ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৭

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৭
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

প্রণয় প্রিয়তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে চাপা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। তবে অনেকক্ষণ থেকে সে একটা বিষয় উপলব্ধি করছে—খালি মনে হচ্ছে কেউ তাকে দেখেছে। এই যে এখনো তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে যে এখনো কেউ তাকিয়ে আছে—প্রণয়ের ভ্রু-যুগল আপনা-আপনি কুঞ্চিত হয়ে গেলো। সে সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে নজর বোলাল, কিন্তু চার দিক একদম স্বাভাবিক—কোথাও কেউ নেই।
সে মাথাটা ঘুরিয়েই নিচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ পুকুরের শেষ প্রান্তের ঝোপে নজর আটকালো। কয়েক সেকেন্ড সে সেদিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। অতঃপর আবারো সেদিকে তাকিয়েই অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। কপাল চুলকে মনে মনে বলল, “যত্তসব চামচিকার দল! নিজেদের কী ভাবে!”

কিন্তু প্রণয়কে এই বিষয় নিয়ে তেমন ভাবতে দেখা গেল না। প্রণয় পুরো ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দিল।
চৈত্রের মধ্যাহ্ন প্রহরের প্রখর সূর্যরশ্মি প্রণয়ের গায়ে এসে পড়ছে। তার ফর্সা ত্বকও কেমন লাল হয়ে জ্বলছে। সে আর সেখানে দাঁড়ালো না, ধীর পায়ে পুকুর ঘাটের অন্য প্রান্তে চলে গেলো।
এই জায়গাটা বেশ শান্ত, শীতল ও আরামদায়ক। শিকদার বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর পেছনের অংশ। শিকদার বাড়ির সামনে ও ভিতরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চেয়ে কৃত্রিম সৌন্দর্যের সমাহার বেশি। তবে বাড়ির পেছনের দিকের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শিকদার বাড়ির পেছন দিক প্রায় ৩৫ হাজার স্কয়ার ফিট জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। সেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার—বিভিন্ন ধরনের বড় বড় ফুল ও ফলের গাছ। ফুল গাছগুলো থেকে ঝরে যাওয়া ফুল থোকায় থোকায় নরম ঘাসের উপর বিছিয়ে রয়েছে, যা খুবই দৃষ্টিনন্দন। তবে সব থেকে বেশি দৃষ্টিনন্দন হলো লাল পদ্মের পুকুর, যা পুরো জায়গাটার প্রায় সত্তর পার্সেন্ট দখল করে নিয়েছে। পুকুরটি চার দিক থেকেই শান বাঁধানো, যা তার শোভা আরো বৃদ্ধি করেছে।

পুকুরের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় চারটি আমগাছ। সেখানকার সবথেকে বড় গাছটার ছায়া গিয়ে পড়েছে পুকুরের শেষ প্রান্তে। ফলস্বরূপ, এই দিকটা বেশ শীতল। প্রণয় শুকনো পাতা সরিয়ে পানি থেকে এক সিঁড়ি উপরে বসে স্বচ্ছ কাচের ন্যায় টলটলে জলে পা ডুবিয়ে দিলো। তার দৃষ্টি পড়েছে একটা লাল রঙের পদ্মের ওপর। সে পদ্মফুলের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে কল্পনায় কিছু একটা আঁকলো। মুহূর্তেই মন চঞ্চল হয়ে উঠলো কল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য।

প্রণয় শান্ত হেসে বুকে হাত দিয়ে বললো, “তোর এই ছরফটানির জন্য আমি একটা সেকেন্ডও শান্তি পাই না! একটু শান্ত হ, ভাই, সব হবে।” তার শাসনবাণী মনে হয় মন শুনলো।
প্রিয়তা শিকদার বাড়িতে প্রবেশ করতে না করতেই ইনয়া ছুটে এসে তাকে পেঁচিয়ে ধরলো। কাজের সময় এমন আদিখ্যেতা করাতে প্রিয়তা ভীষণ বিরক্ত হলো। সে বিরক্ত চোখে বান্ধবীর দিকে তাকাতেই ইনয়া কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে বললো, “বান্ধবী!” অন্য সময় হলে ইনয়ার এই অসহায় মুখ দেখে সে মজা নিতো, হয়তো খোঁচা দিয়ে দুই-একটা কথাও বলতো। কিন্তু এখন এসবের সময় নেই। তাই ইনয়াকে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো, “এত তেল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যাকে খুঁজছিস, সে লাইব্রেরি রুমে আছে। এখন ছাড় আমাকে, সর সামনে থেকে।”
বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে দৌড় লাগালো। ইনয়া ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, ‘কিসের এত তাড়া?’ তবে বেশি ভাবলো না। যা জানার তা জানা হয়ে গেছে, তাই এসব ফালতু চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মুখে লজ্জার ভাব ফুটিয়ে তুলে দাঁত দিয়ে নখ কাটলো।

সে আবার লজ্জা মুখে উপরে যেতে যেতে বললো, “আমি এসে গেছি, পেয়ারেলাল!”
প্রিয়তা রান্নাঘরে গিয়ে একটা বড় প্লেটে গুনে গুনে আটটা রুটি আর সকালে নিজের হাতে বানানো প্রণয়ের প্রিয় ডিসটা নিলো। তারপর কিছু মনে করার ভঙ্গিতে প্লেটটা ক্যাবিনেটের ওপর রেখে নিজের ঘরের দিকে ছুটে গেলো। সেখান থেকে এক পাতা প্যারাসিটামল নিয়ে ফিরে এলো। তারপর খাবারের প্লেট আর একটা গরম পানির বোতল নিয়ে চুপিচুপি এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

পরিণীতা রান্নাঘরের দিকেই যাচ্ছিলো। তখন খায়নি বলে এখন তার ভীষণ খিদে পেয়েছে। কিন্তু রান্নাঘরের সামনে গিয়ে প্রিয়তার এমন চোরের মতো খাবার নিতে দেখে সে কপাল কুঁচকালো। মনে মনে বললো, ‘হাবভাব তো সুবিধার না! কিন্তু নিজের বাড়িতে চুরি করার কি আছে? আজব!’ মনে মনে আবারও বলল, ‘দেখতে হচ্ছে তো ব্যাপারটা।’
ব্যাপার দেখার জন্য সে পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো নিজের জন্য নিচ্ছে। কিন্তু আটটা রুটি নিতে দেখে তার চোখ কপালে উঠলো। কারণ, প্রিয়তা দুইটার বেশি রুটি কখনোই খেতে পারে না। তবে আটটা নিয়ে কি করবে?
তাকে ভাবনার জগতে ঝুলিয়ে রেখেই প্রিয়তা খাবার নিয়ে চোরের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। পরিণীতা এবার আরও আশ্চর্য হল।

মনে মনে ভাবলো, ‘ব্যাপারটা কি হলো? কোথায় গেলো?!’
কোথায় গেলো, তা দেখার জন্য পরিণীতা ও চুপিচুপি প্রিয়তার পিছু নিলো।
প্রিয়তা পুকুর ঘাটে এসে প্রণয়কে এদিক-ওদিক খুঁজলো, কিন্তু দেখতে পেলো না। মনে মনে বললো, “কোথায় গেলেন উনি?”
পরিণীতা নারকেল গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করে বললো, “এই মেয়েটাকে কি ভূতে ধরল নাকি? না হলে এই ভরদুপরে নির্জন পুকুর ঘাটে কাকে রুটি খাওয়াতে এসেছে?”
প্রিয়তা এদিক-ওদিক দেখতে দেখতেই চোখ পড়লো দীর্ঘ সিঁড়ির ওপারে। প্রণয় গাছের ছায়ায় বসে পানিতে পা ডুবিয়ে রেখেছে।

প্রিয়তার কেমন ভয় ভয় করছে। আবার যদি বকা দেয়, ধমক দেয়, বা যদি না খায়! সে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললো, “বাঁচিয়ে নিও, মাবুদ!”
সে দুরুদুরু মনে পা বাড়ালো প্রণয়ের দিকে। বুকটা কেমন ধুকপুক করছে।
প্রণয় হাত দুটো পিছনের দিকে রেখে হাতের উপর ভর দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তার অনুভব হচ্ছে, তার রক্তজবা এসেছে।
সে চোখ বন্ধ রেখেই বললো, “আবার কেন এসেছিস? তোকে না আসতে মানা করেছি! না শুনিস না কেন তুই?”
প্রিয়তা ঢুক গিললো। খাবারের প্লেটটা পাশে রেখে সে নিজেও প্রণয়ের পাশে বসে শীতল জলে পা ডুবিয়ে দিলো। তীব্র গরমে ঠান্ডা পানি পায়ে লাগতেই শরীর শিরশির করে উঠছে। আরামে চোখ মুদে আসছে।
পদ্ম পুকুরে মোট ৮০টা সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়িগুলি উপর থেকে একদম পুকুরের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। পুকুরের উপরি ভাগে ১৫টি এবং নিম্নাংশে ৬৫টি সিঁড়ি রয়েছে।
পানির ভেতরের প্রথম সিঁড়িতে পা ডুবিয়ে বসে আছে দুজন। স্বচ্ছ পানির ভেতর দুজনেরই ফরসা পা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

প্রিয়তা ডাক দিলো, “প্রণয় ভাই!”
প্রণয় কথার প্রত্যুত্তর না করে সোজা সামনের পানিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তার দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো ফুলো ফুলো , ধবধবে ফর্সা, সুন্দর ছোট্ট দুটো পা। সে পায়ের নখ থেকে গোঁড়ালি পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল কিছুক্ষণ।
তারপর সামনের দিকে চোখ রেখে উত্তপ্ত কণ্ঠে বললো, “তোকে এখন আর কিছু বলি না বলে তুই পেয়ে বসেছিস! বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস দিনকে দিন। একটা কথাও তুই শুনতে চাস না।”
প্রিয়তার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। সে মাথা নিচু করে নিলো। যেটার ভয় পাচ্ছিল, সেটাই হলো।
প্রিয়তা আমতা আমতা করে বললো, “এটাই শেষ বার।”
প্রণয় কপাল কুঁচকে মাথা ঘুরিয়ে প্রিয়তার মুখের দিকে তাকালো। ভারী পুরুষালি কণ্ঠে শুধালো, “কি শেষ বার?”
প্রিয়তা পুনরায় থেমে থেমে বললো, “বেয়াদবি।”

প্রণয় বললো, “তাহলে স্বীকার করে নিচ্ছিস, তুই বেয়াদব?”
প্রিয়তা ভাবনায় পড়ে গেলো। সত্যি তো! সে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছে যে সে বেয়াদব।
প্রণয় কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
প্রিয়তা তাড়াহুড়ো করে বললো, “না, না!”
প্রণয় মনে মনে হেসে বললো, “পাগলী!”
তারপর সে আবার সামনের সেই পদ্মফুলের দিকে চোখ রাখলো।
প্রিয়তা পুনরায় ডাক দিলো, “প্রণয় ভাই!”

