ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩২
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
উন্মাদের মতো ভালোবাসা শুষে নিতে থাকলো প্রিয়তার তুলতুলে ঠোঁট থেকে ,,তৃষ্ণার্ত চাতক তার হাজার বছরের তৃষ্ণা মেটাতে মরিয়া। যে ভালোবাসাকে কাছে পাওয়ার পিপাসায় সে মরছিল বছরের পর বছর, আজ সেই ভালোবাসা, তার সেই আমরণ আশক্তি, তার রক্তজবার স্পর্শে—মনের পিপাসা তো মিটলোই না, বরং মনের আগুন আরও আরও বাড়তে লাগলো।
প্রিয়তার নিশ্বাস ফুরিয়ে আসছে, হাত-পা অবস লাগছে। সে তীব্র অস্থিরতায় খামচে ধরেছে প্রণয়ের পিঠ।
প্রিয় পুরুষের প্রত্যেকটা গভীর স্পর্শ তার অন্তরে গভীর দাগ কাটছে। অপরিচিত, দমবন্ধ করা অসহ্য অনুভূতির অতলে সে পিষ্ট হচ্ছে। হৃদপিণ্ডটা অসহ্য রকমভাবে লাফাচ্ছে—প্রিয়, অথচ নিষিদ্ধ পুরুষের এমন স্পর্শে বুকের ভেতরের প্রাণপাখিটা ছটফটিয়ে মরছে।
জীবনের প্রথম, কোনো পুরুষ তার এত কাছে। আবার সেই পুরুষটা ভালোবাসার নিষিদ্ধ—দুর্লভ, তার জন্য প্রাণদায়ী ও প্রাণঘাতী দুটোই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তার সেই কালচে লাল ঠোঁটের স্পর্শে প্রিয়তার দুনিয়া দুলছে। যদিও ঠোঁট জোড়ার প্রতি তার অনেক লোভ, তবু বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে—সেটা সুখের না দুঃখের, বুঝতে পারছে না প্রিয়তা।
সে শুধুই তার প্রণয় ভাইয়ের ভালোবাসা অনুভব করছে, তার পাগলামি অনুভব করছে।
ঠোঁটের ভাজে প্রিয় পুরুষের অস্তিত্ব—এই পুরুষের ভালোবাসায় এত সুখ! কই, আগে তো জানতো না সে!
সে তো কেবল দুঃখই পেয়েছে।
চোখ বন্ধ করতেই, বন্ধ চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নিষিদ্ধ কিছু—নিষিদ্ধভাবে পাওয়ার অশ্রু।
এই পুরুষের সামান্য ছোঁয়া তার জন্যও পার্থিব সুখের মেলা।
নিষিদ্ধ পুরুষের গভীর ছোঁয়া লাগছে গায়ে।
তবে কি আজ থেকে, তাকে পুরোপুরি কলঙ্কিনী বলা যায়?
