ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৭
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রণয় ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো, আর প্রিয়তা ও মনপ্রাণ ভরে পুরুষালি দেহের মন মাতানো গন্ধটা শুষে নিতে নিতে হতবাক চিত্তে ভাবলো, কী আছে এই মানুষটার শরীরে, যার গন্ধও প্রিয়তাকে ড্রিঙ্ক করার মতো ফিলিংস দেয়!
প্রিয়তা বড় বড় নিশ্বাসে ঘ্রানটা ফুসফুসে ভরে নিয়ে মনে মনে ভাবল — এই লোক কি পারফিউমের সাথে অ্যালকোহল মিশিয়ে গায়ে স্প্রে করে? না হলে আমার এমন নেশা নেশা লাগে কেন?
প্রিয়তা ড্রাগ অ্যাডিকটেড মানুষের মতো ঘ্রাণটা ইনহেল করার মধ্যেই গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ কানে এল —
“টি-শার্টটা খুলে দেই?”
হঠাৎ কণ্ঠে চমকে উঠে, লজ্জা পেয়ে গেলো প্রিয়তা। পেটে মুখ ডুবিয়ে নিশ্বাস আটকে চুপটি করে পড়ে রইলো।
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললো —
“নিশ্বাস ছাড়, আর ঘুমের ভান ধরতে হবে না।”
প্রিয়তা সত্যিই আর অভিনয় করলো না, শুয়া থেকে উঠে বসলো। প্রণয়ের কাঁধে মাথা রেখে বাহু জড়িয়ে ধরলো। আদুরে কণ্ঠে ডাকলো —
“ও প্রণয় ভাই…”
প্রণয় মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ছোট্ট করে জবাব দিলো —
“হুঁ…”
প্রিয়তা এবার অত্যন্ত কোমল কণ্ঠে বললো —
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“একটা গান শুনাবেন, প্রণয় ভাই? দেখুন কী সুন্দর রাত, চাঁদের আলোয় চারপাশ উজ্জ্বল করছে। এমন আবহাওয়ায় আপনার গান না শুনলে ঘুম আসবে না।”
প্রণয় স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো —
“এখন রাত প্রায় ৩টা। এই সময়কে কী বলে জানিস তো?”
হঠাৎ প্রণয়ের কথায় প্রিয়তার মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়ে গেলো। বুক ধুকপুক করতে শুরু করলো। সে প্রণয়ের দিকে আরও একটু চেপে গেলো। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে মিনমিন করে বললো —
“আপনি আমার ভালো সইতে পারেন না, প্রণয় ভাই…”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে তাকালো ভারী পল্লবযুক্ত ভীতু চোখজোড়ার দিকে, উচ্ছ্বসিত মুখখানা মুহূর্তেই আতঙ্কে ছেয়ে গেছে।
প্রণয় বেশ মজা পেল। ওর ভয়ে বাড়িয়ে দিতে চোখে চোখ রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো —
“যা সত্যি তাই বলেছি। এখন রাত ৩টার কাছাকাছি। আশেপাশের আবহাওয়াটা কেমন ভারি ভারি লাগছে। মাথার ওপর ২০০ বছরের পুরোনো জামগাছ… আর তুই তো জানিস, এই গাছে…”
প্রণয় কথা শেষ করার আগেই বিদ্যুৎ বেগে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রিয়তা। মেয়েটার ছোট্ট শরীরে মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে।
হাসলো প্রণয় —
“মেয়েটা বুকে আসলে এত শান্তি লাগে কেন? মেয়েটা বুকে আসলেই সব কেমন শান্ত হয়ে যায়… সাগরের ডেউয়ের মতো বিশাল বিশাল জলোচ্ছ্বাস হৃদয় কিনারায় আছড়ে পড়তে থাকে…”
প্রিয়তা প্রণয়ের পিঠের দিকে টি-শার্ট খামচে ধরে ত্রস্ত কণ্ঠে বললো —
“প্লিজ, আর কিছু বলবেন না, প্রণয় ভাই…”
প্রণয় বুঝলো, একটু বেশি হয়ে গেছে। সে মাথায় হাত বুলিয়ে মিহি কণ্ঠে বললো —
“বেশি ভয় পেয়েছিস জান? আমি তো মজা করছিলাম। আমি থাকতে কী ভূত তোকে খেয়ে নেবে? আমি খেতে দেবো?”
প্রিয়তা কিছু বললো না, নড়লোও না।
প্রণয় বুক ভরে শ্বাস নিলো, অস্তিত্বে প্রশান্তি অনুভব করলো।
আকাশের সুবিশাল রূপালি চাঁদের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে সুর তুললো —
“নেমে এলো চাঁদ আকাশ থেকে ধুলো মাখা গলিতে,
রঙ চটা দিন করল রঙিন স্বপ্নের তুলিতে,
দেখে ওই হাসি আমি বানভাসি মন ডুবে যেতে চায়,
তার ওই চাওয়া ঝোড়ো হাওয়া পাগল করে যায়…”
অতিবাহিত হলো আরো কিছুটা সময়।
প্রণয় অনুভব করলো, তার বুকে গনগন ভারি নিশ্বাস পড়ছে।
সে অতিসতর্কতায় উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট দেহটা পাঁজাকোলে তুলে নিলো।
ধীরে পায়ে ছাদ ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল…
রাত ৪টা বেজে ১২।
বাহিরের আকাশ এখনও নিকষ কালো আঁধারে নিমজ্জিত।
তবু আকাশ দেখে মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হতে শুরু করবে।
পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, শুনশান।
এই নিস্তব্ধ রজনীতে একটা শুকনো পাতা পড়লেও তার শব্দটা ভয়ংকর শোনাবে।
পরিণীতার মাথা ব্যথায় চিরে যাচ্ছে।
সে এলোমেলো ভঙ্গিতে বিছানার সাথে মাথা ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে।
চোখ দুটো বেয়ে অনর্গল নোনা পানির বৃষ্টি নামছে।
হাঁটু ছুঁই ছুঁই চুলগুলো এলোমেলোভাবে টাইলসের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কোনদিনও যন্ত্রণা কি জিনিস না বোঝা পরিণীতা আজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত যন্ত্রণার ভার বইতে পারছে না।
বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে সাদমান শিকদার-এর বলা এক একটা বাক্য।
মস্তিষ্কও বারবার চিৎকার করে বলছে—
“এবার তোর কি হবে? তোর অবস্থা ও তোর ছোট বোনের মতই হতে চলেছে।”
কিন্তু মন সে কথা মানতে সম্মত নয়।
বুকের ভেতরটা যন্ত্রণার নীল বিষে ছেয়ে যাচ্ছে পরিণীতার।
এই পরিবারের বিধি-নিষেধের জন্য সে কোনমতেই মাস্টারমশাইকে ছাড়তে পারবে না,
কারণ মাস্টারমশাইকে ছাড়া বাঁচা পরীর পক্ষে সম্ভব নয়।
আর সাদমান শিকদারের কথা স্পষ্ট—
তিনি কোনওদিনও ওর মাস্টারমশাইকে মেনে নেবেন না।
তবে কি পরীকে এই পরিবার আর ভালোবাসার মানুষের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে?
