ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩১

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩১
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

রাত ১২টা বেজে ৩৫। প্রণয় আর প্রিয়তা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হাসপাতালের রুমগুলো সাউন্ডপ্রুফ হওয়ার দরুন বাইরের কোনো শব্দই ভেতর থেকে তেমন শোনা যায় না। কালকের মতো আজও প্রণয় প্রিয়তাকে বুকে জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় ডুবে আছে।
এমন সময় কারো জোরালো ডাকাডাকিতে প্রণয়ের ঘুম হালকা হয়ে গেল। শব্দের তীব্রতা আরও বাড়তেই ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো প্রণয়। চোখ মেলে ঝাপসা চোখে সামনে তাকিয়ে দেখলো—জাভেদ আতঙ্কিত চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
জাভেদ আবার উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,

— “স্যার, আর শুয়ে থাকবেন না, উঠে পড়ুন তাড়াতাড়ি!”
প্রণয়ের ঘুমের রেশ পুরোপুরি কেটে গেল। প্রিয়তাও এমন ডাকাডাকিতে উঠে পড়েছে, তবে তার মস্তিষ্ক এখনো জিমাচ্ছে। প্রণয় বিরক্ত কণ্ঠে জাভেদকে ধমক দিয়ে বললো,
— “কি সমস্যা, জাভেদ? এত রাতে এমন ডাকাডাকি করছো কেন? হাসপাতালে কি ডাকাত পড়েছে?”
ভয়ে জাভেদের কপাল বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ছুটছে। এতক্ষণে প্রিয়তাও কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো জাভেদের দিকে। জাভেদ পুনরায় বললো,
— “স্যার, আপনি এখুনি আপুকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালান, না হলে অনেক বড় বিপদে পড়বেন।”
ভ্রু কুঁচকে গেল প্রণয়ের। অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “কেন?”
জাভেদ তাড়াহুড়ো করে বললো,
— “এত কথা বলার সময় নেই, স্যার। ওরা যখন-তখন এখানে চলে আসবে। সবাই যেদিক পারছে, সেদিকেই পালাচ্ছে!”
প্রণয় কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না। প্রিয়তা কৌতূহলী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
— “কারা?”
জাভেদ বললো,

— “স্যার, হাসপাতালে টেরোরিস্ট অ্যাটাক হয়েছে। এখানে সিক্রেটলি মন্ত্রিসাহেব ভর্তি ছিলেন, কিন্তু সে কথা কীভাবে যেন লিক হয়ে গেছে। ওরা হাসপাতাল অ্যাটাক করেছে। মন্ত্রী সাহেবের নিরাপত্তা বাহিনী আর কিছু পুলিশ ছিল। যেহেতু বিষয়টা খুবই সিক্রেট ভাবে ছিল, তাই তেমন একটা সিকিউরিটি ছিল না। তাই ওরা সন্ত্রাসীদের সাথে পেরে উঠছে না। সন্ত্রাসীরা সংখ্যায় অনেক। ওদের হাতে পড়লে, আপু মারাত্মক বিপদে পড়তে পারে।”
প্রণয় চেচিয়ে বললো,
— “হোয়াট? টেরোরিস্ট?”
টেরোরিস্টদের কথাটা কানে আসতেই ভয়ে প্রিয়তার শরীর জমে গেল। সে শক্ত করে চেপে ধরলো প্রণয়ের বাহু। প্রণয় উত্তেজিত হয়ে গেল,

