ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৪

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৪
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

প্রিয়তা চিৎকার দিয়ে বলল, “ছাড়ুন বলছি, শুদ্ধ ভাই! আঃহ, লাগছে! ছাড়ুন, প্লিজ!”
শুদ্ধ চরম বিরক্ত হলো, কিন্তু সাথে সাথেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল।
হঠাৎই তার বউয়ের গলাটা কেমন যেন অন্যরকম শোনালো! তার বউয়ের গলা সুমিষ্ট, এমন বাজখাই তো নয়!
ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল শুদ্ধ। পাশে তাকাতেই সে খানিকটা চমকে গেল—
তুহিনা!

ওর বিছানায় শুয়ে।
লজ্জা লজ্জা মুখ করে মাথা নিচু করে আছে।
সেকেন্ডের মধ্যেই শুদ্ধ বুঝে গেল, একটু আগে কী হয়েছে!
ঘটনাটা ব্রেনে প্রসেস হতেই শুদ্ধর মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গেল। মাথাটা ধপ করে গরম হয়ে উঠল।
সে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল তুহিনার দিকে। শুদ্ধর এমন রাগান্বিত লুক দেখে তুহিনার লজ্জা পালিয়ে গেল।
ওমন লাল চোখ দেখে আতঙ্কে কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলল।
শুদ্ধ সকাল সকাল এত ভালো একটা স্বপ্ন দেখছিল!
আজকের সারাদিনটা তার এত সুন্দর স্বপ্নটার কথা ভেবে কাটত—এই মেয়েটা পুরো মুডটাই খারাপ করে দিল!
সে রাগে কটমট করতে করতে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল, “সকাল সকাল এই ন্যাকা মেয়েটার মুখ দেখতে হলো!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তুহিনা শুদ্ধর একটু কাছে আসার চেষ্টা করে বলল, “আপনার জন্য চা করে আনি, শুদ্ধ ভাই?”
তুহিনার দিকে তাকাতেই শুদ্ধের গা জ্বলে গেল।
সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “কেন? তুই কি এই বাড়ির কাজের লোক?”
তুহিনা একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করে বলল, “তোমার জন্য এটুকু তো করতেই পারি!”
তুহিনার এমন আদিখ্যেতা দেখে শুদ্ধর মেজাজ আরও খারাপ হলো।
সে বিছানা থেকে নেমে বজ্র কণ্ঠে ধমক দিয়ে বলল, “এসব খেজুরে আলাপ আমার পছন্দ নয়!
তুই আমার ঘরে নক না করে, কোন সাহসে ঢুকেছিস?
Answer me, damn it!
তোকে না কতো দিন বারণ করেছি?
আমার পারমিশন ছাড়া আমার ঘরে ঢুকবি না! সামান্য manners টাও জানিস না? সামান্য শিক্ষাটাও নেই তোর?”
তুহিনার মুখটা অপমানে ছোট হয়ে গেল।

এইসব অপমান তার সয়ে গেছে।
তুহিনাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুদ্ধর রাগের পারদ আকাশ ছুঁচ্ছে।
মন তো চাচ্ছে এই বেয়াদব মেয়েটাকে থাপড়ে সোজা করে দেয়!
কিন্তু এসব শুদ্ধর পার্সোনালিটির সাথে যায় না।
তাই সে নিজেকে সংযত করে বলল, “ফাজিল মেয়ে একটা!”
শুদ্ধর এমন অবহেলায় তুহিনার চোখ-মুখে চরম অসহায়ত্ব ভর করল।
সে শুদ্ধর দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আপনি কি কোনোদিন আমার ভালোবাসা বুঝবেন না, শুদ্ধ ভাই?”
সে চোখের জল মুছে নিয়ে মনে মনে শপথ করল,
“তবে যত যাই হোক, আপনি আমাকে যতই অপমান করুন, আপনাকে আপন করেই ছাড়ব!
এটা এই তুহিনা চৌধুরীর প্রমিস।”

তুহিনাকে আকাশ-পাতাল ভাবতে দেখে শুদ্ধ আবার ধমক দিয়ে দাঁত কটমট করে বলল,
“কি সমস্যা? খাম্বার মতো সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর সামনে থেকে!
আর সকাল সকাল তোর এখানে কী কাজ? নিজের বাড়ি-ঘর দোর নেই?”
তুহিনা পূর্বের ন্যায় মাথা নিচু রেখেই বলল,
“আপনার সাথে যাব, তাই এসেছি।”
শুদ্ধর মুখটা বিরক্তিতে তেতো হয়ে গেল।
সে তুহিনার হাত ধরে টেনে নিয়ে ঘরের বাইরে বের করে দিয়ে শাসিয়ে বলল,
“Next time আমার অনুমতি ছাড়া আমার ঘরে ঢোকার দুঃসাহস দেখালে, মেরে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব!
Mind it!”
বলে চলে গেল…

তুহিনার চোখ টলটল করছে। আর কত অপমান সে সহ্য করবে ভালোবাসার জন্য? মান-সম্মান তো সে কবেই বিসর্জন দিয়েছে! কিন্তু শুদ্ধর কাছে তার কোনো মূল্যই নেই।
তুহিনার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে শুদ্ধর দরজার বাইরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। চোখের পানি মুছে বলল,
— কেন আমাকে ভালোবাসেন না, শুদ্ধ ভাই? আমি কি এতটাই খারাপ? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না? কেন আপনি আমার সাথে এতটা রূঢ়?
তার কণ্ঠে অসহায়ত্ব ঝরে পড়ল। সে পুনরায় অসহায় কণ্ঠে বলল,
— বলুন না, শুদ্ধ ভাই, আমার কোন দিকটা কম? আমি কি দেখতে ভালো নই? আমার শিক্ষা-দীক্ষার কি কোনো অভাব আছে? নাকি আমি আপনার যোগ্য নই? তাহলে কেন প্রতিনিয়ত আপনার বিষাক্ত বাক্যবাণে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেন?

তুহিনার কান্না থামছেই না। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন তার মনে এলো। সাথে সাথেই বিস্ময়ে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মুখ থেকে আপনা-আপনিই বেরিয়ে এলো,
— আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন, শুদ্ধ ভাই?
তুহিনার মনে পড়ে গেল কিছুক্ষণ আগের ঘটনা—ঘোরের মধ্যে বলা শুদ্ধর কিছু অবিশ্বাস্য বাক্য। যা সে শুদ্ধর মুখ থেকে কখনও শুনতে পাবে, তা কল্পনাও করেনি। তখন মনে হয়েছিল, এগুলো তাকে বলছে! কতটা বোকা সে!
সে তো ভালো করেই জানে, এসব কথা তাকে বলার মতো মানুষ শুদ্ধ নয়!
তুহিনার অন্তরে ভয়ের বীজ গেঁথে গেল। ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার চেয়েও বেশি, ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয় গলা চেপে ধরল। চিন্তিত মনে সে উঠে দাঁড়াল। মন শান্ত করে, মাথা ঠান্ডা করে ভাবার চেষ্টা করল—এই বিষয়ে সঠিক তথ্য তাকে কে দিতে পারে?
সাথে সাথেই দু’জনের মুখ তার চিত্রপটে ভেসে উঠল।

প্রথমজন—প্রণয়। কিন্তু প্রণয়কে প্রশ্ন করার মতো সাহস তুহিনার নেই। প্রণয়কে দেখলেই তার হাঁটু কাঁপে। সে কোনোদিনও প্রণয়ের সঙ্গে কথা বলেনি।
আর দ্বিতীয়জন? তার কথা ভাবতেই আশার আলো একটু ঝলক দিয়ে উঠল তুহিনার মনে…
সে ধীর পায়ে ড্রয়িং রুমের দিকে চলে গেল।
তুহিনা আর প্রহেলিকার অবস্থা একদম একই—দুজনেই ভালোবেসে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শুধু পার্থক্য এতটুকুই—প্রহেলিকা ভালোবাসা ধরে রাখতে ভুল রাস্তা বেছে নিয়েছে, আর তুহিনা এখনো ভুল পথে পা বাড়ায়নি। বা হয়তো সে জানেই না শুদ্ধর প্রিয়তমা সম্পর্কে!
প্রহেলিকা আর তুহিনা ছোট থেকেই প্রণয় আর শুদ্ধকে ভালোবাসত। কিন্তু প্রণয় আর শুদ্ধ কোনোদিনও ওদের গুরুত্ব দেয়নি, ওদের ভালোবাসা বুঝতে চায়নি। ওদের সেই সময়ই ছিল না! তারা দুজন কেবল একজনকে নিয়ে মত্ত ছিল—একজনের জন্যই উন্মাদ ছিল। আশেপাশে কে ওদের প্রতি কী অনুভব করে, না করে, তা নিয়ে তাদের কোনো বিন্দু মাত্র মাথাব্যথা ছিল না।