এই কাজ পরী কিভাবে করবে?
আর এই পরিবারকে তাদেরকে এত সহজে ছেড়ে দেবে পরী?
যতটুকু সাদমান শিকদারকে চিনে, উনি সব সহ্য করে নিলেও
কেউ তার বংশের মান-মর্যাদা নিচু করবে—এটা তিনি কখনো মানবেন না।
পরীর নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে।
সে চোখ মুছে বললো—
“আপনি সব সময় এই ভয়টাই পেতেন, তাই না মাস্টারমশাই?”
মাস্টারমশাইয়ের কথা ভাবতেই পরিণীতার টনক নড়লো।
মনে পড়লো, পরশু রাতের পর থেকে মাস্টারমশাইয়ের সাথে আর একবারও ওর কথা হয়নি।
মাস্টারমশাইয়ের ফোনটা ও বন্ধ।
সাদমান শিকদার-এর কথায় পরিণীতা এতটাই কষ্ট পেয়েছিল যে,
আর মাস্টারমশাইয়ের খোঁজটা ও আর নেয়া হয়নি।
পরিণীতা দ্রুত চোখ মুছে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
বিছানা হাতরে, বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করলো।
দ্রুত হাতে কল লিস্ট ওপেন করে “মাস্টারমশাই” নামে সেভ করা নম্বরে কল লাগাতে নিতেই
টুং টুং শব্দ করে ফোনে দু’টি নোটিফিকেশন এলো।
পরিণীতার মনোযোগ নষ্ট হলো।
পরিণীতা ফোনটা উপরের দিকে সোয়াইপ করতেই দেখলো,
একটা আননোন নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে দু’টি ভিডিও এসেছে।
পরিণীতার কপালের ভ্রু দ্বয় কিছুটা বাঁকা হলো।
মনে মনে খানিকটা আশ্চর্য হলো—এই শেষ রাতে কে ভিডিও পাঠাতে পারে?
পরিণীতা সংকোচিত মনে নোটিফিকেশনের উপর ক্লিক করলো।
হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন হয়ে গেল।
আসলে এগুলো রিমাইন্ডার নোটিফিকেশন।
এই ভিডিও দুটি আরও ২৪ ঘণ্টা আগে পাঠানো হয়েছিল, যা কিনা পরিণীতা দেখেনি।
অতিরিক্ত চিন্তায় সে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকেইনি।
পরিণীতা মনোযোগ দিয়ে মেসেজগুলো দেখতে শুরু করলো।
অচেনা নম্বরটা থেকে ভিডিওর পাশাপাশি কিছু টেক্সট মেসেজও এসেছে।
পরিণীতা ফোন স্ক্রল করে উপরের দিকে যেতেই
সবার আগে একটা মেসেজের উপর দৃষ্টি আটকালো,
যেখানে বেশ বড় একটা ম্যাসেজ, গুটিগুটি ইংরেজি অক্ষরে বেশ কয়েক লাইন লেখা।
পরিণীতা লেখাগুলো মন দিয়ে পড়তে লাগলো।
মেসেজটা এমন ছিল—
**“My princess,
আমি চাইনি তোমাকে এসব বলতে বা দেখাতে।
আমি জানি, আমার প্রিন্সেস অনেক স্নিগ্ধ হৃদয়ের—এসব সহ্য করতে পারে না।
তবুও, ওহ আজ আমি হেল্পলেস…
আমি চেষ্টা করেছিলাম সবভাবে বিষয়টা সামলে নেওয়ার, বাড়তে না দেওয়ার।
চেষ্টা করেছিলাম একজন ভালো বাবা হয়ে থাকতে।
কিন্তু পারলাম আর কই…
কি বলো তো, আমার মেয়ে তো জেদটা ও আমার মতোনই পেয়েছে।
যাই হোক প্রিন্সেস, তুমি যেহেতু আমার কথা শুনবেই না,
তাহলে নিচের ভিডিওগুলো তোমার জন্য।
এরপর ভেবে দেখবে আমার কথা শুনবে কিনা।
তবে নিচের ভিডিওটা দেখার আগে উপরের ভিডিওটা দেখবে।
অবশ্যই নিজেকে মেন্টালি স্ট্রং করে নিয়ে দেখবে।”**
মেসেজটা দেখে পরিণীতা বিস্মিত হলো।
এই অদ্ভুত কথাগুলোর আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না।
তবে এটা বুঝলো, এগুলো তার আব্বু পাঠিয়েছেন।
তবে কী আছে এই ভিডিওতে, যা দেখার জন্য পরিকে মেন্টালি স্ট্রং হতে হবে?
সাদমান শিকদারের অ্যালার্ট দেখে পরিণীতা একটু ভীত হলো।
ইতস্তত হাতে প্রথম ভিডিওটাতে ক্লিক করলো।
সাথে সাথেই একটা বেশ পুরোনো ভিডিও প্লে হয়ে গেলো,
যেখানে দুটো ছেলে সাইকেল চালিয়ে আসছে।
ওদের দু’জনকে দেখতে প্রায় অনেকটা কাছাকাছি, ভাই হবে হয়তো।
একজনের বয়স সম্ভবত ৯–১০, আর একজনের বয়স সম্ভবত ১৯–২০।
দু’জনের চেহারা দেখে পরিণীতা চমকে গেলো।
আরও কৌতূহলী চোখে ভিডিওটা দেখতে লাগলো।
ভিডিওর ছেলেদুটো সাইকেল চড়ে বড় রাস্তা পেরিয়ে মাঠের কাছে আসতেই,
একটা বড় প্রাইভেট কার এসে ধাক্কা মেরে দিলো সাইকেলে।
ছেলেদুটো উল্টে পড়লো পাশের মাঠে।
সাথে সাথেই গাড়ি থেকে নেমে এলো কালো পোশাক পরিহিত সুঠাম দেহী ৪–৫ জন দেহরক্ষী।
তারা একপ্রকার দৌড়ে এসে ওই দুই ছেলের মাঝে বড় ছেলেটাকে টানতে টানতে সরিয়ে নিলো ছোটো ছেলেটার কাছ থেকে।
সাথে সাথেই ছোটো ছেলেটা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো।
আহাজারি করতে করতে বললো, “আমার ভাইয়াকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
সে চিৎকার দিয়ে তার বড় ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যেতে নিলে,
একজন বিশাল দেহী গার্ড এসে তার ছোট্ট দেহটা আটকে দেয়, যেতে দেয় না তার ভাইয়ের কাছে।
দেখতে দেখতে উপর চারজন গার্ড অমানুষের মতো মারতে থাকে সেই ১৯–২০ বছর বয়সি ছেলেটাকে।
মারতে মারতে ছেলেটার মুখ দিয়ে রক্ত উঠে যায়।
তবুও সেই ছেলেটি হাসে।
চিৎকার দিয়ে বলে, “আমাকে মেরে ফেললেই সব থেমে যাবে না, শিকদার সাহেব!”
