ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৪
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
জ্বলন্ত রূপের পানে চেয়ে ঘামতে লাগলো প্রণয়।
ঢোক গিলে মনে মনে বলল,
“এবার দুনিয়া জাহান্নামে চলে গেলেও কন্ট্রোল হারানো যাবে না।”
পুরনো অনুভূতিরা আবারো জেগে উঠছে, যে অনুভূতির সাথে কিছুক্ষণ আগে এই নারীই পরিচয় করে দিয়েছে।
তার বুকের ভেতর আবারো তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।
সে প্রিয়তার জলন্ত রূপের পানে চেয়ে মনে মনে আওড়ালো —
“নারী, তুমি বড়ই ভয়ানক — তোমার মায়াময় দৃষ্টি অস্থিরতার ঝড় তোলে হৃদয়ে, তোমার উষ্ণ নিঃশ্বাসের বেকুলতা আমাকে টেনে নেয় এক অজানা আকর্ষণের অতল গহ্বরে; তুমি ভালোবাসার সেই অগ্নিস্রোত, যেখান থেকে মুক্তি নেই, নেই ফেরার পথ।”
তবে নিজেকে আবারও সংযত করে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল ।
“তুমি যতই আশক্তিময় হও না কেন, এবার ভুল করেছি বলে কি বার বার করবো?”
নিজেকে সান্ত্বন রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে সে , কিন্তু তাতে কোনো কাজ হলো না— বরং অস্থিরতা আরও বেড়ে চললো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তার সামনে বসে প্রিয়তা মনোযোগ সহকারে হাতের শাড়িটা উল্টেপাল্টে দেখছে—সবুজ পাড়ের লাল রঙের সুতির শাড়ি, দাম বড়জোর দুই-তিনশো টাকা হবে। তবে কমদামি হলেও এই শাড়িটা যে প্রিয়তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে তা তার চোখমুখের উজ্জ্বলতা দেখে বোঝা যাচ্ছে।
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে “প” উচ্চারণ করতেই—
হেচ্ছুউউউউউউউউউউ…
হেচ্ছুউউউউউউউউয়ুয়…
হেচ্ছুউউউউউউউউউউউ…
প্রণয়ের হাত চেপে ধরে পরপর তিনবার ঘর কাঁপিয়ে হাঁচি দিয়ে শান্ত হলো।
প্রিয়তার এমন অবস্থা দেখে প্রণয় ছাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
“দুই মিনিট বৃষ্টিতে ভিজেই আমার ননির পুতুলের ঠান্ডা লেগে গেছে।”
দ্রুত সে প্রিয়তার গালে কপালে হাত ছুঁইয়ে শরীরের উষ্ণতা পরখ করতে লাগলো।
দেহের তাপমাত্রা অনুভব হতেই চমকে উঠলো সে —শরীর ক্রমশই গরম হচ্ছে।
এইভাবে আর বেশিক্ষণ ভেজা কাপড়ে থাকলে তার প্রাণ নিশ্চিত কঠিন জ্বরে পড়বে।
সে দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়াল দৃঢ় গলায় আদেশ করল,
“আমি সামনের দিকে ফিরে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াচ্ছি, তুই তাড়াতাড়ি চেঞ্জ কর।”
প্রিয়তা তখনও একের পর এক হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে।
সে নাক ঘসে অসহায় মুখে তাকাল প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় আরও তাড়া দিয়ে বলল,
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে চেঞ্জ কর।”
বলে সামনের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলো অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালো।
প্রিয়তার নাক দিয়ে ইতিমধ্যেই পানি পড়া শুরু হয়ে গেছে।
সে নাক টেনে কোনোরকমে নিজের কাপড় পাল্টাতে লাগল।
কিন্তু কেমন যেন এক অদ্ভুত দম বন্ধ কর অনুভূতিতে তার সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে ।
আশপাশের বাতাসটাও ভারী ভারী লাগছে। যতই প্রণয় ভাই না দেখুক, তার উপস্থিতি প্রিয়তার হার্টবিট বাড়িয়ে দিচ্ছে—
সে থ্রি-পিস পালটে কোনোরকম এলোমেলোভাবে শাড়িটা পরে নিল।
লাল রঙের ব্লাউজটা গায়ের সাথে একদম পারফেক্টলি ফিটিং হয়েছে।