যদিও তখন প্রহেলিকা আর তুহিনা প্রিয়তার তুলনায় অনেকটাই বড় ছিল, প্রিয়তা তখন নিতান্তই শিশু। ভালোবাসার মতো কিছু ছিল না তার মাঝে—সে কেবল একটা সুন্দর, আদুরে, মিষ্টি বাচ্চা মাত্র! যার গুলগুল নীল চোখের চাহনি যে কাউকেই বিমোহিত করত। এছাড়া বিশেষ কিছুই ছিল না।
তুহিনা শুদ্ধর দুই বছরের ছোট, আর প্রহেলিকা প্রণয়ের এক বছর ছোট। বয়সের ব্যবধান খুবই কম হওয়ায় ওরা চারজন একসাথেই বড় হয়েছে।
যখন থেকে ওরা ভালোবাসার মানে বুঝেছে, তখন থেকেই ভালোবাসার মানুষ হিসেবে শুদ্ধ আর প্রণয়কেই ভালোবেসেছে। সেখানে “প্রিয়তা” নামের কেউ ছিল না।
তখন প্রহেলিকার মনে এত বিদ্বেষও ছিল না। সে তার অন্যান্য ছোট ভাই-বোনদের মতোই প্রিয়তাকেও ভালোবাসত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রণয়ের ওর প্রতি এমন পাগলামো দেখে তার মনটা বিষিয়ে গিয়েছিল ভীষণ কষ্ট হতো তার। যতবার প্রণয়ের প্রিয়তার প্রতি এমন বাঁধনহারা ভালোবাসা দেখাত, ততবারই তার মনে প্রিয়তার জন্য একটু একটু করে ঘৃণা জন্ম নিত।

একসময় সে উঠে-পড়ে লেগেছিল প্রিয়তাকে মেরে ফেলার জন্য!
কিন্তু শুদ্ধ আর একজন বিশেষ ব্যক্তির জন্য সে সফল হয় নি। তবে তার এই হিংসাত্মক মনোভাব সম্পর্কে প্রণয় কোনোদিনও জানতে পারেনি।
শুদ্ধ আর প্রণয় থেকে প্রিয়তা ১৩ বছরের ছোট।
শুধু একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে দিনরাত তাদের মধ্যে ঝামেলা চলত। মারামারি করে দু’দিন পরপর দু’জনেই একসাথে হাসপাতালে ভর্তি হতো!
ধীরে ধীরে তাদের গভীর বন্ধুত্ব গভীর শত্রুতার রূপ নিল । আর আজ এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও এই দ্বন্দ্ব বা শত্রুতা একচুল পরিমাণও কমেনি! বরং তা দিন দিন আরো বেশি ডালপালা মেলছে।
প্রিয়তা ধীরে ধীরে যত বড় হচ্ছিল, আর তাদের তাকে আপন করার আকাঙ্ক্ষাও বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।
যদিও শুদ্ধ দূরে ছিল, তবুও সে তার সুইটহার্টকে নজরের আড়াল করেনি। প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ডের খবর সে রাখত।
অবশেষে তারও দিন এলো!

সে ও একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল—প্রণয়কে প্রিয়তার থেকে চিরতরে দূরে সরিয়ে দেওয়ার!
শুদ্ধ যতই প্রহেলিকাকে ‘ব্রেনলেস’ বলুক না কেন, আজ যা কিছু হচ্ছে, তার ৯০% ক্রেডিট প্রহেলিকারি!
প্রহেলিকা যদি ওই কাজটা না করত, তাহলে শুদ্ধ কখনোই প্রণয়ের থেকে তার প্রাণ আলাদা করে দিতে পারত না!
কোনো মতেই প্রণয়কে বাধ্য করা যেত না!
প্রণয় শিকদারের কোনো দুর্বলতাই ছিল না—শুধু একটা দুর্বলতা ছাড়া!
এটাই সেই দুর্বলতা যেখানে টোকা দেওয়ার সাথে সাথেই প্রণয় শিকদার ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
আর এই সুযোগটাই লুফে নিয়েছে শুদ্ধ আর প্রহেলিকা!
তবে তাদের ভালোবাসা পাওয়ার রাস্তাটা ভয়ংকর!
তাদের ভালোবাসার রূপ প্রণয়ের ভালোবাসার মতো কোমল নয়—বরং ধ্বংসাত্মক!
তবে ওরা দুজনই প্রিয়তাকে এত পরিমাণ ভালোবাসে, এত পরিমাণ চায়—যা প্রিয়তা কোনোদিনও কল্পনা করতে পারবে না!
তবে সব সত্য-মিথ্যার বেড়াজালের ঊর্ধ্বে একটা কথাই ধ্রুব সত্য—শুদ্ধ আর প্রণয়ের ভালোবাসায় কোন কম বেশি নেই!

দুজনের ভালোবাসাই সমান।
ওরা এত পরিমাণ ভালোবাসে যে ওই একটা মেয়ের জন্য হাজারটা জীবন ধ্বংস করতে তাদের হাত কাঁপবে না!
তারা প্রাণ দিতেও পারবে, আবার নিতে ও পারবে।
ওরা দুজনেই নিঃস্ব।
ওদের নিজের বলতে কিছুই নেই…
সকাল ৮:৪৫
শুদ্ধ গুসল সেরে খালি গায়ে কেবল ট্রাউজার পরে বেরিয়েছে। তার পুরুষালি ফরসা দেহ থেকে গড়িয়ে পড়া বিন্দু-বিন্দু জলকণা দারুণ আকর্ষণীয় লাগছে। হাত আর বুকের পেশি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ৬’১” উচ্চতার এক সুদর্শন সুপুরুষ! হাঁটা-চলা, পার্সোনালিটি—সবকিছুতেই মেনলি ভাবটা তীব্র।