প্রণয় সামনের দিকেই তাকিয়ে শান্ত গলায় উত্তর দিলো, “হুঁ।”
সে ভয়-ভয়, কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখনো রেগে আছেন?”
প্রণয় এক বাক্যে জবাব দিল না।
প্রিয়তা পুনরায় বললো, “আমি জানি, আপনি রেগে আছেন।”
প্রণয় আগের মতোই বললো, “যেহেতু জানিস, তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
প্রিয়তা কষ্ট পেলো। কাঁপা কণ্ঠে বললো, “কি করলে আপনার মাথা ঠান্ডা হবে? আমার ওপর রেগে থাকবেন না, প্লিজ বলুন।”
প্রণয় কিছু বললো না।
প্রিয়তা প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “প্লিজ খেয়ে নিন। আমি সরি বলেছি তো? পুরো ২০ ঘণ্টা হলো, আপনি কিছু খাননি।”

প্রণয় মাথা ঘুরিয়ে সোজা ওর নীল চোখের দিকে তাকালো। প্রেয়সীর দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব—নীল রঙের ডাগর ডাগর চোখ দুটো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে আকুতি নিয়ে। ওই নিলচে চোখের ধারালো চাহুনি প্রণয়ের রুহু অবধি কাঁপিয়ে তুলেছে।
সে অবাক হওয়ার ভান ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, “বাবা! তুই এটার হিসাবও রেখেছিস?”
প্রিয়তা এহেন কথায় লজ্জা পেয়ে গেলো। ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো দৃষ্টি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো।
প্রণয় প্রিয়তার লজ্জা পাওয়া দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
পুনরায় বললো, “যখন মুড ছিল, তখন খেতে চেয়েছিলাম। এখন আর মুড নেই, তাই খাবো না। তাই বলছি, শুধু শুধু কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করবি না।”

প্রিয়তা মন খারাপ করে বললো, “স্যরি বলেছি তো, প্লিজ!”
প্রণয় এসব অনুনয়-বিনয়ে কান দিলো না। তার একটাই কথা—খাবে না মানে খাবেই না।
প্রিয়তা দেখলো, প্রণয় তার কোনো কথাই কানে তুলছে না। তার মন আরও খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর, কিছু একটা ভেবে তার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো।
সে পাশে রাখা খাবারের প্লেটটা তুলে নিয়ে ভালো করে বসলো। গরুর মাংসের কালা ভুনা দিয়ে রুটি ছিঁড়ে নিজের মুখে পুরে দিলো। দুই বাইট খেয়েই—

জুড়ে জুড়ে নিজেই নিজের তারিফ করে বললো, “আমি তো বিশ্ববিখ্যাত রাঁধুনি হওয়ার যোগ্যতা রাখি! কী ভালো রেধেছি!” বলতে বলতে টপ করে আরেকটা বাইট মুখে পুরলো।
“কেউ না খেলে না খাক, আমি একাই খাব। কি সুন্দর খোলা-মেলা পরিবেশ, কেমন পিকনিক-পিকনিক ফিল পাচ্ছি!”
প্রিয়তা আর কোনো দিকে না তাকিয়ে টপাটপ রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরছে। প্রণয় মুগ্ধ চোখে নিজের প্রিয় রমণীটিকে দেখে চলেছে। তার বক্ষে বয়ে চলেছে প্রশান্তিধায়ক শীতল বাতাস। প্রিয়তার খাওয়া দেখেই তার অর্ধেক খিদে মরে গেল, মন তৃপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু কেউ তার সামনে বসে তার পছন্দের গরুর মাংসের কালা ভুনা খাবে—সেটা সে কী আর হজম হয়!

বেশিক্ষণ আর সে ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না। এমন লোভনীয় খাবার দেখে তার পেটও গুড়গুড় করে উঠলো।
প্রিয়তা আড়চোখে প্রণয়ের দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু প্রণয় ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, প্রিয়তা আরেকটু তারিফ করে বললো, “কি ভালো, আহা?”
বলে সে আবার একটা বাইট মুখে দিতে যাবে, তার আগেই প্রণয় তার হাত টেনে ধরে খাবারটা নিজের মুখে পুরে দিলো।
প্রিয়তা মিষ্টি হাসলো, প্রয়য়ের দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “তুমিই কি শুধু আমাকে চেনো? আমি চিনি না?”

