ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫০

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫০
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

রায়পুরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত চন্দ্রবন—এই বনের শোভা সৌন্দর্য নিয়ে আশেপাশের অন্তত পাঁচ গ্রামে নানা রকমের গল্প প্রচলিত রয়েছে।
এ যেন প্রকৃতির এক অনবদ্য সৃষ্টি। এটি শুধু সৌন্দর্যে নয়, বরং জৈব সম্পদে পরিপূর্ণ এই বৃহৎ জঙ্গল। জঙ্গলের বুকে ছড়িয়ে রয়েছে নানা প্রজাতির ঔষধি লতা-পাতা, শতবার্ষিকী প্রাচীন গাছপালা থেকে শুরু করে ছোট ছোট ঝোপঝাড়—সবই যেন নিঃশব্দে নিজের অস্তিত্বের গল্প বলে চলে। এই পুরো জঙ্গলটা শিকদারদের নিজস্ব সম্পদ।
জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে লাল মাটির কাঁচা রাস্তা।
রাস্তার দুই পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী শাল, সেগুন আর নাম না জানা অজস্র গাছ যেন প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছে।

তাদের ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের সোনালি রশ্মি নিঃশব্দে খেলা করে—আলো আর অন্ধকারে মিশে তৈরি হয় এক দুর্বোধ্য রহস্যময় মায়াজাল।
এই নির্জন পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই চোখে পড়ে যায় এক পুরনো মরচে পড়া লোহার গেট।
গেটটি শতাব্দীপ্রাচীন হলেও এখনো দণ্ডায়মান, দৃঢ় ও অটুট।
তার ওপরে ঝুলে থাকা একটি ধাতব নেমপ্লেটে লেখা— “শিকদার কুঞ্জ”
গেট পেরোতেই চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয় এক বিশাল বাগানবাড়ি।
দুই তলা বিশিষ্ট সাবেক আমলের স্থাপত্য, যার বয়স প্রায় দুই শতকের বেশি।
পুরো বাগানবাড়ি সহ এই বিশাল প্রপার্টি প্রায় ৬০ হাজার স্কয়ার ফিট জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।
এই বাগানবাড়িকে ঘিরে গোলাকৃতি, বিশ ফুট উঁচু সুরক্ষা প্রাচীর—যার পাশ ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে নারকেল ও সুপারি গাছ, যেন বংশপরম্পরায় অভিভাবকের ভূমিকায়।
বাড়ির পেছনে ৮০,০০০ স্কয়ার ফিট বিস্তৃত বিশাল আমবাগান।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পূর্বদিকে জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, সবেদা সহ আরও নানা দেশি ফলের গাছ।
উত্তর দিকে সুবিশাল ফুলের উদ্যান, যার কেন্দ্রে এক প্রাচীন লোহার দোলনা—যেটিকে সাদা রঙে রাঙানো হয়েছে, যেন ভালোবাসার স্পর্শ আজও তার গায়ে লেগে আছে।
এই পুরো বাড়ির পরিবেশে যেন মিশে আছে এক অন্যরকম আবহ—সুগন্ধ, অপার্থিব নীরবতা, এক অফুরন্ত শান্তির ঠিকানা যেখানে চাপা পড়ে আছে ইতিহাসের ঘেরা সেই সোনালী অধ্যায়।
এই গহিন জঙ্গলের বুকে এই বাগানবাড়ির নির্মাণ করেছিলেন সাজিদ শিকদারের প্রয়াত পিতা, জিহাদ শিকদার।
তিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় এই বাড়িতেই অতিবাহিত করেছেন।
এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় স্থান।

তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররাও যেন এই বাড়িতে বসবাস করে।
তবে বাস্তব চিত্র অন্যরকম—সবসময় মনোবাঞ্ছা মেনে চলে না।
মনের মিল, রুচি, জীবনধারা—এসব বদলে গেলে স্মৃতি হয়ে যায় উপেক্ষিত।
জিহাদ শিকদারের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে সাদমান শিকদার রায়পুরের পুরনো জমিদার বাড়ি ভেঙে সেখানে আধুনিক ঢাঁচে তৈরি করেন “প্রণয় কুঞ্জ” এবং পরিবার নিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ফলে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে স্মৃতিবহ এই বাগানবাড়ি—দুজন কেয়ারটেকার ব্যতীত কেউই আর এখানে বসবাস করে না।

তবে বছরের ৩৬৪ দিন এই বাড়িতে না আসলেও, প্রতিবছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে সাদমান শিকদার তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে এসে এই বাড়িতে বসবাস করেন। প্রতি বছরে একদিন, তাঁর পিতা-মাতার স্মৃতি চর্চা করেন।
প্রতি বছরে ১০ই আগস্ট, জিহাদ শিকদারের জন্মবার্ষিকীতে, পুরো শিকদার পরিবার এই বাড়িতে জড়ো হয়।
বাড়ির পশ্চিম দিকে শিকদার পরিবারের পারিবারিক গোরস্থান—সেখানে সকলেই প্রয়াত জিহাদ শিকদারের কবর জিয়ারত করে, স্মরণ করে প্রিয় পিতাকে।
ঠিক তেমনই একদিন আজ।
জিহাদ শিকদারের চার পুত্র, তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানসহ সকলেই উপস্থিত এই বিশেষ দিনে।
তবে এ বছরের এই জন্মবার্ষিকীতে একটু ভিন্নতা ও রয়েছে।
এই বছর শিকদার পরিবারের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সাদমান শিকদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার—মাফিয়া দুনিয়ার কিংবদন্তি ‘ডিকে বস’।

সঙ্গে আছেন তাঁর দুই সন্তান—১৮ বছরের পুত্র রিক ও ১৫ বছরের কন্যা এলিনা।
বাগানবাড়ির গার্ডেনে আজ চাঁদের হাট বসেছে।
এই বাড়ির বাগানটা শিকদার বাড়ির বাগানের থেকেও বিশাল—সব দিকে সবুজ আর সবুজ, সেই সবুজের সমারোহে মেতে উঠেছে – প্রিয়তা, পরিণীতা, থিরা, থোরি, তন্ময়—সবাই নরম ঘাসের উপর দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি করছে।
যদিও তন্ময় এখনো হাঁটা শিখেনি, তবুও সে কারও চেয়ে কম নয়।
ডিকে বসের সন্তানরাও এই শিশুদের প্রতি দারুণ মমতাশীল।
বিশেষ করে রিকের চোখে প্রিয়তা যেন এক জীবন্ত পুতুল।
তার দীঘল, হাঁটু ছুঁয়ে যাওয়া চুল, আর নীল চোখ—যা রিককে বারবার ভাবাতে ও আকর্ষিত হতে বাধ্য করে।
সবদিক থেকে ভাবনা-চিন্তা করতে গেলে রিকের কাছে প্রিয়তা রূপকথার ‘রূপাঞ্জেল’ এর মতো লাগে।
ভীষণ ইচ্ছা করে এই রূপাঞ্জেলের সাথে একটু কথা বলতে।
রিকের এই কল্পনার ঘোরে সে কখন যেন নিজের অজান্তেই প্রিয়তার লম্বা চুলে হাত দিতে উদ্যত হয়, চুলটা স্পর্শ করতে যাবে—

ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে আসে এক গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বর—
“Stop! Don’t touch my princess!”
সহসাই হাত থেমে যায় রিকের।
চমকে উঠে সে পেছন ঘুরে তাকায়।
প্রিয়তাও কারো কণ্ঠে পিছনে তাকিয়ে দেখে—তাদের থেকে কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ দেহি, সুদর্শন পুরুষ।
চোখে তার চাপা ক্ষোভ, তবে তা মুখের আদলে প্রকাশিত হচ্ছে না।
সামনের ব্যক্তিকে দেখে প্রিয়তার দৃষ্টিতে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়ল।
সে এক দৌঁড়ে ছুটে যায় তাঁর কাছে।
হাস্যজ্জ্বল মুখে, মাথা উঁচিয়ে, মায়াবী দৃষ্টিতে চাইল সেই ব্যক্তির পানে।

আলতো করে প্রণয়-এর পুরো আঙুলের ভাঁজে নিজের কোমল আঙুল জড়িয়ে নিল।
রিক হালকা হাসার চেষ্টায় এগিয়ে আসলো প্রণয়-এর কাছে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রিয়তার প্রশংসা করে বললো,
“Oh, your princess is very beautiful.
I’ve seen many girls, but no one seemed as beautiful as her.”
রিক-এর কথায় প্রণয়ের প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো।
মনে মনে রাগে ফুসে উঠলেও, মুখে কিছু বললো না, কারণ ডিকে বস-এর সাথে ঝামেলায় জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
তাই প্রণয় রিক-এর কথার কোনো উত্তর দিল না।

নিজের হাতে মুঠোয় থাকা কোমল হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বাগানবাড়ির গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
তবে রিক কিছু মনে করলো না, কারণ একটাই—সে বাঙালি নয়।
তাই মনে বাঙালিদের মতো জিলাপির প্যাঁচ নেই।
তবে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে, উক্ত ঘটনার সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছিল প্রহেলিকা।
আজ, যে করেই হোক, প্রণয়কে সে তার মনের কথা জানিয়েই ছাড়বে।
বলবেই—কতটা ভালোবাসে তাকে, কতটা চায় তাকে নিজের করে।
আর এর একটা পরিষ্কার উত্তর না নিয়ে আজ থামবে না প্রহেলিকা।
তাই এই অদম্য সংকল্প নিয়ে, নিঃশব্দে এবং সতর্ক পায়ে, সে-ও প্রিয়তা আর প্রণয়ের পিছু নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।

প্রণয় প্রিয়তাকে নিয়ে হাঁটছে—ঘন জঙ্গলের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে।
চারদিকে সবুজ অরণ্যে ঘেরা মাটির রাস্তাটা ঢেকে আছে শুকনো পাতার চাদরে, যেন গাছেরা নিজেদের ঝরাঝরা স্মৃতি বিছিয়ে পথ সাজিয়ে রেখেছে।
বসন্তের বিকেলের কোমল আলো পাতার ফাঁক দিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে পথের মাটি, বাতাসে উড়ে আসছে থোকায় থোকায় শিমুল তুলো।
প্রকৃতি বিলাস করতে করতে সেই পথে হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলেছে এক যুগল।
সেই যুগলকে কোনো দিক থেকেই কপোত-কপোতী বা প্রেমিক-প্রেমিকা বলা চলে না।
আবার ভাই-বোন বলতেও কোথাও একটা বাঁধবে।

বর্তমান দৃষ্টিতে তাঁদের দুজনের ব্যবধান অনেক—তাঁদের একজন সম্পূর্ণ পরিণত, ভারি চেহারার, ব্যক্তিত্ববান, তো অন্যজন একেবারেই অপরিপক্ব, অবুঝ, শিশুসুলভ, উচ্চতায়ও সেই পুরুষের অর্ধেকেরও কম।
সবকিছুই বেমানান, তবুও কোথাও একটা চমৎকার ভাবে মানিয়ে গেছে, যা চোখের দেখায় প্রকাশিত হয় না।
অনেকক্ষণ যাবৎ প্রণয় কোনো কথা বলছে না।
চোখ-মুখ গম্ভীর করে এক ধ্যানে হেঁটে চলেছে, যেন পাশের মহিলাকে সে চেনেই না, তাঁর সাথে তার কোনো কথা নেই।
তবে প্রিয়তা তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
তার তখন থেকে কথা বলার জন্য পেট মুচড়াচ্ছে, ঠোঁট দুটো নিশফিশ করছে কিছু একটা বলার জন্য।
তবে প্রণয় ভাইকে রাগী রাগী মুখে থাকতে দেখে একটু একটু ভয়ও লাগছে।
আরও খানিকটা হেঁটে যেতেই প্রিয়তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ল।
সে আর চুপ করে থাকতে পারলো না।
ভয় ভয়, নিচু কণ্ঠে ডাকলো,

“… প্রণয় ভাই…”
জবাব দিল না প্রণয়।
প্রিয়তা এবার আরেকটু সাহস যোগিয়ে প্রণয়ের পেটের কাছের শার্ট টেনে ধরল, কণ্ঠের কোমলতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে আরও দুইবার ডাকলো, “ও… প্রণয় ভাই…”
এবারও জবাব দিল না প্রণয়, চোখ মুখ আগের মতোই শক্ত।
প্রণয়ের এমন নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য হলো না প্রিয়তার।
এমন নিগূঢ় নিশ্চুপতা ও উপেক্ষায় ছোট্ট মনে ব্যথা অনুভব হল।
কেন প্রণয় ভাই তার সাথে এমন করছেন? কেন কথা বলছেন না তার সাথে?
সে তো প্রণয় ভাইয়ের সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না—এটা কি তিনি জানেন না?
এসব ভাবনাতেই প্রিয়তার চোখে স্বচ্ছ পানি টলমল করে উঠলো।
সে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আচমকাই ফুঁপিয়ে উঠলো।

সঙ্গে সঙ্গেই পদযুগল স্থির হয়ে গেল প্রণয়ের।
সে মাথা নিচু করে তাকালো প্রিয়তার রক্তিম, কান্না মিশ্রিত মুখপানে।
প্রিয়তা ফুঁপাতে ফুঁপাতে অভিমানে প্রণয়ের হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল।
নাক টানতে টানতে শুকনো পাতার উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়লো।
প্রণয় বুঝলো—তার জানপাখির খুব অভিমান হয়ে গেছে।
সে নিজেও তো মনে মনে ভীষণ রেগে আছে।
কোথায় সে অভিমান করে বসে থাকবে, তা না! পান থেকে চুন খসলেই মহারানী কেঁদে কুটে সাগর বানিয়ে ফেলেন!
আচ্ছা, এই মেয়েটা কি কখনো তার রাগের আড়ালের ভালোবাসাটা দেখতে পাবে না?
প্রিয়তা প্রণয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘুরে বসলো।
অন্য দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

অসহায়ত্বের এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রণয়ের বুক চিরে।
সে প্রিয়তার দুই বাহু ধরে এক টানে তাকে বসা থেকে উঠিয়ে দিল।
প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগে, তার দুই বাহু ধরে উপরে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে নিল।
কপালে উষ্ণ পরশ এঁকে দিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো—
“পাখি… তুই বড্ড অবুঝ… কবে বড় হবি বল?”
প্রণয়ের উষ্ণ আদরে প্রশ্রয় পেয়ে গেল প্রিয়তা।
গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
অভিমানী কণ্ঠে অভিযোগ করল—

“আপনি আমায় একটু ও ভালোবাসেন না প্রণয় ভাই… একটু ও না…”
প্রিয়তার বোকা বোকা কথায় হেসে ফেললো প্রণয়।
তুলতুলে গালে লালচে খয়েরি অধর চেপে ধরে বললো—
“এত ভালবাসি, তারপরেও ভালোবাসা কম পড়ে জান।”
প্রণয় আবারো প্রিয়তার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল—
“এই বুকের কতখানি তোর জন্য, তা একবার যদি তোকে দেখাতে পারতাম জান…”
প্রণয় প্রিয়তাকে নামিয়ে দিল।
আবার আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে হাঁটতে হাঁটতে বললো—
“একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা জান পাখি…
তোকে আমার করে না নেওয়া পর্যন্ত আমার যে দুশ্চিন্তা কমবে না…
আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না…

আমার শান্তির ঘুম হারাম হয়ে গেছে অনেক বছর…
তোকে একবার আমার নামে দলিল করে নিতে পারলে, এর পর আর আমার কোনো চিন্তা থাকবে না আমার…
আমি একটু নিশ্চিন্তে তোর বুকে ঘুমাতে পারবো…
আমার যে বড্ড চিন্তা হয় তোকে নিয়ে…
আমার যে শত্রুর অভাব নেই জান…
কতজনের আমার থেকে কত রকম চাহিদা…
তারা কখনো জানতে চায় না যে আমি কী চাই, আমার মন কী চায়…
স্বার্থপর, সব বেইমানদের ভীড়ে বাস করি…
কখন কে কিভাবে ছুরি মেরে দেবে, বুঝতেও পারব না…
আমার যে এই পৃথিবীতে তুই ছাড়া কাউকে চাই না জান… কিচ্ছু চাই না…
শুধু তুই আমার হয়ে থাক…

তোর ভালোবাসায়, নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চাই আজীবন…”
“আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও… একটু তাড়াতাড়ি বড় হো…”
প্রিয়তা কিছুই বুঝলো না প্রণয়ের কথার আগা মাথা…
শুধু ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলো তার মুখের দিকে।
প্রণয় ওই বোকার চোখের চাহনি দেখে আবারো গলে গেল।
ইসস! মেয়েটা এত আদুরে কেন!
প্রণয়, পড়ন্ত বিকেলে প্রিয়তমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কন্ঠে সুর তুলল—
আমার ভিতর ও বাহিরে,

অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
আমার, ভিতর ও বাহিরে,
অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি, হৃদয় জুড়ে।
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক,
খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ।
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক,
খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ।
তেমনি তোমার গভীর ছোয়া,
তেমনি তোমার গভীর ছোয়া,
ভিতরের এই বন্দরে।
আমার ভিতর ও বাহিরে,
অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
আমার ভিতর ও বাহিরে,
অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম,
পাপড়ির আবডালে ফসলের ধুম।
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম,
পাপড়ির আবডালে ফসলের ধুম।
তেমনি তোমার নিবিড় চলা,
তেমনি তোমার নিবিড় চলা,
মরমের মূল পথ ধরে।
আমার ভিতর ও বাহিরে,
অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
আমার ভিতর ও বাহিরে,
অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি, হৃদয় জুড়ে।

প্রিয়তা মুগ্ধ কণ্ঠে শুনলো প্রণয় ভাই এর গান।
প্রণয় ভাই এর সবকিছুই তার কাছে বড্ড ভালো লাগে।
প্রণয় ভাই, মানুষটাই এমন ভালবাসা ময় যে প্রিয়তা তার আকর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনা।
প্রণয় এর পথ চলতে চলতে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে যে কেউ তাদের পিছু নিচ্ছে… আর প্রণয় এটাও বেশ ভালোই জানে যে কে তাদের পিছু নিচ্ছে।
কিন্তু এসব তামাশা দেখার মতো সময় প্রণয় এর হাতে নেই।
সে সব কিছু উপেক্ষা করে তার প্রিয়তমার সঙ্গ উপভোগ করছে।
তার কাছে অন্যের ফালতু প্যাচাল শোনার মতো সময় মোটেই নেই।
কিন্তু প্রণয় ভাবনা শেষ করার আগেই পেছন থেকে রিনরিনে নারীকণ্ঠ ভেসে আসলো।

“প্রণয়”
দাঁড়িয়ে পড়লো প্রণয়, বিরক্তিতে প্রণয়ের মুখ থেকে ‘চ্’ সূচক শব্দ বেরিয়ে আসলো।
এখন না জানি কী কী শুনাবে তাকে!
লজ্জা লজ্জা মুখে, কিছুটা কোণ্ঠা নিয়ে এগিয়ে আসলো প্রহেলিকা। কিছুটা ভয়, কিছুটা লজ্জা আর কিছুটা উত্তেজনায় প্রহেলিকার দেহে মৃদু কাপন ধরছে।
সে এলোমেলো চোখে আশেপাশে দৃষ্টি পাত করছে। হৃদপিণ্ডে গতি বাড়ছে হুহু করে।
প্রণয় বিরক্ত চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকে পর্যবেক্ষণ করলো। অতঃপর কিঞ্চিত ব্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কিছু বলার থাকলে বলো, আর না হলে পথ ছাড়ো।”
প্রহেলিকা, লজ্জা লাগছে… প্রচন্ড, ভালোবাসার মানুষের সম্মুখে ভালোবাসার কথা বলাটা যে কতটা কঠিন তা কেবল তারাই বুঝে যারা এই পরিস্থিতিতে কখনো পড়েছে।
প্রিয়তা গুল গুল চোখে তাকিয়ে আছে দু’জনের দিকে।
প্রহেলিকা কিঞ্চিত জড়তা নিয়ে বললো,
“Please… যেও না প্রণয়… আমার তোমাকে অনেক কথা বলার আছে।”
প্রণয় বুকে হাত গুজে, কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,

“বলো।”
প্রহেলিকা ঢোঁক গিলে, তুতলিয়ে তোতলিয়ে বললো,
“না মা-মানে… প্রণয়… আমি আসলে…”
প্রণয় আরও কিঞ্চিত বিরক্ত হলো, তবু ধৈর্য ধরে বললো,
“হ্যাঁ… বলো, কী বলতে চাও তুমি?”
প্রহেলিকা চোখ-মুখ খিঁচে, এক শ্বাসে বললো,
“I love you Pronoy… I really love you… will you marry me…?”
প্রহেলিকা অসস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে।
তবে প্রণয় নির্বিকার। তার মুখের এক্সপ্রেশনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে আগে থেকেই জানত প্রহেলিকা এমন কিছুই বলবে।
প্রিয়তা গুল গুল চোখে তাকিয়ে আছে প্রহেলিকার দিকে।
প্রণয় মাথা নিচু করে প্রিয়তার দিকে তাকালো, আদুরে কণ্ঠে বললো,
“জান, ওই যে দূরে গাছটা… ওখানে গিয়ে দাঁড়া… আমি এখুনি আসছি।”
তাই করলো প্রিয়তা।

কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বাধ্য মেয়ের মতো, কিছুটা দূরে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো।
প্রহেলিকার চোখে-মুখে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে…
প্রণয় কয়েক সেকেন্ড সেটা দেখে, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
“এসব তোমার পাগলামি, আমার কাছে এসবের কোন অর্থ নেই প্রহেলিকা… আমি তোমাকে বোন মনে করি প্রথম থেকেই। আমার অন্যান্য ভাইবোনদের মধ্যে আর তোমার মধ্যে কখনো পার্থক্য করিনি।
তাই আমাদের মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্ক হওয়া কখনো সম্ভব না।
আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”

প্রণয় এর স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে প্রহেলিকার পৃথিবী দুলে উঠলো…
সেকেন্ড পার হবার আগেই চোখ দুটো জলে টইটুম্বুর হয়ে গেল।
তবে তা দেখলো না প্রণয়, তার আগেই চোখ ফিরিয়ে নিল।
প্রহেলিকা জানে প্রণয় তাকে ভালোবাসে না,
তাই বলে এইভাবে প্রত্যাখ্যান করবে!
প্রণয় আর কিছু না বলে চলে যেতে নিতেই খপ করে তার হাত ধরে ফেললো প্রহেলিকা।
প্রণয় কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের বেগে প্রণয়ের বলিষ্ঠ বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো, শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো প্রণয়ের পিঠ।

ক্রন্দনরতো কণ্ঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,
“প্লিজ প্রণয়, এমন কোরো না আমার সাথে। আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না প্রণয়। বিশ্বাস করো, তুমি আমাকে ভালো না বাসলে আমি কি নিয়ে থাকবো বল,প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ দাও – আমি তোমাকে অনেক সুখে রাখবো, অনেক ভালোবাসবো।
প্রহেলিকা আবারো কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে ও একটু ভালোবাসো প্রণয়।
কেন ওই দুধের বাচ্চাটার পেছনে পড়ে আছো? ওর কি যোগ্যতা আছে তোমাকে পাওয়ার? কেন ওকে এত ভালোবাসো প্রণয়?

আমি কি ওর থেকে কম সুন্দরী? ও কি এমন দিতে পারবে যা আমি দিতে পারবো না?
বরং আমি যা দিতে পারবো, তা ও কখনো তোমাকে দিতে পারবে না।
ও কখনো তোমাকে স্যাটিসফাই করতে পারবে না ?
ওর তো শরীর—আর কিছু বলার!”
প্রণয় ঝাড়া মেরে প্রহেলিকাকে নিজের থেকে আলাদা করে নিলো—
কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ল প্রহেলিকা।
চোখ তুলে সামনে তাকানোর আগেই তার বা গালে পুরুষালি হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ জল জল করে ভেসে উঠলো।

প্রহেলিকা অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে।
প্রণয়ের চোখ দুটো বেয়ে যেন গলিত লাভা উপছে পড়ছে।
রাগে তার কপালের ফর্সা চামড়া বেঁধ সবুজ শিরা ফুলে উঠেছে।
সে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকালো প্রহেলিকার দিকে, দাঁতে দাঁত পিষে রাগে কিড়মিড় করতে করতে বললো,
“তোর কোনো যোগ্যতা আছে আমাকে পাওয়ার? নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছিস?
তোর কি যোগ্যতা আছে আমার জানকে নিয়ে মন্তব্য করার!
আর তুই স্যাটিসফ্যাকশন এর কথা বলছিস? ছি! কত নোংরা মানসিকতা!
ও একটা ছোট বাচ্চা।

আর আমার যদি সেটিসফেকশনের প্রয়োজন হল তাহলে আমি ওর কাছেই যাবো।
আমি তোকে ভালোবাসিনি, আর কোনোদিন বাসবোও না।
আমি ওকে ভালোবেসেছি।
আর আমার শ্বাস যতক্ষণ চলবে, ওকেই ভালোবাসবো—এটা ভালো মতো মাথায় ঢুকিয়ে নে।”
বলে চোখ ফিরিয়ে নিলো প্রণয়।
প্রিয়তার হাত চেপে ধরে হন হন করে চলে গেল সেখান থেকে।
প্রণয়ের এমন ভয়ঙ্কর রাগ দেখে রীতিমতো থর থর করে কাঁপছেন প্রিয়তা।
প্রহেলিকা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের যাওয়ার পানে।
যন্ত্রণায় তার হৃদপিণ্ড অবশ হয়ে আসছে, আর রাগে তার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে — সবকিছু জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে, ভস্ম করে দিতে মন চাচ্ছে।

প্রহেলিকা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল।
রাগে, অপমানে, ভালোবাসা না পাওয়ার ব্যর্থতায় সে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
তার সকল অপ্রাপ্তি, অপমানের জ্বালা — সবকিছু গিয়ে আচড়ে পড়লো প্রিয়তার উপর।
প্রহেলিকা নিজেই নিজের চুল টেনে ধরে চিত্কার দিয়ে কেঁদে উঠলো।
দাঁত কিড়মিড় করে, হিসহিসিয়ে বললো,
“আমি যদি তোমাকে না পাই প্রণয়, তুমি ও কখনো তোমার ভালোবাসা পাবে না!”
প্রহেলিকার চোখ-মুখে ভয়ঙ্কর হিংস্রতা ফুটে উঠেছে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
“আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিলে তো? এবার দেখবি আমি তোর থেকে কী কী কেড়ে নিতে পারি!
আমার থেকে সব কেড়ে নেওয়ার ফল হবে ভয়ংকর! এতদিন তোকে বোন বলে অনেক ছাড় দিয়েছি — কিন্তু আর নয়।

প্রণয়কে আমি কাউকে দেবো না।
প্রণয়, আমার — শুধুই আমার!”
প্রহেলিকা বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলালো।
কয়েক মিনিট একদম চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবলো।
অতঃপর মুখে ফুটে উঠলো এক ভয়ঙ্কর বাঁকা হাসি।
বাড়ির দিকে যেতে যেতে রহস্যময় কন্ঠে বললো,
“আজ কিছু তো হবেই! যা আমার আদরের বোনের জন্য মোটেও ভালো হবে না!”
শিকদারদের বাগান বাড়ি ‘শিকদার কুঞ্জ’ আজ উজ্জ্বল ভাবে নতুন সাজে সেজে উঠেছে।
গভীর অরণ্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাংলোটা সারা বছর শুনশান নিস্তব্ধতায় এই বনের মধ্যে ভূত বাংলো হিসেবে পড়ে থাকে।
এবং সারা বছর অবহেলায় পড়ে থাকা বাংলোটি বছরে একবার জমকালো আয়োজনের সেজে ওঠে — শুধু এই একটি দিনের জন্য।

বাকি ৩৬৪ দিন এটা ভূতুড়ে বাংলোই থেকে যায়।
কিন্তু আজ সেই ব্যতিক্রমী দিন।
আজ ‘শিকদার কুঞ্জে’ শিকদার পরিবারে বাৎসরিক পারিবারিক মিলনমেলা।
সাদমান শিকদারের আমন্ত্রণে ইতিমধ্যেই ভিড় জমেছে — তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, বন্ধু, ব্যবসায়িক সহযোগী, কলিগ, এমনকি কিছু মিডিয়া পারসোনালিটিরও।
গার্ডেন এরিয়ায় শুরু হয়ে গেছে জমকালো পার্টির মূল অংশ।
হালকা আলো, ফুলের গন্ধ আর উচ্চ-সোসাইটির হাসি-মজা মিলিয়ে যেন এক অভিজাত উৎসবের আবহ।
তবে এতকিছুর মধ্যে আজকের পার্টির মূল আকর্ষণ হলো — DK বস।
ব্যবসায়িক জগতে DK এমন এক নাম, যার সুনজরে থাকার জন্য বিজনেসম্যানরা সবকিছু করতে প্রস্তুত।
দিনে দু’বার পা ধুয়ে দিতে হলেও তাদের আপত্তি নেই।
কারণ DK বসের আশীর্বাদ মাথার উপর থাকলে, বিজনেস ওয়ার্ল্ডে — নাম, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, স্ট্যাটাস, টাকা-পয়সা সব কিছু আপনা হতে হেঁটে চলে আসে।
আর পাওয়ার থাকে শীর্ষে।

এই DK-র উপস্থিতির জন্যই আজকের পার্টিতে অতিথিদের ভিড় যেন পিঁপড়ের সারির মতো বেড়েই চলেছে — একটানা, গুছানো আর উদ্দীপনায় ভরা।
এই বিশেষ সন্ধ্যায় সাদমান শিকদারের একটা বিশেষ উদ্দেশ্যও আছে —
তিনি চান, তাঁর বড় ছেলের সঙ্গে DK বসের প্রফেশনালভাবে পরিচয় করাতে।
চান, তাঁর উত্তরসূরি যেন এই সাম্রাজ্যের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয় — বৈধ হোক কিংবা অবৈধ, সবই।
কারণ, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস — বাকি সব সন্তানের তুলনায় তার বড় ছেলের বুদ্ধিমতা অনেক বেশি তীক্ষ্ণ।
আর এই ছেলের হাত ধরেই তাঁদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ আরও ১০ গুণ উজ্জ্বল হতে পারে।
আর তাতে তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে পারে — DK বস।
তাই আজকের পার্টির ব্যস্ততা থেকে একটু বিরতি নিয়ে তিনি বাংলোর ভিতরে ঢুকে পড়লেন — একান্তে ছেলের সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য।

প্রিয়তা একটা বেবি পিংক কালার প্রিন্সেস গাউন পরে প্রণয় বেডের ঠিক মাঝখানটায় আসন পেতে বসে আরাম করে নিজের পছন্দের কিটক্যাট চকলেটে কামড় বসাচ্ছে।
তার হাঁটু সমান ঘন লম্বা চুলগুলো প্রণয় সুন্দরভাবে বিছানার চার পাশে বিছিয়ে দিয়ে পাখা অন করে রেখেছে, যাতে ফ্যানের বাতাসে চুলগুলো তারাতারি শুকিয়ে যায়, কারণ এই বাড়িতে কোনো হেয়ার ড্রায়ার নেই।
প্রণয় প্রিয়তার কাছে বসে সুন্দরভাবে প্রিয়তার সামনে পড়া বেবি হেয়ারগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো।
হাতের তালুতে Moisturizing Cream টা দিয়ে আলতো হাতে প্রিয়তার সারা মুখে অ্যাপ্লাই করে দিল।
দুই হাত মুখে ব্লেন্ড করে দিতে দিতে বলল,

“আমি যতক্ষণ না পর্যন্ত সাওয়ার নিয়ে বেরচ্ছি, ততক্ষণ এই ঘরের বাইরে পা রাখবি না। আর সব থেকে ইম্পরট্যান্ট কথা, আজকে বাড়িতে অনেক নতুন মানুষ এসেছেন, আরও আসবে। তাই ভুল করে ও কোনো অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলবি না। বড় ছোট যেমনই হোক, কাছে ডাকলে যাবি না। সবার উদ্দেশ্যে যে ভালো হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। তোকে নিয়ে আমি কোন রিস্ক নিতে পারব না। তাই সব সময় আমার আশেপাশে থাকবি। বুঝতে পেরেছিস?”
প্রিয়তা প্রণয়ের গালে টুক করে একটা চুমু খেয়ে মাথা উপর নিচ ঝাঁকালো, কিউট ফেস বানিয়ে বলল,

“হুঁ।”
প্রণয় দেখল প্রিয়তা চকলেট দিয়ে আবার মুখটা মাখিয়ে ফেলছে।
তাই প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মুখ থেকে চকলেটটা টান দিয়ে বের করে নিল প্রণয়।
পছন্দের চকলেটে থাবা বসাতেই প্রিয়তার সুন্দর মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।
প্রণয় নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে সুন্দর করে প্রিয়তার ঠোঁটের আশেপাশে লেগে থাকা চকলেটটুকু মুছে দিল।
হাতে থাকা আধখাওয়া চকলেটের একটু টুকরো ভেঙে প্রিয়তার মুখে দিল, বাকিটাতে তাতে কামড় বসাতে বসাতে বলল,

“Remember, আমি না আশা পর্যন্ত এখান থেকে উঠে কোথাও যাবি না।”
বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল প্রণয়।
প্রিয়তা ও চুপচাপ বসে রইল।
সে আবার প্রণয় ভাইয়ের ভীষণ বাধ্য ছানা।
প্রণয় ২০ মিনিট লাগিয়ে সাওয়ার নিল।
টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হল।
তার চওড়া ফর্সা পিঠ কাঁধ বেয়ে স্বচ্ছ পানির বিন্দুগুলো আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে নেমে আসছে।
এই দৃশ্যে যে কোনো নারী খুন হতে বাধ্য।
তবে প্রিয়তা ছোট মানুষ তাই অত সুন্দর দৃশ্যে তার মনে কোনো রকম অনুভূতিই হল না।
প্রণয় কালো শার্টটা গায়ে জড়িয়ে এসে প্রিয়তার চুলগুলো আবারো উলটে পালটে দিল, যাতে করে কোথাও ভিজে না থাকে।

প্রণয় কে দেখে প্রিয়তা মিনমিন করে বলল,
“আরেকটা চকোলেট দিবেন প্রণয় ভাই প্লিজ?”
প্রণয় কিছু বলল না, শুধু ভ্রু বাকিয়ে পুচকে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
প্রিয়তা প্রণয়ের বাহু ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল,
“ও প্রণয় ভাই দিন না প্লিজ!”
প্রণয় ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,
“হা কর।”
আশ্চর্য হল প্রিয়তা, কারণ প্রণয় ভাইয়ের হাতে কোন চকোলেট নেই।
সে তবুও কোনো রূপ প্রশ্ন ছাড়া হা করল।
প্রণয় তার দুই গাল সরিয়ে ভালো মতো দাঁত দেখতে লাগলো।
প্রণয়ের কার্যক্রম বুঝতে পেরে প্রিয়তা যট করে মুখ বন্ধ করে নিলো, তাড়াহুড়ো করে বলল,
“বিশ্বাস করুন, আমার দাঁতে পোকা নেই!”

প্রণয় উঠে ড্রয়ার থেকে আরেকটা কিটক্যাট চকলেট আনতে আনতে বলল,
“তাই তো দেখছি! কিন্তু তুই যে হারে দিনরাত চকলেটের উপর থাকিস, এতদিনে তো তোর দাঁত দিয়ে পোকাগুলোর লাঞ্চ ডিনার সেরে ফেলার কথা। এগুলো এখনো আস্ত আছে কীভাবে!”
প্রিয়তা মনে মনে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
“২৪ ঘন্টায় ১০ বার করে মেরে ধরে ব্রাশ করালে পোকাগুলো কি উড়ে উড়ে আসবে?”
প্রণয় চকলেটের রেপার ছাড়াতে ছাড়াতে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিছু বললি?”
চমকে উঠল প্রিয়তা, দুই পাশে তড়িৎ গতিতে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো,
“ক-কই, কিছু না তো।”

প্রণয় চকলেটের একটা টুকরো ভেঙে প্রিয়তার মুখে দিয়ে বলল,
“আমি খাইয়ে দেব, চকলেটে হাত লাগাবি না।”
প্রিয়তা ঝড়ের বেগে মাথা উপর নিচ ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল।
প্রণয় নিজের ব্যাগ থেকে চিরুনি, হেয়ার ব্যান্ড, হেয়ার ক্লিপ, ইয়াররিং, ব্রেসলেট, পেনডেন্ট, ঝুমকা, কাজল, লিপগ্লস, টিপ সব বের করে প্রিয়তার সামনে এসে বসল।
আশ্চর্য না? ছেলে মানুষের ব্যাগে আবার এসব থাকে নাকি!
কিন্তু আমাদের প্রণয় ভাইয়ের ব্যাগে এসবই থাকে।
প্রণয় প্রিয়তার হাঁটু ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো সুন্দরভাবে Royal Crest Bun করে দিয়ে মাথায় সুন্দর একটা পিঙ্ক প্রিন্সেস ক্রাউন পরিয়ে দিল।

হাতে ব্রেসলেট, কানে ছোট ছোট ইয়াররিং ও পরিয়ে দিল।
ঠোঁটে হালকা স্ট্রবেরি ফ্লেভারের গ্লস দিয়ে চোখে হালকা কাজল দিয়ে দিল।
ব্যাগ থেকে নতুন আনা হোয়াইট স্নিকার্স যত্ন সহকারে প্রিয়তার পায়ে পরিয়ে দিয়ে কপালে একটা ছোট্ট স্টোনের টিপ পরিয়ে দিল।
প্রিয়তার সাজ ডন!
মেয়েটা কে এখন পুরো বার্বি ডল লাগছে।

প্রণয় কয়েক মিনিট মন প্রাণ ভরে দেখে নিল নিজের ছোট্ট প্রিয়তমাকে।
এতো ছোট মেয়ে, অথচ তার প্রতি প্রণয়ের আসক্তির বিন্দু পরিমাণ কমতি নেই, উল্টো সেই আসক্তির পাহাড় দিন দিন বাড়তে বাড়তে মুক্ত সাগরের স্রোতস্বিনী ধারার মতো অনিয়ন্ত্রিত — বাঁধনহীন ভাবে বেড়েই চলেছে।
প্রণয় নিজের অনুভূতির উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
অনেক বছর আগে এই ভালোবাসার জন্য সবার নিকট সে বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হয়েছে,
তবুও তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই — তার কাউকে লাগবে না।
এখন যত তারাতারি সম্ভব, নিজের জানকে নিজের মধ্যে নিহিত করতে পারলে প্রণয় একটু শান্তির মুখ দেখবে।
প্রণয় প্রিয়তার ললাটে উষ্ণ গভীর স্পর্শ এঁকে দিল।
প্রিয়তা ও রিটার্ন গিফট হিসেবে নিজের গ্লস দেয়া ঠোঁটে প্রণয়ের গালে শব্দ করে চুমু এঁকে দিল।
সাথে সাথেই তার ঠোঁটের সব গ্লস লেগে গেলো প্রণয়ের গালে।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল প্রণয়।
আবার প্রিয়তার ঠোঁটে গ্লস রি এপ্লাই করে দিলো।
গ্লস দেওয়াতে প্রিয়তার রক্ত লাল ঠোঁট জোড়া হীরের মতো ঝিলিক দিচ্ছে।
প্রণয় বিছানা থেকে উঠে যেতে যেতে বলল,
“তুই বস, আমি রেডি হয়ে নেই।”
প্রিয়তা রাজি হল না।
লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে বলল,
“না!”
প্রণয় ব্ল্যাক স্যুট বের করতে করতে বলল,
“কেন না? চুপচাপ বস!”

তবুও প্রিয়তা বসলো না, ছুটে এসে প্রণয়ের হাত থেকে ব্ল্যাক ব্লেজারটা নিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
“সব সময় তুমি আমাকে সাজিয়ে দাও, প্রণয় ভাই, আজ আমি তোমাকে সাজাবো।”
প্রিয়তার কথায় বাঁকা হাসলো প্রণয়।
মনে মনে বলল,
হ্যাঁ নিশ্চয় — এমন প্রিন্স ট্রিটমেন্ট তো আমিও ডিজার্ভ করি।
সে প্রিয়তাকে ড্রেসিং টেবিলের টুলের উপর দাঁড় করিয়ে দিল।
দুই হাত পিছন দিকে দিয়ে বলল,
“পরিয়ে দে।”
প্রণয়ের কথায় ভীষণ আনন্দিত হল প্রিয়তা।
সুন্দর করে প্রণয়কে ব্লেজার পরিয়ে দিল।
তারপর প্রণয়ের পুরো বেগ ঘেঁটে ঘুটে সব ওলট-পালট করে নিজের হ্যালো কিটি ডল বসানো হেয়ারব্যান্ড বের করল।

প্রণয়কে টেনেটুনে নিচু করে সেটা সুন্দরভাবে মাথায় পরিয়ে দিল।
যাতে করে সামনের চুল এসে কপালে না পড়ে, তাই প্রিয়তা ভালোমতো ব্যান্ড পরিয়ে চুলগুলো আটকে দেয়।
প্রিয়তার কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গেল প্রণয়।
সে কি মেয়ে নাকি যে মাথায় পুতুল বসানো হেয়ার ব্যান্ড পড়ে বসে থাকবে!
তবুও কিছু বলল না, নিষ্পলক চোখে প্রিয়তার মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
প্রিয়তা প্রণয়ের রেগুলার ইউজের Clinique for Men Maximum Hydrator Activated Water-Gel Concentrate ক্রিমটা হাতে নিল।
সেখান থেকে কিছুটা হাতের তালুতে নিয়ে নিজের ছোট ছোট কোমল হাতে প্রণয়ের পুরুষালি মুখে ভালো মতো অ্যাপ্লাই করে দিল।

অতঃপর হেয়ারব্যান্ডটা খুলে প্রণয়ের Balmain Paris Styling Gel টা হাতে নিয়ে প্রণয়ের ভেজা চুলে সুন্দরভাবে জেল অ্যাপ্লাই করে দিল।
হঠাৎ কি মনে হতে জেল মাখানো হাতটা নিজের নাকের কাছে ধরলো।
সাথে সাথেই একটা স্ট্রং ফ্র্যাগরেন্স এসে নাকে লাগলো।
প্রিয়তা সেই সুগন্ধি নিতে নিতে চোখ বড় বড় করে বলল,
“বাহ প্রণয় ভাই! এই জেলটার তো অনেক সুন্দর গন্ধ! পরের বার থেকে এটা আমি ও চুলে মাখবো!”
প্রিয়তা বাচ্চা বাচ্চা কথায় হেসে ফেললো প্রণয়।
বাম হাতে জেল দেওয়া চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে সেট করতে করতে বলল,
“এটা ম্যান হেয়ার জেল প্রিন্সেস, তোমার জন্য নয়।”
প্রিয়তা জেদী গলায় বলল,

“না, আমি এটা চুলে মাখবোই!”
প্রণয় বেশি তর্কে না জড়িয়ে হার মেনে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমার জান, এখন থেকে এটা পুরোটাই তোর! এটা কাল থেকে তুই মাখিস।”
প্রিয়তা ভীষণ খুশি হয়ে চুমু দিতে এগোতেই প্রণয় প্রিয়তার মাথাটা নিজের গলায় চেপে ধরে বলল,
“বাইরে পার্টি চলাকালীন চুমু খাওয়ার ক্রেভিং হলে আমার গলায় চুমু খাবি।
If you crave a kiss, you’ll kiss my neck okay.”
প্রিয়তা শুধু ড্যাব ড্যাব চোখে চাইল প্রণয়ের দিকে, মুখে উত্তর না দিয়ে।
প্রণয়ের কথা মত শার্টের কলার সরিয়ে সত্যি সত্যি গলায় আরো বেশ কয়েকটা চুমু খেল।
ফলশ্রুতিতে আবার ঠোঁটের সমস্ত গ্লস প্রণয়ের গলায় লেগে গেলো।

প্রণয় আবার প্রিয়তার ঠোঁটে গ্লস এপ্লাই করে দিল।
হাতে ঘড়ি পরতে নিল, Clive Christian No. 1 – Imperial Majesty for Men
পারফিউম হাতে কাঁধে গলার স্প্রে করতে করতে প্রিয়তাকেও মাখিয়ে দিলো।
ততক্ষণে বাইরে থেকে দরজায় নক এর শব্দ ভেসে আসছে।
প্রণয় শান্ত কণ্ঠে বললো – “আসুন ”
সাদমান শিকদার ভিতরে প্রবেশ করলেন।
ভিতরে এসে প্রণয়কে পার্টির জন্য রেডি দেখে খুশি হয়ে বললেন,
“You are ready, my son.”
প্রণয় ছোট করে বলল,
“হুঁ।”
সাদমান শিকদার প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে প্রিয়তাকে কাছে ডাকলেন।
প্রিয়তা গুটি গুটি পায়ে বড়ো আব্বুর কাছে গেলে সাদমান শিকদার প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“বাহ, খুব সুন্দর লাগছে তো আমার আম্মুকে!”
“জাও আম্মু, তোমার আপুরা তোমায় খুঁজছে।”
প্রিয়তা ও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রণয়ের কাছে সাদমান শিকদারকে কেমন সন্দেহজনক মনে লাগছে। মুখ দেখেই মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই বড় কোনো মতলব আছে। সে তো আর উনাকে কম দিন চেনে না।
প্রিয়তা চলে যেতেই সাদমান শিকদার প্রণয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। ছেলেকে কয়েক সেকেন্ড দেখে কোনো ভণিতা ছাড়াই বললেন,
“আজ সবাইকে কেন ডেকেছি জানো?”
প্রণয় ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,

“না।”
সাদমান শিকদার শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“সবার সাথে তোমার প্রফেশনাল মিট-আপ করাবো বলে।”
সাদমান শিকদারের কথায় প্রণয়ের কপালে সূক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠলো। কপাল কুঁচকে বলল,
“কেন?”
সাদমান শিকদার আবারও কোনো ভণিতা ছাড়াই বললেন,
“তোমার পড়াশোনা শেষ হয়েছে, এক বছরও বেশি হয়েছে। তুমি বংশের বড় ছেলে এবং যথেষ্ট মেধাবী। তাই আমি চাই, আমার পরে আমাদের পূর্বপুরুষদের যত রকম ব্যবসা আছে, সব কিছুর ভার তুমি নাও। কারণ, তোমার থেকে বেশি যোগ্য এই পরিবারের অন্য কেউ নেই।”

সাদমান শিকদারের কথায় প্রণয়ের ঘৃণায় তার দিকে তাকাতেই ইচ্ছে হচ্ছে না, রাগে গায়ের সমস্ত রক্ত ফুটছে। ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ছে দেহের শিরায় শিরায়।
তবুও সে ভদ্রতা বজায় রেখে সোজাসাপ্টা কণ্ঠে বললো,
“আপনি আমাকে কোন ব্যবসার ভার নিতে বলছেন? আপনার SK গ্রুপ নাকি নারী পাচার, বেআইনি অস্ত্রের পাচার, অর্গান ট্রাফিকিং, শিশু পাচার… নাকি আপনার সেই দে*হ ব্যবসার বিজনেস? কোনটা?”
সাদমান শিকদারের ছেলে খোঁচা মারা কথায় রাগলেন না, বরং শান্ত থেকে বাঁকা হেসে বললেন,

“Cool down my son. এত উত্তেজিত হওয়ার কি আছে — এমনভাবে বলছো যেন এগুলো কোনো অন্যায় করছি! এগুলো আমাদের বংশীয় পরম্পরা। পূর্বপুরুষ ধরে সবাই করে এসেছে। এগুলো আমাদের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক! এই প্রজন্মে তুমি এই বংশের বড় ছেলে। তাই এসবের ভার এবার তোমাকে নিতেই হবে। তুমি সিংহের ছেলে আর তাই তোমার তেজ ও সিংহের মতই — তোমার অধিপত্য, পুরুষত্ত্ব ও প্রখর শাসনকালে আমাদের ব্যবসা আরও উন্নতি হবে — এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই আজ তোমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। আমাদের যত রকম ব্যবসা আছে, এখন থেকে সব কিছুর মালিক হবে তুমি।”

প্রণয় ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠছে। সে সাদমান শিকদারকে সাফ সাফ জানিয়ে দিল কঠিন কণ্ঠে দৃঢ় বাক্যে বললো,
“Sorry Mr. Shikdar, আমি আপনার বংশের বড় ছেলে বলেই আমি আপনার বংশীয় পাপের ভাগ নিতে পারবো না। আপনি হাত দুটো নোংরা করেছেন বলে আমাকেও ওটা করতে হবে — এমন কোনো কথা নেই।
I’m sorry, আমি পারবো না। আপনার বংশের ব্যবসার হাল ধরতে আমি খুব সাধারণ মানুষ, তাই খুব সাধারণ সাদামাটা একটা জীবন কাটাতে চাই — যেখানে থাকবে না কোনো পাপের ছিটেফোঁটা, মিথ্যে, কপটতা।
আমি আপনার উত্তরাধিকার, আপনার ব্যবসা, টাকা পয়সা — কিছুই চাই না। আমি নিজের ব্যবসা শুরু করেছি, আর সেখান থেকে যা পাবো তা দিয়েই আমার ও আমার রক্তজবার চলে যাবে।

আমি আপনার মতো পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে নিজের জীবন পার করতে পারব না। আমি আমার পবিত্র রক্তজবার সাথে একটা শান্ত, স্বাভাবিক, সুখী জীবন কাটাতে চাই — যেখানে অপবিত্রতা কোনো ছিটা ফুটো ও থাকবে না।
যদি বলেন আপনার বাড়ি থেকে চলে যেতে — আমি রাজি আছি, তবুও আমি আপনার এসবেতে নিজেকে জড়াতে পারবো না।”
বলে হনহনিয়ে চলে গেল প্রণয়।
সাদমান শিকদারের চোখ মুখে ভীষণ দুশ্চিন্তায় কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা গেলো।
প্রণয় যদি উনার এসকল ব্যবসার হাল না ধরে, তবে তো সব শেষ!
উনার চিন্তার মাঝেই ঘরে প্রবেশ করলেন খালিদ শিকদার ও প্রহেলিকা শিকদার।
প্রহেলিকা খোঁচা মেরে বললো, “কি, বড়ো আব্বু রাজি হলো না তো?”
সাদমান শিকদার পেছন ঘুরে তাকালেন।
এবার খালিদ শিকদার বললেন, “কেন রাজি হচ্ছে না, তার কারণ?”
ও কিন্তু স্পষ্ট করে বলেছে।

প্রহেলিকা আবারো বাঁকা হেসে বললো, “বড়ো আব্বু, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়, আর এই শিক্ষা আপনি আমাদের দিয়েছেন। তাহলে এই নীতি আপনি কেন নিজের জীবনে প্রয়োগ করছেন না? এত ভাবছেন কেন আপনি? আঙুল বাঁকান, দেখবেন, সব হবে।”
সাদমান শিকদার প্রহেলিকার কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেললেন।
জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললেন, “মানে?”

প্রহেলিকা এগিয়ে আসতে আসতে বাঁকা হেসে বললো, “প্রণয় তো বলেই দিয়েছে সে কেন আপনার ব্যবসায় হাত লাগাবে না। সে যেহেতু বলেই দিয়েছে সমস্যার কারণ, সেহেতু সেই কারণটাকেই কেনো উপড়ে ফেলছেন না।
আপনি বুদ্ধিমান বড়ো আব্বু, তাই বেশি কিছু বলার প্রয়োজন মনে করি না।”
সাদমান শিকদার ও কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললেন, “কীভাবে করবো?”
খালিদ শিকদার ও বাঁকা হেসে বললেন, “একটা উপায় আছে। আমাদের এক একজনের এক এক রকম চাহিদা, আর সব পূরণের একটা রাস্তা — তাই কাজটা খুব সূক্ষ্মভাবে করতে হবে। রিস্ক কিন্তু প্রচুর।”
সাদমান শিকদার ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন, “বলো, কী ভেবেছো?”

প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বললো, “আপনার ছেলের প্রাণ পাখিটাকে বাজিতে লাগাতে হবে। তবে মেরে ফেলা যাবে না। জানেন তো, এটা তার জীবনের একমাত্র দুর্বলতা… আর এই দুর্বলতায় ঘা দিলে সে ও আমাদের কে মেরে ফেলবে।
তাই মেরে না ফেলে এমন কিছু করতে হবে, যাতে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙে।
মানে, প্রণয় আমাদের কথায় উঠবে, বসবে আর আমাদের কোন ক্ষতি সে করতে পারবে না। তাকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে হবে। এতে করে আপনি আপনার ব্যবসার উত্তরসূরি পাবেন, আমি পাবো আমার ভালোবাসার। এর জন্য আপনার আদরের ভাইয়ের মেয়ের সাথে সুন্দর কিছু কর্মো।”

“করতে হবে”—বললেন রাজি?
সাদমান শিকদারের চোখ মুখ জ্বলে উঠলো।
খালিদ শিকদার বললেন, “আরো একটা রিস্ক নিতে হবে। তবে এইটাই আমাদের সবথেকে বড় গুটি। এক গুটিতেই আমরা বাজিমাত করে ফেলবো। আমাদেরকে প্রণয়ের ভালোবাসার ফায়দা লুটতে হবে।”
সাদমান শিকদার এক বাক্যে বললেন, “আমি সব কিছুতেই রাজি, বাস! আমার শুধু প্রণয়কে চাই।”
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বললো, “আমারও।”
” বর্তমান ”

আবির্ভাব উত্তেজিত চোখে তাকিয়ে আছে প্রহেলিকার দিকে। সে মনের ডাক্তার হয়ে ও নিজের মনের ওপর আজ কন্ট্রোল রাখতে পারছে না। পরবর্তী ঘটনা শোনার জন্য উত্তেজিত হয়ে উঠছে তার মস্তিষ্ক।
সে খানিক অস্থির কণ্ঠে বললো, “তারপর কী হলো?”
প্রহেলিকা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শান্ত চোখে দেখলো অভির্ভাবের অধম্য কৌতূহল, তার চোখে মুখে সবটা জানার তীব্র আগ্রহ।
প্রহেলিকা অভির্ভাবের অবস্থাটা দেখে বাঁকা হাসলো, আবারও বাঁকা হেসে বলা শুরু করলো—
“অতীত…”
বাগান বাড়ির লার্ন এরিয়াতে ফুল ভলিউমে মিউজিক বাজছে।
এখানে অতিথিসহ বাড়ির সকলে উপস্থিত।
তবে যতারীতি প্রিয়তা হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে রেখেছে প্রণয়, যাতে করে এই লোকের ভিড়ে তার প্রাণ হারিয়ে না যায়।
পার্টি শুরু হয়েছে অনেকক্ষণ।

ডি.কে. বসের ছেলে রিক দূর থেকে দেখছে প্রিয়তাকে এবং মনে মনে বলছে —
“লুকস লাইক অ্যা রুপানজেল!”
প্রহেলিকা দূর থেকে কয়েক সেকেন্ড রিককে পর্যবেক্ষণ করে পাশে এসে দাঁড়ালো।
মৃদু কণ্ঠে আলাপ করে বললো —
“হ্যালো রিক, তোমার প্রিয়কে ভালো লাগে?”
রিক সরল কণ্ঠে বললো —
“হ্যাঁ, খুব ভালো লাগে। জাস্ট সি, she’s like a Rapunzel — so beautiful.”
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বললো —

“তাহলে দূর থেকে দেখছো কেন? যাও গিয়ে কথা বলো ওর সঙ্গে।”
রিক মন খারাপ করে ফেললো।
মলিন কণ্ঠে বললো —
“ঐ ভাইয়াই তো রুপানজেলের সাথে কথা বলতে দেয় না!”
প্রহেলিকা ভালো একটা সুযোগ পেয়ে গেল।
বাঁকা হেসে বললো —
“তুমি কথা বলতে চাও?”
রিক উত্তেজিত হয়ে মাথা নাড়ালো।
প্রহেলিকা হেসে বললো —

“ওকে, ফাইনা, ব্রাদার, আমি তোমাকে কথা বলতে হেল্প করবো।”
রিক আবার মন খারাপ করে বললো —
“কিন্তু কীভাবে ভাইয়া?”
প্রহেলিকা থামিয়ে দিয়ে বললো —
“ঐ ভাইয়া তো দেখবেই না, তাহলে আটকাবে কীভাবে?”
রিক বেশ আগ্রহী হয়ে বললো —
“তাহলে কথা বলিয়ে দাও।”
প্রহেলিকা এবার তার মোক্ষম চালটা চেলে দিয়ে বললো —
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলাবো। তবে এখানে নয়। এখানে তো প্রণয় আছে। সে দেখলে তোমাকে কখনও তোমার রুপানজেলের সঙ্গে কথা বলতে দেবে না।”
রিক আগ্রহ নিয়ে বললো —

“কোথায় কথা বলবো তাহলে?”
প্রহেলিকা কথার ফাঁকে একটা ট্যাবলেট রিকের জুসের গ্লাসে মিশিয়ে দিয়ে বললো —
“ঐ যে দেখছো, উনি আমার বাবা, উনার সাথে যাও। আমি প্রিয়কে নিয়ে আসছি।”
রিক এক চুমুকে জুসটা খেয়ে ফেললো।
বিশ্বজয়ের হাসি দিলো প্রহেলিকা।
রিক খালিদ শিকদারের সাথে চলে গেল।
রিকের ফেলে যাওয়া গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে বললো —
“আব আইগা না মাজা!”
সে পরিনিতাকে ডাক দিয়ে বলল —
“এই শুন!”
দাঁড়িয়ে পড়লো পরিণীতা।
প্রহেলিকার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল —
“কিছু বলবে আপু?”

প্রহেলিকা ও সিরিয়াস কণ্ঠে বলল —
“হ্যাঁ আম্মু তোকে আর প্রিয়তাকে ঘরে যেতে বলেছে। তুই প্রিয়তাকে নিয়ে আয়।”
বলে চলে গেল প্রহেলিকা।
পরিনিতা ও প্রহেলিকার কথা মতো প্রণয়ের কাছে গিয়ে বললো —
“দাদান, মেজো আম্মু আমাকে আর প্রিয়কে ডেকেছে। ওকে একটু নিয়ে যাই?”
তনুশ্রী বেগমের কথা শুনে কিছু মনে করলো না, প্রণয় প্রিয়তাকে যেতে দিলো।
প্রিয়তার হাতটা পরিনিতার হাতে দিয়ে বললো —
“একদম হাত ছাড়বি না। আর দরকার শেষ হলে আবার আমার কাছে এনে দিবি।”
পরিনিতা হেসে রাজি হলো।
প্রিয়তার হাত ধরে নিয়ে চলে গেলো।
প্রিয়তা বললো —

“মেজো আম্মু কেন ডেকেছে, আপু?”
পরিনিতা ছোট করে বললো —
“জানি না তো বোন।”
প্রিয়তা আর পরিনিতা আরো কিছুটা দূরে এগিয়ে যেতেই, এখন এক ভদ্র মহিলা এসে পরিনিতাকে বললেন —
“এই যে মেয়ে, তোমার আম্মু তোমাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছেন।”
পরিনিতা একটু কনফিউজড হয়ে প্রিয়তাকে নিয়ে যেতে ধরলে ভদ্রমহিলা আবার বাগড়া দিয়ে বললেন —
“ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
পরিনিতা ও ছোট মানুষ। প্রণয়ের কথামতো বললো —
“দাদান ওকে হাত ছাড়া করতে বারণ করেছেন।”
ভদ্রমহিলা প্রিয়তার হাত ধরে বললেন —
“আমি ওকে নিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি তাড়াতাড়ি শুনে আসো।”
কিন্তু পরিনিতা বোনকে ফেলে যেতে রাজি হলো না।
তখন আরেকজন মহিলা এসে বললেন —

“তোমার আম্মু সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছেন, দ্রুত যাও!”
এই কথা শুনে পরিনিতার মাথা খারাপ হয়ে গেলো।
সে দ্রুত ছুটলো বাড়ির ভিতরে।
প্রিয়তা ও যেতে নিলে ওই মহিলা প্রিয়তার হাত খপ করে ধরে ফেললো।
প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মুখ চেপে ধরে অন্যত্র নিয়ে চপে গেলো।
রিক দাঁড়িয়ে আছে এই বাগান বাড়ির বেসমেন্টে, যেখানে পুরো দিনের কিছু আসবাবপত্র আর ধুলোবালি ছাড়া অন্য কিছু নেই।
রিক একটু আশ্চর্য হলো —

“ওই আঙ্কেল তাকে এখানে কেন নিয়ে এল?”
“এখানে সে কীভাবে কথা বলবে রুপানজেলের সাথে?”
তবু প্রিয়তার সাথে একান্তে কথা বলার লোভে বেশি কিছু ভাবলো না।
তবে তার শরীরটা কেমন খারাপ লাগতে শুরু করেছে।
কেমন উদ্ভটরকম গরম লাগছে।
ঘামও হচ্ছে।
রিক বাহাতে গাল, গলার ঘাম মুছলো।
মিনিট পার হতেই রিক অদ্ভুতভাবে উত্তেজিত হতে শুরু করলো।
সে বুঝতে পারছে না তার সাথে কী হচ্ছে।
মনে হচ্ছে, পুরো শরীরে অদ্ভুত রকম উত্তেজনা কাজ করছে।
আর এটা কিসের উত্তেজনা, সে ও রিক ভালোভাবে বুঝতে পারছে।
তবে হঠাৎ করে কেন এমন লাগছে?

সেকেন্ডে সেকেন্ডে রিকের শরীরের সেই আগ্রাসী উত্তেজনা বেড়েই চলছে।
সে যেন নিজের মধ্যে থাকতেই পারছে না।
আরও কয়েক মিনিট পার হতেই সে একদম উন্মাদ হয়ে উঠছে।
সারা শরীরে তীব্রভাবে টেস্টোস্টেরন হরমোন ছোটাছুটি করতে শুরু করেছে।
এমন সময় সেই মহিলা প্রিয়তাকে ওই ঘরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিলো।
ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে ভয় পেয়ে গেলো প্রিয়তা।
দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো —
“কে আছেন? দরজা খুলুন!”

প্রিয়তার কণ্ঠে প্রিয়তার দিকে চাইলো রিক।
সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে চাচ্ছে।
তবে সে যত চেষ্টাই করুক, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
নারী সঙ্গ পাওয়ার জন্য তার অস্থিরতা আকাশ ছুঁচ্ছে।
প্রিয়তা পিছু ফিরে রিককে দেখে, তার দিকে এগিয়ে গেলো।
ভয়ার্ত কণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বললো —

“প্লিজ ভাইয়া, আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করুন। এই ঘরে আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি… আমি প্রণয় ভাইয়ের কাছে যেতে চাই। আমাকে প্রণয় ভাইয়ার কাছে নিয়ে চলুন!”
প্রিয়তা আরো কিছু বলার আগেই রিক ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রিয়তা কে জড়িয়ে ধরলো।
আরো ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো প্রণয় ভাইয়ের ছোট্ট প্রিয়তা…
কেটে গেছে আরো ৩ ঘণ্টা, প্রিয়তা এখনও ফিরে আসেনি প্রণয়ের কাছে।
প্রণয় ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আসে, পাশে খুঁজছে প্রিয়তাকে।
এক সময় খুঁজতে খুঁজতে অধৈর্য হয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল।
আলতো হাতে তনুশ্রী বেগমের ঘরের দরজায় নক করলো।
তনুশ্রী বেগম ও অর্থি বেগম মিলে গল্পে মশগুল ছিলেন।
দরজায় টোকা পড়তেই একটু জোর গলায় বললেন, “ভিতরে আসো।”
প্রণয় দ্রুত পায়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।
প্রণয়কে দেখে তনুশ্রী বেগম বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বলবে বাবা?”
প্রণয় খানিকটা অধৈর্য কণ্ঠে বললো, “প্রিয় কোথায়?”
প্রণয়ের কথায় সামান্য অবাক হলেন অনুশ্রী বেগম।
স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, “ও কোথায় আমি তো জানি না আব্বু, আমি তো বিকেলের পর আর ওকে দেখিনি।”
তনুশ্রী বেগমের কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লো প্রণয়।
উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “২-৩ ঘণ্টা আগে প্রিয় তোমার কাছে আসেনি?”
এবার ও দুই পাশে মাথা নাড়লেন তনুশ্রী বেগম।
প্রণয় ভয় পেয়ে গেল, কারণ এটা তাদের শিকদার বাড়ি নয়।
প্রণয় দ্রুত তনুশ্রী বেগমের ঘর থেকে বেরিয়ে পরিনিতা খুঁজতে লাগলো।
এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে পেয়ে ও গেল।
পরিনিতা ও ভয়ে ভয়ে প্রিয়তাকে খুঁজছে।

প্রণয় দ্রুত গিয়ে পরিনিতাকে জিজ্ঞেস করলো, “আমার প্রিয় কোথায়?”
পরিনিতা ভয় পেয়ে চুপ করে রইলো।
ভয়ে প্রণয়ের মনে হচ্ছে কেউ তার হৃৎপিণ্ড ধারালো কিছু দিয়ে চেপে ধরেছে।
এমন সময় পরিনিতাকে চুপ করে থাকতে দেখে চরম রেগে গেল প্রণয়।
বোনকে ঝোড়ালো শব্দে ধমক দিয়ে বললো, “তোর সাথে দেয়ার সময় কি বলেছিলাম? বল আমার জান কোথায়?”
পরিনিতা ভয় ভয় সেই সময়ের সব ঘটনা বললো।
এমনকি কেউ যে তাকে মিথ্যে খবর দিয়ে নিয়ে গেছিলো এটাও ও বললো।
পরিনিতার বলা কথায় প্রণয়ের মাথা ঘুরে উঠল।
হৃদপিণ্ডের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল।

সে পাগলের মতো ছুটে গিয়ে এদিকে ওদিকে খুঁজতে লাগলো।
প্রণয় ১ ঘণ্টা লাগিয়ে পুরো বাড়ির ছাদসহ বাড়ির প্রত্যেকটা কোণা খুঁজলো, তবু ও প্রিয়তাকে কোথাও পেল না।
প্রণয় যেন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
সে আর নিজের দেহ ও মনে কোনো শক্তি পাচ্ছে না।
প্রণয় বাড়ির গুদাম ঘরের কাছে গিয়ে বসে পড়লো।
কপালে হাত ঠেকিয়ে ফুপিয়ে উঠলো।
“কোথায় খুঁজবো আমি তোকে জান, কোথায় চলে গেলি বল না, ময়না পাখি!
তোর প্রণয় ভাইকে এত দুশ্চিন্তা কেন দেস!
প্লিজ ফিরে আয়, জান, এখন আমি কোথায় খুঁজবো তোকে?”
প্রণয়ের বুকের বা পাশটা কি ভীষণ যন্ত্রণায় অবচেতন হতে শুরু করেছে!
এই বাড়ির চারদিকে শুধু ঘন জঙ্গল, ছাড়া আর কিছু নেই।
প্রণয় নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।

শরীরের ভারটা দরজায় এলিয়ে দিতেই স্টোর রুমের দরজা হাট খুলে গেল।
সাথে সাথেই একটা কথা প্রণয়ের মনে পড়ে গেল।
সেকেন্ডের মধ্যেই চমকে বসা থেকে উঠে পড়লো।
প্রণয় এত বড় পয়েন্ট সে কিভাবে মিস করে গেল!
এই ঘর সাধারনভাবে কখনো খোলা হয় না, বিশেষ কাজ ছাড়া।
আজ এমন কি হলো!
প্রণয় ভাবনা চিন্তা ফেলে দ্রুত দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো।
অজানা আশঙ্কায় কলিজা থর থর করে কাঁপছে, তার জানের এতটুকু ও কিছু হলে সহ্য করতে পারবে না প্রণয়, মরে যাবে একদম।

তৎক্ষণাৎ প্রণয় ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো, যা ভেবেছিল তাই।
বেসমেন্টের দরজা খোলা।
প্রণয় দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে বেসমেন্টে নামতে শুরু করলো।
নিচের করিডোর দিয়ে ঢুকতেই দেখলো সবগুলো রুম অন্ধকার,
তবে একটা ঘরে আলো জ্বলছে।
প্রণয় যতই সেদিকে এগোতে লাগলো, ততই তার কলিজার পানি শুকিয়ে মরুভূমি হতে লাগলো।
প্রণয় দরজার কাছে গিয়ে দেখলো দরজাটা বাহির থেকে বন্ধ।
প্রণয় কাঁপা হাতে দরজার লকটা খুলতেই বিস্ময়ে প্রণয়ের হৃদপিণ্ড বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।
পদযুগল টলে গেল, বিস্ময় চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল প্রণয়।
সামনে আর এক পা বাড়ানোর ও শক্তি জোগাতে পারল না।
ভিতরে পুরো ফ্লোর রক্তে মাখামাখি।
ঘরের ঠিক মাঝখানে পড়ে আছে একটি রক্তাক্ত মৃতদেহ, যার মাথা থেকে এখনও নদীর স্রোতের মতো হল হল করে রক্ত বের হচ্ছে।

তার থেকে একটু দূরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে প্রিয়তা।
তার বাহু গড়িয়ে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে।
প্রণয় একপ্রকার ঘোরের মধ্যেই ছুটে গেল প্রিয়তার কাছে, চিৎকার দিয়ে ডাকলো, “জান!”
প্রণয়ের কণ্ঠে স্তব্ধতা, ফিরে পেল প্রিয়তা, ভয়ার্থ চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
প্রণয়ের মুখখানা দৃশ্যপটে ধরা পড়তেই প্রিয়তার সকল ভয় দূর হয়ে গেল।
সে একটা খুন করে ফেলেছে,
তবু ও তার নিজেকে এখন সবচেয়ে সুরক্ষিত মানুষ মনে হচ্ছে।
চোখ উপচে নদীর জোয়ারের মতো পানি পড়ছে।
প্রণয় মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসলো প্রিয়তার সম্মুখে।

“আশেপাশ জলে যাক, পুরে যাক ছাই হয়ে যাক—তাতে কিছু যায় আসে না প্রণয়ের।”
প্রণয় নিজের জান পাখিকে জীবিত দেখে বুকে শান্তি অনুভব করলো।
প্রিয়তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, প্রিয়তার দুই গালে হাত রাখলো।
প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ড প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠে ঝড়ের বেগে আঁচড়ে পড়লো প্রণয়ের পুরুষালী বুকে।
প্রণয়ের বুকের কাছের শার্ট মুঠো করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি… আমি মেরে ফেলেছি প্রণয় ভাই… খুন করে ফেলেছি… বিশ্বাস করুন, আমি ওকে মারতে চাইনি।”
প্রণয় কি হয়েছে কিছু জানতে চায় না।

সে দুই হাতে প্রিয়তার ছোট্ট দেহটা নিজের বুক পাঁজরে মিশিয়ে ফেললো।
নিজের ভিতরকে অনুভব করাতে চাচ্ছে যে, তার প্রাণ বেঁচে আছে।
প্রণয় প্রিয়তাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললো,
“এমন হাজারটা খুন করে ফেললেও আমি সামলে নেবো।
তবু জান, আমাকে এমন কিছু শুনাস না, যা আমি সহ্য করতে পারবো না রে, মরে যাবো!
এর থেকে ভালো, তুই চুপ করে থাক, জড়িয়ে থাক আমার বুকে।
তবু ও এমন কিছু বলিস না, যা সহ্য করার ক্ষমতা আমার হৃদপিন্ডের হয়নি।”
প্রিয়তা তবু ও চুপ করলো না।
হেঁচকি তুলতে তুলতে বলতে লাগলো,

“৪ ঘণ্টা আগে,
রিক শক্ত করে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে জোরজবরদস্তি করতে শুরু করলো…”
প্রিয়তা ছোট্টো দেহ পেরে উঠছিলো না রিক-এর শক্তির সাথে।
রিক তাকে এক ধাক্কাতে ফেলে দেয় মেঝেতে, জানোয়ার মতো প্রিয়তার হাত কামড়ে মাংস উঠিয়ে দেয়।
এতে ব্যথায় চিত্কার দিয়ে, ভয়ে আরো গুটিয়ে যায় প্রিয়তা।
রিক প্রিয়তার জামা ধরে টান দিতে নিতেই, প্রিয়তা হাতের কাছে যা পায় তা দিয়েই রিক-এর মাথায় সোজোরে মেরে দেয়।

সাথে সাথেই মাথা চেপে ধরে উল্টে পড়ে রিক।
প্রিয়তা ভয়ে ছুটে, ঘাবড়ে গিয়ে আরো কয়েকবার আঘাত করাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে রিক।
প্রণয় চমকে তাকায় প্রিয়তার ভয়ার্ত মুখের দিকে, তার দুই চোখে উচে পড়ছে নোনা পানির ধারা।
সে প্রিয়তার দুই গালে হাত রেখে ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“তার মানে তোর সাথে কিছু করে নি তাই তো?”
উপর-নিচ মাথা নাড়লো প্রিয়তা।
প্রণয়ের অধরের কোনে ঝলমলে হাসি ফুটে উঠলো।
সে আবার প্রিয়তাকে একঝটকায় নিজের বুকে মিশিয়ে নিলো।
চোখ বন্ধ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললো,
“তোমার অসীম করুণা, মাবুদ!”

প্রণয় নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করতেই আবার চমকে উঠলো।
দ্রুত পাশে ফিরে মৃতদেহটার দিকে তাকালো।
দৃশ্যপটে রিক-এর চেহারাটা ভেসে উঠতেই ভয়ে প্রণয়ের কলিজাটা ছ্যাত করে উঠলো।
তার হৃদপিন্ডের সকল রক্ত হিম হয়ে গেল মুহূর্তেই।
সে তীব্র ভয়ে প্রিয়তাকে বুকে আরো গভীরে মিশিয়ে নিলো।
মনে মনে ভাবলো,

“এই ঘটনা যদি কোনোভাবে জানা জানি হয়ে যায়, তখন আমি আমার জানকে কীভাবে বাঁচাবো?
না না, আমি থাকতে আমার জানের কিছু হতে দেবো না!”
ঠিক তখনই একটা বিকট চিত্কার ভেসে এলো।
প্রণয়, প্রিয়তার কানে চমকে কেঁপে উঠলো দুজনেই।
ভয়ে এবার জ্ঞান হারালো প্রিয়তা।
প্রণয় চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো ডি.কে বসের মেয়ে এলিনা।
এলিনা ছুটে রিক-এর কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ডাকলো,
“এই! ব্রো, ওঠ না!”

কিন্তু উঠলো না রিক।
এলিনা এবার ডি.কে বসকে ডাকতে নিতেই, পিছন থেকে মাথায় সোজোরে আঘাত অনুভব করলো।
চোখের পলকেই তার সামনের পৃথিবী ঝাপসা হতে শুরু করলো।
মিনিট পার হবার আগেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো এলিনা—
প্রিয়তা রিক-কে যে ফুলদানি দিয়ে মেরে ফেলেছিলো, সেই একই ফুলদানি দিয়ে এলিনাকেও আঘাত করেছে প্রণয়—
সে বেঁচে থাকতে তার জানের কিছু হতে দেবে না, কাউকে তার প্রাণের ক্ষতি করতে দেবে না।
এর জন্য যদি হতে হয় পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুর ব্যক্তি—
তাতেও সে রাজি আছে, প্রণয়।
অভির্ভাবের মাথা লিটারেলি হ্যাং করছে।

সে চোখে তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রহেলিকার দিকে।
তবে প্রহেলিকা অত্যন্ত স্বাভাবিক, যেন অভির্ভাবকে তার জীবনের মশা মারার কাহিনী শোনালো।
তার চোখে মুখে অনুশোচনার বিন্দুমাত্র চাপ দেখলো না অভির্ভাব।
কে বলবে ভালবাসা এতোটা সাইকো হতে পারে!
তবে সব ঘটনা শুনলেও তার কাছে সব কিছু ক্লিয়ার নয়, তার সব প্রশ্নের উত্তর চাই।
তাই শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো অভির্ভাব—
“প্রিয়তা কে দিয়ে এই খুনটা করিয়ে, তোমাদের তিন জনের কিভাবে লাভ হলো?
আর বর্ণনা শুনে তো এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়নি এটা খুনের প্ল্যান ছিলো!”
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে তাকালো অভির্ভাবের দিকে।
হু হা করে হেসে দিয়ে বললো,

“একদম ঠিক ধরেছেন!
ওই ছেলেটাকে মেরে ফেলার আমার কোনো উদ্দেশ্যই ছিলো না।
সবাইকে বুঝিয়ে ছিলাম, ওই ছেলেটাকে মেরে ফেলে কী কী করতে হবে—
তার একটা পারফেক্ট প্ল্যান বানিয়েছিলাম সবার সাথে।
কিন্তু ওই প্ল্যান যে সত্যি সত্যি সফল হয়ে যাবে, সেটা ভাবিনি।
কারণ আমার উদ্দেশ্য ছিলো, প্রিয়তাকে প্রণয়ের জীবন থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া।
আমি জানতাম, প্রিয়তার মতো মেয়ে কখনো কাউকে খুন করতে পারবে না।
আমার বোনটা খুব নরম সরম কিনা, সে কি আর কাউকে মারতে পারে?
আমি চেয়েছিলাম, ওই ছেলেটাকে দিয়ে প্রিয়তার কামটা তামাম করে দিতে।
তারপর আমার বোন নিজেই মরে যেতো।

কিন্তু কী হলো?
সবাইকে যা বলে বোকা বানিয়েছিলাম, সেটাই সত্যি হয়ে গেলো!”
অভির্ভাব ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তাহলে পুরো প্ল্যানটা কী ছিলো?
আর আপনার বিয়ের রহস্যটা এখনো ক্লিয়ার হলো না।”
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বললো,
“যা হয়, ভালোর জন্যই হয়, ডাক্তার!
ওই ছেলেটা মরে যাওয়াতে আমাদের লটারি লেগে গেছে।”
অভির্ভাব ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কীভাবে?”
প্রহেলিকা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,

“প্রিয়তা যখন ওই খুনটা করে, সেই সময়কার সব ছবি আর ভিডিও আমি সুন্দর মতো যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম কয়েক বছর।
ভাবছিলাম কী করবো, কীভাবে কাজে লাগাবো!
একবার ভাবছিলাম, এগুলো ডি.কে বসকে দিয়ে আমার শত্রুর চ্যাপ্টারটা চিরতরে ক্লোজ করে দিই।
কিন্তু সেটা ও পারছিলাম না, কারণ এই ফটো ভিডিও অলরেডি আমার বড় আব্বু কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলো।
প্রণয়কে ব্ল্যাকমেল করে, তার বিজনেস প্রণয়কে নিতে বাধ্য করেছিলো।
আর প্রণয় বেঁচে থাকতে প্রিয়তার গায়ে ফুলের টুকা লাগতে দেবে না,
তাই নিজের গায়ে শিশু পাচার, নারী পাচারসহ সকল পাপ মাখতে বাধ্য হলো।
কিন্তু এতে তো আর আমার লাভ হচ্ছিলো না!”

“তারপর?”
“তারপর ভাবলাম সবকিছু করলাম আমি কিন্তু, এত কিছু করে, এত প্ল্যান প্রোগ্রাম করে, আমার লাভটা হল কোথায়?
যেহেতু এগুলো আমার কোনো কাজেই লাগছে না, সেহেতু অন্যরা কেন ফায়দা লুটবে?
তাই ঠিক করলাম, এইসব ডি.কে বসকে দিয়ে, আমার শত্রুকে শেষ করে দেবো।
তারপর প্রণয় হবে শুধুই আমার!
কিন্তু তখনই ঘটলো আরেক ঘটনা।”
অভির্ভাব কিছুটা কৌতূহল নিয়ে বললো,
“কি ঘটলো?”
প্রহেলিকা মুচকি হেসে বললো,

“তখন এমন একটা আইডিয়া পেলাম, যা নিয়ে আমি আগে কখনো ভেবেই দেখিনি!”
“কি আইডিয়া?”
প্রহেলিকা বলতে শুরু করলো,
“আমাদের ফুফাতো ভাই শুদ্ধ, প্রণয়ের চাইল্ডহুড বেস্ট ফ্রেন্ড—
যে শুধুমাত্র প্রিয়তার জন্য, প্রণয়ের বেস্ট শত্রুতে পরিণত হয়েছিলো।
ওদের দু’জনের একটাই জিনিস প্রয়োজন ছিলো আর তা হলো প্রিয়তা।
শুদ্ধ আর প্রণয়ের মাঝে প্রিয়তা কে নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগেই থাকতো।
ভীষণ ভালোবাসতো শুদ্ধ প্রিয়তাকে।
কিন্তু প্রণয় বেঁচে থাকতে তো কোনোদিনও ও প্রিয়তাকে শুদ্ধর হতে দিতো না!
তাই কীভাবে জানি, আমার সব কথা জেনে ফেলে শুদ্ধ।
তারপর আমাকে এমন একটা ডিল অফার করে, এমন একটা আইডিয়া দেয় যাতে করে আমাদের দুজনেরই লাভ হবে,

আর এসবে আমাকে সন্দেহ করার সুযোগ প্রণয় কখনো পাবে না।
আমি পাবো প্রণয়কে, আর সে পাবে প্রিয়তাকে।”
অভির্ভাব ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি আইডিয়া?”
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বললো,
“শুদ্ধ প্রণয়কে প্রিয়তার সেই খুনের ভিডিও দিয়ে বলে,
প্রিয়তার জীবন থেকে চিরতরে সরে যেতে,
না হলে সে প্রিয়তাকে বাঁচতে দেবে না।
প্রিয়তা যদি তার না হয়, তবে কারো হতে দেবে না।
নিজের প্রাণপাখির জীবনের এত সংশয় ও হুমকি পেতে পেতে, কোণঠাসা হয়ে পড়ে প্রণয়, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার।

বাধ্য হয়ে রাজি হয় প্রিয়তাকে নিজের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে।
তবুও এতেই সন্তুষ্ট হয় না শুদ্ধ।
শর্ত দিয়ে বলে, শুধু এটাতে হবে না, সে বিশ্বাস করে না প্রণয়কে, প্রণয় যে আবারো প্রিয়তাকে পেতে চাইবে না—
তার কি গ্যারান্টি আছে?
তাই প্রণয় যেন আর কখনো প্রিয়তার জীবনে ফিরে না আসে,
তার জন্য তাকে বিয়ে করতে হবে—
যাতে চাইলে ও আর প্রিয়তার কাছে কখনো ফিরতে না পারে।
প্রণয় সব করতে রাজি হলেও, সে কিছুতেই অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলো না।
কারণ সে মরে যাবে,তবুও প্রিয়তার জায়গায় অন্য কাউকে সে স্ত্রীর অধিকার দিতে পারবে না।
কিন্তু শুদ্ধ ও ছাড়ার পাত্র নয়,

প্রণয় রাজি না হওয়াতে, সত্যি সত্যি ডি.কে বসের কাছে সব পিক ভিডিও সেন্ড করে দিতে যায়।
এই পর্যায়ে প্রণয়ের বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
তাই সে বিয়ে করতে ও রাজি হয়।
আর এই দুর্বলতার ফায়দা তোলে আমার আব্বু।
সে ও ব্ল্যাকমেল করে বলে, বিয়ে করলে তাঁর মেয়ে, মানে আমাকেই করতে হবে—
কারণ আমি তাকে খুব ভালোবাসি।
প্রণয়ের কাছে এই কথাটা ও শোনা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না।
কিন্তু এখানেই ব্ল্যাকমেল শেষ হয় না!
আমার আব্বু বলেন, তাঁর মেয়েকে, মানে আমাকে,
কোনোভাবে বঞ্চিত করা যাবে না,

আমাকে যাতে সে কখনোই অসুখী না দেখে,
আমাকে যেন আমার প্রাপ্য সমস্ত অধিকার দেওয়া হয়,
আমাকে যেন স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা হয়,
আমাকে যেন সবসময় হাসি-খুশি দেখা যায়।
আমি যাতে এইসব শর্তের ব্যাপারে কখনো কিছু না জানি।
তিনি যদি কোনোদিন আমাকে দুঃখী দেখেন,
সেটা মোটেও ভালো হবে না প্রিয়তার জন্য।
প্রণয় এগুলোও শুনতে বাধ্য হয়।
প্রণয় শুধু প্রিয়তাকে বাঁচিয়ে রাখবে বলে নিজের জীবন জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়।
সে শুধু প্রিয়তাকে ভালো দেখতে চায়, তাই সব মেনে নেয়।”
অভির্ভাব মাথা চক্কর দিচ্ছে,

এত গভীর ষড়যন্ত্র ও কেউ কিভাবে করতে পারে!
তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
“এর মানে, সব কিছুর মাস্টারমাইন্ড আপনি!
আর দিন শেষে সবচেয়ে নির্দোষ ও নিষ্পাপ হয়ে গেলেন আপনি!
মানে, আপনি সবকিছু সাজালেন, অথচ আপনি সবথেকে নিষ্পাপ থেকে গেলেন?”
আপনি তার জীবন নষ্ট করলেন অথচ সে জানতেই পারল না।
প্রহেলিকা হাই তুলে বললো,
“জি ডাক্তার স্যার!
এই প্রহেলিকা শিকদার কে হালকা ভাবে নেবেন না।
আমার সাথে মাইন্ড গেমে কেউ পেরে ওঠে না,
তাই আমার প্রণয় জান ও পারে নাই।
প্রণয় এখন আমার।

আমাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতোই।
যদিও সে আমাকে ভালোবাসে না, তা নাই বাসুক।
আমি তার মন যে কখনোই পাবো না, এ আমি ভালই জানি।
তাতে কী হয়েছে?
মন না পাই, দেহ তো পেয়েছি, প্রিয়তার থেকে কেড়ে তো নিয়েছি!
এই আমার সর্বোচ্চ সুখ।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৯

তার ভালোবাসা কোনোদিনও পাবো না—
তাই তার আশাও আমি করি না।”
অভির্ভাব একদম স্পিচলেস হয়ে গেল।
প্রহেলিকাকে বাইরে থেকে দেখলে সুস্থ মনে হলো,
সে ভেতর থেকে পুরোপুরি সাইকো।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫১