ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২০

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২০
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

শিকদার বাড়ির ছাদে পাতা সাদা চেয়ারে বসে আছে সুদ্ধ। ঠোঁটে তার রহস্যময় বাঁকা হাসি। সামনের টেবিলে সে গভীর মনোযোগ দিয়ে চেস বোর্ড সাজাচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।
এসব দেখে বিরক্ত হলো প্রহেলিকা। ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “মাথা কি পুরো খারাপ হয়ে গেছে? এখন কি খেলা-ধুলার সময়?”
সুদ্ধ বাঁকা হেসে রসিকতার সুরে বলল,

— “কুল ডাউন, বড় ভাবি! আপনি বড়ই উত্তেজিত। এত উত্তেজনা ভালো না। এই জন্যই তো আপনার দ্বারা কিছু হয় না। এত বছরে ও কিচ্ছু ছিঁড়তে পারোনি! এই ব্রেন নিয়ে ওরকম একটা জিনিসকে কিভাবে সামলান, বলেন তো?”
সুদ্ধর এমন খোঁচা মারা কথা শুনে রেগে গেল প্রহেলিকা। হিঁসহিঁস করে বলল,
— “তোমার দ্বারা খুব হয়েছে! এত বড় বড় কথা বলছো, তুমিই বা কি ছিঁড়তে পেরেছো, শুনি?”
ভ্রু কুঁচকে সুদ্ধ বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “আমার দ্বারা কিছু হয়নি? তাহলে আজ তুই যা কিছু পেয়েছিস, তা কার ধারা পেয়েছিস? তোর নিজের মুরদ আছে কিচ্ছু করার? ব্রেন তো তোর হাঁটুর নিচে! মন ভর্তি হিংসা ছাড়া আর কী আছে তোর?”
প্রহেলিকা এবার চরম রেগে গেল। ওড়নার নিচে করে আনা ছুরিটা বের করে কৌশলে সুদ্ধর গলায় ধরে বলল,
— “তোর খুব দেমাগ, না! তুই আমাকে খারাপ বলিস, তুই নিজে যে আস্ত শয়তান, সেটা জানিস তো?”
সুদ্ধ আবারও বাঁকা হাসল। কৌশলে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে প্রহেলিকাকে তার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,
— “জানি, কিন্তু আমি তোর মতো এতটা ও নরকের কীট নই।”
প্রহেলিকার চোখ থেকে আগুন ঝরছে। সুদ্ধ তাকে ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

— “সাথে ছুরি নিয়ে ঘুরে বেড়াস, তা ভালো, কিন্তু আজ যে সাহস দেখিয়েছিস, সেটা আর দ্বিতীয়বার দেখানোর কথা ভুলেও ভাববি না। নাহলে তুই খুব ভালো মতোই জানিস, এই আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ আসলে কে! এই আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ, না চাইলে তাকে মারার ক্ষমতা কেউ রাখে না। আর তোর মতো নরপিশাচ তো কখনোই না। তোকে একটা কাজ দিয়েছিলাম, সেটাও তুই ঠিকমতো করতে পারলি না।”
প্রহেলিকার রাগে শরীর জ্বলে গেলেও সে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল, কারণ সে জানে, এই সাইকোপ্যাথের সাথে লাগতে যাওয়া মানে নিজের কবর নিজেই খোঁড়া। আর যা-ই হোক, প্রহেলিকা শিকদার এতোটাও বোকা নয়। সে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

— “কি করতে চাস তুই?”
আগের মতোই ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ধরে রেখে চেস বোর্ডের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো কন্ঠে রহস্য বজায় রেখেই বলল,
— “জাস্ট দেখে যা।”
প্রহেলিকা ভ্রু কুঁচকালো। তার একটাই কথা—সব নষ্টের মূল ওই মেয়েটা। ওকে মেরে ফেললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত, তার হাড়টা একটু জুড়োতো, রাতে শান্তির ঘুম হতো, আর সর্বোপরি, তার প্রিয় প্রণয় কেবল তারই হয়ে যাবে… কিন্তু?