এই অবস্থায় তুহিনা তো কোন ছাড়, যে কোনো নারী এক দেখাতেই খুন হয়ে যাবে!
সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেল এক জায়গায়, ঠোঁটে খেলল এক চমৎকার বাঁকা হাসি। চোখ বন্ধ করতেই দৃশ্যপটে ফুটে উঠলো কাল রাতের মোহনীয় সব দৃশ্য।
সে আয়নার দিকেই তাকিয়ে রহস্যময় কণ্ঠে বলল—
**”ম্যাডাম, আমার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছ?
এর সুদ যদি আমি শোধে আসলে নিতে না পারি, তবে আমার নামও শুদ্ধ চৌধুরী নয়! বহু বছর আমাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মেরেছো, সুইটহার্ট। এবার আমার পালা! এবার তোমাকে এই শুদ্ধের হৃদয়-খাঁচায় বন্দিনী হতেই হবে। এই শুদ্ধকেই তোমাকে আপন করতে হবে। এই শুদ্ধের বিষাক্ত ভালোবাসার বিষ তোমাকে পান করতেই হবে।
ড. চৌধুরী আবার কারও ঋণ রাখে না! তুমি যেহেতু আমায় ভালোবাসা দিয়ে খুন করেছো, তাহলে তোমাকেই বা কিভাবে অক্ষত থাকতে দেই, বলো তো?

Now your turn, my sweetheart! My love… Be prepared!”**
বলে সে বাঁকা হাসল। ফরসা গালের টোল পড়া হাসিটা যে কী মারাত্মক দেখালো!
সে ওয়ার্ডরোব খুলে সাদা ফরমাল শার্টের সঙ্গে কালো ফরমাল প্যান্ট বের করল। ফোনে টাইম দেখে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই পিছন থেকে গম্ভীর, পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো—
“কাল রাতে কোথায় ছিলি তুই?”
শুদ্ধ পিছন না ঘুরেই বাঁকা হাসল।
প্রণয় ওর দিকেই এগিয়ে এসে শক্ত কণ্ঠে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ল—
“কাল রাতে কোথায় ছিলি? Answer me?”
শুদ্ধ হাসল, ভ্রু নাচিয়ে একটু দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে প্রণয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রণয়ের উদ্বিগ্ন চোখে চোখ রেখে নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল—

“জান্নাতে!”
এমন উত্তর শুনে ভ্রু কুঁচকালো প্রণয়। পুনরায় রেগে কিছু বলতে নিলে হঠাৎ তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল এক জায়গায়। বলা চলে, তার বাকশক্তি হারিয়ে গেল! মস্তিষ্কের সমস্ত স্নায়ু যেন নিজেদের সক্ষমতা হারালো!
নিস্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইল সে শুদ্ধের বুকের দিকে।
আজ সে হয়তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে চায় না।
শুদ্ধের বুকের বাম পাশে বেশ গভীর দুটো চিহ্ন—যে কেউ একবার দেখেই বলে দিতে পারবে, এটা সাধারণ কোনো ক্ষত নয়। এটা বিশেষ! এটা দুজনের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের বিশেষ চিহ্ন!
আর সেই দাগটাই সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ফর্সা, নিখুঁত দেহের ওই জায়গাটা রক্ত জমাট বেঁধে কালচে নীল বর্ণ ধারণ করেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অনেক ব্যথা।
শুদ্ধ, প্রণয়কে এত মনোযোগ দিয়ে নিজের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রণয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সে ও নিজের দিকে তাকাল। ঘটনা বুঝতে পেরে বাঁকা হেসে প্রণয়কে বলল—
“কি এত মন দিয়ে দেখছিস এটা? এটা লাভ বাইট! তোর থেকে ভালো কে চিনে, ভাই?”
সে ভ্রু উঁচকে প্রণয়ের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রণয়ের কোনো জবাব না পেয়ে তাকে একটু রাগিয়ে দিতে বলল—

“ভাবছি, দাগটা মিটে যেতে দেব না! পারমানেন্টলি রেখে দেব! আমার সুইটহার্টের দেওয়া প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন আজীবন বুকে ধরে রাখব!”
কিন্তু প্রণয় এবার কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে, শুদ্ধ মনে মনে ভাবল— শকটা তাহলে ভালোই গভীরে লেগেছে!
সে প্রণয়ের কাঁধে হাত রাখতেই—
প্রণয় চমকে গেল। বুকের ভিতর কেমন অনুভূতি হচ্ছে, সেটা সে বুঝতে পারল না, তবে বাইরে দেখে আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি।
প্রণয় রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো শুদ্ধর দিকে। তার দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ, চোখের সাদা অংশ রক্তিম, সেখানে হয়তো পানি চিকচিক করছে। কপালের সবুজ শিরাগুলো ফুলে ফেঁপে ভেসে উঠেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সামনে ব্যক্তির উপর কিছুক্ষণের মধ্যেই টর্নেডো ঝড় বয়ে যাবে!

শুদ্ধ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রণয়কে পর্যবেক্ষণ করে আবারও বাঁকা হেসে বলল, “কুল ম্যান, এত রেগে যাওয়ার কী আছে? আমাদের এগ্রিমেন্টেই তো ছিল—আমার সুইটহার্ট নিজে থেকে আমার কাছে এলে, আমাকে ভালোবাসলে, তুই আমাদের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াবি না। ওর উপর থেকে নিজের সকল অধিকার তুলে নিবি, ওকে আমার হতে তুলে দিবি। এখন দেখ, প্রমাণ তোর চোখের সামনে!
আর মুখে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে তো আমার মনে হয় না।”
প্রণয়কে কথাগুলো বলতে কেন জানি বুক কাঁপছিল শুদ্ধর। প্রিয় বন্ধুর মনের অবস্থা আন্দাজ করে খারাপ লাগা ছড়িয়ে পড়ছিল মনের আনাচে-কানাচে। সে মোটেও চাইনি প্রণয় এসব দেখে ফেলুক। সে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই শক্ত হাতের তীব্র আঘাত এসে লাগলো শুদ্ধর গায়ে!
শুদ্ধ চমকালো না। এটার জন্য সে প্রস্তুতই ছিল।

প্রণয় রক্তলাল চোখে শুদ্ধকে মারতে মারতে চিৎকার করে বলল, “I just f****k your agreement!**
She is only mine! How dare you touch my love? I will destroy you!”
বলতে বলতে এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো শুদ্ধকে। শুদ্ধর নাক-মুখ দিয়ে ইতিমধ্যেই রক্ত উঠে এসেছে , তবু ও তার ঠোঁটে বিশ্বাস-জয়ের হাসি! যা দেখে প্রণয়ের রাগ আরও তীব্র হারে মাথায় চেপে বসল। বুকটা দুঃখে, কষ্টে, ব্যথায়, যন্ত্রণায় আর মাথাটা রাগে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে! আজ সে নিজে মরবে, নাহলে সকল যন্ত্রণার উৎসকে তুলে ফেলবে!

শুদ্ধকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলেছে, কিন্তু শুদ্ধ একবারও আঘাত করেনি, কেবল প্রণয়কেই আঘাত করতে দিচ্ছে! কারণ, সে জানে, এখন তার শত্রুকে বাধা দিলে সে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। শান্তশিষ্ট প্রণয়ের রাগ সম্পর্কে তার থেকে ভালো আর কে জানে?
এই শত্রুতাকে মেরে ফেললেও শুদ্ধ কখনোই এই শত্রুকে হারাতে চায় না। প্রিয়তার বাস হৃদপিণ্ডের ৮০ ভাগ জুড়ে থাকলেও, বাকি ২০ ভাগ জায়গা এই শত্রুর দখলে!
প্রণয় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মারতে মারতে হঠাৎ থেমে গেল!
তার নজর আটকালো শুদ্ধর পিঠে—
সেখানে ১০টা নখের ধারালো আঁচড়ের দাগ! সেখানে ও রক্ত জমাট বেঁধে আছে!
প্রণয়ের হাত আপনাতেই থেমে গেল।
চোখ বন্ধ করতেই গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ তরল, নিভে গেল সকল হিংস্রতা। দুর্বল লাগছে ভীষণ। সে চোখ খুলে আরও কয়েকবার দেখলো ক্ষতগুলো। এগুলো দেখে কানার ভাই অন্ধও সম্পর্কের গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে পারবে!

প্রণয় এখানে এসেছিল, তার মনের সন্দেহ দূর করতে। নিজের চিন্তা-ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে নিজের মনকে একটু স্বস্তি দিতে। কিন্তু সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হবে! এখানে এসে এমন কিছু দেখবে, যা তার পুরো পৃথিবীটাই উলটপালট করে দেবে। চিনিয়ে নেবে বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন, ফুরিয়ে যাবে তার জীবনের সকল প্রয়োজনীয়তা।
সে এই মুহূর্তে অনুভব করল—এখন নয়, বরং কাল রাতেই তার মরে যাওয়া উচিত ছিল!
তবে সে সামান্য স্বস্তি নিয়েও হলেও মরতে পারতো, এতটুকু শান্তি সে পেতো, যার জন্য মনের এত ব্যাকুলতা! যার বিচ্ছেদে সে নিঃস্ব—সে অন্তত একটু হলেও তো তাকে ভালোবেসেছে! এতটুকু সান্ত্বনা তো সে নিজেকে দিতেই পারতো! কিন্তু এখন তো সে মরে গেলেও শান্তি পাবে না! তার এই অসম্পূর্ণ জীবনের এতো অপ্রাপ্তি তাকে কিছুতেই শান্তি দেবে ন।
সে বহু কষ্টে উচ্ছারন করলো-

“ছি! রক্তজবা, তুমি এতটা নিচে নামতে পারলে?”
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রণয়ের চোখ-মুখ পুনরায় দ্বিগুণ হিংস্রতায় ছেয়ে গেল! তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো কাল্পনিক সকল সম্ভাব্য দৃশ্য!
রাগে তার শরীর কাঁপছে। ইচ্ছে করছে এবার মেয়েটাকে নিজের হাতেই খুন করে ফেলতে! বুক পুড়ছে তার! তীব্র ক্ষোভে সে বলল—
**”তুই আমার পবিত্র ফুল! তোকে আমি নিজের বুকে আগলে ছোট থেকে মানুষ করেছি। কখনো নিজে একটু ছুঁয়ে দেখার সাহস করিনি। যদি তুই মলিন হয়ে যাস, যদি তোর পবিত্রতায় দাগ লেগে যায়—এই ভয় সব সময় নিজেকে বোঝাতাম! আমার রক্তজবা, একদিন ঠিক আমার হবে! সেদিন আমার মনের সকল ভালোবাসা দিয়ে তোকে আপন করে নেব! কোনো তাড়া ছিল না আমার!
কিন্তু যেদিন সেই আশাটাও নিভে গেল, সেদিন অনেক কষ্ট হয়েছিল জানিস? তবু এ মনকে আবারও বুঝিয়েছিলাম—আমার জন্য আমার রক্তজবার দর্শনই যথেষ্ট!

তুই আমার মানসিক শান্তি! দিনশেষের ক্লান্তি আর অপূর্ণতা পুষিয়ে নিয়েছি তোর চাঁদমুখ দেখে! চাঁদের গায়ে কলঙ্ক থাকলেও তোকে আমি কখনো কলঙ্ক লাগতে দিইনি! সব ঝড়ঝাপটা নিজেই সহ্য করেছি…”**
**”আর আজ তুই নিজেই আমার বুকে সবচেয়ে বিষাক্ত ছুরিটা মারলি! তবে ঠিক আছে, তোকে আমি নিজের জীবন দিয়ে আগলে রেখেছিলাম, আজ আমিই তোকে এই দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেব! তুই আমার না হলে, কোনো অধিকার নেই তোর বেঁচে থাকার!

তুই মিথ্যাবাদী! তোর সাথে সাথে তোর চোখও মিথ্যে বলে! আমি তোকে চিনতে ভুল করেছি! কিন্তু ব্যাপার না, আমি যেহেতু বাঁচব না, তাহলে তোকে ও মরতে হবে! আমি পারব না তোকে ছাড়া থাকতে! তাই আমি যেখানে থাকব, তোকেও সেখানেই থাকতে হবে! কবরই যদি হয় আমার শেষ ঠিকানা, তবে সেখানে আমি একা যাব না!”**
প্রণয় পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল শুদ্ধর ঘর থেকে।
শুদ্ধের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। সে নিজের ঠোঁটের কোণা থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তটুকু মুছে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল, “খুব লেগেছে আজ, তাই না? আমারও লাগতো! খুব কষ্ট হয়েছে! বল, আমার তো হতো! দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর, শুধু তোর জন্য আমাকে আমার ভালোবাসার থেকে হাজার মাইল দূরে পড়ে থাকতে হয়েছে! আজকে তুই ঠিক যে যন্ত্রণা অনুভব করলি, সেটা আমাকে প্রতিনিয়তই অনুভব করতে হতো। শুধু তোর জন্য, খুব কষ্ট হতো, বিশ্বাস কর! খুব! একবার দেখার জন্য গলা শুকিয়ে যেত, কিন্তু পারতাম না! তোর জন্য বা তোদের জন্য!

অন্যকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে তোদের, আর সেই কষ্টের কয়েক ফোঁটা যখন নিজের গায়ে লাগে, তখন তোরা সহ্য করতে পারিস না! বিশ্বাস কর, আজকে তুই যে কষ্টটা পাচ্ছিস, এটা তুই ডিজার্ভ করিস! এটা তোর কর্মফল! বহু বছর তো সুখে কাটালি, এবার একটু অনুভব কর! আমি এতো বছর কী কী সহ্য করে বেঁচে আছি, শুধু মাত্র তোর জন্য!”
সে কিছু একটা ভেবে তৎক্ষণাৎ ফোন লাগালো। কারো নাম্বারে কয়েকবার রিং হতেই ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে কী বলল, শোনা গেল না। শুধু “শুদ্ধ” বলল—

“খুব কষ্ট পেয়েছে… চোখে চোখে রাখবেন… যদি মরে যায়, তাহলে আপনারই লস!”
অপাশের ব্যক্তি কিছু একটা বলল, যা শুনে শুদ্ধ চরম রেগে গেল। রাগে গজরিয়ে উঠে বলল—
“জাস্ট মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ! আমি আপনার হাতের পুতুল নই! এই আবদ্ধ চৌধুরি শুদ্ধ কারো কথায় চলে না! সে নিজেই নিজের মর্জির মালিক! এতদিন আপনি আমাকে আপনার হাতের ইশারায় নাচিয়েছেন, কারণ আমি ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো আপনার কথা রাখবেন! কিন্তু এখন আমি ভালোই বুঝতে পারছি, আপনার মতো স্বার্থপর মানুষ নিজের স্বার্থটা ছাড়া অন্যেরটা কখনোই দেখে না তাই আমাকেই আমারটা বুঝেনিতে হব আপনার ভরসায় থাকলে এজীবনে আমি আমারটা পাবো না ! তাই আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না! সেটা আপনার জন্য ভালো হবে না! আমার বলা কাজ তাই বললাম , বাকিটা আপনার ইচ্ছা!”

বলে কট করে ফোন কেটে দিল।
প্রণয় দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করল। ড্রয়ার খুলে সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার বের করে হাতে নিল। তার লাল লাল চোখ দুটো জলজল করছে। সে ধরে আসা গলায় বলল—
“তোর দেহ ও মনের উপর কেবল আমার অধিকার! তোর মনের মালিক আমি, দেহের উত্তরসূরি! তোকে যদি কোনোদিন আপন করতে না-ও পারতাম, তবু ও তোকে আমি অন্য কারো হতে দিতাম না! দুঃখিত, জান! আমি এত মহান নই যে আমার প্রিয়তমাকে অন্যের হাতে তুলে দেব! প্রয়োজন হলে আমি নিজেই নিজের প্রাণ নিয়ে নেব, তবু অন্যের অধিকার সহ্য করব না!”

সে রিভলভারটা নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
প্রহেলিকা বারান্দায় টানানো পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। চোখ-মুখ তার ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেছে। সে প্রণয়কে এত রেগে যেতে এর আগে কখনো দেখেনি। ভয়ে তার রীতিমতো কলিজা লাফাচ্ছে! সে ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। ভাবল—
“কি হলো ব্যাপারটা? ওটা নিয়ে কাকে মারতে গেল? আর কি বলল? নিজের প্রাণকে নিজেই মেরে ফেলবে! তাহলে কি…”

প্রহেলিকার ভ্রু কুঁচকে গেল। কিছুক্ষণ ভাবার পর তার চোখ-মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে এলো—
“প্রিয়তা!”
কয়েক পল থমকে থাকার পর হাত দিয়ে মাচি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলল—
“তুমি যত বড়ই যাই হও না কেন, আর যতই রেগে থাকো না কেন, এই কাজ তোমার জন্য নয়! তোমার রাগের চরম পর্যায়ে তুমি নিজেকে শেষ করে দিতে পারো, কিন্তু প্রিয়তার গায় সামান্য টোকা ও দিতে পারবে না! রক্ষক কখনোই ভক্ষক হতে পারে না! আর তুমি যদি ওকে সত্যি মারতে পারতে, তাহলে পৃথিবীটাই অন্যরকম হতো! এত দিনে আমি তোমার মনে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে ফেলতে পারতাম এই সব ছাইপাঁস ভাবনার মাঝেই!”
হঠাৎ তার মাথায় প্রশ্ন জাগল। মনে মনে ভাবল—

“সকাল সকাল কী এমন ঘটল, যে আমার প্রাণের স্বামী এত রেগে গেল?”
কিছু ভাবতেই সে ঝটকা খেয়ে উঠল সে। তারপর দৌড়ে ছুটে গেল শুদ্ধের ঘরের দিকে।
প্রণয় প্রিয়তার দরজায় হালকা চাপ দিতেই দরজাটা শব্দহীনভাবে খুলে গেল।
প্রিয়তা কখনো দরজা ভেতর থেকে লক করে না, সবসময় চাপানো থাকে। কাল অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে মেয়েটা কোনোরকম খেয়ে সোজা ঘুমিয়ে পড়েছিল…
প্রিয়তার কক্ষের ভেতরে পা রাখতেই প্রণয়ের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। বিদ্যুৎবেগে নাকে এসে লাগল সেই অতি পরিচিত, মন-প্রাণ শান্ত করে দেওয়া মোহনীয় সুবাস—যা প্রণয়ের জন্য নিষিদ্ধ মাদক। তার হৃদপিণ্ডের গতি বাড়তে লাগল।

