ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৮
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রিয়তা পঞ্চমবারের মতো বমি করে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলল। তীব্র গা-গুলানো ভাব আর মাথা ঘোরার কারণে সে চোখে সর্ষেফুল দেখছে। চোখ-মুখের অবস্থা বেহাল, সে এক হাতে দেয়াল ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে, কিন্তু শরীর আর সায় দিচ্ছে না তার। লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পিঠের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
প্রিয়তা পেট চেপে ধরে টলতে টলতে বিছানার কাছে আসতেই হঠাৎ তার চোখের সামনের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। সেকেন্ড পার হওয়ার আগেই সে মাথা ঘুরে ফ্লোরে পড়ে গেল। দুই-এক মিনিট যাওয়ার আগেই পেট চেপে ধরে অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। তীব্র ব্যথার তোপে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে প্রিয়তার। না চাইতেও চিৎকার বেরিয়ে আসছে মুখ দিয়ে। সে ফ্লোরে পড়ে থেকে ছটফট করতে করতে ফুপাতে শুরু করল।
প্রণয় প্রাণ হাতে নিয়ে উন্মাদের মতো ছুটে এলো প্রিয়তার ঘরে। ব্যস্ত হয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে পা রাখতেই সামনের দৃশ্য দেখে তার হৃদপিণ্ড থমকে গেল। যেটার ভয় পেয়েছিল সে, সেটাই সত্যি হয়েছে। প্রণয় উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডাকল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
___ “জান!”
প্রণয়ের কণ্ঠ কানে আসতেই প্রিয়তা শব্দ করে কেঁদে উঠল। উঠে বসার শক্তিটুকুও নেই তার। সে শুধু ক্রন্দনরত গলায় ডাকল,
____ “প্রণয় ভাই…”
নিজের জানটাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে প্রণয়ের ভেতরটা জ্বলে উঠল।
সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। চোখ-মুখে হাত বুলিয়ে আতঙ্কিত কণ্ঠে শুধালো,
_____“বেশি ব্যথা করছে জান? তুই একটু দাঁড়া, আমি এখনই আসছি।”
বলেই সে উঠে যেতে নিলে প্রিয়তা শক্ত করে তার টি-শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরল।
করুণ কণ্ঠে মিনতি করে বলল,
____ “প্লিজ, যাবেন না প্রণয় ভাই…”
থমকে গেল প্রণয়। ব্যথাতুর নয়নে তাকালো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তমার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে তার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে প্রিয়তাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিল, মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
____ “তুই একটু অপেক্ষা কর, জান। আমি এখুনি আসছি।”
প্রিয়তা আরও শক্ত করে প্রণয়ের টি-শার্ট আঁকড়ে ধরল। করুন কণ্ঠে থেমে থেমে বলল,
____ “প্লিজ, যাবেন না… আমার খুব কষ্ট হচ্ছে… আমার কিছু লাগবে না শুধু আপনি থাকুন।”
প্রণয়ের ভীষণ কষ্ট হলো। সে নিজের জান-পাখিকে বুকের গভীরে আরেকটু নিবিড়ভাবে মিশিয়ে নিল। কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বলল,
____ “যাচ্ছি না, জান। শুধু পাঁচ মিনিট দে আমায়… একটু সহ্য কর।”
প্রিয়তা অসহায় চোখে চেয়ে রইল। প্রণয় তাকে বসিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে বড় একটা ক্লাচার এনে এলোমেলো চুলগুলো খোঁপা বেঁধে দিল।
আবার কপালে চুমু খেয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল, ____“Just 5 minutes, জান…”
প্রিয়তা শুধু অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইল। প্রণয় তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে গিয়ে এক পাতিল পানি গরম বসালো। ভালোভাবে ফুটিয়ে হট ওয়াটার ব্যাগে ভরে দ্রুত উপরে ছুটে এলো।
ততক্ষণে প্রিয়তা আবার গা-গুলাতে শুরু করেছে। সে চোখ-মুখ খিঁচে পেটের নিচে বালিশ চেপে ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। প্রণয় এসে ওকে সোজা করে বসালো, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না।
প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় পা তুলে বসল। বালিশ দুটোতে হেলান দিয়ে পরম আদরে প্রিয়তাকে নিজের বুকে টেনে নিল—প্রিয়তা ও মাথা এলিয়ে দিল প্রণয়ের কাঁধে। শরীরের যন্ত্রণাটা অনেকটা হলেও প্রিয় পুরুষের স্পর্শ ও গন্ধে মনে শান্তি লাগছে।
প্রণয়ের বুকটা কেমন তোলপাড় করছে। সে হট ওয়াটার ব্যাগটা সযত্নে প্রিয়তার তলপেটে চেপে ধরল—একদম ধীরে, সাবধানে। প্রিয়তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে স্লো ভয়েসে বলল,
____ “একটু গরম লাগবে, সহ্য করে নে জান… সব ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে চোখ খিঁচে অতিরিক্ত তাপ হজম করে নিল। কিছুক্ষণ গরমে একটু কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে আরাম লাগতে শুরু করল। ব্যথা ধীরে ধীরে একটু কমে আসছে। প্রণয় চুপচাপ ওর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে শাসনের সুরে বলল,