প্রণয় অধৈর্য কণ্ঠে বললো, “হ্যাঁ, পরে তাকাবি! এখন তাড়াতাড়ি দে, ভীষণ খিদে লেগেছে!”
প্রিয়তা সব চিন্তা-ভাবনা পুকুরের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। একে একে করে সাড়ে সাতটা রুটি খাইয়ে দিলো প্রণয়কে। আটটার মধ্যে একটার অর্ধেক তো সে নিজেই খেয়ে নিয়েছে।
শেষ বাইটটা খাইয়ে দিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “পেট ভরেছে?”
প্রণয় কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “হুম।”
প্রিয়তা গরম পানির বোতলটা প্রণয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
প্রণয় সেটা হাতে নিয়ে মুখ কুঁচকে বললো, “গরম পানি কেন এনেছিস?”
প্রিয়তা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, “কারণ, আপনার জ্বর।”
প্রণয় আর কথা বাড়ালো না। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিলো। এবার বেশ আরাম লাগছে—খিদেয় পেটটা এতক্ষণ জ্বলছিল!

কে জানি বলেছিল, খোদার রাজ্যে পূর্ণিমার চাঁদ যেন জলসানো রুটি—একদমই সত্যি কথা বলেছিলো।
প্রিয়তা ওষুধের পাতা থেকে একটা ট্যাবলেট খুলে প্রণয়ের হাতে দিয়ে বললো, “খান।”
প্রণয় সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে প্রিয়তমার দিকে তাকালো।
তার মনে পড়ল, আগে সে যখনই অসুস্থ হত, ছোট্ট প্রিয়তা তাকে নিজের হাতে ওষুধ খাওয়াতো। সে হাসলো, তারপর বিনা বাক্যে ওষুধটা খেয়ে নিলো।
প্রিয়তা এবার বড় করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মনে মনে বললো, “বেটা অনেক জ্বালিয়েছে কাল থেকে!”
এখন সে নিশ্চিন্ত। মনে মনে প্রহেলিকাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কেমন বউ তুমি বড় আপু—নিজের স্বামীর খোঁজটা পর্যন্ত রাখো না! যত্নই যখন নিতে পারবে না, তাহলে কেড়ে নিয়েছিলে কেন আমার থেকে?”

সে আবার প্রণয়ের দিকে মায়াভরা নজরে তাকালো। প্রণয়ও একই সময় প্রিয়তার দিকে তাকালো। প্রিয়তার সুশ্রী মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে মনে মনে বললো—
“কেন আমার এতো কাছে আসো, প্রিয়তমা? কেন আমাকে প্রতিনিয়ত তোমার প্রতি আরও দুর্বল করে দিচ্ছ, যদিও আমার দুর্বল হওয়ার আর কিছু বাকি নেই! তবুও সহ্যের সীমা তো এখনো ভাঙেনি। কিন্তু তুমি এভাবে আমার যত্ন নিলে, সেটাও খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে তখন সর্বনাশ নেমে আসবে। তাই বলছি, আমার এত কাছে এসো না। আমি ছুঁয়ে দিলে তুমি পুড়ে যাবে, আর ছুঁতে না পারলে আমি মরে যাব। একেমন যন্ত্রণা, প্রিয়তমা!”
দূরে দাঁড়িয়ে এই সকল কাহিনি দেখলো তিনজন—দুইজন পুকুরের ওই পারে ঝোপের আড়াল থেকে, আর একজন আমগাছের আড়াল থেকে।

পরিণীতা হাঁ করে সামনের সমস্ত দৃশ্য গিলছিল। আম গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বাগানের পাতা-সাদা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল সে। পরিণীতার মাথা ঘুরছে। সে তার বোনের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। সে জানত, প্রিয়তা ওর ভাইকে ভালোবাসে, তাই বলে এতটা!
একজন বিবাহিত পুরুষকে সত্যিই কি এতটা ভালোবাসা যায়? উত্তরটা পরিণীতার মন থেকে আসল—বিয়ে-শাদি এগুলো তো লোক দেখানো নিয়ম। এই মামলায় ভালোবাসার যেখানে যুক্তি-তর্কের জায়গা নেই, সেখানে মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বও মূল্যহীন। ভালোবাসার ক্ষেত্রে মানুষ বেহায়া হতে দ্বিধা করে না, আর সত্যি বলতে, বিয়ে হলেই কি ভালোবাসা মরে যায়? এতটাইকি সস্তা সেই অনুভূতি যে তিনটা শব্দ আর একটা সাইন দিয়ে মুছে ফেলা যাবে না যাবে না ? আর সেখানে প্রিয়তার ভালোবাসা তো আজকের নয়। তাহলে সে কীভাবে ভুলে যাবে ?
পরিণীতা স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এই নিষিদ্ধ ভালোবাসা দিন দিন কমার বদলে আরও ডালপালা মেলছে। সে মনে মনে কয়েকটা লাইন আওড়াল—

“ভালোবাসা এমন এক পবিত্র অনুভূতি, যা বাড়তে বাড়তে এক সময় গাছের মতোই শাখা-প্রশাখার বিস্তার করে। গাছের ডাল ছেঁটে দিয়ে যেমন তার গতি রোধ করা যায় না, তেমনি নিয়ম বেঁধে দিয়েও ভালোবাসার গতি রোধ করা যায় না।”
“ভালোবাসা হলো ফুলের মতো—অল্প আঘাতেই তার সৌন্দর্য মলিন হয়, কিন্তু হারিয়ে যায় না। ভালোবাসা কোনো নিয়ম বা শর্তাধীন নয়, তা মুক্ত বিহঙ্গের মতোই ডানা মেলে উড়তে চায়।”
কিন্তু যতই ভালোবাসা থাকুক, পরিণীতা প্রিয়তাকে প্রণয়ের ভালোবাসার চাদর থেকে দূরে রাখতে চায়। কারণ, এই ভালোবাসা প্রিয়তার জন্য মোটেও সুখকর নয়। এই নিষিদ্ধ আসক্তি থেকে সে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না। একটা সময় আসবে, যখন আর সে এই তীব্র পীড়া সহ্য করতে পারবে না। এসব ভেবেই পরিণীতা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল।

