি করত না!
প্রিয়তা কিছুতেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, কাঁপাকাঁপি বন্ধ করতে পারছে না। গলা শুকিয়ে আসছে, গলা দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারছে না।
এদিকে প্রণয়ের সম্পূর্ণ নেশা চড়ে গেছে। সে ৮০% নিজের হুশেই নেই, তার পুরো মন ও মস্তিষ্ক জুড়ে আছে সামনের নারীটা। সে সবটা জুড়ে থাকলেও প্রকাশ করা বারণ ছিল কিন্তু এখন এসব নীতিবাক্য তার মাথায় নেই সে নিজেকে কোনো মতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না বলা চেষ্টাই করলো না । এই তুলতুলে দেহটাকে বুকে জড়িয়ে নিলে তার যে আকাশ পরিমাণ মানসিক শান্তি লাগে—যে শান্তির কিছুটা ও যদি অন্য কোথাও পাওয়া যেত, কিন্তু মেলেনি—সে জানে এই শান্তি পৃথিবীর অন্য কিছুতে মিলবে না। এই অপার মানসিক শান্তির আধার কেবলমাত্র এই নারীটি।
হুশে থাকা কালীন সে প্রতিনিয়ত বাহানা খুঁজতো এই নারীটিকে একটু খানি ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য। এই নারীর স্পর্শ তার জন্য জীবনদায়ী ওষুধ, যা তাকে মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। এই মেয়েটার জন্য সে যে কতটা তৃষ্ণার্ত, সেটা হয়তো এই বোকা মেয়েটা জীবনে আন্দাজও করতে পারবে না, বোঝবে না। সে যে প্রতিটা মিনিটে, সেকেন্ডে কতটা তার পেছনে ছুটছে, এই মেয়েটা জানবে না। তার জন্য এই আব্রার শিকদার প্রণয় কতবার নিজের হাত লাল করেছে, কত নিরীহের প্রাণ নিয়েছে!
আর আজকে তার এই অবস্থার জন্য তার পাপই হয়তো সবচেয়ে বেশি দায়ী। কিন্তু আল্লাহ সাক্ষী, সে একটা পাপও নিজের জন্য করেনি। যা করেছে, শুধুমাত্র নিজের রক্তজবাকে বাঁচানোর জন্য করেছে। কিন্তু আল্লাহর দরবারে পাপ তো পাপই, এর শাস্তিও তাকে পেতেই হবে, আর সেটা সে পাচ্ছেও।
কথায় আছে না মানুষ নিজের সব থেকে প্রিয় জিনিসটাই ধরে রাখতে পারেনা ওদের দুজনের ক্ষেত্রে ও সেটাই হয়েছে।
এমন হাজারটা শাস্তির বিনিময়েও তার রক্তজবা ভালো থাকুক—সে সেটাই দেখেই সুখে থাকবে। যেকোনো যন্ত্রণা ভুলে যাওয়ার জন্য মেয়েটার নীলাভ চোখের চাহনি, হাসিমাখা মুখ—এসবই যথেষ্ট এগুলো দেখলেই প্রণয়ের কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়।
সে স্বীকার করে, তার মনে জ্বলতে থাকা দাবানলের আগুন, তার মন জ্বালিয়ে দেওয়া বিধ্বংসী লেলিহান শিখা মুহূর্তেই শীতল তুষারে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে মেয়েটা। সত্যি বলতে, তার সামান্য স্পর্শ প্রণয়ের ক্রোধের সর্বোচ্চ সীমান্ত থেকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে আনার ক্ষমতা রাখে। সে মানে, এই ছোট্ট কোমল দেহটা জড়িয়ে ধরলে তার ভীষণ আরাম লাগে। জ্বলতে থাকা কলিজায় তুষারপাত হয়। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। বড়ো মানসিক শান্তি পাওয়া যায়।
কিন্তু এইসব থেকে সে গত দুই বছর ধরে বঞ্চিত রয়েছে। একটু ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিটা সেকেন্ড চাতকের ন্যায় ছটফটিয়ে মরেছে। কিন্তু অসহায়—সে পারেনি। তার এত কষ্ট, যন্ত্রণা দেখেও আল্লাহর এতটুকুও মন গলেনি। নিজের অসহায়ত্বের কাছে অপারগ সে, হেরে যাওয়া এক সৈনিক।
কিন্তু আজ সে তার হুশে নেই। তাই মন যা চাইছে, তাই করছে। নিজেকে আটকানোর কোনো প্রয়াস নেই, অনুভূতি লুকানোর কোনো ব্যস্ত চেষ্টাও নেই।
সে প্রিয়তার গলার কাছের জামায় হাত দিল। লাফিয়ে উঠল প্রিয়তা। সে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আপনি ড্রাঙ্ক?”