সাথে সাথেই গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সাদমান শিকদার।
ধীর পায়ে হেঁটে এসে ছেলেটার গলা পা দিয়ে চেপে ধরেন।
ক্রুদ্ধ চেহারায় বাঁকা হেসে বললেন—
“তোকেও অনেক সুযোগ দিয়েছি বেঁচে থাকার জন্য,
অনেক সুযোগ দিয়েছি নিজেকে শুধরে নেওয়ার জন্য।
কিন্তু তুই ছোটো লোকের বাচ্চা!
আমার মেয়ের পিছুই ছাড়ছিস না?
তোদের মতো ছোটো লোকেরা আসলে বাঁচার যোগ্যতাই রাখে না।
ভেবেছিলাম, বয়স কম, মাফ করে দেবো।
কিন্তু তুই সব সীমা ছাড়িয়ে গেছিস।
এবার তুই দেখবি, এই সাদমান শিকদার কতটা নিষংস!”
দীর্ঘক্ষণ পা দিয়ে গলা চেপে ধরায় ছেলেটার কাশি উঠে গেলো।
সাদমান শিকদার একটা গার্ডের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়াতেই
গার্ডটা বিশাল বড় রামদা সাদমান শিকদারের হাতে তুলে দিলো।
সাদমান শিকদার সেটা হাতে নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালেন।
বাঁকা হেসে বললেন,
“তুই বলেছিলি না তুই মরতে ভয় পাস না? এখন পাবি, তুই ভয় পেতে বাধ্য!
তোকে এমন নিষংস মৃত্যু দেব, যা দেখে আশপাশও থমকে যাবে।
তোর মৃত্যু দেখে ভুবা প্রাণীরাও ভয়ে কাঁপবে।
দ্বিতীয়বার কেউ সাহস করবে না সাদমান শিকদারের মেয়ের দিকে হাত বাড়ানো!”
তবুও ছেলেটার চোখে-মুখে কোনো ভয় নেই, নেই কোনো উদ্বেগ, উত্তেজনা।
ছেলেটা বোধহয় আল্লাহর নাম নিয়ে কালেমা পড়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
তার ছোটো ভাই চিৎকার দিয়ে কাঁদছে, আর সবার কাছে মিনতি করছে।
সাদমান শিকদার চোখের পলক ফেলার আগেই সোজোরে কোপ বসিয়ে দিলেন ছেলেটার বুকের মাঝ বরাবর।
সাথে চমকে উঠলো উপস্থিত সকল গার্ডসহ ছেলেটার ছোটো ভাই।
একদম থমকে গেলো পরিবেশ।
রক্তের একটা পিচকারি ছিটকে এসে পড়লো সাদমান শিকদারের সাদা পাঞ্জাবিতে।
সাদমান শিকদার বাঁকা হেসে দুজন গার্ডের দিকে তাকাতেই গার্ডরা এসে ছেলেটার বুক থেকে হৃদপিণ্ড টেনে বের করে নিলো।
তখন হয়তো ছেলেটা জীবিত ছিলো।
এই নিষংস হত্যাকাণ্ড দেখে ছেলেটার ভাই তৎক্ষণাৎ সেন্সলেস হয়ে পড়ে।
সাদমান শিকদার টিস্যু দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে গাড়িতে উঠে বসলেন।
“এটাকে এখানেই ফেলে রাখো। গোটা রায়পুরবাসী দেখুক — সাদমান শিকদারের মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর শাস্তি কতটা ভয়ানক।”
সাথে সাথেই প্রথম ভিডিওটা বন্ধ হয়ে গেলো।
পরিণিতার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থরথর করে কাঁপছে।
ভয়ভীত চোখ দুটো বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
পরিণিতা ফোনটা হাতে ধরে রাখার শক্তি পাচ্ছে না।
কাঁপা দুই হাতে ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরলো।
নিঃশ্বাস আটকে আসছে পরিণিতার।
ওই ছোটো ছেলেটাকে চিনতে পরিণিতার ভুল হয়নি।
আর কোনো প্রশ্ন চিন্তা করার মতো অবস্থা পরিণিতার মস্তিষ্কে নেই।
সে ঝাপসা চোখে পরের মেসেজগুলো পড়তে শুরু করলো।
পরবর্তী মেসেজটা ছিল এমন…
মাই প্রিন্সেস,
আমি জানি তুমি এই মুহূর্তে অনেক ঘাবড়ে আছো, প্যানিক করছো, কিন্তু কুল, শান্ত হও।
এতো ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এগুলো আমাদের জন্য মশা মারার মতো ব্যাপার।
তুমি হয়তো ভাবছো, এটা তোমাকে কেন দিলাম, দিতে চাইনি।
কিন্তু তুমি আমার, আমার জন্য আর কোনো রাস্তাই রাখোনি প্রিন্সেস।
এই ভিডিওটা তোমার আগে ওই ছেলেটাকে দিয়েছিলাম, যার হাত ধরে তুমি আমার বংশ মর্যাদা চুরমার করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছো।
কিন্তু ভিখিরির বাচ্চার উপর কোনো প্রভাব পড়েনি।
তুমি নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছো ওই বাচ্চা ছেলেটাকে।
হ্যাঁ, ওই ছেলেটাই এখনকার তোমার সেই মাস্টারমশাই।
ওই ছেলেটা নিজে চোখের সামনে সব দেখেছে, সব জানতো।
তার পরও ও আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস করেছে।
ও নিজে চোখের সামনে দেখেছে, আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর জন্য ওর ভাইয়ের সাথে ঠিক কী করেছি।
তবু ও, ওই ভিখিরির বাচ্চার কলিজায় এত সাহস যে আবারো আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে।
শুধু তাই নয়, ভাইয়ের মতো ওকেও সাবধান করেছিলাম।
কিন্তু আমার কথার পাঁচ পয়সার মূল্য দেয়নি।
সব জেনে শুনে মরার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল।
এতটুকু পড়তেই পরিণিতার হাত থেকে ফোনটা ফসকে গেল।
হাত পা থর থর করে কাঁপতে শুরু করল।
মনে হচ্ছে তার হৃদপিণ্ডটা কেউ ধারালো নখ দিয়ে চেপে ধরেছে।
তার মাস্টারমশাইয়ের সাথে ও কী এমন কিছু?
পরিণিতা আর ভাবতে পারল না।
‘মাস্টারমশাই’ বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো।
তার চোখের সামনে সব ঝাপসা লাগছে।
তবু সে কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে পড়তে শুরু করলো।
সেখানে লেখা:
“My princess, তোমার আব্বুর কথার অবাধ্য না হতে তোমার জন্য ছোট্ট একটা অ্যালার্ট। Let’s enjoy my . Click the second video.”
