ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৮

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৮
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

ইনায়া বিরক্ত হয়ে করিডোরে অনবরত পায়চারি করছে আর দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। কখন থেকে অপেক্ষা করছে সে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির এখনো দেখা মেলেনি। এতো ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া তার মোটেও পছন্দ না। তবু সে অপেক্ষা করছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার—নীল চোখের সাদা বিড়ালটার উপর। সে ফুঁসতে ফুঁসতে মনে মনে বলল,
— “ঢঙ! অন্য সময় রসগোল্লা, রসগোল্লা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, আর এখন আমি তিন ঘণ্টা ধরে উনার বাড়িতে এসে বসে আছি, শুধু উনাকে একটু দেখবো বলে, আর মহাশয়ের কোনো পাত্তাই নেই! আমি যে এসেছি, সেই খবরটাও হয়তো উনি রাখেন না। যেমন বোনটা, তারছেঁড়া! কথার—কাজের কোনো মিল নেই, তেমন ভাইটা তো আরও বেশি তার ছেঁড়া !”

বলতে বলতে আবারো করিডোরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত কয়েক পাক খেল।
না, আর তো সহ্য হয় না! সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আল্লাহকে বলল,
— “হে মাবুদ! দিলেন যখন, একটা ভালো বেটাই দিতে পারতেন। এমন মিনিটে মিনিটে রং পাল্টানো বেটা না দিলেও হতো। এই বেটারে ভালোবেসে আমার জীবন তেনা তেনা হয়ে গেছে! তার যখন আমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়, তখন যে কোনো মূল্যে তার দেখতেই হবে। দরকার হলে বাড়ি থেকে তুলে এনে দেখবে, তবু দেখবেই! আর আমার যখন দেখতে ইচ্ছে হয়, তখন তার হদিসই পাওয়া যায় না! তার বাড়ি বয়ে আসলেও তার দেখা পাওয়া যায় না। আল্লাহ, এই অন্যায়ের বিচার দিলাম তোমার কাছে!”
পৃথম পাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে হাত দুটো আড়াআড়ি ভাবে বুকে গুঁজে কপালে ভাঁজ ফেলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইনায়ার দিকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “কি আশ্চর্য! সে যে এতটা জালিম, এটা সে নিজেই জানতো না! তার যে এত খুঁত আছে, সেটা সে নিজেই জানতো না। কে জানি বলেছিল, ‘বউকে জ্ঞান দিতে এসো না, কারণ সে নিজেই মস্ত বিশ্ববিদ্যালয়! তোমার ভুল ত্রুটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
পৃথম সেই ব্যক্তির প্রশংসা করে বলল,
— “কে বলেছিল জানি না, তবে একদম সঠিক বলেছিল!”
ইনায়ার কথা গুলো শুনে পৃথম বেশ মজা পেলো। সে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। যে মেয়েটা তার সামনে লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারে না, সেই মেয়েটা তাকে দেখতে তার বাড়ি বয়ে এসেছে—ইন্টারেস্টিং! পৃথম এবার ইনায়ার মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করে আবারো ভ্রু কুঁচকালো।
ইনায়া এখনো পৃথমকে লক্ষ্য করেনি। পৃথম ধীরে পায়ে এগিয়ে গিয়ে কোনো রকম কথা-বার্তা ছাড়াই আচমকাই ইনায়াকে কাঁধে তুলে নিলো। পৃথমের গুষ্টি উদ্ধারে ব্যস্ত থাকা ইনায়া হঠাৎ নিজেকে শূন্যে দেখে লাফিয়ে চিৎকার দিতে নিতেই পৃথম ধমক দিয়ে বলল,

— “চুপ! একদম শব্দ করবা না, রসগোল্লা! নাহলে এখুনি এখানেই তোমাকে কামড়ে খেয়ে ফেলবো। I swear!”
কোনো বাধা-নিষেধ মানবো না—ইনায়া দেখলো সে সেই প্রতীক্ষিত কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির কাঁধে। কিন্তু এগুলো কি বলল লোকটা! ঠান্ডা গলায় এমন নির্লজ্জ মার্কা হুমকি শুনে ইনায়ার কলিজা ছলাত করে উঠলো। বক্ষপিঞ্জরে থাকা প্রাণপাখিটা ছটফটিয়ে উঠলো। সে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো।
এই নির্লজ্জ পুরুষকে বিশ্বাস নেই—যা বলেছে, তা করে দিতেই পারে!
কারণ, পূর্বে প্রিথমের এমন লাগামছাড়া হুমকি ইনায়া গায় মাখতো না। বিধায় এই নির্লজ্জ পুরুষ তার সকল বানীই বাস্তবায়ন করে প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, সে তার বোনের মতো নয়— যা বলে, তাই করে। তাই, এই ভুল সে আর ভুলেও করবে না।

প্রিথম তাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। ইনায়ার ভেতরটা ভয়ে আর লজ্জায় সিটিয়ে গেল, তবে এই ভয় খারাপ কিছুর আশঙ্কায় নয়। এই ভয় তার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষের লাগামছাড়া কথা আর লাগামছাড়া কাজের। তবে প্রিথমকে সে অগাধ বিশ্বাস করে, ভালোবাসে, সম্মান করে। সে জানে, প্রিথম তার সাথে কখনোই খারাপ কিছু করবে না, করতে পারে না, কারণ প্রিথম তাকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসে।
কিন্তু এই লোকের লাগামছাড়া কথা-বার্তা ইনায়ার রুহু অব্দি কাঁপিয়ে তোলে।
প্রিথম তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। তারপর পাশের ড্রয়ার খুলে বড় একটা চকোলেটের বাক্স ইনায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাগি রাগি গলায় বলল—
— “কি ব্যাপার? দিন দিন এমন শুকিয়ে শুটকি মাছ হয়ে যাচ্ছো কেন? আমার হবু শ্বশুর কি তোমায় খেতে দেন না, নাকি ওজন কমানোর ভূতটা আবার মাথায় চেপে বসেছেন ? কোনটা?”
ইনায়া একটু ভয় পেয়ে প্রিথমের দিকে চোরা চোখে তাকালো, যার মানে— “একটু কম খাই, বেশি মোটা হয়ে যাচ্ছি তো!”

