ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৬
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
ম্যাথস গুলো ৫ মিনিটের মধ্যে কমপ্লিট করে দাও, অ্যাঞ্জেল!
পরিণীতা একবার অঙ্কের দিকে তাকায়, তো একবার আবিদের দিকে। আবিদ চশমার কোণা ঠেলে গভীর মনোযোগী দৃষ্টিতে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। পরিণীতা দেখলো—কি জানি সব চিহ্নযুক্ত হিজিবিজি অঙ্ক! এই যে উদ্ভট চিহ্নগুলো আছে, পরিণীতা সবগুলোর নামও ঠিকমতো বলতে পারবে কিনা, সন্দেহ।
পরিণীতা গভীর মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে অঙ্কগুলো দেখল কিছুক্ষণ, কিন্তু হায়! সবকিছুই তার মাথার চার হাত ওপরে দিয়ে উড়ে গেলো। পাক্কা ২০ মিনিট মনোযোগ দিয়ে কলম চাবানোর পরও যখন সে এক লাইনও উদ্ধার করতে পারলো না, তখন সে চিন্তায় পড়ে গেলো। মনে মনে ফন্দি আঁটলো—এই ব্যাটার হাত থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়?
সে অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলো, সামনের বেটাকে এভাবে না হলে অন্যভাবে কাবু করবে। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ! পরিণীতা সামনে আসা, চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে লজ্জা-লজ্জা ভাব নিয়ে সামনে থাকতেই ভয় পেয়ে গেলো। আবিদ রাগী রাগী চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
পরিণীতা শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলবে, তার আগেই আবিদ ধমক দিয়ে বললো, “হাত পাতো!”
পরিণীতা ভয়ে কলিজা লাফাচ্ছে। আবিদ আবারও সজোরে বললো, “হাত পাতো, অ্যাঞ্জেল!”
পরিণীতা ভয় ভয় হাত পাতলো। সাথে সাথেই আবিদ ছটাস ছটাস করে চারটা বাড়ি লাগিয়ে দিলো! ব্যথার তীব্রতায় পরিণীতা চিৎকার দিয়ে ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠেলো। এখনো তার হৃদপিণ্ড ধকধক করছে!
“কি ভয়ানক স্বপ্ন ছিল! আস্তাগফিরুল্লাহ!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরিণীতা মনে মনে দুঃখ পেয়ে বললো, “আপনি আমাকে স্বপ্নেও মারধর করেন, মাস্টার মশাই! একটু-ও ভালোবাসেন না? একটু ভালোবাসলে কি আপনার জাত যাবে?” সব সময় শুধু ধমকানো-চমকানো!
পরিণীতা ঝিমাচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে আগে ১০ মিনিট না ঝিমালে তার শরীর জায়গায় আসতে চায় না। সে একটা হাই তুলতেই আবার কিছু একটা মনে হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো। দেয়াল ঘড়িতে দেখলো সকাল ১০!
পরিণীতা কপাল চাপড়ে “হায় হায়!” করে উঠলো। বিদ্যুৎ বেগে বিছানা থেকে নেমে ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। আজ হয়তো পরিণীতার শেষ দিন!
সে ব্রাশে পেস্ট লাগাতেই ওর ফোনটা চিৎকার দিয়ে বেজে উঠলো। ব্রাশ করতে করতেই বেরিয়ে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো—পূর্ণতা! সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোঁশব্দে ধমক ভেসে এলো।
পূর্ণতা চিৎকার দিয়ে বললো, “পরি! পরিণিতার কান ঝাঁঝিয়ে উঠলো পূর্ণতা আবার চিৎকার দিয়ে বলল তোর আক্কেল কি কোনো দিন হবে না? আজকে আমাদের ম্যাথসের এক্সাম আছে, তুই সেটা ভুলে গেছিস, তাই না? আমি কখন থেকে কলেজে এসে তোর জন্য অপেক্ষা করছি!”
পরিণীতা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো, “আরে, টেপির মা! চেতোস কেন? আমি ২০ মিনিটের মধ্যেই আসছি!”