— “শিট!”
সে দ্রুত হাতে রক্তের ক্যানুলাটা টেনে খুলে ফেললো। আবারো হাতে শিরা বেয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগলো। প্রিয়তা আর্তনাদ করে প্রণয়ের হাত চেপে ধরল। একটু তেজি গলায় বললো,
— “বারবার এটা খুলে ফেলেন কেন আপনি?”
প্রণয় তার কথা কানে তুললো না, দ্রুত তার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো।
— “আরে, রক্ত পড়ছে তো, প্রণয় ভাই!”
প্রণয় ধমক দিয়ে বললো,
— “একদম বেশি কথা বলবি না, চুপচাপ চল আমার সঙ্গে! নাহলে এখানেই ফেলে রেখে যাবো!”
প্রিয়তা যেহেতু এখন টেরোরিস্টদের চোখে দেখে নাই, তাই সত্যি বলতে ওর অতটাও ভয় করছে না। ওরা ক্যাবিনের বাইরে পা রাখতেই গুলির আওয়াজ কানে এলো। ভয়ে লাফিয়ে উঠলো প্রিয়তা। প্রণয়ের হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলো।
জাভেদ বললো,

— “ওরা সেকেন্ড ফ্লোরে ভাঙচুর করছে, মনে হচ্ছে। এখনই এখানে উঠে আসবে। স্যার, আপনি তাড়াতাড়ি যান।”
প্রণয় প্রিয়তার হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে করিডোরের উল্টো দিকে ছুটে গেল। যেতে যেতে জাভেদকে বলল,
— “ফাস্ট, গার্ডদের কল করো!”
জাভেদ দ্রুত সিকিউরিটি নম্বরে ফোন করল। প্রিয়তার ভীষণ ভয় করছে, আবার করছে না ও—কারণ সবাই জানে, প্রণয় ভাইয়ের সঙ্গে থাকলে ওর আবার এত ভয়-ডর করে না! হালকা ভয়, হালকা উত্তেজনার সাথে ওর কেমন বাড়ি থেকে প্রণয় ভাইয়ের হাত ধরে পালানোর মতো ফিল হচ্ছে—ব্যাপারটা থ্রিলিং।
ছুটতে ছুটতে প্রণয় প্রিয়তাকে উদ্দেশ করে বলল,

— “তারাতারি চল, জান! ওরা উপরে চলে এসেছে… আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে।”
প্রিয়তা শুধু মাথা নেড়ে প্রণয়ের সঙ্গে পা মেলাল।তারা করিডোরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল। চিৎকার আর গুলির শব্দ এখন আরও কাছ থেকে আসছে। ভয় পেয়ে গেল প্রিয়তা। প্রণয় চারপাশে তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল। হঠাৎ করিডোরের বাঁ পাশে ছোট্ট একটা লাল আলোয় দেখতে পেল—‘EMERGENCY EXIT’ লেখা বোর্ডটা অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ল।
সে প্রিয়তাকে নিয়ে এগিয়ে গেল সেই দরজার দিকে। চিৎকার আর গুলির শব্দ আরও তীব্র—এখন বোধহয় করিডোর থেকেই আসছে।
দরজাটা ঠেলে তারা ঢুকে পড়ল ফায়ার এক্সিট সিঁড়িতে। ধাতব সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে নিজের পায়ের শব্দ যেন নিজেদেরকেই ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। ঠিক তখনই ওপরে ভেসে এলো গলার আওয়াজ—

— “চেক দ্যাট সাইড!”
চমকে উঠল প্রিয়তা, থেমে গেল তার পদযুগল। হাতে টান লাগাতেই থেমে গেল প্রণয়ও। পেছন ফিরে প্রিয়তার ভয়ার্ত চোখে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল প্রণয়। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে প্রিয়তাকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে এক খানা নরম চুমু খেয়ে ভরসা দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “ভয় পাস না, জান। আমি আছি তো। আমি থাকতে তোকে কিচ্ছু হতে দেব না, প্রমিস।”
প্রিয়তা অশ্রুসজল চোখে প্রণয়ের দিকে তাকাল আর ভয় পেল না। প্রণয় ভাই পাশে থাকলে জাহান্নামের আগুনকেও ভয় করে না সে। তারা দ্রুত নেমে গেল গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
নিচের করিডোরের অবস্থা বিভৎস—চারদিকে সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে আছে। সামনে এক পা বাড়াতেই তাদের চোখ পড়ল পুলিশের পোশাক পরিহিত চারটা রক্তমাখা মৃতদেহের উপর। তাদের রক্তে ফ্লোর বেসে যাচ্ছে,, এই দৃশ্য নজরে আসতেই চমকে উঠে আপনা-আপনি চিৎকার দিয়ে ফেলল প্রিয়তা। সঙ্গে সঙ্গে প্রণয় ওর মুখ চেপে ধরে পাশের রুমে ঢুকে পড়ল।