এই পুরুষের ভালোবাসার সবটুকু পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার দেহের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে, নিশ্বাস ফুরিয়ে আসছে।
সে প্রণয়ের কোলে থেকেই চটফট করে উঠলো।
কিন্তু প্রণয়ের সেদিকে কোনো হুঁশ নেই।
সে তার রক্তজবার ভালোবাসায় মগ্ন।
এই নারীর শরীরের প্রতিটা লোমকূপ পর্যন্ত তার মাঝে আশক্তিময় অগ্নি ছড়িয়ে দেয়।
এই নারীকে ভালোবাসতে পারাটা ছিল তার স্বপ্ন, কিন্তু তা আর কখনো পূরণের আশা ছিল না।
এই নারীকে একটু খানি ভালোবাসার জন্য সে প্রত্যেকটা মুহূর্ত তোড়পেেছে।বছরের পর বছর করুন বিচ্ছেদের আগুনে দগ্ধ হয়েছে।
এই নারীর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাটা সহজ ছিল না, এই নারীকে ছুঁয়ে ফেলা থেকে নিজেকে সংবরণ করা ছিল দুঃসহ।
তবুও সে নিজের ইচ্ছেকে প্রতিমুহূর্তে হত্যা করেছে, নিজেকে তিলে তিলে শেষ করেছে।
কিন্তু আজ, এই নারী নিজেই তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে—ছুঁয়ে দিয়ে সহ্যের সকল বাধ ভেঙে দিয়েছে।
তাই আজ, জমানো ভালোবাসার সবটুকুই তাকে নিতে হবে—হোক সে সুখের বা দুঃখের।
এরপর দুজনের মৃত্যু হলেও হোক—ভালোবাসার নদীতে এখন আর বাধা দেওয়া সম্ভব নয়।
এই মুহূর্তে প্রণয় পুরোপুরি ‘আউট অফ কন্ট্রোল’।
একপ্রকার হুঁশেই নেই সে।
এই আকর্ষণীয় নারীর সকল আশক্তি তাকে গ্রাস করেছে।
প্রিয়তা দম আটকে আসছে।
সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতেই, প্রণয় আরও গভীরভাবে কোমর চেপে ধরে ডিপ কিস করতে লাগল।
প্রিয়তার চোখ লাল হয়ে আসছে, সে আরো বেশি ছটফট করে উঠলো।
প্রণয় এবার ঠোঁটের ভাজ থেকে ঠোঁট হালকা সরিয়ে নিল।
সঙ্গে সঙ্গেই ‘হা’ করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো প্রিয়তা।
দুই সেকেন্ড নিঃশ্বাস নেওয়ার আগেই, প্রণয় আবারো ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল—পরম যত্নে ভালোবাসতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর ঠোঁট ছেড়ে, কপালে গভীর চুমু খেল।
প্রিয়তার দেহে জান ফিরে এলো।
সে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল কিন্তু কিছু ভয়ংকর কথা কানে আসতেই তার নিশ্বাস আবার ও গলায় আটকে গেল।
প্রণয় ডান গালে সময় নিয়ে গাঢ় চুমু খেল, কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে আকুল কণ্ঠে বলল,
— “দূরে যাস না জান, মরে যাবো।
আই নিড ইউ বেবি গার্ল,, আই নিড ইউ ডিপলি, বিকজ উইথআউট ইউ, আই ফিল লাইল আই আম লসিং মাইসেল্ফ …”
এমন মরণ-বাক্য কর্ণকুহরে পৌঁছতেই প্রিয়তার দম আটকে গেল।
, শরীরে সমস্ত রক্ত হিম হয়ে গেল।
প্রণয় ভাইয়ের মুখে এমন বাক্য—সে তার এত বছরের জীবনে কখনো শোনেনি।
এমন স্পর্শের সাথেও সে কস্মিনকালেও পরিচিত নয়।
অথচ এই প্রণয় ভাইয়ের স্পর্শ তার সবচেয়ে বেশি চেনা।
এই প্রণয় ভাই তো তাকে সবচেয়ে বেশি আদর করতো, তার স্পর্শের গভীরতা সে জানে।
তবে কেন এখনকার প্রত্যেকটা স্পর্শ তার কাছে অপরিচিত লাগছে?
প্রত্যেকটা স্পর্শের গভীরতাই কেমন অসীম, কেমন অন্যরকম, সুখের, সম্পূর্ণ অচেনা।
এই স্পর্শ, এই ব্যক্তি, এই কণ্ঠ—সবকিছুই তার বড্ড চেনা।
অথচ সেই চেনা প্রণয় ভাইয়ের সাথে এই প্রণয় ভাইয়ের আকাশ-পাতাল ফারাক।
এক চুল পরিমাণও মিল নেই।
কয়েক মুহূর্তেই মানুষটা বদলে গেছে।
প্রিয়তার ভাবনার সুতো বেশি দূর এগোতে পারলো না।
এর আগেই তার হৃদপিণ্ড ধকধক করতে লাগল।
প্রণয়, কানের লতিতে চুমু খেতে খেতে গলার কাছে নেমে আসছে।
প্রণয় ঘাড়ে নাক ঘষে, খোঁপা থেকে এক টানে কাঁটাটা খুলে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেললো।
সঙ্গে সঙ্গেই এক রাশ ঘন কালো লতানো চুল তরতর করে পিঠ ছাড়িয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
উন্মুক্ত চুল থেকে ঝড়ের গতিতে সেই পরিচিত মাদকীয় সুঘ্রাণটা নাকে এসে লাগলো।
এই গন্ধটা সবসময় আগুনে গিয়ে ঢেলে দেয়।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।
প্রণয়ের মস্তিষ্ক তো অনেক আগেই কার্যক্ষমতা হারিয়েছে—এখন হৃদপিণ্ডও হারাচ্ছে।
আজ মস্তিষ্ক বাধা দেওয়ার সুযোগই পাচ্ছে না—আজ মনের কথাই শেষ কথা।
প্রণয় নাক-মুখ ডুবিয়ে দিল প্রিয়তার চুলে।
প্রাণ ভরে হৃদপিণ্ডে টেনে নিল সেই মাদকীয় সুবাস।
চুলে মুখ ডুবিয়ে রেখে, নেশাক্ত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল—
— “উফফফ, চুলে কী মাখিস জান অ্যালকোহল, নাহলে এত মাদকীয় হবে কেন?আমাকে শেষ করে দেওয়ার এত কিসের তাড়া তোর?
এই শোন পাখি, তুই শুধুই আমার।
অন্য কারো কাছে কখনো যাবি না—খুন করে ফেলবো তোকে।”
বলে বলতেই, সেই সুঘ্রাণে আবারও হারিয়ে গেল।
এই মুহূর্তে এই নারীকে তার থেকে আলাদা করলে মরে যাবে সে।
এই নারীকে সে কাউকে দেবে না।
এই নারীটা তো শুধুই তার ভালোবাসার পাখি, একান্তই ব্যক্তিগত।
এই নারীর মন ও শরীরের সকল ভালোবাসা শুধুই তার জন্য।
দুর্বল মুহূর্তে পুরুষ মানুষের সকল আকুতির দর্শন মিলে।
ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে, সেখানে নাক ঘষে গভীর চুমু খেতে খেতে হাস্কি টোনে বললো,
— “তুই এত নরম কেন জান, পাখি আমার? ইচ্ছে তো করছে তোকে পুরো খেয়ে ফেলি। একটু খাই জান, প্লিজ?”
প্রিয়তার বুক চলাৎ করে উঠলো, এমন আবদার শুনে।
স্পর্শগুলোতে হাত-পা অবশ হয়ে আসছে।
প্রণয় ভাইয়ের এই অসহ্য সুখমিশ্রিত ভালোবাসাময় স্পর্শগুলো সে একদম সহ্য করতে পারছে না।
আর কথাগুলো তো!
প্রণয় এক টানে গলা থেকে ওড়নাটা টেনে খুলে পাশে ছুঁড়ে মারলো।
তীব্র আসক্তিতে মুখ ডুবালো প্রিয় নারীর গলায়।
প্রিয়তা সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে নিল, খামচে ধরলো প্রণয়ের চুল।
প্রণয়ের গভীর স্পর্শ মেয়েটা সইতে পারছে না।
মন বলছে, “এমনিতেই যখন মরবি, তখন অপূর্ণতা থাকবে কেন?”