প্রণয় কোনো জবাব দিল না। প্রিয়তাকে ধরে ঘুরিয়ে দিল। প্রিয়তার পিঠ ঠেকল প্রণয়ের বুকে। সে নিঃশব্দে খোঁপায় আটকে রাখা বড়ো ক্লাচারটা খুলে দিল। মুহূর্তেই একরাশ ঘন কালো লতানো চুল বাঁধনহারা ঝর্ণার ন্যায় তরতরিয়ে নেমে এলো—প্রথমে কাঁধ, তারপর পিঠ, তারপর কোমর, আর শেষে হাঁটু ছাড়িয়ে গেল।
প্রণয় মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে আছে সেই ঘন কালো চুলে। প্রণয়ের সকল প্রিয় জিনিসের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে প্রিয়তার এই লম্বা কালো কেশরাশি, যা প্রণয়কে আরও বেশি পাগল করে দেয়। একসময় এই চুলের খেয়াল সে নিজেই রাখত।
কিন্তু প্রণয়ের জন্য সুখ খুব একটা স্থায়ী নয়। তাই তো সেই দিনগুলো নিমেষেই হারিয়ে ফেলেছে। বিনিময়ে কী পেয়েছে? মৃত্যুসম বিষাক্ত দিন।
সে মাথা নিচু করে প্রিয়তার খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে দিল। সুসু করে অতিপ্রিয় গন্ধটা নাক দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করছে।
“আহ, কি শান্তি! এই শান্তি পৃথিবীর কোথাও নেই।”
প্রণয় জড়িয়ে আসা গলায় বলল, “কি মাখিস চুলে? অ্যালকোহল? না হলে এত মাদকীয় কেন হবে? তুই জানিস, এটাতে আমার কত মাতাল-মাতাল লাগে! কেন আমাকে পাগল করে ধান্দায় থাকিস সবসময়?”
বলে মাথার চুলে ছোট্ট একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিল।
আবারও নিজের ঠোঁটজোড়া নামিয়ে নিল প্রিয়তার গলার কাছে। এক নরম আদরের স্পর্শ ফুটে উঠল প্রিয়তার অস্তিত্বে। আবারও কানের কাছে মুখ নিয়ে গভীর হাস্কে টোনে, অধিকার আর চরম ভালোবাসার মিশ্রণে ফিসফিস করে বলে উঠল, “তুই আমার, শুধু আমার।”
প্রিয়তা চকিতে তাকালো প্রণয়ের চোখের দিকে । তার চোখে চরম অবিশ্বাস। সে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলল, “এসব কি বললেন প্রণয় ভাই? কেন বললেন এগুলো? এটা কি অতিরিক্ত নেশার কারণে ভুলভাল প্রলাপ, নাকি…?”
এটা ভাবতেই সে আবার চমকে উঠে প্রণয়ের চোখের দিকে তাকাল। নীলাভ চোখ ভরে উঠল নতুন এক ভাবনায়—”এটা কি করে হয়? প্রণয় ভাইয়া তো প্রহেলিকা আপুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে!”
প্রিয়তা ভাবল,হয়তো নেশার কারণে ভুলভাল বকছেন। প্রণয়ের এমন লাগামছাড়া, এখানে-ওখানে ছুঁয়ে দেওয়াতে প্রিয়তার জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তবে সে বুঝল, এখনই প্রণয় ভাইকে আটকাতে হবে, কারণ উনি উনার হুশে নেই।
প্রণয়ের চোখ আটকে আছে প্রিয়তার লাল টকটকে পদ্মের মতো অধরে। প্রণয় নেশাভরা চোখে চেয়ে আছে—এই দৃষ্টি সহ্য হচ্ছে না প্রিয়তার। সে প্রণয়ের বুকে বল প্রয়োগ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল। কিন্তু প্রণয় আরও শক্ত করে কোমর পেছিয়ে ধরে মাদকীয় গলায় ধমক দিয়ে বলল,
“আরেকবার ছটফট করলে পাশের পুকুরে ফেলে আসব।”
তার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। প্রণয় তার বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে প্রিয়তার নরম ঠোঁটে স্লাইড করছে।
প্রিয়তার মস্তিষ্ক বলছে—”এই পুরুষ নিষিদ্ধ, এর এত কাছে আসলে মৃত্যু হবে তোর!”
“এখন সে হুশে নেই। হুশে আসলেই বউ ছাড়া কিছু বুঝবে না।”
এছাড়াও, এইসব পাপ-অন্যায় সে কারও স্বামীর মাতাল অবস্থায় সুযোগ নিতে চায় না।
প্রণয় নিজের কালচে লাল ঠোঁটজোড়া প্রিয়তার নরম ঠোঁটের কাছে আনতেই হঠাৎ করেই নিজের ভার ছেড়ে দিল প্রিয়তার উপর। এত ভারী শরীরের চাপ উপরে পড়তেই প্রিয়তার পদযুগল টলে গেল।
সে বুঝল—প্রণয় সেন্সলেস হয়ে গেছে।
তার পুরো দেহের ভর ছেড়ে দিয়েছে প্রিয়তার উপর। প্রিয়তার চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সে কিছুতেই প্রণয়কে নিয়ে ব্যালেন্স রাখতে পারছে না।
কেমন করে পারবে? কোথায় ৪৮ আর কোথায় ৮২!
প্রিয়তার কোমল দেহ কিছুতেই পুরুষালী ভারের তীব্রতা সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু প্রণয়কে সে কিছুতেই পড়তে দেবে না। তাই কোনো রকমে পিছাতে পিছাতে ড্রয়িং রুমের সোফায় নিয়ে শুইয়ে দিল।
ধপাস করে প্রণয়ের পাশে বসে পড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল।
প্রণয়ের নিস্তেজ, সুদর্শন চেহারার পানে চোখ রাখল। প্রণয়ের গালে হাত রেখে মোহনীয় গলায় বলল,
“যখনই ভাবি নিজেকে একটু শক্ত করব…”
“তখনই তুমি ঝড়ের বেগে এসে আবার সব এলোমেলো করে দাও। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দাও। সব দোষ তোমার! তুমি আমাকে তোমার কাছ থেকে সরে যেতে দিচ্ছ না। অদৃশ্যভাবে যেন বেঁধে রাখছো নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে। আমি কষ্ট পাচ্ছি, আর তোমার ভীষণ ভালো লাগছে, তাই না?”
“আমাকে যেহেতু ভালোই বাসো না, তাহলে বেঁধে রাখছ কেন? কেন অদৃশ্য হাতটা ছেড়ে দিচ্ছ না? আমি কোনো বিপদে পড়লে কেন তুমি সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ো? কেন আমাকে নরম করে তৈরি করলে? কেন শক্তভাবে তৈরি করলে না? ছোট থেকে কেন আমার এত যত্ন নিলে?”
নাক টেনে টেনে কথাগুলো বলল প্রিয়তা।
কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে আবারও বলল,
“জানো, কেন আমি তোমার প্রতি এত আসক্ত?”
“তুমি নিষিদ্ধ জেনেও… ওহ! তোমার প্রতি আমার আসক্তি এক ফোঁটাও কমেনি। বরং দিন দিন হুহু করে বেড়ে চলেছে। কেন পাপ জেনেও নিজেকে পাপী হওয়া থেকে আটকাতে পারছি না? তবে শোনো—”
“তুমি ছাড়া আমার জীবনে দ্বিতীয় এমন কেউ নেই—
যে আমার চোখ দেখলেই মন পড়ে ফেলবে,
আমার কিছু পছন্দ হলে মুখে বলার আগেই চোখের সামনে হাজির করবে।
আমার খিদে লাগছে—এটা আমার পেট বোঝার আগেই সে বুঝে যাবে।
আমার না বলা কথাগুলো তার কাছে খোলা বইয়ের পৃষ্ঠার মতো হবে।”
“তুমি ছাড়া দ্বিতীয় এমন কেউ নেই, জানো—
যার কাছে মানসিক শান্তি মিলবে,
যার বক্ষে স্বর্গের সুখ মিলবে।
মন খারাপের দিনে কিছু না বলেই ঘুরতে নিয়ে যাবে,
বুকে মাথা রাখতে দেবে—এমন কেউ নেই।”
“সবার কাছে আমার নীল চোখ রহস্যময় নীল সমুদ্র।
কিন্তু তুমি—তোমার কাছে এই চোখের গভীরতা এক হাতও নয়।”
“এত ভালোবাসা দেওয়ার পরও কি তোমার প্রতি এই অসুস্থ আসক্তি জন্মানোটা অস্বাভাবিক কিছু ?
তোমাকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়াটা কি ভুল?”
চোখ মুছে অন্য হাতটা প্রণয়ের অন্য গালে রেখে বলল—
“জানো, নারী পৃথিবীর কোনো কিছুতেই আটকে যায় না।
টাকা-পয়সা, রূপ, সৌন্দর্য—কিছুতেই নয়।
এই সব ক্ষণস্থায়ী। এক না একদিন এসবের ওপর থেকে মন উঠে যাবে। এসবে নারী আটকায় না।”
“কিন্তু নারী আটকে যায় স্নেহে, সম্মানে, ভালোবাসার যত্নে, আগলে রাখায়,
চোখের পানে তাকিয়ে মন বুঝে নেওয়ায়।
এই সবের কারণেই একবার যদি কোনো নারী কারও মাঝে আটকে যায়,
পৃথিবী অধিক-অধিক হয়ে গেলেও, সে আর এগিয়ে যেতে পারে না।”
সেখানে তুমি—
আমার জন্ম থেকে শুরু করে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত এই সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবেসেছ।
যত্ন নিয়েছ, মাটিতে পা রাখতে দাওনি—পাছে যদি পায়ে ময়লা লেগে যায়!
আমার না বলা কথাগুলোও অনায়াসে শুনে নিয়েছ।
আমাকে আমার চেয়ে বেশি বুঝেছ।
এত আদর-যত্ন, ভালোবাসা পাওয়ার পর—
আমি কি তোমার মাঝে না আটকে থাকতে পারি?
এটা কেউ বোঝে না। আমি বুঝাতেও চাই না।
এই আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা, এই থমকে যাওয়া সব কিছু আমার একার।
আমি জানি, তুমি আমার জন্য সারাজীবনের মতো নিষিদ্ধ।
তবুও তো আমার চোখে ভালোবাসা মানে শুধুই তুমি—আমার প্রথম ভালোবাসা।
তুমি আমাকে ভালোবাসো না তো কী হয়েছে!
আমি তো বাসি।
ডান হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল—
“কিন্তু আমি কখনোই আপনার কাছে ভালোবাসার দাবি করব না।
আমি জানি, আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।
আমি চাই, আপনি খুব সুখী হোন।
আপনার দুঃখ কষ্ট যা কিছু খারাপ আছে —সব আমার হোক।
আমার সকল সুখ আপনার হোক। আমিন।”
বলেই চোখ বন্ধ করে নিল।
বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল তরল বেদনা।
সে প্রণয়ের এলোমেলো সিল্কি চুলগুলো নিজের হাতে কিছুটা গুছিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে চেয়ে থেকে রান্নাঘরের দিকে গেল।
বড় সাইজের দুটি লেবু চিপে এক মগ লেবুপানি বানাল।
তাতে দুই চামচ লবণ মিশিয়ে প্রণয়ের কাছে নিয়ে গেল।
সে মগটা টি-টেবিলের ওপর রেখে প্রণয়কে টেনে-হিঁচড়ে তুলল।
কিন্তু এইভাবে কীভাবে খাওয়াবে?
