ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৬
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
ড্রয়িং রুমের পরিবেশ জমজমাট। ভাই-বোনরা মিলে জমিয়ে আড্ডার আসর বসিয়েছে। বিকেলের ঘুরতে যাওয়া নিয়ে এক একজনের এক এক ধরনের মতামত—যেমন ঘুরতে গিয়ে কী করবে, কী কী কিনবে ইত্যাদি বিশদ আলোচনা।
তাদের মধ্যে থেকে তন্ময় উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
— ইয়েএএ! আজকে অনেকগুলো রাইড ট্রাই করবো আর অনেক অনেক মিষ্টি খাবো!
অরণ্য ভাইয়ের মাথায় গাঁট্টা মেরে বললো,
— রাইড ট্রাই করতে গিয়ে সবার সামনে কাপড় নষ্ট করে ইজ্জত ডুবাতে চাস?
রাজও সমতালে খোঁচা মেরে বলল,
— আর এমনিতেই ফুলতে ফুলতে ফুটবল হয়ে গেছিস, এর ওপর এত মিষ্টি খেলে দেখা যাবে কোনো একদিন ‘গ্যাস বেলুন’ হয়ে উড়ে যাবি!
তন্ময় মুখ ভেংচালো। তার ইতর ভাই-বোনদের অপমান আজকাল আর তার গায়ে লাগে না। এসব তার সয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তোবা তার গায়ের চামড়াই মোটা হয়ে গেছে। সে বেশ ভালোই জানে, যত সে রাগ করবে, এরা তত বেশি পিছনে লাগবে। কিন্তু কী আর করার! সবসময় কি আর মাথা ঠান্ডা রাখা যায়?
তন্ময় ওদের কথায় পাত্তা দিল না দেখে ওরা মনে হয় মনঃক্ষুণ্ন হলো। কিন্তু হার মানার পাত্র তো তারাও নয়! অরণ্য আর রাজ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। পরপর অরণ্য রাজকে কিছু একটা ইশারা করলো। রাজও চোখের ইশারায় বোঝালো—ঠিক আছে!
রাজ আফসোসের সুরে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— ঠিক বলেছিস ভাই! এর ওপর দেখ, ওর দাঁতেও পোকা আছে। মাঝের কয়েকটা দাঁত তো চুরি হয়ে গেছে।
পাশ থেকে সমুদ্রও তাল মিলিয়ে বললো,
— আচ্ছা, তোমাদের কি মনে হয়, এত কিছুর পরও ওকে কোনো মেয়ে বিয়ে করবে?
প্রেমও সায় দিয়ে বললো,
— মনে তো হয় না!
এতক্ষণ সব অপমান গিলে নেওয়া তন্ময়ের আর সহ্য হলো না। অন্য যে কোনো অপমান তার গায়ে না লাগলেও, যখন কেউ বউ নিয়ে খোঁটা দেয় বা খোঁচা দেয়, তখন আর সে সহ্য করতে পারে না। তন্ময় ঠোঁট উল্টে ফেললো। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে! ভাবগতিক সুবিধার নয়—ঝড়ের পূর্বাভাস !
ওরা চার ভাই চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলো, যার অর্থ—প্ল্যান সফল! এখন আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়, তাই তারা চুপচাপ কেটে পড়লো।
তন্ময় বিকট গলায় চিৎকার দিয়ে উঠলো। সাথেই ওরা কানে চেপে ধরলো। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শব্দের তীব্রতা ও বাড়ছে, তাই তারা-ও কানে হাত চেপে কেটে পড়লো। তন্ময়ের কান্নার স্বর তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তারস্বরে চিৎকার শুনে ছুটে এলো প্রহেলিকা। তন্ময়কে কোলে নিয়ে বললো—
— “কি হয়েছে, ভাই?”
তন্ময় প্রহেলিকাকে জাপটে ধরে নাক টেনে টেনে অভিযোগ করলো,
— “বড় আপু, ভাইয়ারা আমাকে এটা বলেছে, ভাইয়ারা আমাকে সেটা বলেছে—ইত্যাদি।”
প্রহেলিকা সব শুনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো,
— “এ আর নতুন কি!”
প্রহেলিকা চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,
— “জানিসই তো, ওরা কেমন ইতর। ওদেরকে পাত্তা দেওয়ার দরকার কি! চল, আমরা সাথে…”
তন্ময় বললো,
— “কোথায়?”
প্রহেলিকা বললো,
— “আইসক্রিম খাব।”
প্রহেলিকার মুখ থেকে আইসক্রিমের কথা বের হতে দেরি, কিন্তু তন্ময়ের কান্না পল্টি নিতে দেরি করলো না। তন্ময়ের এমন সেকেন্ডের মধ্যে পাল্টি নেওয়া দেখে প্রহেলিকা ও অবাক হলো না, কারণ ওর সব ভাই-বোনই প্রায় এরকম। বড়গুলো তো ছোটগুলোর থেকেও কম বুঝে —হাতে-পায়েই বড় হয়েছে শুধু।
সকাল দশটা বাজতে চললো। পরিণীতা এখনো ঘর থেকে বের হয়নি। সকালের নাশতা-ও করেনি। অনুশ্রী বেগম ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে গেছেন মেয়েকে। উনার হয়েছে যত জ্বালা! উনার একটা ছেলে-মেয়ে-ও উনাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। তিনি সপ্তম বারের মতো পরিণীতার দরজায় কড়া নেড়ে বললেন—
— “তুই খুলবি নাকি? তোর আব্বুকে ডাকবো?”
পরিণীতা এত ডাকাডাকি আর নিতে পারলো না। ধড়াম করে দরজা খুলে দিলো। অনুশ্রী বেগম মেয়ের এমন অবস্থা দেখে চমকালেন! সর্বাঙ্গে মলিনতা, চেহারা ফ্যাকাশে, চোখ দুটো আগুনের ফুলকির মতো টকটকে লাল—যেন এখনই রক্ত গড়িয়ে পড়বে! অনুশ্রী বেগমের মাতৃমন ব্যথিত হয়ে উঠলো। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—
— “কি হয়েছে, মা?”
— “তোমার এই অবস্থা কেন?”
পরিণীতা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকালো। অনুশ্রী বেগম ব্যথিত নয়নে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়েই আছেন তার দিকে। পরিণীতা পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কৌশলে কথা এড়িয়ে গেলো। অনুশ্রী বেগমকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বললো,
— “আম্মু, মাথা ব্যথাটা আবার বেড়েছে। কাল রাতে একটু ঘুমোতে পারিনি, তাই এমন দেখাচ্ছে। তুমি চিন্তা করো না, আমি ঠিক আছি।”
অনুশ্রী বেগম সহজ-সরল মানুষ। উনার মনে এত জটিলতা নেই। আর সত্যি, পরিণীতার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। তাই তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “ওষুধ খেয়েছিস, আম্মু?”
পরিণীতা ছোট করে বললো, “উঁহু।” অনুশ্রী বেগম একটু রেগে গেলেন।
— “ধমক দিয়ে বললেন, কেনো?”
পরিণীতা তাচ্ছিল্য হাসি হেসে মনে মনে বললো, সব ব্যথা ওষুধে সারে না, আম্মু!
অনুশ্রী বেগম বললেন,
— “তারাতারি ফ্রেশ হও, আমি তোমাকে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেব।”
পরিণীতা একটু অধৈর্য হয়ে বললো,
— “আম্মু, তুমি খাবারটা ঘরে পাঠিয়ে দাও। আমি খেয়ে ওষুধ খেয়ে নেব।”
মেয়ের কথা শুনলেন না অনুশ্রী বেগম। তিনি বললেন,
— “চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
পরিণীতা চোখ-মুখ অন্ধকার করে ফেললো। কিছুতেই এই খাবার এখন তার গলা দিয়ে নামবে না। কিন্তু আম্মুকে বেশি কিছু বলাও যাবে না, নইলে উনি সন্দেহ করতে পারেন। অনুশ্রী বেগম খাবার আনতে চলে গেলেন।
পরিনীতা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি পড়তেই দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। নিজেকে দেখে থমকালো সে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় নিজের কী দশা বানিয়েছে! নিজের গালে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
—”কেন আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন? মাস্টারমশাই, আপনি তো আমাকে আমার থেকে ভালো বোঝেন… আপনি তো জানেন, আপনার অ্যাঞ্জেল আপনাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। মরে যাবে সে! সব জেনে-বুঝে কেন কষ্ট দিলেন?”
বলতে বলতে আবার হাঁটু মুড়ে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সত্যি, তার মাথাটা যন্ত্রণায় মাথাটা ফেটে যাচ্ছে।
পরিনীতা কাঁদতে পারে না, বিশ-পঁচিশ মিনিট কাঁদলেই তার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়। আর সেখানে ছয় ঘণ্টা তার চোখের পানি শুকায়নি। চোখের ভারী পল্লবগুলো ভিজে একটার সঙ্গে আরেকটা চিপকে আছে।
তার কানে কেবল একটা কথাই বাজছিল—
“তুই নষ্ট! তোর মুখ দেখতে চাই না, তুই আমার সামনে আসবি না!”