আর শরীর বলছে, “তুই তো এখনই মরবি।”
প্রণয়ের গালের খোঁচা খোঁচ দাড়ির ঘর্ষণ লাগছে গলায়।
প্রণয় চুমু দিতে দিতে বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেলে কামড়ও দিয়ে ফেলছে।
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে সকল ব্যথা হজম করে নিচ্ছে।
সে দ্রুত হাতে প্রিয়তার জামাটা গলার কাছ থেকে টেনে কিছুটা নিচের দিকে নামালো।
তীব্র আসক্তিতে সেখানেও মুখ ডুবিয়ে দিলো।
প্রিয়তা পা দিয়ে শক্ত করে মাটি চেপে ধরেছে।
চোখের কোনা বেয়ে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা অশ্রু।
প্রণয় সেখানেও উন্মাদের মতো ভালোবাসার চিহ্ন একে দিচ্ছে।
তার অবাধ্য হাতের বিচরণ সর্বত্র।
তীব্র ভালোবাসায় সেখানেও জোরে কামড় বসিয়ে দিল।
প্রিয়তা নিচু স্বরে “আহহ” করে উঠলো।
মুখ দিয়ে অস্পষ্টভাবে বের হলো,
— “প্রণয় ভাই, প্লিজ…”
প্রণয় আবার একটা হালকা বাইট করে, স্লো ভয়েসে আদুরে কণ্ঠে বললো,
— “মাই প্রিন্সেস, ইউ আর মাই পয়জন, ইউ আর মাই ড্রাগ, এন্ড ইউ আর মাই অবসেশন. ডোন্ট কল মি ভাই , মাই সোল . নাও জাস্ট কল মি প্রণয় …”
প্রিয়তার বুক ধক করে উঠলো।
ঢোক গিলে ভাবলো, এই মানুষটা কি আসলেই প্রণয় ভাই?
সে হুঁশে ফিরেছে অনেক আগেই, কিন্তু প্রণয় ভাই একদম নিজের মধ্যে নেই।
কিছু শোনার বা বোঝার অবস্থাতেই নেই।
সে প্রণয়কে আঁকড়ে ধরে মনে মনে আওড়ালো—
“আপনাকে বাধা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই প্রণয় ভাই।
আমি চাইও না।
এই একটা বিষয়ে আমি যে বড় লোভী।
কিন্তু এর জন্য যদি পরে আপনার আফসোস হয়…
যদি নিজেকে বিশ্বাসঘাতক মনে হয়…
যদি নিজেকে অপরাধী মনে হয়…
যদি আর আমার সাথে কথা না বলেন…
আমার কাছে আপনাকে ওদেয়ও কিছু নেই।
আপনার জন্য আমি আমার জানটাও দিতে পারি।
সমাজের চোখে আপনি নিষিদ্ধ, আপনি অবৈধ…
জানি না, আর কী কী।
কিন্তু আমার জন্য, আপনি আমার পুরো পৃথিবী।
আপনার জন্য আমি সর্বনিকৃষ্ট, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কলঙ্কিনী নারী হতেও রাজি আছি।
আমি জানি, আপনি স্বাভাবিক হয়ে গেলে আর এভাবে কখনোই ভালোবাসবেন না।
এটাই হয়তো প্রথমবার, আর এটাই হয়তো শেষবার।
আমি আপনাকে জোর করতে পারবো না, কারণ আমার সেই অধিকারটাই নেই।
কিন্তু এই দুই-একটা মুহূর্ত আমার আজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।
আপনার ভালোবাসার উন্মাদনা দেখার সুযোগ হয়তো আমার হবে না।
সবাই বলে আমি খারাপ…
আমি তো অস্বীকার করি না।
আমি ও মানি, আমি খারাপ—এতে লুকোনোর তো কিছু নেই।
আপনার জন্য আমি খারাপ, বেহায়া, দুশ্চরিত্র—আর যা যা আছে, সব হতেও রাজি আছি।”
এসব ভেবেই তার বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
সে ও গভীরভাবে ভালোবেসে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো প্রণয়ের কপালে।
প্রণয় আরও গভীরভাবে ভালোবাসার জন্য প্রিয়তার জামায় হাত দিতেই,
প্রিয়তার গলা শুকিয়ে গেলো। জামাটাতে টান দিতে নিতেই বিকট শব্দে আশেপাশে কোথাও বাজ পড়লো।
চমকে উঠলো প্রিয়তা।
ঝড়ের বেগে ঝাঁপটে ধরলো প্রণয়কে।
তীব্র জুড়ালো শব্দ কানে আসতেই প্রণয়ের সব উন্মাদনা থেমে গেল, ঘোর কেটে গেল মুহূর্তেই।
কি ঘটছে বুঝে আসতেই থমকে গেল প্রণয় ছিটকে দূরে সরে যেতে চাইলো,
কিন্তু প্রিয়তার জন্য পারলো না।
এতক্ষণ ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা মনে পড়তেই প্রণয়ের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো।
“আর একটু হলেই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা আমি করে ফেলতাম।”
— “শিট! শিট! শিট! কী করলাম এটা? কীভাবে পারলাম নিজের রক্তজবাকে এভাবে ছুঁয়ে দিতে?”
আর একটু হলেই নিজের হাতে নিজের ভালোবাসার ফুলটাকে নষ্ট করে দিতাম।
প্রণয় পাশের পাথরে সজোরে ঘুষি মারলো।
ভয়ে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা, দূরে সরে গেল কিছুটা।
প্রণয় পরপর আরও কয়েকটা ঘুষি মেরে নিজের চুল খামচে ধরলো—
— “শিট! আমি… আমি আমার রক্তজবাকে অপবিত্র করে দিচ্ছিলাম! ছি! আমি এত খারাপ… আমি এতটা নিচ? আমি আমার রক্তজবার জন্য এতটা বিপদজনক?!”
আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
সে সব ভাবনা দূরে ফেলে দ্রুত প্রিয়তার দিকে ঘুরে চাইল।
ত্রস্ত হাতে পকেট হাতড়ে ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট অন করলো।
প্রিয়তার হাত ধরে আবার কাছে টেনে আনলো।
তার দিকে ভয়ার্থ চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা।
ওর ভীষণ ভয় করছে।
সে আগে কখনো প্রণয় ভাইকে এমন করতে দেখেনি।
প্রণয় ফ্ল্যাশটা প্রিয়তার মুখের দিকে ধরলো।
তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নিলো প্রিয়তা।
প্রণয় আতঙ্কিত চোখে তাকালো নিজের প্রাণপাখির দিকে।
প্রিয়তার পদ্মলাল ঠোঁট জোড়া হালকা হালকা ফুলে আছে।
উপর থেকে একটু একটু চামড়া উঠে যাওয়াতে হালকা হালকা রক্ত দেখা যাচ্ছে।
ঢোক গিললো প্রণয়।
ত্রস্ত হাতে কাঁধ থেকে চুল সরাতেই থমকে গেলো।
ছোট-বড় অনেক কামড়ের দাগ লাল হয়ে আছে।
দুই-একটায় রক্তও চিকচিক করছে।
ওড়নাটা কিছুটা দূরে পড়ে আছে।
অনুশোচনায় জল জল করে উঠলো প্রণয়ের চোখ।
কিন্তু সে তো এখানেই থেমে যায়নি।
এখন দেখার জন্য জামাটা আরেকটু সরাতে হবে—
কিন্তু এতে ভীষণ সংকোচ হচ্ছে প্রণয়ের।
তবু ও কাঁপা হাতে জামাটা আরেকটু নিচে নামাতেই, চোখ বন্ধ করে নিলো প্রণয়।
কিছুক্ষণ মূর্তির মতো বসে রইলো।
অতঃপর কাঁপা হাতে পাশে পড়ে থাকা ওড়নাটা তুলে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে পুনরায় প্রিয়তাকে টেনে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো।
অপরাধবোধের তীব্র আগুনে দগ্ধ হয়ে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললো—
— “I’m sorry, জান… I’m really very sorry… আমি এসব করতে চাইনি, বিশ্বাস কর… আমায় মাফ দে, প্লিজ জান… আমায় শাস্তি দে…”
বলতে বলতে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
মনে মনে আফসোস করে বললো—
— “কেন আমায় আটকালি না, জান? কেন আত্মসমর্পণ করলি?
পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে মিলিয়ে গেলে কি মানুষ বেপরোয়া হয়ে যায়?
কেন আটকালি না? এত ভালোবাসিস…
সে বড় বড় করে নিশ্বাস ফেললো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে।
“মনে যাই, চলুক এখন… এগুলো প্রকাশ করা যাবে না। স্বাভাবিক হতে হবে আমাকে। আমি তোকে জন্য বড় বিপদজনক, জান…”
তাই যত দ্রুত সম্ভব তোকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে হবে।
সে উপরের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললো—
“হে মাবুদ, তোমার অসীম মেহেরবানি… আজ তুমি আমাদের পাপ করা থেকে বিরত করেছো। আমার রক্তজবাকে বাঁচিয়েছো। নাহলে সব শেষ হয়ে যেতো। এত বছরের সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা, অর্থহীন হয়ে যেত?”
যাকে বাঁচাতে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে পুড়িয়ে মারি, সেই-ই শেষ হয়ে যেত।
প্রিয়তা আরও শক্ত করে প্রণয়ের পিঠ জড়িয়ে ধরলো।
তারও ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে—সেটা এজন্য নয় যে প্রণয় ভাই তাকে স্পর্শ করেছে,
বরং এজন্য যে প্রণয় ভাই তাকে স্পর্শ করতে চাননি।
সেই তো প্রথম পদক্ষেপটা নিয়েছিল। অথচ নির্দোষ মানুষটা শুধুই শুধুই অপরাধবোধে কষ্ট পাচ্ছে।
কয়েক মুহূর্ত পর প্রণয়ের মনে পড়লো—
ওরা যাদের থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছে, তারা নিশ্চয়ই আরও সামনে এগিয়ে গেছে।
বেশিক্ষণ এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়।
প্রণয় প্রিয়তাকে টেনে তুলে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“চল, এখান থেকে।”
প্রিয়তার লজ্জায় মাটিতে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে।
এক ছুটে এখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু কোথায় বা পালাবে, বেচারি?
প্রণয় ওর হাত মুঠো করে ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো সামনে, অজানা গন্তব্যে।
কোথায় যাচ্ছে জানা নেই।
প্রণয়ের জানা মতে এই জঙ্গলটা বিশাল বড়।
আর এখানে অন্য সন্ত্রাসীদের আস্তানাও আছে।
এক শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে তারা অন্য শত্রুর ঘরে প্রবেশ করেছে ।
কিন্তু এ ছাড়া আর কী-ই বা উপায় ছিল?
প্রণয়ের ভীষণ আফসোস হচ্ছে।
মনের সমুদ্রে এখনো উত্তাল ঝড় বইছে।
চোখের সামনে ভাসছে সেই মুহূর্তগুলো—নিজের সংযম এভাবে হারিয়ে ফেলবে, সে স্বপ্নেও ভাবেনি।
হাতের মুঠো আরেকটু শক্ত করে ধরে মনে মনে বললো—
“আমি জানি, তুই আমাকে চাস…
আমি-ও তো তোকে চাই, জান। খুব করে চাই।
তোকে একেবারে আমার অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে নিতে চাই।
কিন্তু মানুষের সব চাওয়া কি আর পূরণ হয়?”
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ প্রণয় দাঁড়িয়ে পড়লো।
থেমে গেল প্রিয়তাও।
প্রণয়ের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, আশেপাশে কেউ বা কারা আছে।
প্রিয়তা প্রশ্ন করতে যাবে, তার আগেই প্রণয় ওর মুখ চেপে ধরলো।
ফিসফিসিয়ে বললো,
“একদম চুপ… কেউ আছে আশেপাশে।”
ঢোক গিললো প্রিয়তা।
আবারও ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো।
অন্ধকারে প্রণয় আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি ঘোরালো।
তার সেকেন্ড পেরোবার আগেই, শুকনো পাতার উপর ডজন খানেক পায়ের শব্দ তাদের দিকে দ্রুত বেগে আসতে লাগলো।
প্রণয় শক্ত করে প্রিয়তার হাতের কব্জি ধরে বাম দিকে দৌড় দিলো।
প্রিয়তা ছুটতে ছুটতে বললো,
“আমরা কি ধরা পড়ে যাবো, প্রণয় ভাই?”
প্রণয় বললো,
“আমি বেঁচে থাকতে তোকে কিছু হতে দেব না।
এখন ছুট!”
প্রায় মিনিট পাঁচেক একটানা ছোটার পর ওদের মনে হলো—
ওরা এখনো পিছন পিছন আসছে, আর সংখ্যায়ও অনেক।
দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ দুজন হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো পাশের ঢালে।
চলাৎ করে উঠলো প্রণয়ের কলিজা।
পড়ে যাওয়ার আগেই নিজের প্রাণকে শক্ত করে, নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো।
পড়ার সাথেসাথেই তারা গড়াতে লাগলো নিচের দিকে। কোথায় পড়ছে, জানে না প্রণয়, কিন্তু অনেক শক্ত মাটি আর পাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ।
প্রণয় ভালোভাবে প্রিয়তার পিঠে আর মাথায় হাত রাখলো, যাতে কোনোভাবেই এই শক্ত মাটি-পাথরে তার প্রাণ একটুও ব্যথা না পায়। প্রায় সাত-আট মিনিট গড়ানোর পর ফাইনালি থামলো।
প্রণয়ের শরীরের অনেক জায়গায় ছিলে গেছে। পুরো শরীর ব্যথায় জর্জরিত। তবু নিজের ব্যথাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিলো না প্রণয়। প্রিয়তাকে টেনে বুকে এনে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় কোথায় ব্যথা পেয়েছিস, জান?”
প্রিয়তা আরও একটু মিশে গেলো প্রণয়ের সাথে। এটাই তো সেই পরিচিত স্পর্শ, পরিচিত কণ্ঠ, যা প্রিয়তার সর্বকালের চেনা।
প্রিয়তা নিচু কণ্ঠে জবাব দিলো,
“উঁহু… কোথাও ব্যথা পাইনি।”
কিন্তু প্রণয় বিশ্বাস করলো না। সে ফোন বের করে আবারও প্রিয়তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চেক করতে লাগলো—কোথাও ছিঁলে গেছে কি না। দুই হাত ভালোভাবে দেখলো। না, ছিঁলে যায়নি কোথাও।
মুখের দিকে ফোনটা ধরতেই আবার নজর পড়লো—গলায় ফরসা ত্বকে লাল দাগগুলো জলজল করছে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো প্রণয়।
প্রিয়তা নিচু স্বরে বললো,
“সত্যি বলছি, একটু-ও ব্যথা পাইনি।”
কিন্তু প্রণয় ওর কথায় গুরুত্ব দিলো না।
ডান পা টেনে সামনে আনতেই আতকে উঠলো প্রিয়তা।
তাড়াহুড়ো করে সরিয়ে নিতে চাইল, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
“পায়ে হাত দেবেন না, প্লিজ। আপনি আমার অনেক বড়ো…”
প্রণয় সেসব কথা কানে তুললো না। বরং মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।
প্রিয়তা বুঝতে পারলো, বলে লাভ নেই।
প্রণয় সালওয়ারটা একটু উঁচুতে তুলতেই ওর বুক ধক করে উঠলো। ফরসা পা শক্ত পাথরের ঘর্ষণে ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
সে রেগে তাকালো প্রিয়তার দিকে, ধমক দিয়ে বললো,
“তুই ব্যথা পাসনি?!”
প্রিয়তা বুকা হাসলো,
“ব্যথা তো ভীষণ লেগেছে, টনটন করছে…”
প্রণয় পাশে একধরনের লতা দেখতে পেলো। কেটে গেলে বা ছিঁড়ে গেলে এই লতা চিপে রস লাগালে আরাম হয়।
প্রণয় সেটা তুলে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলো।
প্রিয়তার ওড়নার কোণা থেকে এক টুকরো কাপড় ছিঁড়ে পায়ে পেঁচিয়ে দিলো।
ওরা যেখানে এসে পড়েছে, সেটা উপরের জঙ্গল থেকে অনেকটাই নিচে। এটা কোন জায়গা, সঠিক জানে না প্রণয়।
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে বললো,
“একটু ফোনটা দিবেন?”