ভয়ে প্রিয়তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। প্রণয় প্রিয়তার ভয়ার্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ওর মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। আতঙ্কিত প্রিয়তা নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রণয়ের পিঠ।
প্রণয় কিছু বলবে, তার আগেই দুজন ব্যক্তি ধপ করে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ল। আরও ভয় পেয়ে গেল প্রিয়তা। সঙ্গে সঙ্গে প্রণয় আবার ওর মুখ চেপে ধরল। লোক দুটি ঘরে ঢুকে আশেপাশে খুঁজতে লাগল।
প্রথম লোকটি দ্বিতীয় লোকটিকে বলল,

— “কিসি কি আওয়াজ সুনি।”
দ্বিতীয় লোকটা বলল,
— “হাঁ, সুনা তো… লেকিন ইয়াহাঁ তো কোই নেহি হ্যায়!”
প্রথম লোকটা বলল,
— “নিশ্চিত হ্যায়, ইয়াহাঁ কোই না কোই তো জারুর হ্যায়। আওয়াজ তো একদম পাস সে আ রাহা থা।”
দ্বিতীয় লোকটা বলল,
— “তো ফির মিল কে কিউঁ নেহি রাহা হ্যায়?”
প্রথম লোকটা বলল,
— “আচ্ছে সে দেখ… শায়দ কিসি কোণে মে হো।”
দ্বিতীয় লোকটা বলল,
— “লগতা হ্যায়, ইয়াহাঁ নেহি হ্যায়। আগে দেখকে চল।”
বলে লোক দুটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

প্রিয়তার ছোট্ট দেহটা প্রণয়ের বুকের মাঝে থেকেও কেঁপে উঠছে। প্রণয় হৃদস্পন্দনের তীব্র ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। ভয় যে তার করছে না, এমনটা নয়। সব থেকে বেশি ভয় তো তারই—নিজের জানের ভয় নয়, এই সন্ত্রাসীদের হাতে যদি পড়ে, তবে তার রক্তজবার কী পরিণতি হবে?
প্রিয়তা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। প্রণয় প্রিয়তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
— “শ্… কিছু হয়নি, ওরা চলে গেছে।”
প্রিয়তা এখনও কাঁপছে। প্রণয় ওকে আবারও বলল,
— “যদি বাইরে অপ্রীতিকর কিছু দেখিস, সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের দিকে তাকাবি। মনে থাকবে?”
প্রিয়তা কেবল মাথা দোলাল।

সে আরও শক্ত করে প্রণয়ের বুকে মাথা রাখল। প্রণয় উঁকি দিয়ে বাইরে দেখল—কয়েকজন কালো পোশাক পরিহিত, মুখ বাঁধা লোক উপরের দিকে যাচ্ছে, হাতে AK-47 রাইফেল। উপরতলা থেকে মেয়েদের চিৎকার ভেসে আসছে।
পুলিশ আছে, তবে সংখ্যায় কম। আর বিষয়টা মনে হচ্ছে এখনো তেমন কেউ জানে না। জানলেও এখনো আসতে পারেনি সবকিছুতেই তো সময় লাগে ওদের । এখানে বেশি সময় থাকা মানেই ঘোর বিপদ।
প্রণয় প্রিয়তাকে নিয়ে ধীর পায়ে করিডোরের ডান দিকে ঘুরে গেল। কিছুটা দূরে এগোতেই দেখতে পেল একটা পুরনো স্টোররুম। পাশেই একটা সার্ভিস করিডোর। তারা সন্তর্পণে সেই করিডোর ধরে এগোতে লাগল।
করিডোরটা ধোঁয়ায় অন্ধকার… আরেকটু এগিয়ে যেতেই—