ইনায়ার মনের কথা বুঝতে পেরে প্রিথম আরও রেগে গেলো। ইনায়াকে টেনে হিচড়ে নিজের কোলে বসিয়ে ফুলোফুলো গালে একটা চুমু খেলো।
ইনায়া আহাম্মক বনে গেলো। সে জানতো, চুমু খাওয়ার জন্য রোমান্টিক মুড লাগে, প্রেম-প্রেম অনুভূতি লাগে। তবে কেউ যে রেগে গেলেও চুমু খায়— এটা সে সামনের মানুষটাকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। সত্যিই হয়তো শিকদাররা অন্য মাটি দিয়ে গড়া, তাদের মন বোঝা বড়ই দায়।
প্রিথম ইনায়ার অবাক হওয়াকে দুই পয়সার পাত্তা দিলো না। সে অপর গালেও আরেকটা কষে চুমু খেলো। অতঃপর তেজী গলায় ধমকে উঠলো—

— “এই মেয়ে, তোমাকে না, এই সব ডায়েট-ফায়েট বালছাল করতে বারণ করেছি!”
এমন বাজখাই চিৎকার শুনে ইনায়া চমকে উঠলো। নরম কণ্ঠে বললো— “হুম।”
প্রিথম রাগি গলায় আবারও ধমকে উঠলো।
কোলে বসেই কেঁপে উঠলো ইনায়া। প্রিথম রাগি গলায় বলল—
— “কোথায় বসে আছো এখন?”
ইনায়া ধমক খেয়ে হালকা ভয় পেলো। কাঁপাকাঁপা গলায় বলল—
— “তো, তোমার কোলে।”
প্রিথম গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠে বলল—
— “তুমি আমার বউ হবা। তোমাকে আমি কোলে নেবো। আমার যদি তোমাকে কোলে নিতে অসুবিধা না হয়, তাহলে তোমার কিসের অসুবিধা? তুমি কেন আমার এতো সুস্বাদু রসগোল্লার সাইজ ছোট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো, কেন?”

ইনায়া এই কথা শুনে রসগোল্লার মতো চোখ করে প্রীতমের সমুদ্র-নীল চোখের দিকে তাকালো। মনে-মনে বলল, “কি বলল লোকটা?” রসগোল্লার সাইজ! হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই সে নিজের দিকে তাকাল। সাথে-সাথেই চোখ-মুখ কুঁচকে মনে-মনে বলল, “ছি! নির্লজ্জ লোক!”
প্রীতম ইনায়ার মুখের অভিব্যক্তি দেখে আবার ধমক দিয়ে বলল,
— “কি সব উল্টোপাল্টা ভাবছো?”
ইনায়া অবাক হয়ে ভাবলো, মনের কথা শুনে ফেললো নাকি?

প্রীতমের ঠোঁটে হঠাৎ করেই বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো সে ঠোঁট কামড়ে হাসলো । ইনায়াকে আরও গভীরভাবে কাছে টেনে নিলো। তারপর মুখটা ইনায়ার গলার কাছে নিয়ে গিয়ে কেমন অদ্ভুত মাদকীয় কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল—
— “শুনো রসগোল্লা, তুমি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। উহু, সবার থেকে প্রিয় রসগোল্লা। তাই সেটার এক্সট্রা যত্ন তোমাকে নিতেই হবে। আমার রসগোল্লা, আমি তোমাকে শুকাতে দেবো না। আমার আদর দিয়ে সব সময় ফুলিয়ে রাখবো। তাই শুকিয়ে আমার সব ইনভেস্টমেন্টে পানি ডালার মতলব করবে না! আর হ্যাঁ, তুমি যেটা ভাবছিলে, ওটা ওহ!”

এতক্ষণ লজ্জা পেলেও শেষের কথাটা শুনে ইনায়া ভীষম খেলো। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। সে প্রীতমের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছে না। মনে-মনে প্রীতমকে আবারো ‘নির্লজ্জ’ উপাধি দিল।
প্রীতম আবারও আদর-মাখা কণ্ঠে বলল—
— “শুনো রসগোল্লা, এত রোগা বউ আমার পছন্দ না। বউ একটু গলুমলু হবে, বউয়ের গালগুলো ফোলা-ফোলা হবে, বউ তুলোর মতো নরম হবে—তবেই না আদর করতে ভালো লাগবে! জড়িয়ে ধরলে বউ বউ ফিল হবে মনে হবে না, বউকেই জড়িয়ে ধরেছি। আর তাছাড়া, এখন যদি তুমি খেয়ে-দেয়ে গায়ে বল না বানাও, তাহলে ভবিষ্যতে এই প্রতীক শিকদার প্রীতমকে কীভাবে সামলাবে? তাই আর এক গ্রামও যদি আমার বউয়ের ওজন কমে, তাহলে I swear! তোমাকে পুরোটা গিলে ফেলবো। You know না, আমার রসগোল্লা কত ফেভারিট!”