পরিণিতা সেকেন্ড ভিডিওটা ক্লিক করতে সাহস পাচ্ছে না।
অপ্রত্যাশিত কিছু দেখে ফেলার ভয়ে তার হাত-পা ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপছে।
সে তার মাস্টারমশাইয়ের একটা সামান্য ব্যথাও সহ্য করতে পারবে না।
পরিণিতা অনেকক্ষণ চেষ্টা করে, কাঁপা হাতে দ্বিতীয় ভিডিওটা ক্লিক করলো।
সাথে সাথেই দ্বিতীয় ভিডিওটা ও প্লে হয়ে গেল।
আবিদ আর পরিণিতা ওই রেস্টুরেন্টটা থেকে বেরিয়ে, পরিণিতাকে বাড়ি দিয়ে আবিদ নিজের বাড়ির দিকে যাওয়া ধরতেই,
আচমকা তাকে ধরে ফেলে কালো পোশাক পরিহিত দুইজন বলিষ্ঠ দেহী লোক।
আবিদ সব বুঝে যায়।
মুহূর্তেই একদম নড়াচড়া করে না, ছাড়া পাওয়ার চেষ্টাও করে না।
শুধু শান্ত কণ্ঠে কারো উদ্দেশ্যে বলে,
“তাহলে আমাকে ও আপনার আসল রূপ দেখাতে চলে এলেন?
কিন্তু আমি তো আপনার আসল রূপ সম্পর্কে অজ্ঞাতই নই সিকদার সাহেব।”
বাঁকা হেসে এগিয়ে এলেন সাদমান শিকদার।
বয়স ৬০ পেরিয়েছে অনেক আগেই, তবু জমিদারি জৌলুশে ভাটা পড়েনি একটুও।
তিনি এগিয়ে এসে আবিদের সামনে দাঁড়ালেন, চোখে চোখ রেখে বললেন,
“তোদের সাহস দেখে আমি নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই।
মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তোদের ভালোবাসার জন্য শুধু আমার মেয়েদেরকেই চোখে লাগে, প্রাণের মায়া নেই।
তোরা কেমন মানুষ!
আর তুই তো দেখি, তোর ভাইয়ের থেকেও বেশি উন্মাদ হয়ে গেছিস আমার মেয়ের জন্য।
তোর ভাই নয়, প্র্যাকটিকালি দেখিনি তাই সাহস দেখিয়েছে…
তার বিষয়টা মানা যায়, বাড়ন্ত বয়সে ছেলেদের রক্ত গরম, তাই উল্টাপাল্টা কিছু করতেই পারে।
তোর ভাইও ভুল করেছিল আমার কথা না মেনে।
কিন্তু তুই? তুই কি মাটি দিয়ে তৈরি?
তোর ভাইকে তোর চোখের সামনেই এই একই কারণে নিষংসভাবে শেষ করে দিয়েছি।
তুই দেখেছিস, তবুও একবারও তোর কলিজা কাঁপলো না?
আমার মেয়েকে ভালোবাসার আগে তুই তোর ভাইয়ের মতো বাড়ন্ত বয়সে নেই, যথেষ্ট পরিণত আর বোঝদার।
সব জেনে শুনেও কীভাবে মরতে চলে এলি?
একবারও তোর বাপের কথা ভাবলি না?
তুই মরলে তাদের কে দেখবে?
প্রাণের মায়ায় একেবারে ছেড়ে দিয়েছিস।”
আবিদ বাঁকা হেসে তাকালো সাদমান শিকদারের দিকে।
তার কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এক বাক্যে বললো,
“সবই যখন জানেন, ?”
“তো জিজ্ঞেস করলেন কেন?”
সাদমান শিকদার এমন বাঁকা উত্তরে আরও ক্ষেপে গেলেন।
বলিষ্ঠ হাতে সোজা ঘুষি মারলেন আবিদের নাক বরাবর।
আবার ফোনটা ছিটকে দুই হাত দূরে পড়লো।
পরিনিতা আর কিছু না দেখে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে সশব্দে কেঁদে উঠলো।
ভঙ্গুর কণ্ঠে বললো,
“আমাকে কেন এত ভালোবাসলেন মাস্টারমশাই?
আপনি তো সব জানতেন, তবু ও কেন আটকাননি আমায়?
কেন ভালোবাসলেন? আমি আপনার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম।
মাস্টারমশাই, আগে জানলে আমি কখনো আমার ভালোবাসার কথা আপনার কাছে প্রকাশ করতাম না।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মাস্টারমশাই, আপনাকে ছাড়া এখন আর বাঁচতে পারবো না আমি।”
আবারও কিছু মনে করে কেঁপে উঠলো পরিনিতা।
দ্রুত ফোনটা তুলে আবারও ভিডিওটা প্লে করলো।
আবিদ আবার মাথা তুলে তাকালো সাদমান শিকদারের দিকে, চোখে তার এক ফোঁটাও মৃত্যুভয় নেই—
আর এটাই যেন মেনে নিতে পারছেন না সাদমান শিকদার।
আবিদ এবার হেসে বললো,
“কি ভাবছেন? আপনাকে কেন ভয় পাচ্ছি না?
কেন চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখেও ভয় পাচ্ছি না?”
এবার আবিদ শরীর দুলিয়ে হুহু করে হেসে উঠলো।
আবিদকে হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন সাদমান শিকদার, সন্দেহী কণ্ঠে বললেন,
“ভয়ে পাগল হয়ে গেছিস নাকি?”
আবিদ এবার একটু শান্ত হলো।
সাদমান শিকদারের দিকে দুই কদম এগিয়ে এসে বললো,
“এই রায়পুরের বড় কর্তা সাদমান শিকদার,
আমার মতো তুচ্ছ একটা ছেলেকে ভয় দেখাতে কত কষ্ট করছেন—
কিন্তু কেন ভয় পাচ্ছেন আমাকে?
যদি আপনার মেয়ে কে হারাতে হয়, তাই আমাকে মারতে ভয় পাচ্ছেন?
যদি আপনার বড় মেয়ের মতো ভালোবাসার মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে
পরী ও কিছু একটা করে ফেলে?
কারণ আপনি ও খুব ভালোভাবে বুঝে গেছেন,
পরী আমাকে কতটা ভালোবাসে। তাই না?
আচ্ছা বাদ দেই আপনার মেয়ের কথা।
আপনি আমার কথা জানতে চেয়েছেন, ঠিক আছে, আমার কথা বলি।
হ্যাঁ, মৃত্যু কে না ভয় পায়?
আমি ও পেতাম, খুব পেতাম।
বিশেষ করে আমার সামনে যেদিন নৃশংসভাবে আমারই ভাইকে মেরে ফেললেন,
তার পর থেকে কারো সাথে কথা বলতেও ও ভয় পেতাম।
ট্রমাটাইজড হয়ে গেছিলাম কিছু বছর।
অনেক সময় লেগেছে আপনার দেয়া ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে।
সময় এর সাথে সাথে যখন আমার ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ জানলাম,
তখন খুব রাগ হয়েছিল ভাইয়ের উপর।
সামান্য একটা মেয়ের জন্য কেউ মরে?
খুব ঘৃণা জন্মেছিল এই ভালোবাসা শব্দটার প্রতি।
ভালোবাসা বলে যে কিছু আছে পৃথিবীতে, এটা মানতে রাজি ছিলাম না।
কিন্তু কি হলো?