তারা করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট লোহার দরজা দেখল। দরজার ওপারে হাসপাতালের পেছনের লোডিং জোন। প্রণয় দরজাটা একটু সাবধানে খুলল। বাইরে হাসপাতালের পেছনের এলাকা দেখা যাচ্ছে—এক পাশে পুরনো জেনারেটর, আর তার পেছনে গাঢ় সবুজে ঢাকা জঙ্গল।
প্রণয় দরজা ঠেলে বাইরে পা রাখতেই মুহূর্তেই থমকে গেলো। বাইরের তীব্র বেগে বাতাস বইছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোধহয় তীব্র ঝড়বৃষ্টি শুরু হবে।
দূরে সন্ত্রাসীরা মন্ত্রিসাহেবকে গাড়িতে উঠাচ্ছে। সাথে বেশ কিছু যুবতী মেয়ে ও নারী—তাদের সাথে যে কী করবে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না! যে ক’জন পুলিশ নিরাপত্তায় ছিল, সবাইকে হয়তো মেরে ফেলেছে।
সন্ত্রাসীরা তাদের দেখতে পেল না, কারণ তারা অনেকটা দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রণয় প্রিয়তার হাত শক্ত করে ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

— “চল, এখান থেকে।”
কিন্তু প্রিয়তা নড়ল না। তার ভীষণ মায়া হচ্ছে মেয়েগুলোর উপর। সে নরম কণ্ঠে বলল,
— “ওদের ফেলে চলে যাবো প্রণয় ভাই? ওদের তো অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। ওদেরকে বাঁচানো যায় না? প্রণয় ভাই, আমরা স্বার্থপরের মতো পালাবো?”
প্রণয় শান্ত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
— “এখানে আমাদের কিছু করার নেই, জান। সব জায়গায় জোর খাটে না। আর আমাদের এখন জোরও নেই। ওরা যদি আমাদেরকে দেখে ফেলে, আমাদের অবস্থাও ওদের মতোই হবে। আমরা এখন কিছু করতে পারবো না। সব জায়গায় বাহাদুরি দেখাতে হয় না, কিছু কিছু জায়গায় পালাতে হয়।”
প্রিয়তা করুন চোখে তাকালো। হঠাৎ কিছু কথা তাদের কানে এলো—

— “এই বস! দেখ তো, কিতনা খুবসুরত লড়কি! এতনা খুবসুরত লড়কি তো ম্যায় মেরে এতনে সালো কি উমর মে একবার ভি নাহি দেখ, কভি নাহি দেখা!”
প্রণয় আর প্রিয়তা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার থেকে কিছুটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল দু’জন। তারা মূলত পুরো ব্যাপারটা কন্ট্রোল করছিল। কালো পোশাক পরিহিত, অন্ধকার রাত—তাই কিচ্ছু দেখার উপায় নেই। তবে কালো আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য সদৃশ্য হচ্ছে।
লোকটা কথায় তাদের বস বাজ পাখির ন্যায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকালো। ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চমকালো। সেই বিদ্যুতের সাদা আলোতে প্রিয়তার মায়াময় চেহারা দৃশ্যমান হলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। প্রিয়তার সুশ্রী মুখ নজরে আটকাতেই লোকটার চোখের আগুন ঠান্ডা হয়ে গেল, মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে এলো—

— “মাশাআল্লাহ!”
পাশের লোকটা আবার বলল,
— “ইয়া আল্লাহ, মাশাআল্লাহ! এতনা খুবসুরত! উসকো তো হামারি ভাবি বননা চাহিয়ে! কেয়া গেহরা নীলা নীলা আঁখে, উসকা বাল দেখ তো, লম্বি ঔর খুবসুরত! উসকা চেহরা দেখ, কিতনা মাসুম! বাহ! ইস জ্যায়সা লড়কি তো হামারা ভাবি বননে কে লায়ক হ্যায়, বস!”
ওদের বলা কথাগুলো কানে আসতেই প্রণয়ের হৃদপিণ্ড ছলকে উঠল, ঘাবড়ে গেল প্রিয়তা।
ওদের দিকে না তাকিয়ে বিদ্যুৎবেগে প্রিয়তার হাত চেপে ধরে জঙ্গলের দিকে দৌড় দিল প্রণয়।
ছুটতে ছুটতে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
— “তারাতারি ছুট, জান! ওরা আমাদের দেখে ফেলেছে!”
লোক দুটো কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রণয় প্রিয়তার হাত ধরে দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল।
লোকটা হুংকার দিয়ে বলল,