প্রণয় ফোনটা এগিয়ে দিলো।
প্রিয়তা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“একটা কথা বলবো? বকবেন না প্লিজ…”
প্রণয় ভুরু কুঁচকে তাকালো।
প্রিয়তা ভীতু কণ্ঠে বললো,
“আপনার শার্টটা একটু খুলবেন, প্লিজ…”
প্রণয় অবাক হলো, না, কোনো রকম দ্বিমতও করলো না।
শার্টটা খুলে ফেললো।
প্রিয়তার ভীষণ লজ্জা লাগছে, কিন্তু লজ্জা-শরম সব সাইডে রেখে চোখ তুলে তাকাতেই চমকে উঠলো।
হাতে আর পিঠে অসংখ্য জায়গায় ছিঁলে গেছে।
সাথে সাথেই প্রিয়তার নীলাভ আঁখি যুগল পানিতে টইটুম্বুর হয়ে গেলো।
কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দিলো ক্ষতস্থানে।
চোখ বন্ধ করে নিলো প্রণয়।
সে-ও সেই একই লতা তুলে চিপে রস লাগিয়ে দিলো।
হাতের ক্ষতে ওড়নার কয়েক টুকরো বেঁধে দিলো।
মনে মনে ভীষণ শান্তি পেলো প্রণয়।
এমন সেবা পেলে এর চেয়ে বেশি আঘাত পেলেও ক্ষতি নেই।
প্রণয় আবার শার্টটা পরে নিলো।
ধীর কণ্ঠে বললো,
“চল এখান থেকে। আকাশে দেখ, যখন-তখন বৃষ্টি আসবে।”
কিন্তু প্রিয়তার মন চাইছে না, তাই বললো,
“আরেকটু বসি?”
প্রণয় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ওর মুখের দিকে চাইল।
কিন্তু তখন থেকে প্রিয়তার পিঠ চুলকাচ্ছে, কিন্তু চুলকাতে পারছে না!
প্রিয়তা পিঠে হাত দিতেই কিছু একটা অনুভব করলো।
প্রণয় ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
প্রিয়তাকে বারবার পিঠে হাত দিতে দেখে এক ভ্রু তুলে প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে? এমন চিংড়ি মাছের মতো লাফাচ্ছিস কেন?”
প্রিয়তা করুণ কণ্ঠে বললো,
“কি জানি… খালি পিঠ চুলকাচ্ছে…”
প্রণয়ের ভ্রু আরো খানিকটা কুঁচকে গেলো।
দ্রুত এগিয়ে এলো প্রিয়তার কাছে।
থ্রিপিসের কুর্তাটা একটু ফাঁক করে পিঠের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলো।
সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠলো প্রিয়তা, চোখ গোলগোল হয়ে গেলো।
প্রণয় জামার মধ্যে থেকে হাত বের করে প্রিয়তার সামনে ধরলো—
বিশাল সাইজের একটা নাদুসনুদুস পানির জুঁক, তেলতেল করছে!
সাথে সাথেই ভয়ে চিৎকার দিয়ে প্রণয়ের বুকে মুখ লুকালো প্রিয়তা।
ভয়ার্থ কণ্ঠে অনুরোধ করলো,
“প্লিজ, ওটা সরান… আমার খুব ভয় করছে!”
হেসে ফেললো প্রণয়।
জুঁকটা ছুঁড়ে মারলো দূরে।
ওর পাগলিটা ছোটোবেলা থেকেই—সাপ-জুঁক বড্ড বেশি ভয় পায়।
প্রণয় আরেকটু ভয় দেখাতে বললো,
“এইজন্যই বলছি, চল এখান থেকে। দেখছিস—জায়গাটা ভর্ত্তি ঘাস! হয়তো পাশে জলাশয়ও আছে। তাই এখানে ঘাসের জুঁক আর পানির জুঁকের অভাব নেই।
ওদের পাঁচ মিনিট লাগবে তোর তুলতুলে দেহটা খেয়ে ফেলতে!”
প্রিয়তা আরও ভয় পেয়ে গেলো।
চোখ কুঁচকে প্রণয়ের বুকে মুখ লুকালো।
প্রণয় উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“চল।”
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩১
প্রিয়তা ভীষণ ভয় পেয়েছে।
সে এখন আর কিছুতেই এত বড় বড় ঘাসে পা রাখতে পারবে না!
সে ভীতস্বরে বললো,
“এত জুঁকের মাঝে আমি পা রাখতে পারবো না! যদি পায়ে ধরে ফেলে!”
প্রণয় পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ওকে কোলে নিলো।