হঠাৎ একদিন… একদম হুট করে আসা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো,
আপনার মেয়ে আমার হৃদয় উপকূলে আছড়ে পড়লো।
হঠাৎ একদিন এক নাম না জানা পরীর সাথে দেখা হয়ে গেল।
তাকে প্রথমবার দেখেই বুকে একটা অদ্ভুত অনুভূতির,
একটা অদ্ভুত টান অনুভব করেছিলাম।
জানতাম না সেই কিশোরীর নাম, পরিচয় কিছুই,
শুধু জানতাম সে অদ্ভুত মায়াবী দেখতে।
তার অবুঝ চোখের দৃষ্টি আমার বুকপাঁজরে ঝড় তুলতো—
যার আকর্ষণ থেকে বাঁচাতে পারিনি নিজেকে।
ধীরে ধীরে খুব বাজেভাবে আটকে পড়েছিলাম তার মাঝে।
সে আমাকে দেখেনি কখনও, কিন্তু আমি দেখতাম।
তারপর একদিন আপনার বড় ছেলে আমার কাছে এলো,
তার বোনকে পড়ানোর জন্য।
আপনার মেয়েকে পড়াতে হবে শুনে প্রথমে তো না করে দিয়েছিলাম।
কিন্তু কি মনে হতে রাজি হয়ে গেলাম আপনার মেয়েকে পড়াতে।
তারপর জীবনের সবথেকে বড় ধাক্কাটা খেলাম।
আবারও আমার জীবনের সব হিসেব উলটপালট হয়ে গেল।
ওই বাড়িতে আমার ভালোবাসার পরীকে,
আপনার মেয়ের রূপে দেখে আমার পায়ের নিচের জমিন সরে গেলো।
আবাক হয়েছিলাম ভীষণ।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, কোনো এক অদ্ভুত কারণে
সেদিন আমার একটুও ভয় লাগেনি।
সে আপনার মতো এক নৃশংস ব্যক্তির অংশ শুনে ও
তার প্রতি বুকে জমা ভালোবাসায় একটুও টান অনুভব করিনি,
বরং সেটা দিন, মাস, বছরের সাথে সাথে
ডালপালা মেলে আমার হৃদয়ে ছড়িয়ে গেলো গভীর থেকে গভীরে।
যেদিন ভালোবাসার দাবি নিয়ে আপনার মেয়ে আমার এই বুকে মাথা রেখেছিল,
সেদিন আমি শুধু তাকে আমার বুকপাঁজরে মিশিয়ে নেইনি,
মুক্ত করে দিয়েছি মৃত্যুভয়কে।
সেদিন বুঝেছি আমার ভাই কেন আপনার হাতে মরার জন্য ও প্রস্তুত ছিল,
তবুও ভালোবাসা ছাড়তে রাজি হয়নি।
আর আমি, যদি আপনার বাড়িতেই আপনার মেয়েকে প্রথমবার দেখতাম,
তবুও ও হয়তো আমার ভালোবাসা একইভাবে জন্মাত।
আর অবশ্যই, আপনার মতো তুচ্ছ মানুষের ভয়ে
আমি আমার ভালোবাসাকে ভুলে যেতাম না বা ছেড়ে দিতাম না।
আপনি আমাকে মৃত্যুর কি ভয় দেখাবেন?
আপনার মেয়ে আমাকে এত এত ভালোবেসেছে—
এখন যদি মরেও যাই, আমার আফসোস নেই।
কারণ, পরী আমার রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় মিশে আছে।
আমি জানি, আমি পরীকে কোনোদিন ও পাব না।
তবুও ওকে ভালোবাসি,
শেষ নিঃশ্বাস অবধি ভালোবাসার দাবি ছাড়বো না।
পরী আমার, শুধুই আমার।
মৃত্যু ব্যতীত আপনি আমার পরীকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবেন না।”
সাদমান শিকদারের রাগ এবার আকাশে উঠলো।
তবুও তিনি নিজেকে শান্ত রাখলেন।
বাঁকা হেসে বললেন,
“যে মরতে ভয় পায় না, তাকে মেরে ও মজা পাওয়া যায় না, পানসে লাগে।
যা, এইবারের মতো তোকে প্রাণভিক্ষা দিলাম।
তবে মনে রাখিস, এটা তোকে জীবন ভিক্ষা দেইনি, দিয়েছি জাহান্নামের আরেক রূপ।
একদিন তুই নিজেই আসবি আমার কাছে মৃত্যু ভিক্ষা চাইতে।
মৃত্যু পিপাসায় ছটফট করতে করতে বলবি—
আমাকে মৃত্যু দাও, এই জীবন আমি আর বাঁচতে পারবো না।
তখন তোকে মনের সুখে মৃত্যু উপহার দেব।
তার আগে তুই বেঁচে থেকে জাহান্নামের দর্শন করবি।
দেখবি, তোর চোখের সামনে কত চমৎকার চমৎকার কান্ড ঘটবে
আর তুই কিছুই করতে পারবি না।
তবে এখন প্রাণে না মারলেও, ওর… আমার প্রিন্সেসের জন্য একটা ভিডিও ক্লিপ লাগবে।”
শেষের কথাগুলো সাদমান শিকদার আবিদের কানে কানে বললেন,
যা ভিডিওতে শোনা গেল না।
এবার সাদমান হুঙ্কার দিয়ে গার্ডদের আদেশ দিলেন,
“ওকে মারতে মারতে শেষ করে দাও, তবে প্রাণটা যেন না যায়।
আমার মেয়েকে লাস্ট একটা সুযোগ তো দিতে হবে।”
বলে চলে গেলেন।
সাদমান শিকদারের বলা কথার গভীরতা আবিদ বুঝলো না।
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সাদমান শিকদারের দিকে।
মনে মনে ভাবলো, “কি করতে চায়?”