সে আক্ষেপের সুরে বললো, “কেন বুঝতে চেষ্টা করিস না, বোন? বড় দাদান বড় আপুর, তোর নয়! আমি জানি বোন, বড় দাদানের থেকে তুই দূরে থাকতে পারিস না। আমি যখনই নিজেকে তোর জায়গায় রেখে ভাবতে যাই, নিঃশ্বাস নিতে পারি না, দম বন্ধ লাগে। আর বড় দাদান? আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, বড় দাদান ও তোকে ভালোবাসে!”
“আমার মায়ের পেটে ভাই, সে তার অনুভূতি কিছুটা হলেও বুঝি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেহেতু ভালো তোকেই বাসে, তাহলে সে কেনই বা বড় আপুকে বিয়ে করলো? কেন? দাদান তো বলেছিল, সে বড় আপুকে ভালোবাসে। কেউ তো তাকে বিয়ে করতে জোর করেনি।”
“আসলে এই সব কিছুর জন্য মূল অপরাধী কে, সেটাই বুঝতে পারছি না। যত দিন যাচ্ছে, পুরো ব্যাপারটা ততই গুলিয়ে যাচ্ছে। উফ! এত কী ভাবছো, ফুলপরী?”
পরিণীতা গভীর চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন ছিল। হঠাৎ কারও কণ্ঠস্বর কানে আসতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো পরিণীতা।

চকিতে পাশে ফিরে তাকালো—সাদাফ!
গালে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
পরিণীতার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে সাদাফ একটু অবাক হলো। ভ্রু নাচিয়ে বললো, “কি এমন ভাবছিলে, ফুলপরী, যে কথা শুনেই লাফিয়ে উঠলে?”
পরিণীতা নিজেকে সামলে নিলো।
স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। কথা এড়িয়ে গিয়ে বোকা হেসে বললো, “ভাইয়া, আপনি কখন এলেন?”
সাদাফ ভাবুক কণ্ঠে বললো, “যখন তুমি ইহজগত ছেড়ে ভাবনার জগতে পাড়ি জমিয়েছিলে, তখন!”
পরিণীতা একটু আশ্চর্য হলো। সত্যি কি ও এতটাই ভাবনায় বিভোর ছিল?
সাদাফ ডাকলো, “ফুলপরী!”
পরিণীতা প্রত্যুত্তর করলো, “হুম?”

সাদাফ পরিণীতার মলিন, শুকনো মুখের দিকে কিছুক্ষণ মনোযোগী দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তারপর কপালে ভাঁজ ফেলে সন্দিহান কণ্ঠে বলে উঠলো, “কি ব্যাপার, ফুলপরী? তোমার কি মন খারাপ? তুমি কি কেঁদেছিলে?”
পরিণীতা চমকে উঠলো। নজর লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। হঠাৎ পরিণীতার ঘাবড়ে যাওয়া দেখে সাদাফের কপালের ভাঁজ আরেকটু প্রসারিত হলো।
পরিণীতা হাসার চেষ্টা করে বললো, “কি? না, না তো।”

সাদাফের সন্দেহ আরো গাঢ় হলো মনে মনে বললো, “মিথ্যে বলছো কেন, ফুলপরী? কি এমন হয়েছে তোমার?”
পরিণীতার মলিন মুখটা দেখে সাদাফের বুকের নরম মাংসপিণ্ডে হালকা ব্যথা হলো।
সাদাফের খুব ইচ্ছে হলো মেয়েটার হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করতে—
“কি হয়েছে, ফুলপরী? তুমি কেন কষ্ট পেয়েছো? বলো আমায়। আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো। I promise! তুমি শুধু একবার আমাকে বলো।”
পরিণীতা চুপ করে বসে আছে, আর সাদাফ গালে হাত দিয়ে নিস্পলক চোখে পরিণীতার মায়াময় মুখের দিকে চেয়ে আছে। এই কাজে যেন সে কোনোদিনই বিরক্তি বোধ করবে না।
পরিণীতা মনে মনে হালকা বিরক্ত হলো—”এইভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়? বেচারি উঠেও যেতে পারছে না। গুরুজন, হঠাৎ উঠে গেলে বেয়াদবি হয়ে যাবে।”

সাদাফ পরিণীতার দিকে চেয়ে দুষ্টু হেসে বললো, “শর্তের কথা মনে আছে, ফুলপরী?”
পরিণীতা চোখ তুলে তাকালো। সে তো এই লোকের শর্তের কথা ভুলেই গিয়েছিল।
পরিণীতা মাথা নিচু করে স্বীকৃতি জানালো।
সাদাফ মিষ্টি হেসে বললো,
“আজ শর্ত পূরণের দিন।”
পরিণীতা মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেল—না জানি কি করতে বলবে! কিন্তু যেহেতু কথা দিয়ে ফেলেছে, কি আর করার!
পরিণীতা জিজ্ঞেস করলো, “কি করতে হবে আমাকে?”
সাদাফ পরিণীতার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। পরমুহূর্তেই মুখ সিরিয়াস বানিয়ে ফেললো। সিরিয়াস গলায় বললো, “ভয় পাচ্ছো ?”
পরিণীতা এবার আরও একটু ভয় পেলো, কিন্তু কন্ঠে অহংকার বজায় রেখে বললো, “আমি শিকদার বংশের মেয়ে, ভয় পাওয়া আমার ধাঁচে নেই! হ্যাঁ!”