তাই আবার রান্নাঘরে গেল।
নিজের সাদা ওড়নাটা ভিজিয়ে নিয়ে এলো।
কিছুটা সোজা ভাবে বসিয়ে চোখ-মুখ-গলা মুছে দিতে দিতে ভাবল—
কী এমন হলো?
যে প্রণয় ভাই কোনো দিনওমদ ছুঁয়ে দেখতেন না, ভাইয়াদেরকেও লুকিয়ে-চুরিয়ে খেতে দিতেন না—সেখানে উনি নিজেই নেশা করে বাড়ি ফিরেছেন!
এটা তো অবিশ্বাস্য, অসম্ভব ব্যাপার।
কিন্তু কে জানে কতটা খেয়েছেন, যে চোখটাও খুলে রাখতে পারছেন না!
প্রিয়তার মুছে দেওয়া কাজে লাগল। প্রণয় চোখ মেলে চাওয়ার চেষ্টা করল। তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
প্রিয়তা তাকে জোরজবরদস্তি করে পুরো এক মগ লেবুপানি খাইয়ে দিল।
লেবু পেটে যেতেই প্রণয়ের গা গুলিয়ে উঠল। চোখের পলক ফেলার আগেই সে প্রিয়তার গায়ে হড়হড় করে বমি করে দিল।
কিন্তু, মদ ছাড়া পেট থেকে আর কিছুই বেরোল না!
সে আবারও নেতিয়ে পড়ল।
এইসব মদ-গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস শিকদার বংশের ছেলেদের নেই—আর প্রণয় শিকদারের তো প্রশ্নই আসে না। তাই এসব মদ-গাঁজা তার সহ্য হয় না।
প্রিয়তার সারা শরীর থেকে মদের গন্ধ ছড়াচ্ছে।
আশ্চর্যজনকভাবে, একটুতেই খুঁতখুঁত করা মেয়েটার আজ মোটেই ঘেন্না লাগছে না।
প্রিয়তা নিজের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ভিজে ওড়নাটা দিয়ে আবারও মুখ-গলা মুছে কুশন দিয়ে লম্বালম্বিভাবে শুইয়ে দিল। যদিও প্রণয়ের পা সোফার বাইরে চলে গেছে।
প্রণয়ের মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে মনে মনে আওড়ালো—
“মাশাল্লাহ!”
কিন্তু নিজের গা থেকে আসা মদের গন্ধে এবার ওর নিজেরই গা গুলিয়ে উঠল। তাই সে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। ওয়ার্ডরোব থেকে মেরুন রঙের ফুল স্লিভ থ্রিপিস বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। পাক্কা ১৫ মিনিট ঘষে-মেজে গোসল করে বেরিয়ে এলো।
মেরুন রঙের থ্রিপিসে মেয়েটাকে অপ্সরী লাগছে।
এখন এত চুল শুকানোর সময় নেই, তাই চুলে একটা বড় তোয়ালে পেঁচিয়ে খোঁপা করে নিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রণয়ের কাছে এসে দেখল, সে বিধ্বস্ত শরীরে অজ্ঞান হয়ে ঘুমাচ্ছে।
প্রিয়তা কাছে গিয়ে আবার গালে হাত দিতেই চমকে উঠল—
আবারও জ্বরে!
শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
এখন শেষ রাত ৩:৫৫, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান হবে। আব্বু-চাচ্চু, আম্মু, বড়মা—সবাই উঠে পড়বে।
তারা যদি এভাবে প্রণয় ভাইকে দেখেন, তখন কী হবে? কত শত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে! সবাই উনার এ অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়বে। নেশা করে বাড়ি ফিরেছেন জানলে—উনার সম্মান নষ্ট হবে। সবাই ভুল বুঝবে!
প্রিয়তা কিছু একটা ভেবে তিন তলায় চলে গেল। শেষের দিক থেকে দুই নম্বর রুমের দরজায় নক করল—একবার, দুইবার… তারপর পরপর কয়েকবার।
প্রেম গভীর ঘুমে ছিল। অনেক রাত অবধি পেইন্টিং করেছে। দুই দিন পরই তার এক্সিবিশন—তাই দম ফেলার ফুরসত নেই। মাত্র দু’ঘণ্টা আগে ঘুমাতে গিয়েছে।
কিন্তু এমন দরজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দে তার ঘুম হালকা হয়ে এলো।
আবার পরপর কয়েকবার শব্দ হতেই সে পুরোপুরি জেগে গেল।
হাত বাড়িয়ে পাশের সেন্টার টেবিল থেকে চশমাটা তুলে চোখে পরে নিল। ঘড়িতে দেখল—৪:০১।
“এত ভোরে কে ডাকছে?”—ভেবে প্রেম একটু অবাক হলো।
কিন্তু আর কিছু না ভেবে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই হতবাক হয়ে গেল!
প্রিয়তা টলটলে চোখে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রেম প্রথমে অবাক হলো, কিন্তু বোনের চোখে পানি দেখে উত্তেজিত হয়ে গেল। উৎকণ্ঠিত গলায় বলল—
“কি হয়েছে, বোনু? তুই কাঁদছিস কেন? আর এই সময় তুই এখানে কেন?”
প্রিয়তা চুপচাপ দাদানের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিল।
প্রেম পুনরায় বললো—
“কি হয়েছে, বল তো?”
প্রিয়তা নিচু স্বরে বললো—
“ছোট দাদা, আমার সাথে একটু নিচে চলো…”
প্রেম বললো—
“কেন?”
প্রিয়তা কাঁপা গলায় বললো—
“প্লিজ দাদা, চলো। নাহলে সবাই উঠে পড়বে!”
প্রেম বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। কিছু না বুঝেই প্রিয়তা তার হাত ধরে ছুট লাগালো।
প্রিয়তা প্রেমকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো।
প্রেম নিজের বড় ভাইকে এমন অবস্থায় দেখে বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া করে গেল। হতবাক গলায় বললো—
“কি হয়েছে বড় দাদানের?”
প্রিয়তা কাঁপা গলায় সংক্ষেপে সব খুলে বললো।
কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো কথাগুলো বুঝতে। বুঝে উঠতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
ভাইয়ের অবস্থা দেখে মনে হলো, কেউ যেন ওর কলিজায় ছুরি চালিয়ে দিয়েছে।
সব বিস্ময় মিলিয়ে গেল মুহূর্তেই। একবার বোনের দিকে, আরেকবার ভাইয়ের দিকে তাকালো।
সবকিছু বুঝতে পেরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আর্তনাদ করে বললো—
“আমার ভাইটা… না জানি কত যন্ত্রণা অনুভব করে প্রতিনিয়ত। আল্লাহ, আমার ভাইকে ধৈর্য দাও, সহ্য দাও, সকল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করো!”
প্রিয়তা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললো—
“প্লিজ দাদা, উনাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। এখুনি! আব্বু-আম্মু উঠে পড়বে!”
প্রেম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো—
“বোনু, তুইও ধরবি? নাহলে আমি উপরে নিতে পারবো না।”
প্রেম প্রণয়কে টেনে তুলে ডান হাতের কব্জি ধরতেই প্রিয়তা চিৎকার করে বললো—
“ওখানে ধরো না, ভাইয়া! অন্য হাতে ধরো!”
প্রেম কপালে ভাঁজ ফেলে বললো—
“কেন?”
প্রিয়তা বললো—
“ওখানে উনি আঘাত পেয়েছেন।”
প্রেম বোনের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।
প্রণয়ের বাঁ হাত নিজের কাঁধে নিল।
প্রিয়তা সাবধানে প্রণয়ের ডান হাত নিজের কাঁধে নিল।
অনেক কষ্টে, ধীরে ধীরে তারা প্রণয়কে প্রেমের ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।
ওরা দু’জনে প্রণয়ের দুই পাশে চিতপটাং হয়ে পড়ে গেল।
হা করে শ্বাস নিচ্ছে দু’জন।
প্রেম মনে মনে বললো—
“কি খাস ভাই! আসলে, প্রণয়কে ভয়ে আনাতে দু’জনেরই প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়েছে। এত বিশাল দেহের, বলিষ্ঠ পুরুষকে বয়ে নিয়ে আসা মুখের কথা নয়!”
ভোর ৪টা ২৫। হালকা হালকা ঠাণ্ডা পড়েছে। পরিনীতা কালো রঙের একটা শাল দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি প্যাকেট করে নিলো। চোখ দু’টো ছাড়া প্রায় কিছুই দেখার উপায় নেই।
সে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ড্রয়িং রুমে পা রাখলো। সামনে চার কর্তা সাদা টুপি, পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের দেখেই পরিনীতা বড় পিলারের পিছনে লুকিয়ে পড়লো।
চার কর্তা নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলতে বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে চলে গেলেন।
পরিনীতা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির বাহিরে পা রাখলো। এখনো পুরোপুরি সূর্যের আলো ফোটেনি, বেশ অনেকটাই অন্ধকার। কিছুটা ভয় ভয় করছে।
পরিনীতার জহুরী চোখে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করলো। কেউ নেই। সে পা টিপে টিপে সদর দরজার বাইরে গেল। আম গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সামনে তাকালো।
চার জনের মাঝে দু’জন পাহারা দিচ্ছে।
পরিনীতা বিরক্ত হয়ে মনে মনে বললো, “এদের কি ঘুম পায় না?”
সে বাড়ির পেছন দিক ধরে হাঁটা ধরলো।
পদ্মপুকুর পেরিয়ে সে পেয়ারা গাছটার কাছে এলো। সাদা লম্বা স্কার্ট শক্ত করে ধরে শিকদার বাড়ির উপরের বন্ধ জানালাগুলোর দিকে তাকালো। কেউ দেখছে কিনা—না, কেউ নেই। কেউ দেখছে না।
সে ছেলেদের মতো পেয়ারা গাছের ডালে উঠে পড়লো। শিকদার বাড়ির ১২ ফুট উঁচু পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে নিচে দেখলো।
তার ভয় লাগছে এখান থেকে লাফ দিতে।
“এখন তো আর মাস্টার মশাই নেই, যে ক্যাচ ধরে ফেলবে!”
কিন্তু সে মনে সাহস এনে আল্লাহর নাম নিয়ে লাফ দিলো।
শিকদার বাড়ির পেছনের পিচঢালা রাস্তায় পড়ে হেভি ব্যথা পেলো। হাঁটুতে, কনুইয়ে, কোমরে কিছুটা ছিঁড়ে রক্ত বের হচ্ছে।
মিনিট পাঁচেক চোখ-মুখ কুঁচকে ব্যথা গিললো।
তারপর চকিতে আশেপাশে তাকালো।
এই সময়ে এখানে তাকে কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
এখন আকাশ আরও একটু পরিষ্কার হয়েছে।
সে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের ঝোপঝাড়ের দিকে তাকালো। ওই দিকটা অনেকটাই অন্ধকার।
সে মনে মনে আল্লাহর নাম নিয়ে ঝোপঝাড়ের চিকন ঘাসের রাস্তার দিকে পা বাড়ালো।
মিনিট দশেক হাঁটার পর সে একটা বড় জামরুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
সে ভাবলো, আর মাত্র ১০-১২ মিনিট, তার পর ধরবে।
জামরুল পড়ে পুরো গাছের নিচে বিছিয়ে আছে।
সে একটা তুলে ওড়নায় মুছে কামড় বসালো।
খেতে খেতে অপেক্ষা করতে লাগলো।
মিনিট দশেক পর সে দেখলো, দূর থেকে কেউ একজন হেঁটে আসছে।
সে হাঁটার ধরন আর দেহের গঠন দেখে চিনে নিলো।
সে গাছের নিচে লুকিয়ে পড়লো। আবিদ সাদা পাঞ্জাবি গায়ে, টুপি মাথায় দিয়ে এগিয়ে আসছে। সে ফজরের নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে গিয়েছিল। চোখ দু’টো তার অসম্ভব লাল, হয়তো সারা রাত ঘুমায়নি ছেলেটা।
সে জামরুল গাছটা অতিক্রম করে চলে যেতে নিলেই, কেউ দৌড়ে এসে পিছন থেকে তার পিঠের উপর আছড়ে পড়লো। আবিদ তাল সামলাতে না পেরে দুই পা এগিয়ে গেল। সে আশ্চর্য হয়ে গেল এমন হঠাৎ আক্রমণে, তার কপালে ভাঁজ পড়লো।
সে সোজা হয়ে পিছনে ফিরে তাকালো। পাঁচ ফুট দুই কি তিন ইঞ্চির একটি নারী অবয়ব, যার পুরো শরীর কালো চাদরে ঢাকা। এই আলো-আঁধারিতে অন্য কেউ দেখলে ভূত-প্রেত ভেবে ভয়ে আতঙ্কে অক্কা পেত। কিন্তু আবিদ তো আর তাদের দলে পড়ে না। সে ভ্রু কুঁচকে নারীটির দৃশ্যমান চোখের দিকে তাকালো।
গাঢ় বাদামি রঙের এক জোড়া অত্যন্ত মায়াবী টানা চোখ। তার কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল। সে এক টানে মুখ থেকে চাদর সরিয়ে নিলো। দৃশ্যমান হলো একখানা অতি মায়াবী সুন্দর চেহারা। দিবাকরের প্রথম আলো এসে মেয়েটির কোমল ফরসা ত্বকে পড়ে ঝিলিক দিচ্ছে, বড্ড মায়াময়ী দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।
আবিদের চোখে ভেসে উঠলো কাল সন্ধ্যার সেই অপ্রীতিকর তিক্ত দৃশ্য। এটা মনে পড়তেই শান্ত-শ্যামলা সুদর্শন মুখে ছড়িয়ে পড়লো হিংস্রতা। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো সে, ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে সামনের সপ্তদশী নারীর দিকে তাকালো।
পরিনীতা তার মাস্টারমশাইয়ের চোখে এমন দৃষ্টি খুব একটা দেখেনি, তাই কিছুটা ভয় পেলো মেয়েটা।
আবিদ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় হাঁটা ধরলো। পরিনীতা এমন অদ্ভুত আচরণে আশ্চর্য হয়ে গেল।
সে আবিদের বাঁ হাতটা নিজের কোমল হাতে ধরে আগলে নিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে, মাস্টারমশাই?”