কিন্তু সে যদি কিছু করতে যায়, তবে প্রণয় কিছু জানলে? পরে জানবে, কিন্তু শুদ্ধ তো তাকে আর এক সেকেন্ড ও দুনিয়ার বুকে নিঃশ্বাস নিতে দিবে না নিজের হাতে তার কলিজা বের করে মেপে নেবে তাকে এমন ভয়ানক মৃত্যু দিবে যা ভাবলেই প্রহেলিকার শিরায় উপশিরায় শীতল স্রুত বয়ে যায় !সে বুঝে পায় না, এই মেয়েটাকে এতো ভালোবাসার কী আছে? প্রণয় তো তাও নিজেকে ধরে রেখেছে, কিন্তু এটা তো পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে!—এই ভাবনাতেই প্রহেলিকার মুখ তেতো হয়ে গেল।

সে শুদ্ধর সামনে চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল। শুদ্ধ খুব মনোযোগ দিয়ে একের পর এক গুটি সাজাচ্ছে। প্রহেলিকা বুঝতে পারছে না, আসলে এর মনে চলচে টা কি।
প্রহেলিকার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কী যেন ভেবে উঠে দাঁড়ালো শুদ্ধ। দ্রুত পায়ে যেতে যেতে বলল, “যেটা বুঝবি না, সেটাতে তোর মোটা মাথা ঢোকানোর কোনো চেষ্টা ও করবি না। আর আমার কাজে বাধা দেওয়ার কথা তো ভুলেও মাথায় আনবি না। এটা তোর জন্য ভালো হবে না।”
বলেই সে চলে গেল।
প্রহেলিকা রাগল না নির্বিকার চোখে দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলল,

— “সাইকো একটা! একে কোনো বিশ্বাস নেই। আমাকেই কিছু ভাবতে হবে। প্রিয়তাকে পাওয়ার জন্য এ যে কোনো সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমার প্রণয় আর এই পরিবারের ক্ষতি করতে দু’বারও ভাববে না। ও খুবই বিপজ্জনক। কী ভাবছে আর কী চাচ্ছে, কিচ্ছু বোঝা যায় না!”

চিত্রা, ইনায়া, প্রেরণা, তন্ময়, অরণ্য, সমুদ্র আর রাজ—সবাই একসঙ্গে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো এটা, তো কখনো ওটা কিনছে। মেয়েরা দামাদামি করছে, বেশি হলে মুখ বাঁকাচ্ছে। অরণ্য আর সমুদ্র প্রচণ্ড বিরক্ত। তারা এটাই বুঝতে পারে না—একটা জিনিস নিয়ে এতবার দর-কষাকষি করার কি আছে ! তাদের মতে, দর-কষাকষির একটা অপ্রয়োজনিয় জিনিস? তারা আজ হাড়ে হাড়ে অনুভব করল আসলেই, মহিলাদের সঙ্গে কেনাকাটি করা মানে নিজেকে পাবনার বাসিন্দাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা! তাদের মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না মেয়েদের সঙ্গে ঘুরতে, কিন্তু রাজের জন্য তারা পালাতেও পারছে না।

কিন্তু পূর্ণতা সবার থেকে একটু আলাদা। সে ওদের সঙ্গে আছে ঠিকই, কিন্তু এসব ফালতু কাজে সে নেই । তার কাছে এসব ইউজলেস। সে কেবলমাত্র মেলাটা দেখতে এসেছে, মেয়েদের এত ন্যাকামো, এত রংঢং তার একদম পছন্দ নয়। পূর্ণতার স্বভাব কিছুটা টমবয়দের মতো। তার কিছু পছন্দ হলে কোনো প্রকার বার্গেনিং ছাড়াই সে সেটা তুলে আনে। আর তাছাড়া এইসব হিজিবিজি জিনিসপত্রের প্রতি তার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। সে চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভালো করে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে।
রাজও তার পাশে পাশে হাঁটছে, আর এটা-ওটা বলে পূর্ণতাকে ডিস্টার্ব করছে। পূর্ণতা এই ছ্যাঁচড়া লোকটার উপর ভীষণ বিরক্ত। রাজ তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গলায় আফসোসের সুর তুলে গান ধরল।
ও ললোনা, ও লোলনা, ও ললোনা, ও ললনা!

তুমি আমার মনটা বোঝো না।
ও ললোনা, তোমার সঙ্গে আমার বনেনা,
ও ললনা, নাটক বুঝ, আবেগ বুঝনা।
আমার বুকের পিঞ্জরাতে ছিল তোমার বসবাস,
তুমি মনে জায়গা দিলে না, ও ললনা,
তোমার সাথে আমার বনে না।
পূর্ণতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশুরো গলায় গাইছিল।
পূর্ণতা তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।
এমন কাক-মার্কা গলায় গান শুনে পূর্ণতার কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম!
পূর্ণতা এত ঢং আর সহ্য করতে পারল না।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো।

রাজও সাথে সাথেই থেমে গেল, কিন্তু অন্যরা কেউই খেয়াল করল না।
তাই ওরা এগিয়ে গেল।
রাজ ইনোসেন্ট ফেস করে তাকিয়ে আছে পূর্ণতার দিকে।
পূর্ণতা ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “সমস্যা কী আপনার? আমাকে বিরক্ত করছেন কেন?”
রাজও একইভাবে ভ্রু কুঁচকে নাটকীয় ভঙ্গিতে পূর্ণতার দিকে আঙুল তুলে বললো,
— “কাকে বিরক্ত করছি? তোমাকে?”
পূর্ণতা বিরক্ত হলো।

সে এগিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে রাজকে একটু সরিয়ে দিল।
পায়ের নিচে, মাথার উপরে, কাপড়ের ভাঁজে কিছু খুঁজতে লাগলো।
রাজ আহাম্মক হয়ে অবাক কণ্ঠে বললো,
— “কি খুঁজছো এভাবে?”
পূর্ণতা বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
— “খুঁজছি আমি ছাড়া আর কে আপনার সাথে কথা বলছে?”
রাজ হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলো।
সে নিজের অবাকত্ব কাটিয়ে মনে মনে বললো—
“এই মেয়েকে ভাই-বোনদের জন্য ভাবী বানানো এতো সহজ হবে না!”
পূর্ণতা বাজখাই কণ্ঠে হুমকি দিয়ে বলল,
— “আরেকবার যদি আমাকে বিরক্ত করেন, তাহলে…”
রাজ এক ভ্রু তুলে বলল,
— “তাহলে কি?”

পূর্ণতা বাঁকা হেসে চারপাশে তাকালো। আশেপাশে কেউ তাদের দিকে দেখছে কিনা? না, সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। সে রাজের দিকে একটু এগিয়ে এসে বাঁকা হাসি দিল।
রাজের গলার পানি শুকিয়ে গেল। কেন জানি না, তার মধ্যে থাকা পুরুষ সত্তা এই নাগিনীকে কিছুটা হলেও ভয় পাচ্ছে।
তার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে পূর্ণতা জোরে সুরে একটা পাঞ্চ বসিয়ে দিল রাজের পেট বরাবর!
রাজ কুঁকিয়ে উঠল। আশেপাশের কয়েকজন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।
পূর্ণতা বাঁকা হেসে বলল,

— “এবার তো শুধু ডেমো দেখালাম। আবার যদি আমার পেছনে আসো, তবে মেরে হাড়-গোড় পাউডার বানিয়ে দেব—মাইন্ড ইট!” বলেই মুখ বাকিয়ে চলে গেল।
রজন্নো শিকদার রাজ, পাবলিক প্লেসে মার খেল ভাবা যায় , তার সঙ্গে ফ্রি-তে হুমকিও পেল! পূর্ণতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাজ মনে মনে হেসে বলল,
— “আমার ধানী লঙ্কা, তোমাকে তো ছাড়া যাবে না, সুন্দরী!”
উফ্, কী জোর লাগল! রাজের মনে হল, মার খেয়ে পেটে যন্ত্রপাতিগুলো কেঁদে উঠল। সে শুনেছে, মেয়েদের হাত নাকি নরম তুলোর মতো হয়, কিন্তু এই মেয়ের হাত না হাতি, সেটাই বুঝতে পারল না রাজ!
অরণ্য আর সমুদ্র ছুটে এসে ভাইকে ধরল। অরণ্য মিটমিটিয়ে হাসছে, সমুদ্র দুঃখ-দুঃখ ভাব করে কষ্ট পাওয়ার ভান ধরে বলল,

— “ভাবি মারছে, বুঝি? কেদ না ভাই, বউরা এমনি জালিম হয়!”
রাজ ভ্রু কুঁচকে তাদের দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা দু’জন রাজকে পচানোর একদম পারফেক্ট কারণ পেয়ে গেছে! এবার তো তিলকে তাল বানিয়ে মশলা মাখিয়ে অন্য ভাইদের কাছে প্রেজেন্ট করবে। এরপর সবগুলো এক হয়ে রাজের কান ঝালাপালা করে দেবে!
আর সব থেকে বিরক্তিকর লাগলো অরণ্যের গা-জ্বালানো হাসি! অরণ্য আবার দুষ্টু হেসে বলল, “মেজো দাদান আর ছোটো দাদানকে এই হট হট নিউজটা এখুনি দিতে হবে। গেলাম, সেঝদা!”
রাজ বলল, “এতো নাটক না করে সোজা বল, কতো দিতে হবে?”

অরণ্য দুষ্টু হেসে বলল, “টাকা তো ছোট দাদানের কাছ থেকে নেব,” বলে আবারও দুষ্টু হাসল।
রাজ ধরেই নিলো, আজ তার মান-সম্মান শেষ! তবে মনে মনে হেসে বলল, “কিউট নাগিন! এই সবকিছুর হিসাব যদি এক এক করে না নিতে পারি, তবে আমার নাম ও রজন্নো শিকদার রাজ নয়, হুঁ!”
প্রিথম আর প্রেম মেলা থেকে কিছুটা দূরে চলে এল। এত গাদা-গাদি আর ভিড় তারা একদম নিতে পারে না। অস্বস্তি বোধ করে, যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। তার উপর এই অসহ্য রকম গরম! তাদের একটু ফ্রেশ এয়ার দরকার।
প্রেম আর প্রিথম পাশাপাশি হাঁটছে। প্রেম একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরল। প্রিথম কয়েক পলক চুপ করে দেখল, তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,

— “এসব ছাই পাশ কেন খাস, ভাই? তোর কিসের এত কষ্ট?”
প্রেম মৃদু হাসল। শিকদাররা খুবই ওয়েল-ডিসিপ্লিনড—নেশাপানি বা কোনো ধরনের মাদক সেবন তারা করে না। কিন্তু প্রেমের মাঝে মাঝে একটা-দুটো সিগারেট খেতেই হয়, না হলে ভেতরের আগুনটাযে কিছুতেই দমন করা যায় না।
প্রেম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “আমি তো মাঝেমধ্যে খাই। বড় দাদানকে দেখো না? এক দিনেই দু’প্যাকেট শেষ করে ফেলে!”
প্রিথমও দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
— “দেখি তো, কিন্তু কিছু বলতে পারি না। কী বলবো? থাক এসব!”
মাঝে মাঝে তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করি, অনুভব করার চেষ্টা করি। প্রেম হেসে বললো,
— “কি অনুভব হয়?”

প্রিথম ব্যথাতুর দৃষ্টি আকাশের দিকে স্থাপন করে আহত গলায় বললো,
— “নিঃশ্বাস নিতে পারি না! অক্সিজেনের অভাব বোধ করি। এইভাবে আমাদের ভাই কি বাঁচবে? সেই ভয়েই কুঁকড়ে থাকি!”
প্রেম আবার হাসলো। সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে বললো,
— “শুধু ভাইয়ের কষ্টটাই চোখে পড়ে, আমাদের ছোট্ট বোনটার কষ্টটা চোখে পড়ে না?”
প্রিথম ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— “হয়তো পড়ে, না দেখার ভান করি। তাকে ও কিছু বলার নেই, কিছু বলে সান্ত্বনা দেওয়ারও ভাষা নেই। কিছু জানি না, এভাবেই ভালো আছি। সব কিছু যেমন ভাসছে, তেমনি ভাসুক। কোনো একপার নিতে গেলে প্রলয় নেমে আসবে, ধ্বংস হয়ে যাবে সবকিছু। মৃত্যু মিছিল শুরু হবে শিকদার বাড়িতে, যা সহ্য করার বা সামলানোর কোনোটারই ক্ষমতা আমার নেই।”
প্রেম আবার বললো,

— “তোমার কি মনে হয়, এসব এই বংশের লোকের কর্মফল? দাদির কাছে শুনেছি, তার জীবনের গল্প। তিনি বলেছিলেন—আমাদের ওপর নাকি বদদোয়া আছে। সব শেষ হয়ে যাবে, কেউ ভালো থাকবে না, সবাই সব হারাবে! তবে কি সত্যি সেই বদদোয়া কবুল হয়ে গেছে? সত্তর বছর আগের ঘটনার কি পুনরায় পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে?”
প্রিথম স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল,
— “এমন কিছুই হতো না, ভাই, যদি ওরা সুধরে যেত! বিনাশ যদি নেমে আসে, তবে শুধু ওদের জন্যই আসবে। ওরা যে বড় পাপী, ভাই!”
প্রেম আর কিছু বলল না।