____“এতো ব্যথা করছিল, ডাকিসনি কেন আমায়? আমায় না ডাক, সেজমাকে তো ডাকতে পারতিস। আর কতো জ্বালাবি আমায় বল ?”
প্রিয়তা চুপচাপ বুকে মুখ খুঁজে ঘাপটি মেরে পড়ে রইল। কোনো উত্তর করল না। এখন কিছু বললেই বকবে।
প্রণয় ভারী নিশ্বাস ফেলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল কণ্ঠে শুধালো,
____ “এখন একটু ভালো লাগছে, পাখি?”
প্রিয়তা আরেকটু বুকের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল। প্রণয়ের শরীরের ঘ্রাণ নিতে নিতে ছোট করে বলল,
__“হুম।”
হাসলো প্রণয়। সতর্ক কণ্ঠে বলল, “বেশি নড়িস না, ব্যথা বেড়ে যাবে।”
প্রিয়তা মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
___“বাড়ুক ব্যথা, আপনি আছেন না… আপনার স্পর্শই আমার সকল ব্যথার একমাত্র ওষুধ। আমার সকল অসুখের একমাত্র সুখ—কেবল আপনি, শুধু আপনি।”
ছোট্ট বিড়ালছানা কো-কো এতক্ষণ গুল-গুল চোখে এদের কাণ্ডকারখানা দেখছিল। কী বুঝল কে জানে। সে ও ধীর পায়ে হেঁটে এসে প্রণয়ের ডান উরুর উপর উঠে শুয়ে পড়ল।
কো-কোর মাথায় হাত বুলিয়ে হাসল প্রিয়তা। অতিরিক্ত যন্ত্রণায় আর প্রণয় ভাইয়ের শূন্যতায় ঘুম আসছিল না প্রিয়তার। কিন্তু এখন প্রণয় ভাইয়ের উষ্ণ কোমল স্পর্শ আর যত্নে প্রিয়তার চোখের পাতা ভারী হচ্ছে। একটু একটু করে গভীর তন্দ্রা জেঁকে বসছে।
প্রণয় অনবরত তার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। আদর পেয়ে দেখতে দেখতেই প্রিয়তা আর কো-কো ঘুমের দেশে হারিয়ে গেল।
একটু শান্তি পেল প্রণয়, কিন্তু ঘুম আসেনি তার চোখে। কারণ, সে ভালোই জানে—একটু পর আবারও প্রিয়তার অশান্তি শুরু হবে।
আর ঠিক তাই হলো। মিনিট কুড়ি পার হতেই প্রিয়তা আবারো ছটফটিয়ে উঠল।
_____“বেশি খারাপ লাগছে, জান?”
প্রিয়তা বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু এবার যন্ত্রণাটা এতটাই তীব্র যে সে আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না।
প্রণয়ের গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল।
প্রণয়ের নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগল।
এই সমস্যাটা জেনেটিক—এটা প্রিয়তা তার আম্মুর কাছ থেকে বংশসূত্রে পেয়েছে। এটার কোনো দাওয়াই নেই। পিরিয়ডের সময় সব মেয়েদেরই কমবেশি ব্যথা হয়, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রিয়তার ব্যথাটা এতটাই তীব্র যে পরপর দুইটা পেইন কিলার না খেলে ব্যথা ছাড়তে চায় না। আর পেইন কিলার তো প্রণয় তাকে খেতে দেবে না।
প্রিয়তা ছটফট করতে করতে অনুরোধের সরে বলল,
____“Please… প্রণয় ভাই, আমাকে একটা পেইনকিলার দিন, নাহলে আমি সত্যি মরে যাবো…”
প্রণয় ওকে আরো শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বসে রইল। প্রিয়তা বারবার পেইনকিলার চাচ্ছে।
প্রণয় আর সইতে না পেরে শান্তভাবে বলল,
_____“সব সময় পেইনকিলার খেতে নেই। তুই জানিস তো, এটা কতোটা খারাপ? শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলোর ক্ষতি হয়।”
প্রিয়তা এসব বুঝতে চাচ্ছে না। গরম পানির সেঁক এখন ব্যথা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রণয় ওয়াটার ব্যাগটা সরিয়ে নিল।
প্রিয়তা এখন অস্বাভাবিকভাবে ঘামতে শুরু করেছে।
আবার বমি ও পাচ্ছে।
প্রণয় তাকে কোলে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। শাওয়ারের নিচে বসিয়ে দিয়ে মাথায় ধীরে ধীরে পানি ঢালতে লাগল।
প্রায় পাঁচ মিনিট পানি ঢালার পর প্রিয়তাকে আবার এনে বিছানায় বসিয়ে দিল, তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিল।
তবু ও ব্যথা কমছে না।
প্রণয় তাকে রেখে উঠে যেতে নিলে প্রিয়তা আবারো আর্তনাদ করে উঠল, অসহায় চোখে চেয়ে বলল,
___“চলে যাচ্ছেন, প্রণয় ভাই?”
প্রণয় দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেলো, পুনরায় ফিরে এসে প্রিয়তার মায়াভরা মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকালো, স্নেহময় কণ্ঠে বলল,
____“এই যাবো, আর এই আসবো…”
বলেই চলে গেল।
হাজার কষ্টের মাঝে ও হেসে ফেলল প্রিয়তা।
এত ভালোবাসা কি সে আর কোথাও পাবে? এত ভালো কি আর কেউ তাকে বাসতে পারবে? কেউ কি পারবে প্রণয় ভাইয়ের অভাব পূরণ করতে?
অনেকে চাইলে হয়তো প্রিয়তার জন্য অনেক কিছু করতে পারবে, কিন্তু প্রিয়তার জন্য প্রণয় ভাই—কেউ হতে পারবে না।
প্রণয় আবারো কিচেনে এলো।
তাড়াহুড়ো করে একটা প্যানে সরিষার তেল গরম করতে দিয়ে তাতে চার কোয়া রসুন থেঁতো করে দিল। রসুনটা ভালো মতো তেলের সাথে পুড়িয়ে সেটা একটা বাটিতে নিয়ে ডিপ ফ্রিজে রাখল ২–৩ মিনিট।
কিছুটা ঠান্ডা হলে সেটা নিয়ে প্রিয়তার কাছে এলো।
প্রিয়তা বিছানায় গুটিসুটি হয়ে কাঁদছে। প্রণয় ভাই কাছে থাকলে ব্যথা করে, তবুও ভালো লাগে। কিন্তু প্রণয় ভাই দূরে গেলে নিঃশ্বাসটাও বন্ধ হয়ে যেতে চায়।
প্রণয় ওর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাছে এলো।
প্রিয়তা তেল দেখে মুখ ছোট করে ফেলল, একটু দূরে সরে প্রথমেই তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলল,
____“একদম পায়ে হাত দেবেন না!”
কিন্তু প্রণয় এসব শোনার বান্দা নয়। প্রিয়তার কথা সে কানেই তুলল না।
তার দুই পা টেনে নিজের কাছে নিতে নিতে ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল,
____“ছোটবেলায় লাথি মারতে মারতে আধমরা বানিয়ে ফেলেছিস, এখন ঢং করা হচ্ছে।”
মুখটা আরো ছোট করে ফেলল প্রিয়তা।
প্রণয় তিনটে বালিশ উঁচু করে তাকে শুইয়ে দিলো, ডান পাটা নিজের উরুর উপর তুলে ধীরে ধীরে পায়ের তালুতে তেল মালিশ করতে লাগল।
প্রণয়ের স্পর্শে প্রিয়তার গা কয়েকবার শিউরে উঠল।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে প্রণয় পায়ের তালুতে, হাতের তালুতে তেল মালিশ করে দিলো। পা টিপে দিল, মাথাও টিপে দিল।
তাতে ধীরে ধীরে কিছুটা আরাম বোধ করল প্রিয়তা।
পরম শান্তিতে একসময় ঘুমিয়েও পড়লো।
প্রিয়তা ঘুমিয়ে পড়তে দেখে প্রণয়ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
আরও কিছুক্ষণ হাত-পা টিপে উঠে পড়ল।
প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর পড়ার টেবিলে গিয়ে বসল। দুই মিনিট লাগিয়ে একটা চিরকুট লিখে প্রিয়তার টেবিল ল্যাম্পের পাশে রাখল।
আবারো পাশের রমণীর দিকে কিছুক্ষণ তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
এই একটা মুখ… তাকিয়ে থাকলে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে…
এত বছরেও সেই আমরণ তৃষ্ণার এতোটুকুও কমেনি, বরং তা হয়েছে আরো গভীর থেকে গভীরতর।
মৃত্যু ব্যতীত এই তৃষ্ণার কোনো অন্ত নেই।
প্রণয় হেসে ঘুমন্ত প্রিয়তমার কপালে আলতো চুমু খেল।
কোকোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে ও প্রিয়তার পাশে শুইয়ে দিল।
আদেশের সুরে বলল,
____ “নিজের মায়ের খেয়াল রাখবি।”
বলে দুজনের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল…
সকাল ৮টা ৪৫।
সাদমান শিকদার ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে চা পান করতে করতে খবরের কাগজ হাতে নিলেন।
এটা ওনার রোজকার অভ্যাস। পাশে উনার দুই ভাই কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছেন।
সাদমান শিকদার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাগজের ফ্রন্ট পেজটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই উনার মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়ে গেল, দুই ভ্রুয়ের মধ্যে আপনা-আপনি ভাজ পড়ল। তিনি কাজের ছেলেকে ডেকে টিভি অন করতে বললেন।
ততক্ষণে প্রণয়, শুদ্ধসহ বাড়ির ছেলেরা অফিসের জন্য রেডি হয়ে নিচে নামছে।
সাদমান শিকদার বোধহয় একটু উদ্বিগ্ন। তিনি মনোযোগী ভঙ্গিতে টিভির দিকে তাকালেন।
সেখানে সংবাদ পাঠিকা বলছেন—
“Breaking News”
> সংবাদপাঠক (কঠিন ভঙ্গিতে):
“চাঞ্চল্যকর ঘটনা রাজধানীতে!
একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে নির্মমভাবে খুন করে, তার কাটা মাথা পাঠানো হয়েছে সরাসরি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার—ডিসিপি আহসান হাবিবের—বাড়ির ঠিকানায়!
শুধু তাই নয়, ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে দেশজুড়ে সৃষ্টি করা হয়েছে আতঙ্কের পরিবেশ।
ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর উপশহর ‘গোলপ’ এলাকায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ডিসিপির বাসায় একটি সাধারণ পার্সেল প্যাকেটে মাথাটি পাঠানো হয়। প্যাকেট খুলতেই বেরিয়ে আসে কাটা মাথা, সঙ্গে একটি ছোট্ট মেমোরি কার্ড—যার মধ্যে ছিল খুনের সম্পূর্ণ ভিডিও ফুটেজ।
এই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে অবস্থান করছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি মেহজাবীন খান।”
> রিপোর্টার (মেহজাবীন খান):
“জি, আমি এখন গোলপ এলাকার সেই বাড়ির সামনে আছি, যেখানে আজ সকাল সাড়ে দশটায় পার্সেলটি পৌঁছায়।
ডিসিপির পরিবারের একজন সদস্য পার্সেলটি হাতে নেন। খুলতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সবাই। মাথাটি একটি প্যাকেটজাত অবস্থায় ছিল, সঙ্গে ছিল একটি বার্তা—যেখানে লেখা ছিল, ‘এবার পালা তোমার।’
পুরো ঘটনাটি তদন্ত করছে সিআইডির বিশেষ টিম।
এখনো নিহত ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি, তবে পুলিশের ধারণা, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত প্রতিহিংসার অংশ।
আমরা আরও বিস্তারিত জানাচ্ছি পরবর্তী বুলেটিনে।
মেহজাবীন খান, নিউজ ২৪, ঢাকা।”
এমন নিউজ কানে আসতেই সবাই সচকিত দৃষ্টিতে টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকালো।
প্রণয়ের ঠোঁটে ফুটে উঠলো অদৃশ্য বাঁকা হাসি—যা আর কেউ লক্ষ্য না করলেও শুদ্ধ ঠিকই করলো।
সে বাঁকা চোখে কিছুক্ষণ প্রণয়কে পর্যবেক্ষণ করলো।
অনুস্রী বেগম আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,
_____“আজকাল মানুষ আর মানুষ নেই, সব অমানুষ হয়ে গেছে। এমন নির্মমভাবে কেউ কাউকে মারে?”
তিনি কথা বলতে বলতে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।
ভীতু চোখে নিজের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
______“বাবা, তোরা সাবধানে থাকিস।”
ওরা সবাই আম্মুকে টেনশন নিতে দেখে মুচকি হাসলো।
প্রেম অনুস্রী বেগমের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
_____“যার সাথে মায়ের দোয়া থাকে, সেই সন্তানের কিছু হয় না।”
অনুস্রী বেগম মৃদু হেসে ছোট ছেলের কপালে চুমু খেলেন।
এই খুনের ব্যাপারটা কেউই আর তেমন সিরিয়াস নিল না, কারণ আজকাল এসব অহরহই হতে থাকে।
এসব তারা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেও, ও দুজন ফেলতে পারলো না।
তারা ঠিকই বুঝেছে, এসব কার কাজ।
প্রিতম ব্যস্ত ভঙ্গিতে অর্তি বেগমের উদ্দেশে বললো,
_____“ছোটো আম্মু, বনুদের তাড়াতাড়ি ডাকো। আমাদের লেট হয়ে যাচ্ছে তো!
ওদেরকে ড্রপ করে আমাদের অফিসে যেতে হবে—আজকে অনেক ইম্পর্টেন্ট একটা মিটিং এটেন্ড করতে হবে।”
অর্তি বেগমও সম্মতি জানিয়ে ছুটলেন মেয়েদের ডাকতে।
সাদমান শিকদার প্রণয়ের উদ্দেশে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
____“তুমি কোন অফিসে যাচ্ছো?”
প্রণয় ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিল,
__ নিজের।
সাদমান শিকদার একটু অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন,
____“এসকে গ্রুপের প্রতি তো তোমার একটা দায়িত্ব আছে।”
প্রণয় ফোন টিপতে টিপতে দায়সারা ভাবে জবাব দিল,
____“তো আপনার ও আমার প্রতি একটা দায়িত্ব ছিল।”
অনুস্রী বেগম দেখলেন, এক কথা-দুই কথায় বাবা-ছেলের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে যাবে, তাই তিনি বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
_____“আহ, ছাড়ুন তো এসব।”
তিনি প্রণয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
___“সকাল সকাল মাথা গরম করিস না বাবা।
সাদমান শিকদার মনে মনে ফুসে উঠলেন।
তাদের কথার মাঝেই পরিণীতা, প্রেরণা, থিরা, থোরি, তন্ময়, অরণ্য, সমুদ্র—সবাই চলে এলো।
অনুস্রী বেগম সবাইকে সুরা পড়ে ফুঁ দিয়ে বললেন,
___“সাবধানে যাবি।”
ওরাও হেসে আব্বু-আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
সোহেব শিকদারও উঠে চলে গেলেন।
খালিদ শিকদার, সাদমান শিকদারের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় কণ্ঠে বললেন,
____“ভাইজান, পানি কিন্তু মাথার উপর দিয়ে বইছে। শক্ত হাতে হাল ধরেন। পুরো ব্যাপারটা কিন্তু আবার হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। এবার কন্ট্রোল হারালে আর সামলাতে পারবেন না।”
সাদমান শিকদার কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে বললেন,
____“বাবা বাবাই হয় আর ছেলে ছেলেই হয়।
ওকে আমি জন্ম দিয়েছি, আর ওর প্রাণভোমরা আমার হাতের মুঠোয় বন্দি করে রেখেছি।
ও কিচ্ছু করতে পারবে না। আমাকে টপকে কিছু করতে চাইলে হাত মুঠো করে ধরব—ছটফট করতে করতে মরে যাবে।
কিন্তু ও তো আমার ছেলে, এতটা ও খারাপ বাবা আমি নই।
তাই তো ওকে নিজের প্রাণভোমরার কাছে থাকতে দিচ্ছি, দেখতে দিচ্ছি।
বিনিময়ে সে আমাদের কাজ দিচ্ছে।
এই ডিল যতদিন চলবে, ও ততদিন ভালো থাকবে।
আর যেদিন কথার অবাধ্য হবে…”
খালিদ শিকদার চোখে-মুখে আগ্রহ নিয়ে বললেন,
_____“সেদিন কী করবেন ভাইজান?”
সাদমান শিকদার বাঁকা হেসে বললেন,
“সেদিনই দেখবি…”
সকাল ১০টা।
প্রিয়তা আলস্য দেহে ঘুম থেকে উঠে আড়ামোড়া ভাঙলো।
এখন কিছুটা ঠিক লাগছে।
সে ঝিম ধরে কিছুক্ষণ বসে রইলো।
চোখ বন্ধ করতেই একে একে মনে পড়তে লাগলো কাল রাতের সকল কথা, প্রণয় ভাইয়ের করা যত্নগুলোর কথা।
প্রণয় ভাইয়ের কথা ভাবতেই প্রিয়তার ঠোঁট আপনাআপনি প্রসারিত হলো।
প্রণয় ভাইয়ের এমন সেবা-যত্ন প্রিয়তার জন্য নতুন নয়।
এগুলো প্রিয়তার অভ্যাস।
সে পেট চেপে বিছানা থেকে উঠে বসল।
আশেপাশে হাতড়ে নিজের ফোনটা খুঁজলো।
এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে চোখ পড়ল টেবিল ল্যাম্পের পাশে।
সেখানেই ওর ফোনটা পড়ে আছে।
সে হাত বাড়িয়ে সেটা তুলতে গিয়ে লক্ষ্য করলো, ফোনের নিচে একটা ভাজ করা চিরকুট।
সে ভ্রু কুঁচকে কৌতূহলী হাতে সেটা তুলে নিল।
ফোনটা পাশে রেখে আলতো হাতে কাগজের ভাঁজটা খুলতেই চোখের ভাষা পাল্টে গেল।
সেখানে ইংরেজি অক্ষরে গুটিকয়েক লাইন লেখা:
প্রিয়তমা/রক্তজবা,
গুড মর্নিং, মাই সানশাইন!
আই হোপ ইয়োর ডে ইজ অ্যাজ লাভলি অ্যাজ ইয়োর স্মাইল।
জাস্ট আফিউ সফট রিমাইন্ডার্স ফ্রম মি, ওকে?
ট্রাই নট টু রান অ্যারাউন্ড টু মাচ।
স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম কোল্ড ওয়াটার, ইট’স নট গুড ফর ইউ।
ইফ ইউ ফিল এনি পেইন, ডোন’ট জাস্ট গ্র্যাব এ পেইনকিলার — প্লিজ, ওয়েইট।
ইট ইয়োর মিলস অন টাইম, ডোন’ট স্কিপ দেম।
অ্যান্ড ইফ দ্য পেইন গেটস ওয়ার্স, টেল মি।
আই’ল বি দেয়ার,
টু জেন্টলি মাসাজ ইয়োর হ্যান্ডস অ্যান্ড ফিট উইথ ওয়ার্ম অয়েল —
জাস্ট টু মেইক ইউ ফিল বেটার।
ইতি~ প্রণয়__
লেখাটা পড়ে হেসে ফেললো প্রিয়তা।
ধীর কণ্ঠে বললো,
____“আপনি না থাকলে আমার কী হতো, প্রণয় ভাই…”
সে পেট চেপে বিছানা থেকে উঠলো, চিরকুটটা আবার ভাঁজ করে বইয়ের ভেতর গুঁজে রাখলো।
ওয়ারড্রোব থেকে জামাকাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল সেরে বেরিয়ে এলো সে।
তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
এক রাতের ব্যথা তার সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতা ২% কমিয়ে দিয়েছে।
সে লম্বা চুলগুলো শুকিয়ে আচড়ে বেণি করে নিলো।
মাথায় ওড়না দিয়ে কোকোকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
প্রহেলিকা ঘুম থেকে উঠেছে। আরও ১০ মিনিট আগে উঠে নিজের এলোমেলো অবস্থা দেখে বেশ খুশি হলো।আশে পাশে প্রণয়কে কোথাও দেখতে না পেয়ে ভাবলো, প্রণয় হয়তো অফিসে চলে গেছে।
পাশে পড়ে থাকা প্রণয়ের শার্টটা দেখে হাতে তুলে নিলো। সাথেসাথেই মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেলো। বাঁকা হেসে বললো,
___“উফ্! এত বুদ্ধি নিয়ে আমি যে কি করবো!”
সে প্রণয়ের রাতে ফেলে রাখা শার্ট-প্যান্ট তুলে নিয়ে গায়ে একটা ওড়না জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রিয়তা নিজের ব্যালকনিতে বসে নিচের পদ্মপুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। পুকুরের সবুজ জলে অগণিত লাল পদ্মপুষ্প খুব সুন্দর মানিয়েছে। ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রিয়তা হারিয়ে গেল শৈশবের স্মৃতিতে।
___“প্রিয়, আছিস?”
— কারো গলার শব্দে ধ্যান ভেঙে গেল প্রিয়তার। সে সামনে থেকে মনোযোগ সরিয়ে ঘরের ধিকে তাকিয়ে দেখলো প্রহেলিকা দাঁড়িয়ে আছে।
সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ঘরের ভিতর।
প্রহেলিকা লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
____“স্যরি বোনু, তোকে ডিস্টার্ব করার জন্য। আসলে আমার ঘরের ওয়াশরুমে পানি আসছে না। আমি একটু তোর ওয়াশরুমে শাওয়ারটা নিয়ে নেই?”
প্রহেলিকার অবস্থা দেখে প্রিয়তার পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গেল। আবার হৃদয়ে তীব্র রক্তক্ষরণ শুরু হলো।
প্রহেলিকা একটু লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললো,
____“কি রে বোন, কিছু বললি না? আসলে অন্যদের ওয়াশরুমের শাওয়ার নিতে যেতে কেমন লাগছে।”
প্রিয়তার চোখ টলটল করে উঠলো। বুকের মধ্যে আবার অপ্রিয় যন্ত্রণার আগুন ধরে গেল। সে কাঁপা কণ্ঠে বললো,
___ “ঠিক আছে আপু, তুমি শাওয়ার নাও।”
প্রহেলিকা প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
____“লক্ষ্মী বোন আমার!”
— বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
প্রহেলিকা যেতেই প্রিয়তার চোখের বাঁধ ভেঙে গেল। প্রহেলিকার এলোমেলো চুল, লেপ্টে যাওয়া লিপস্টিক, এলোমেলো শাড়ি — প্রিয়তার হৃদয় কয়লার মতো জ্বলে উঠলো।
প্রিয়তা আবার ব্যালকনির দিকে ছুটে গেল। তার চোখ পড়লো সোফার ওপর, যেখানে প্রহেলিকা প্রণয়ের শার্টটা ফেলে গেছে।
প্রিয়তা কাঁপা হাতে শার্টটা তুলে নিলো। সাদা রঙের শার্টে লাল লিপস্টিকের দাগটা বড্ড দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। প্রিয়তার সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো। তার নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিতে মন চাচ্ছে। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে আবার দৌড়ে গিয়ে ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে দিল।
এই সব দৃশ্য আবার দরজার আড়ালে কেউ একজন দেখে ফেলল।
প্রিয়তা বারান্দার মেঝেতে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলো। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার
— “ছি! মেয়ে হিসেবে কতটা বেহায়া হয়ে গেছি আমি!”
প্রিয়তা ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
____“আপনি কাল অন্য জনকে ছুঁয়ে আমার কাছে এসেছিলেন, প্রণয় ভাই… কেন এসেছিলেন? আমি তো আপনাকে ডাকিনি! তবে কেন এসেছিলেন? আমি মরলে আপনার কিছুই যায় আসবে না? আর সামান্য ব্যথা, আমি মরেও যেতাম না! কেন আপনি অন্য নারীর ছোঁয়া গায়ে মেখে আমার কাছে এসেছিলেন?
আপনার স্ত্রীর কাছেই থাকতেন। ভালোবাসি বলে এভাবে অপমান করবেন? আপনি ছাড়া থাকতে পারি না বলে এভাবে যন্ত্রণা দেবেন? আপনি অনেক খারাপ, প্রণয় ভাই, অনেক খারাপ!
আপনাকে আমি অন্য কারো সাথে দেখতে পারি না।”
অতিরিক্ত নড়াচড়া আর কাঁদার ফলে আবারও ধীরে ধীরে সেই ভয়ংকর রকমের ব্যথায় চড়ে বসছে। প্রিয়তা দাঁতে দাঁত পিষে শরীর ও মনের যন্ত্রণা হজম করার চেষ্টা করলো।
ছটফট করতে করতে কাতর কণ্ঠে আল্লাহর দরবারে আবেদন জানালো—
“হে মাবুদ, আমি এভাবে বাঁচতে চাই না। তুমি তো জানো, আমার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না।
আমি কোনো বিবাহিত পুরুষকে ভালোবাসিনি। কিন্তু আমার ভাগ্যে ছিল না সে। তোমার কাছে অনেক করে চেয়েও আমি মানুষটাকে পাইনি, মানুষটা আমার হয়নি।
সে ও নাকি কাউকে ভালোবেসে ছিল, তাকেই আপন করেছে।
আমার ভালোবাসার পূর্ণতা দাওনি তুমি, তাদের দিয়েছো।
তাতে আমি একটুও দুঃখিত নই।
আমার ভালোবাসার পুরুষ ভালো থাকুক, সুখে থাকুক— এতটুকুই চাই।”
প্রিয়তা আবারও দুই হাতে চোখের জল মুছে বললো,
“আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না। মাবুদ, প্লিজ, আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও।
এই জীবনের বোঝা আমি আর বইতে পারছি না।
আমার এতটুকু জীবনেই আমি হাপিয়ে উঠেছি।
আমি ওনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, বাঁচতেও পারবো না।
উনার অন্যের পাশে দেখার শক্তি আর নেই আমার। প্লিজ, রহম করো, মাবুদ।”
বিলাপ করতে করতেই অতিরিক্ত ব্যথা সইতে না পেরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেন্স হারিয়ে ফেললো প্রিয়তা।
ওভাবে লুটিয়ে পড়ে রইল মেঝের উপর।
দুপুর ১টা।
সাদমান শিকদার একা বসে আছেন নিজের লাইব্রেরি রুমে।
তিনি মনোযোগ দিয়ে কিছুটা পড়ছেন।
এমন সময় দরজায় ঠকঠক নক-এর শব্দ হলো।
— “আঙ্কেল, আসবো?”
সাদমান শিকদার মাথা তুলে চাইলেন।
সদাফ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি গম্ভীর কণ্ঠে অনুমতি দিয়ে বললেন, “আসো।”
সদাফ মার্জিত ভঙ্গিতে ধীরে পায়ে এগিয়ে এল, সামনে দাঁড়িয়ে নমনীয় কণ্ঠে বলল,
___“আঙ্কেল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।”
সাদমান শিকদার মুখ তুলে সামনে ছেলেটিকে পরখ করলেন।
গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
__“বসো।”
সদাফ উনার সামনে সোফায় বসে পড়লো।
— “বলো।”
সদাফ কিছুক্ষণ ৬০ ঊর্ধ্ব ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে কোনো ভয় বা ভীতি ছাড়াই বললো,
“প্রথমেই আমি আমার দৃষ্টতা জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। কিন্তু আমার মনে হলো, এই বিষয়ে আপনাকে বলাটা খুবই জরুরি। এই বিষয়ে আপনার কথাই শেষ কথা।”
সাদমান শিকদার চশমা ঠেলে সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকালেন সাদাফের দিকে।
বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কণ্ঠে গাম্ভীর্য ধরে রেখেই বললেন,
___“তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু বিষয়টা কী, সেটা তো বলো।”
সদাফ কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কোনো ভণিতা ছাড়াই সোজাসাপ্টা ভাবে বললো,
__“আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।”
সাদমান শিকদারের হাত থেমে গেল।
তিনি ভ্রু কুচকে চাইলেন সামনের ছেলেটার দিকে।
ছেলেটার চোখ-মুখ বলছে—সে বেশ সাহসী ও নিজের সিদ্ধান্তে অনড়।
তিনি আরও গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
___“বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছো?”
সদাফ আবার সাহসী কণ্ঠে প্রত্তুত্তর করল,
__“ধরে নিন তাই।”
সাদমান সিকদার শান্ত ভঙ্গিতে তাকালেন।
সদাফ আবারও নমনীয়, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
____“আমার মনে হয় না আমি আপনার মেয়ের অযোগ্য। আর আমার হাতে আপনার মেয়েকে তুলে দিতে কোনো অসুবিধা হবে। তবু যদি মনে হয় আমি অযোগ্য, তবে আপনি যেভাবে নিজেকে পরিবর্তন করতে বলবেন, সেভাবেই করবো। আমি কোনো সম্পর্ক জড়াতে চাই না। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।”
সাদমান সিকদার ছেলেটার সাহসিকতায় মুগ্ধ হলেন। বইটা বন্ধ করে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
_____“বিয়ে যেহেতু করতে চাও, তাহলে একা এসেছো কেন? বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে আসো। তোমার বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া তো আর আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেব না।”
সাদমান সিকদারের কথায় সদাফের চোখ-মুখ ঝলমল করে উঠলো। সে চোখে হাসলো, যদিও সেটা বাইরে থেকে বোঝা গেল না।
সাদমান সিকদার আবার গম্ভীর স্বরে বললেন,
____“তা আমার কোন মেয়েকে বিয়ে করতে চাও? প্রেরণা?”
সদাফ থমকালো।
থেমে বলল,
____“না, আমি আপনার ছোট মেয়ে পরিণীতা কে বিয়ে করতে চাই।”
সাদমান সিকদার ছেলেটাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরীক্ষা করে বললেন,
_____“দেখো বাবা, তুমি যথেষ্ট সাহসী ও সৎ। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি আমার মনমতো জামাই হতে পারো। কিন্তু আমার বড় মেয়েকে রেখে ছোট মেয়েকে তো বিয়ে দিতে পারি না।”
সদাফের মুখের উজ্জ্বলতা নিভে গেল। সে মাথা নিচু করে নিল।
সাদমান সিকদার তার অবস্থা দেখে বললেন,
_____“তুমি আমার প্রণয়ের বয়সী। তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নাও। আমার দোয়া সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে।”
সদাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
____“বিয়ে করলে আমি আপনার মেয়েকেই করবো। তার জন্য আমাকে যত বছর অপেক্ষা করতে হয়, আমি রাজি আছি। আপনি শুধু একটা কথা দিন—আপনি পরিকে অন্য কাউকে দেবেন না। আপনি আমাকে ওয়াদা করুন, আপনার বড় মেয়ের বিয়ের পরপরই পরিকে আমার হাতে তুলে দেবেন।”
সাদমান সিকদার প্রশস্ত হেসে সদাফের কাঁধ চাপড়ে বললেন,
_____“তোমার প্রচেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার মেয়েকে সত্যিই অনেক পছন্দ করো। তুমি চাইলেই আমার মেয়ের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়তে পারতে, কিন্তু তুমি তা করোনি। তুমি আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছো—আমি ইমপ্রেসড। তুমি একজন নামকরা সায়েন্টিস্ট, প্রতিষ্ঠিত, আমার মেয়ের জন্য উপযুক্ত। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি—আমার পরিকে তোমার সঙ্গেই বিয়ে দেব। আমার বড় মেয়ের বিয়ের পর, তুমি তোমার বাবা-মাকে নিয়ে এসো। তুমি যদি ততদিন অপেক্ষা করতে পারো, তবে পরিকে তোমার সঙ্গেই বিয়ে দেব।”
প্রফুল্ল হলো সদাফের মন।
সে তার জীবনের সবচেয়ে পছন্দের জিনিসটাকে নিজের নামে অলিখিতভাবে লিখিয়ে নিয়েছে।
সাদমান সিকদার যে এত সহজে রাজি হয়ে যাবেন, সেটা সদাফ ভাবতেই পারেনি।
সদাফ সাদমান সিকদারের পা ধরে সালাম করে বললো,
____“অনেক, অনেক ধন্যবাদ আঙ্কেল।”
সাদমান সিকদার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিলেন।
সদাফ আবার বললো,
____“আঙ্কেল, আমি এই মাসে UK ফিরে যাবো। আমার ছুটি শেষ। আপনার বড় মেয়ের বিয়ের পর আমি বাবা-মাকে নিয়ে আসবো।”
সাদমান সিকদার মৃদু হেসে বললেন,
____“সব ঠিক। তবে আমারও একটা শর্ত আছে।”
শর্তের কথা কানে আসতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো সদাফ।
— “কি শর্ত?”
সাদমান সিকদার কিছুটা রহস্যময় কণ্ঠে বললেন,
_____“আজকে যা কথা হলো, তা আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মধ্যেই থাকবে। কাউকে বলবে না—এমনকি প্রণয়কেও না।”
সদাফের কপালে বড় ভাঁজ পড়লো।
সে আশ্চর্য কণ্ঠে বললো,
___“কেন?”
সাদমান সিকদার বাঁকা হেসে বললেন,
____“প্রশ্ন কোরো না, শুধু যেটা বললাম মনে রেখো। এই কথা যদি পাঁচ কানে যায়, তবে তুমি আর পরিকে পাচ্ছো না।”
চমকে উঠলো সদাফ।
আগ-পিছ না ভেবে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
_____“আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আঙ্কেল। আজ আমাদের মধ্যে যা কথা হলো, তা আমার আর পরির বিয়ে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত কেউ জানবে না।”
সাদমান সিকদার হেসে বললেন,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৭
____“গুড বয়।”
সদাফও খুশি হলো।
সে আর কিছু জানতে চায় না, বুঝতেও চায় না।
সে যে কোনো মূল্যে শুধু পরিকে চায়।
পরি পাওয়া পর সিকদার পরিবার কেন এই পুরো দুনিয়া জাহান্নামে যাক—তাতে তার কিছুই যায় আসে না।