ইনায়া প্রীতমের মুখে এতবার ‘বউ’ ডাক শুনে লজ্জায় মিইয়ে গেলো। গালে ছড়িয়ে পড়ল রক্তিম লালিমা। তড়িৎগতিতে সে মুখ লুকালো প্রীতমের বুকে। এই লোকটা সব সময় এমন করে… বেহায়া লোক!
প্রীতম হালকা হেসে ইনায়ার চুলে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো। এই আদুরে মেয়েটা কেন যে তাকে এত আকর্ষিত করে, বুঝতে পারে না সে। এই প্রতীক শিকদার প্রীতমের কোনো দুর্বলতা নেই, কোথাও সে আটকায় না—তবে কেন এই মেয়েটার প্রতি তার চরম আসক্তি? হ্যাঁ, এই মেয়েটাই ওর দুর্বলতা ওর প্রান এখানেই আটকে গেছে সে। সে ভালোবেসে ফেলেছে… বড্ড বেশি। নরম দেহটা পৃথম আরেকটু নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে পরম সুখের নিঃশ্বাস ফেলল।

সুদ্ধ’র আজ দুটো অপারেশন করার কথা থাকলেও, সে একটা করেছে। আর আরেকটা সে তার কলিগ আর তার স্পেশাল টীমের হাতে তুলে দিয়েছে। সুদ্ধ আগের মতো দিন-রাত ধরে এখন আর অপারেশন করাতে পারে না, কারণ তার বাঁ হাতের ব্যথাটা এখনো পুরোপুরি সারেনি। মাঝে মাঝে ভীষণ যন্ত্রণা হয়, বেশি নাড়াচাড়া করলেও কষ্ট হয়—এখনও ভালোভাবে শুকায়নি জায়গাটা।
সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেল সুদ্ধ। নিজের ঘরে না গিয়ে পা বাড়ালো প্রিয়তার ঘরের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে আলতো করে হাত ছোঁয়াতেই পুরোপুরি খুলে গেল দরজাটা । মনে মনে হাসলো সে। কোনো রকম দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই, নক না করেই প্রিয়তার ঘরে ঢুকে পড়লো।

ঘরে ঢুকতেই তার দৃষ্টির পরিবর্তন হলো—তার চোখের কোনায় মুগ্ধতা জমা হলো। এই ঘরে তার আগে কখনো আসা হয়নি। শুধু এই ঘর কেন, শিকদার বাড়ির কোথাওই সে প্রয়োজন ছাড়া যায় না। ভালোভাবে ঘরটায় চোখ বোলাল। ঘরটা বেশ বড়, গুছানো ও পরিপাটি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ঘরের মালিক বেশ রুচিশীল। এমন নয় যে, সুদ্ধর ঘর গুছানো নয় বা পরিপাটি নয়, কিন্তু প্রিয়তার ঘরে একটা অন্য রকম ব্যাপার রয়েছে—একটা অন্যরকম মিষ্টি সুঘ্রাণ আছে যা সুদ্ধের ঘরে নেই।

সুদ্ধ দেখলো, ঘরের উত্তর দিকের দেওয়ালে বড় একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। ছবিটিতে কালো শাড়ি পরিহিত, নীলচোখের একটি অপরূপ সুন্দর মেয়ে—মেয়েটির বয়স আনুমানিক ষোলো কি সতেরো হবে। সে একটি সাদা বিড়াল কোলে নিয়ে চুমু দিচ্ছে। বিড়ালটি তার এক হাত মেয়েটির গাল ছুঁয়ে রেখেছে। সুদ্ধ হাসলো, ছবিটার কাছে গিয়ে তার আঙুল ছুঁইয়ে দিল ছবির গাল আর ঠোঁটে। তারপর আবার চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো।
দক্ষিণ দিকে বড় একটা ওয়ার্ডরোব। তার থেকে কিছুটা দূরে একটা বিশাল আয়না। আয়নাটা বেশ বড় আর এস্থেটিক। সে ধীর পায়ে আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়নার নিচের ড্রেসিং টেবিলে সাজানো নানা বিধ প্রসাধনী। যেগুলোর নাম জানাতো দূরের কথা, আগে কখনো এগুলো দেখেছে বলেও মনে পড়ে না সুদ্ধের। সে কয়েকটা তুলে নাম দেখলো—কি বিকট নাম এক একটার! সুদ্ধের কাছে মনে হলো, এর থেকে নানা বিধ মেডিসিন এর নাম হয়তো আরো সহজ। সে সেগুলো যথাস্থানে রেখে পুনরায় আয়নাতে দৃষ্টি রাখলো।

আয়নার দু’পাশে অসংখ্য কালো রঙের টিপ ছিপকানো, যা প্রিয়তার কপালে প্রায়ই দেখা যায়। হাত দিয়ে সেগুলোও ছুঁয়ে দেখল শুদ্ধ। সেখান থেকে কয়েকটা তুলে, তার সফেদ শার্টের হাতায় চিপকে নিলো।
তারপর নিজের ব্যাগ থেকে মাঝারি আকারের একটা র‍্যাপিং করা বাক্স বের করে প্রিয়তার ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখল। ঘরটার সুগন্ধ শুদ্ধকে মোহিত করছে। বেশ রুচিশীলভাবেই সাজানো হয়েছে ঘরটা—ঘরের পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, সবকিছুই সুনিপুণ।