আবিদের রাগটা তিরতির করে বাড়ছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে সামনের মেয়েটাকে এখানেই জীবিত কবর দিয়ে দিতে, সুন্দর মুখের নকশা পাল্টে দিতে। সোজা বাংলায়, এখানে নিজের হাতে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওই নরম কোমল মেয়েটাকে আঘাত করলে মেয়েটা যা ব্যথা পাবে, তার থেকে ওর নিজের প্রাণেই হাজার গুণ বেশি ব্যথা আছড়ে পড়বে। তাই প্রাণপণে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে, মেয়েটাকে আঘাত করতে চায় না সে ।
সে পুনরায় হাত ঝাড়া দিয়ে চলে যেতে নিলো। তার ক্রোধ একটু একটু করে সীমা ছাড়ানোর পর্যায়ে যাচ্ছে।
পরিনীতা এবার আরও অবাক হলো। সে বুঝলো না, তার অপরাধটা কী? সে এবার দৌড়ে গিয়ে সামনে থেকে জড়িয়ে ধরলো।
আবিদ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। এক ঝটকায় পরিনীতাকে নিজের থেকে আলাদা করে দিয়ে পরিনীতার নরম তুলতুলে গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলো। তার চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে, মেজাজ তার আগ্নেয়গিরির ন্যায় উত্তপ্ত লাভা ছড়াচ্ছে।
আবিদ নিজেকে আর সামলাতে না পেরে হিংস্র হয়ে গেলো। পরিনীতার চুলের মুঠি ধরে টেনে নিজের কাছে আনলো। মুখটা মুখের কাছে নিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে রাগে গজরাতে গজরাতে বললো—
“নষ্টা মেয়ে! খুব জ্বালা না শরীরে? যখন-তখন যে কোনো পুরুষকে জড়িয়ে ধরিস! তোদের মতো নষ্ট মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, মুখ দেখতেও ঘৃণা লাগে আমার! রুচিতে বাঁধে! একদম ছুঁবি না আমাকে। এই শোন, পরের বার তুই আর তোর এই অপয়া মুখ—কোনোটাই আমি দেখতে চাই না। তাই আমার সামনে আসার ভুল আর ভুলেও করবি না! আর এই সব গায়ে পড়া স্বভাব ছেড়ে ভালো হয়ে যা! ছিঃ!”
বলে পরিনীতাকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে হনহন করে চলে গেলো।
পরিনীতা পানিতে টলটলে চোখে বিস্ময় নিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিলো আবিদের কঠোর মুখপানে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না—তার মাস্টারমশাই তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছেন! যাকে তিনি সব সময় পবিত্রতার প্রতীক মনে করতেন, তিনি কিনা তাকে “নষ্টা” উপাধি দিলেন!
পরিনীতার নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না। হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার। বিন্দুমাত্র আফসোস নেই যে, আবিদ তাকে চড় মেরেছে। এমন চড় সে মাঝে সাঝেই খায়। কিন্তু আজকে আবিদ যে কথাগুলো বললো, পরিনীতা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি! কথাগুলো সোজা পরিণীতার কোমল হৃদয় কে আঘাত করেছে
তার কানে বারবার একটা কথাই বাজছে—
“তুই একটা নষ্টা মেয়ে! আমি তোর মুখ দেখতে চাই না! পরের বার তুই আর তোর এই অপয়া মুখ আমায় কখনোই দেখাবি না!”
পরিনীতার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। তার মাস্টারমশাই তাকে এই কথা বললো?
মেয়েটা এই বিষয়টা মাথায় আনতেই ভুলে গেল—আবিদ তাকে কেন এগুলো বলবে? সে তো এসব বলার মানুষ নয়! তার পুরো মন আর মস্তিষ্ক জুড়ে আবিদ বলা অতি তীক্ষ্ণ বিষাক্ত কটু বাক্যগুলো কয়েক মিনিট কাঁদতে কাঁদতে ছটফট করলো পুরো মূর্তে।
তার বারবার একটাই কথা কানে বাজতে লাগলো—
“তোর এই অপয়া মুখ আমি আর দেখতে চাই না! আমাকে দেখাবি না!”
পরিনীতা শুকনো পাতার উপর শুয়ে পড়ে কাঁদছে, কলিজা চিরে যাচ্ছে।
সকাল ৭টা ৪৫। আজ শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই সবাই বাড়িতেই আছে, কারও কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। বাড়ির অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা এখনো ঘুমিয়ে। বিশেষ করে জমিদার পুত্রদের জন্য তো এখন মধ্যরাত! আজ অফিস নেই বলে ১১টা অবধি ঘুমাবে, আর আগে যদি কেউ কানের কাছে ঢোলও বাজায়, তবুও কেউ উঠবে না।
তন্ময় হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে ঘুমিয়ে আছে, মুখের লালা দিয়ে পুরো বালিশ প্রায় ভিজিয়ে ফেলেছে। মিসেস অর্থি বেগম ঘরে ঢুকে ছেলেকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলেন। কাছে গিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন—
“আব্বু, উঠো!”
এই সব মৃদু ধাক্কা-ধমকি তন্ময়ের গায়েই লাগলো না। এবার অর্থি বেগম চিৎকার করে ডাকলেন—
“তন্ময়, উঠো!”
তন্ময় ঘুমের ঘোরে বিরক্ত হলো, কিন্তু উঠলো না। এমন চিৎকারে তোড়ি উঠে পড়লো। চোখ ডলতে ডলতে বললো—
“আম্মু, কি হলো?”
মিসেস অর্থি বেগম বললেন—
“তাড়াতাড়ি ভাইকে ডেকে তুলে নিচে আসো।”
এই কথা বলে অর্থি বেগম চলে গেলেন। তোড়ি ভালোই জানে, একে এভাবে ঘুম থেকে তোলা অসম্ভব ব্যাপার। তাই কিছু একটা ভেবে তন্ময়ের পেটের দিক থেকে টি-শার্ট তুললো, ফোলা ভুঁড়িতে জোরে একটা চিমটি কাটলো।
তন্ময় চিৎকার দিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠলো—
“কে? কে?”
