ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪১

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪১
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

পরিণীতা, প্রিয়তা, ইনায়া, পূর্ণ—সবাই মিলে পরিণীতার বারান্দার দোলনায় বসে আছে।
সকলের চিন্তা-চেতনা জুড়ে একটা জিনিসই বিরাজ করছে—চিত্রা।
পরিণীতা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে।
প্রিয়তা ব্যস্ত পায়ে অনবরত পায়চারি করতে করতে চিত্রার নম্বরে কল করে যাচ্ছে। ভয়ে রীতিমতো মেয়েটার শরীর ভিজে যাচ্ছে।
ইনায়া গালে হাত দিয়ে বললো,

“তলে তলে এত কিছু চলে, আর আমরা কিছুই না! প্রিয়ো, তুই ও আমাদের কিছু বললি না?”
পূর্ণতা একটু চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“ওসব কথা বাদ দিয়ে ভাব, এখন কী করবি? অতিরিক্ত হচ্ছে না সব কিছু? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
ইনায়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
“যদি চিত্রা আপু সত্যি সত্যি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলে? আমার মনে হয়, আমাদের আর সময় নষ্ট করা উচিত না—এখনই প্রেম ভাইকে সব জানানো উচিত।”
প্রিয়তা ৩০তম বার ফোন করে নিরাশ হল, পরিণীতার পাশে এসে দপাশ করে বসে পড়লো। উদ্ভ্রান্ত কণ্ঠে বললো,
“এখন কি করবো?”
পূর্ণতা বললো,
“চল, প্রেম ভাইয়াকে গিয়ে ডেকে আনি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ডেকে আনি’ বলতেই দাঁড়িয়ে পড়লো পূর্ণতা। সাথে সাথেই পরি ওর হাত টেনে বসিয়ে দিলো। বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“তোর মাথায় কি গোবর পুরা, পূর্ণ? এখন এই শেষ রাতে গিয়ে তুই ছোড়দা কে ডেকে তুলবি? তারপর কী বলবি—চিত্রা আপু তার জন্য পাগলামি করছে? ঊষা ভাবি কী ভাববে? ছোড়দা কী রিঅ্যাকশন দেবে, ভেবেছিস? আর সব থেকে বড় কথা, এখন কিভাবে ডাকবো দুজনকে? বিবেক কি গিলে খেয়েছিস?”
প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
“এত স্ট্রেস আর নেওয়া যায় না।”
প্রিয়তা বললো,
“আমার মনে হয় না ওরকম কিছু হবে, কারণ চিত্রা আপুর বাড়িতে অনেক লোক। যেভাবে চিৎকার দিয়ে কান্নাকাটি করছিল, আমি নিশ্চিত পাশে সবাই ছিল। তাই এই চিন্তাটা একটু কম কমলে ও চলবে। আর আমি এটা নিয়ে চিন্তা ও করছি না।”
ইনায়া কৌতূহলি কণ্ঠে বললো,

“তাহলে কি নিয়ে চিন্তা করছিস?”
প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ব্যথিত কণ্ঠে বললো, “আজ থেকে চিত্রা আপুর ধ্বংসের শুরু হলো। যতদিন না পর্যন্ত চিত্রা আপু ছোড়দাকে পুরোপুরি ভুলতে পারবে, ততদিন জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলে পুড়ে মরবে। কি ভীষণ যন্ত্রণায় কাটবে তার এক একটা দিন, একেকটা ক্ষণ!”
পরি প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আর আমার মনে হয় না, চিত্রা আপু কখনও ভুলতে পারবে। বিচ্ছেদের ঘা, তার না-পাওয়ার নিদারুণ যন্ত্রণা, তার আসক্তির পাহাড়—যা কখনোই ভালোবাসাকে ভুলতে দেয় না। বরং চক্রবৃদ্ধি হারে তা মনের গভীর থেকে গভীরে শিকড় গেড়ে নেয়। আর যেখানে ছোটো ভাবি চিত্রা আপুর বোন, সে খানে তো ছোড়দা তার চোখের সামনেই থাকবে—ভুলে যাওয়া কিভাবে সম্ভব?”

ওরা সকলেই ব্যথিত হল।
ইনায়া ভাবুক কণ্ঠে বললো,
“ঐ জন্যই বোধ হয় চিত্রা আপু প্রেম ভাইয়ার আশেপাশে সবসময় ঘুরঘুর করতো। তোমরা দেখোনি, আমি দেখেছি।”
সবাই ওর দিকে তাকালো।
ইনায়া আবার,
“হ্যাঁ, চিত্রা আপু প্রায় সময় প্রেম ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতো, কথা বলার বাহানা খুঁজতো, আরও কত কী! ওই যে প্রিথা আপুর বিয়ে হলো, তখন আরও অনেক কিছুই দেখেছি। কিন্তু বেশি ভাবিনি, কারণ ভাইয়াকে কখনো চিত্রা আপুর দিকে তাকাতে দেখিনি বা কথা বলতে দেখিনি।”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো পরিণীতা। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললো,

“দুনিয়ার সব ঝামেলা কি ভাইদের সাথেই হওয়ার ছিল? সকল যামেলা-যন্ত্রণা কি আমার ভাইদের কেই দেখে?”
আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“প্রথমে বড় দাদনকে সীমাহীন যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখতাম, তবু নিজের মনকে বুঝতে দিতাম—ওদের ভালোবাসা দুই তরফা, কষ্ট পেলে দুজনেই পাচ্ছে। কিন্তু ছোড়দার ব্যাপারটা অন্যরকম। চিত্রা আপুর ভালোবাসা একপাক্ষিক। এখন চিত্রা আপুর এই একতরফা পাগলামির জন্য না আবার ছোটো দাদনের জীবনে কোনও ঝড় নেমে আসে! প্রিয় যে বর্ণনা দিলো, তাতে মনে হয় না চিত্রা আপু কখনও ছোড়দাকে ভুলতে পারবে। জানি না, কোন ঝড় অপেক্ষা করছে।”

ওদের কথা বলার মাঝেই প্রিয়তা লক্ষ্য করলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যোদয় হবে।
বাহিরের দিকে তাকিয়ে তার কিছু একটা মনে আসতেই তার সকল চিন্তা পালিয়ে গেলো, মন প্রফুল্ল হল। সে চিত্রা, প্রেম, সবার ভাবনা এক পাশে রেখে চট করে উঠে দাঁড়ালো।
প্রিয়তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ইনায়া বললো, “কোথায় যাচ্ছিস?”
প্রিয়তা কিছু না বলে একপ্রকার দৌড় দিলো।
অবাক হয়ে গেলো ইনায়া। প্রিয়তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবারও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো পরিণীতা। কারণ, সে ভালোই জানে প্রিয়তা এখন কোথায় যাবে।

প্রিয়তা দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে সেটা নিয়ে দৌড় দিলো উপরের দিকে।
দুই মিনিটের মধ্যেই শিকদার বাড়ির দীর্ঘ সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে গেলো।
আলতো হাতে ছাদের দরজা ঠেলতেই সামনে দৃশ্য দেখেই প্রিয়তার মাসুম মন বড়সড় একটা ক্রাশ খেয়ে বসলো।
অন্ধকার আকাশে একটু একটু সূর্যকিরণ উঁকি দিচ্ছে।
প্রণয় ছাদের মাঝখানে স্কিন টাইট ট্র্যাক প্যান্টের সাথে মাসলস ফিট র‍্যাক পরে পুশ-আপ দিচ্ছে।
আলো-অন্ধকারের মধ্যে তার পুরুষালী পেটানো শরীরটা প্রিয়তার নজর কাড়ছে।
প্রিয়তা নিজের অজান্তেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলো প্রণয়ের দিকে—
প্রণয়ের গা, কাঁধ, বুক ঘামে ভিজে পাতলা স্কিনি গেঞ্জিটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে।
উন্মুক্ত হাত, বুক, কাঁধের পেশিগুলো বেয়ে স্বচ্ছ ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে।
প্রিয়তার গালে হাত দিয়ে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে গিলে খাচ্ছে প্রণয় ভাইকে।
প্রণয় ভাইয়ের হটনেস দেখে প্রিয়তার মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে এলো—

“হট চকলেট!”
প্রণয় পুশ-আপ দিতে দিতে প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“এই শেষ রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কী করিস?”
আচমকা প্রণয়ের পুরুষালী কণ্ঠে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেল তার।
তাড়াতাড়ি চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“সকালের ফ্রেশ এয়ার নিতে এসেছি।”
প্রণয় পুশ-আপ দেওয়া বন্ধ করে বসল। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখন সকাল?”
প্রিয়তা আবার ফেঁসে গেল। আমতা আমতা করে বলল,

“মামানে… একটু পর তো হবেই… তাই আগে আগেই চলে এসেছি, যাতে সূর্যোদয়টাও দেখতে পারি।”
প্রিয়তার চোখ লুকিয়ে মিথ্যে বলা দেখে হেসে ফেললো প্রণয়।
প্রিয়তা মনে মনে আফসোস করে বলল,
“বেটা! আমায় দেখেই পুশ-আপ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে!
আমি গাধা, কেন যে সামনে গেলাম!”
সে আবার নিচু কণ্ঠে বলল,
“আপনার পুশ-আপ দেওয়া শেষ, প্রণয় ভাই?”
প্রণয় শান্ত চোখে তাকালো প্রিয়তার দিকে।
প্রিয়তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বাঁকা হেসে বলল,

“হুম।”
মন খারাপ হয়ে গেল প্রিয়তার।
যা দেখতে ছুটে এলো, সেটাই আর হলো না।
সে মন খারাপ করে বলল,
“ওহ…”
প্রিয়তাকে মুখ অন্ধকার করে ফেলতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো প্রণয়।
প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু কণ্ঠে বলল,
“ইচ্ছে তো ছিল আরও ১০০ খানিক দেওয়ার…”
প্রণয়ের মুখের কথা কসার আগেই প্রিয়তার মুখ ঝলমল করে উঠলো।
উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল,

“তাহলে দিন!”
প্রণয় হতাশ হয়ে বলল,
“থাক, আজ আর দেবো না। জিমে গিয়ে ৫০ কেজি ডাম্বেল তুলবো।”
প্রিয়তার হাসি হাসি মুখটা আবারো অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেল।
মুখ কালো করে বলল,
“কেন? এই না বললেন দিবেন। তাহলেই আবার জিমে গিয়ে ডাম্বেল তোলার কী দরকার?
এখানেই পুশ-আপ দিন না!”
প্রণয় আবারো হতাশ কণ্ঠে বলল,

“৫০ কেজি তুলতে হবে। এখানে আমি ৫০ কেজি কোথায় পাবো?”
প্রিয়তা মন খারাপ হলো। কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“৫০ কেজি নেই, ৪৮ কেজি আছে! চলবে?”
প্রিয়তার কথায় প্রশস্ত হাসলো প্রণয়।
প্রিয়ার মনের বাসনা বুঝে বলল,
“ঠিক আছে। ৪৮ কেজিই না হয় দে।”
প্রিয়তা লাজুক হাসলো, লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন।”

প্রণয় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে পুশ-আপ দেওয়ার ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লো।
প্রিয়তা হাতের ব্রাশটা রেলিংয়ের উপর রেখে ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল প্রণয়ের কাছে।
তার কেমন গলা শুকাচ্ছে, বুকও হালকা হালকা কাঁপছে।
কিন্তু নিজের কাপাকাপি বন্ধ করে প্রণয়ের পিঠের ওপর শুয়ে পড়লো।
নিজের ওপর ছোট্ট দেহের ভারটা অনুভব হতেই তীব্র শান্তিতে বুকটা ভরে গেল প্রণয়ের।
ঠোঁটে ফুটে উঠলো প্রশান্তিময় হাসি।
প্রিয়তা রিনরিনে কণ্ঠে বলল,

“দিন এখন।”
প্রণয় হেসে আবারো পুশ-আপ দিতে শুরু করলো।
আর প্রিয়তা মনপ্রাণ ভরে প্রণয়ের ঘামে ভেজা শরীরের গন্ধ নিজের মধ্যে শোষেনিতে লাগলো।
প্রতিদিন সকালে জিমে ওয়ার্ক আউট করার আগে এক ঘন্টা করে পুশ-আপ দেওয়ার প্রণয়ের নিত্য অভ্যাস।
আগে প্রায়ই এমনভাবে প্রিয়তাকে পিঠে নিয়ে পুশ-আপ দিতো।
আর প্রিয়তা নেশাগ্রস্তের মত প্রণয়ের ঘামে ভেজা শরীরের ঘ্রাণ নিতো।
এটা প্রিয়তার ভীষণ পছন্দের একটা বিষয়।
প্রণয়ের নরমাল দেহের ঘ্রাণের চেয়ে প্রণয়ের ঘামে ভেজা শরীরের ঘ্রাণ আরও অনেক বেশি মাদকীয় ও ম্যানলি লাগে প্রিয়তার কাছে।
তার প্রচণ্ড অবসেশন এই ঘ্রাণের ওপর।

আগে যখনই প্রণয় বাইরে থেকে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে আসতো, তখনই প্রিয়তা বুকে মুখ লুকিয়ে ঘামে ভেজা গায়ের গন্ধটা নিতো।
ম্যানলি পারফিউমের সাথে ঘামের গন্ধ মিলেমিশে একদম একাকার — ড্রিঙ্ক না করেও পুরো মাতাল মাতাল একটা অবস্থা!
প্রিয়তা ধীর কণ্ঠে শুধালো,

“কষ্ট হচ্ছে, প্রণয় ভাই?”
প্রণয় পুশ-আপ দিতে দিতে মৃদু ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
“তুই কি কোনভাবে আমার এবিলিটি নিয়ে সন্দেহ করছিস?
তোর কি আমাকে পুষ্টিহীনতায় ভোগা মানুষ বলে মনে হয়?
তোর মতো আরও দুটোকে প্রণয় শিকদার এক হাতে তোলার সামর্থ্য রাখে।”
একটা কথা জিজ্ঞেস করার এতগুলো কথা শুনিয়ে দেওয়াতে হতভম্ব হয়ে গেল প্রিয়তা।
মনে মনে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,

“এই জন্যই মানুষের ভালো চাইতে নেই।”
প্রণয় আরও বেশি ঘামতে লাগলো।
প্রায় ১০০টা পুশ-আপ কমপ্লিট করে থামলো।
ছাদের রেলিংয়ের কাছে এক হাত উঁচু করে পুরো ছাদ প্লাস্টার করা সেই উঁচু অংশে প্রণয় আর প্রিয়তা বসে পড়লো।
ততক্ষণে পূর্ব আকাশে ক্ষীণ রক্তিম সূর্যের দর্শন মিলছে।
প্রিয়তা দেখলো প্রণয়ের সারা শরীর বেয়ে নদীর স্রোতের মতো ঘাম ছুটছে।
সে নিজের ওড়নাটা দিয়ে আলতো হাতে প্রণয়ের গাল, গলা, বুক, কাঁধ মুছে দিতে লাগলো।
প্রণয় তীব্র আসক্তিময় চোখে তাকিয়ে রইলো প্রিয়ার মায়াময় মুখের দিকে।
নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে ডাকলো,

“জান…”
হাত থেমে গেল প্রিয়তার।
চোখ তুলে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল—
“তোকে যতো দূরে দূরে রাখতে চাই, তুই ত তো কেন কাছে চলে আসিস? কেন আমার সকল ভাবনা এলোমেলো করে দিস?

তোর নিষ্পাপ মুখ, বোকা চোখের চাউনি, তোর নরম স্পর্শ আমাকে স্থির থাকতে দেয় না, মনকে শক্ত করে রাখতে দেয় না, মুহূর্তে ভেঙে চুরে গুঁড়িয়ে দেয় মনের শক্ত থেকে শক্ত দেওয়ালটা ও।
তোর নিঃশ্বাসের উষ্ণতা আমার অভ্যাস, তোর কন্ঠের মিষ্টতা আমার মরণের অসুখ। তুই বুঝে গেছিস তাই না?
এই প্রণয় শিকদার তার জানটাকে ছাড়া একদম থাকতে পারে না। তার জানটাকে না দেখে নিঃশ্বাস নিতে পারে না।
তাই বারবার ভালোবাসার লোভ দেখাস?
আমি চাই তুই আমায় ভুলে যা, সাথে এটা ও চাই, তুই যেদিন আমায় সত্যি সত্যি ভুলে যাবি, সেদিনই যেন এই পৃথিবীতে আমার শেষ দিন হয়।”
প্রিয়তা প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

“কি?”
প্রিয়তার কন্ঠে প্রণয়ের ভাবনার সুতো ছিঁড়লো।
সে প্রিয়তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিচক্ষণ চোখে তাকালো প্রিয়তার দিকে।
উল্টো প্রশ্ন ছুরলো—
“মুখের অবস্থা এমন কেন? কিসের চিন্তা করছিস তুই?”
থমকে গেল প্রিয়তা। এটাও বুঝে গেছেন! এখন কী জবাব দেবে সে?
প্রণয় ভাইকে এসব কীভাবে বলবে?
প্রণয়ের দিক থেকে চোখ নামিয়ে আমতা আমতা করতে শুরু করলো—
সাথে সাথে ভ্রু কুঁচকে ফেলল প্রণয়।
প্রিয়তার গাল ধরে মুখ উঁচু করে তুলল।
ভ্রু নাচিয়ে বলল—

“বল, কি নিয়ে এতো চিন্তা করছিস? দেখে তো মনে হচ্ছে রাতে ও ঠিকমতো ঘুমাসনি!”
প্রিয়তা বিপাকে পড়ে গেল।
প্রণয় ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলার মতো বুকের জোর তার নেই।
তাহলে এখন এসব প্রেম-ভালোবাসার কথা প্রণয় ভাইকে বলতে হবে?
প্রণয় প্রিয়তার আরেকটু কাছে চলে এলো।
নরম গালে স্লাইড করতে করতে আদুরে কণ্ঠে ডাকল—

“জান।”
কেঁপে উঠল প্রিয়তা।
চোখ বন্ধ করে গরগর করে বলতে লাগলো—
“একটা বিষয় নিয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে আছি, তাই রাতে ঘুমাতে পারিনি।”
এবারও আরও খানিকটা ভ্রু কুঁচকে গেল প্রণয়ের।
কপালে ভাজ ফেলে বলল—
“কি?”
প্রিয়তা প্রণয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলল, আমতা আমতা করে বলতে লাগল—

“কাল ছোড়দা বিয়ে করেছে।
“তো”
” তো ছোট ভাবীর বড়ো বোন চিত্রা আপু ছোটদা কে অনেক পছন্দ করে।”
“তারপর”
“তারপর কাল মাঝরাতে চিত্রা আপু আমাকে ফোন করে বলে—ছোড়দাকে ফোন না দিলে উল্টা-পাল্টা কিছু একটা করে ফেলবে।”
“হুম, তারপর”

“তারপর আমি পরি আপুকে বলি—আপু ছোড়দাকে ডাকতে নিষেধ করে দিয়েছে।
এখন চিত্রা আপু কী করবে, না করবে, তা নিয়ে চিন্তায় আছি।”
পুরো কথাটা প্রিয়তা প্রণয়ের চোখের দিকেই তাকিয়ে বলল।
প্রণয় ও খুব কাছ থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নিজের প্রাণের দিকে।
সব শুনে প্রণয় শান্ত কণ্ঠে বলল—
“যা হবার হবে। এগুলো তাদের একান্ত পার্সোনাল ম্যাটার।
এখানে তোর কোনো ভূমিকা নেই, আর মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তোর ছোট্ট মাথাকে এত চাপ দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

তাদের কোনো বিষয়েই কথা বলবি না, বুঝেছিস?”
প্রিয়তা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল।
প্রণয় কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল—
“গুড গার্ল।”
প্রিয়তা পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় হাত বাড়িয়ে রেলিং থেকে ব্রাশ নিয়ে প্রিয়তার মুখের সামনে ধরে বলল—
“হা কর।”

প্রিয়তা প্রণয়ের হাতে ব্রাশ দেখে মুখ ছোট করে ফেলল।
এখন ২০ মিনিট ধরে তার উপর অত্যাচার হবে!
প্রিয়তাকে মুখ কালো করে ফেলতে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল প্রণয়।
দুই গাল চেপে ধরে দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিতে দিতে বলল—
“নিশ্চয়ই চাস না ছুট বেলার মতো সারা বাড়ি ছুটে তোকে ধরে বেঁধে ব্রাশ করিয়ে দেই!”
প্রিয়তা সাথে দুই পাশে মাথা নাড়ালো।
প্রণয় তার সামনে দাঁতে ব্রাশ চালাতে চালাতে বলল—

“তাহলে না, নড়ে চুপচাপ বস।”
প্রিয়তা ও একদম স্থির হয়ে গেল।
প্রণয় সময় নিয়ে ঘষে ঘষে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে বলল—
“এখন ঘরে গিয়ে কী করবি, বল তো?”
প্রিয়তা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল—
“ফ্রেশ হয়ে নিচে যাব।”
প্রণয় তার ঠোঁটের দুই পাশে লেগে থাকা ফেনা বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠে বলল—
“যদি মার না খেতে চাস, তবে ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়বি।
আর অন্যের বিষয়ে বেশি মাথা ঘামাবি না। মনে থাকবে?”
প্রিয়তা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল—

“হুম। ঠিক আছে, যা।”
প্রিয়তা প্রণয়কে আরও কয়েক সেকেন্ড মন ভরে দেখে নিয়ে উঠে চলে গেল।
প্রণয় চেয়ে রইল প্রিয়তার যাওয়ার পানে।
সকাল সাতটা।
অনবরত দরজায় কড়াঘাতের শব্দে ঘুম হালকা হয়ে এল প্রেমের। সে বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকালো, ঝাপসা চোখে চোখ মেলে তাকালো, আশপাশ হাতড়ে সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে চশমা নিয়ে চোখে পরল। উঠে বসতে গিয়ে বাধা প্রাপ্ত হলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো, ঊষা তার পাঞ্জাবির কলার দুই হাতে মুঠো করে ধরে শিশু সুলভ ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে।
প্রেম সন্তর্পণে ঊষার হাত ছাড়িয়ে উঠে দরজা খুলে দিল। প্রহেলিকা হাতে শাড়ি, গয়না আর আরও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রেম কপাল কুঁচকে বলল,

“বড় আপু, তুমি এত সকালে?”
প্রহেলিকা হেসে বলল,
“বড় আম্মু পাঠিয়েছেন, তোর বউকে রেডি করে নিয়ে যেতে। কিছু নিয়ম-আচার বাকি আছে। তা, কোথায় তোর বউ?”
প্রেম দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো।
প্রহেলিকা ঘরে প্রবেশ করে চারপাশে চাইল।
প্রেম ধীরে কণ্ঠে ঊষাকে ডাকলো,
“এই ঊষা, ওঠো, সকাল হয়ে গেছে।”
ঊষা একটু নড়ে চড়ে প্রেমের হাত জড়িয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
প্রহেলিকা মুচকি মুচকি হাসছে।
প্রেম আবার ডাকলো,

“এই ঊষা, ওঠো।”
ঊষা এবার পিটপিট করে তাকালো।
প্রেম তাকে অর্ধঘুমে অবস্থায় তুলে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“বড় আপু এসেছেন, দেখো।”
ঊষা বোকা চোখে তাকালো প্রেমের দিকে। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠায় তার ব্রেইন কাজ করছে না।
প্রহেলিকা গিয়ে ঊষার পাশে বসলো।
প্রেম ওয়ারড্রোব থেকে ট্রাউজার-টি-শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
প্রহেলিকা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ১৪-১৫ বছর বয়েসি মেয়েটার দিকে। মেয়েটা বেশ সুন্দর।
প্রহেলিকা মিষ্টি কণ্ঠে বলল,

“ঘুম ভালো হয়েছে?”
ঊষা প্রহেলিকার দিকে তাকালো।
প্রহেলিকা বসতে বসতে বলল,
“তুমি আমাকে দেখো নাই? আমি প্রেমের বড় আপু।”
ঊষার দৃষ্টির পরিবর্তন হলো, সাথেসাথেই সালাম দিল।
প্রহেলিকা মেয়েটার সুশিক্ষার উপর প্রসন্ন হলো।
হাতে করে আনা খয়েরি শাড়িটা ঊষার হাতে দিয়ে বলল,
“এটা বড় আম্মু দিয়েছেন। গোসল সেরে এটা পরে রেডি হয়ে নিচে আসো।”
ঊষা হাত থেকে শাড়ি নিয়ে কিছুটা অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

“এত সকালে গোসল করবো, আপু? আরেকটু বেলা হলে করি?”
প্রহেলিকা একটু ইতস্তত করে বলল,
“এটাই নিয়ম। তাই এখনই গোসল করে এটা পরে নিও।”
ঊষা এবার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
প্রহেলিকা একটা মেডিসিনের পাতা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা থেকে একটা খেয়ে নাও।”
ঊষা সেটা হাতে নিয়ে দেখলো, বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আমি তো অসুস্থ না, আপু! ঔষধ কেন খাবো?”
প্রহেলিকার একটু লজ্জা লাগলো। যতোই হোক, ছোট ভাইয়ের বউ। সে একটু নিচু কণ্ঠে বলল, “এটা পেইনকিলার। একটা খেয়ে নাও, শরীরের সব ব্যথা-বেদনা চলে যাবে।”
ঊষা এবার আরো বড় বড় করে তাকালো প্রহেলিকার দিকে, আপত্তি জানিয়ে বলল,

“আমার তো কোথাও ব্যথা নেই, আপু!”
প্রহেলিকা ভ্রু কুঁচকালো।
ঊষাকে মাথা থেকে পা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো।
একটু কৌতূহলী কণ্ঠে বলল,
“তোমার হাতে-পায়ে, গায়ে ব্যথা নেই?”
ঊষা দুই পাশে পাশে মাথা নাড়ালো।
প্রহেলিকার চতুর মস্তিষ্ক যা বোঝার বুঝে নিলো। সে ঊষার হাত থেকে মেডিসিনের পাতাটা নিয়ে বলল,
“তাহলে থাক, এটা খেতে হবে না। তুমি শুধু গোসল সেরে এটা আর কিছু গয়না আছে, ওগুলো পরে নিচে চলে আসো, কেমন?”

ঊষা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
প্রহেলিকা হেসে বেরিয়ে গেল।
ঊষা উঠে বিছানাপত্র গুছিয়ে পিছন ফিরে থাকাতেই ঝটকা খেলো।
আপনা-আপনি আবারো তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো।
প্রেম শুধু ট্রাউজার পরে, কাঁধে টি-শার্ট ঝুলিয়ে, টাওয়াল দিয়ে গা মুছতে মুছতে বেরিয়েছে।
তার উন্মুক্ত পুরুষালি ফরসা পৃষ্ঠ, চওড়া কাঁধ, পিঠ বেয়ে বিন্দু বিন্দু জলের কণা গড়িয়ে পড়ছে।
হাতের ও কাঁধের পেশিগুলো টাইট হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
ঊষা দ্রুত নিজের চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।
তার বুক অস্বাভাবিক হারে কাঁপছে।
সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তুতলিয়ে বলল,

“এই ক্কি! আপনি খা… খালি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? প্লিজ ক… কিছু পরেন, আমার লজ্জা লাগছে।”
ঊষার কণ্ঠে পিছু ফিরে তাকালো প্রেম।
ঊষাকে আবার কাল রাতের মতো কাঁপতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো।
গা মুছা বাদ দিয়ে ঊষার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
তীক্ষ্ণ চোখে ঊষার কাঁপাকাঁপি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বুকে হাত গুঁজে বলল,

“চোখ খোলো।”
ঊষা খোলে না, বরং আরও জোরে খিঁচে বন্ধ করে নিলো।
প্রেম দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁধের টি-শার্টটা পরে নিলো।
“এবার চোখ খোলো।”
ঊষা ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো।
বুকের কাঁপন কিছুটা কমেছে।
সে আর প্রেমের দিকে না তাকিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
প্রেম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের আর্ট গ্যালারিতে চলে গেল।
প্রিয়তা, পরিনিতা, ইনায়া, পূর্ণতা, প্রেরণা, থিরা—সবাই ভিড় জমিয়েছে শিকদার বাড়ির রান্নাঘরে। আজকের সব রান্না তাদের ছোট ভাবী করবে। অনুশ্রী বেগম উষার মাথায় হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বললেন,

“মা, তুমি সব পারবে না। আমরা হেল্প করে দেই।”
ঊষা চমৎকার হেসে বলল,
“না আম্মু, আমি সব পারবো।”
অনুশ্রী বেগম নিজের ছেলের বউয়ের দিকে প্রসন্ন তাকালেন। কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“যদি কিছু দরকার হয় ডাক দেবে।”
ঊষা মাথা নাড়লো। অনুশ্রী বেগম চলে গেলেন।
ইনায়া দুষ্টু দুষ্টু হেসে বললো,

“ভাবী, কালকে ঘুম কেমন হলো?”
“প্রেম ভাইয়া বাসর রাতে কী গিফট দিলো?”
ঊষা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। লাজুক কণ্ঠে বললো,
“দোয়া করে দিয়েছেন।”
ওরা একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো—
পরিনিতা ঊষার গলায় উঁকি ঝুঁকি মারতে মারতে বললো,
“উহু উহু ভাবী, কোন লাভ সাইন দেখছি না কেন? ভাইয়া নিশ্চয় অনেক রোমান্টিক!”
ইনায়া একচোখ টিপ দিয়ে বললো,

“এত সুন্দর বউ পেয়েও রোমান্টিক না হলে ভাইয়ের জীবনটাই বৃথা। আমি যদি প্রেম ভাইয়ার জায়গায় থাকতাম, আগামী ১০ দিন ঘর থেকেই বের হতাম না। ঘরের বাইরে বড় বড় করে লিখে রাখতাম
‘Do Not Disturb!’”
প্রিয়তা হাই তুলে বললো,
“রোমান্টিক হোক আর যাই হোক, তোমার জামাই মস্ত কিপটা! আমাদের বাসর সাজানোর টাকাটাও পর্যন্ত দেয়নি!”
ঊষা মিষ্টি বানাতে বানাতে লাজুক হেসে বললো, “উনাকে বলে দেব, আপনাদের টাকা দিয়ে দিতে।”
ওদের কথাবার্তার মাঝেই ঊষা কারো গলা শুনে চমকে উঠলো। পরিনিতা, প্রিয়তা আর ইনায়ারও পিলে চমকে উঠলো।
ঊষা রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে দেখলো, ড্রইং রুমে চিত্রা আর কুহু দাঁড়িয়ে আছে। কুহুর চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে, সে-ও ভীষণ ঘাবড়ে আছে।
চিত্রা জোরে জোরে প্রেমকে ডাকছে। ঊষা আপুকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। ইনায়া পরিনিতার হাত চেপে ধরে ভয়ে ভয়ে বললো,

“আপু, আমার ভীষণ ভয় করছে।”
পরিনিতা আর প্রিয়তারও বুক ধড়ফড় করছে।
উষা ছুটে গিয়ে চিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
“আপু, তুমি এসেছো!”
উষা দেখে আবার চিত্রা শান্ত হয়ে গেলো। চিত্রার গলা শুনে অনন্য সমুদ্র, অনুশ্রী বেগম আর তনুশ্রী বেগম বেরিয়ে এলেন।
চিত্রার চেহারার সৌন্দর্য মলিনতায় ঢাকা পড়েছে। চোখের সাদা অংশ রক্তাভ। দেখে ঠিক লাগছে না। সে অশ্রু চোখে উষার দিকে তাকাতেই টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো।
উষার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিকদার বাড়ির বউদের মতো—গায়ে দামি শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, হাতে-কানে স্বর্ণের ভারী গয়না।
এই সাজটা বুঝি তার প্রেমের বউ হিসেবে।
চিত্রার চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্রেমকে দেখার জন্য গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে।
প্রিয়তা লক্ষ্য করলো, চিত্রার ভাব ভালো না। সে ছুটে গিয়ে চিত্রার এক হাত চেপে ধরলো। চোখের ইশারায় কাঁদতে মানা করলো।

অনুশ্রী বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
“উষা, তুমি চিত্রাকে চেনো?”
উষা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালো,
“কে হয় আমার?”
—“আমার আপু।”
—“মানে তুমি যে বলেছিলে তোমার কেউ নেই?”
পরিনিতা অনুশ্রী বেগমকে পুরো ঘটনা খুলে বললো।
অনুশ্রী বেগম বিস্মিত, হতবম্ভ। তিনি অবাক কণ্ঠে বললেন,
“চিত্রার পরিবার তোমার সাথে এমন করেছে!”
লজ্জিত হলো চিত্রা। মাথা নিচু করে নিলো।
উষা মাথা নিচু করে বললো,

“আম্মু, চিত্রা আপু আমাকে সবসময় রক্ষা করেছে। চিত্রা আপু না থাকলে, হয়তো আমি ও থাকতাম না!”
অনুশ্রী বেগম চিত্রার দিকে তাকালেন, মৃদু হেসে বললেন,
“আমি জানি চিত্রা কতটা ভালো মেয়ে, কিন্তু চিত্রার মতো মেয়ের পরিবার—এমন ভাবতেই কেমন লাগছে।”
তনুশ্রী বেগম বললেন,
“ছাড়েন তো বড় আপা!”
তিনি চিত্রার উদ্দেশে বললেন,

“আসো মা!”
চিত্রার পা এগোচ্ছে না। তার এসব কিছুই ভালো লাগছে না। সে শুধু প্রেমকে দেখতে চায়।
পরিনিতা, প্রিয়তা কে ইশারা দিলো।
প্রিয়তা বললো,
“নাস্তার সময় চলে এসেছে। ভাবী, তাহলে তুমি চিত্রা আপুর সাথে কথা বলো, আমরা রান্নাটা সেরে নেই।”
উষা সাথেসাথেই আপত্তি জানিয়ে বললো,
“না না আপু, আমি করবো!”
উষা চিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি যাবে না আপু। তোমার সাথে অনেক কথা আছে।”

বলে চোখের পানি মুছে রান্নাঘরে চলে গেলো।
অনুশ্রী বেগম আর তনুশ্রী বেগমও চলে গেলেন।
পরিনিতা আর প্রিয়তা চিত্রাকে ধরে তাদের ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
প্রিয়তা রিকুয়েস্ট করে বললো,
“আপু, প্লিজ, এই বাড়িতে কাউকে কিছু বলো না। নাহলে বিশাল সমস্যা হয়ে যাবে।”
চিত্রা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।
প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আহত কণ্ঠে বললো,
“আমি কাউকে কিছু বলবো না, আমাকে শুধু একটু প্রেমকে দেখতে দাও, প্লিজ! আমি একটু আমার প্রেমকে দেখবো!”

থেমে গেলো ওরা।
প্রিয়তা চিত্রার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “এই চোখের পানি মানুষকে দেখিও না আপু, তারা তোমাকে ছোটো করবে, কিন্তু তোমার ব্যথাটা বুঝে তার মূল্যায়ন করবে না!”
চিত্রা এবার কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো। চোখ মুছে বললো,
“প্লিজ, আমাকে প্রেমের কাছে যেতে দাও!”
প্রিয়তা আরো কিছু বলতেই চাচ্ছিল কিন্তু পরিনিতা তাকে থামিয়ে দিলো।
চিত্রাকে টেনে তুলে বললো,

“ছোড়দা আর্ট গ্যালারিতে আছে।”
ইনায়া দরজা খুলে দিলো।
চিত্রা আর কারো দিকে না তাকিয়ে উন্মাদের মতো ছুটলো।
পূর্ণতা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“এটা কী করলি পরি? চিত্রা আপু এখন এগুলো প্রেম ভাইয়াকে বলবে।”
—“প্রেম ভাইয়া এগুলো জেনে কি করবে? শুধু শুধু বিব্রত হবে? প্রেম ভাইয়া এখন বিবাহিত!” এটা চিত্রা আপুর বুঝা উচিত।

—“চিত্রা আপুর এসব অনুভূতির কথার এখন আর কোনো মূল্য নেই।”
পূর্ণতার কথায় প্রিয়তার বুকের রক্ত ছলকে উঠলো।
তার অবস্থানও তো একই। মুহূর্তেই চোখে অশ্রু চলে এলো প্রিয়তার।
পূর্ণতা আবার বললো,
“এখন প্রেম ভাইয়া চিত্রা আপুর ছোট বোনের স্বামী। আর ছোটো বোনের স্বামীকে ভালোবাসার কথা বলা—কতো জঘন্য একটা ব্যাপার!”
—“তুই কেন যেতে দিলি?”
পরিনিতা পূর্ণতার দিকে তাকালো, শান্ত কণ্ঠে বললো,

—“তুই কখনো কাউকে ভালোবাসিসনি, তাই না? তাই ভালোবাসার মানুষ হারালে কোথায় লাগে—তুই বুঝবি না! একটা গভীর প্রেম মনের কতটা গভীরে থাকে, আর সেটা অন্যের হয়ে গেলে—তার কতটা পোড়ে, সেটা ভালো না বাসা মানুষগুলো কোনো দিনও বুঝতে পারবে না। এমনকি আমি ও বুঝতে পারবো না।
চিত্রা আপুর অনুভূতিগুলো—কারণ, আমার জীবনে কোনদিনও এমন পরিস্থিতি আসেনি। আর যারা কোনদিন এমন পরিস্থিতিতে পড়েনি, তারা কিভাবে বুঝবে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা কতটা!

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে—আমি যাকে ভালোবাসি, সে-ও আমাকে ভালোবাসে।
আর পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ব্যাপার হচ্ছে—আমি যাকে ভালোবাসি, সে অন্য কারো!
আমি প্রথম শ্রেণির মানুষ, আমি যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে তার জীবনের থেকেও ভালোবাসে—তাই আমি বুঝবো না।
কিন্তু অনুভব করার চেষ্টা তো করতে পারি।
এখন ছোড়দার কাছে চিত্রা আপুকে যেতে না দিলে—তোর কি মনে হয়, সব ঠিক হয়ে যেত?”

—“কখনই না!
—“হ্যাঁ, ছোড়দা—উষার স্বামী।”
—“সেটা আমরা বললে চিত্রা আপু বুঝতে চাইবে না, মানতেও চাইবে না। এটা ছোড়দাকে বলতে হবে।”
—“তাই চিত্রা আপুকে নিজেকে সামলানোর জন্য হলেও, অন্তত একবার ছোড়দার সাথে কথা বলাটা জরুরি!”
চুপ হয়ে গেলো পূর্ণতা।
আসলে পরি ভুল কিছু বলেনি।
ওরা সকলে একযোগে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।

প্রেম নিজের আর্ট গ্যালারিতে মনোযোগসহকারে পেইন্টিং করছে। তার যে আর্ট এক্সিবিশন হওয়ার কথা ছিল, সেটা আপাতত বাতিল হয়ে গেছে। তাই সেটার জন্য আরও কিছু পেইন্টিং দ্রুত বানানো প্রয়োজন।
প্রেম গভীর মনোযোগে হাত চালাচ্ছিল। হঠাৎ একটা শব্দ কানে আসতেই হাত থেমে গেল প্রেমের। সে পেছন ঘুরে সামনে তাকাতেই ঝড়ের বেগে কেউ এসে বুকে আঁচড়ে পড়ল। তাল সামলাতে না পেরে প্রেম দু’কদম পিছিয়ে গেল।
চিত্রা প্রেমের টি-শার্ট খামচে ধরে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। করুণ কণ্ঠে বলল,

— “এমন কেন করলে প্রেম? তোমার কি একবারের জন্য আমার কথা মনে পড়লো না? তুমি কেন একবারের জন্যও বুঝলে না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? কেন আমায় এভাবে শেষ করে দিলে প্রেম? কেন আমার মোনাজাতে রাখা বুকটা অন্য কারও নামে লিখে দিলে? কেন এমন করলে প্রেম? কেন? এর থেকে তুমি নিজে আমাকে শেষ করে দিতে, বিশ্বাস করো এত কষ্ট হতো না! আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না প্রেম, মনে হচ্ছে কেউ আমার কলিজাটা ধরে টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি প্রেম, একদম শেষ হয়ে যাচ্ছি।
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি , প্রেম।
থমকে গেল প্রেম। এক ঝটকায় চিত্রাকে সরিয়ে দিল নিজের কাছ থেকে। চিত্রার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে প্রেমের বুকে কোথাও একটা হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল। চিত্রার বলা বাক্যে কালকের মাটি চাপা দেওয়া অনুভূতিগুলো সচল হয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
তবুও প্রেম নিজেকে শক্ত করে রুক্ষ কণ্ঠে বলল,

— “এসব কী আচরণ চিত্রা? বলা নেই, কওয়া নেই—এভাবে জড়িয়ে ধরার মানে কী? আর কী সব আবোল-তাবোল বলছো?”
চিত্রা আহত চোখে তাকাল প্রেমের দিকে। আবারো শক্ত করে প্রেমকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলল,
— “প্লিজ প্রেম, আমাকে একটু শান্তি দাও। না হলে আমি এখনই নিশ্বাস আটকে মরে যাব। বিশ্বাস করো, অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার।”
প্রেমের অজান্তেই চোখের কোণে পানি চলে এল। তবুও সে নিজেকে শক্ত রাখল। আবার চিত্রাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,

— “আমাকে টাচ কোরো না চিত্রা। আমি বিবাহিত।”
প্রেমের মুখে “বিবাহিত” কথাটা চিত্রার হৃদয়টা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। সে এবার কাঁদতে কাঁদতে প্রেমের সামনে লুটিয়ে পড়ল। ধরা গলায় বলল,
— “হয় আমাকে মেরে ফেলো প্রেম, না হয় যেভাবেই হোক আমাকে তোমার করে রাখো। আমি পৃথিবীর আর কিছু বুঝতে চাই না, শুধু তোমার কাছে একটু স্বস্তি চাই।”
চিত্রার এমন অবস্থায় প্রেমের মস্তিষ্কের সবকিছু গুলিয়ে যেতে লাগল। কাল যে ব্যাপারটা অত্যন্ত সহজ মনে হয়েছিল, আজ সেটা ভীষণ কঠিন লাগছে।
সে চিত্রার দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,

— “তুমি যে আমাকে ভালোবাসো, আমাকে কোনোদিনও বলেছিলে? আর তাই এখন এসব কথা একদম নিরর্থক। আমি বিবাহিত চিত্রা। ঊষা আমার স্ত্রী। একজন বিবাহিত পুরুষের কাছে ভালোবাসা চাওয়ার চেয়ে ঘৃণিত ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। আমি জানি না, তোমার মনে আমার জন্য কী আছে না আছে, তবে আমার মনে তোমার জন্য কিছু নেই। আমি যাকে বিয়ে করেছি, তার সাথেই থাকতে চাই।”
বলে হন্তদন্ত করে বেরিয়ে গেল প্রেম।
চিত্রা প্রেমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে বলল,

— “যেও না প্রেম!”
প্রেম দ্রুত কদমে নিজের ঘরে চলে গেল। ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। বেসিনের সামনে গিয়ে চোখে-মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিল। বুকটা তার অস্বাভাবিকভাবে জ্বলছে। এমন তো হওয়ার কথা নয়! সে তো নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছিল, চিত্রা তার কেবল ভালো লাগা! ভুলেও গিয়েছিল সব!
তবে এখন কেন আবার শুকনো অনুভূতিগুলো তাজা হয়ে উঠছে?
প্রেম নিজের চুল টেনে ধরল। তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি গড়িয়ে পড়ছে। বারবার চোখের সামনে চিত্রার আহাজারি, চিত্রার কান্নাভেজা মুখ।
চিত্রার কথা সব ভেসে উঠছে। কাল চিত্রাকে না দেখাতে কিছু অনুভব হয়নি, এখন চিত্রাকে ছটফট করতে দেখে বুকের কোথাও একটা তীব্র দহনে পুড়ছে।
প্রেম নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। মনকে বোঝালো,

— “চিত্রা আমার ক্ষণিকের আবেগ ছিল, যাকে আমি অতিসহজেই ভুলে গেছি।
চিত্রা আমার জীবনের অতীত।
এখন ঊষা আমার সব।
ঊষা আমার স্ত্রী, আমার দায়িত্ব, আমার কর্তব্য।
আমি ভাবলে শুধুই ঊষাকে নিয়েই ভাবব।
আমি তোমাকে নিয়ে ভাবতে চাই না, চিত্রা।”
প্রেম চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করল,
— “হে মাবুদ, কাউকে কষ্টে রেখো না।
চিত্রার আমার জন্য ছিলো না, তাই আমার হয়নি।
যে আমার জন্য ছিল, সেই আমার হয়েছে।
চিত্রার জীবনে ওর জন্য এমন কাউকে পাঠাও, যে তাকে বুঝবে, তার ভালোবাসা বুঝবে।
ওর মনে আমার জন্য যা আছে, তা ভোলার তাওফিক দাও।
আমার পক্ষে আর কখনই তাকে আপন করে নেওয়া সম্ভব নয়।
যার সাথে আর কিছু হওয়ার নেই, তার জন্য মনে মায়া দিও না।”

প্রেম বড় বড় নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। সকলে খাওয়া-দাওয়া শেষ। ইনায়া বসে আছে প্রীতমের ঘরের কাউচে। ইনায়া শিকদার বাড়িতে এসেছে ২০টা ঘণ্টা হয়ে গেছে। অথচ পেয়ারালালের কাছ থেকে এখনও একটা চুমু জোটেনি। চুমু খাওয়া তো দূর, বেটার দেখাটাও মিলে নি।
“রসগোল্লা রসগোল্লা” বলে মুখে ফেনা তোলা পেয়ারালালের কাছ থেকে চুমু খাওয়া ইনায়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন পেয়ারালাল দিতে না চাইলে, ও ইনায়া তাকে তুলে নিয়ে এসে চুমু খেয়ে মন চায়! ইনায়া কাউচে বসে গালে হাত দিয়ে হিজিবিজি চিন্তায় বিভোর হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো,

— “আমার পেয়ারালাল কি নতুন বেডি পাইলো? আমি কি রুগা হয়ে গেলাম?”
সে নিজের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “না, সব তো ঠিকই আছে! তাহলে পাত্তা দিচ্ছে না কেনো? বেটা লুচুর কী হলো? হায়, আমার পেয়ারালালের দিকে না জানি কোন ডাইনি নজর পড়েছে!”
ইনায়া বসে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলো।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে পড়লো সে। পেয়ারালালের দুঃখ আর প্রাণে সহে না।
সে গালে হাত দিয়ে মনের দুঃখে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো—

“ভালোবাসা শুধুই তামাশা
ভালবেসে বুঝেছি আপন ভেবে
পরের বুকে মিথ্যে শান্তি খুঁজেছি
আর কারো চলোনাতে আমি যে
আর ভুলবো না।
রূপেরই আগুনে জালাবো সবাইরে
আমি নিজে জ্বলবো না!”
ইনায়া_

SK গ্রুপের কাজের এত চাপ বাড়ছে যে প্রিথম দম ফেলার সময় পাচ্ছে না। সে মাত্রই বাসায় এসে ঘরে ঢুকতেই এমন একটা চমৎকার গান কানে আসতেই পা থেমে গেলো। সাথে সাথেই ভুরু বাঁকিয়ে ফেললো। কিন্তু ইনায়ার তাকে লক্ষ্য করল না। সে মনের দুঃখে গেয়েই চলেছে। প্রিথম দেয়ালে হেলান দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ইনায়ার গান ইনজয় করলো।
“তার ঠোঁটের কোনায় লেগে রয়েছে দূরদর্শ বাঁকা হাসি।”

গান গাইতে গাইতে হঠাৎ সজোরে দরজা লাগানোর শব্দে লাফিয়ে উঠলো ইনায়া। আতঙ্কিত চোখে পেছনে চাইতেই দেখলো, প্রিথম দরজা লাগিয়ে এগিয়ে আসছে ঠোঁটে তার দুষ্টু হাসি। এতক্ষণ প্রিথম কে চাইছিল ঠিকই, কিন্তু এখন প্রীতমের চোখ-মুখের এক্সপ্রেশন দেখে ইনায়ার কলিজা লাফাতে শুরু করলো। ইনায়া বসা থেকে কাউচের উপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো, হুঁশিয়ারি দিয়ে বললো—

— “বেটা লুচু, ওখানেই থেমে জান! একদম এগোবেন না।”
প্রীতম ঠোঁট দুটো পাউট করে ফ্লাইং কিস ছুড়ে বললো—
— “My dear রসগোল্লা, do you miss me?”
ইনায়া ঢোক গিলে বললো—
— “নননা!”
বলতেই প্রিথম চো মেরে তাকে কাঁধে তুলে নিলো। ফিসফিসিয়ে বললো—

— “উফ্‌ফ্‌ baby, আমি সব, সব শুনেছি! তুমি প্রিথম স্পেশাল চুমু চাচ্ছো, তাই না? আজকে চুম্মাতে চুম্মাতে যদি তোমাকে চাঁদে পাঠিয়ে দিতে পারি না পারি, তো আমার নামও প্রিথম শিকদার নয়!”
বলে ইনায়াকে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। ইনায়া ভয়ভয় করে বললো—
— “না! আমি চুমু খাবো না।”
প্রিথম কাছে আসতে আসতে বলল—
— “প্রিথম শিকদারের কাছে From Submit করার অপশন আছে, কিন্তু Cancel-এর আর কোনো option নেই baby।”
বলে খপ করে ধরে ফেললো।

— “বিসমিল্লাহ্‌!” বলে ইনায়ার ফুলো ফুলো গালের উপর মিশন চুমু স্টার্ট করে দিলো।
সেই সকাল থেকে অনুশ্রী বেগমের মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথায় চিরে যাচ্ছে। অনেক বাম লাগানোর পরও কাজ হচ্ছে না। তাই তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। ব্যথায় দুই চোখের কার্নিশ বেয়ে ওঝরে পানি পড়ছে। এই সব মাথা ব্যথা শুধু চিন্তা করতে করতে বাড়িয়েছেন তিনি।
চোখ বন্ধ অবস্থায় কপালে হঠাৎ নরম দুটি হাতের অস্তিত্ব অনুভব করলেন। সাথে সাথেই চোখ মেলে তাকালেন তিনি। উষা, তার ছোট ছোট হাতে সুনিপুণ ভাবে উনার কপালের দুই পাশে মালিশ করে দিচ্ছে। অনুশ্রী বেগম মুগ্ধ চোখে তাকালেন। উষা নমনীয় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল—
“বেশি ব্যথা করছে আম্মু?”

অনুশ্রী বেগমের ভীষণ আরাম লাগছে উষার মালিশে। তিনি আবার চোখ বন্ধ করে বললেন—
“তুমি কীভাবে বুঝলে আম্মু, আমার ব্যথা করছে?”
উষা মৃদু হেসে বললো—
“সকাল থেকে দেখছি আপনি মাথা ধরে বসে আছেন। আবার চোখ দিয়ে পানি ও আসছে। তাই বুঝলাম আপনার হয়তো মাথা ব্যথা করছে।”
মনে মনে তৃপ্ত হলেন অনুশ্রী বেগম। সন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন—
“তুমি এত খেয়াল করো আম্মু, আমার নিজের মেয়েরাই তো এত খেয়াল করে না!”
উষা মুখ ছোট করে বললো—

“আপনি তো কাল বলেছিলেন আমি আপনার মেয়ে, আবার এখন বাদ দিয়ে দিচ্ছেন?”
হেসে ফেললেন অনুশ্রী বেগম। তৃপ্তি নিয়ে বললেন—
“মা হওয়ার জন্য গর্ভে ধারণ করাটা আবশ্যক নয়। তুমি যদি আমার মেয়ে না হতে, এত খেয়ালি করতে না। জানো আম্মু, প্রেম ও তোমার মতন! কিন্তু আমার ছেলেটা কাজের চাপে সব সময় খেয়াল রাখতে পারে না। আমি প্রেমের উপর ভীষণ খুশি যে তোমার মতো একটা মেয়ে আমায় এনে দিয়েছে। তাছাড়া আজকালকার বউদের যা চরিত্র!”
উষা আরও সুনিপুণ ভাবে মালিশ করতে করতে বললো—
“আপনার যখনই মাথা ব্যথা হবে, আমায় ডাকবেন আম্মু।”
অনুশ্রী বেগম হেসে বললেন—

“মাথা ব্যথা এখন অনেকটাই কম লাগছে।”
তিনি শুয়া থেকে উঠে বসলেন। উষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—
“দোয়া করি, জীবনে অনেক সুখী হও।”
উষা লজ্জা মিশ্রিত হেসে ফেললো।
তিনি নিজের হাত থেকে সাবেকি আমলের বড় বড় দুইটা বালা খুলে উষার দুই হাতে পরিয়ে বললেন—
“এগুলো কখনো হাত থেকে খুলবে না আম্মু। এগুলো বংশীয় প্রতিক। এই দুইটা প্রেমের বউয়ের নামে ছিলো। তাই তোমাকে দিলাম।”
উষা অনুশ্রী বেগমের বুকে মাথা রেখে বললো—
“আমি একটু আপনার কাছে থাকি আম্মু।”

অনুশ্রী বেগম মাতৃস্নেহে উষার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। উষা অনুশ্রী বেগমের কাছাকাছি থাকলে, সে তার মৃত মাকে অনুভব করতে পারে। অনুশ্রী বেগম যেভাবে মাতৃস্নেহে জড়িয়ে নেন উষাকে, আম্মুর মৃত্যুর পর ওতোটা ভালোবেসে আর কেউ কখনো জড়িয়ে নেয়নি।
প্রহেলিকা হাতে প্রেগনেন্সি কিট নিয়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে স্পষ্ট একটা লাল দাগ, তার রাগে দুঃখে কান্না পাচ্ছে। এইবারেও ও প্রেগন্যান্ট আসেনি। সে হতাশ হয়ে পড়লো। তাকে হতাশা এসে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। কী করবে সে এখন? কীভাবে প্রণয়কে আরও শক্তভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখবে? এতগুলো মাস ধরে একটা বারও সে পজিটিভ সাইন পায়নি। প্রহেলিকা মনে মনে ভাবলো—কাল সে একজন গাইনী ডাক্তার কনসাল্ট করবে।
সে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো, প্রণয় বিছানায় বসে আছে। প্রণয়কে দেখে সে বাঁকা হাসলো, শাড়ি ঠিক করে এগিয়ে গিয়ে প্রণয়ের গা ঘেঁষে বসলো, নেকামো করে বললো,

“কাল দুপুর থেকে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছিলে জান?”
প্রণয়ের হাতের ও কপালের রগ তীব্র রাগে ফুলে আছে। সে এতক্ষণ প্রহেলিকার অপেক্ষাতেই ছিল। প্রহেলিকা প্রণয়ের আরও একটু কাছে আসতেই, প্রণয় খপ করে প্রহেলিকার চুলের মুঠি ধরে ফেললো। চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করিয়ে প্রহেলিকা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তার গালে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে সজোরে চড় বসিয়ে দিলো।
সঙ্গে সঙ্গেই প্রহেলিকা ছিটকে তিন হাত দূরে গিয়ে পড়লো। সে অবাক চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় হিংস্র চোখে তাকিয়ে তেড়ে এসে প্রহেলিকার গালে আরেকটা চড় মারলো। চিৎকার দিয়ে বললো—

“কেন করলি আমার সাথে এমন? কেন আমার জীবনটা জাহান্নাম বানিয়ে দিলি? তোর আর তোর বাপের সব কথা তো মেনে নিয়েছি। তারপরও কেন জানের পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছিস? কেন আমার জানকে শান্তি দিচ্ছিস না? কেন বারবার আমার দুর্বলতায় আচড় কাটছিস? কিসের এত হিংসে তোর?
আরেকদিন যদি আমার জানের দিকে তোর নোংরা হাত বাড়াস, আই সোয়্যার, তোর কলিজা কেটে আমার পুষা চিতা বাঘকে খাইয়ে দেব!”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪০

প্রহেলিকা প্রণয়ের এমন রূপ আগে কখনো দেখেনি, এমন বাক্য প্রণয়ের মুখে আগে কখনো শুনিনি। প্রণয় ওর দিকে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে, বাঁ হাতে থাকা ইনজেকশনটা প্রহেলিকার গায়ে সজোরে বসিয়ে দিলো।
সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার করে উঠলো প্রহেলিকা।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪২