ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫১
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রহেলিকা নতমস্তকে বসে থাকতে থাকত, হঠাৎই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। অন্ধকার নিস্তব্ধ কক্ষে প্রহেলিকার অট্টহাসির বিকট শব্দ আশপাশের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আরো ৫ গুণ জোরালো শব্দের প্রতিফলিত হচ্ছে।
প্রহেলিকা পাগলের মতো হাসতে হাসতে আচমকাই অদ্ভুত ভঙ্গিমায় কাঁদতে শুরু করলো।
অন্ধকার ঘরের বুক চিরে তার কান্নাটা যেনো অশরীরী লাগছে।
প্রহেলিকার এসব উল্টোপাল্টা আচরণ দেখেও ডঃ আবির্ভাব একদম নিশ্চুপ, সে মনোযোগ দিয়ে প্রহেলিকার গতি-বিধি নিরীক্ষণ করছে।
প্রহেলিকার চোখ মুখের অবস্থা ইতিমধ্যেই বিধ্বস্ত।
প্রহেলিকা দুই হাতে চোখ মুছতে মুছতে বিলাপ করে উঠলো, কান্না জড়িত করুন কন্ঠে বলল— “কেনো আমার জীবনটাই এমন হলো ডাক্তার? আমি কি জীবনে খুব বেশি কিছু চেয়ে ফেলেছিলাম? কি হতো আমার জীবনটা যদি আর পাঁচটা মেয়ের মতো হতো? কি হতো প্রণয় যদি আমাকে ভালবাসতো? যদি অন্য কাউকে না চাইত— আমি ও তো সুখী হতে পারতাম।
আমি তো প্রথম থেকে কোন পাপ করিনি, তাহলে কোন পাপের শাস্তি পেলাম? কিসের জন্য আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল? মানলাম, আমি এখন অনেক বড় পাপী। বিশ্বাস করুন, তার জন্য আমি মোটেও অনুতপ্ত নই। যা করেছি, বেশ করেছি। কিন্তু এসব তো কালকের কথা। কিন্তু আমার কপাল তো পুড়েছে আরো ১৬ বছর আগে। তখন তো পাপ কি সেটাই বুঝতাম না। তবে আমার হাসি-খুশি জীবনটা কেনো আমার জন্যই অভিশাপ হয়ে দাঁড়ালো?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বলতে পারেন?
আবির্ভাব কিছু বলল না, শুধু নির্বিকার ভঙ্গিতে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললো— “শান্ত হোন…”
অতিরিক্ত কান্নার ফলে প্রহেলিকার হেঁচকি উঠছে।
আবির্ভাব পানির গ্লাস ও এগিয়ে দিলো।
প্রহেলিকা ঢক ঢক করে পানি টুকু খেয়ে খানিকটা শান্ত হলো।
আবির্ভাব কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলল—
“দেখুন মিসেস প্রহেলিকা শিকদার, পৃথিবীতে যদি সবাই সবকিছু পেয়ে যেতো, তাহলে আফসোস নিয়ে বাঁচতো কারা? পৃথিবীতে সবাই নিজের চাহিদা মত সবকিছু পেয়ে গেলে ‘আফসোস’ বাক্যটারই তো কোন অর্থ থাকতো না।
পৃথিবীর নির্মম সত্যি কী, বলুন তো?
আপনি যেমন একটা পারফেক্ট জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন — ওইরকম একটা পারফেক্ট জীবন সকলেই চায়, কিন্তু জীবন সবাইকে সবকিছু দেয় না। তাই পৃথিবীতে ‘পারফেক্ট’ বলে কিছু হয় না। পৃথিবীতে ঈশ্বর ব্যতীত এমন কেউই নেই, যে কিনা সবদিক থেকে পারফেক্ট। তাই আপনি, আমি — কেউই পারফেক্ট নই। No one is perfect.
কিছু না কিছু অপূর্ণতা প্রত্যেকের মাঝেই থাকে। আর আমাদের সেই অপূর্ণতা নিয়েই বাঁচতে হয়।
এর জন্য কাউকে দায়ী করা ও যায় না।
আপনি এই পুরো গল্পে আমাকে যাদের যাদের নাম বললেন, একবার ভেবে দেখুন তো— তারা কেউ কি পারফেক্ট? তাদের লাইফে কি কারো hidden problem নেই? কোন অপূর্ণতা নেই? প্রত্যেকেরই আছে।
আসলে, কল্পনায় আমরা আমাদের জীবন যত সুন্দর করে সাজাতে চাই — বাস্তব হয় তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ওরকম কল্পনা আর বাস্তবতা কোনদিনও মিলেমিশে এক হয় না।
কিছু পেয়েছি, কিছু পাইনি — এটা নিয়ে আমাদের আজীবন বাঁচতে হয়।
যেমন আপনাকে কষ্ট দিয়েছে নিয়তি — ভবিতব্য — তা বলে, আপনি কি আপনার unhappy life শুধুই নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন? না—
আপনার হাসবেন্ড আপনাকে ভালো না বাসার জন্য — আপনি যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছিলেন — তার একশো গুণ বেশি যন্ত্রণাময় জীবন আপনি তাকেও দিয়েছেন।
না হলে হয়তোবা তার জীবনটা অনেকটাই পারফেক্ট হতো, কিন্তু সেই পারফেকশনেও বাধা পড়েছে, কারণ এটাই পৃথিবীর নিয়ম,পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের ভালোবাসা আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায় — তাই পৃথিবীতে কেউই পারফেক্ট থাকতে পারে না।
যে পরিমাণ কষ্ট এখন আপনি পাচ্ছেন — তার ১০ গুণ কষ্ট সেও পাচ্ছে।
আপনি ভালো নেই, তাই আপনি তাকেও ভালো থাকতে দেননি। হয়তো এর জন্য আপনার সেই ছোট বোন ও অনেক কষ্ট পাচ্ছে বা আশেপাশের আরো অনেকেই হয়তো প্রভাবিত হচ্ছে। এভাবেই একজন মানুষের অসুখি জীবনে , আশেপাশের মানুষকে ও প্রভাবিত করে, ভালো থাকতে দেয় না— বিশেষ করে, সে — যার জন্য জীবনে happy হতে পারে না — তাকে ও সে কোনোদিনও happy থাকতে দেয় না।
আপনার এই ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা — এই সমাজে অনেকেরই আছে।
কিন্তু দিন শেষে, কেড়ে নিয়ে আটকে রেখে কেউই সুখি হতে পারে না।বেঁধে রাখার প্রবনতা তাদের হতাসা ছাড়া কিছুই দেয় না।
ভালোবাসা জোর করে হয় না মিসেস শিকদার, সেটা জোর করে আদায় করা ও যায় না। হয়তো মানুষটাকে অনেক নিয়ম-কানুনের অসহায়ত্ব আর অপারকতার বেড়াজালে আটকে দেওয়া যায়, কিন্তু তার মনটা কখনোই বেঁধে রাখা যায় না।
যার জ্বলন্ত উদাহরণ আপনি নিজেই—
দেখেন এইটুকুতেই আপনার mental health এর কি অবস্থা হয়েছে।
তাহলে আপনার হাসবেন্ডের mental health এর কি অবস্থা? I don’t know.
কিন্তু মনে রাখবেন— প্রত্যেকটা মানুষই যন্ত্রণা সহ্য করার একটা ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।
তাকে ততটুকুই আঘাত করা উচিত — যতটুকু সে সহ্য করতে পারে।
আর তাকে যদি তার সহ্য সীমার থেকে বেশি যন্ত্রণা দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে মনে রাখবেন—
আপনি যার জন্য এত এত কিছু করছেন — যাকে আপনার করে রাখার জন্য এত brain waste করেছেন — সেই কিন্তু আপনাকে ফাঁকি দিয়ে যাবে।
আবির্ভাবের সকল কথায় এতক্ষণ নির্বিকার থাকলেও, এই কথায় চমকে উঠলো প্রহেলিকা। ভয়ার্ত চোখে তাকালো আবির্ভাবের দিকে।
আবির্ভাব তা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। আবার বলতে লাগলো—
“হ্যাঁ, এটা ঠিক— মানুষের যন্ত্রণাসহ্যর কোনো একক হয় না।
মানুষ — ঈশ্বরের অদ্ভুত সৃষ্টি — সে অসীম যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করে নিতে পারে।
কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে— সব কিছুরই একটা সীমা আছে।
তাই— দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মৃত্যু তুল্য দিন কাটালে—
আপনি আপনার হাসবেন্ডকে বেশি দিন ধরে রাখতে পারবেন না দায়িত্ব নিয়ে তাকে-
Broken Heart Syndrome (Takotsubo Cardiomyopathy), Sudden Cardiac Arrest (SCA), Silent Myocardial Infarction (Silent Heart Attack), Stress-Induced Arrhythmia, Burnout Cardiomyopathy, Hypertensive Heart Disease, Neuro-cardiac Failure, Autonomic Dysfunction (Dysautonomia), Coronary Vasospasm, Endothelial Dysfunction (stress-induced vascular injury) —
এই সব কঠিন হৃদরোগ ধরিয়ে দেবেন।
আর তার এই অসীম যন্ত্রণার শেষ হবে এক নির্মম মৃত্যু দিয়ে। এমনকি এগুলো আপনার ও হতে পারে।
তাই সময় থাকতে ভালো থাকার চেষ্টা করুন — উভয়েই।”
প্রহেলিকা এবারও চুপ করে রইলো।
আবির্ভাব আবার বললো— “আমি শুধু আপনাকে সাজেস্ট করতে পারি। বাকিটা আপনার ইচ্ছা।
তবে একটা কথা বলুন তো…”
প্রহেলিকা অনুভূতিহীন চোখে তাকালো।
আবির্ভাব একটু কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো—
“আপনি, আমি — দু’জনেই ভালো মতো জানি — সত্যি কখনো চাপে থাকে না। সত্যর আলাদাই জোর — সেটা এক না একদিন সামনে আসবেই। সবাই জানবেই।
তখন আপনি কী করবেন?
আপনার হাসবেন্ড যদি কোনোদিন জানতে পারে — আপনি তার সঙ্গে কী কী করেছেন, কিভাবে কিভাবে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন? কীভাবে তার থেকে তার ভালোবাসাকে দূরে করে দিয়েছেন? বাধ্য করেছেন আপনার সাথে জড়াতে?
তখন আপনি কি করবেন?
ভালোবাসা থাকলে — সাত কূল মাফ — সেটা অন্য ব্যাপার।
কিন্তু সে তো আপনাকে ভালোও বাসে না। তাই ক্ষমা করে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
তখন আপনি এক্স্যাক্টলি কি করবেন?”
আবির্ভাব প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো প্রহেলিকার দিকে।
প্রহেলিকা কয়েক পলক আবির্ভাবের দিকে তাকিয়ে একটা কুটিল, রহস্যময় হাসি দিলো।
সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল আবির্ভাব — এই হাসির অর্থ উদঘাটনে সে ব্যর্থ হলো।
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বললো— “আজ আপনাকে অনেক কিছুই বলেছি। এর উত্তর না হয় অন্য কোনোদিন দেবো…”
আবির্ভাবের বিষয়টা রহস্যময় লাগলেও, ও বেশি ঘাঁটালো না।
প্রহেলিকাকে নিয়ে নিজের চেম্বারে এসে বসলো।
প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে সিরিয়াস কণ্ঠে বললো—
“মিসেস প্রহেলিকা শিকদার, আপনার এই সমস্যার কোনো পার্মানেন্ট সল্যুশন আপাতত আমার কাছে নেই।
কারণ, আপনার সকল সমস্যার কারণ আপনার সেই অসুস্থ সম্পর্ক, আর আপনি সেটা কখনই ত্যাগ করতে পারবেন না— আপনার এই অসুস্থ সম্পর্কটা দিন দিন আরো বেশি অসুস্থ হয়ে উঠবে। আর আপনার আর আপনার হাসবেন্ড উভয়েরই মানসিক সমস্যা বাড়তেই থাকবে। যেখান থেকে আপনাদের আবারো হাসিখুশি জীবনে ফিরে আসা— It’s next to impossible.
আপনি যেহেতু আপনার হাসবেন্ডকে ছাড়া থাকতে পারবেন না,
So, moral of the story— এটার কোনো সমাধান নেই।
আপনারা ৪ জন একটা ক্রিটিক্যাল, আনহেলদি রিলেশন এ জড়িয়ে আছেন—
আর সেই সম্পর্কে যতদিন যাবে, সমস্যাগুলো আরো শক্তভাবে পেঁচিয়ে ধরবে।
তাই আমি আপনাকে মেডিসিন লিখে দিচ্ছি। বেশি ডিপ্রেসড ফিল করলে খাবেন। তবে মেডিসিনটা অভ্যাস করবেন না—”
বলে একটা প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিলো আবির্ভাব।
প্রহেলিকা উঠতে নিলে, আবির্ভাব হঠাৎই বলে উঠলো—
“যদি কোনোদিন মনে হয়— আপনি এই অসুস্থ সম্পর্কটা থেকে মুক্ত হতে চান, বা এর ভার আপনি আর বইতে পারছেন না—
তখন আসবেন। আপনাকে প্রপার ট্রিটমেন্ট করবো। এবং সেটা কাজে দেবে।”
প্রহেলিকা আবির্ভাবের দিকে ঘুরে তাকাল, হালকা হেসে দৃঢ় কন্ঠে বলল—
“প্রহেলিকা পচে গলে কবরের মাটির সাথে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত সে তার ভালোবাসার দাবি ছাড়বে না— আর কথা যদি হয় প্রণয়ের, তবে মরণ হলে ও তাকে অন্য কারো হতে দেব না।”
সে যদি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মরে যায় তবে মরুক,আমার জন্যই মরুক।
তার জীবন মরণ হক আমার নামে।
বলে সৌজন্যমূলক হেসে চলে গেল প্রহেলিকা।
আবির্ভাব তার যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো—
“ভালোবাসা যে কতটা ভয়ঙ্কর, কতটা সুন্দর, কতটা যন্ত্রণাময় — তা এই পরিবারকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।”
আবির্ভাব প্রহেলিকার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো, পিওনকে স্ট্রং ব্ল্যাক কফির অর্ডার দিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই সাইলেন্ট মোডে থাকা ফোন স্ক্রিনে নিঃশব্দে ভেসে উঠলো এক নাম।
নামটা দৃষ্টিতে ভাসতেই আবির্ভাবের বক্ষ জুড়ে বয়ে গেল হৃদয় জুড়ানো ভালোবাসাময় শীতল হাওয়া। সে ফোন রিসিভ করে চোখ বন্ধ করে ডাকলো – “স্রোতস্বিনী।”
আবির্ভাবের মুখে “স্রোতস্বিনী” ডাকটা যেন শ্বেতার কান দিয়ে ঢুকে সোজা হৃদপিণ্ডকে গুলিবিদ্ধ করলো। ফরসা মুখশ্রীতে লজ্জা রাঙ্গা গোলাপি আভা নৈসর্গিক ধুতি ছড়াতে লাগলো, টসটসে গাল দুটো পাকা লাল টমেটোর মত রক্তিম হয়ে উঠলো।
শ্বেতা নিজেকে ধাতস্থ করার আগে আবারও ওপাশ থেকে আহত পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
আবির্ভাব বেকুল কণ্ঠে আফসোস করে বলল–
“দূরে থেকে লজ্জা পেলে কি আমি দেখতে পাবো, মাই লাভ? তুমি লজ্জা পাচ্ছো, সেটা ঘরের খাট, আলমারি, চেয়ার, টেবিল সবাই দেখতে পাচ্ছে, অথচ আমি এতটাই হতভাগা যে আমার সেই স্বর্গীয় দৃশ্য দর্শনের সৌভাগ্যটুকু হচ্ছে না। লজ্জাটা জমিয়ে রাখো, মাই লাভ, সেটা শুধু আমাকে দেখাবে, শুধু শুধু ঘরের জড়বস্তুদের দেখিয়ে লাভ আছে!”
শ্বেতা লজ্জায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। আরুষ্ট কণ্ঠে মৃদু ধমকে বললো –
“একদম পটানোর চেষ্টা করবেন না, পাগলের ডাক্তার! আপনি সারাদিন আপনার পাগলদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আমি কে হই আপনার, যে আমার খোঁজ নিবেন!”
হেসে উঠলো আবির্ভাব, কণ্ঠে আরেকটু প্রেম মিশিয়ে বলল –
“পাগলরা আমার কাছে চিকিৎসা নিতে আসে ঠিকই। কিন্তু তারা কি জানে, তাদের ডাক্তারও মস্ত পাগল? কোনও এক অষ্টাদশী তাদের ডক্টরকে রূপের জালে ফাঁসিয়ে বধ করেছে বহু আগে…
বড্ড বাজেভাবে পটিয়ে নিয়েছে।”
শ্বেতার গালের রক্তিম লালিমা আরো বিস্তৃত হল। সে বাড়ন্ত লজ্জাটা গিলে নিয়ে, মুখ বাকিয়ে বললো –
“এত পাগল হলে পাবনায় যান।”
শ্বেতার কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো আবির্ভাব। কৌতুক করে বললো –
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই! ওটাই তো আমাদের আসল সংসার! চলো, তুমি আমার পাগলী আর আমি তোমার পাগল, একসাথে পাবনায় যাই। তারপর পাবনার সব পাগলদের নিয়ে একসাথে সংসার পাতি। আমাদের ঝাঁকে ঝাঁকে আন্ডা বাচ্চা হবে! সবাই এক দেখাতে বলবে – পাগল আর পাগলীর সংসার!”
আবির্ভাবের কথায় তাজ্জব বনে গেল শ্বেতা। “সে কী বললো! আর এই পাগলের ডাক্তার তার কী মানে বের করলো! আসলেই এই লোকটা পাগলদের সঙ্গে থাকতে থাকতে পাগল হয়ে গেছে।”
শ্বেতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভিমানি কণ্ঠে বললো –
“আপনাকে তো কিছু বলাই যায় না। তার আগে আপনি বাচ্চা ভুলানোর মতো সব ভুলিয়ে দেন। এটা কিন্তু ঠিক না।”
শ্বেতার কথায় বড্ড শান্তি লাগছে মনে।
আবির্ভাব চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বললো –
“কারণ তুমি বাচ্চা, মাই লাভ। তাই তো বাচ্চা ভুলানোর মতো ভুলিয়ে দিই। আর সবসময় আমার কাছে বাচ্চা হয়েই থেকো।”
শ্বেতাও লাজুক হেসে বিছানায় শুয়ে পড়ে বললো –
“আমাদের ব্যাপারটা দাদাকে কবে জানাবেন?”
আবির্ভাব কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠান্ডা কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো –
“তুমি বললে, এখুনি জানিয়ে দেব। বলো, জানাবো?”
আবির্ভাবের এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়াতে ফাঁকা ঢোঁক গিললো শ্বেতা। ভয়ভয় বললো –
“আপনার ভয় করছে না? দাদা জানতে পারলে আপনার হার্ট বের করে নেবে।”
আবির্ভাব তৃপ্ত হেসে বুকের বাম পাশে হাত রেখে বললো –
“যারা ভয় পায়, তারা কখনো ভালোবাসতে পারে না, মাই লাভ। আর এই হার্ট তোমার এখানে, তুমি সযত্নে নিজের নাম লিখেছো। এখন তোমার ভাই যদি সেটা কেটে টুকরো টুকরো করে, তাহলে লসটা ও তোমারই হবে। আমি না থাকলে তোমাকে এত ভালো কে বাসবে, মাই লাভ?”
আবির্ভাবের কথায় শ্বেতার বুকে সুখ-সুখ অনুভূতি রা-দুলা দিয়ে গেল। মোহনীয় কণ্ঠে বললো –
“কাল দেখা করবেন, আবির্ভাব?”
আবির্ভাব তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো –
“তুমি চাইলে, এখনই দেখা করতে পারি।”
আবির্ভাবের কথায় শ্বেতা চোখ ঘুরিয়ে দেওয়াল ঘড়ি দেখলো – রাত ৯টা ২০।
আজ রাতে কেউ ডিনার করবে না, কারণ আজ প্রথম সেহেরি। তাই একেবারে সবাই সেহেরি করবে।
তাই রাত ৩টার আগে কেউ তাকে খুঁজবে না।
“কি ভাবছো, মাই লাভ?”
শ্বেতা শুয়া থেকে উঠে বসে বললো –
“আপনি এখন গ্রামে আসবেন?”
আবির্ভাব বসা থেকে উঠে পড়লো, টেবিল থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে চেম্বার থেকে বের হতে হতে বললো –
“আমি ৪৫ মিনিটের মধ্যে আসছি, মাই লাভ।”
শ্বেতা আর্তনাদ করে উঠলো –
“নাঃ… আবির্ভাব! প্রণয় ভাইয়া আর দাদা বাড়িতেই আছে… তারা যদি এত রাতে আপনাকে দেখে ফেলে!”
আবির্ভাব ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসতে বসতে বললো –
“এটা তোমার সমস্যা, মাই লাভ, আমার নয়। আমার এখন আমার মাই লাভকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
আবির্ভাবের কথায় অস্থির হলো শ্বেতার মন। সে অনুনয় করে বললো –
“প্লিজ, একটু বুঝুন না, কাল দেখা করি।”
আবির্ভাব শ্বেতার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো –
“I love you, I’m on my way.”
শ্বেতা হার মেনে বললো –
“আপনি এসে ওই মোড়ের রাস্তায় দাঁড়াবেন, আসছি আমি।”
ঠোঁট এলিয়ে হাসলো আবির্ভাব –
“Good girl. আমি আসছি।” – বলে ফোন কেটে দিলো।
শ্বেতার চোখ মুখে ফুঁটে উঠলো অপার্থিব অসহায়ত্ব। সে ফোনটার দিকে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বললো –
“আমাদের জীবনটা দিন দিন ভীষণ জটিলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আবির্ভাব –
এই সমাজ কি কখনো আমাদের মেনে নেবে?
ধর্মের দোহাই দিয়ে আপনাকে আমার থেকে আলাদা করে দেবে না তো?
আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি, আবির্ভাব…
খুব, খুব ভালোবাসি।
কোনও কিছুর বিনিময়েই আপনাকে হারাতে পারবো না।”
সিকদার বাড়ির ৪ তলার বিশেষ বৈঠক ঘরে চোখ-মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন –
মেহজাবিন চৌধুরী, সাদমান সিকদার, খালিদ সিকদার, সাজিদ সিকদার, সোহেব সিকদার।
তাদের চোখ-মুখের অবস্থা অত্যন্ত সিরিয়াস। বিশেষ করে ছোটবোনের আবদার শুনে সাদমান সিকদার ও খালিদ সিকদার একটু চিপায় পড়ে গেছেন।
তবে সাজিদ সিকদারের অবস্থা ব্যতিক্রম। তিনি এখনো ব্যাপারটা হজম করে উঠতে পারেননি।
মেহজাবিন চৌধুরী সাজিদ সিকদারের দিকে তাকিয়ে খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন –
“তোমার কি আমার প্রস্তাবটা পছন্দ হয়নি, নাকি আমার ছেলেকে তোমার পছন্দ নয়? নাকি তার যোগ্যতা নিয়ে তোমার কোনো প্রশ্ন আছে?
আমি আসলে বুঝতে পারছি না, তোমাকে এত ভাবনা চিন্তা কেনো করতে হচ্ছে।”
সাজিদ সিকদার একটু ধাতস্থ হয়ে কণ্ঠে নম্রতা বজায় রেখে বললেন –
“কি বলছেন আপা, শুদ্ধের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো মূর্খ আমি নই।
আর শুদ্ধকে অপছন্দ করার তো প্রশ্নই আসে না।
ওর মতো এমন well-educated, স্বাবলম্বী, ব্যক্তিত্ববান, যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলে হাতে যেকোনো বাবাই তার মেয়েকে চোখ বুজে তুলে দিতে চাইবে – অবশ্যই এখানে আমি ও এর ব্যতিক্রম নই।
আমি ও চাই, আমার মেয়ে একটা সঠিক মানুষের হাতে পড়ুক, তার একজন সুযোগ্য জীবন সঙ্গী হোক, যে আমার মেয়েকে সারাজীবন দেখে শুনে রাখবে, কখনো দুঃখ পেতে দেবে না – আর শুদ্ধ সেরকমই একটা ছেলে। কিন্তু…”
মেহজাবিন চৌধুরী এতক্ষণ শান্ত চোখে ভাইকে দেখছিলেন, কিন্তু শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন।
কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন –
“কিন্তু কী?”
সাজিদ শিকদার একটু ইতস্তত করে বড় ভাইদের দিকে তাকালেন, গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করলেন –
“দেখেন আপা, মেয়েটা আমার হলেও তার সব বিষয়ে একা সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার নেই।
এই বাড়ির সবাই জানে, প্রিয়তা ছোট থেকে কার কাছে মানুষ হয়েছে, কে তার যত্ন নিয়েছে, কে তার দেখভাল করেছে, লালন পালন করেছে।
সকল বায়না-আবদার মিটিয়েছে, আমার মেয়েটাকে কখনো ভালোবাসার অভাব বোধ করতে দেয়নি।
আমি তো বছরের বেশির ভাগ সময় বাসায় থাকি না।
আমার অনুপস্থিতিতে আমার মেয়েকে যে আগলে রেখেছে, প্রকৃত অর্থে দেখতে গেলে আমার মেয়ের আসল অভিভাবক তো সে।
আর তাছাড়া ওর আরেক অভিভাবক হিসেবে তার বড় ভাইও আছে—এই বাড়ির মাথা বড় ভাইজান, মেঝ ভাইজান আছেন।
এদের সবার সম্মতি ছাড়া আমি তো কোনো কথা দিতে পারবো না আপা।
সেই অধিকার আমার নেই।
আপনি বরং সবাইকে ডাকুন, সবার মতামত শুনি, তারপর যা ভালো মনে হবে তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে আর।
তাছাড়া শুদ্ধরও তো একটা মতামত আছে।”
সাজিদ শিকদারের কথায় মেহজাবিন চৌধুরী একটু স্থির হলেন।
সাদমান শিকদার আর খালিদ শিকদার আরেকটু গুছিয়ে বসলেন, কারণ একটু পর অনেক কিছু দেখতে হবে—যেখানে উনাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া কোনো কাজ নেই।
কারণ, এই বিষয়ে উনারা বেফাঁস কিছু বলে বেকায়দায় পড়তে চান না, তাই যে বলার সেই বলুক।
মেহজাবিন চৌধুরী সাদমান শিকদারের দিকে তাকিয়ে অনুমতি চেয়ে বললেন,
“আমার ছেলের সাথে যদি প্রিয়তাকে নিতে চাই, আপনাদের আপত্তি আছে বড় ভাইজান, মেঝ ভাইজান,?”
সাদমান শিকদার বোনের দিকে তাকিয়ে সাবলীল কন্ঠে বললেন,
“শুদ্ধকে আমরা ছোট থেকে চিনি।
সে একজন আন্তর্জাতিক মানের নামকরা ডাক্তার।
তার সাথে আমাদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে হলে তা আমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মানের ও গৌরবের।
এই বিষয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই।
তবে এই বিষয়ে আমাদের মতামতের থেকে ও জরুরি প্রণয় ও পৃথমের মতামত।
কারণ, প্রিয়ো আম্মুকে ছোট থেকে এত বছর সর্বোচ্চভাবে আগলে রেখেছে প্রণয় আর পৃথম।
তাই ওদের যদি কোনো সমস্যা না থাকে, আমাদেরও কোনো সমস্যা নেই।
তাছাড়া এই প্রজন্মের বড় ওরা—ওদের অনুমতি ছাড়া তো আর এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।”
মেহজাবিন চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবলেন।
সাদমান শিকদার গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, “রহমান! রহমান!”
কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাজির হলো রহমান।
বৈঠক ঘরের এমন গম্ভীর পরিবেশ দেখে একটু ইতস্তত করলো।
সাদমান শিকদার গম্ভীর মুখে বললেন, “যাও, শুদ্ধ, প্রণয় আর পৃথমকে ডেকে আনো। বলবে জরুরি প্রয়োজন, এক্ষুনি আসতে।”
রহমান মাথা নেড়ে চলে গেল।
সাজিদ শিকদার মেহজাবিন চৌধুরীর অতিআগ্রহ কিছুক্ষণ অবাক চোখে দেখলেন।
অতঃপর একটু কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“শুদ্ধ তো অনেক কোয়ালিফায়েড একজন হার্ট সার্জন।
সে চাইলে প্রিয়তার থেকে পরিণত, বুদ্ধিমান, উচ্চশিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করতে পারে।
এমনকি সে তো তার লাইফ পার্টনার হিসেবে ওরকম একটা ম্যাচিউর মেয়ে ডিজার্ভ করে।
সেখানে আমার মেয়ে নিতান্তই বাচ্চা, ইম্যাচিউর, অগোছালো—জোর করে না খাওয়ালে খেতে পর্যন্ত চায় না।
শুদ্ধ কি আমার মেয়ের সাথে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে?”
সাজিদ শিকদারের কথায় মেহজাবিন চৌধুরী স্বচ্ছ হাসলেন।
বড় নিঃশ্বাস নিয়ে প্রশন্ন কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলেন,
“প্রিয়তাকে আমি অনেক আগ থেকেই শুদ্ধর জন্য পছন্দ করে রেখেছি, বিশেষ করে যখন থেকে জানতে পেরেছি শুদ্ধ প্রিয়োকে ভা—”
কথা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না মেহজাবিন চৌধুরী।
তার আগেই পৃথম এসে হাজির হলো।
পিছনে পিছনে শুদ্ধ আর প্রণয়ও এলো।
তিন ভাই কক্ষে পা রাখতেই সবাইকে এই সময় একসাথে এক জায়গায় দেখে কপাল কুঁচকে ফেললো।
সবার গম্ভীর চেহারার পানে দৃষ্টি পাত করে প্রণয়ের কেমন খটকা লাগলো, তার মনে হচ্ছে এখানে বড় কোন খিচুড়ি পাকানো চলছে।
প্রণয়, পৃথম আর শুদ্ধ গিয়ে সাদমান শিকদারদের সামনে সোফায় বসল।
মহল বেশ গম্ভীর।
প্রণয় সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কোনো জরুরি দরকার, ফুপ্পি?”
পৃথমও কৌতূহলী নজরে তাকালো।
মেহজাবিন চৌধুরী প্রণয় আর পৃথমের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ আব্বু, খুবই জরুরি দরকার।”
প্রণয় আবার কণ্ঠের স্বাভাবিক মাত্রা ধরে রেখে বলল—
“জি, বলুন।”
মেহজাবিন চৌধুরী এক পলক সবার দিকে তাকিয়ে প্রণয়ের দিকে দৃষ্টির স্থির করলেন, দৃঢ় কণ্ঠে কোনো রকম সংকোচ ছাড়াই বললেন,
“আমি প্রিয়তার বিয়ের ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলতে চাই।
সাজিদ আর ভাইজানদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিয়েছি, উনারা সকলে-ই রাজি।
এখন তোমরা দুজন সম্মত হলেই আমরা কথা এগিয়ে নিতে পারি।”
মেহজাবিন চৌধুরীর নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলা কথায় নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটলো বৈঠক কক্ষে।
পৃথম বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মেহজাবিন চৌধুরীর দিকে।
সাদমান শিকদার, সাজিদ শিকদার, খালিদ শিকদার, মেহজাবিন চৌধুরী, পৃথম, শুদ্ধ—সবাই একযোগে তাকিয়ে আছেন প্রণয়ের দিকে।
মেহজাবিন চৌধুরীর কথায় প্রণয়ের যেন পায়ের নিচের জমিন সরে গেল মুহূর্তেই।
বুকের গভীরের ছাই চাপা আগুনটা যেন এক লহমায় দাবানলে পরিণত হলো।
নিঃশ্বাস টুকু আটকে এলো কণ্ঠনালিতে—
এমন কিছু শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না প্রণয়।
তার প্রাণপাখিটাকে তার বুক থেকে আজীবনের জন্য ছিনিয়ে নেওয়ার অনুমতি চাওয়া হচ্ছে তার কাছেই !
পৃথম প্রণয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত হলো।
প্রণয়কে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বললো,
“কিন্তু ফুপ্পি, এটা কীভাবে হয়?”
মেহজাবিন চৌধুরী প্রণয়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পৃথমের দিকে দৃষ্টি পাত করলেন, ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“কেন হয় না?”
পৃথম কণ্ঠের নমনীয়তা বজায় রেখেই বললো,
“ফুপ্পি, আমার বোন এখনও অনেক ছোট, অনেক ইম্যাচিউর—মাত্র ১৬।
সে মোটেও এখন বিয়ে, সংসার এগুলোর জন্য উপযুক্ত নয়।
আর শুদ্ধ ভাইয়া আমার বোনের চেয়ে আরো বেটার, ম্যাচিউর কাউকে ডিজার্ভ করেন।”
মেহজাবিন চৌধুরী পৃথমের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলেন।
পৃথমের কথার বিপরীতে অকাট্য যুক্তি দাঁড় করিয়ে বললেন,
“তুমি নিজেও তো ১৬ বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছো পৃথম।
দেখতে শুনতে ও মাশাল্লাহ, এই বাড়িতে এসেই সে শাশুড়িদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে সংসারের হাল ধরেছে।
এমনকি বেশ ভালোভাবে, পরিপাটি করে সংসারও করছে।
আমি শুনলাম তোমার বউ নাকি প্রিয়তার বান্ধবী।
তো, সে পারলে তোমার বোন কেন পারবে না?
আর তাছাড়া আমি এক্ষুনি বিয়ের কথা বলছি না—বিয়ে হবে আরও ২ বছর পর।
আমি শুধু এক্ষুনি সকল কথা-বার্তা সেরে রাখতে চাই, যাতে পরে এগুলো নিয়ে সময় নষ্ট করতে না হয়।
এখন কথা-বার্তা হয়ে থাক, বিয়ে হবে প্রিয়তার ১৮ হলেই।”
মেহজাবিন চৌধুরীর এক একটি বাক্যে প্রণয়ের নরম হৃদপিণ্ডকে বিষাক্ত তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করছে।
শরীরে জ্বালা ধরে যাচ্ছে।
হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে তার, কঠোর ব্যক্তিত্বের খোলস ছেড়ে অক্ষিকোটরে বেদনা, অশ্রু জমা হচ্ছে।
চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে, হাতের কপালের শিরা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
উহু, এটা ক্রোধে নয়।
মেহজাবিন চৌধুরী পৃথমকে ছেড়ে আবার প্রণয়ের দিকে মনোযোগ দিলেন।
আগের মতোই স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন,
“বলো প্রণয়, তোমার কি কোনো আপত্তি আছে শুদ্ধর সাথে প্রিয়তার বিয়ে নিয়ে?
দেখো, মেয়েদেরকে সারাজীবন চাইলেই বাড়িতে রাখা যায় না।
তাদের কোনো না কোনো সময় পরের ঘরে দিতেই হয়।
সে যতই আদরের হোক, তাকে একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য কারো হাতে তুলে দেওয়াটা বেশি বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?
এখানে সবাই রাজি—বলো, তোমার কি মতামত?”
প্রণয় নিজের অন্তরের তীব্র দহনলিলা কিছু মুহূর্তের জন্য মনে চাপা দিল।
চোখ তুলে শুধু একবার ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকালো সাদমান শিকদারের দিকে।
সাদমান শিকদার ছেলের গোপন যন্ত্রণা পরিমাপ করতে পেরে একটু ব্যথিত হলেন বটে,
কিন্তু তিনিও নিরুপায়—জীবনে কিছু পেতে গেলে কিছু বিসর্জন দিতে হয়।
তিনিও দিয়েছেন—নিজের ছেলের ভালোবাসার বিসর্জন।
মেহজাবিন চৌধুরী আবার প্রশ্ন করলেন,
“কি হলো, বলো—তোমার কি মতামত?”
পৃথমের ভীষণ খারাপ লাগছে।
প্রণয় চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ে গেল ভালোবাসাময় দিনগুলো।
কি বলবে সে?
কীভাবে এই মুখে নিজের প্রাণপাখিটাকে অন্য কারো হাতে তুলে দেওয়ার অনুমতি দেবে?
এমন প্রশ্ন সম্মুখীন হওয়ার আগে প্রাণটা কেন চলে গেল না?
কীভাবে সহ্য করবে এই দগ্ধ হৃদয়ের রক্তক্ষরণ?
কীভাবে নিজের ভালোবাসার পাখিটাকে অন্য কারো হাতে তুলে দেওয়ার অনুমতি দেবে?
এই পাখিটা কে যদি শুদ্ধ নিয়ে নেয়—কার মুখ চেয়ে বাঁচবে প্রণয়?
প্রণয় নিজের চোখের পানি লুকাতে ব্যর্থ হচ্ছে।
তাই এখানে আর এক সেকেন্ডও নয়—
নয়তো এরা তাকে বাক্যবাণেই মেরে ফেলবে।
সকলে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় সবাইকে অবাক করে দিয়ে আচমকাই বসা থেকে উঠে পড়লো।
কক্ষ ত্যাগ করতে করতে কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আপনারা যা ভালো বুঝেন, তাই করুন।”
আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না—প্রণয় দ্রুত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো।
ব্যথিত হলো পৃথম ও শুদ্ধ।
তবে কিছুই যে করার নেই।
মেহজাবিন চৌধুরী এবার বড় করে হাসলেন।
সাদমান শিকদার ও সাজিদ শিকদারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তাহলে কথা ফাইনাল হয়ে গেল ভাইজান, প্রিয়তা আজ থেকে আমার বউমা।”
সাজিদ শিকদারও হাসলেন।
তার বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল।
তিনি তো চান, তার দুই মেয়েই যেন জীবনে অনেক সুখী হয়।
সেখানে এক মেয়ের জন্য শুদ্ধর মতো উপযুক্ত পাত্র পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ পাওয়া থেকে কোন অংশে কম নয়।
এই যুগে পরের ছেলেদের বিশ্বাস করা যায় না—
সেখানে শুদ্ধ, উনার নিজের ভাগ্নে।
তিনি অবশ্য প্রিয়তার জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন—
কিন্তু উনার সেই ভাবনা দুই বছর আগেই মিথ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে।
তাই এই সময়ে দাঁড়িয়ে, শুদ্ধর থেকে ভালো, যোগ্যতাসম্পন্ন, বিশ্বাসযোগ্য ছেলে তিনি আর পাবেন না।
মেহজাবিন চৌধুরী প্রফুল্ল কণ্ঠে বললেন,
“তাহলে এই খুশির দিনে তো মিষ্টি মুখ করতে হয়!”
সাদমান শিকদার হালকা হেসে জুলেখা বানুকে ডাকলেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই জুলেখা বেগম এসে উপস্থিত হলেন।
সাদমান শিকদার আদেশ দিয়ে বললেন,
“এখনই বাজার থেকে ২০ কেজি ফ্রেশ মিষ্টি এনে আশেপাশে বিতরণ করে দাও।
আর এখানে মিষ্টি পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”
জুলেখা বেগম নত কণ্ঠে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলেন।
শুদ্ধর হৃদয় আজ কেমন ভালো লাগার আবেশে জড়িয়ে যাচ্ছে—
এই বুঝি ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে পাওয়ার সুখ,
সকল কষ্টের অবসানের প্রথম ধ্বনি।
অপেক্ষার প্রহর আর মাত্র দুটো বছর,
তারপর শুদ্ধর এত বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটবে—
প্রিয়তমা হবে আপন।
রাত ১০টা, ড্রাউনিং রুমে প্রিয়তা, পরিণীতা, প্রেরণা, থীরা, থোরি, তন্ময়, অরণ্য, সমুদ্র, রাজ, প্রিথম, প্রেম — তাদের কাজিন সাদিফ, রাদিফ, অভ্র, শুভ্র, শুভ্রতা, তিশা — সব ভাই বোন মিলে মুড়ি-চানাচুর খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে, কারণ তারা সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকবে, এর পর সেহরি খেয়ে ঘুমাবে। চিত্রা আর পূর্ণতা ও আছে আজ। অনুশ্রী বেগম, তনুশ্রী বেগম, অনন্যা বেগম, অর্থি বেগম, ঊষা আর ইনায়া মিলে সেহরির জন্য রান্না করছে।
প্রিয়তা ও অরণ্য দুই বাদর নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করে ইশারায় একে অপরকে কিছু একটা বুঝালো। অতঃপর দুই ভাইবোন মুখে বড় একটা হাসি ঝুলিয়ে তন্ময়ের দুই পাশে গিয়ে বসলো। তন্ময় নিজে মতোই চকোলেট খাচ্ছে। প্রিয়তা তন্ময়ের হাত চেপে ধরে তার চকোলেটে একটা কামড় বসালো। অরণ্যকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো —
“ছোটো ভাইয়া, তোমার কি মনে হয় আমাদের ভাই দিন দিন আমাদের বংশের সব থেকে সুদর্শন ও সুযোগ্য পুরুষ হয়ে উঠছে?”
তন্ময় আপুর দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো। অরণ্যও তন্ময়ের হাত চেপে ধরে তন্ময়ের চকোলেটে কামড় বসালো, তন্ময়ের কাঁধ চাপড়ে বাহবা দিয়ে বললো —
“ঠিক বলেছিস কালা চান্দ এর বউ। আমাদের ছোটো কর্তা তো আব্বু, চাচ্চু, দাদানদেরকে ও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন চালতে থাকলে আমাদের ছোটো কর্তার জন্য বাংলাদেশে বউ খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
তন্ময় এবার মাথা ঘুরিয়ে একই ভঙ্গিতে তাকালো অরণ্যের দিকে। বাকিরা ও মনোযোগ দিয়ে সার্কাস দেখার অপেক্ষায়।
প্রিয়তা আবার ও তন্ময়ের হাত চেপে ধরে তার চকোলেটে কামড় বসিয়ে বললো —
“ঠিক বলেছো ছোটো ভাইয়া, আমাদের চাঁদের টুকরো ভাইয়ের জন্য উগান্ডা অথবা আফ্রিকা থেকে সুন্দরী নিয়ে আসবো। কী বলো?”
মুখটা সিরিয়াস রেখেই বললো প্রিয়তা। প্রিয়তার কথায় সবাই চোখ বড় বড় করে ফেললো। ফিক করে হেসে উঠলো অরণ্য, যতটা সম্ভব নিজের হাসি কন্ট্রোল করে।
তন্ময় চকোলেটের শেষ বাইটটা খেয়ে বললো —
“অথবা নাইজেরিয়া হলেও ও মন্দ হবে না।”
প্রিয়তা মাথা উপর-নিচ করে সম্মতি জানালো। তন্ময় চকোলেটের দিশা ভুলে ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে উৎসুক কণ্ঠে বললো —
“ছোটো আপু, ওই দেশে বুঝি খুব সুন্দর মেয়ে পাওয়া যায়?”
অরণ্য আর প্রিয়তা একে অপরের দিকে তাকিয়ে এক সঙ্গে বললো —
“খুব।”
রাজ ও ওদের মাঝখানে এসে বসলো, তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে মুখটা ইনোসেন্ট করে বললো —
“ভাই, আজ তুই ছোটো বলে তোকে মুরগি বানালো।”
প্রিয়তা ও অরণ্য চোখ বড় বড় করে রাজের দুই হাত জোরে চেপে ধরলো। রাজ শয়তানি হেসে তাকালো ভাইবোনদের দিকে। আরও রসিয়ে রসিয়ে তন্ময়কে বললো —
“ভাই, তুই দেখবি ওইসব মেয়েরা কেমন সুন্দরী।”
রাজের কথায় উৎসাহে ফেটে পড়লো তন্ময়। এক লাফে রাজের কোলে চলে গেলো। রাজের হাত ঝাঁকিয়ে বললো —
“দেখাও না সেজো দাদান!”
রাজ আবার অরণ্য আর প্রিয়তার দিকে তাকালো। অরণ্য প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে চোখের ইসারায় বললো —
“সুনামি আসতে চলেছে, কালা চান্দ এর বউ বাঁচতে চাইলে পালা!”
রাজ গুগল ওপেন করে একটা আফ্রিকান মেয়ের ছবি তন্ময়ের চোখের সামনে ধরলো। তন্ময় প্রফুল্ল মনে উৎসাহ নিয়ে ছবিটার দিকে তাকাতেই তার সমস্ত আনন্দ-উৎসাহ মিলিয়ে গেলো এক নিমিষে। সুন্দর মুখখানা অমাবস্যার রাতের ন্যায় ঘন কালো আঁধারে ছেয়ে গেলো।
ছবিটাতে — এটা কাল, কুচকুচে, অতিরিক্ত কুঁকড়ানো চুলের, ভোটকা ঠোঁটওয়ালী মেয়ের ছবি। তন্ময় কয়েক সেকেন্ড ছবিটার দিকে তাকিয়ে ঘর কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো! শব্দের তীব্রতায় উপস্থিত সকলের বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো।
অরণ্য আর প্রিয়তা তো এক সেকেন্ডেই হাওয়া হয়ে গেলো। রাজ শয়তানি হাসি দিয়ে এবার উগান্ডার একটা মেয়ের ছবি বের করলো — এই মেয়ে আবার টাকলা!
তন্ময় শিখদার রীতিমতো নীল রঙা মেঝের কার্পেটে পড়ে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে। সে কিছুতেই টাকলা, ভোটকা ঠোঁটওয়ালী মেয়ে বিয়ে করবে না!
তন্ময়ের চিৎকারে উপস্থিত জনতার কেউ ড্রয়িং রুমে ঠিকে থাকতে পারলো না। নিজেদের কান চেপে ধরে একপ্রকার জান বাঁচিয়ে পালালো।
ছেলের কান্নার শব্দে রান্না ফেলে ছুটে এলেন অর্থি বেগম, তন্ময়কে কোলে নিয়ে শান্ত করতে করতে চলে গেলেন। এর মধ্যে পুরো ড্রাউনিং রুম ফাঁকা হয়ে গেছে।
শুধু রাজ একা বসে আছে। রাজকে একা বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো শ্বেতা। রাজের পাশের সোফায় বসে হেসে হেসে গল্প করতে শুরু করলো। দুজন কথার এক পর্যায়ে রাজের দৃষ্টি আটকালো কিছুটা দূরে, সে কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো, শ্বেতার দিকে তাকিয়ে কণ্ঠ উঁচু করে গান ধরলো — —
আমার যত ভাই ব্রাদার ডাকবে তোমায় ভাবি..!!
তোমার শাড়ীর আচঁলেতে থাকবে ঘরের চাবি.!!
হাবুডুবু খাচ্ছি আমি প্রেম সাগরে নেমে..!
প্রথম দেখায় আমি তোমার পড়েছিলাম প্রেমে..!
হঠাৎ রাজের এমন অদ্ভুত গানে ভ্রু কুঁচকে গেলো শ্বেতার। সে সন্দিহান নজরে আশেপাশে চোখ ঘুরালো। তার ও দৃষ্টি আটকালো কিছুটা দূরে — যা ভেবেছিলো তাই!
শ্বেতা ও বাঁকা হেসে বেশ লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করে বললো —
“ইসস! কী যে বলো না, লজ্জা লাগে তো!”
রাজ ও বাঁকা হেসে বললো —
“দেখ তোকে লজ্জা পেলে কত সুন্দর লাগে, অথচ আশেপাশে দেখ, নাগিন দিয়ে ভরা! সব সময় ফনা তুলে ছোবল দেওয়ার ধান্দায় থাকে!”
শ্বেতা একটু ভীতু কণ্ঠে বললো —
“কী বলো! নাগিন? এই বাড়িতে সাপ ও আছে নাকি?”
রাজ কিছু বলবে, তার আগেই রাগে ফসফস করতে করতে এগিয়ে এলো পূর্ণতা। সেন্টার টেবিলের উপর থেকে নিজের ফোনটা নিতে নিতে রাজের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিপেক্ষ করলো। সত্যি বলতে ভিতর ভিতর রাজের পুরুষত্ত্বা একটু কেঁপে উঠলো।
শ্বেতা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। পূর্ণতা ফোনটা নিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো। শ্বেতা রাজের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বললো —
“এই আপা আবার জেলাস হচ্ছে কেন? হুঁ হুঁ! বলো বলো, নিশ্চয়ই এখানে ও কোন কাহিনী আছে!”
রাজ বসা থেকে উঠে যেতে যেতে বললো —
“তোর ভাবি লাগে বেয়াদব।”
শ্বেতা দুষ্টু কণ্ঠে বললো —
“সে তো বুঝেতেই পেরেছি যে ইনি আমাদের সেজো ভাবি, তবে বিশাল ঝাঁজ!”
রাজ শ্বেতার দিকে ৫০০ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বললো —
“এটা খা, আর মুখ বন্ধ রাখ।”
শ্বেতা টাকা টা নিয়ে বাঁকা হেসে বললো —
“মাঝে মাঝে এমন এমন দক্ষিণা পেলে মুখ বন্ধ রাখতে আমার কোন অসুবিধা, তবে দক্ষিণা যদি না পাই …”
রাজ যেতে যেতে বললো —
“ব্ল্যাকমেল করবি না!”
হেসে উঠলো শ্বেতা।
প্রিয়তা নিজের মনে গুনগুন করতে করতে ছোটো ছোটো পা ফেলে ৩ তলার মাঝারি ছাদের দিকে যাচ্ছে।
উদ্দেশ্য — ছাদে লাগানো বিদেশি লেবুর গাছটা থেকে কয়েকটা লেবু পাতা ছিড়ে আনুশ্রী বেগমকে দেওয়া।
কারণ, ডালে লেবুর পাতা দিলে নাকি অনেক সুন্দর গন্ধ হয়, আর এই গাছের পাতার ঘ্রাণই আলাদা।
যদিও ও এত রাতে একা ছাদে আসতে প্রিয়তার একটু গা চমচম করছিলো, তবু ও বড় আম্মুর আদেশ মানতে তো হবেই।
প্রিয়তা ৩ তলার করিডোর পেরিয়ে ইউ-টার্ন নিয়ে বাঁদিকের ছাদে পা রাখতেই কিঞ্চিত আশ্চর্য হল, কারণ পূর্ব দিকের ছাদ লাগোয়া বিশাল ঘরটায় আজ আলো জ্বলছে!
ঘরটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো প্রিয়তা, কারণ গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে এই ঘরটা তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। এই ঘরে পা রাখা তো দূরের কথা, এই ঘরের আশেপাশেও আসাতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন প্রণয় শিকদার।
তাহলে এই ঘর খোলার মত এত বড় সাহস কে দেখালো — এটা জানার জন্য প্রিয়তার হঠাৎই প্রচণ্ড কৌতূহল কাজ করছে। লেবু পাতার কথা তার মাথা থেকে জাস্ট বেরিয়ে গেছে।
সে চপল পায়ে এগোতে লাগলো সেই ছাদ লাগোয়া বিশাল ঘরের দিকে।
শিকদার বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ও সুবিশাল কক্ষ হচ্ছে এটি। মুক্ত পরিবেশে ছাদ লাগোয়া এই কক্ষটা প্রণয় বিশেষ করে নিজের জন্যই বানিয়েছিল — আর এটাই মূলত প্রণয়ের আসল সুখ-নিবাস।
যেখানে জড়িয়ে আছে প্রণয়ের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায়, সকল সুখকর স্মৃতি — যা প্রণয় আজ গত দুই বছর ধরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে।
আজ দুই বছরের বেশি সময় হল প্রণয় এই কক্ষ ত্যাগ করে অন্য ঘরে শিফট হয়েছে। সেই অব্দি কেউ এই ঘর খোলার সাহস পায়নি।
তবে হঠাৎ করে নিজের এত পছন্দের ঘর ছেড়ে দেওয়ার কারণ আজও অস্পষ্ট শিকদার বাড়ির সদস্যদের কাছে।
এই ঘরে সে সাধারণত কাউকে আসতে দেয় না, এমনকি নিজেও আসে না।
তাই প্রিয়তার কৌতূহলী মনের কৌতূহল চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে।
প্রিয়তা ধীরে পায়ে ঘরের কাছে যেতেই কিছু ভাঙচুরের শব্দ কানে এলো।
কিছু একটা ঝংকার তোলার শব্দে ও ঈষৎ কেঁপে উঠলো প্রিয়তা।
সে পা টিপে টিপে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
দরজাটা লক নয়, তবে ভেতর থেকে ভেজানো।
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে সেটাতে আলতো হাত ছুঁতেই দরজাটা আপনা-আপনি হাট করে খুলে গেল।
এবার ও মৃদু কেঁপে উঠলো প্রিয়তা।
সে কাঁপা কদমে কক্ষে ফেলতেই আচমকা পুরো বাড়ির ইলেকট্রিসিটি চলে গেল।
আনন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আসলো আশপাশ।
তবে দক্ষিণের বিশাল জানালা খোলা থাকায় অর্ধচন্দ্রের রুপালি আলো জানলা গলিয়ে ঘরের মেঝেতে এসে পড়ছে।
তবে সেই আলো ঝাপসা — বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না।
অন্ধকারে ভীষণ ভয় প্রিয়তার। তার উপর, এই পুরো নির্জন ছাদের তালাবদ্ধ অন্ধকার কক্ষে নিজের উপস্থিতি বুঝতে পেরে সিউড়ে উঠছে তনু-মন।
আর সে তো এটাও জানে না — এই ঘরে কে আছে? আদৌ কেউ আছে কিনা?
কারণ, এই ঘর দুই বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ। আর বড় আম্মু বলেন, কোন জিনিস পরিত্যক্ত হয়ে গেলে সেখানকার নেগেটিভিটি বাড়তে থাকে।
আর হঠাৎ এখানে কারো আসার কথা ও নয়।
ভয়ে প্রিয়তার পিলে চমকে উঠলো, বুকের মধ্যে রক্ত জমতে লাগলো মুহূর্তেই।
চোখের সামনে ভাসতে লাগলো হলিউড-বলিউড মুভির অশরীরীদের ভয়ংকর সব মুখাভয়ব।
প্রিয়তা তৎক্ষণাৎ চোখ-মুখ খিঁচে স্ট্যাচুর মতো মেঝের সাথে সেঁটে রইলো।
তার কাছে আশপাশের পরিবেশটা কেমন ভারি ভারি লাগছে। ভয়ে হাঁপানি রোগীর মতো কলিজা ধড়ফড় করছে, তার বাঁকানো অঙ্গের বাঁকে বাঁকে কাঁপন ধরছে মৃদু মৃদু।
কম্পনরত অবস্থায় প্রিয়তা ঘাড়ে কারো উষ্ণ গরম নিঃশ্বাসের উপস্থিতি অনুভব করলো।
ভয়ে আরও জমে গেল প্রিয়তা। হাত দিয়ে নিজের জামাটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল। কপাল বেয়ে স্বচ্ছ তরল দরদর করে নেমে আসছে।
মনে মনে আয়তুল কুরসি সহ যত দোয়া-দরুদ জানে সব পাঠ করতে লাগলো প্রিয়তা।
প্রিয়তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে — কেউ তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে!
খুব কাছ থেকে একদৃষ্টিতে দেখছে তাকে।
তার গরম নিঃশ্বাস অনবরত প্রিয়তার কাঁধে, ঘাড়ে এসে আঁচরে পড়ছে।
প্রিয়তা ভিতু মন হঠাৎ সচকিত হল।
কাঁপাকাপি বজায় রেখে সচল মস্তিষ্কে ভাবল — “এক মিনিট! ভূত ও কি আজকাল নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেছে?”
প্রিয়তা নিজের ভাবনাতেই বলদ বনে গেল।
অদৃশ্য হাতে নিজেই নিজের মাথায় চাটি মেরে বললো — “গর্ধব! ভূত আবার নিঃশ্বাস নেয় নাকি?”
প্রিয়তা যখন অনুভব করলো, পাশের ব্যক্তি ভূত নয়, বরং জলজ্যান্ত মানুষ — তখনই চমকে চোখ খুলে ফেললো।
তড়িত বেগে পিছনে ঘুরে তাকাতেই চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো কারো প্রশস্ত বুক। সঙ্গে সঙ্গেই মাথা উঁচিয়ে উপরে দৃষ্টিপাত করল প্রিয়তা।
অন্ধকার কক্ষে চাঁদের ঝাপসা আলোয় তার দৃষ্টি আটকালো এক পুরুষের মায়াবী মুখশ্রীতে — যার গভীর চোখ দুটো স্থির, শুধু তার মধ্যেই নিবদ্ধ।
প্রিয়তা এই মুহূর্তে প্রণয়কে এখানে দেখে কিছুটা আশ্চর্য হল। হতবিহবল কণ্ঠে কিছু বলতে নিতেই, তার রক্তলাল ওষ্ঠের উপর তর্জনী আঙুল চেপে ধরলো প্রণয়।
সঙ্গে সঙ্গেই একদম স্থির হয়ে গেল প্রিয়তা।
নির্বিকার চোখে তাকিয়ে রইলো সেই পুরুষের মায়াময় চোখে।
প্রিয়তা কি সত্যি ওই চোখে তাকিয়ে একটু ও বুঝতে পারে, এই পুরুষটা তার প্রতি কতটা আসক্ত?
সে কি এতো ভালোবাসার একটুকুও দেখতে পায় না?
সে কি দেখতে পায় না, কেমন করে তার প্রেমানলে পুড়ে পুড়ে একটা মানুষটা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে?
প্রিয়তা কি জানে, তার এই নিটোল প্রেম কতটা ভয়ানক হয়ে উঠেছে এই পুরুষটার জন্য? এ যেন ভালোবাসা না, অভিশাপ — যা তাকে একটু একটু করে এগিয়ে দিচ্ছে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে।
কিন্তু আফসোস, প্রিয়তা এসবের কিছুই জানতে পারলো না, দেখতে ও পেলো না, ও বুঝতে ও পারলো না।
শুধু নিজের অবুঝ দৃষ্টির সম্মোহনী মায়ায়, সেই পুরুষের হৃদয়কে আরেকটু ঘায়েল করে নিল।
কয়েক মুহূর্ত নিজের প্রাণের দিকে তাকিয়ে আরও দুই কদম এগিয়ে এলো। আহত কন্ঠে বলল —
“আমি কি জীবনে খুব বড় পাপ করে ফেলেছিলাম, জানপাখি?”
থমকালো প্রিয়তা।
কিচ্ছু বুঝতে না পেরে, অবুঝ চোখে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের ঘোলাটে চোখের পানে।
প্রিয়তার সেই অবুঝ দৃষ্টি দেখে প্রণয়ের ঠোঁটে কোনে বিদ্রুপের হাসি খেলে যায়— যার জন্য এত কিছু, শালার সেই বুঝলো না!
হঠাৎ করেই মাথায় কেমন যেন রাগ চড়ে যাচ্ছে।
মন-মস্তিষ্ক উভয়েই জ্বলে উঠছে। প্রিয়তার দিকে তাকাতেই মনে পড়ে যাচ্ছে তখন প্রিয়তার ‘শুদ্ধর বউ’ হতে চাওয়া কথা।
মনে পড়ে যাচ্ছে তখন শুদ্ধর প্রিয়তার পাশ ঘেঁষে বসার কথা।
আবারো প্রিয়তার দিকে তাকাতেই রাগটা তেতে উঠে। ফুসে ওঠে ভেতরটা।
এই মেয়েটা কি বোঝে না?
তার মুখে অন্য কারো বউ হওয়ার কথা শুনলে প্রণয়ের কষ্ট হয়, বুকে!
এই মেয়েটা কি বোঝে না — অন্য কেউ যখন তাকে নিজের বউ বা — বাগদত্তা বলে দাবি করে, তখন প্রণয়ের গোটা পৃথিবী জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়!
অন্য কেউ যখন তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার বাহানা খুঁজে, তখন প্রণয়ের বুকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।
সে একদমই মেয়েটার আশেপাশে কাউকে সহ্য করতে পারে না — এই মেয়েটা শুধুমাত্র তার, একান্তই নিজের — তার জান, প্রাণ, সব!
কেন এই মেয়েটা তার এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা দেখতে পেলো না?
কেনো পাবে না, যেনে ও যত দিন যাচ্ছে, এই মেয়েটার প্রতি মায়া আর ভালোবাসা — দুটোই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
এত ভালোবাসার পর নিজের কলিজাটাকে অন্যের পাশে দেখে, কিভাবে সহ্য করবে প্রণয়? কলিজাটা চিরে যাবে না?
প্রণয় চোখ বন্ধ করে নিজের বারন্ত রাগ আর জ্বলন্ত মনকে একটু ধমাতে চাইল।
সে যতই রেগে থাকুক, সে কখনোই নিজের জানপাখির উপর কোনো প্রকার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চায় না।
তাই নিজের যন্ত্রণা গিলে নিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বললো — “চলে যা এখান থেকে। আমায় একটু একা থাকতে দে।”
কিন্তু এক চুলও নড়লো না প্রিয়তা।
দৃষ্টি ও সরালো না।
সটান দাঁড়িয়ে রইলো।
প্রণয় প্রিয়তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, নিজেকে রাগ আর যন্ত্রণা — দুটোই নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।
প্রিয়তা গেল না।
বরং প্রণয়ের পেটের দুই পাশের টি-শার্ট হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো।
আরেকটু কাছে এসে অবুঝ কণ্ঠে প্রশ্ন করলো — “আপনি কি কাঁদছিলেন, প্রণয় ভাই? কেউ আপনাকে কষ্ট দিয়েছে?”
প্রণয় আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না।
যন্ত্রণায় তার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে।
সে এক ঝটকায় প্রিয়তাকে পাশের দেয়ালের সাথে মিশিয়ে, শক্ত করে এক হাতে কোমর চেপে ধরে, অন্য হাত প্রিয়তার পাশের দেয়ালে রাখলো।
আচমকা এমন হওয়াতে কিছুটা ঘাবড়ে গেল প্রিয়তা। ভীত চোখে তাকালো প্রণয়ের রাগান্বিত মুখে।
প্রণয় তার তুলতুলে হাতটা তুলে দেয়ালের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো।
ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো প্রিয়তা।
তবু ও শব্দ করলো না।
শুধু নির্বিকার চোখে চেয়ে রইলো প্রণয়ের রক্তিম চোখের পানে।
প্রণয় নিজেদের মধ্যেকার সেন্টিমিটারসম দূরত্বটাও ঘুচিয়ে দিলো।
নিজের বলিষ্ঠ দেহ দ্বারা প্রিয়তাকে শক্ত বাধনে আটকে ফেলল।
মুখটা প্রিয়তার মুখ বরাবর মুখ নামিয়ে, তীব্র রাগ ও আসক্তি মিশ্রিত কণ্ঠে হিসহিসিয়ে বললো —
“বুঝিস না তুই, তাই না? তবে কবে বুঝবি আমি মরে গেলে, হ্যাঁ আমি মরে গেলে নিশ্চয়ই বুঝবি, আমায় ঠিক কতটা যন্ত্রণা দিয়ে পুরিয়ে মেরেছিলি — প্রতিটা মুহূর্তে, প্রতিটা সেকেন্ডে।”
প্রিয়তা অবাক চোখে চেয়ে আছে।
প্রণয় প্রিয়তার ডান হাতটা তুলে নিজের বুকের বা পাশে চেপে ধরল —
“একদিন বুঝবি, এই বুকটা তোর জন্য কী ছিল।
কিন্তু যেদিন বুঝবি — সেদিন হয়তো আমি কবরেই শুয়ে থাকবো।
সেদিন অনেক ডেকেও তুই আর সাড়া পাবি না। অনেক দূরে হারিয়ে যাবো তোর জীবন থেকে।
সেদিন হয়তো তুই সব বুঝবি, জানপাখি… কিন্তু সেই দিনটা দেখার জন্য আমি থাকবো না!”
বলতে বলতে চোখের পানি ছেড়ে দিলো প্রণয়।
কণ্ঠনালীও কেঁপে উঠলো।
প্রণয় বলার এক একটা বাক্যে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
প্রিয়তার অন্তর জ্বলে উঠলো প্রণয়ের বলা বাক্যগুলোতে।
সে কেবল অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইল প্রণয়ের মুখের পানে।
প্রণয় আরেকটু প্রিয়তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দাঁড়ালো।
প্রিয়তার নরম গালে হাত রেখে আহত কণ্ঠে বললো —
“সেই দিন বেশী দূরে নয়, জানপাখি… যেদিন আমি তোর থেকে অনেক দূরে হারিয়ে যাব।
তখন আর তোর সব কথা শোনার জন্য আমি থাকবো না,
তোর সকল আবদার মেটানোর জন্য,
তোর জ্বালাতন সহ্য করার জন্যও আমি থাকবো না।”
প্রণয়ের কথার মর্মার্থ না বুঝলেও, তার বলা নিষ্ঠুরতম বাক্যগুলোতে প্রিয়তার ছোট্ট মন ব্যথা জর্জরিত হয়ে উঠলো।
চোখের কোণে পানি টলমল করে উঠলো।
প্রণয় প্রিয়তার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললো —
“এখানে কান পেতে শোন, জান… এখানে থাকা ছোট্টো প্রাণপাখিটা আর সহ্য করতে পারছে না।
অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে… হয়তো একদিন এভাবেই ছটফট করতে করতে মরে যাবে…
আমার মন-প্রাণ আমাকে অনেক অভিশাপ দেয়, জানিস?
আমি নাকি তাদের এক সেকেন্ডও ভালো থাকতে দেই না।
আমি তাদের কিভাবে বুঝাবো বল —
আমার ভালো থাকার সব রাস্তা যে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে,।
আমি যে বেঁচে আছি — এটাই তো অনেক…”
বলতে বলতে থেমে গেল প্রণয়।
চুপ করে চেয়ে রইলো প্রিয়তার টলমল অশ্রুপূর্ণ নীলাভ চোখের পানে।
ওই চোখেই তো প্রথম খুন হয়েছিল সে।
প্রিয়তার চোখে সে যন্ত্রণা দেখতে পাচ্ছে।
হালকা হাসলো প্রণয়।
প্রিয়তার দুই গালে হাত রেখে পরম ভালোবাসায় কপালে ঠোঁট চেপে ধরলো।
দুজনেরই গাল বেয়ে টপটপ করে ঝরতে লাগলো বেদনা মিশ্রিত অশ্রুজল।
প্রণয় প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো —
“আমি কিছু চাই না, জানপাখি… তুই শুধু জীবনে অনেক ভালো থাকিস…
আমার আত্মা দেখে শান্তি পাবে।”
প্রিয়তা হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠল।
আচমকাই প্রণয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে ফুপিয়ে উঠলো।
পুরুষালী পিঠ আঁকড়ে ধরে ধরে ফুপাতে ফুপাতে বললো —
“এসব আপনি কি বলছেন, প্রণয় ভাই? কেন বলছেন? কী হয়েছে আপনার?
যাই হয়ে থাকুক, প্লিজ এমন বলবেন না…
আমার ভীষণ কষ্ট হয়।
আপনি তো জানেন, আমি আপনাকে ছাড়া একটুও থাকতে পারি না, প্রণয় ভাই!”
প্রিয়তার বুকে মাথা রাখতেই প্রণয়ের কলিজায় আগুন লেগে গেল।
সে আস্তে করে নিঃশব্দে ছোট্ট দেহটা নিজের বুক-পাঁজরে মিশিয়ে নিলো।
নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো।
চুলে চুমু খেয়ে মনে মনে বললো —
“অন্যের বউ হতে চাস হো… সমস্যা নেই।
তবে আমায় জীবিত রেখে এত বড় শাস্তি দিস না, পাখি।
সত্যি বলছি, এই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারবো না।একটুও পারবো না।
এর আগে তুই নিজের হাতে আমার নিঃশ্বাসটা বন্ধ করে দিস…
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫০
আমি হাসিমুখে শিকার করব —তা হবে আমার জন্য পরম সুখের।
কিন্তু আমায় জীবিত রেখে অন্যের নামে কবুল বলিস না জানপাখি।
তুই তো আমার সব রে… আমার জানপাখি… আমার প্রাণপাখি… আমার লক্ষ্মী…
এই বুকে তুই যতক্ষণ থাকিস, ততক্ষণ বড় সুখ… সুখ অনুভব হয়।
আবার তুই যখন চলে যাস — তীব্র দহনে পুড়তে থাকে এই হৃদয়।
মুখে যতই বলি, তোকে অন্যের হতে দেবো —
কিন্তু আমার মন জানে, সে তোর এক কণা ভাগও অন্য কাউকে দিতে পারবে না,…
তুই শুধুই আমার।”