প্রিয়তা কাপড় পাল্টানো শেষে ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল প্রণয়ের কাছে—শাড়িটা বারবার পায়ে পেঁচিয়ে যাচ্ছে।
সে পেছন থেকে বলল,
“হয়ে গেছে।”
প্রণয় শান্ত দৃষ্টিতে পেছনে ফিরে তাকাতেই একটা বড় ধাক্কা খেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে আবার ঢোক গিলল। হালকা ধমকে বলল,
“এটা কি শাড়ি পরার ধরন! মনে হচ্ছে, কেউ তোকে জোরজবরদস্তি শাড়িটা গায়ে পেঁচিয়ে দিয়েছে।”
প্রিয়তা করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে নম্র গলায় বলল,
“বকছেন কেন? আপনি তো জানেন আমি অতোটা ও ভালো শাড়ি পড়তে পারি না, সব সময় আপু-আম্মুরা পরিয়ে দেয়।”
প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে অদৃশ্য হাতে নিজের কপাল চাপড়াল।
প্রিয়তা আবার বলল,
“যেমন করেই হোক, কাজ চালানোর মতো হয়ে গেছে। এবার আমি চোখ বন্ধ করে দাঁড়াচ্ছি, আপনি চেঞ্জ করে নিন।”
বলতে সামনের দিকে পা বাড়াতেই আচমকা শাড়িতে পা পেঁচিয়ে
‘ধাড়াম’
করে মাটিতে মুখ তুবড়ে পড়ল।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল প্রণয়—এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে সে ধরে নেওয়ার সুযোগটাই পেল না।
প্রিয়তা মাটিতে পড়ে হাতের কনুইয়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেল। ব্যথায় চোখে পানি চলে এসেছে কান্না গুলো গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখন সে বড় হয়েছে—প্রণয় ভাইয়ের সামনে কাঁদাটা ভালো দেখায় না। তাই ঠোঁট কামড়ে প্রাণপণে কান্নাটা গিলে নেওয়ার চেষ্টা করল।
প্রণয় দ্রুত এসে ওকে ধরল হাত মুছিয়ে দিয়ে ধমকে বলল,
“এত কিছু পারিস, আর একটা সামান্য শাড়ি তুই ঠিক মতো পরতে পারিস না?”
প্রিয়তা জলজল চোখে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টাল।
প্রণয় তাকে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি চেঞ্জ করে আসি, তারপর ঠিক করে দেব।”
বলেই সে প্রিয়তার পেছন দিক দিয়ে চলে গেল।
আমি ঠিক করে দেব কথাটা শুনে প্রিয়তার বুকটা ধক করে উঠল।
অজান্তেই স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো কয়েক বছর আগের সেই ভালোবাসা মিশ্রিত দিনটি…
৯ বছর বয়সি প্রিয়তা বড় আম্মুর ওয়ারড্রোবের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঘাটাঘাটি করছে। একটা করে শাড়ি হাতে নিচ্ছে, আর একেক রকম এক্সপ্রেশন দিচ্ছে। কিন্তু এগুলোর একটা-ও স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশনে পরার উপযুক্ত নয়।
সবকিছুই কেমন অতিরিক্ত মনে হচ্ছে, তাই সে হতাশ—ভীষণ হতাশ।
আম্মু, মেজো আম্মু, ছোট আম্মু—কারো শাড়িই প্রিয়তার পছন্দ হলোনা।
এখন বড় আম্মুর শাড়িরও একই অবস্থা।
সে চোখ-মুখে অমাবস্যার ঘন অন্ধকার নামিয়ে চুপচাপ গিয়ে প্রণয় ভাইয়ের বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
এখন প্রণয় ভাই-ই তার একমাত্র মুশকিল আসান।
প্রণয় তখন ভার্সিটিতে। আজ তার অনার্স ৪র্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা।
সে আরও ২০ মিনিট পর বাসায় ফিরল—চোখে-মুখে প্রগাঢ় ক্লান্তির ছাপ, সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজবে।
ক্লান্ত চিত্তে নিজের ঘরের মেঝেতে পা রাখতেই দেহের সকল ক্লান্তি, মনের সকল অবসাদ, কর্পূরের ন্যায় চোখের নিমিষেই মিলিয়ে গেল।
ঠোঁটে ফুটল প্রশস্ত প্রাণবন্ত হাসি।
প্রায় ১০ ঘণ্টা নিজের “জান” কে দেখতে না পেয়ে, তার প্রাণটা কই মাছের মতো ছটফট করছিল। তাই তো সে এক্সাম শেষ হতেই এক প্রকার ছুটে এসেছে।
প্রণয় শান্ত কণ্ঠে ডাকল,
“রক্তজবা!”
প্রিয়তা গভীর চিন্তাভাবনার সাগরে ডুবে ছিল।
আচমকা প্রণয় ভাইয়ের কণ্ঠ কানে আসতেই মন পুলকিত হলো।
প্রণয় চোখের পলক ফেলার আগে প্রায় একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রণয়ের বুকে।
প্রণয়ের বুকের সকল ছটফটানি মুহূর্তেই থেমে গেল।
সকল যন্ত্রণা, সকল ক্লান্তি জুড়িয়ে গেল।
সে নিজের প্রাণটাকে দুই হাতে তুলে নিজের ঘামে ভেজা শরীরের সাথে মিশিয়ে নিল।
প্রিয়তা গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হেসে উঠল—সে হাসিতে ছিল কেবল স্বচ্ছতা আর নির্মলতা।
সে প্রণয়ের গালে আর নাকের ডগায় টুপটাপ করে অজস্র চুমু খেয়ে অভিমানি কণ্ঠে বলল,
“ছাড়ুন আমাকে! আপনার সাথে কথা নেই। আমি রেগে আছি!”
চুমু খেতে খেতে খেতে রাগ ঝাড়তে দেখে হেসে ফেলল প্রণয়।
সে প্রিয়তার নাক টেনে দিয়ে চিন্তার অভিনয় করে বলল,
“আমার জান আমার উপর এতো রেগে আছে কেন? শুনি?”
প্রিয়তার নাকের ডগা লাল হয়ে ফুলে উঠল।
প্রণয় কথা শেষ করার আগেই প্রিয়তা ঠোঁট উল্টে ফুপিয়ে উঠল।
গলা জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল,
“আজ আপনি আমাকে কিছু না বলেই চলে গেছেন প্রনয় ভাই ! কতবার ফোন করেছিলাম আপনাকে …আর আপনি একটা কথাও বললেন না। তাই আমি-ও আর কথা বলব না! একটুও না!”
প্রণয় বিস্মিত হলো। আজ সে এত ব্যস্ত ছিল যে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল—এমিনকি এখনো সাইলেন্টই আছে।
কিন্তু এসব কথা তো তার রক্তজবা বুঝবে না।
প্রণয় প্রিয়তার ঠোঁটের কোণে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“ওরে বাবা, এত রাগ! আচ্ছা, আমি সরি, এই যে কান ধরছি…”
কিন্তু এতে-ও প্রিয়তার মন গলল না।
প্রণয় অসহায় মুখে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে দুষ্টু হাসল।
প্রিয়তাকে বিছানায় বসিয়ে, নরম দু’গালে আলতো চুমু দিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
“আমার রক্তজবা কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছে?”
প্রিয়তার নীলচোখ টলটল করে উঠল।
প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়তার দুই হাত মেলে ধরল।
তারপর নিজের শার্টের পকেট আর প্যান্টের পকেট থেকে বড় বড় পাঁচটা ডেইরি মিল্ক চারটা কিটক্যাট চকোলেট বের করে প্রিয়তার হাতের মুঠোয় গুঁজে দিল।
স্নেহমাখা কণ্ঠে বলল,
“আমার রক্তজবা কি এখনো? ”
কথা শেষ করার আগেই প্রিয়তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সে আবার প্রণয়ের গালে ‘টুকুস’ করে একটা চুমু খেয়ে বলল,
“একটুও রেগে নেই!”
প্রণয় হেসে একটা চকলেটের র্যাপার খুলে প্রিয়তার মুখে দিয়ে বলল,
“আরও একটা জিনিস এনেছি আমার রক্তজবার জন্য। সেটা চাই?”
প্রিয়তা চকলেট খেতে খেতে মাথা নেড়ে দ্রুত সম্মতি জানাল।
প্রণয় হেসে ব্যাগ থেকে একটি সিম্পল ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়ি বের করে তার হাতে দিল।
মনমতো শাড়ি দেখে প্রিয়তার চোখ চকচক করে উঠল। বিস্ময়ভরা চোখে সে প্রণয় ভাইয়ের দিকে তাকাল।
সে যেমনটা ভেবেছিল—প্রণয় ভাইয়ের মতো করে তাকে আর কেউ বোঝে?
প্রণয় ওর পাশে গা এলিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“পছন্দ হয়েছে?”
প্রিয়তা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জবাব দিল,
“খুব!”
প্রণয় হেসে বলল,
“তাহলে এখন একটু মাথাটা টিপে দে। খুব ব্যথা করছে!”
প্রিয়তার মনে ভীষণ মায়া হলো।
সে এগিয়ে গিয়ে প্রণয়ের মাথাটা নিজের কোলের উপর রাখল।
হালকা হাতে চুলে বিলি কাটতে কাটতে মাথায় মৃদু মাসাজ করতে লাগল।
প্রশান্তিতে প্রণয়ের চোখ বন্ধ হয়ে এল।
প্রিয়তার তুলতুলে হাতের ছোঁয়ায় ভীষণ আরাম বোধ করল।
জীবনে এতটুকু শান্তিই তো সে চেয়েছিল।
কিছুক্ষণ পর, প্রিয়তা ডাকল,
“প্রণয় ভাই?”
প্রণয় চোখ বন্ধ রেখেই মৃদুস্বরে উত্তর দিল,
“হুমম্ম…”
প্রিয়তা বলল,
“শাড়িটা তো অনেক বড়। বড়দের জন্য। আমি কীভাবে পরবো?”
চোখ বন্ধ রেখেই ঠোঁট এলিয়ে হাসলো প্রণয়।
প্রিয়তা মাথা মাসাজ করতে করতে হালকা হালকা চুলও টেনে দিল উফফ প্রশান্তি তে ঘুম চলে আসছে।
প্রিয়তা এবার বায়না ধরে বলল,
“এখুনি একবার পরে দেখি প্রণয় ভাই?”
চোখ বন্ধ রেখেই ধীর কণ্ঠে জবাব দিলো,
“এখন পরে কী করবি? তোদের তো কাল অনুষ্ঠান।”
কিন্তু প্রিয়তার আর ধৈর্য ধরতে পারল না।
সে জেদ ধরে বলল,
“না, এখনই পরব!”
প্রণয় চোখ মেলে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল,
“ঠিক আছে, যা পরে আয়।”
প্রিয়তা উঠতে গিয়ে ও থেমে গেল।
কিছুক্ষণ ভেবে মুখটা ছোট করে ফেলল।
কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“কিন্তু কীভাবে পরবো? ওটা তো অনেক বড়!”
প্রণয়ের ঠোঁটে অদৃশ্য হাসি ফুটে উঠল।
সে শুয়া থেকে উঠে বসল। এখন অনেকটাই আরাম বোধ করছে।
প্রিয়তাকে নিচের ড্রয়ার দেখিয়ে বলল,
“ওখান থেকে কাঁচিটা নিয়ে আয়।”
প্রিয়তা ও কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ ড্রয়ার খুলে কাঁচি এনে প্রণয়ের হাতে দিল।
প্রণয় শাড়ির ভাঁজ খুলে প্রিয়তাকে সোজা করে দাঁড় করাল।
তার উচ্চতার মাপ নিয়ে অর্ধেক থেকে একটু ওপরে কাঁচি দিয়ে শাড়িটা কেটে দিল।
পছন্দের শাড়ি কাটতে দেখে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল প্রিয়তা।
প্রণয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বুকে টেনে নিল সান্তনা দিয়ে বলল,
“কাঁদিস না বাচ্চা, তোর পরার উপযোগী করতে হবে তো।”
প্রিয়তা বহু কষ্টে কান্না চেপে শান্ত হলো।
প্রণয় দেখল, মেয়েটা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
সে আর কিছু না বলে খুব যত্ন সহকারে শাড়িটা ফ্রকের উপর দিয়ে পরাতে লাগল।
শাড়িটা ওর গায়ের রঙের সঙ্গে দারুণ মানিয়ে গেছে।
প্রিয়তার মন খারাপটা টিকল না।
প্রণয় সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে মুগ্ধ নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল।
তারপর ওকে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“দেখ, কেমন লাগছে?”
সেদিন প্রিয়তা নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলো না।
নয় বছরের মেয়েটি যেন সেদিন হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেছিল তাকে বারো-তেরো বছরের কিশোরীদের মতো পরিণত লাগছিলো ।
প্রণয় সেদিন ওর গাল টেনে কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বলেছিল,
“My Disney Princess!”
কিন্তু তাদের এত সুখ হয়তো কারো সহ্য হচ্ছিল না।
কেউ আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে সকল দৃশ্য অগ্নিদৃষ্টিতে অবলোকন করল …
প্রণয়ের কথায় ঘোর কেটে গেল প্রিয়তার।
সে আনমনে চোখ তুলে সামনে তাকাতেই চমকিত হলো।
ঠোঁট দুটো আপনাআপনি হাঁ হয়ে গেল।
সে গোল গোল চোখে চেয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে…
প্রিয়তার এমন চাহুনিতে প্রণয়ের কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। জীবনে প্রথমবার সে লুঙ্গি পরেছে।
প্রিয়তা মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভালোভাবে স্ক্যান করলো, তবে তার দৃষ্টি একটা জায়গায় স্থির হয়ে আছে।
গোড়ালি থেকে কিছুটা ওপর পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়ে আছে আকর্ষণীয় লোমশ পুরুষালী পা, যা প্রিয়তার সকল মনোযোগ আকর্ষণ করছে।
প্রিয়তা যেটা কল্পনা করে হেসে কোটি কোটি হয়েছিল, বাস্তবিক দৃশ্যে সেরকম কিছুই প্রতিফলিত হলো না, বরং এই লুঙ্গি পরা লুকে প্রণয় ভাই কে দেখে তার পাপী মন আরো কয়েক দফা ক্রাশ খেয়ে বসলো ।
আকাশের গুরুম গুরুম শব্দ কানে আসছে।
প্রণয় প্রিয়তাকে হাত ধরে টেনে কোনো রকম দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো,
“সাবধানে দাঁড়া, বেশি নাচানাচি করলে আবার আগের মতন ধারাম করে পড়বি।”
প্রিয়তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। এখন কি আর সে ছোট আছে?
এলোমেলো শাড়িতে দেখে প্রণয়ের আবারো শরীর খারাপ লাগছে।
সে কাঁপা হাতে শাড়ির আঁচলে হাত ছোঁয়াতেই হাঁপানি রোগির মত তার হৃদপিণ্ড ধড়ফড় করতে শুরু করল ।
সে দ্রুত হাত নামিয়ে নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।
এখন আর এই কাজটা করা তার জন্য এতটা ও সহজ নয়
সে আর কোন ভুল করতে চায় না। কিছুক্ষণ থেমে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়তার খোঁপা থেকে ভেজা গামছাটা টেনে খুলে নিল।
চোখের নিমিষেই অর্ধভেজা চুলগুলো হাঁটু ছাড়িয়ে গেল।
প্রণয়ের এহেন কাণ্ডে হতবম্ভ হয়ে গেল প্রিয়তা।
প্রিয়তাকে বেশি কিছু ভাবার সময় না দিয়ে ভেজা গামছাটা চোখে শক্ত করে বেঁধে নিল প্রণয় ।
বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো প্রিয়তা।
প্রণয় ভালোভাবে চোখে গামছা বেঁধে প্রিয়তাকে টেনে একদম কাছে নিয়ে এলো।
কাঁধ থেকে আঁচলটা এক টানে নামিয়ে দিল।
সাথে সাথেই প্রিয়তার দেহের রক্ত চলকে উঠলো, সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেলো,
প্রণয়ের প্রতিটা স্পর্শে অন্তরের অন্তস্থল পর্যন্ত ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপছে।
প্রণয় ধীরে ধীরে পুরো শাড়িটা খুলে আবার প্রথম থেকে পরাতে শুরু করলো।
হাতের আঙ্গুলগুলো মাঝে মাঝে আলতো ছুঁয়ে দিচ্ছে।
প্রিয়তা মোহিত নয়নে সামনের পুরুষের দিকে চেয়ে রইল।
প্রণয়ের অতি সুদর্শন চেহারার দিকে তাকিয়ে আবারো প্রেমে পড়ে গেল প্রিয়তা, আনমনেই গুনগুন করে গাইল—
বন্ধু তুমি ভালো,
তুমি তো চাঁদের আলো,
আমি মনে হয় বামন হয়ে চাঁদেই হাত বাড়াই।
ঝলসে যাবো জানি,
মানছে না মনখানি,
পাবো না জেনেও মিছেমিছি কেনো তোমাকেই ছুঁতে চাই।
আমি কেনো বারবার প্রেমে পড়ে যাই,
এই জনমে পাই বা না পাই পরজনমে চাই।
প্রণয় গানটা শুনলো, তবুও কিছু বললো না।
সে সুন্দর মতো শাড়ির আঁচলটা কাঁধে তুলে দিয়ে চোখ থেকে গামছা সরিয়ে নিল।
চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দু’একটা হার্টবিট মিস করলো।
লাল শাড়িতে সামনের নারীকে আজ আর কিশোরী লাগছে না,
প্রিয়তা নিজেও নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো।
শাড়িটা একদম পরিপাটি ভাবে শরীরের সাথে চিপকে আছে।
প্রণয় কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আর দুই এক ঘণ্টার মধ্যেই সকাল হয়ে যাবে, যা গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নে।”
কিন্তু প্রিয়তা গেলো না।
কি হলো, দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যা!
প্রিয়তা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“একা যাব? অপরিচিত জায়গায় একা আমার ভয় লাগে।
খালি মনে হয় আশে পাশে তিনারা আছে।”
ভ্রু কুঁচকানো প্রণয়,কপাল চুলকে বললো
“তিনারা আবার কারা?”
প্রিয়তা ঢোক গিলে বললো,
“এই রাতের বেলা তিনাদের স্মরণ করবেন না প্লিজ, তাও আবার এখন রাত ৩ টা তিনাদের সময়।”
প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়তাকে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল।
সাথে সাথে আবারও বিকট শব্দে আশেপাশে কোথাও বাজ পড়লো।
চমকে উঠে প্রণয়কে ঝাঁপটে ধরলো প্রিয়তা।
প্রণয় দেখলো একটা মাত্র বালিশ।
সে সেটা নিজের পিঠের নিচে দিয়ে আধ শুয়া হয়ে শুলো দেওয়ালে হেলান দিয়ে প্রিয়তাকে টেনে নিজের বুকের মাঝে নিলো।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে কণ্ঠে বললো,
“যেটা চেয়েছিস হয়েছে, এবার চোখ বন্ধ কর।”
প্রিয়তা ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় বুকের আরো গভীরে মুখ লুকালো।
দু’হাতে পেট শক্ত করে আকরে ধরে চোখ বন্ধ করলো।
এর থেকে বেশি শান্তি কি পৃথিবীতে আর কিছুতে আছে?
মনে মনে বললো,
“আপনি আবার আমার অভ্যাস খারাপ করে দিলেন প্রণয় ভাই।
এবার কাল থেকে যখন ঘুমানোর জন্য আপনার বুকটা পাবো না, তখন আমার ঘুম আসবে কিভাবে?
কাল থেকে যখন আবার আপনাকে অন্য কারো সাথে দেখবো, তখন সহ্য করবো কিভাবে?
আমার জীবনটা এমন ছন্নছাড়া কেন?
আমি কি একটু বেশি চেয়ে ফেলেছিলাম প্রণয় ভাই?
তবে আপনি কেনো আমার হলেন না?
আমি আপনার ভালোবাসা নয় জানি, আমি আপনার মায়া, যাকে আপনি অনেক আদরে বড় করেছেন।
আমার প্রতি আপনার অনেক স্নেহ।
আর আমি পাপিষ্টা আপনার এই স্নেহের পবিত্রতা ধরে রাখতে পারলাম না, ভালোবেসে ফেললাম, যেই ভালোবাসার কোন পরিচয় হয় না।
আপনি বাস্তবে আমার না হলেও কল্পনাতে শুধুই আমার ।
ভালোবাসি প্রণয় ভাই, অনেক ভালোবাসি।”
প্রণয় দুই হাতে পিঠ জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে মনে মনে বললো,
“তোর ভালোবাসাটা কম কর জান, নয়তো আমার মতোই সীমাহীন যন্ত্রণায় জলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবি।
আমার অভিশপ্ত বুকে শান্তি খুজিস না।
তা তোকে ক্ষণিকের শান্তি দিলেও চিরস্থায়ী যন্ত্রণার শিকলে আবদ্ধ করে রাখবে একটু একটু করে শেষ করে দেবে তোকে, যা আমি সহ্য করতে পারবো না।
তুই আমার অনেক আদরের জান, অনেক ভালোবাসার।
তোর কষ্ট সহ্য করতে পারবো না জান।
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৩
তাই তোর আজীবন সুখের জন্য ক্ষণিকের কিছু কষ্ট তোকে দিতেই হবে।
সেই দিন আমাকে ঘৃণা করে অনেক দূরে চলে যাস জান।
আমার নামটা শুনলেও যেন তোর ঘৃণা লাগে।
আমার ছোট্ট পাখি, কত যন্ত্রণা পেয়েছিস, আর নয়।
এবার তোকে সুস্থ জীবনে ফিরতে হবে।
তোকে আমি আবার আগের মতো দেখতে চাই।
তোর সকল কষ্ট আমার হোক পাখি,
পরম শান্তিতে ধীরে ধীরে দু’জনেই গভীর ঘুমে তলিয়া গেল ।