সে গিয়ে প্রিয়তার বড় বেডের ওপর সটাং হয়ে শুয়ে পড়ল। শুদ্ধের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রিয়তার বিছানার তোশক থেকে শুরু করে বেডশিট—সবকিছু থেকেই তীব্র সুগন্ধ ভেসে আসছে, যা শুদ্ধর রক্ত সঞ্চালনের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভিতরে কাঁপন ধরাচ্ছে, বুকের ভেতর ধকধক করছে। সে ফিসফিস করে বলল,
“উফফ, সুইটহার্ট! শুধু তুমিই না, তোমার সবকিছুই বড্ড জ্বালাময়। তুমি যেটাতেই হাত দাও, সেটাতেই মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে—যে মাদকে আমি আমার চিরশত্রুর ভীষণভাবে আসক্ত।”
এই বলে সে গভীর শ্বাস নিল। পাশে থাকা প্রিয়তার মাথার বালিশটা টেনে নিজের মাথার নিচে রাখল। কী মনে হতেই উপুড় হয়ে শুয়ে, বালিশে মুখ ডুবিয়ে দিলো। সাথে সাথেই প্রিয়তার চুলের সেই তীব্র মাদকীয় সুভাস ঝড়ের গতিতে শুদ্ধর হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করল।

সে এইভাবে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল, “এইভাবে এটা-ওটাতে আর কত খুঁজবো তোমাকে, সুইটহার্ট? আমারও তো ইচ্ছে হয়, এসব থেকে নয়—সরাসরি তোমার থেকেই তোমার মাদকীয় সুভাসটা মনপ্রাণ ভরে টেনে নিতে। I am deadly addicted to you, my sweetheart. আমার তোমাকে চাই, আর সেটা আমি যে করেই হোক, পেয়েই ছাড়বো।”
কিছু একটা ভেবে সে ভ্রু কুঁচকে দ্রুত উঠে বসলো। কয়েক সেকেন্ড বালিশটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই বালিশটা হাতে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে যেতে নিতেই তার নজর আটকালো সিঙ্গেল সোফার উপর।

সেখানে পড়ে আছে একটা কালো রঙের ওড়না আর পিংক প্যাস্টেল কালারের থ্রিপিস। শুদ্ধ এগিয়ে গিয়ে সেগুলোও তুলে নিলো। তারপর কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া ছাড়াই প্রিয়তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রিয়তা অজান্তেই তার ঘর থেকে চুরি হয়ে গেল। চিত্রা প্রেমের ঘরের বাইরে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। আসলে এটা ঘর নয়, চতুর্থ তলার একটা বিশাল অংশ জুড়ে প্রেমের ব্যক্তিগত আর্ট গ্যালারি। সেখানেই প্রেম তার দিনের বেশির ভাগ সময়টা কাটায়। চিত্রা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে—ভিতরে সত্যিই প্রেম আছে কি না।
সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ভালোভাবে কান পাতলো দরজায়—যদি কিছু শোনা যায় এই আশায়। কিন্তু সেগুড়ে বালি, ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দই শোনা গেল না। চিত্রা মনে-মনে একটু দুঃখ পেয়ে ভাবলো—ভিতরে নেই নাকি? তবে সে মনে একটু সাহস জুটলো। দরজায় হালকা চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল। এটা দেখে চিত্রা মনে-মনে বেশ খুশি হলো।

সে দুরু-দুরু বুকে ভেতরে প্রবেশ করলো। অষ্টাদশী হৃদয়ে প্রেমের প্রবল বাতাস বইছে। সে কত দিন থেকে কাতর হয়ে বসেছিল তার প্রেমিক পুরুষকে এক নজর দেখার জন্য, কিন্তু কোনো অজুহাতই সে পাচ্ছিল না। তবে আজ, যখন তার বোন কুহু বললো তার বান্ধবী থিরা তাকে শিকদার বাড়িতে আসতে বলেছে, তখন এই সুযোগটা আর হাতছাড়া করেনি চিত্রা।
প্রেমের ব্যক্তিগত আর্ট গ্যালারিতে সে ধীর পায়ে প্রবেশ করলো। চারদিকে নজর ঘুরাতেই দেখলো—নানা ধরনের পেইন্টিং ও স্কেচ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। রং-তুলি এখানে-ওখানে পড়ে রয়েছে, কয়েকটি ক্যানভাসে অর্ধসমাপ্ত চিত্র ঝুলছে। এটা প্রেমের একান্ত ব্যক্তিগত জগৎ। এখানে সে অন্যদের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না, তাই তো দরজার বাইরে বড় বড় করে ঝুলিয়ে রেখেছে—“অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ নিষেধ।”

কিন্তু চিত্রা তো চিত্রাই! তার মতে, এটা তার ভবিষ্যৎ বাচ্চার বাপের মানে তার নিজেরও। আর তাছাড়া, চিত্রা ভীষণ কৌতূহলী মেয়ে—যে কোনো বিষয়েই তার কৌতূহল বেশি। আর প্রশ্ন যখন তার একমাত্র ক্রাশ অহনাব শিকদার প্রেমকে ঘিরে, তখন তো সে সাথে বেপরোয়া ও!
চিত্রা কিছুটা এগিয়ে যেতেই তার পদযুগল থেমে গেল। চোখ স্থির হয়ে গেল, মুখ হাঁ হয়ে গেল।
সে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে প্রেমের বাম পাশের দেওয়ালে, যেখানে একটা ছবি ফ্রেম ঝুলছে। চিত্রা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই ছবিটির দিকে। এটা—ওর সেই ছবিটা, যেটা প্রেম এঁকেছিল। অথচ, সে যখনই ছবিটা চেয়েছিল, তখন প্রেম সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছিল—এটা সে এঁকেছে, মানে এটা তার; এটা সে চিত্রাকে কিছুতেই দিয়ে দেবে না সে যাই হোক । কিন্তু এই ছবিটা এত যত্ন করে প্রেম দেয়ালে টানিয়ে রেখেছে! এটা তো চিত্রা ভাবতেও পারে না।
চিত্রা লক্ষ্য করলো, ছবির নিচে টানা হাতে লেখা—“চিত্ৰাঙ্গনা”। চিত্রা মুগ্ধ হয়ে সেই লেখার দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ পিছন থেকে বজ্রকণ্ঠের ধমক ভেসে এলো—

—”এই মেয়ে! তুমি অনুমতি ছাড়া এখানে ঢুকেছো কেন? পড়তে পারো না নাকি?”
প্রেমের এমন হুঙ্কার শুনে কেঁপে উঠলো চিত্রা। ভয়ে লাফিয়ে উঠল, সাথে সাথেই পাশ থেকে কয়েকটা রঙের কৌটো উল্টে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে সে পেছনে ফিরে প্রেমের দিকে তাকালো—প্রেম আগুন চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। রাগে তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে।
প্রেম তার দিকে তেড়ে এসে চিৎকার করে বললো—
—”এই মেয়ে, অনুমতি ছাড়া কারও ঘরে প্রবেশ করতে হয় না জানো না তুমি?”
প্রেমের এমন অপমানজনক বাক্যে চিত্রার মন ব্যথিত হলো। চোখের কোনায় পানি টলমল করে উঠলো। চিত্রার চোখে পানি দেখে প্রেমের ধক করে জ্বলে ওঠা রাগটা আচমকাই নিভে গেল। সে উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল—
—”এই মেয়ে, কাঁদছো কেন? তোমাকে কি মেরেছি আমি?”
চিত্রার ভীষণ অভিমান হলো। সে মুখ ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। প্রেম তার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো—

—”কেন আগুন নিয়ে খেলতে চাও মেয়ে মনে আছো, মনেই থাকো। ওটাই তোমার জন্য সুরক্ষিত উপযুক্ত স্থান, চিত্ৰাঙ্গনা। বাস্তবে আসার আবদার করো না। আমি তোমাকে প্রশ্রয় দিতে পারবো না।
এই শিকদার বংশে জন্ম নিলে ভালোবাসার অধিকার থাকে না। এই বংশে ভালোবাসা দণ্ডনীয় অপরাধ। যে ভুল আমার ভাই-বোনরা না বুঝে করে ফেলেছে, আমি সেই একই ভুল বুঝে শুনে করতে পারবো না। এই ভুলের কোন ক্ষমা হয় না।

এই বংশে জন্ম নিয়ে ভালোবাসলে, আর সেটা লোক জানাজানি হলে—ভালোবাসার মানুষকে চিরতরে হারাতে হয়। আর আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না চিত্রাঙ্গনা । তাই মন গহীনের রানী তুমি সেখানেই সুখে থাকো—প্রেমের প্রেয়সী হওয়ার স্বপ্ন দেখো না। জ্বলে যাবে মেয়ে, পুড়ে যাবে! সহ্য করতে পারবে না!”
বলেই প্রেম পেছন ফিরে চিত্রার ছবির দিকে তাকালো…
বিকেল ৪টা। প্রিয়তা, পরিণীতা, পূর্ণতা, ইনয়া, চিত্রা, প্রেরণা, কুহু, তীরা, থরি—সবাই মিলে পরিণীতার ঘরের বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল। পরিণীতার ঘর থেকে সামনের পদ্মপুকুরের কিছুটা অংশসহ পূবের রাস্তাটা দেখা যায়, যেখানে প্রায়ই আবিদ এসে তাকে ফোন দিয়ে বলতো, “ঘুম আসছে না এঞ্জেল, জানলার কাছে এসো, তোমাকে দেখবো।”

সবাই বারান্দায় গোল হয়ে বসে ঠিক করছিল—কার সঙ্গে কোন পোশাকটা ভালো যাবে, কার সঙ্গে কোন রঙটা ভালো মানাবে, কীভাবে চুল বাঁধলে অন্য রকম দেখতে লাগবে—মেয়েদের যা কাজ আর কি! পূর্ণতা পরিণীতাকে ধমকেধামকে স্বাভাবিক রেখেছে, সবার পোশাক নির্বাচনও শেষ। শুধু প্রিয়তা আর পরিণীতা এখনো ঠিক করতে পারেনি যে তারা কী পরবে আর কীভাবে সাজবে।
পূর্ণতা জিজ্ঞেস করল, “আমরা কখন বেরোব?”
থরি উত্তর দিল, “মেজদাদান বলে দিয়েছেন, ৬টার পরে।”

প্রেরণা বলল, “তাহলে চলো, গিয়ে প্রস্তুতি শুরু করি।” কিন্তু সবার এক্সপ্রেশন দেখে মনে হলো, সে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল।
ইনয়া বলল, “আপু, তুমি এক্ষুনি রেডি হবে? একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না?”
পূর্ণতা ইনয়াকে ধমক দিয়ে বলল, “তুই চুপ কর! আসলেই তো সময় লাগবে। আপু, তুমি যাও।”
প্রেরণা বোকা হাসল, “আসলেই কি তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে?” সে সময় দেখে বুঝল, মোটেই তারাতাড়ি হয়নি—বরং দেরিই হয়ে গেছে। এখুনি গিয়ে ফেস প্যাক লাগাতে হবে। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। অন্যরা তখনও হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রেরণা সে সবে গুরুত্ব দিল না, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল পরিণীতার রুম থেকে।
ইনয়া প্রিয়তার গায়ে হেলান দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তোরা ভাই-বোনগুলো এমন কেন রে?”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমরা কেমন?”