সাদাফের বেশ মজা লাগলো। সে পরিণীতার দিকে একটু ঝুঁকে বললো, “সত্যি?”
পরিণীতা মুখটা একটু এগিয়ে এনে একই ভঙ্গিতে বললো, “১০০%।”
সাদাফ দুষ্টু কণ্ঠে বললো, “ওকে, তাহলে আজ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তুমি আমার।”
পরিণীতা একটু ভড়কালো। চোখ বড় বড় করে বললো, “মানে?”
সাদাফ কোনো উত্তর দিল না। পরিণীতার মুখে ফুঁ দিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে চলে গেল।
পরিণীতা বিমূঢ় হয়ে গেল। মনে মনে বললো, “আমি উনার মানে? তা কি?” সে আরও কিছু ভাবতে নিতেই হঠাৎ তার ফোনটা হাতের মুঠোয় ভাইব্রেট করে উঠলো। কেঁপে উঠলো পরিণীতা।
ফোনটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরতেই খুশিতে চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। বুকের ভেতর থাকা যন্ত্রটা খুশিতে আত্মহারা হলো। সকল অপমান, সকল তিক্ত বিষাক্ত কথা পরিণীতা জাস্ট ভুলে গেল।
সে তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললো, “মাস্টারমশাই!”

ওপাশ থেকে কোনো শব্দ শোনা গেল না।
তাতে কি! পরিণীতা তাড়াহুড়ো করে বলতে শুরু করলো, “মাস্টারমশাই, আমি… আমি জানতাম আপনি আমাকে ফোন দেবেন। আপনি আমাকে বকে থাকতেই পারবেন না। আপনি… আপনি কেন আমাকে ব্লক করে দিয়েছিলেন, মাস্টারমশাই? আমি কি করেছি? প্লিজ, আমি আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই। প্লিজ, মাস্টারমশাই, একটু কথা বলতে চাই।”

কথাগুলো বলতে বলতে পরিণীতা আবারও কান্না করে দিলো।
কিন্তু এবারও ফোনের ওপাশ থেকে কোনো প্রতিউত্তর ভেসে এলো না।
পরিণীতা “হ্যালো… হ্যালো” বলতে বলতেই ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল।
ফোন কেটে যাওয়ার শব্দ কানে আসতেই পরিণীতা ফোনটা কানে থেকে নামিয়ে দেখলো—কল কেটে গেছে।
পরিণীতা এবার আরও জোরে জোরে কান্না করে দিলো, ভুলেই গেল যে সে বন্ধ ঘরে নয়, বরং ওপেন প্লেসে রয়েছে।
পরিণীতা ব্যস্ত হাতে আবার ফোন ডায়াল করলো আবিদের নাম্বারে। চোখের পানিতে ফোনের অক্ষরগুলো ঝাপসা দেখছে।
সে ফোন ডায়াল করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এলো—
“আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন, সেটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।”
একবার, দু’বার, পরপর কয়েকবার পরিণীতা আবিদের নাম্বারে ফোন করলো। কিন্তু সেই একই কথা ওপাশ থেকে বারবার ভেসে আসলো—

“আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন, সেটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।”
পরিণীতা নিজের চুল টেনে ধরলো, ফোনটা ছুঁড়ে মারলো দূরে। দু’হাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা।
ভারি ফোনটা গিয়ে সোজা পূর্ণতার পায়ে আঘাত করলো।
পূর্ণতা চেঁচিয়ে উঠলো, “আহহ! পরীইইই, মারবি নাকি?!”
বলে সামনে তাকাতেই তার প্রিয় বান্ধবীর অবস্থা দেখে থমকে গেল পূর্ণতা। সে ছুটে গেলো পরিণীতার কাছে।
পরিণীতার চোখে-মুখে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনার সুরে বললো, “শান্ত হ পরি, কি হয়েছে তোর? এভাবে কাঁদছিস কেন?”
পরিণীতা পূর্ণতার দিকে অশ্রুশিক্ত নয়নে তাকালো। পূর্ণতা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পরিণীতা কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পূর্ণতার কোমর জড়িয়ে ধরলো।
কান্নার তীব্রতায় মেয়েটার হেঁচকি উঠছে।

পূর্ণতা দশ মিনিট কোনো প্রশ্ন করলো না, শুধু ধীরে ধীরে পরিণীতার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর কোমল কণ্ঠে বললো, “পরি, আমার দিকে তাকাও পরি।”
পরিণীতা উষ্ণতা পেয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ভাঙা ভাঙা গলায় বললো, “আমি খারাপ নই পূর্ণ, আমি খারাপ নই!”
পূর্ণতা আগের মতোই মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো, “তুই যে খারাপ না, সেটা এভাবে বলার দরকার নেই। সবাই জানে। দেখ, আমার দিকে তাকা।”

পরিণীতা অশ্রুশিক্ত নয়নে পূর্ণতার দিকে তাকালো।
পূর্ণতা তার গাল মুছে দিয়ে বললো, “একদম কাঁদবি না। আমি জানি, হয়তো এমন কিছু হয়েছে, যা তুই সহ্য করতে পারছিস না। আমি জানতে চাইবো না কী হয়েছে, শুধু বলবো—শান্ত হয়ে যা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পরিণীতা কিছুটা শান্ত হলো।
পূর্ণতা শুধু তার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী নয়, বরং তার কমফোর্ট জোন। পূর্ণতার কাছে সে তার মনের কথাগুলো সাচ্ছন্দ্যে বলতে পারে, ভীষণ স্বস্তি অনুভব করে মেয়েটার কাছে।
এমনকি প্রিয়তার কাছেও সে এতটা স্বস্তি অনুভব করে না।
পূর্ণতা পরিণীতার হাত ধরে বললো, “চল, একদম কাঁদবি না।” পরিণীতা ওর হাতটা ধরলো।
ওরা দু’জন বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।

শুদ্ধ আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। সে এতক্ষণ কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রায় দশ মিনিট আগে সে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। কিন্তু গার্ডেন এরিয়াতে পরিণীতা আর সাদাফকে কথা বলতে দেখেই গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল।
কথা বলা পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু…
পরেরটা… কী হলো?
পরের ঘটনাগুলো শুদ্ধর বুঝতে একটু অসুবিধে হল। সে কপাল চুলকে বললো, “কি হলো ব্যাপার?”
চোখ বন্ধ করে মিনিট পাঁচেক ভাবলো। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই হঠাৎ করেই চোখ খুলে ফেললো। ঠোঁটে ঝুলছে তার রহস্যময় হাসি।

সে বাঁকা হেসে বললো, “এই ব্যাপার!” মন তার আবারও ফুরফুরে হয়ে গেল।
সে বুকে হাত দিয়ে বললো, “অনেকক্ষণ আমার সুইটহার্টকে দেখি না। এখনই গিয়ে দেখতে হবে। না না, শুধু দেখলেই হবে না, টুপটাপ কয়েকটা চুমুও খেতে হবে।” সে যেতে যেতে গাইল, “আমার এই বাজে স্বভাব কোনদিন যাবে না!”
দুপুর দু’টো। ইনায়া এই নিয়ে দশম বার লাইব্রেরি রুমে উঁকি দিয়েছে। কিন্তু জমিদারদের আড্ডা এখনো চলমান!
ছুটির দিনে তারা পাঁচ ভাই মিলে পুরো সপ্তাহের ঘটা ঘটনা নিয়ে গবেষণায় বসে—এটা তাদের অলিখিত রুলস। তাদের মধ্যে বয়সের দিক থেকে একটু উনিশ-বিশ থাকলেও মন দিক থেকে তারা একদম সমবয়সী।
তবে সাত ভাইয়ের মধ্যে প্রণয় আর শুদ্ধর সঙ্গে তারা এতটা সহজ নয়। কারণ প্রণয় ওদের সবার বড় ভাই—ভীষণ শান্ত ও গম্ভীর প্রকৃতির। তারা ছোট থেকেই তাদের বড় দাদানকে খুব সম্মান করে, ভয় পায়। তাই তার সঙ্গে তারা অতটা খোলামেলা নয়।

আর শুদ্ধ? সে তো আরও এক কাঠি উপরে!
শুদ্ধর সঙ্গে তাদের একদম ফর্মাল সম্পর্ক। ফুফাতো ভাই হলেও তারা শুদ্ধকে খুব একটা ব্যক্তিগতভাবে চেনে না। তার উপর শুদ্ধ ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের—একেবারে প্রণয়ের মতো। তাই তাদের দুজনের সঙ্গে ওদের কাজের বাহিরে খুব একটা কথা হয় না।
ওরা পাঁচ ভাই তিন ঘণ্টা ধরে লাইব্রেরি রুমে আড্ডার আসর বসিয়েছে।
অরণ্য বারবার রাজের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু দুষ্টু হাসছে। অরণ্যের এসব কার্যকলাপে রাজ মহা বিরক্ত। অন্যরাও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে।

বারবার এমন করাতে শেষ পর্যন্ত রাজ আর সহ্য করতে পারলো না। ধমক দিয়ে বললো, “ওই! আমি কি তোর নতুন বউ? আমাকে দেখে বারবার এমন লতিয়ে যাচ্ছিস কেন?”
সমুদ্রও তাল মিলিয়ে বললো, “ঠিক ঠিক, বড় ভাইয়ের সঙ্গে বেয়াদবি!”
প্রেম, অরণ্যের সমর্থন টেনে বললো, “আহ! আমার ভাইটা কে বকছো কেন?”
সে-ও অরণ্যের মতো দুষ্টু হেসে বললো, “নিশ্চয় কোনো সিক্রেট ইনফরমেশন পেয়েছিস, তাই না ভাই?”
অরণ্য প্রেমকে এক চোখ টিপ দিয়ে বললো, “একদম!”
পৃথম নীরব দর্শকের ভূমিকায় পালন করছে।
প্রেম উৎসাহ দিয়ে বললো, “ভাই, আমি তোর পাশে আছি। একদম ভয় পাবি না। বল তুই!”
অরণ্য আবার রাজের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসলো।
রাজ এবার আর সহ্য করতে পারলো না। অরণ্যের পিঠ বরাবর দাঁড়াম করে কিল বসিয়ে দিল।
কুঁকিয়ে উঠলো অরণ্য।