— “পাকড় উসকো! মুঝে ও চাহিয়ে! চাহিয়ে! কিসি ভি वजह সে চাহিয়ে!”
প্রণয় আর প্রিয়তা প্রাণপণে ছুটছে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। পেছনে পেছনে বেশ কিছু সন্ত্রাসী তাড়া করছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকে যতটুকু দেখা যায়, বনলতায় শরীরে যত্রতত্র ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে হঠাৎ প্রিয়তা “উফ্‌!” বলে উঠে থমকে যায়। চমকে যায় প্রণয়ও। পা থেমে যায় তার।
ছুটে গিয়ে প্রিয়তার কাছে উত্তেজিত গলায় বলে উঠল,
— “কি হয়েছে, জান? কোথায় ব্যথা পেয়েছিস?”

প্রিয়তার চোখে পানি এসে গেছে। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা না গেলে ও প্রনয় বুঝতে পারল প্রিয়তা ব্যথা পেয়েছে। প্রিয়তা প্রায় কান্না করে দিচ্ছে। প্রণয় তাড়াহুড়ো করে ওর দুই গাল ধরে বলল, “কি হয়েছে? জান কোথায় ব্যথা পেয়েছিস? বল আমায়।”
প্রিয়তা প্রণয়ের হাত ধরে নিজের ডান হাতের উপর রাখল। তরল কিছু একটার আভাস পেতেই চমকে উঠল প্রণয়। পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে ঝটপট হাতে বেঁধে দিল। হাত টেনে ক্ষতস্থানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ধীর কণ্ঠে শুধালো, “বেশি ব্যথা করছে?”

প্রিয়তা উত্তর দেওয়ার আগেই সন্ত্রাসীদের পায়ের শব্দ একদম কাছে চলে এসেছে। প্রণয় প্রিয়তাকে টেনে নিয়ে পাশে একটা ঢিবির আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ঢিবিটা খুবই ছোট। ওরা দুজন লুকানোর চেষ্টা করলে সহজেই ওদের দেখে ফেলবে। ওদের হাতে টর্চ লাইট ও আছে।
প্রণয় নিজেদের মধ্যকার সব দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো। প্রিয়তাকে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরল নিজের সাথে। প্রিয়তার মনে হচ্ছে তার হাড়গোড় গুলো বোধ হয় গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল ,সে হয়তো এখনই দম আটকে মরে যাবে। সে প্রণয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— “আমাকে কি কমলা লেবু পেয়েছেন, প্রণয় ভাই? যে এভাবে চিপে চিপে জুস বের করছেন!”
প্রণয় ওকে নিজের সাথে চেপে ধরে সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে নজর ভোলাচ্ছিল। প্রিয়তার কথাগুলো কানে আসতে সে চোখ নামিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকালো। কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো।
সে ও একইভাবে প্রিয়তার গলার কাছে ঠোঁট নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “আমি চিপে জুস বের করলে তোর খারাপ লাগবে না? কিন্তু ওদের হাতে যদি তুই পড়িস, তবে কি হবে বল তো?”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকাল প্রণয়ের মুখের দিকে। প্রণয় আরও একটু চেপে ধরে বলল,