বলে সামনে তাকালো। কিন্তু হায়! সামনের দৃশ্য ঝাপসা দেখলো। তন্ময় উঠে পড়েছে দেখে তোড়ি দৌড় দিলো।
তন্ময় চোখ কচলে হাতড়ে চশমা খুঁজে চোখে পরে নিয়ে সামনে তাকালো। কেউ নেই! তন্ময়ের খুব রাগ হচ্ছে। ভাবতে লাগলো—এই কাজ করলো কে? কিন্তু কোনো এক সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করা মুশকিল। কারণ, তার সব ভাই-বোনই সন্দেহভাজন। কাউকেই সন্দেহ তালিকার বাইরে রাখা যাবে না। তার মাঝে মাঝে আসলেই সন্দেহ হয়—ওরা কি সত্যিই তার ভাই-বোন? নাহলে সারাদিন তার মতো অবুঝ শিশুর পিছে কেন যুকের মতো পড়ে থাকবে!
সে আবার শুয়ে পড়লো। কিছু সময় এপাশ-ওপাশ করলো। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করার চেষ্টা করলো। কিন্তু দুঃখের কথা কী বলবো—পুরো ঘুম একবার ভাঙলে তা কি আর সহজে আসে!
চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। সে বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। তারপর দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
প্রহেলিকা ঘুম থেকে উঠেছে আরও এক ঘণ্টা আগে।
সে এক ঘণ্টা যাবত প্রণয়কে ফোন করে যাচ্ছে। কিন্তু গত রাতের মতো এবারও ওর ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেল। তার এবার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তার থেকে ও বেশি রাগ হচ্ছে নিজের উপর—সে ঘুমিয়ে পড়লো! ওর বর এখনো বাড়ি ফেরেনি, আর ও নিশ্চিন্তে কীভাবে ঘুমালো!
দুশ্চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে গেল। চার গিন্নির সাথে মিলে প্রেরণা শুক্রবারের স্পেশাল ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে। অনুশ্রী বেগম প্রহেলিকাকে দেখে মিষ্টি হেসে বললেন—
“কি ব্যাপার, আম্মু? আজকে এত দেরি হলো যে!”
প্রহেলিকা জোরপূর্বক হাসলো। এদিক-ওদিক তাকালো, কিন্তু এখনো কেউ নিচে নামে নি।
মিনিট পাঁচেক পর চার কর্তাও ধীরে ধীরে নিচে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়লেন। চার গিন্নি মিলে নিজেদের স্বামীকে পরম যত্নে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন।
প্রিয়তা সকাল সকাল আরেকবার গোসল সেরে নিলো। সাদা রঙের একটা অর্গানজা ফুল স্লিভ লং জামা পরে নিলো। পাক্কা এক ঘণ্টা সময় নিয়ে হাঁটু অবধি লম্বা চুলগুলো ভালোভাবে শুকিয়ে নিলো। কে জানে কেন, আজ মনটা অনেক ফুরফুরে। গুমরে মরতে মরতে হাসতেই ভুলে গেছে মেয়েটা!
কিন্তু কেন যেন আজ মনটা অনেক ভালো। তাই একটু সাজবে বলে ঠিক করলো।
প্রিয়তা স্ট্রেইটনার দিয়ে লতানো চুলগুলো আরও একটু স্ট্রেইট করে নিলো। ছোট ছোট উলের পুতুল বসানো দুটি ক্লিপ দিয়ে সামনের চুলগুলো আটকে পিছনে ছেড়ে দিলো। যদিও চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়ানো প্রিয়তার একদম পছন্দ নয়, কিন্তু আজ ইচ্ছে হলো।
সমুদ্র নীল চোখে হালকা কাজল দিলো। ঠোঁটে সেই চিরচরিত স্ট্রবেরি ফ্লেভারের লিপগ্লস। কানে ছোট্ট ছোট্ট হোয়াইট স্টার ইয়াররিংস। কপালে ছোট্ট কালো টিপ।
প্রিয়তাকে কেমন লাগছে, এই রূপের বর্ণনা করার জন্য কোনো শব্দই আমার শব্দভাণ্ডারে নেই। তাই আমার পাঠিকারা বুঝে নেবেন।
প্রিয়তা সাদা ওড়নাটা গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে গিয়ে আব্বু-চাচ্চুদের পাশে বসলো। চার ভাই মেয়ে দেখে ঝরঝরে হাসি উপহার দিলেন।
সাদমান শিকদার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—
“বাহ! আমার মা-টাকে একদম আমার আম্মাজানের মতো লাগছে, মাশাআল্লাহ!”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো।
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৩
সোফায় বসে চিন্তা করছিলো প্রহেলিকা। এই সব আদিখ্যেতা দেখে তার গা জ্বলে গেল। একে তো প্রণয়ের চিন্তা, তার উপর সবাই কী দেখে! এতটুকু বাচ্চা মেয়ের মাঝে সেটা বুঝে পায় না!
প্রহেলিকার খুব হিংসে হয়। মনে হয়, এই রূপের জন্যই হয়তো প্রণয় এত পাগল।
কেন? সে কি প্রিয়তার থেকে কোনো অংশে কম সুন্দর? ছিঃ! রাগে শরীর রি-রি করছে তার।
প্রিয়তা মা-চাচিদের কাছে গিয়ে বলল—