কিন্তু তার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই
বলিষ্ঠ দেহী দুজন গার্ড তাকে নৃশংসভাবে মারতে শুরু করলো।
অপ্রস্তুত অবস্থায় অতর্কিত হামলায় তাল সামলাতে পারলো না আবিদ।
মুখ থুবড়ে পড়লো পিচঢালা রাস্তায়।
গার্ড দুজন তাকে প্রতিরক্ষার সুযোগ না দিয়ে
অমানবিকভাবে পেটাতে শুরু করলো।
বলিষ্ঠ দেহের এক একটা আঘাতে যেকোনো মানুষের প্রাণ বেরিয়ে যাবে।
এক পর্যায়ে আবিদের নাক-মুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত উঠতে শুরু করলো।
মুহূর্ত পার হওয়ার আগে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইলো রাস্তায়।
তার রক্তে ভেসে গেল পিচঢালা রাস্তার প্রায় অনেকটা।
সাদমান শিকদার এবার গার্ডদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“হয়ে গেছে, এবার ওকে এভাবেই ফেলে চলে আসো।”
বলে চলে গেলেন।
সাদমান শিকদারের এই কথার সাথেই ভিডিওটা ও শেষ হয়ে গেল।
পরিনিতার মনে হচ্ছিল পৃথিবী তার মাথার উপর ক্রমাগত পাক খাচ্ছে।
চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে।
বুকের ভেতর চলতে থাকা ছোট্টো হৃদযন্ত্রটা যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে কাঁদছে।
মুখ দিয়ে অস্ফুটে বের হলো,
“মাস্টার মশাই…”
পরিনিতা ঝাপসা চোখে দেখলো ভিডিওর নিচে আরও কয়েকটা লাইন, যেখানে লেখা:
—
“I know princess, তুমি অনেক ভেঙে পড়েছো।
তবে তোমাকে good news দেই—
ছেলেটা মরে যায়নি।
তবে আজ থেকে তোমার কাজের উপর নির্ভর করবে তার বাঁচা-মরা।
তুমি কর্ম করো আর ফল পাবে সে।
এবার দেখো, তুমি যা ভালো বুঝো—
ওই ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখবে নাকি মেরে ফেলবে, তোমার ব্যাপার।
আমি তো শুধু আমার কথা বললাম।”
পরিণীতার মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এসব কোনো কথা, কোনো অনুভূতি—কিছুই কাজ করছে না, যেন…
শুধু প্রাণপ্রিয় মাস্টার মশাইয়ের রক্তমাখা, নিথর দেহটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
যে দেহের লোমে লোমে পরিণীতা ভালোবাসা আহরণ করত, সেই দেহখানা রক্তাক্ত হয়ে পড়েছিল—ভাবতেই পরিণীতার দেহের সকল রক্ত ছলকে উঠলো।
হৃদপিণ্ডটা অসার হয়ে এলো ব্যথায়।
এই দৃশ্য পরিণীতা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না।
চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে।
ফোনটা ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে।
সেকেন্ডের মধ্যেই ফোনটা মেঝের টাইলসে লেগে সশব্দে চূর্ণ হয়ে গেলো।
পরিণীতার সহ্য হচ্ছে না কিছু।
সে নিজেই নিজের চুল টেনে ধরে আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলো।
নিঃশব্দ ঘরে পরিণীতার এমন হৃদয়নিগ্রহ কান্নার এক একটা আর্তনাদ কী ভীষণ করুণ শোনাচ্ছে—
যা এই নিশুতি রাতে চার দেয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে গেল।
পরিণীতা কাঁদতে কাঁদতে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।
হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই ইচ্ছে হলো বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সেই রাস্তার দিকে তাকাতে,
যেখানেই পরিণীতা তার প্রাণপ্রিয় মাস্টার মশাইয়ের সাথে অজস্র সুখের স্বপ্ন সাজিয়েছে।
যেখানে দাঁড়িয়ে পরিণীতা স্মৃতির পাহাড় গড়েছে।
হঠাৎ করেই পরিণীতার বুকের ভেতরটা যেন কেউ খামচে ধরলো।
মাস্টার মশাইয়ের অবস্থার জন্য ব্যাকুল হলো হৃদয়।
হঠাৎ করেই প্রিয় পুরুষকে দেখার জন্য, ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠলো পরিণীতার হৃদয়।
সে একপ্রকার বিভ্রান্ত অবস্থায় ছুটে গেলো বারান্দায়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই পরিণীতার পদযুগল একদম স্থির হয়ে গেলো, যেন কোনো অদৃশ্য চুম্বকীয় আকর্ষণ।
গাঢ় বাদামি চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো সহসা।
পদ্ম পুকুরের পাশে দক্ষিণের রাস্তায় সোডিয়ামের হলুদ আলোয় স্পষ্ট এক যুবকের প্রতিচ্ছবি—
তার ব্যাকুল অক্ষিজুগল তৃষ্ণার্ত হয়ে তাকিয়ে আছে সপ্তদশীর মায়াবী মুখোপানে।
অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে ভীষণ কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির দর্শনে পরিণীতার মস্তিষ্ক, তার বিচার-বিবেচনা, বোধ-বুদ্ধি—সব খুইয়ে ফেলল।
মুহূর্তেই ভুলে গেলো সব সতর্ক বাণী।
হৃদয়টা যেন তার গলিতে লাভা নদী—যাকে প্রশান্তি দিতে এই পুরুষের উষ্ণ ছোঁয়া খুব জরুরি।
প্রিয় পুরুষকে দেখতেই পরিণীতার অধরকোণে ফুঁটে উঠলো এক টুকরো ঝলমলে হাসি।
বুকের ভিতরের ফুটন্ত রক্তে শীতলতা ভর করলো।
সে বারান্দা থেকে বেরিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় ওড়না-টোড়না ফেলে দরজা খুলে একপ্রকার ছুটলো বাইরে।
আজ যেন কিশোরীর মনে কোনো ভয় নেই, থামানোর কেউ নেই।
ভালোবাসার উপর কিছু নেই।
আশেপাশের দুনিয়াটা যেন অদৃশ্য।
তাকে এই মুহূর্তে কেউ দেখে ফেলল কিনা, ধরা পড়ে যাবে কিনা—এসবেরও কোনো ভয় নেই।
ভালোবাসার তাগিদে ছুটছে সে, যার সামনে সব তুচ্ছ, নিরর্থক।
পরিণীতা ঝড়ের বেগে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
তার বুকের ভিতর উথলে উঠছে ভালোবাসার এক বিশাল নোনা সমুদ্র।
হাঁটু ছুঁই ছুঁই খোলা চুলগুলো এলোমেলো ভাবে দোল খাচ্ছে কোমরের নিচে।
আজ কোনো লুকোচুরি নেই।
পরিণীতা ছুটে মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
তবে চারজন পাহারাদারের মধ্যে দু’জন ঘুমোচ্ছিল আর দু’জন কোথায়, কে জানে।
পরিণীতা পিচঢালা রাস্তায় খালি পায়ে ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেলো পেছনের রাস্তায়।
তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে, এক উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের লম্বাটে পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে।
তার তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো চাতকের মতো তাকিয়ে আছে সপ্তদশীর মুখপানে।
পরিণীতার চোখের বাঁধ ভেঙেছে অনেক আগেই।
সে আর আশেপাশে, উপরে-নিচে কোথাও দেখলো না।
কোনো কথা বলার সুযোগও দিল না।
মুহূর্ত বিলম্ব না করে, এক ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আবিদের পুরুষালী প্রশস্ত বুকে।
আবিদের দুর্বল—শরীর তাল সামলাতে ব্যর্থ হলো।
দুই পা পিছিয়ে পরিণীতাকে নিয়ে উল্টে পড়লো কালো পিচঢালা রাস্তায়।
পরিণীতা কোনো দিকে তাকালো না।
আবিদের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো।
শরীরের যতটুকু শক্তি জমা ছিলো, সবটুকু দিয়ে তার ভালোবাসার পরীকে বুকে আগলে নিলো আবিদ।
তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো সুখের নিঃশ্বাস।
চোখের কোনা বেয়ে নেমে এলো নিঃশব্দে দুই ফোটা তরল।
তবে সে পরীকে কিছু বললো না।
পরীকে তার চোখের পানি ঝরাতে দিলো।
সময়ের সাথে সাথে পরিণীতার কান্নার তীব্রতা বাড়ছে।
সে অসাবধানতায় আবিদের বাহু চেপে ধরতেই মুহূর্তের মধ্যেই গরম কিছুতে পরিণীতার হাতে ভিজে গেলো।
তবে টু শব্দ করলো না আবিদ।
হাতে তরল অনুভব হতেই পরিণীতা থমকালো।
আবিদের বুক থেকে মাথা তুলে নিজের হাতের দিকে চাইলো।
সোডিয়ামের নিয়ন আলোয় পরিণীতা দেখতে পেলো, তার পুরো হাত লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে গেছে।
এটা তার মাস্টার মশাইয়ের রক্ত!
ভাবনাটা পরিণীতার বুক চিরে কলিজায় গিয়ে আঘাত লাগলো।
সে উদ্বিগ্ন চোখে তাকালো সামনের মানুষটার দিকে।
আবিদের মাথায় সাদা রঙা ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো।
দুই হাতে ব্যান্ডেজ বা হাতের কব্জিতে ক্যানুলা ফিট করা।
আর কোথায় কোথায় ব্যান্ডেজ আছে, তা কাপড়ের জন্য বোঝা যাচ্ছে না।
পরিণীতার দৃশ্যপটে আবার ভেসে উঠলো আবিদের সেই রক্তমাখা নিথর দেহের প্রতিচ্ছবি।
পরিণীতার কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে আসলো।
পরিণীতা অশ্রু-চোখে আবিদের ব্যান্ডেজগুলোতে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে,
দুই গালে হাত রেখে ভাঙ্গা কণ্ঠে শুধালো—
“আপনার অনেক লেগেছে, তাই না মাস্টার মশাই?”
আবিদ শান্ত চোখে চেয়ে দেখলো পরিণীতার চোখ-মুখের বিধ্বস্ত অবস্থা।
ফর্সা মুখটা কাঁদতে কাঁদতে রক্তাভ হয়ে গেছে।
সে দুর্বল হাতে পরিণীতাকে টেনে বুকে নিল, কোমল গালে হাত রেখে কপালে ও ঠোঁটে চেপে ধরলো।
মনের ভেতরের চলমান ঘূর্ণিঝড় ধামাচাপা দিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো—
“তখন না লাগলেও এখন খুব লাগছে অ্যাঞ্জেল।
পৃথিবীর সকল আঘাত এই বুক সহ্য করে নেবে,
কিন্তু আমার অ্যাঞ্জেল এর চোখের পানির বেদনা সহ্য করার মতো অত শক্তি যে এখনো হয়নি।”
পরিণীতা নিঃশব্দে চাইল আবিদের পানে, কান্না গিলে নিয়ে থমথমে কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“এত ব্যথা কী করে পেলেন, মাস্টারমশাই?”
আবিদ এই প্রশ্নে চমকালো না, বরং অতি শান্ত কণ্ঠে পরিণীতার বাদামী চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে বলল,
“এগুলো কিছু না, জাস্ট একটা মিনি অ্যাকসিডেন্ট। দুই একদিনে ঠিক হয়ে যাবে, পাখি, কিচ্ছু হয়নি।”
আবিদের ঠান্ডা মাথায় বলা মিথ্যে বাক্যগুলো পরিণীতার কোমল মনে বেদনার বিষ আরও বেশি ছড়িয়ে দিল। ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক ব্যথাতুর হাসি। সে দুই হাতে আবিদের টি-শার্ট খুলতে খুলতে বলল,
“এত ভালোবাসেন কেন, মাস্টারমশাই? আমি কি সত্যি এত ভালোবাসার যোগ্য? কেন এত বেপরোয়া হয়ে গেলেন? এত ভালো না বাসলেও হতো। আমি আপনাকে একটু ভালোবাসতে বলেছিলাম, অথচ আপনি নিজেকে ধ্বংসের সীমানায় নিয়ে গেলেন। এটা সহ্য করতে পারছি না… আপনার দেহের আঘাত… আমাকে ও আঘাত করুন।”
আবিদ খানিক চমকালো পরিণীতার কথায়। টি-শার্ট টেনে ধরে বলল,
“কাপড় খুলছো কেন?”
পরিণীতা টলমলে চোখে তাকাল আবিদের দিকে। আবিদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবারো তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল।
কিছুটা হকচকিয়ে গেল আবিদ। পরিণীতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমাকে মাফ করে দিন, মাস্টারমশাই। আমি বুঝতে পারিনি, আমার পাগলামি আপনার জীবনে এইভাবে ধ্বংস ডেকে আনবে। আমি যদি সেদিন একটু বুঝতে পারতাম, আমি আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারব না, তবে আমি কোনদিনও আপনাকে এই জীবনে জড়াতাম না। আপনি ভীষণ ভালো, মাস্টারমশাই। আপনি এসব ডিজার্ভ করেন না…”
আবিদের একটু সন্দেহ হলো। সে পরিণীতার মুখ তুলে, নরম গাল আলতো হাতে মুছে দিল। মখমলে গালে ঠোঁট চেপে ধরে কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে, জান? এমন করছো কেন? বললাম তো, ছোট একটা অ্যাকসিডেন্ট। দুই একদিনে আগের মতো হয়ে যাবো।”
পরিণীতা শান্ত হলো না। হেঁচকি তুলে বলল,
“মিথ্যে বলবেন না, মাস্টারমশাই। মিথ্যাটা আপনার সাথে যায় না। আমি সব জানি, মাস্টারমশাই, সব! এগুলো আমার জন্যে হয়েছে, তাই না?”