— “ওরা তোর সুন্দর তুলতুলে দেহটার সাথে কি করবে, তা তো ভালোই বুঝতে পারছিস। You know what I mean…”
প্রিয়তা গোলগাল চোখে তাকাল প্রণয়ের দিকে। ঢোঁক গিলল, মনে মনে বলল,
— “প্রণয় ভাই, এমন কথা ও বলতে জানেন? তবে কথাটা খুব একটা মন্দ বলেননি। ওদের হাতে ধরা পড়লে… ওরা তো সত্যিই তাই করবে।”
ভয়ে প্রিয়তার কলিজার পানি শুকিয়ে গেল। সে বিদ্যুৎ গতিতে প্রণয় ভাইয়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। প্রণয় গলায় একটু ব্যথা লাগল। সে হাতের বন্ধন একটু নরম করে বলল,
— “গলা চিপে মেরে ফেলবি মনে হচ্ছে!”
প্রিয়তা এবার দুই হাতে গলা হালকা চেপে ধরে বলল,
— “হে, মেরে ফেলব। আপনার কোনো সমস্যা?”
হাসল প্রণয়। প্রিয়তার গায়ের মাধকীয় গন্ধটা তীব্রভাবে নাকে এসে লাগছে। সে আসক্তি মিশ্রিত ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,

— “এতে লসটা কি আমার হবে…”
প্রণয়ের কথার ধরনে কিছু একটা ছিল, যা সোজা প্রিয়তার হৃদপিন্ডকে বিদ্ধ করেছে। প্রণয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে গলায়, ঘাড়ে। প্রিয়তার হঠাৎ কি যেন হলো। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে তীব্র এক নিষিদ্ধ বাসনা জেকে বসলো।
সে ভুলে গেলো ভালোবাসা যতই তৃষ্ণার্ত হোক না কেন, সে চাইলেই এই পুরুষকে ছুয়ে দিতে পারে না। এটা তার অধিকারের সীমার মধ্যে নেই, কিন্তু মন মানল না। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেওয়ার সময়ই পেল না।

মোহগ্রস্তের মতো ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিল প্রণয়ের গলায়। কাপা কাপা নরম আঙুলগুলো ছুঁয়ে ফেলল গলার সেই উঁচু হাড়টা, সেই অ্যাডামস অ্যাপলটা, যেটা প্রিয়তাকে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষিত করে। প্রণয়ের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। প্রিয়তা লক্ষ্য করলো, হঠাৎই প্রণয়ের হার্টবিট অনেক ফাস্ট হয়ে যাচ্ছে। তার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি প্রিয়তা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছেন। তার কেমন মাতাল মাতাল লাগছে। প্রণয়কে স্পর্শ করে সে নিজেই কেপে উঠছে।
প্রিয়তা এক হাত নামিয়ে আনল প্রণয়ের বুকে। কান পেতে শুনতে লাগল বুকের অস্থির হৃদস্পন্দন।

অন্য হাতে অনুভব করল প্রণয়ের গলার অ্যাডামস অ্যাপলটা নড়ে উঠল। প্রিয়তা ধীরে বুক থেকে মাথা তোলল, অতঃপর কোন সংকোচ ছাড়াই নিঃশব্দে, মুখ ডুবিয়ে দেয় প্রণয়ের গলায়। ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে থাকে তীব্র ভালোবাসায়, গভীর আসক্তিতে প্রতিটা স্পর্শের আলাদা আলাদা ভাষা রয়েছে যা হয়তো সেই পুরুষটা ছাড়া অন্য কেউ কখনো বুঝবে না। একের পর এক নরম চুমু এঁকে দেয় তার উষ্ণ ত্বকে।
অতঃপর নেশাতুর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে ওঠে—

— “আমার তো পুরো জীবনটাই লস… বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই। সেখানে ওই একটা লাভের আশায় তো বেচে আছি, ওখানে লস হলে আর বাঁচতে পারব না।”
প্রিয়তা কথাটা শেষ করার আগে তীব্র বিদ্যুৎ ঝলকে চারপাশ আলোকিত হলো। সেই সাদা আলোয় প্রিয়তার নজর আটকালো — একজোড়া গভীর নেশাগ্রস্ত গাঢ় বাদামি চোখে।
সাথে সাথেই চোখ আটকে গেল সেই নেশাগ্রস্ত চোখজোড়ায়, ওই চোখের তীর্যক চাউনি বুকের ভেতর তোলপাড় করতে শুরু করল। নিষিদ্ধ অনুভূতির জোয়ারে কিশোরী মন ভেসে যেতে চাচ্ছে।
মনের ভেতর প্রাণঘাতী অনুভূতিরা তোলপাড় করছে।
নিষিদ্ধ আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরতে ইচ্ছে হচ্ছে।