ইনয়া নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “এই যে—তুই একটা নিরামিষ, তোর ভাই একটা মস্ত আমিষ! আর তোর এক বোন—ময়দা সুন্দরী, আরেক বোন সেলফি কুইন! আর কী চাই? বইন, পরপরই আবার লজ্জা পাওয়ার নাটক করে বলল, ‘শুধু তর নয়, আমার অহ শ্বশুরবাড়ির লোক!'”
প্রিয়তা সন্দেহের সুরে বলল, “সবই না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমার ভাই কেমন করে আমিষ হলো?”
ইনয়া চমকে উঠল, কথা ঘুরিয়ে বলল, “কিছু না, কিছু না।”
প্রিয়তা কেমন চোখে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।
আরও এক ঘণ্টা পর তাদের আড্ডার আসর ভঙ্গ হলো।
প্রিয়তা নিজ ঘরে চলে গেল প্রস্তুত হতে। ঘরে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়ল। তার মোটেই ইচ্ছে হচ্ছে না কোথাও যেতে। কিন্তু গার্লস গ্রুপ কি আর তাকে ছেড়ে দেবে! যেতেই হবে। তাই কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেয়ে উঠে বসলো সে।

তারপর অলস ভঙ্গিতে গিয়ে ওয়ার্ডরোব খুলল। বিশ্বাস করুন আপুরা, এত বড় ওয়ার্ডরোবের কোনো কোণায় এক চিলতে জায়গাও খালি নেই! সব জায়গা দামি দামি শাড়ি, থ্রিপিস, গাউন, লং ড্রেস আর অন্যান্য সাজসজ্জার জিনিসপত্রে ঠাসা।
প্রিয়তা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল—মনে মনে বলল, “এই জন্যই কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না! একটা ভালো জামাও নেই যা পরতে পারি!” অসহায় মুখে সে জামাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, বড় আব্বুকে বলতে হবে কয়েকটা নতুন ড্রেস কিনে দিতে। কিন্তু এখন কি পরবো?

সে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও জামাগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই মনের মতো কিছু পাচ্ছে না। হতাশ হয়ে পাশ ফিরে দাঁড়াতেই তার চোখ আটকে গেল ড্রেসিং টেবিলের ওপর। সাথে সাথেই চোখ সরু করে ফেললো। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল সে সেদিকে। টেবিলের ওপর একটা বড়সড় গিফট বাক্স পড়ে আছে।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে মনে মনে ভাবল, “এটা আবার কি?”
সে বাক্সটা হাতে তুলে নিল। বক্সটা বেশ ভারীই অনুভব হলো। সে দেখলো, বক্সের ওপরের অংশে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা—”This is for you, Priyata.”
প্রিয়তা আরও অবাক হলো। বাক্সটা নেড়েচেড়ে দেখল। বেশ বড়সড় বাক্স। প্রিয়তা সন্ধিহান চোখে তাকিয়ে ভাবল, কিন্তু এটা কে রাখলো এখানে? সাথে সাথে সন্দেহ মিলিয়ে গেল। সে ভাবলো, হয়তো প্রণয় ওর জন্য রেখেছে, কারণ আগেও প্রণয় ওকে প্রায়ই এমন ছোট-বড় অনেক উপহারই দিত।
প্রিয়তার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে ভিতরে কি আছে দেখার জন্য। সে আর কৌতূহল দমন করতে পারলো না। বাক্সটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো।

সে টেনে-টুনে উপরের র‍্যাপিং পেপারটা খুলে ফেলতেই ভেতর থেকে বের হয়ে এল একটা খুব সুন্দর সাদা রঙের বাক্স, যার চারপাশ টেপ দিয়ে আটকানো। প্রিয়তা কাঁচি দিয়ে একটা একটা করে সবগুলো টেপ কেটে ফেলল। আলতো হাতে বাক্সটা খুলতেই প্রিয়তার মুখ হাঁ হয়ে গেল। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
বাক্সের ভেতর থেকে বের হলো একটা অপূর্ব সুন্দর ডিজাইনের সাদা রঙের পাকিস্তানি থ্রিপিস। প্রিয়তা তো অবাক! তারপর আরেকটা পাতলা নীল রঙের বাক্স বের করল। প্রিয়তা ভাবলো, দেখে তো মনে হচ্ছে জুয়েলারি বক্স।
প্রিয়তা আগ্রহ নিয়ে সেটা খুলতেই আরও বিস্মিত হলো। একটা ভীষণ সুন্দর চিকন চেইন, সেটাতে “P” লেটারের ডায়মন্ডের পেন্ডেন্ট ঝুলছে।

প্রিয়তা বাক্সটা পাশে রেখে আরও কিছু আছে কিনা দেখতে লাগল। সেখানে থেকে আবারও সাদা কাগজে মোড়ানো কিছু একটা বের হলো। প্রিয়তা সেটার উপর থেকে কাগজ সরাতেই ভীষণ খুশি হলো। প্রিয়তা দেখলো, ড্রেসের সাথে ম্যাচিং বড় এক ডজন সাদা রঙের চুড়ি। সাথে এক পাতা কালো টিপ ও একটি ছোট্ট চিরকুটও চোখে পড়ল।
প্রিয়তা আগ্রহ নিয়ে কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখল। তাতে লেখা—
“এগুলো তোমার জন্য, Sweetheart.”
প্রিয়তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বুঝতে পারল, এগুলো প্রণয় দেয়নি। অন্য কেউ দিয়েছে।
প্রিয়তা আবার ভাবনায় পড়ে গেল, “এগুলো অন্য কেউ দিয়েছে। কিন্তু কে?” লেখাটা ও প্রিন্ট করা, তাই কার লেখা চেনার উপায় নেই।
অজানা ব্যক্তির দেওয়া উপহার নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেল সে। জিনিসগুলো তার ভীষণ ভীষণ সুন্দর লেগেছে, তা খুব পছন্দ ও হয়েছে। কিন্তু কে দিল সেটা না জেনেই পড়বে?
অনেকক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করে নিজের মনকে বুঝ দিলো—কে দিয়েছে সেটা বড় কথা নয়, ভালোবেসে দিয়েছে এটাই বড় কথা।

প্রিয়তা ঠিক করল, উপহারদাতার অপমান সে করবে না। আজ রাতের মেলায় সে এগুলো পরেই যাবে।
প্রিয়তা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। বিশ মিনিট পর গোসল সেরে বের হয়ে আসলো। চুল ভিজায়নি সে, কারণ এই চুল শুকাতেই তার এক ঘণ্টা সময় লাগবে। তাই সেই ঝামেলায় আর গেল না। মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের প্রতিবিম্ব দেখে থমকে গেল।
ফুল-স্লিভ সাদা থ্রিপিসটা তার গায়ের রঙের সঙ্গে একদম মিলেমিশে গেছে। নিজের দিকে সে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটু অবধি লতানো চুলগুলো হালকা কার্ল করে নিয়ে মাঝ বরাবর সিঁথি কেটে খুলে রাখল।
নীল চোখে হালকা কাজল দিল, পদ্মের মতো লাল টকটকে ঠোঁটে ডার্ক শেডের ওয়াটারপ্রুফ লিপস্টিক দিল। গালে সামান্য ব্লাশার লাগালো, উপরে একটু হাইলাইটার ও দিলো। দুই হাতে সাদা রঙের চুড়িগুলো সমানভাবে ভাগ করে পরে নিল। হীরার চেইনটাও পরলো। দুই ভ্রুর মাঝ বরাবর একটা ছোট্ট সাদা পাথরের টিপ পরল—এটাই তার ফাইনাল লুক।

সে নিজেকে আয়নায় একবার ভালো করে দেখে নিল। মনে মনে বলল—”খারাপ লাগছে না, বেশ ভালোই তো!” তারপর নিজের ফেভারিট সাধা রঙের হিলটা পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ওকে কেমন দেখতে লাগছে সেটা আপনারাই বুঝে নিবেন।
সন্ধ্যা ৫টা ৫০। ধীরে ধীরে সব মেয়েরাই নিচে নামছে। সবাইকেই পরীর মতো সুন্দর লাগছে। ইনায়া আর চিত্রা ম্যাচিং ল্যাভেন্ডার রঙের ফুল-স্লিভ থ্রিপিস পরেছে। সবাই প্রায় একইভাবে সেজেছে, শুধু পোশাকের পার্থক্য। পূর্ণতা পরেছে একটা এক্সপেন্সিভ কালো রঙের লং গাউন। চোখে কাজল আর ঠোঁটে ডার্ক মেরুন রঙের লিপস্টিক দিয়ে কোমর অবধি স্ট্রেট করা চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। আজ নিশ্চিত রাজ তার নাগিনীর রূপে পাগল হয়ে যাবে!
পরিণীতা পেস্টাল কালারের ফুল-স্লিভ থ্রিপিস পরেছে। কোমর অবধি রিবন্ডিং করা চুলগুলো খুলে রাখা। গাঢ় বাদামি বর্ণের চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। হাতে অ্যাপল খচিত কালো বেল্টের স্মার্ট ওয়াচ। তার সৌন্দর্য যেন আলাদাই মায়াময় দ্যুতি ছড়াচ্ছে—সত্যিই যেন স্বর্গের পরী। সবাই মুগ্ধ হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রিয়তা বেশ বিব্রত ও বিরক্ত। ইনায়া এসে তার পাশে বসে কানে কানে বলল, “ননদিনী, আমি যদি ছেলে হতাম, তাহলে যেভাবেই হোক তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম। পালাতে রাজি না হলে তুলে নিয়ে যেতাম, তবু তোমাকে পেয়েই ছাড়তাম। তোমাকে না পেলে জীবনটাই বৃথা!”
ইনায়া আবার বলল, “সত্যি বলছি, তোকে জড়িয়ে ধরে একটা কষে চুমু খেতে মন চাচ্ছে!”
প্রিয়তা মুখ কুঁচকে বলল, “চুপ কর, বেয়াদব! নিজের জামাইকে গিয়ে খা!”
ইনায়া সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, “তোর বলার অপেক্ষায় আমি বসে নেই। ওটা আমার কবেই খাওয়া হয়ে গেছে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। ইনায়া জিভ কাটল।
প্রিয়তা ধমক দিয়ে বলল, “কাকে কী বলছিস? একটু লজ্জা কর! সে আমার আপন বড় ভাই।”
ইনায়া মুখ বাঁকিয়ে বলল, “তো আমি ও তো তোর বেস্টফ্রেন্ড। সে দিক থেকে আমার জামাই, তোর দুলাভাই!”
প্রিয়তা বিরক্ত হলো।

পরিণীতা প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “খুব সুন্দর লাগছে তোকে, বোন।” অন্যরাও প্রশংসা করল। প্রিয়তা লজ্জা পেল।
৫টা ৫৯।
একে একে তরুণ শিকদাররা হাজির হতে লাগল—পরপর রাজ, প্রিথম, সদাফ, প্রেম, সমুদ্র আর অরণ্য। একে একে সকলেই এসে হাজির হলো ড্রয়িংরুমে।
প্রিথম কালো ফর্মাল শার্টের সঙ্গে ম্যাচিং কালো ফর্মাল প্যান্ট পরেছে। সুঠাম দেহে শার্টটা আটোসাটো হয়ে চিপকে আছে। পেটানো দেহের পেশিগুলো শার্টের হাতায় টান টান হয়ে ফুলে উঠেছে। তবে তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে তার নীল চোখ। ইনায়া তো প্রিথমকে দেখে হা হয়ে গেছে! মনে মনে বেশ কয়েকটা ক্রাশ খেয়ে নিজেকে নিয়ে অহংকার করে বলল—

“আহ, আমার জামাই কত সুন্দর ! সুযোগ পেলেই একটা কালো টিপ পরিয়ে দেবো।”
রাজকে ডার্ক নেভি ব্লু ফর্মাল শার্টের সঙ্গে ব্ল্যাক ফর্মাল প্যান্টে দারুণ সুদর্শন দেখাচ্ছে। যদিও পূর্ণতা তাকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না, সে খুব চাইছে তার ‘নাগিন’ অন্তত একবার তার দিকে তাকাক। কিন্তু পূর্ণতা তো পূর্ণতাই—ওকে দুই পয়সার পাত্তাও দিচ্ছে না! অথচ সে তার নাগিনীকে প্রথম দেখাতেই বিশাল বড় ক্রাশ খেয়ে বসেছে।
প্রেম অফ-হোয়াইট রঙের ফর্মাল শার্টের সঙ্গে কালো ফর্মাল প্যান্ট পরেছে। চিরাচরিত চশমাটা তার ব্যক্তিত্বে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। সেট করা চুলের কয়েকটা আলগোছে সামনে এসে পড়েছে। এক কথায়, প্রেমকে পুরো চকলেট বয় লাগছে। চিত্রা তো বেহুশ হওয়ার উপক্রম , চোখ ফেরাতেই পারছে না! প্রেমের প্রেমে তো সে কবেই পড়েছে এবার মনে হয় কোমরটা ও ভাঙল।

সদাফকে ধূসর রঙের ফর্মাল শার্ট আর কালো ফর্মাল প্যান্টে ভীষণ সুদর্শন লাগছে। সে তার ফুলপরীর উপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও নজর সরাতে পারছে না। মনে মনে ভাবছে—
“আমার পরীটা এত সুন্দর কেন? অন্যদের নজর লেগে যাবে না?”
অন্যদিকে, অরণ্য আর সমুদ্র স্টাইলিশ চেক শার্ট পরেছে। সদাফ, প্রেম, রাজ আর প্রিথমের মতো পরিপূর্ণ পুরুষের ছাপ তাদের মধ্যে নেই—বরং কিছুটা ছেলে ছেলে ভাবই রয়ে গেছে।
প্রিয়তা প্রিথমের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, “ভাইয়া, আমাকে কেমন লাগছে?”
প্রিথম কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই রাজ কথা কেড়ে নিয়ে বলল—
“ইস! কী বিশ্রী দেখাচ্ছে আপা! শুধু আমাদের কেন, অন্যদেরও দেখা—ভয়ে তারাও পালাবে!”
অরণ্যও তাল মিলিয়ে বলল, “একদম ঠিক বলেছ সেজদা!”

প্রেম ভাবুক কণ্ঠে বলল, “তোরে দেখে তালগাছের সুন্দরী লাগছে!”
সমুদ্র তো এক কাঠি ওপরে! সে ফোন বের করে একটা কার্টুন শাকচুন্নির ছবি দেখিয়ে বলল—
“দেখ, তোকে ঠিক এমনই দেখাচ্ছে!”
প্রেম আবার বলল, “যা বোন, এসব পাল্টে আয়। আমরা মানুষকে ভয় দেখানোর ব্যবসা করি না।”
রাজ মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল , “আমরা চাই না আমাদের বোনকে দেখে বাইরের কেউ পটল তুলুক!”
সবাই হেসে উঠল। প্রিয়তার মুখটা দেখার মতো হলো। সে অসহায়ভাবে প্রিথমের দিকে তাকাল, যেন বলতে চাইছে

“ওরা কি সব সত্যি বলছে ভাইয়া?”
প্রিথম ধমক দিয়ে বলল, “আমার বোনকে কেউ একদম বিরক্ত করবি না। আমার বোনকে প্রিন্সেসের মতো লাগছে! বিশ্বাস না হলে মা-বাবাকে জিজ্ঞেস করে আয়!”
প্রিয়তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে ভাইদের ভেংচি কাটল। ঠিক তখনই তন্ময়, থিরাথিরা আর প্রেরণাও এসে গেল।
তন্ময়কে আজ বড্ড কিউট লাগছে। ওকে দেখে রাজ সেই খুসি হলো ! খেপানোর জন্য রাজ মুখ হা করতেই, প্রিথম আবার ধমক দিয়ে বলল—
“একটাও বাজে কথা মুখ দিয়ে বের করবি না!”
রাজ তৎক্ষণাৎ মুখ বন্ধ করে নিল। অরণ্য, সমুদ্র আর প্রেমও মুখ চুলকাচ্ছে কিছু বলার জন্য।
তন্ময় শয়তানি হাসি দিয়ে বলল—

“এবার কিছু বলে দেখাও!”
ওরা চার ভাই কটমট করে তাকাল, যার অর্থ—”তোকে পরে দেখে নেব!”
দোতলার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে সব দেখছিল প্রণয়। তার চোখ স্থির হয়ে আছে এক শুভ্র সুন্দরী রমণীর ওপর। সে বিড়বিড় করে বলল—
“এত সুন্দর করে কেন সেজেছ রক্তজবা? কার জন্য সেজেছ? কাকে দেখাতে চাও? আমি চাই না অন্য কেউ তোকে দেখে মুগ্ধ হোক। তুমি যেও না রক্তজবা, প্লিজ যেও না!”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৭

প্রিথম বলল, “সবাই তো চলে এসেছে। তাহলে গাড়ি বের করছি।”
প্রিথম এগোতেই তন্ময় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল।
“দাঁড়াও মেজো দাদান! আমি এখনই আসছি।”
বলে সে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠে গেল। সবাই বিরক্ত হলো। রাজ মৃদু স্বরে বলল—
“কুমড়া পাঠাস!”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৯