আচমকাই যন্ত্রণার আগুনে ভালোবাসার ঘৃত পড়ল। তাতে ভালোবাসার ভাড় বাড়ল কি না বোঝা গেল না, তবে যন্ত্রণার আগুন হলহল করে ছড়িয়ে পড়ল অন্তরের আনাচে-কানাচে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল প্রিয়তার বিছানার কাছে।
কাছে যেতেই প্রাণপ্রিয় মুখখানায় দৃষ্টি আটকাতেই প্রণয়ের সকল অনুভূতি অসাড় হয়ে গেল। সে নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে রইল নিজের প্রাণপাখির দিকে।
প্রিয়তা বেবি পিংক কালারের হ্যালো কিটি ওভারসাইজ টি-শার্টের সঙ্গে ম্যাচিং ঢিলা প্লাজো পরে আছে। প্লাজোটার হাঁটুর একটু নিচ পর্যন্ত উঠে আসায় তার অতি আকর্ষণীয় ফরসা পা দুটি দৃশ্যমান।
লম্বা ঢেউ খেলানো চুলগুলো সহজেই বিছানায় ছাড়িয়ে মেঝের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে। নাকের আশেপাশে তেল চিকচিক করছে, বন্ধ চোখের কালো পাপড়িগুলোতে অপরূপ মায়া লেপ্টে আছে। এক হাত গলার কাছে, আরেক হাত পেটের ওপর রেখে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে প্রিয়তা। পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে দিবাকরের আলো এসে গায়ে পড়ছে।

প্রিয়তার নিষ্পাপ চেহারার দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই মনে হল প্রণয়ের তীব্র রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ, উদ্ধত্য—সব মুহূর্তেই কেউ শুষে নিয়েছে। লাভা ছড়ানো জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি মুহূর্তেই শান্ত নীল সাগরে পরিণত হলো। তবে মস্তিষ্কের ক্রোধঅনল নিভে গেলেও মনের ক্ষতটা আরও খানিক গভীর হলো। সেখান থেকে অদৃশ্য রক্ত ধীরে ধীরে ঝরতে লাগল, যা প্রণয়ের জন্য অসহনীয়।
সে দৃষ্টি সরিয়ে রিভলবারটির দিকে তাকাতেই নিজের প্রতি চরম ঘৃণা চলে এলো। অন্তরাত্মা ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, “পারবি তো?”
প্রণয় তাচ্ছিল্য হাসল।
রিভলবারটা পাশের জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে মহোগ্রস্তের ন্যায় এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে…
প্রিয়তার মাথার পাশে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে নিজের দুর্বলতাকে মন-প্রাণভরে দেখল।
নিজের দুই হাত প্রিয়তার দুই পাশে রেখে একটু ঝুঁকে গেল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার ঘুমন্ত ভারি নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে প্রণয়ের চোখে-মুখে।

প্রিয়তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতেই টপ করে এক ফোঁটা তরল গড়িয়ে পড়ল প্রিয়তার ডান গালে। সে প্রিয়তার নরম গালে হাত ছুঁইয়ে আকুল কণ্ঠে বলল,
“আঘাত যদি করারই ছিল, পুরো শরীরটা তোমার ছিল। কিন্তু বোকা, তুমি আঘাত করার জন্যই হৃদয়টাই বেছে নিলে?”
কথা বলার আর নিঃশ্বাস নেওয়ার তালে তালে প্রণয়ের গলার Adam’s Apple এদিক-সেদিক নড়াচড়া করছে। সে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আরও কিছু বলবে, তার আগেই প্রিয়তা ঘুমের ঘোরে প্রণয়ের বাঁ হাতটা আকড়ে ধরল। আপনা-আপনি চোখ বন্ধ হয়ে গেল প্রণয়ের। আবারও গাল বেয়ে আরেক ফোঁটা বেদনার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল প্রিয়তার গলায়।
সে প্রিয়তার নরম হাতটা মুঠো করে হাতের উল্টো পিঠে অলতো চুমু খেয়ে বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলল,

“পৃথিবীর সবাই আমাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেত, আমার একটুও কষ্ট লাগতো না জান। কিন্তু তোমার দেওয়া ছোট থেকে ছোট কষ্টগুলোও আমি সহ্য করতে পারি না। আর সেই তুই—আজ আমাকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিলে!”
সে বড় করে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। অতঃপর প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“তবে তাই হোক! তোর সুখেই আমি সুখী! আমি যদি না-ও থাকি, তবুও আমার জান, তুই সুখী থাক!”
অতঃপর প্রিয়তার কপালে পড়ে থাকা দুই-একটা বেবি হেয়ার সন্তর্পণে কানের পেছনে গুজে দিয়ে সেখানটায় গভীরভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে বলল,

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৩

“আমার সকল সুখ তোর হোক পাখি!”
তার ধৈর্যের আর কুলালোনা । সে আর এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে। প্রবল বেগে বেরিয়ে গেল প্রিয়তার ঘর থেকে, অতঃপর শিকদার বাড়ি থেকে।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৫