পূর্ণতা আবার জোরালো শব্দে ধমক দিয়ে বললো, “সিরিয়াসলি পরি? তুই আরও ২০ মিনিট পরে আসবি? ২০ মিনিট পর থেকে আমাদের এক্সাম স্টার্ট হয়ে যাবে!”
পরিণীতার মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।
পূর্ণতা আবার বললো, “তোর জন্য বোনাস পয়েন্ট—কলেজে নতুন ম্যাথসের প্রফেসর জয়েন করেছেন! আমি যদিও ওনাকে এখনো দেখি নাই, তবে শুনেছি, স্যার নাকি হাব্বি ঝাঝালো! তুই তো শেষ!”
পরিণীতার ভয়-বিস্ময়ে চোখ গোল গোল হয়ে গেল।
পূর্ণতা আবার বললো, “যদি ভালো চাস, ১০ মিনিটের মধ্যে যেভাবে পারিস চলে আয়!”
বলেই টাস করে ফোনটা কেটে দিল।
পূর্ণতা দিনে-দুপুরে পরিণীতার মাথায় বাজ ফেলে দিল!
পরিণীতা আল্লাহ স্মরণ করে বললো, “হে মাবুদ! নারকেল ফাটানোর জন্য কি সবসময় আমার মাথাটাই পছন্দ হয়?”
সে নিজের মাথায় বাড়ি মেরে কলেজ ইউনিফর্ম নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। যেতে যেতে
অংক কে গালি দিয়ে বললো, “যত্তসব বালের উত্তেজনা মার্কা সাবজেক্ট সব সময় সব জায়গায় শুধু ধরাধরি করা করি ছিহ!
আজাইরা প্যাঁচাল!
এইসব বাল যে কোন হলায় বের করেছিলো! হাতের কাছে পাইলে কেজি কুড়ি এক শুকনা মরিচের পেস্ট খোয়াতাম সালাকে!”
পরিণীতা এক মিনিটে চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে কোমরসমান চুলগুলো পনিটেল করে নিয়ে।
তারাহুরো করে ব্যাগ গুছিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
শিকদার বাড়িতে বর্তমানে তেমন কেউ নেই। পুরুষরা সবাই অফিসে, অনন্যা, সমুদ্র, প্রেরণা ভার্সিটিতে, থিরা-থরি তন্ময় স্কুলে। বাড়িতে কেবল চার গিন্নি—প্রহেলিকা, পরিণীতা আর প্রীয়তা।
প্রিয়তা আজ কলেজ যাবে না।
পরিণীতা ছুটে ড্রইংরুম ক্রস করার সময় অনন্যা বেগম পেছন থেকে ডেকে উঠলেন, “এই পরি! দাঁড়া!”
পরিণীতা থমকে গেল। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে ছুটে গিয়ে অনন্যা বেগমের দু’গালে কষে দু’টো চুমু খেয়ে অসহায় কণ্ঠে বললো, “প্লিজ, সেজো আম্মু! এখন খাওয়ার কথা বলবা না, অনেক লেট হয়ে গেছে!”
বলে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না!
ছুটে বেরিয়ে গেল শিকদার বাড়ি থেকে। অনন্যা বেগম যা বলতে চাচ্ছিলেন, সেটা আর বলার সুযোগ পেলেন না।
পরিণীতা ছুটে শিকদার বাড়ির বিশাল গ্যারেজের সামনে এসে থ হয়ে গেল। কথায় আছে, না-অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়! পরিণীতারও এখন তেমন অবস্থা। তার তো এখন হাত-পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে!
শিকদার বাড়ির ১২ খানা গাড়ির মধ্যে বর্তমানে একটা ও নেই! শিকদার বাড়ির পুরোনো ড্রাইভার রহমান চাচা পরিণীতাকে দেখে ছুটে এসে বললেন, “কি হয়েছে, পরী আপা? এভাবে বসে আছো কেন?”
পরিণীতা অসহায় গলায় বলল, “সব গাড়ি কোথায়, চাচা?”