এবার আর মুখ চেপে হাসি নয়, পুরো ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো সে।
ওরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।
অরণ্য হাসতে হাসতে ওদের কাছে সম্পূর্ণ ঘটনাটা খুলে বললো।
এবার অরণ্যের সঙ্গে প্রেম আর সমুদ্রও যোগ হলো।
পৃথম বললো, “ছি ভাই! তুই আমার ভাই—একটা পুচকে মেয়ের হাতে জব্দ হয়ে চলে এলি!”
অরণ্য ফোড়ন কেটে বললো, “শুধু কি তাই? সাথে চিহ্নও নিয়ে এসেছে!”
সমুদ্র উৎসাহিত কণ্ঠে বললো, “কিসের চিহ্ন?”
অরণ্য রাজের দিকে তাকিয়ে গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো, “প্রেমাঘাতের চিহ্ন!”
প্রেম বললো, “প্রেমাঘাত সেটা আবার কি?”

অরণ্য বললো, “ওটা তোমাদের মতো সিঙ্গেল বাচ্চারা বুঝবে না। মেজদাদা ঠিক বুঝে গেছে!”
পৃথম ওর মাথায় বাড়ি মেরে বললো, “বেশি পেকেছিস!”
সমুদ্র বললো, “আমরা সিঙ্গেল আর তোর তো এক ডজন বউ আছে, তাই না?”
এত পিনচ মারা কথা শুনেও রাজ প্রতিবাদ করলো না। তার ঠোঁটে ঝুলছে বাঁকা হাসি।
অরণ্য ভ্রু নাচিয়ে বললো, “তাহলে সেজো দাদান পূর্ণতাকে সেজো ভাবি ডাকা শুরু করে দিই?”
রাজ অরণ্যের মাথায় গাঁট্টা দিয়ে বললো, “পূর্ণতা কি শুধু ভাবি বল? একদম নাম নিবি না, বড় ভাইয়ের বউ হবে!”
সমুদ্র চেঁচিয়ে বললো, “ওয়াহ! প্রথমে মেজো ভাবি আর এবার সেজো ভাবি ও পেয়ে গেলাম!
এবার দুই ভাই।”
প্রেমের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো, “Now your turn! ছোটদাদান, ছোটো ভাবি কবে পাবো?”
প্রেম হাই তুলল, ওদের কথায় পাত্তা দিলো না।
হঠাৎ কথা বলতে বলতে অরণ্যের নজর পড়লো দরজার দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই তার ঠোঁটে পূর্বের নেয় দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো।

এবার সে পৃথমের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
ওর এমন হাবভাব দেখে বাকি তিন ভাই একটু গুছিয়ে বসল। ভাবখানা এমন, যেন আবার কোনো নতুন সার্কাস দেখার অপেক্ষায় আছে।
পৃথমের এমন তাকানো দেখে বিরক্ত হলো। বিরক্ত গলায় বললো, “একদম বদমাশি করবি না!”
অরণ্য ভাব নিয়ে বললো, “তোমার জন্য গুড নিউজ আছে!”
ওরা সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
পৃথম ভ্রু কুঁচকে বললো, “কি সুখবর?”
অরণ্য একটু ভেবে বললো, “এভাবে তো বলা যাবে না।”
পৃথম বললো, “তাহলে কি করতে হবে?”

অরণ্য বললো, “আগে ১০ হাজার টাকা দাও, তারপর খবর। এমন খবর দিবো, একদম দিল খুশ হয়ে যাবে!”
পৃথম বিরক্ত হয়ে বললো, “মাথা খারাপ করবি না ভাই! ভালো লাগছে না।”
অরণ্য বাঁকা হেসে বললো, “দরজার বাইরে মেজো ভাবি দাঁড়িয়ে আছে!”
পৃথম তড়াক করে চোখ খুলে ফেললো। বিদ্যুৎ গতিতে দরজার দিকে তাকালো।
সঙ্গে সঙ্গেই কেউ সরে গেল।
ওরা চার ভাই মুচকি মুচকি হাসছে।
পৃথমের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। সে লাফিয়ে বসা থেকে উঠে পড়লো।
ওয়ালেট থেকে ক্রেডিট কার্ডটা অরণ্যের হাতে দিয়ে বললো, “এতো ভালো খবর দেওয়ার ইনাম! আগামীকালকের মধ্যে যত খরচ করতে পারবি, সব তোর!”
বলে চলে গেল।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৬

ওরা চার ভাই পৃথমের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আবার হেসে ফেললো।
সমুদ্র বললো, “আজকে সিঙ্গেল বলে ভাই-ভাবিদের রঙ-ঢঙ দেখতে হচ্ছে! সময় একদিন আমারও আসবে!”
প্রেম ব্যঙ্গ করে বললো, “তোকে কে পছন্দ করবে?”
সমুদ্র ভাব নিয়ে বললো, “আমাকে তন্ময় পেয়েছো!”
‘তন্ময়’র কথা উঠতেই ওদের মুখের ভঙ্গি পাল্টে গেল। ওরা চারজন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো।
যার অর্থ—আবার মাথায় নতুন কোনো শয়তানি বুদ্ধির উদয় হয়েছে!

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৮