পরিণীতার কথায় এবার একদম স্তব্ধ হয়ে গেল আবিদ। অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল পরিণীতার দিকে।
পরিণীতা আবিদের টি-শার্ট তুলে দেখল, প্রায় পুরো শরীরেই ব্যান্ডেজ করা। পরিণীতা সবগুলোর উপর আলতো হাত ছুঁয়াল।
পরিণীতাকে দেখে মনে হচ্ছে ব্যথা আবিদ পায়নি, সে নিজেই পেয়েছে।
আবিদের অবস্থা দেখে পরিণীতার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।
আবিদ এখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে পরিণীতার দিকে। পরিণীতা আবিদের দিকে অশ্রু চোখে তাকিয়ে থেমে থেমে বলল,
“অনেক হয়েছে… আর না, নয়… আর ভালোবাসবেন না আমায়… আর আমার জন্য এত অমানবিক টর্চারও সহ্য করবেন না… আর কেনই বা এত কিছু সহ্য করছেন? আমি আপনার জন্য অভিশাপ, মাস্টারমশাই। আমি থাকলে আপনি বাঁচবেন না। আমি জানি, কিছুটা আমার পরিবারের অবস্থা… তাদের জন্য খুন করা মশা মাছি মারার সমান। আপনাকে খুন করলে তাদের কিছুই যাবে না… কিন্তু আমি… আমি শেষ হয়ে যাবো, মাস্টারমশাই… এই দিন দেখার আগে আমার মৃত্যু হক… মাস্টারমশাই… ওটাই বেশি সুখের হবে… তাই… আমাকে ভুলে যান, মাস্টার…”
পরিণীতা কথা শেষ করার আগেই তার মুখ চেপে ধরল আবিদ।
এতক্ষণে শান্ত দৃষ্টিজোড়া ভয়ার্ত, অস্থির, চঞ্চল হয়ে উঠছে। চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে তাতে তপ্ত অশ্রুকণারা ভিড় জমিয়েছে।
সে তড়িৎ বেগে পরিণীতাকে নিজের ক্ষতবিক্ষত বুকে মিশিয়ে নিল।
পরিণীতা সহসাই অনুভব করল, আবিদের হৃদয়ের অস্থির হৃদস্পন্দন।
আবিদ পরিণীতাকে জোরালো কণ্ঠে ধমকে উঠল,
“একদম চুপ! আজ যে কথা বলেছো, ঐ কথা আর দ্বিতীয়বার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করো না! তোমার মুখে যেন ওই কথা আর আমি কখনো না শুনি! তোমার কি মনে হয়, আমি কিছু না জেনে তোমাকে ভালোবেসেছি? তোমাকে আমি একদিন বলেছিলাম, এঞ্জেল… ভালোবাসতে ভয় না পেলে মরতেও ভয় পাওয়া উচিত না! মৃত্যু আসবে, জানেই… আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। আর আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ও আছি! তবে যতদিন বেঁচে থাকবো, আমার পরীকে বুকে নিয়ে বাঁচতে চাই! এই পরীকে ছাড়া আমি এমনিতেই মরে যাব ! কাউকে কষ্ট করে মারতে হবে না…
পরি, তুমি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। তুমি আমার আসক্তি, পরি। আমার সব! তুমি আমার বেঁচে থাকার কারণ, তুমি আমার মরে যাওয়ারও কারণ!
তোমাকে ভুলে থাকার সামর্থ্য আর এই হৃদয়ের নেই। যদি সে সামর্থ্য থাকত, তবে তোমাকে ভালোইবাসতাম না।
মৃত্যু আসুক, ভয় করি না।
তুমি শুধু এই বুকে থেকো, পাখি।
তোমার বাপ-চাচা আমার কিছুই করতে পারবে না। তোমাকে বুকে নিয়ে মরার সুখ থেকে আমি বঞ্চিত হতে চাই না, জান… আফসোস নিয়ে বেঁচে থাকার থেকে ভালোবেসে মরে যাওয়া ঢের ভালো…
আমার জান… আমার পরি…”
আবিদের কথায় পরিণীতার নিঃশ্বাসটুকু আটকে আসল কণ্ঠনালীতে। কিন্তু এসব তো সে দেখতে পারবে না।
পরিণীতার মনে পড়ল মেসেজের সেই শেষ বাক্যগুলো।
পরিণীতা আবিদের বুক থেকে মাথা তুলে মায়াভরা চোখে তাকাল আবিদের শ্যামবর্ণ মুখশ্রীতে। চোখের পানি মুছে নিয়ে নরম কণ্ঠে বলল,
“শরীরের এত ব্যথা নিয়ে এসেছেন কেন, দেখে তো মনে হচ্ছে হাসপাতাল থেকে এসেছেন?”
পরিণীতার সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশস্ত হাসল আবিদ। বুকের বা পাশে ইশারা করে বলল,
“এখানটায় প্রচণ্ড ব্যথা করছিলো…”
সাথে সাথেই উদ্বিগ্ন হলো পরিণীতা। উত্তেজিত হাতে স্পর্শ করল সেই পাশে।
পরিণীতার আকুলতা দেখে হেসে ফেলল আবিদ।
পরিণীতার মাথাটা নিজের বুকের বা পাশে চেপে ধরে বলল,
“এইখানে কান পেতে শুনো, এখানে থাকা ছোট্ট পাখিটা শুধু পরিকে একবার দেখবে বলে কতো কাঁদছিলো জানো। নিঃশ্বাসটাও নিতে পারছিলো না… তাই এসেছি… একটু স্বস্তি দাও অ্যাঞ্জেল…”
পরিণীতার ভীষণ মায়া লাগল। একদিনেই মেয়েটার জীবন উলটপালট হয়ে গেছে।
আবিদ পরীর দিকে তাকিয়ে তার কোমল হাত দুটো তুলে তার এপিঠ ওপিঠে চুমু খেয়ে মিহি কণ্ঠে বলল,
“যে ব্যক্তি অতিরিক্ত মাদক সেবন করতে করতে মৃত্যুর পর্যায়ে চলে যায়, তাকে আর মৃত্যু ব্যথিত মাদক ছাড়ানো সম্ভব হয় না, পরি। জোর করে সেই চেষ্টা করোনা। না হলে পরে দেখবে, যাকে নেশাদ্রব্য দিলে সে দু’দিন বেশি বাঁচতো, তার কাছ থেকে তার প্রিয় নেশা কেড়ে নিয়ে ‘পরোপকার’ করতে গিয়ে তুমি তাকে সময়ের আগেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলে।
ঠিক তেমনি, তুমি যেহেতু সব জেনে গেছো, তাই লুকিয়ে লাভ নেই।
আমি আমার পরির সাথে বাঁচতে চাই, যতদিন বাঁচা যায়।
আমাকে শেষ করে দিও না, পরি।
আমি তোমাকে না দেখে, না ছুঁয়ে থাকতে পারি না, পরী। পারবোও না।
তুমি আমার জন্য সেই তীব্র মাদকীয় আসক্তি, যা আমার থেকে কেড়ে নিলে, আমাকে সে ভয়ংকর, নিষ্ঠুর, যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেবে, পরি, যা আমার রূহকেও শান্তিতে থাকতে দেবে না…”
পরিণীতার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আবিদ অসহায় চোখে তাকাল পরিণীতার দিকে। কপালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলল,
“তোমার বুকে একটু মাথা রাখতে দেবে, পরি? কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছে…”
পরিণীতা ফুপিয়ে উঠল। আবিদের মাথাটা শক্ত করে নিজের বুকে চেপে ধরল। তার এলোমেলো চুলের ভাঁজে হাত রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল,
“আপনি খুব স্বার্থপর, মাস্টারমশাই… শুধু নিজের দিকটাই ভাবলেন…”
পরিণীতার দুই চোখের কোন বেয়ে নেমে আসছে অঝোর ধারায় নুনা পানির ধারা…
আবিদ পরিণীতার কোমল সুবাসময় বক্ষে নাক-মুখ ডুবিয়ে দিল। প্রাণভরে সেই প্রিয় নারী দেহের গন্ধটা এনহেল করল শ্বাসে শ্বাসে, দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
শক্ত করে পরিণীতার পিঠ জড়িয়ে ধরে বলল,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৬
“আমার কিছু চাই না, পরি… আমার শুধু তুমি হলেই চলবে… ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে, পরি… তুমি শুধু আমার হয়ে থাকো… অন্য কিছু নিয়ে তোমার ভাবার প্রয়োজন নেই…”