এই তিক্ত কথাগুলো মনে আসতেই ভেতরটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
প্রেমিকের বলা বিষ বাক্যে সপ্তদশীর অন্তর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে—
তবু সে নিজের মনের কাছে অসহায়। সত্যি, সে ওই মানুষটাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।
পরিনীতা চোখ বন্ধ করলো। কল্পনায় ভেসে উঠলো এক শ্যামসুন্দর পুরুষের চেহারা। সে নিজ মনেই বললো—
“আপনাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ…
আপনি অবহেলা করলেও আপনাকে ভালোবাসি, অপমান করলেও আপনাকে ভালোবাসি। আপনি অনিয়ম করে ভুলে থাকলেও আপনাকে সব সময় কল্পনায় রাখি। আমার এক আকাশ সমান ভালোবাসার কাছে আপনার অবহেলা ও অপমান কখনো বাধা হতে পারে না।
প্রিয়তা হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে পরিনীতার দিকে। হাতে তার খাবারের প্লেট।
অনুশ্রী বেগম রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার সময় কাজের মেয়ে রহিমা খালা তাকে ডেকে বললো,
— “বড় আব্বাজান আপনাকে ডাকছে, বড়োমা।”
অনুশ্রী বেগম স্বামীর আদেশ শুনে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। সিঁড়ি পার হতেই তিনি প্রিয়তাকে দেখতে পেয়ে বললেন,
— “ছোট আম্মু, তোমার পরি আপুর জন্য তাড়াতাড়ি খাবার নিয়ে যাও।”
প্রিয়তা একটা প্রশ্ন করারও সময় পেলো না। অনুশ্রী বেগম নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
অগত্যা প্রিয়তা রুটি আর আলুভাজি নিয়ে পরিনীতার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। প্রিয়তা নির্দ্বিধায় ঘরে প্রবেশ করে সামনের উক্ত দৃশ্য দেখে হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল পরিনীতার ক্রন্দনরত লাল মুখশ্রীর দিকে।
খাবারের প্লেটটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সে ছুটে গেল পরিনীতার কাছে। পরিনীতার মাথায় হাত দিয়ে বললো,
— “কি হয়েছে তোর, আপু?”
পরিনীতা চোখ তুলে অশ্রুশিক্ত নয়নে ছোট বোনকে দেখলো। প্রিয়তা প্রশ্নবোধক চোখে চেয়ে আছে তার দিকে।
পরিনীতা প্রিয়তার প্রশ্নবোধক চাহনিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পুনরায় নতুন উদ্যমে কেঁদে উঠলো।
পরিনীতা যতই নরম মনের মেয়ে হোক না কেন, সে প্রিয়তার মতো নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রদর্শন করতে পারে না। সবার সামনে সে অনেকটাই চাপা স্বভাবের। তার সমস্ত কোমলতা, শিশুসুলভ আচরণ,ও তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ—সবটাই তার মাস্টারমশাইয়ের কাছে। অন্যদের চোখে পরিনীতা খুবই ভদ্র, মার্জিত, শান্ত স্বভাবের মেয়ে; পরিস্থিতি বুঝে চলে।
অনুভূতি লুকিয়ে রাখার প্রতিভাটা শুধু পরিনীতার নয়, বরং প্রিয়তা ছাড়া পুরো শিকদার বংশের সবারই কম-বেশি রয়েছে। তারা প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান, কারো কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না।
তবে শিকদারদের সকল বৈশিষ্ট্যের ঊর্ধ্বে রয়েছে তাদের প্রচণ্ড পরিমাণ ভালোবাসার ক্ষমতা। তারা সকল বিষয়ে কুটিলতার আশ্রয় নিলেও ভালোবাসায় একদম নির্মল। তারা কাউকে সহজে ভালোবাসে না, আর ভালোবাসলে তার জন্য সকল সীমা অতিক্রম করতে প্রস্তুত—প্রাণ দেওয়া থেকে শুরু করে প্রাণ নেওয়া—কিছুতেই দ্বিধাবোধ করে না। এককথায়, ভালোবাসা নিয়ে যদি কোনো কথা হয়, তবে সেটাতে শিকদাররা ১০-এর মধ্যে ১০০!
পরিনীতা দেখলো, প্রিয়তা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পরিনীতা বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলো, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। বাম হাতের তালুতে নিজের চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রিয়তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— “তুই বস, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
বলেই তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়ালো। প্রিয়তা তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
প্রিয়তা এমন অদ্ভুত ব্যবহারে তাজ্জব বনে গেলো। এমন আচরণে সে বিস্মিত, হতভম্ব। প্রিয়তা মনে মনে বললো,
“এই তো কিছুক্ষণ আগেই কেঁদে-কেটে সাগর বানিয়ে ফেলেছিল, তাহলে এক সেকেন্ডের মধ্যে বদলে গেলো কীভাবে?”
প্রিয়তা হয়তো বুঝলো না—পরিনীতা প্রণয়ের বোন।
সেই প্রণয়, যে বছরের পর বছর নিজের আকাশসম অনিয়ন্ত্রিত আসক্তি নিজের ভেতর চেপে রেখেছে, ঝড়ের পর ঝড় নিজের বুক পেতে সহ্য করে নিয়েছে—সেখানে পরিনীতার এই ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক।
মিনিট দশেক পর ওয়াশরুম থেকে বের হলো পরিনীতা। প্রিয়তা দেখলো, মেয়েটা একেবারে গোসল সেরে বেরিয়েছে। প্রিয়তা তাকে এখনো হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরিনীতা একদম আগের মতোই স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
— “কি হলো? এমন হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন? মুখে মাছি ঢুকে পড়বে, হাঁ বন্ধ কর!”
বলে, ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো। চুল থেকে তোয়ালে সরাতেই কোমর অবধি ঘন কালো দীঘল কেশরাশি পিঠের উপর আছড়ে পড়ল।
প্রিয়তা বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলো, “আমি পাগল, নাকি আপু পাগল হয়ে গেছে? কে জানে বাবা!”
পরিনীতা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাতে শুকাতে বললো—
— “কি রে বোন, এভাবে আর কতক্ষণ চোখ দিয়ে গিলে খাবি? এখন তো আমার নজর লেগে যাবে!”
প্রিয়তা হিজিবিজি ভাবনা একপাশে সরিয়ে রেখে পরিনীতার পাশে গিয়ে বসে বললো—
— “তুমি ঠিক আছো, আপু?”
পরিনীতা চুলে হেয়ার ড্রায়ার চালাতে চালাতে বললো—
— “কেন? আমাকে দেখে কি তোকে অসুস্থ মনে হচ্ছে?”
প্রিয়তা কথা না বাড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো—
— “কাঁদছিলে কেন, আপু?”
পরিনীতা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো—
— “মাথা ব্যথা করছিল। তুই তো জানিসই, মাঝে মাঝে এমন হয়।”
প্রিয়তা—অনুশ্রী বেগমের মতোই সহজ-সরল মনের, কিন্তু এই কথা তার বিশ্বাস হলো না।
পরিনীতা বুঝতে পারলো প্রিয়তা তাকে সন্দেহ করছে। প্রিয়তার দিকে চেয়ে চাপা নিঃশ্বাস ফেললো। কান্না হজম করে রাখাতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
প্রিয়তা বললো—
— “বড় আম্মু তোমার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন, আপু।”
পরিনীতা ধীর স্বরে বললো—
— “ঠিক আছে, খাব।”
কোমর অবধি সিল্কি চুলগুলো শুকিয়ে নিয়ে হাত দিয়ে পেঁচিয়ে খোঁপা করে নিলো।
প্রিয়তা আবার কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই তুরি ছুটে এসে বললো—
— “আপু, তোমাদের বান্ধবীরা এসেছে।”
পরিনীতা ভ্রু কুঁচকে বললো—
— “কেন?”
প্রিয়তা বললো—
— “নিচে আসো, জানতেই পারবে।”
বলে, তুরির হাত ধরে ছুটে বেরিয়ে গেলো।
পরিনীতা ওদের প্রস্থানের পানে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এতক্ষণ চেপে রাখা ছাইচাপা জ্বলন্ত কয়লাগুলো বুকের ভেতর পুনরায় জ্বলে উঠলো। নিঃশব্দে চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা উষ্ণ তরল ।
ডান হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে পরিনীতা আয়নার দিকে তাকালো। গাঢ় বাদামি বর্ণের চোখে হালকা করে কাজল দিলো। লাল চোখে কালো কাজল—কেমন অদ্ভুত, ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। কপালে একটা ছোট কালো রঙের টিপ পরলো। উড়নাটা গলায় দিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
শিকদার বাড়ির ড্রয়িং রুমে গোল হয়ে বসে আছে—কুহু, চিত্রা, ইনায়া আর পূর্ণতা।
পূর্ণতা বসতে বসতে বিরক্ত হয়ে গেল। বিরক্তিতে সে চ আকৃতি শব্দ উচ্চারণ করে উঠে দাঁড়ালো।
মনে মনে পরিনীতার গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে পরিনীতার ঘরের দিকে পা বাড়াল। কি আশ্চর্য! না—শিকদার বাড়িতে দাঁড়িয়েই শিকদারদের গুষ্টি উদ্ধার করছে! সে মনে মনে ফুঁসতে ফুঁসতে তৃতীয় তলার সিঁড়িতে পা রাখতেই কারো বলিষ্ঠ বুকের সাথে ধড়াম করে বাড়ি খেলো। ব্যথায় আর বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকালো। এ বাড়িতে আসলেই সে কারো না কারো সাথে ধাক্কা খায়। সে না তাকিয়েই ফুঁসে উঠে বললো—
—”কোন খাম্বা রে! আমার মাথা ফাটিয়ে দিলি? কানা নাকি? আজব!”
রাজ বুকে হাত গুঁজে, এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে সামনের সপ্তদশী রমণীর পানে। সে মনে মনে বললো, “ঝগড়াটে মেয়েমানুষ এত সুন্দর হবে কেন? আশ্চর্য!” সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার ফর্সা মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। এটা দেখে রাজের মনে হলো—লাল টুকটুকে “পাকা স্ট্রবেরি ঝুলছে!” সে মনে মনে খান দশেক ক্রাশ খেয়ে বসলো।
পূর্ণতা অপর পাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্ত চোখে সামনে তাকালো। দেখলো, রাজ বুকে হাত গুঁজে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতার রাগ দ্বিগুণ বাড়লো। এই লোকটা পৃথা আপুর বিয়ের দিন থেকে তার পিছে পড়ে আছে! আজ তো একে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে।
পূর্ণতা ও-ই একই ভঙ্গিতে বুকে হাত গুঁজে, এক ভ্রু তুলে বললো—
—”আমি তো জানতাম, আপনি কানা। এখন তো দেখছি বোবাও!”
রাজ মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করলো, কিন্তু জবাব দিলো না। এতে পূর্ণতা অপমানিত বোধ করল। বিদায়, সে আরও বেশি রেগে গেলো। সে রাজের একদম কাছে চলে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো—
—”আপনি একটা হাড়বজ্জাত লোক! আমার পেছনে পড়ে থাকা ছাড়া আপনার আর কোনো কাজ নেই? আপনার বোন যেমন তার ছিড়া, আপনিও তেমন তার ছিড়া। ব্লা ব্লা ব্লা…”
এত ঝারি শুনে রাজ মোটেও বিচলিত হলো না। বরং ঠোঁট কামড়ে হেসে শান্ত গলায় বললো—
— “ভাই, এনি চান্স তুমি কি আমাকে ঝগড়াতে ইনভাইট করছো? তবে শুনে রাখো, মেয়ে-মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়া করা যায়, হয়তো জেতাও যায়। কিন্তু এমন সুন্দরী নাগিনের সঙ্গে ঝগড়া করার রিস্ক এই রাজন্য—শিকদার রাজ—কিছুতেই নেবে না। উহু! বলা যায় না, কখন আবার বিষ দাঁত বসিয়ে দাও!”
রাজের এমন খোঁচা মারা কথায় পূর্ণতার রাগের আগুনে এক চামচ ঘি-এর কাজ করলো। পূর্ণতা নিজের রাগটা কোনোভাবে গিলে নিয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।
রাজ ভ্রু কুঁচকালো। পূর্ণতা এক পা, এক পা করে রাজের একদম কাছে—খুব কাছে চলে এলো। পূর্ণতাকে এত কাছে দেখে রাজের হৃদপিণ্ড ধুকপুক করতে শুরু করলো। সে ভাবলো, “এটা স্বাভাবিক না! এটা নিশ্চিত কোনো স্ক্যাম!”
সে নিজেকে বোঝ দিল— “রাজ, বি স্ট্রং! কিছুতেই দুর্বল হওয়া যাবে না!”
এই চিন্তা করতে করতেই হঠাৎ—
— “উফফফ!”
পূর্ণতা বাঁকা হেসে বললো—
— “নাগিন যেহেতু বলেছো, ছোবল তো খেতেই হবে!”
রাজ নিজের পা ধরে নিচে বসে পড়েছে। পরিনীতা উপরে থেকে নামছিল। ভাইকে পা ধরে বসে থাকতে দেখে একপ্রকার দৌড়ে নেমে এলো। ভাইয়ের পাশে বসে উৎকণ্ঠিত গলায় বললো—
— “কি হয়েছে, দাদান? পায়ে ব্যথা পেয়েছো? কীভাবে?”
রাজ কোনো রকমে হাসার চেষ্টা করে বললো—
— “একটু-ও ব্যথা পাইনি, বোন।”
বলতে বলতে পূর্ণতার দিকে চোখ সরু করে তাকালো, যার অর্থ— “এক মেঘে বর্ষাকাল যায় না! আমারও সময় আসবে, তখন সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেব!”
পূর্ণতা মুখ ভেঙচি কাটলো, যার অর্থ— “দেখা যাবে, কে কাকে জব্দ করতে পারে!”
পরিনীতা আবার বললো, “তুমি ঠিক আছো, দাদান?”
পূর্ণতা নাক সিটকে বললো—
— “ঢং দেখলে গা জ্বলে যায়!”
বলে গটগট করে নিচে নেমে গেলো।
রাজ মনে মনে বাঁকা হেসে বললো—
— “সুন্দরী, মনে তো ক্ষত করেইছো। এখন দেহেও করলে ব্যাপার না! এর সুদ তোমাকে সুদে-আসলে ফেরত দেবে—এই রাজন্য, শিকদার রাজ।
পরিনীতা ভাইকে হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। ঝাঁকিয়ে বললো—
— “হাসছো কেন?”
রাজ উঠে দাঁড়িয়ে যেতে যেতে বললো—
— “তুই বুঝবি না!”
সত্যি, পরিনীতা কিছুই বুঝলো না। তাই সে আর তার ব্রেনকে বুঝতে জোর করল না। নিচে নেমে গেলো। পূর্ণতা রাগে খিটমিট করছে। এই লোকটা জাস্ট অসহ্য! পূর্ণতা একদম সহ্য করতে পারে না। রাগে ফুঁসফুঁস করতে করতে সে ইনায়ার পাশে গিয়ে বসলো।
মিসেস অনুশ্রী বেগম ওদের বিভিন্ন ধরনের নাস্তা দিয়েছেন। ইনায়া তো একের পর এক মিষ্টি মুখে পুরেই চলেছে। কেউ তার পাশে এসে ধপাস করে বসেছে, বুঝতে পেরে পাশে ফিরে তাকালো ইনায়া। দেখলো, পূর্ণতা ফুঁসছে।
ইনায়া অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো—
— “কি হয়েছে আপু? এত রেগে আছো কেন?”
পূর্ণতা কোনো জবাব দিলো না। ইনায়া একটা মিষ্টি পূর্ণতার মুখের সামনে ধরে বললো—
— “নাও, মিষ্টি খাও। মাথা ঠান্ডা হবে।”
পূর্ণতা অগ্নি চোখে তাকালো। ইনায়া আর বেশি ঘাঁটালো না। মনে মনে বললো— “মনে হচ্ছে ভালোই রেগে আছে। না জানি কার কপাল পুড়লো!”
সে শেষ মিষ্টিটা গালে পুরে এধিক-অধিক তাকালো, কিন্তু না, কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা নেই। মন খারাপ হলো ইনায়ার। চিত্রা আর কুহু, ওদের দুজনের পরিবর্তিত এক্সপ্রেশন দেখে কিছুই বুঝলো না।
ওরা সবাই একসাথেই শিকদার বাড়ি এসেছে কারণ সন্ধ্যার পর সবাই মিলে একসাথে মেলায় যাবে এবং আজ রাতটা তারা এখানেই থাকবে।
প্রিয়তা ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরো বাড়িতে চোখ বুলালো, কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির হদিস পাওয়া গেলো না। সে বাড়ির বাহিরে আসেপাশে দৃষ্টি বুলালো, কিন্তু কোথাও কেউ নেই।
সে কিছু একটা ভেবে শিকদার বাড়ির পিছনের দিকে পা বাড়ালো। কিছুটা দূরে এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল একটা সুঠাম দেহী পুরুষ অবয়ব।
প্রণয় পদ্মপুকুরের সানবাঁধানো ঘাটের এক পাশে দাঁড়িয়ে মনের সুখে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। এই নীল, বিষাদময় শহরে সুখ বলতে ওটুকুই।
সে ঘর থেকে বেরিয়ে তিন তলার মাঝারি ছাদে গিয়ে একটু বসেছিল। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই। পুরো শিকদার বাড়ি মাথায় উঠেছে। চেঁচামেচি আর হইহুল্লোড়ে পুরো বাড়ি গরম হয়ে আছে।
কিন্তু স্বল্পভাষী, গম্ভীর স্বভাবের প্রণয়ের এত নয়েজ মোটেই পছন্দ নয়। এমনি-তেও তার শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। গায়ের উষ্ণতাটা বোধহয় বাড়ছে, তাই এত কথাবার্তা হজম হচ্ছে না। অল্পতেই রাগ চড়ে যাচ্ছে মাথায়।
সিগারেটের শেষ টান দিয়ে পুকুরের কালচে নীল রঙা পানিতে দৃষ্টি গেঁথে বললো—
“পৃথিবীর সকল আফসোস বাক্যের সমষ্টি হবে—
তুমি কোনোদিনও আমার হবে না।
রক্তজবা হবে না আমার একান্ত।”
সে নিকোটিনের ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিল। তখনই পিছন থেকে একটা সুপরিচিত, চিকন, মিষ্টি কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো। প্রণয়ের ঠোঁটে ফুটলো এক অপার্থিব, প্রশান্তিময়, অদৃশ্য হাসি। কিন্তু সে পিছন ফিরলো না।
সে জানতো, তার রক্তজবা নিশ্চয়ই আসবে।
প্রিয়তা চপল পায়ে, অতি সতর্কতার সহিত ঘাটের প্রতিটি সিঁড়িতে পা রাখছে। কারণ, পুকুরটা বহু বছরের পুরনো হওয়ার দরুণ প্লাস্টারগুলো জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। পাশাপাশিই ভীষণ স্যাঁতসেঁতে আর পিচ্ছিল। একটু এদিক-ওদিক হলেই নিশ্চিত পড়ে কোমর ভাঙবে। তাই সে খুব সাবধানে নেমে প্রণয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো।
সূর্যকিরণের জন্য উপরে তাকানোই মুশকিল, অথচ মানুষটা এতটাই লম্বা—যে উপরে না তাকিয়ে কথা বলাও যাবে না।
তাই প্রিয়তা প্রণয়ের থেকে তিন সিঁড়ি উপরে দাঁড়ালো। এবার কিছুটা ঠিক আছে। সে আবারও প্রণয়কে ডাক দিল। এবার পিছন ফিরে চাইল প্রণয়। মেয়েটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সূর্যের তির্যক আলো গায়ে পড়ামাত্র মেয়েটার ফর্সা ত্বক হীরের মতো ঝিলিক দিচ্ছে। উত্তাপের ফলে গোলাপি গাল ধীরে ধীরে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
প্রণয় নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো, চেহারা টানলো সেই চিরাচরিত গম্ভীর্য। পুনরায় দৃষ্টি পুকুরের পানিতে নিবদ্ধ করে কঠিন কণ্ঠে বললো—
— “এখানে কী চাই? কেন এসেছিস?”
এমন ধমকের সুর শুনে প্রিয়তার আত্মা লাফিয়ে উঠলো। সে ঝেড়ে-ঝুরে যতটুকু সাহস সঞ্চয় করে এসেছিল, এমন ধমকের সুর শুনে সেটাও পালিয়ে গেলো।
সে মাথা নিচু করে নিয়ে বললো—
— “স-সরি, প্রণয় ভাই।
এই কথা বলতে…”
প্রিয়তার কণ্ঠনালী কেঁপে উঠলো, যা প্রণয়ের দৃষ্টিতে স্পষ্ট ধরা পড়লো।
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে বললো—
— “কেন?”
প্রিয়তা আমতা-আমতা করে সংকোচ নিয়ে বললো—
— “তখন আমার ওইভাবে বলা একদম উচিত হয়নি।”
প্রণয় এবার আবারও প্রিয়তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটার চোখে-মুখে অপরাধবোধের চাপ স্পষ্ট, সাথে ব্যথা-বেদনাও।
প্রিয়তা আবার মুখ তুলে চাইলো প্রণয়ের পানে।
প্রণয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রিয়তার নীলাভ আঁখিতে দৃষ্টি স্থাপন করলো এবং না-বলা কথাগুলো খুব সহজেই পড়ে নিলো। সাথে লক্ষ্য করলো, নীলাভ চোখের কোণায় অতি সূক্ষ্ম তরল চিকচিক করছে।
প্রণয় চোখ সরিয়ে নিলো, মনে-মনে মৃদু হাসলো। কিন্তু একই ভঙ্গিতে কণ্ঠে তিক্ততা মিশিয়ে বললো
—”আমার কী হলো, আমি খেলাম কি না খেলাম, মরলাম কি বাঁচলাম—তাতে তোর কী? তোকে বলেছিলাম, ‘তুই পারবি না, তাই না করে দিয়েছিস, সিম্পল!’ আর তাছাড়া, এই প্রণয় শিকদার কারও দয়ার পাত্র নয়।”
এমন কঠিন, তিক্ত, বিষাক্ত কথাগুলো বিষের ফলার ন্যায় প্রিয়তার নরম-কোমল হৃদয়ে আঘাত করলো। চোখের কোণে চিকচিক করতে থাকা শুকনো তরল এবার পরিপূর্ণ ফোঁটাতে ভরে উঠলো। সেটা চোখের পলক ফেলার সাথে সাথেই গড়িয়েও পড়লো।
সে মনে-মনে তাচ্ছিল্য করে বললো—
“আমার কি?”
সে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে প্রণয়ের বাদামি বর্ণের চোখে তাকিয়ে মনে-মনে বললো—
“সত্যি, আপনি আমার কেউ না। যদি কেউ হতেন, এতটা কষ্ট দিতে পারতেন না। আপনি তো আমার চোখ দেখেই সব বুঝে যান, অথচ আমার মনের অনুভূতি বোঝেন না। এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? আপনার বলার তিক্ত বাক্যের বিরোধিতা করার মতো কোনো ভাষাই নেই আমার। যে সব জেনে বুঝেই না বোঝার ভান করে, তাকে আর কি বুঝাবো? আপনি আমাকে দেখিয়েছেন—ভালোবাসা আসলে কতটা বিষাক্ত অনুভূতি! পৃথিবীর সমস্ত কষ্টের ওষুধ রয়েছে, কিন্তু এই অদৃশ্য যন্ত্রণার কোনো ওষুধ নেই।
“যেটা আছে, সেটাও এক নিষিদ্ধ পুরুষ—যার বক্ষে পাঁচটা মিনিট মাথা রেখে মনের ক্ষত নিরাময় করা ও সম্ভব নয়। বরং সেই পুরুষের সংস্পর্শে এলে ক্ষতের পরিধি আরও বাড়বে বই কমবে না।”
প্রণয় প্রিয়তার চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিল, তাই প্রিয়তার সকল কথাই সে শুনতে পেল। সে-ও মনে-মনে বললো—
“আমি একা কেন এই যন্ত্রণার বিষ পান করবো? তুমি-ও করো। আমি যেমন সেই ওষুধ থাকতে সত্ত্বেও নিতে পারবো না, তুমিও পারবে না। ভালোবাসার ভাগ নেবে, আর যন্ত্রণার ভাগ নেবে না—তা কী করে হয়? এই হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার সবটুকুই যেমন তোমার, তেমনি এই হৃদয়ে থাকা যন্ত্রণার বিষও তোমাকে প্রভাবিত করবে, রক্তজবা!”
প্রণয় কোনো কথা না বলে প্রিয়তাকে দুই হাতে তুলে নিজের সিঁড়িতে নিয়ে এলো।
প্রিয়তা গভীর ভাবনায় বিভোর ছিল। বিধায় এমন আচমকা আকাশে তুলে দেওয়ায় চমকালেও ভয় পেল না, কারণ ওই হাত দুটো তার অত্যন্ত বিশ্বস্ত। প্রিয়তা সামনে থাকা মানুষটার দিকে অবাক নয়নে তাকালো।
প্রণয়ের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
সে প্রিয়তার অবাক দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাকে ঘুরিয়ে দিল। সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে হাঁটু-সমান লম্বা চুলগুলো একত্রে নিজের হাতে পেঁচাতে শুরু করলো।
প্রিয়তা বিস্ময়ে হতবাক!
কিংকর্তব্যবিমূঢ়—কি হচ্ছে, না হচ্ছে সেটা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। প্রণয় কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই পিঠের উপর থেকে চুল সরাতেই ফরসা পিঠের কিছুটা সদৃশ হল। রোদের আলো পড়ার সাথে সাথেই জায়গাটা চকচক করে উঠলো।
প্রণয়ের হাত সহসা থেমে গেল, দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল।
ওই ফর্সা পিঠ যেন থাকে টানছে কেমন ঘুর লেগে আসছে—হাত-পা শিরশির করছে। শরীরে শিরায়-শিরায় ধাবিত হচ্ছে টেস্টোস্টেরন হরমোন, আর তার সাথে আবারও সেই পরিচিত মাদকীয় সুগন্ধটা ছুটে আসছে।
এই একটি মাত্র নারী, যার প্রতি প্রণয় তীব্র থেকে তীব্র শারীরিক ও মানসিক আকর্ষণ অনুভব করে। যার আশেপাশে থাকলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা দায় হয়ে পড়ে। এই মেয়েটির ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম জিনিসও তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষিত করে।
প্রিয়তার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত—পুরোটাই প্রণয়ের নখদর্পণে। নিজের হাতে লালন-পালন করার এই এক সুবিধা!
প্রণয়ের কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। সে কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো।
ওই খোলা পিঠের ফরসা ত্বক যেন প্রণয়ের শিরা-উপশিরায় উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রণয় চোখ বন্ধ করে নিলো, বড় করে নিঃশ্বাস নিলো। তারপর ফটাফট চুলগুলো খোঁপা করে সাদা ওড়নাটা মাথায় পরিয়ে দিলো।
প্রিয়তা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে—প্রণয় ভাই কি তার যত্ন নিলো?
প্রিয়তা কিছু বোঝার আগেই প্রণয় আবার রামধমক দিয়ে বললো—
“তোকে আর কতবার বারণ করতে হবে যে ভরদুপুরে চুল খুলে পুকুরপাড়ে আসবি না!”
ধমক খেয়ে প্রিয়তার শরীর ঈষৎ কেঁপে উঠল, কিন্তু ধমক খেয়ে মনের ভেতরে উড়ে গেল এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতি।
আজ কতগুলো দিন পর প্রণয় ভাই আবার তীব্র অধিকারবোধ নিয়ে তাকে শাসন করলো!
নাহয় সে অন্য কাউকেই ভালোবাসে, কিন্তু আগে যেমন তার সকল বিষয়ে খেয়াল রাখতো, এখনো কি পারে না?
প্রিয়তার মন তাচ্ছিল্য হেসে বললো—
“আগের মতো আচরণ করলে তুই নিজেকে সামলাতে পারবি তো? এখন তো বিষ খেয়ে বিষ হজম করছিস, তখন পারবি তো?”
মনের যুক্তি শুনে প্রিয়তা চুপসে গেল।
প্রণয় পুনরায় ধমক দিয়ে বললো—
“বাড়ি যা!”
প্রিয়তা চটফটিয়ে উঠলো।
সে যেটা করতে এসেছিল, সেটাই তো করা হলো না!
প্রিয়তা এখনো নড়ছে না দেখে প্রণয় বললো—
“রক্তজবা! বেয়াদবি আমার মোটেও পছন্দ নয়। বাড়ি যা!”
প্রিয়তা এবার মন ঝেড়ে জুড়ে একটুখানি সাহস সঞ্চয় করে বললো—
“আপনি সকাল থেকে কিছু খাননি। খাবেন না, প্রণয় ভাই?”
প্রণয় কাঠ-কাঠ গলায় বললো—
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৫
“না।”
প্রিয়তার ইচ্ছে হলো অনেক কিছু বলার, কিন্তু সাহসে কুলালো না।
তবে সে-ও হার মানবে না।
প্রণয়কে অবাক করে দিয়ে সে দৌড় দিলো বাড়ির দিকে।