দুই ভাই কথা বলতে বলতে রাস্তা পেরিয়ে নদীর পাড় অবধি চলে এসেছে। এই তীব্র গরমে নদীর পাড়ের ঠান্ডা হাওয়া ওদের মন-প্রাণ শীতল করে দিচ্ছে।
ওরা আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই প্রেমের পা থমকে গেল। ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাল। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে—বালির উপর কেউ একজন শুয়ে আছে!
পৃথমও ব্যাপারটা খেয়াল করল। অতঃপর দুই ভাই নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করল, তারপর একসঙ্গে ছুটে গেল লোকটার দিকে।
পৃথম কাছে যেতেই থমকে গেল— আবিদ!
প্রেমও অবাক হয়ে গেল।
উদ্বিগ্ন গলায় প্রেম বলল,

— “আবিদ ভাইয়া এভাবে পড়ে আছে কেন? মেজো দাদান!”
পৃথমও কিছু বুঝতে পারল না। সে আবিদের মাথায় হাত ছোঁয়াতেই চমকে উঠল— শরীর ভীষণ উত্তপ্ত! তীব্র জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, ওর কোনো হুশ নেই!
পৃথম একটু চিন্তিত গলায় বলল,
— “ওর তো অনেক জ্বর… জ্ঞান নেই!”
প্রেমও চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “তাহলে এখন কী করব, দাদান?”
পৃথম আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলল।
প্রেম অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল আবিদের দিকে। পৃথম বলল,

— “ও বাড়ি থেকে এত দূরে এখানে কেন এসেছে? মেলায় এসেছিল বলে তো মনে হচ্ছে না!”
যাই হোক, দুই ভাই বিষয়টা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না।
বিশ মিনিট পর অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছল। পিছঢালা রাস্তার এক পাশে নদী আর অন্য পাশে মাঠ—রাস্তা থেকে কিছুটা নিচে নদী, তাই অ্যাম্বুলেন্সটা রাস্তার এক পাশে এসে দাঁড়াল।
মাঠের শেষ প্রান্তে থাকা কিছু মানুষ অ্যাম্বুলেন্স দেখে অবাক হয়ে গেল।
ভেবেনিল, হয়তো কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্রিথম আর প্রেম ধরা ধরি করে আবিদকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিল। প্রেম বলল,

— মেজদা, তুমি ফিরে যাও। আমি সঙ্গে যাচ্ছি। আর পারলে ভাইয়ার, আব্বু-আম্মুকে খবর দিয়ে দিও। উনারা হয়তো চিন্তা করছেন।
প্রিথম সম্মতি জানাল। গাড়িটা চোখের পলকেই দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।
ওরা তিন ভাই আবারও ইনায়া, চিত্রা আর প্রেরণাদের সঙ্গে হাঁটছিল। কিন্তু রাজ কোনো কথা বলছে না, আর পূর্ণতা তো তাকে দুই পয়সারও পাত্তা দিচ্ছে না।
অরণ্য সমুদ্রের কানে কানে বলল,
— এই ভাবি কনফার্ম সেজদাকে টাইট দেওয়ার জন্য! এমন ভাবিই তো চাই। ফিউচারের সার্কাস দেখার জন্য আমার আর তর সইছে না!
সমুদ্রও ধীরে বলল,

— আস্তে বল! সেজদা শুনলে একা আছাড়ে তোর ভিতরের সবকিছু বাইরে বের করে দেবে।
অরণ্য রাজের মুখের দিকে তাকাল। মুখটা বেশ থমথমে। তার প্রচুর হাসি পাচ্ছে— এমন মনে হচ্ছে, কেউ তার পেটে কাতুকুতু দিচ্ছে! তবু সে ভয়ে চুপ হয়ে গেল। ঠিক তখনই রাজের ফোনটা বেজে উঠল।
রাজ কল রিসিভ করতেই প্রিথম উত্তেজিত গলায় বলল,
— আবিদ তোর ব্যাচমেট তো?
এই কথা শুনে রাজ অবাক হলো। মেজদা হঠাৎ আবিদের কথা কেন জানতে চাইছে?
প্রিথম ধৈর্যহারা হয়ে বলল,
— তোর ব্যাচমেট হলে আবিদের আব্বুর নাম্বারটা দে!
রাজ আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

— কেন?
প্রিথম সংক্ষেপে সব খুলে বলল। রাজ কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল,
— ঠিক আছে, ওর আব্বুকে আমি ফোন দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি।
সমুদ্র আর অরণ্য পরস্পরের দিকে তাকাল। রাজ প্রিথমের ফোন কেটে দিয়ে আবিদের আব্বুকে ফোন করে ওর বর্তমান অবস্থার সম্পর্কে জানাল।
আবিদ আর রাজ ব্যাচমেট— তারা স্কুল, কলেজ, অনার্স, মাস্টার্স সব একসঙ্গে করেছে।
সমুদ্র জিজ্ঞাসা করল,
— কী হয়েছে, দাদান?

রাজ একটু বিষণ্ণ গলায় সব খুলে বলল। ওদের দুজনেরও খারাপ লাগল, কিন্তু মানবতার খাতিরে যতটা সম্ভব তারা যথাসাধ্য করল। এর বেশি আর কী-ই বা তারা করতে পারে!
ওরা আবারও নিজেদের কেনাকাটায় মন দিল। তন্ময় একের পর এক পান্তুয়া, পাটিসাপটা, ক্ষীর, কদম ঠেসে-ঠুসে মুখে ঢুকিয়ে যাচ্ছে। মুখভর্তি খাবারের জন্য দুই দিকের গাল ফুলে পাহাড় হয়ে গেছে। অরণ্য তন্ময়ের এই অবস্থা দেখে আফসোসের সুরে বলল,

— “এতো খাস না, ভাই! পরে দেখা যাবে, তোর ওজনে গাড়ির চাকা ফেটে যাবে।”
তন্ময় ওইসব কথায় পাত্তা দিল না। সে অদৃশ্য তুলা কানে গুঁজে নিয়েছে। ঠিক তখনই সেখানে এসে হাজির হলো সাদাফ আর পরিণীতা। ওদের একটু পরেই এলো পৃথম।
পৃথম এসে ইনায়ার হাতে কিছু একটা দিল। ইনায়া পৃথমের চোখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
— “এটা কী?”
পৃথমও একইভাবে বলল,
— “এটা তোমার জন্য। পরে দেখো।”
ইনায়া খুশি হলো, লজ্জাও পেল। ওরা সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছে, শুধু প্রিয়তা আর প্রণয়ের কোনো হদিস নেই। ওরা তাদের খোঁজার চেষ্টাও করল না, নিজেদের মতো আবারও ঘুরতে শুরু করল।
এদিকে প্রিয়তা আর প্রণয় মেলার অপর প্রান্তে চলে এসেছে। প্রণয়ের হাতে বড় দুটি প্লাস্টিকের ব্যাগ—একটা হাতও ফাঁকা নেই। যে হাত ধরে রেখে বলবে,

— “এতো চটফট করিস না!”
সাঝের মেলায় বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার, হাতে তৈরি শাড়ি, গয়নাসহ নানান ইউনিক জিনিস পাওয়া যায়। প্রিয়তা ঘুরে ঘুরে যা যা দরকার, সব কিনছে। যা দরকার নেই, তাও কিনছে—ভালো লাগলেই কিনে নিচ্ছে। প্রণয় এইসব পাগলামি দেখে মনে প্রশান্তি অনুভব করল।
হঠাৎ প্রিয়তার নজর পড়ল একটা পায়েলের ওপর। সে ছুটে গিয়ে সেটা হাতে নিল। ডিজাইনটা খুবই ইউনিক—কালো সুতোয় সাদা-কালো পুঁতি বসানো। প্রিয়তা প্রণয়কে দেখিয়ে বলল,
— “এটা কিনে দিন!”
প্রণয় হেসে সেটাও কিনে দিল।

প্রিয়তা ওখানে আরও কিছু প্রসাধনী দেখছিল। ঠিক তখনই প্রণয়ের ফোন বেজে উঠল। সে পলিথিনের ব্যাগগুলো নিচে রেখে ফোন বের করল—জাভেদ কল করেছে। একবার প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে জাভেদ কী বলল, শোনা গেল না।
প্রণয় প্রিয়তাকে বলল,
— “রক্তজবা, তুই একটু দাঁড়া। আমি ঠিক এক মিনিটেই ফিরে আসছি। এক পা-ও নড়বি না।”
প্রিয়তা হেসে সম্মতি জানাল।
প্রণয় একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু প্রিয়তাকে চোখের আড়াল করল না। প্রিয়তার দিকে তাকিয়েই কথা বলতে লাগল।

প্রণয়ের মুখে মিশ্র অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে—কখনো সে রেগে যাচ্ছে, আবার কখনো বাঁকা হেসে উঠছে।
প্রিয়তা খুব মনোযোগ দিয়ে একজোড়া অক্সিডাইজ ঝুমকা দেখছিল। হঠাৎই তার ফোনে ‘টুঙ্’ করে একটা মেসেজ এলো। প্রিয়তা স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল পরিনীতার মেসেজ। ভ্রু কুঁচকে মেসেজটা ওপেন করতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল।
মেসেজের চার লাইনের বাক্য এমন ছিল—
“প্রিয়, পশ্চিম দিকের মাঠের শেষ সীমান্তে তাড়াতাড়ি আয়। আমি ভয়ানক বিপদে পড়েছি। বাঁচা আমাকে! আমায় ভীষণ ভয় করছে।”
প্রিয়তার হুশ উড়ে গেল। সে তড়িৎ বেগে আশপাশে প্রণয়কে খুঁজল, কিন্তু কয়েকজন লোকের ভিড় ছাড়া আর কিছুই নজরে এলো না। ভয় আর আতঙ্কে তার ছোট্ট শরীর কেঁপে উঠল।
কি করবে, না করবে—বুঝতে না পেরে সেখানে আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে সবকিছু ফেলে ছুট লাগাল পশ্চিমের দিকে।

প্রণয় কথা বলছিল, হঠাৎ কয়েকজন লোক সামনে এসে জটলা পাকিয়ে দেয়। তাদের জন্য আর প্রিয়তাকে দেখা যায় না। প্রণয় দ্রুত ফোন রেখে ছুটে এলো আগের জায়গায়, কিন্তু আশপাশে প্রিয়তার কোনো চিহ্ন নেই। ব্যাগগুলো যেমন রাখা ছিল, ঠিক তেমনই পড়ে আছে। আতঙ্কে তার গলা শুকিয়ে এলো।
পেছনে তাকিয়ে দেখে চারপাশ স্বাভাবিক, জটলা পাকানো লোকগুলোকেও আর দেখা যাচ্ছে না। প্রণয়ের হুশ হারিয়ে গেল। সে পাগলের মতো এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। ভয় আর উৎকণ্ঠায় মনে হচ্ছে, কেউ তার কলিজাটা ধারালো নখ দিয়ে মুঠো করে চেপে ধরেছে।

প্রিয়তা ছুটে চলেছে পশ্চিম দিকে। এদিকে আলো খুব কম। দূর থেকে মেলার ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। আশপাশে মানুষের নাম-নিশান পর্যন্ত নেই, শুধুমাত্র কয়েকটা প্রাইভেট কার পার্ক করে রাখা।
আশপাশে পরিনীতার কোনো চিহ্নই নেই, এমনকি একটা মশামাছি পর্যন্ত নেই! উপরন্তু, জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিশাল গাছগুলোর ছায়ার কারণে পরিবেশটা আরও ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। চাঁদের ক্ষীণ আলো পর্যন্ত সেই জায়গায় পৌঁছাচ্ছে না।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৯

প্রিয়তা এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। সে অন্ধকারে ভয় পায়, উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। সে এতদূর চলে এসেছে যে এখন আশপাশে তাকাতেই ভয় লাগছে! শুধু মনে হচ্ছে, এখুনি ভূত এসে ঘাড় মটকে দেবে!
সে আল্লাহর নাম নিয়ে উল্টো ঘুরে দৌড় দিতে যাবে, ঠিক তখনই কেউ ঝড়ের বেগে ছুটে এসে পেছন থেকে কোমর আঁকড়ে ধরে পাশের গাড়ির সাথে চেপে ধরল…।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২১