রহমান মিয়া স্বাভাবিকভাবেই বললেন, “বড় সাহেবেরা ৪ জন ৪ টা নিয়ে চলে গেছেন, ভাইজানরা ৫ জন ৫ টা নিয়ে চলে গেছেন, ছোট দুই ভাইজান আর প্রেরণা আপা মনি একটা নিয়ে গেছেন, আর বাকি দু’টা সার্ভিসিংয়ে।”
পরিণীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতে থাকা অ্যাপল ওয়াচে সময় দেখে নিল। আর মাত্র ১২ মিনিট বাকি! সে এখন কী করবে?
“এখানে বসে আছো কেন, ফুলপরী?”
হঠাৎ কারও কণ্ঠে পরিণীতা চমকে পিছনে তাকাল। সাদাফ! ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
পরিণীতার চোখে-মুখে আশার আলো ঝলক দিয়ে উঠলো! সে ছুটে গেল সাদাফের কাছে।
সাদাফ পুনরায় বলল, “আর কলেজ ড্রেস পরে তুমি এখানে কেন?”
পরিণীতা সাদাফের কাছে গিয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে আবদারের সুরে বলল, “আমাকে একটু কলেজে ড্রপ করে দেন না, সাদাফ ভাই? প্লিজ!”
সাদাফ পরিণীতার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে।
পরিণীতা আবার বলল, “সাদাফ ভাই…”
পরিণীতার এমন মোলায়েম কণ্ঠের আবদার সোজা গিয়ে সাদাফের কলিজায় লাগলো! সে মনে মনে বলল, My angel, এভাবে বলো না, মরে যাবো তো! এভাবে বললে সাদাফ সাখাওয়াত নিজের প্রাণ দিত ও দ্বিধা করবে না!
সে পরিণীতার গাল টেনে দিয়ে হেসে বলল, “Just wait a few seconds!” বলেই গ্যারেজের ভেতরে চলে গেল।
পরিণীতা আবার সময় দেখে নিল। ১ মিনিটের মাথায় সাদাফ একটা বাইক নিয়ে ফিরে এলো।
পরিণীতা বাইকটা দেখে হা হয়ে গেল! সে দ্রুত কাছে গিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলল, “এটা তো বড় দাদান-এর! এটা এনেছেন কেন?”
সাদাফ শীতল দৃষ্টিতে পরিণীতার দিকে তাকালো। বাইকে বসে হেলমেট পরতে পরতে বলল, “আমি সব কিছু নিয়ে গেলে ও প্রণয় কিছুই বলবে না। এখন যটপট উঠে বসো!”
পরিণীতা এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো, ওকে এখন তাড়াতাড়ি কলেজে পৌঁছাতে হবে।
পরিণীতা বসতেই বাইকটা চোখের পলকেই শিকদার বাড়ির গেট পেরিয়ে গেল!
শুদ্ধর ফোন তখন থেকে বেজেই চলেছে, কিন্তু শুদ্ধ দেখার সময় পাচ্ছে না। শুদ্ধ নিজেই কেবিনেই বসে ছিল। এমন সময় নার্স আখি এসে উত্তেজিত কণ্ঠে জানালেন,
“স্যার, খুবই ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট এসেছে! ডক্টর রেজা আপনাকে ডাকছেন।”
শুদ্ধ গিয়ে চেকাপ করে দেখল, পরিস্থিতি অনেকটাই হাতের বাইরে চলে গেছে। সে দ্রুত নিজের স্পেশাল ১০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট আর কিছু ডাক্তার-নার্সকে নির্দেশ দিয়ে বলল,
“১০ মিনিটের মধ্যে ওটি রেডি করো, quick! এখুনি ওপেন সার্জারি না করলে, উনি এখানেই মারা যাবেন সে কেবিনের বাহিরে পা রাখতেই!”
পেশেন্টের মা দূর থেকে ছুটে এসে শুদ্ধর পায়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন,
“ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলে বাঁচবে তো? ডাক্তার সাহেব, ওর কী হয়েছে? ডাক্তার সাহেব, আমার ভালো ছেলেটা বাড়ি থেকে গেল, হঠাৎ ওর কী হলো?”
শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভদ্রমহিলার অন্য দুই ছেলে-মেয়ে এসে তাঁকে ধরে সরালেন। শুদ্ধ রোগীর বাবার উদ্দেশ্যে খুবই ফরমালভাবে বলল,
“ওনার হৃদপিণ্ডের প্রধান ধমনী অর্টা ছিঁড়ে গেছে। উনি বহুদিন ধরেই হৃদরোগে ভুগছিলেন। আপনি তো ওনার লিগ্যাল গার্ডিয়ান, আপনাকে রিসেপশনে গিয়ে একটা ফর্ম ফিল আপ করে অনুমতি স্বাক্ষর করতে হবে, তবেই আমরা অপারেশন শুরু করতে পারব। আর হ্যাঁ, কাজটা দ্রুত করলে ভালো হয়, উনার অবস্থা ভালো না।”
ভদ্রলোকের পা কেঁপে উঠল, চোখের কোণে পানি চলে এল। শুদ্ধর একটু খারাপ লাগলেও সে এসব দৃশ্যে অভ্যস্ত। সে নিজের কেবিনের দিকে চলে গেল।
কেবিনে পা রাখতেই ওর ফোন বেজে উঠল। তীব্র বিরক্ত হলো শুদ্ধ। দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে উক্ত নম্বর দেখে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভারী সুর ভেসে এল,
“কোথায় থাকো? হ্যাঁ, তখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি! ফোন ধরতে পারো না?”
শুদ্ধ চরম রেগে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
“আমি আপনার মতো গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই না! আপনাদের যেমন অর্ডার দিলেই হয়ে যায়, আমার আবার সেই ফিচারটা নেই! এখন ব্যস্ত আছি, রাখুন ফোন!”
ওপাশের লোকটি বেশ রেগে গেল, অথচ ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
“তোমার সঙ্গে ইম্পরট্যান্ট দরকার আছে, দেখা করো।”
শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“অপতত ছয় ঘণ্টার মধ্যে দেখা করা সম্ভব নয়।”
লোকটি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল,
“ঠিক আছে, বিকেল ৪টায় হাসপাতালের পাশের ক্যাফেতে ওয়েট করব।”
শুদ্ধ ছোট করে বলল,
“ওকে।”
বলেই ফোন কেটে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
সাদাফ পরিণীতাকে সময়ের পাঁচ মিনিট আগেই কলেজে নিয়ে এসেছে। কলেজের পার্কিং লটে বাইক পার্ক করে নেমে পড়লো দু’জন। পরিণীতা সময় দেখে নিয়ে দৌড় দিতে নিলেই পেছন থেকে সাদাফ ওর বাঁ হাতটা খপ করে ধরে ফেললো। পদযুগল থেমে গেল পরিণীতার। সে পেছন ফিরে সাদাফের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
সাদাফ বাঁকা হেসে পিঞ্চ মেরে বললো, “আচ্ছা, তোমরা ভাই-বোন এমন কেন?”
ভাই নিয়ে খোঁটা কানে আসতেই পরিণীতার ভ্রু কুঁচকে গেল।
সাদাফ আবার বললো, “তোমার ভাই যেমন কোনো দিন কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না, তেমন দেখছি তুমিও সেম ক্ষেতের মুলা।”
পরিণীতা কপাল কুঁচকে বলল, “এ্যা,!”
সাদাফ ওর কপালে টোকা দিয়ে বলল, “এ্যা নয় হে! এই যে তোমাকে সময়ের আগে পৌঁছে দিলাম, তার বদলে আমি কী পেলাম? আজ আমি না থাকলে কী হতো, বলো তো! অথচ তুমি কিছু না বলেই চলে যাচ্ছো। এটলিস্ট একটা থ্যাঙ্ক ইউ তো দিতেই পারতে।”
সাদাফ একটু অভিমানের ভান করলো। পরিণীতার কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল। সে এগিয়ে এসে মিষ্টি হেসে সাদাফের উদ্দেশে বললো, “থ্যাংক ইউ, ভাইয়া! এখন আমি আসি।”
বলে আর সাদাফের জবাবের অপেক্ষা করল না, দৌড় দিল।
কিন্তু পরিণীতার প্রতিধানের মিষ্টি হাসি সাদাফের বক্ষে ভালোবাসার প্রশান্তিময় বাতাস বইয়ে দিল সে হেসে বিড়বিড় করে বলল এভাবে হাসতে হয় না পাগলী।
তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকল দৃশ্য কেউ একজন অবলোকন করলো। সাদাফের হাতে পরিণীতার হাত দেখতেই তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল। ক্রোধ ছড়িয়ে পড়লো তার সর্বকায়ায়। সে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।
পরিণীতা পরীক্ষা হলে ঢুকেই ছুটে গিয়ে পূর্ণতার পাশে বসল। আর ৩ মিনিট পর থেকেই পরীক্ষা শুরু হবে।
পূর্ণতা পরিণীতাকে দেখে ঝাড়ি মেরে বললো, “আরেকটু পরে আসলেও ভালো করতি! হয়তো তোর কল্যাণার্থে পরীক্ষা টাইম আরো ১ ঘণ্টা পিছিয়ে গেছে।”
এতো তাড়াহুড়ো করে আসার পর এমন কথা শুনে পরিণীতা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না!
এত তাড়াহুড়ো করে আকাশ-পাতাল এক করে, না খেয়ে এসেছে সে—এই বালের পরীক্ষা দেবে বলে! এখন সে কনফিউজড—পরে হবে শুনে খুশি হবে, নাকি এত মেহনত পানিতে গেল বলে দুঃখ পাবে—বুঝতে পারল না পরিণীতা। যাই হোক, সে পূর্ণতার সাথে আড্ডা দিতে শুরু করল।
এমন সময় সাবিহা আর অনিমা দৌড়ে এসে পরিণীতার পাশে বসে হাঁপাতে লাগল। পরপর আনিশা আর আইরিনও এসে ধপাধপ ওদের পাশে বসে পড়ল। পরিণীতা আর পূর্ণতা চোখ ছোট ছোট করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “তোদের কি পাগলা কুত্তা তাড়া করেছিল?”
পরিণীতা হেসে বলল, “নানা, পাগলা ষাড় কেউ পিছনে ছেড়ে দিয়েছিল!”
ওরা চারজন ওদের দিকে কটমট করে তাকালো।
ওদের তাকানো দেখে ভয় পাওয়া তো দূর, দুই বান্ধবী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
আনিশা ওদের ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর, বেয়াদব দুটো!”
পরিণীতা আর পূর্ণতা থেমে গেল।
আনিশা লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করে বলল, “I’m in love!”
পরিণীতা আর পূর্ণতার চোখ বড় বড় হয়ে গেল! সাথে সাথে বাকি ৩ জন চিৎকার করে বলল, “Same! বান্ধবী, আমরা ও!”
পরিণীতা আর পূর্ণতা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। পুনরায় ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল।
পূর্ণতা হাসতে হাসতে বলল, “তোদের আর সাদাত স্যারের পাতলা পায়খানার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই! যখন-তখন ছুটে…”
পরিণিতা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে! কিন্তু হঠাৎ সে হাসি থামিয়ে আনিশার দিকে তাকিয়ে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে বলল, “কিন্তু তুই তো ওদের মতো না! তোর কী হলো?”
অনিশা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “তখন থেকে তো সেটাই বলার চেষ্টা করছি! তোরা আর শুনছিস কোথায়?”
এবার পরিণিতা আর পূর্ণতা সিরিয়াস হয়ে বসলো। পূর্ণতা বলল, “কে সে? বল! কাকে দেখে তোরা এত লাট্টু হয়ে গেলি?”
আইরিন বলল, “He is damn handsome! Jhataka aisa laga to dil garden garden ho gaya! তুইও একবার দেখলেই ফিদা হয়ে যাবি! কলেজের সব মেয়েরাই প্রায় লাট্টু হয়ে গেছে!”
পরিণিতার ভ্রু কুঁচকে গেল। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কে সে?”
আইরিন আগের চেয়েও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল, “আমাদের নতুন ম্যাথসের প্রফেসর, এ. আর. স্যার!”
পূর্ণতা আবার বলল, “নতুন যে স্যার এসেছেন?”
ওরা মাথা নেড়ে বলল, “হুম!”
ওরা সবাই পরিণিতা আর পূর্ণতাকে জোর করে ধরে নিয়ে চলল স্যারের এক ঝলক দেখানোর জন্য।
পূর্ণতার মনে হালকা কৌতূহল কাজ করলেও পরিণিতা বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট দেখালো না।
আইরিন বলল, “তুই বসে আছিস কেন? চল না!”
পরিণিতা সাফ জানিয়ে দিল, “I am not interested! স্যার যখন আছেন, তখন কখনো না কখনো ঠিকই দেখা হবে। এত এক্সাইটেড হওয়ার কিছু নেই!”
ওরা হতাশ হলো! পরিণিতাকে রেখেই চলে গেল নতুন ক্রাশকে দেখাতে!
পরিণিতা মনে মনে হেসে বলল, Miss you, মাস্টারমশাই!
আর দুই মিনিট পর থেকেই পরীক্ষা শুরু হবে! কলেজের সবাই ফোন, স্মার্টওয়াচ, আর যা যা ডিভাইস ছিল, সব কিছু বাইরে রেখে এসে বসে পড়ল।
পরিণীতা আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে মনে করার চেষ্টা করছিল, আবিদ ওকে কীভাবে কী করিয়েছে। কিন্তু হায়! আফসোস! পরিণীতার মনে হলো, ফোন, ব্যাগের সাথে সাথে ব্রেনটাও বোধহয় বাইরে ফেলে এসেছে।
সে রেগে ম্যাথসকে গালি দিয়ে বলল, “ছিহ! এসব ধরাধরি, করাকরি আর কতদিন করতে হবে, মাবুদ জানে!”
ও পেছনের বেঞ্চে বসেছে পূর্ণতা। পরিণীতা মাথাটা একটু পেছিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “প্লিজ বান্ধবী, বাঁচিয়ে নিস!”
পূর্ণতা ওর মাথায় গাট্টা মেরে বলল, “গাধা!”
পরিণীতা মাথা ডলতে ডলতে সামনে তাকাতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মুখ আপনাআপনি হাঁ হয়ে গেছে। শুধু পরিণীতা নয়, পুরো ক্লাসের মেয়েরাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে!
ফর্মাল হোয়াইট শার্টের সাথে ফর্মাল ব্ল্যাক প্যান্ট পরেছেন। হাতে ব্ল্যাক বেল্টের ঘড়ি। শার্টের হাতা কনুই অবধি গুটানো। লম্বাটে সুদর্শন দেহে সাদা রংটা অত্যধিক সুন্দর মানিয়েছে। শ্যামসুন্দর মুখশ্রিতে প্রখর গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্বের চাপ স্পষ্ট।
চিত্রলেখা মেম নতুন স্যার কে স্টুডেন্টদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন-
ইনি তোমাদের ম্যাথসের নতুন লেকচারার আবিদ রাফাত স্যার।
ছাত্রীরা মনে হয় বেজার খুশি হল। আলাপ আলোচনা শেষে।
আবিদ স্টুডেন্টদের দিকে তাকিয়ে সাবলীল গলায় বলল—
“Students, now, for the next two hours, please maintain silence unless absolutely necessary. If you need anything, let us know. Avoid unnecessary conversations and help create a peaceful environment for the exam.”
মেয়েরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁ করে শুনছিল আবিদের কথা। আবিদের ভারী, পুরুষালি কণ্ঠে পরিণীতার ঘোর ভাঙল। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, প্রায় সব মেয়েরাই যেন গিলে খাওয়ার ভঙ্গিতে হাঁ করে তাকিয়ে আছে!
পরিণীতা আবিদের দিকে তাকিয়ে দেখল, আবিদ একদম স্বাভাবিক…
ভঙ্গিতেই পেপার ডিস্ট্রিবিউট করছে। সে পাশের চিত্রলেখা ম্যামের দিকে তাকালো। তিনিও ওকে দেখে খনে খনেই ব্লাশ করছেন! পরিণীতার মুহূর্তেই মনে হলো, সে কোনো গরম কড়াইয়ের ওপর বসে আছে! অজানা আশঙ্কায় আর ভয়ে হৃদপিণ্ড শুকিয়ে গেল। অথচ, তার মাস্টার মশাই একবারও তার দিকে তাকাচ্ছেন না পর্যন্ত! পরিণীতা এমনিতেই কিছু পারে না, আর এখন তো আরো সবকিছু ভুলে গেল!
পরিণীতার মনে পড়ল তখন বান্ধবীদের বলা কথা! ওরা তবে আমার মাস্টার মশাইয়ের কথাই বলছিল! তিনি বলেছিলেন, তিনি চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু, কিসের চাকরি জিজ্ঞেস করেনি পরিণীতা!
চিত্রলেখা পরিণীতাকে পেপার দিতে গিয়ে নোটিশ করলেন, পরিণীতা আনমনে কী যেন ভাবছে। তিনি পরিণীতাকে ডাকলেন—
“পরিণীতা! পরিণীতা! পরিণীতা!”
পরিণীতা দড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ইয়েস, ম্যাম!”
চিত্রলেখা রাগী গলায় বললেন, “এসব কী, পরিণীতা?”
পরিণীতা মাথা নিচু করে বলল, “সরি, ম্যাম!”
চিত্রলেখা তাকে পেপার দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বললেন, “সিট ডাউন।”
এতক্ষণ ওর দিকে অনেকেই তাকিয়ে ছিল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবিদও তাকিয়েছে! ওদের এক্সাম স্টার্ট হয়ে গেল। কিছু মেয়ে লিখছে, আর কিছু মেয়ে স্যারকে দেখছে! কেউ দেখছে, ওহ লিখছে ওহ!
আবিদ আর চিত্রলেখা হলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে গার্ড দিচ্ছে। চিত্রলেখা আবিদের সাথে বেশি বেশি কথা বলার চেষ্টা করছে! পরিণীতা সবই লক্ষ্য করছে, তার কিছুতেই লেখায় মন বসছে না!
পরিণীতা দেখল, চিত্রলেখা ম্যাম একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন! লিটারেলি, পরিণীতার কান্না পেয়ে যাচ্ছে! কেউ তার মাস্টার মশাইয়ের সাথে এত ঘেঁষাঘেঁষি করার চেষ্টা করছে—এটা তার মোটেও হজম হচ্ছে না, আর মাস্টার মশাইও কিছু বলছেন না!
পরিণীতা মাথা নিচু করতেই ‘টুপ’ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল পেপারে!
পূর্ণতা চুপিচুপি একটা শিট এগিয়ে দিয়ে বলল, “যা পারিস, তারাতাড়ি টুকে ফেল, নাহলে ফেল করবি, গাধা!”
পরিণীতার মোটেও ইচ্ছে ছিল না, তবুও ও চুপিচুপি কয়েকটা তুলে নিল। পূর্ণতাকে ওর পেজ ফিরিয়ে দিল।
দুই ঘণ্টা পেরোতেই ঘণ্টা বেজে উঠল। সাথে সাথেই আবিদ আর চিত্রলেখা সব পেপার কালেক্ট করতে শুরু করল! এক্সাম শেষ, তাই সকলে বেরিয়ে যাচ্ছে!
চিত্রলেখা বড় এক বান্ডিল পেপার নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলুন, স্যার!”
আবিদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “আপনি যান, আসছি আমি।”
চিত্রলেখা লাজুক হেসে বলল, “ওকে, স্যার!”
এক এক করে সবাই হল থেকে বেরিয়ে গেছে। শেষে তিনজন ছিল, তারাও বেরিয়ে গেল…
শুধু পরিনিতা যায়নি। সবাই যেতেই পরিনিতা ছুটে গিয়ে আবিদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বে বে করে কেঁদে উঠল।
আবিদ হেসে পরিনিতার চুলে হাত রাখল। ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“কি হয়েছে, আমার অ্যাঞ্জেলের?”
পরিনিতা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। আবিদ পরিনিতাকে কোলে তুলে টেবিলের উপর বসিয়ে দিল। নরম গাল বেয়ে পড়া পানি আলতো হাতে মুছে দিয়ে শুধাল,
“কষ্ট পেয়েছো?”
পরিনিতা আবারও শক্ত করে ঝাঁপটে ধরে নিচু কণ্ঠে ধীরে বলল,
“হুঁ।”
আবিদ পরিনিতার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”
পরিনিতা কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে অনুনয় করে বলল,
“প্লিজ, কারো দিকে তাকাবেন না, মাস্টার মশাই। ওদের দৃষ্টি ভালো না!”
আবিদ ঠোঁট কামড়ে হাসল। পরিনিতার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদুরে স্বরে বলল,
“যেখানে আমার কাছে আমার পরী ব্যতীত পৃথিবীর অন্য সকল নারী অদৃশ্য, সেখানে তাকানোর প্রশ্নই বৃথা!”
পরিনিতা লজ্জা পেল। সে আবিদের গলার কাছ থেকে শার্টটা একটু নামিয়ে সেখানে দাঁত দিয়ে গভীর ক্ষত করে দিয়ে বলল,
“এটা আমার চিহ্ন, যা আপনাকে সব সময় মনে করাবে—আপনি একান্তই আমার! এটা মিটে গেলে আবার করে দেবো।”
আবিদ মৃদু হাসল।
মিনিট দুই পরে বলল, “এবার ছাড়ো!”
পরিনিতা ছাড়তে না চাইলে, ও ছেড়ে দিল। সে চলেই যাচ্ছিল, হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় থেমে গেল। পরিনিতার চোখে চোখ রেখে শান্ত কণ্ঠে হুমকি দিয়ে বলল,
“ওই ছেলেটার আশেপাশে যেন তোমাকে আর না দেখি!”
পরিনিতা অবাক হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“কোনো ছেলে?”
আবিদ কণ্ঠ শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও তাতে স্পষ্ট তেজের আভাস পাওয়া গেল। সে আগের মতোই বলল,
“যার সাথে এসেছো!”
পরিনিতার ভ্রু আরও খানিকটা কুঁচকে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“সাদাফ ভাই??”
আবিদ পরিনিতার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে আস্তে করে বলল,
“নিজের ভাই ছাড়া পৃথিবীর কোনো ভাই, ভাই হয় না জান! তোমাকে না বলেছি মানে না। নেক্সট টাইম ওই লোকটার সাথে বা আশেপাশে দেখলে তোমার অবস্থা দেখার অবস্থা রাখবো না!”
বলেই পরিনিতার নিচের ঠোঁটে হালকা কামড় বসিয়ে বলল,
“তুমি তো সিল মেরে দিয়েছো, এখন কি আমারও সিল মেরে দেওয়া উচিত নয়?”
আবিদের কথার ধরন দেখে পরিনিতার চোখ গোল গোল হয়ে গেল। আবিদ ঠোঁট কামড়ে হেসে পরিনিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে স্লো ভয়েসে বলল,
“না থাক! তুমি ব্যথা পাবে। আমি তোমাকে এখনই ব্যথা দিতে চাই না!”
বলে, বাকি অর্ধেক পেপার নিয়ে চলে গেল।
পরিনিতা হাঁ করে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, “কি বললেন উনি!”
পরিনিতা দুই হাতে মুখ ঢেকে বলল,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৫
“উফফ! কি লজ্জা!”
তারপর চুড়িদারের গলাটা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নিল। সেখান থেকে মেনলি একটা সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। লজ্জায় পরিনিতার গাল লাল লাল হয়ে গেল।