নিষিদ্ধ মানুষটার ভালোবাসা আজ অজানা কারণে খুব করে পেতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার উপর মানুষটার গায়ের মাতাল করা গন্ধ আর ঘায়েল করা দৃষ্টিতে প্রিয়তার সব সীমা ছাড়াতে ইচ্ছা করছে।
প্রিয়তার এমন ইচ্ছাকৃত, লাগামহীন স্পর্শে—
প্রণয়ের ভিতরে ছাইচাপা আগুনটা হঠাৎই ধক করে জ্বলে উঠল। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল।
তার চোখের মণি কেঁপে উঠল। শরীরের প্রতিটা স্নায়ুতে বিদ্যুৎ খেলে গেল, বুকের গভীরে জমে থাকা সবটুকু ধৈর্য এক মুহূর্তে টলমল করে উঠল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টায় সে ঢোক গিলে, মনে মনে বলল—
“কেন নিজের মৃত্যু কামনা করছো রক্তজবা? তুমি তো এতটা অবুঝ নও… তুমি কি জানো না, তোমার এই একেকটা কর্মকাণ্ডের ফলাফল ভয়ানক হবে?

এখন যদি ভুল কিছু হয়ে যায়…!
তুমি কেন এভাবে আমাকে উন্মাদ করে দিচ্ছো? এভাবে কাছে টেনো না আমায়… । আমি পারবো না নিজেকে থামাতে। তোমাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই আমার, আর কাছে টানার সামর্থ্য নেই আমার।
তোমাকে কাছে টেনে নেওয়া… আর শেষ করে দেওয়ার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। তুমি বুঝতে পারছো না কী করছো! নিষিদ্ধ আগুন থেকে দূরে পালাতে হয়, জান, ঝাঁপ দিতে হয় না।
তোমার উচিত নয়… একদম উচিত নয় এভাবে আমায় ছুঁয়ে দেওয়া। এভাবে নয়, রক্তজবা…!
আমি তোমায় বাঁধা দিতে পারব না। আর তুমি যদি এমন করতে থাকো… তবে একটু পর নিজেকে ও বাঁধা দিতে পারব না।”

দ্বিতীয়বার বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে প্রিয়তার নজর পড়লো প্রণয়ের অতিআকর্ষণীয় কালচে লাল ঠোঁটে। আরোও একটা ভয়ানক ইচ্ছা মাথা ছাড়া দিয়ে উঠলো, আপনা-আপনি হাত চলে গেল প্রনয়ের ঠোঁটে ।
প্রণয়ের ঠোঁটে হাত ছোয়াতেই প্রিয়তা ৪৪০ ভোল্টেজের ঝটকা খেল। নিষিদ্ধ ইচ্ছাটা মনের মধ্যে আরো বেশি করে ডালপালা মেলতে লাগলো। সে কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করতে পারল না।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩০

নিজের পদ্মলাল ঠোঁটজোড়া যত কাছে এগিয়ে নিচ্ছে, ততই বুকের ভেতর উতাল পাতাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। প্রণয়ের প্রত্যেকটা উষ্ণ নিঃশ্বাসের মাধকতা তার শিরায় শিরায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়তার কম্পনরত নরম ঠোঁটজোড়া প্রণয়ের ঠোঁটের সাথে স্পর্শ লাগতেই, প্রণয়ের সকল ধৈর্যের সহ্যের বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে ঘুড়িয়ে গেল। সে তীব্র বেগে প্রিয়তাকে টেনে কোলে বসালো দুই গালে হাত রেখে গভীরভাবে প্রিয়তমার নরম ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩২