ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫২

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫২
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

ভালোবাসায় যে সুখ নেই, সেটা আবারও প্রমাণিত হলো। ভালবাসলে আপনাকে কষ্ট পেতেই হবে, এ যেন ওলিখিত শর্ত।
প্রণয় এর ভীষণ ভয় হচ্ছে নিজেকে নিয়ে, কারণ তার নিজের এই অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতির উপর তার নিজেরই কোন কন্ট্রোল নেই।

তার নিজের ভবিষ্যত তো সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, তাই সে চায়না তার দ্বারা আর কোন ভুল হোক , তবুও এই মেয়েটার সামনে সে ঠিক থাকতে পারেনা লুকিয়ে রাখতে পারে না নিজের অন্তরের দুর্বলতা । অব্যক্ত ভালোবাসা গুলো উগ্রে আসতে চায়, তার এই সর্বনাশা আসক্তি না জানি কখন তার জানপাখির চরম সর্বনাশ করে দেয়। এই পাখিটা কে ছাড়া থাকতে পারবে না বলে এতো গুলো দিন নিজের পরিণতি কি হবে জেনেও, সে এই পবিত্র ফুলটা কে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল। সকল অশান্তির পর এক টুকরো সুখ খুঁজতো সে এই পাখিটার মাঝে। ক্লান্ত দিনের অবসানে, এই মায়াবী মুখের অবুঝ চাহুনি ছিলো বেঁচে থাকার প্রেরণা। যন্ত্রণা পরিমাণ বেশি হলে তা নিবারণের জন্য এই ফুলটাকে বুকে জড়িয়ে ধরাই ছিলো স্বর্গ সুখের সন্ধান। এখন যেমন বুক পাঁজরে মিশিয়ে রেখেছে, তাই এই শান্তি টুকুর জন্য সে বড্ড স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিল। শুধু মাত্র একটু শান্তির লোভে, সে অনেক ভুল করে ফেলেছে এই পাখিটার সাথে। যা কিছু হয়েছে এতে এই পাখিটার তো কোন দোষ নেই, তবে সে কেন এই নরক তুল্য যন্ত্রনা বুকে জড়াবে? তাই যা হওয়ার হয়ে গেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তবে আর নয়।
নিজের কষ্ট হবে বলেই সে আর স্বার্থপর হতে পারবে না। নিজের ভালোবাসার ভবিষ্যৎটা সে নিজের হাতে আর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারবে না। এবার আর নিজের কথা নয়।
অনেক স্বার্থপরতা সে দেখিয়ে ফেলেছে সে ইতিমধ্যেই।
আর নয়, আর কোন মানসিক শান্তি সে খুঁজবে না।
সকল ক্লান্তি, যন্ত্রনা, অবসাদ, অশান্তি, এই জান যতদিন সইতে পারবে, ততদিনই পৃথিবীর আলো দেখবে, নিঃশ্বাস নেবে।
প্রিয়তা বুকে মুখ লুকিয়ে এখনও ফুপিয়ে যাচ্ছে।

কোন এক অজানা কারণে ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে, ভীষণ কান্না ও পাচ্ছে তার।
প্রণয় ভাই তার সাথে কেন এমন করেন?
কেন সে এই মানুষটাকে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না?কেন এই মানুষটাকে এত রহস্যময় লাগে?
এই মানুষটার ভালোবাসা যেন তার কাছে আস্ত এক গোলকধাঁধা, সবকিছুই কেমন ঘোলাটে, অস্পষ্ট, বড় অদ্ভুত ও বৈচিত্র্যময়?
কখনো হাসায়, আবার কখনো কাঁদায়।

এত বছর একসাথে থেকে, ও জন্মের পর থেকে দেখে, ও প্রিয়তা এই মানুষটাকে চিনতে পারে না। কোনটা তার ভালোবাসা, কোনটা তার সহানুভূতি বুঝতে পারে না।
প্রিয়তা প্রণয়ের বুকে নাকের পানির চোখের পানি মুছে দিয়ে বিড় বিড় করে বলল—
“আমি আপনার ভালোবাসা একটু ও বুঝতে পারি না প্রণয় ভাই।
আমার কখনো কখনো মনে হয় আপনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন।
আপনার থেকে বেশি আপন আমার আর কেউ নেই। আপনার থেকে বেশি ভালো আমাকে এই দুনিয়াতে আর কেউ বাসে না।

ভীষণ রকম ভালোবাসেন আপনি আমাকে, মনে হয় যেন আমি যেন আপনার সব।
আবার কখনো কখনো মনে হয় আপনি আমাকে কোনওদিন ওই চোখে দেখেননি।
আমি আপনার কাছে স্রেফ একটা মায়া, অভ্যাস, সহ্য, যত্ন, সহানুভূতি,দায়িত্ব —ভালোবাসা নই।
তখন আমার মন বলে, আপনি আমাকে ভালোবাসেন।
কিন্তু মস্তিষ্ক বলে, আপনি যদি ভালোই বাসতেন, তাহলে কি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারতেন?
আপনি তো বাড়ির প্রত্যেকের সামনে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, আপনি বড় আপুকে ভালোবাসেন, বিয়ে করতে চান।
বাড়ির কেউ তো কখনো আপনাকে একবিন্দু ও জোর করেনি প্রণয় ভাই।
আপনি বলেছিলেন, বড় আপু আপনার ভালোবাসা।
আমি ও তো দেখেছি, আপনি বড় আপুকে কত ভালোবাসেন।
আপনাদের কত সুন্দর সুখের সংসার।
সেখানে আমার জায়গাটা কোথায়?

কোথাও নেই।
আপনি—আমাকে ভালোবাসতেই পারেন না।
তাহলে মাঝে মাঝে এমন করে আমাকে গুলিয়ে দেন কেন প্রণয় ভাই,?
মাঝে মাঝে আপনার অদ্ভুত কিছু আচরণ, অদ্ভুত দুটো একটা কথা আর এলোমেলো কিছু স্পর্শ আমার তিলে তিলে গড়া ধৈর্যের পাহাড়কে মুহূর্তে চূর্ণ করে দেয়। আপনার দুট একটা ছুয়াতে নিজেকে যা যা বুঝাই তার, সব আবার ভুলে যাই।
আপনি আপনার খেয়ার খুশি মতো কখনও আমাকে কাছে টেনে নেন,আবার কখনো দূরে সরিয়ে দেন এমন কেনো করেন প্রণয় ভাই?
আমি আসলে আপনার কে?

যখনই মনে হয় আপনি আমাকে ভালোবাসেন, তখনই মনে পড়ে যায়—আপনি অন্য কারো।
আপনি কোনওদিনও ও আমার হবেন না।
আমি কোনদিন ও আপনাকে পাব না, আপনি আমার সেই কাল্পনিক পুরুষ যে বাস্তবে কোনদিনও আমার হবে না।”
তাই আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি প্রণয় ভাই, কিন্তু আপনি প্রতিবার আমাকে এলোমেলো করে দেন।
আমি আর এই দুটানায় থাকতে পারছি না প্রণয় ভাই।
প্রণয়ের শরীরের সাথে লেপ্টে থাকায় প্রণয় নারী দেহের সেই মাতাল করা মাধকীয় সুঘ্রাণটা খুব কাছ থেকে পাচ্ছে, যার জন্য প্রণয়ের তাকে একটুও ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। এই ভাবাবেই থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে অনন্তকাল। মন বলছে, এই সময়টা কখনো না ফুরাক। কিন্তু তার ভাবনা ফুরানোর আগেই হুট করে ইলেকট্রিসিটি চলে এলো।
আচমকাই কক্ষের সব সব লাইট জলে উঠলো।
আলো চোখে পড়তেই ধ্যানভঙ্গ হলো দুজনেরই।

প্রণয় এর হুস ফিরলো মনে পড়তে লাগল, একটু আগে সে প্রিয়তার সাথে ঠিক কি কি করেছে, সে আবারও আবেগের বশে প্রিয়তা কে কি কি বলে দিয়েছে, কিভাবে নিজের অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতিগুলো জাহির করেছে।
“শিট! প্রিয়তা নিশ্চয়ই এখন এসকল কথার মর্মার্থ উদ্ধার করে বসে পড়বে”—তাই প্রিয়তার ভাবনাকে বাড়তে দিলো না প্রণয়।
ঝটকা মেরে প্রিয়তা কে নিজের বুক থেকে দূরে সরিয়ে দিলো আচমকাই। নিজে ও প্রিয়তার থেকে দুই কদম পিছিয়ে গেলো।

মুখে ফুটিয়ে তুলল সেই চিরচেনা গাম্ভীর্য, কাঠখোট্টা চেহারার আড়ালে মুহূর্তেই ঢাকা পড়ল কিছুক্ষণ আগের সেই কাতর প্রেমিক পুরুষ, তার সকল অসহায়ত্ব, দুর্বলতা, ভালোবাসা—সব যেন এক নিমিষেই চেহারা থেকে উবে গেল।
সেকেন্ডের মধ্যে রং পাল্টাতে দেখে প্রিয়তা তো পুরাই হতভম্ব।
নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আবারও প্রিয়তার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলো প্রণয়, চোখ তার অনুভূতিশূন্য।
প্রিয়তার চোখে মুখের সেই চুম্বকীয় আকর্ষণ, ভালোবাসা, কোমলতা, প্রণয়কে পুনরায় কাবু করতে চাচ্ছে।
তবে এবার আর প্রণয় সেই ফাঁদে পা দিল না, নিজেকে সামলে নিলো।
প্রিয়তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কণ্ঠে রুক্ষতা এঁটে ধমকে বললো—

“এখানে কেনো এসেছিস? বারণ করেছিলাম না এই ঘরের আশেপাশে আসতে!
তবে কেন এসেছিস? এখনই বেরিয়ে যা!”
কিছুক্ষণ আগে সেই দুর্বল প্রণয়ের সাথে, এখনকার এই রাগান্বিত প্রণয়ের কোন মিলই খুঁজে পেল না প্রিয়তা, বিধায় চরম আশ্চর্যনিত হয়ে তাকিয়ে রইল । মানুষ কিভাবে এত তাড়াতাড়ি রঙ পাল্টে ফেলে, এটাই বুঝে এলো না প্রিয়তার।

এই মুহূর্তে প্রণয়ের চোখে মুখে তীব্র বিরক্তি ছাড়া অন্য কিছু নেই, যেন সে প্রিয়তা কে সহ্যই করতে পারছে না।
ঠিক এই কারণে প্রিয়তা প্রণয়ের ভালোবাসা নিয়ে সবসময় কনফিউশনে থাকে, কিছুই বুঝতে পারে না।
কিছুক্ষণ আগেই এই মানুষটাই তো কত ভালোবাসামিশ্রিত কথা বলছিলো।
এক মুহূর্তের জন্য প্রিয়তার মনে হচ্ছিলো,—এই মানুষটার কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়তো সে।
হয়তো এই মানুষ তাকে নিজের চেয়েও ও বেশি ভালোবাসে।
ওই দুই চোখের ভাষা না বুঝতে পারলে ও চোখে একটা চাপা যন্ত্রণাটা দেখেছে।
তবে এখন আর সেসবের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই যেন কিছুই ঘটেনি।
প্রিয়তাকে হতবম্ব নয়নে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আরও খানিকটা চটে গেলো প্রণয়।
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো—

“কি হলো? চুপ করে আছিস কেন? জানিস না কথার অমান্য করা আমার পছন্দ নয়?”
প্রণয়ের মৃদু ধমকে কেঁপে উঠলো প্রিয়তার সর্বাঙ্গ।
অপমানের অশ্রু জমা হলো অক্ষিকোটরে।
সত্যি সত্যি, একটু আগে প্রণয়ের এলোমেলো কথা আর ব্যবহারগুলো মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো প্রিয়তার।
মনের আকাশে জমা হলো অভিমানের টুকরো টুকরো কালো মেঘ।
সামান্য একটা কথা অমান্য করায় এভাবে বলছেন প্রণয় ভাই?
প্রিয়তার টলমলে চোখের মণি দেখে ধক করে উঠলো প্রণয়ের বুক, দুর্বলতা অনুভব করলো ভীষণ।
তবুও, সেটা প্রশ্রয় না দিয়ে কাটাকাট কণ্ঠে বললো—

“আজকে প্রথমবার ভুল করেছিস, তাই ক্ষমা করে দিলাম।
নেক্সটে যাতে এমনটা হতে না দেখি।
নাও, গেট লস্ট।”
প্রিয়তার অভিমানের পাল্লা আরও ভারী হলো।
সে জলজলে চোখে একবার প্রণয় কে দেখে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো।
প্রিয়তা যেতেই প্রণয়ের বুক চিরে অসহায়ত্বের দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
নিজের রাগের খোলস ঝেরে ফেলে, হাত মুঠো করে সজোরে ঘুষি মারলো পাশের শক্ত সিমেন্টের দেওয়ালে।
সাথে সাথেই ফর্সা চামড়া ছিঁড়ে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে এলো।
কিছুক্ষণ আগে করা কৃতকর্মের জন্য, প্রণয় রাগ আর আফসোস—দুটোই হচ্ছে।
সে কপালে হাত রেখে পাশের কাউচে বসে পড়লো।
নিজেকে বড়ই অসহায় লাগছে তার।

সে নিজের কষ্ট, যন্ত্রণা, ভালোবাসা—কোনটার উপরই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না।
না চাইতেই ও উল্টাপাল্টা আচরণ করে ফেলেছে সে।
সে দুই হাতে কপাল চেপে ধরলো—
“কি করবো আমি? আর মাত্র একটা মাস বাকি।
এই ৩০ দিন আমি কিভাবে পার করবো?
আমি যদি নিজের emotions এর উপর এভাবে কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ি, তাহলে কিভাবে আমি আমার রক্তজবা কে একটা ভালো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে দেবো?
আমার দুর্বল মুহূর্তে করা উল্টাপাল্টা আচরণ ওর মনের উপর ভারি প্রভাব ফেলছে।
এমন চললে ও কোনওদিনও আমাকে ভুলতে পারবে না, এমনকি দূরে গেলেও মুভ অন করতে পারবে না।
প্রণয় অসহায় কণ্ঠে বললো,

নিজে নিজে একা বাঁচতে শিখ জান, পরনির্ভরশীলতা ছেড়ে আত্মনির্ভর হো।
আমার ছায়া থেকে তোকে বেরোতেই হবে।
আমার উপর নির্ভরতা তোকে ছাড়তেই হবে।
তোকে অন্যকে নয়, নিজেকে ভালোবাসতে হবে।
সবার আগে নিজেকে দেখতে হবে।
তাহলে আর আমার মত কারো নিঃস্বতা তোকে পোড়াবে না।
কিন্তু তুই আমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেলে, আমি কিভাবে বাঁচব?
এসব ভাবলেই তো নিঃশ্বাস নিতে পারি না।”

প্রণয় প্রচণ্ড ডিপ্রেসড ফিল করছে।
সব দায়িত্ব, যন্ত্রণা, ভালোবাসা, অসহায়ত্ব—তাকে গ্রাস করছে ধীরে ধীরে।
ক্রমশ সে ঘন নিখাদ অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
জীবনের সেই ক্ষীণ সুখ টুকু হারিয়ে যাচ্ছে অদূরে।
প্রণয় দ্রুতো বসা থেকে উঠে পড়লো।
মাইন্ড রিলাক্স করার জরুরী।
তাই বাসার জামাকাপড় পরেই নিজের কারটা নিয়ে শিকদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

লোকালয় থেকে বেশ দূরে, জনমানবহীন এক নিস্তব্ধ নদীর পাড়ে এসে থামল প্রণয়ের প্রাইভেট কার। চারপাশে নিঃসাড় নীরবতা, ঘনিয়ে আসা রাতের অন্ধকার যেন ধীরে ধীরে গিলে নিচ্ছে পুরো পৃথিবীটাকে। কোথাও কোনও শব্দ নেই—শুধু মুহূর্ত পর মুহূর্ত, গা ছমছমে নিঃস্তব্ধতার বুক চিরে ভেসে আসছে খরস্রোতা নদীর কলকলে জলের মৃদু গুঞ্জন।

প্রণয় গাড়ির দরজা খুলে বাহিরে পা বাড়াতেই এক ঝাঁক দমকা শীতল হাওয়া এসে তাকে ছুঁয়ে দিয়ে মিলিয়ে গেল, যেন কোনও অলক্ষ্য সত্তা প্রণয়ের অস্তিত্বে এক মুহূর্ত থেমে স্পর্শ করে সরে গেল। প্রণয় ধীরে ধাপে এগিয়ে চলল নদীর পাড়ে—চোখের সামনে টলটলে নিঃসীম কালচে জল, আর বুকের ভিতরে বিষাদে ডুবে থাকা জ্বলন্ত হৃদয়।
প্রণয় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল নদীর কালো জলের দিকে। অভিশপ্ত জীবনের বোঝা তার গলায় ফাঁসির দড়ির মত ঝুলছে। প্রণয়ের ক্লান্ত সত্তার প্রতিটা নিঃশ্বাসের একটাই প্রশ্ন—মৃত্যু কবে আসবে? আর কবে মুক্তি মিলবে এই বিভীষিকাময় জাহান্নামতুল্য জীবন থেকে? সে সত্যি হেরে গেছে, তলিয়ে গেছে অন্ধকারে, যেখান থেকে সে চাইলে ও আর কোনওদিন ও আলোর দিশায় ফিরতে পারবে না। তাই এখন শুধু অনন্ত মুক্তির অপেক্ষা, যেখানে আর কেউ তাকে কষ্ট দিতে পারবে না।

প্রণয় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। তার থেকে একটা ঠোঁটে চেপে ধরে জ্বালাতেই এক মুহূর্ত চারপাশে আলোর ক্ষীণ ছটা আর ধোঁয়ার কুন্ডলি দেখা গেল।
নিজের গাঢ় কালচে লাল ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে বড় বড় নিঃশ্বাসে সুখটান দিতে লাগল—এক একটা নিঃশ্বাসে বিষাক্ত ধোঁয়াটা ইনহেল করে নিতে লাগল ফুসফুসে। নদীর পাড়ে শীতল বাতাসের সাথে জ্বলন্ত সিগারেটের কম্বিনেশনটা বেশ লাগলো প্রণয়ের কাছে। যদিও প্রিয় নারীর ঠোঁটের মিষ্টি স্বাদের কাছে এই সিগারেটের স্বাদ বড়ই তুচ্ছ।

প্রণয় তো সেই মিষ্টি ঠোঁটের স্বাদ পেয়ে গেছে, তাই এখন আর এই সিগারেটের স্বাদ তার আগের মতো ভালো লাগে না। সে জন্য সিগারেটও প্রণয়ের নিকট তার কার্যক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। তাই ব্যর্থ হচ্ছে তার বুকের যন্ত্রণাকে ধোঁয়ার সাথে টেনে বের করতে, ব্যর্থ হচ্ছে তার ভেতরের জমে থাকা ক্লান্তির স্তুপ দূর করতে, একটু স্বস্তি দিতে। ফলে প্রণয়ের চটে থাকা মেজাজে বিরক্তির পারদ ছড়াচ্ছে দাবানলের মত।
একটা, দুটো, তিনটে… পরপর আরও বেশ কয়েকটা সিগারেট শেষ হয়ে গেল। কিন্তু বুকের ভিতরের সেই পোড়া দগদগে ক্ষত কিছুতেই নরম হচ্ছে না। উল্টো প্রণয়ের মনে হচ্ছে, কেউ যেন প্রতিটি ক্ষতের উপর সতর্ক হাতে লবণ-মরিচ মাখিয়ে দিচ্ছে—একেবারে নিখুঁত নিপুণতায়।

এমনকি সিগারেটগুলোও যেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিচ্ছে। তারা যেন বোবা কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বলছে— “ভাই, আমরা তো তোর ব্যথা কমানোর আসল দাওয়াই নই। তুইও তো জানিস, তোর আসল দাওয়াই কে তার কাছেই যা। তারপরও আগে যতটুকু পারতাম, এখন আর তাও পারি না। কেন নিয়েছিলি সেই রক্তিম ঠোঁটের স্বাদ? এবার বুঝলি তো—অতি লোভে তাতি নষ্ট হয়?”

এই নিস্পৃহ বিদ্রূপে প্রণয়ের ভেতরটা জ্বলে উঠল। বিরক্তিতে, রাগে, অসহ্য এক হতাশায় মস্তিষ্ক জুড়ে রক্তচাপ বাড়তে লাগল। সে হাতের প্যাকেটটা তুলে জোরে ছুঁড়ে মারল নদীর মধ্যভাগে।
“বিদ্রূপ করে বলল, তুইও পারলি না! তুইও আমায় একটু শান্তি দিতে পারলি না! কেমন বন্ধু তুই? যে বন্ধু যন্ত্রণার ভার নিতে পারিস না, সব বিশ্বাসঘাতক, বেইমানের দল! তোকে ও আমার প্রয়োজন নেই!”—কাঁপা কণ্ঠে গর্জে উঠল সে।

তারপর নদীর দিকে মুখ করে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল— “জান, আয় না আমার বুকে! তুই ছাড়া আমায় আর কেউ ভালোবাসে না, কেউ একটুখানি স্বস্তি দিতে পারে না আয় না প্লিজ!!”
তার সেই আর্ত চিৎকার, সেই বুকচেরা কান্না, গুমরে ওঠা আর্তনাদে অন্ধকারের ঘনত্ব আরো ভারী হলো। নির্জন রাতের বাতাসে মিলিয়ে গেল এক সর্বহারা প্রেমিকের করুণ কণ্ঠস্বর। হয়তো কোথাও, গাছের মাথায় বসে থাকা দু-একটা নিশাচর পাখি শুনতে পেল।
প্রণয় কাঁদতে চাইল—একটু হালকা হতে চাইল। কিন্তু চোখের জল ও আজ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তাদের ও যেন স্পষ্ট দাবি—যতক্ষণ না জান মুখ বুকে এসে মুখ গুঁজবে, ততক্ষণ তারা ও আসবে না। কষ্টের মধ্যে কান্নাটাও আজ বিলাসিতা।
আর প্রিয় সেই মুখ… বুকে জড়িয়ে ধরা তো দূর, হয়তো কিছুদিন পর তার দিকে ওই নজরে তাকানোও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে প্রণয়ের জন্য।

এক মুহূর্তও আর সেথায় দাঁড়াল না প্রণয়। পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল।
মিনিট পাঁচেক হাঁটা রাস্তা পার করে প্রণয় এসে দাঁড়াল এক ঝলমলে চারতলা বিল্ডিং-এর সামনে। অন্ধকার জগতের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা এই উজ্জ্বল বিল্ডিং যেন বাস্তব নয়—স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের মাঝখানে কোনও এক অচেনা সীমান্ত।
বিল্ডিং-এর উপরের সাইনবোর্ডে ঝকমক করছে সোনালি অক্ষরে লেখা— “The Midnight”
প্রণয় একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। নিশ্চুপ, গম্ভীর পায়ে সোজা এগিয়ে গেল মেইন এন্ট্রান্সের দিকে।
প্রণয় কাচের স্লাইডিং ডোরটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই বারের লাল নীল আলো এসে একত্রে প্রণয়ের চোখে লাগলো।

বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেললো প্রণয়।
এটা মূলত একটা লাক্সারিয়াস বার, আর এটা মালিক প্রণয় নিজেই। এটা তার বারের বিজনেস নয়।
এটা সে দিয়েছে কেবলমাত্র তার বিজনেস পার্টনার, স্টাফ, গার্ড, ক্লায়েন্ট, শুভাকাঙ্ক্ষীসহ অন্যদের আমোদ-ফুর্তির জন্য।
এখানে শুধু মদ নয়, বরং সব ধরনের সুবিধাই রেখেছে প্রণয়। যে যেমন সার্ভিস চায়, তাকে সেরকম সার্ভিসই দেওয়া হয়।

সহকর্মীদের স্যাটিসফ্যাকশনে কোনো ত্রুটি রাখে না প্রণয়। তাই তো বস একটু তার কাটা হলেও স্টাফদের কাছে সে অনেক পছন্দের।
লাউডস্পিকারে মিউজিকের শব্দে চরম মাত্রায় বিরক্ত হলো প্রণয়।
বারের ভিতর অনেকে ড্রিংক করছিলো, আবার অনেকে অশালীন কাজেও লিপ্ত ছিলো। সেসব দৃশ্য দৃষ্টিতে লাগতেই ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিল প্রণয়।
তবে প্রণয়কে দেখতে সকলে নিজেদের অবস্থা ঠিক করে নিল। এই সময় তাদের বসকে তারা এখানে মোটেও আশা করেনি।

তার সেকেন্ড পেরনোর আগেই মিউজিকের জুড়ালো শব্দও বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রণয়কে দেখে একপ্রকার ঝড়ের বেগে ছুটে এলো জাভেদ। স্যারকে এই সময় এখানে দেখে তার চোখ দুটো কতবেলের মতো বড় বড় হয়ে ঝুলে আছে। সে মুখ হা করে তাকিয়েছে স্যারের দিকে।
কারণ স্যার এখানে কখনোই আসেন না।
জাভেদের বিস্ময়কে দুই পয়সার ও পাত্তা দিল না প্রণয়। নিজের মতো এগিয়ে গেলো বার কাউন্টারের দিকে।
শুধু জাভেদ নয়, উপস্থিত সকলে-ই তাদের বসকে এখানে দেখে চোখ বড় করে ফেলেছে।
কারণ, তাদের বস খারাপ হতে পারে, কিন্তু চরিত্রহীন কখনোই নয়। পাপিষ্ঠ হলেও নিঃসন্দেহে এক শুদ্ধতম পুরুষ।
প্রণয়কে দেখতেই উপস্থিত মেয়েগুলোর চোখ চকচক করে উঠলো। জিভ দিয়ে লালা ঝরতে লাগলো।

লোলুপ নজরে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে। কারণ এখানে উপস্থিত সকল পুরুষের চেয়ে প্রণয় অধিক আকর্ষণীয়, সুদর্শন, আর তার বাহ্যিক গঠনও দুর্দান্ত—যেকোনো নারীকে মুহূর্তেই বশ করে নিতে সক্ষম।
কোন মেয়ে মানুষ যে কতটা নির্লজ্জ হতে পারে, তা এদেরকে না দেখে কেউ বুঝতেই পারতো না।
তবে এদের এভাবেই ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, যাতে ওরা এখানে আসে প্রত্যেককেই ফুললি স্যাটিসফাইড করতে পারে। তবে ওরা প্রণয়কে চেনে না। কারণ, প্রণয় কখনোই এখানে আসে না। তাই ভাবল, প্রণয়ও বোধহয় একই উদ্দেশ্যে এসেছে।

ওদের মধ্যে একটা মেয়ে তো প্রণয়কে পাওয়ার ইচ্ছা দমাতে না পেরে বলেই ফেললো—
“Who is he? He’s so damn handsome. Oh my God, I want him for one night!”
মেয়েটার কথা কানে যেতেই উপস্থিত সকলের-ই বিস্ময়ে চোখ গুলগুল হয়ে গেল। ভয়, গা কাঁটা দিয়ে উঠলো।
হাঁটুতে কাঁপন ধরে গেল জাভেদের।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালো, তবে তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো মেয়েটা।
প্রণয় নির্বিকার ভঙ্গিতে বার কাউন্টারে গিয়ে বসল। বারটেন্ডার রীতিমতো কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিয়েছে।
মেয়েটা বিকিনির উপর পরা পাতলা জ্যাকেটটা খুলে প্রণয়ের দিকে এগোতে লাগলো।
মেয়েটার কান্ড দেখে জাভেদ ভয়ে শুকনো ঢোঁক গিললো। আর বেশি দূর ভাবার আগেই একটা বিকট শব্দের সাথে চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো পিন পতন নীরবতা।

ভয়ে এক লাফ দিলো জাভেদ।
ভয়ভয় সামনে তাকাতেই দেখলো, মেয়েটার নিথর দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। তার কপাল বেয়ে রক্তের ধারা নামছে।
জাভেদের দুর্বল হৃদপিণ্ড চলকে উঠল এত রক্ত দেখে। আরও ভয় পেয়ে গেলো বেচারা। কাঁপা কাঁপা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় একেবারেই নির্বিকার, সে একের পর এক গ্লাস খালি করে চলেছে, যেন এখানে কিছু হয়ইনি।
উপস্থিত সকলে ও স্বাভাবিক, কারণ তারা জানতো, এমনটাই হবে।
তখন মেয়েটা প্রণয়ের থেকে কয়েক হাত দূরে থাকতেই, প্রণয় খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পিছনে না তাকিয়েই মেয়েটার কপাল বরাবর শুট করে দেয়।

তার পর—আর আল্লাহর নাম নেওয়ার সময় পায়নি মেয়েটা।
কয়েকজন গার্ড এসে মেয়েটার লাশটা সরিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিলো।
বাকি মেয়েগুলো একে অপরকে ধরে থরথর করে কাঁপছে, তারা ভাবতেও পারেনি, সৌন্দর্যের পেছনে এত ভয়ঙ্কর কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে।
খুন করেছে অথচ একদম ঠান্ডা মাথায়!
প্রণয় একদম স্বাভাবিক। সে আরাম করে বসে এক পেগ হুইস্কি গলায় ঢেলে দিলো।
মদটা গলায় পড়তেই প্রণয়ের মনে হলো, গলা থেকে শুরু করে পাকস্থলী পর্যন্ত যেদিক যেদিক দিয়ে যাচ্ছে, সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে—আর এটাই তো সে চায়।
প্রণয়কে গলায় ড্রিংক ঢালতে দেখে উপস্থিত জনতা আরও বেশি বিস্মিত হয়ে গেল। তারা যেন নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না—তাদের বস, ড্রিংক করছে?

জাভেদ পরিস্থিতি সামলাতে, উপস্থিত মেয়েগুলোকে চোখের ইশারায় যেতে বলল। মেয়েগুলো ভয়ভয় সকল পুরুষদেরকে নিয়ে, তাদের জন্য বরাদ্ধকৃত কক্ষে চলে গেল।
বর্তমানে জায়গাটা পুরো ফাঁকা—এক জন বারটেন্ডার, প্রণয় আর জাভেদ—ব্যতীত অন্য কেউ নেই।
প্রণয় বেসামাল ভাবে একের পর এক ওয়াইনের গ্লাস খালি করে যাচ্ছে, নেশা চড়ছে তার ধীরে ধীরে প্রণয়ের এমন টলমলে অবস্থা দেখে জাভেদের ভয়ে রীতিমতো কলিজা ধরফর করছে।
সে খুব ভালো করেই জানে—নিশ্চয়ই ওই আপুকে নিয়েই আবার কিছু একটা হয়েছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় নিজে নিজেই বিড়বিড় করে উঠলো—

“আল্লাহ জানে, আজ আমার কপালে কী আছে… আজ তো নিশ্চিত আমায় দাদি-নানির নামও ভুলিয়ে দেবে।
আল্লাহ কার মুখ দেখে যেন ঘুম থেকে উঠেছিলাম!”
সময় যত গড়াতে থাকলো, প্রণয়ের হুঁশ ততই ফুরিয়ে যেতে থাকলো।
সে যেন এক নিঃশ্বাসে গ্লাস গ্লাস ওয়াইন শেষ করে দিচ্ছে। ড্রিঙ্ক সার্ভ করতে করতে বারটেন্ডার ছেলেটাও একরকম দিশেহারা।
প্রণয় আরেক গ্লাস ওয়াইন গলায় ঢেলে বিড়বিড় করে উঠলো—
“চল পাখি, তোকে নিয়ে অনেক দূরে হারিয়ে যাই… যেখানে আমাদের কেউ খুঁজে পাবে না। শুধু তুই আর আমি থাকবো। আমাদের কেউ চিনবে না… আমি অনেক ভালোবাসবো তোকে, অনেক আদর করবো… যাবি আমার সাথে? বল না, যাবি আমার সাথে…”

এখন তার চোখে হুঁশ নেই। সে যেন বাস্তব ভুলে প্রিয়তাকে হ্যালুসিনেট করছে।
এ দৃশ্য আর সহ্য করতে পারলো না জাভেদ। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো, তবুও সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল প্রণয়ের দিকে। তুতলানো কণ্ঠে ডাকলো—
“স্যার…”
প্রণয় ধীরে ধীরে তার নেশা জড়ানো লালচে চোখে তাকালো জাভেদের দিকে। চোখে যেন আগুন ঝরছে।
জাভেদ গলায় কাঁপুনি নিয়ে বললো—
“স্যার… প্লিজ, আর খাবেন না। অ্যালকোহল তো আপনার সহ্য হয় না…”

জাভেদের কথা প্রণয়ের ওপর আদৌ কোনো প্রভাব ফেললো কিনা বোঝা গেল না। সে গ্লাস ছেড়ে এবার পুরো ওয়াইনের বোতলটা তুলে মুখে ঠেসে ধরলো।
ঢোক ঢোক করে গলায় ঢালতে লাগলো পুরো বোতলের শ্যাম্পেন।
আরও আতঙ্কিত হয়ে উঠলো জাভেদ।
প্রণয়ের টলমলে অবস্থা বুঝাই যাচ্ছে, অ্যালকোহল ভালোভাবেই রক্তে মিশেছে।
এবার আর দেরি না করে, জাভেদ একটু সাহস করে প্রণয়ের হাত ধরে শ্যাম্পেনের বোতলটা আটকে ধরলো। গলা নামিয়ে নিচু কন্ঠে বললো—
“আর নয় স্যার… প্লিজ…”
কিন্তু ততক্ষণে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে প্রণয়ের ভিতরে।

সে গর্জে উঠলো, জাভেদের হাত থেকে বোতলটা ছিনিয়ে নিয়ে পুরো শক্তিতে মার্বেল বসানো মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো।
সেকেন্ডের মধ্যেই কাঁচের বোতলটা শত শত টুকরোয় চূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো মেঝে জুড়ে।
ভয়ে পিছিয়ে গেলো জাভেদ, সঙ্গে বারটেন্ডার ছেলেটাও কেঁপে উঠলো।
জাভেদের ভয় বাড়িয়ে দিতে প্রণয় এবার আরেকটা আশ্চর্যজনক কাণ্ড করে বসলো।
আচমকাই জাভেদকে জড়িয়ে ধরলো প্রণয়।
হঠাৎ স্যারের এমন অদ্ভুত আচরণে হতভম্ভ হয়ে গেল জাভেদ। তাকে জড়িয়ে ধরে করুণ কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো প্রণয়।

এবার যেন বিস্ময়ের অন্ত রইলো না জাভেদের। এও কি সম্ভব? এদের মতো জঘন্যতম, নিকৃষ্ট, হৃদয়হীন মানুষরা ও বুঝি কাঁদতে পারে? জানা ছিলো না জাভেদের।
প্রণয় জাভেদকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে ব্যাকুল কন্ঠে বললো—
“আমাকে ওর মতো করে একটু শান্তি খুঁজে দিতে পারবে, জাভেদ?
আমাকে ওর কথা ভুলে থাকার একটা উপায় বলতে পারবে?
অথবা কোন ঔষধ এনে দিতে পারবে, যা খেলে আমার আর ওর কথা মনে পড়বে না?
বলো না, জাভেদ, কে আছে? কার কাছে গেলে আমার ওর কথা মনে পড়বে না?
ওকে দেখতে ইচ্ছে হবে না?
কাকে বুকে নিলে ওরকম শান্তি পাবো?

কে আমাকে ওর শূন্যতা ভুলিয়ে দিতে পারবে? বলো না!
কীভাবে ওকে ছেড়ে বাঁচবো? একটু বলো না!
তুমি তো আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, আমার সকল অর্ডার মানা তোমার ডিউটি।
আমি তোমাকে অর্ডার করছি, প্লিজ বল—
কোথায় গেলে আমি একটু শান্তি পাবো?”
জাভেদের সমস্ত ভয়ডর উড়ে গেল, একদম নিস্তব্ধ হয়ে রইল সে। অবাক স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের আহত মুখের দিকে।

স্যারকে এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে বা বিলাপ করতে আগে কখনো দেখেনি জাভেদ। এমনকি এটা তাদের কোন স্টাফেরও দুঃস্বপ্ন হতে পারে না।
কাঁধে তো তারা, যাদের মন থাকে? এইসব পাপিষ্ঠ লোকের মন বলে আবার কিছু হয় নাকি হাস্যকর?
অথচ, কতটা নিষ্পাপ একটা মুখ তার—দেখলেই মনে একধরনের শান্তি নেমে আসে। কে বলবে, মানুষটার এই প্রাণ জুড়ানো চেহারার নিচে একটা কুৎসিত চেহারার মানুষ লুকিয়ে আছে?
কে বলবে, এ একজন আন্তর্জাতিক মাপের ক্রিমিনাল?
তার নামে শত শত কেস ফাইল হয়ে পড়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
কেউ দেখলেও কখনো বুঝতে পারবে না, এই মানুষটা দেশের ও দশের কত বড় শত্রু—
একজন ঠাণ্ডা মাথার সন্ত্রাসী কতটা নৃশংস।

গত দুই বছরে সে কত শত মানুষের গণহত্যা চালিয়েছে, তার নির্ভুল হিসেব হয়তো সে নিজেও জানে না।
খুন করা, রক্ত নিয়ে খেলা করা তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জঙ্গলের হিংস্র পশুর মতো, এদেরও রক্তের নেশা আছে।
একবার চড়লে হুশ থাকেনা এদের, কারও না কারও প্রাণ তখন তারা ঠিকই নেয়।
এরা শিকারি প্রজাতির মানুষ।
এটা হয়তো প্রণয়ের রক্তের দোষ।
সে না চাইতেও পশুত্ব, নিকৃষ্টতা, নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা তার রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে।
সে শিকদারদের বংশধর।
এসব না থাকলেই বরং আশ্চর্য লাগতো।
লোকে বলে না, মানুষের রক্ত কথা বলে?
প্রণয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে।

এই মানুষটা কত শত মেয়েকে—জোর করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে।
অপহরণ করিয়েছে, ধর্ষণের শিকার করিয়েছে।
সংখ্যাটা এত বিশাল, যে জাভেদ নিজেই হয়তো গুলিয়ে ফেলবে।
এই বাড়িতেই—এই চৌহদ্দিতে, কত অসহায় নারীর ইজ্জত কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তারও কোনো হিসেব নেই।
প্রতিদিন কত কত নিষ্পাপ শিশু অপহরণ হয়, কতশত মায়ের বুক খালি হয়।
প্রতিদিন কতো কতো নিরীহ মানুষ খুন হয়—তাদের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে নেওয়া হয়।
আর কত দেশের—শত শত কোটি ডলারের কালো টাকার কারসাজি হয়, তার কোনো ঠিকঠিক আন্দাজও কারও নেই।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বড় বড় ৪০টা দেশের পুলিশ তাকে পাগলা কুত্তার মতো খুঁজছে।
এতো নিষ্ঠুর মানুষের মনে ও নরম জায়গা আছে তাহলে?
যেখানে ঘা লেগেছে, বলে সে কাঁদছে?

সত্যি বলতে, এত নিকৃষ্ট হওয়ার পরও জাভেদ নিজের বসকে ঘৃণা করতে পারে না।
কেন জানে না। কারণ, হয়তো যখন সবাই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তখন প্রণয় তাকে আশ্রয় দিয়েছে, চাকরি দিয়েছে, নিজের ছোট ভাইয়ের মতন ট্রিট করেছে—তাই হয়তো সে কৃতজ্ঞ চাইলেও ঘৃণা আসে না।
তবে, তাদের টিমের অনেকেই প্রণয়কে অত্যন্ত ঘৃণা করে—
শুধু প্রাণের মায়ায় চুপ থাকে।
আর ঘৃণা করবে নাইবা কেন?

এমন মানুষকে দেখলে নরমের কিটও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে।
প্রণয়ের মধ্যে তুখর ভালোবাসা ব্যতীত আর কোন মনুষত্বই বেচে নেই বর্তমানে।
প্রণয়ের কথায় আবার ধ্যান ভাঙলো জাভেদের।
প্রণয় আবারো আহতো কন্ঠে বললো—
“আমি ওকে একটু ও ভুলতে পারবো না, জাভেদ।
ওকে এক সেকেন্ড না দেখলে নিশ্বাস নিতে পারি না।
ওর মায়াবী মুখটা না দেখলে আমার দিন শুরু হয় না।
রাতে ঘুম আসে না।
সে প্রবাহিত হচ্ছে—এই আবরার শিকদার প্রণয়ের শিরায় শিরায়, রক্তের ফোটায় ফোটায়।
আমি ওকে কীভাবে অন্যের হতে দেখবো?
আমি ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসি, জাভেদ।

আমি মুখে যতই বলি আমি ওকে ছেড়ে দেব, নিজেকে থেকে আলাদা করে দেব,
আমার এই নষ্ট জীবনে ওকে জড়াবো না—
কিন্তু বাস্তবে এই কাজের কথা ভাবলেই আমার কলিজাটা জ্বলে যায়, জাভেদ।
আমি পারি না।
আমার ভালোবাসাকে ব্যথিত নিশ্বাস নিতে বড্ড ভালোবাসি।
আমার জান পাখিটাকে।
ওই তো—আমার নিঃস্ব জীবনের একমাত্র বেঁচে থাকার কারণ।
ও ছাড়া এই পৃথিবীতে আমাকে আর ভালোবাসার কেউ নেই, জাভেদ—
কেউ নেই।

ও যদি আমাকে ভুলে যায়, আমি কি করবো, জাভেদ?
এতো যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু কি আমার কপালে লেখা আছে?”
বলতে বলতে বার কাউন্টার এ মাথা হেলিয়ে দিলো প্রণয়।
প্রণয়ের কথায় জাভেদ একদম স্তব্ধ, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে স্যারের মুখের দিকে।
স্যার কার কথা বলেছে, সেটা জাভেদ ভালোই বুঝতে পেরেছে।
আর স্যার যে ওই আপুর জন্য কী পরিমাণ উন্মাদ, সেটা আর কেউ না জানুক, জাভেদ ঠিকই জানে।
তবু ও এতোটাও কল্পনা করেনি জাভেদ—
এতো ভালো কেউ কাউকে কিভাবে বাসতে পারে!

আল্লাহ বোধহয় নিষ্ঠুর ব্যক্তিদের সাথে তাদের মতোই চরম নিষ্ঠুরতা করেন।
তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তাদের সবথেকে দুর্বল জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে আঘাত করেন।
এদের শাস্তি দেওয়ার জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক রাস্তাটাই হয়তো বেছে নেন।
যেমন শাস্তি পাচ্ছে আবরার শিকদার প্রণয়।
তবে সত্যি কি প্রণয়ের জীবনটা এমন হওয়ার কথা ছিলো?
সত্যি কি তার এগুলো প্রাপ্য ছিলো?
সুখ—এমন একটা অচিন পাখি,
যে সবার কাছে ধরা দেয় না।
আর প্রণয় সেই পাখিটাকে হাজার চেষ্টার পরও ধরতে পারে নি, নিজের বুকের পিঞ্জিরায় বন্দি করে রাখতে পারেনি।
প্রণয়ের পাগলামো বাড়ছে,
জাভেদ আর প্রণয়কে কন্ট্রোল করতে না পেরে বাধ্য হয়ে কল লাগালো তার আরেক স্যারের নম্বরে।
দুই বার রিং হতেই কল রিসিভ হয়ে গেলো।

শুদ্ধ ফোনটা কানে ধরে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ঝাজিয়ে বললো —
“তুই কে রে ভাই, কী সমস্যা তোর? এত রাতে ফোন দিয়ে আমার এত সুন্দর সুখের স্বপ্নটার বারোটা বাজিয়ে দিলি?”
শুদ্ধর তুই-তকারি শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো জাভেদ।
সে নম্র কণ্ঠে বললো —
“স্যার, আমি জাভেদ।”
‘জাভেদ’ নামটা শুনতেই জাগ্রত হলো শুদ্ধ, ঘুম তার একপ্রকার পালিয়েই গেলো।
ফোনটা চোখের সামনে এনে নাম্বারটা দেখলো।

‘জাভেদ’ নামটা দেখে ভুরু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো—
“কী ব্যাপার? এত রাতে ফোন করেছো কেনো? কী সমস্যা?”
জাভেদ একটু ইতস্তত করলো, ঢোক গিলে আরেকবার প্রণয়ের অবস্থা দেখে শুদ্ধকে বললো —
“প্লিজ স্যার, একবার The Midnight Bar-এ আসুন।”
‘Midnight Bar’ নামটা শুনতেই ঘৃণায় নাক-মুখ কুঁচকে ফেললো শুদ্ধ, মুখ তেতো হলো তার।
উচ্চস্বরে ধমকে বললো —
“What?! Midnight Bar?
তোমার মাথা ঠিক আছে জাভেদ? তুমি কি রাতবিরিতে আমার সাথে ফাজলামো করছো?
আমি এত রাতে ওই নোংরা জায়গায় যাবো?
তুমি ভালো মতই জানো, ওইসব পতিতালয় এলাকায় ডক্টর আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ পা রাখে না!”
জাভেদ একটু অনুরোধ করে বললো —
“Please, আসুন স্যার। ASR-এর অবস্থা ভালো না।”
প্রণয়ের নামটা কানে আসতেই বিস্মিত হলো শুদ্ধ, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো শুয়া থেকে।
চিৎকার দিয়ে বললো —

“What?! প্রণয় ওখানে কেন যাবে?”
জাভেদ ঢোক গিলে পুরো ব্যাপারটা এক্সপ্লেইন করলো।
সাথে সাথেই শুদ্ধের চেহারার এক্সপ্রেশন পালটে গেলো।
সে দ্রুতো বিছানা থেকে লাফিয়ে নামতে নামতে বললো —
“Wait, wait, আমি এখনই আসছি।
আমি না আসা পর্যন্ত ওকে দেখে রাখো।”
বলে ফোন কেটে, ওভাবেই গায়ের কোঁচকানো ট্রাউজার, টি-শার্ট নিয়ে বাসা থেকে ছোটে বেরিয়ে গেলো শুদ্ধ।
তখনো ড্রইং রুমে প্রিয়তা, পরিণীতা, প্রেরণা, অরণ্য, সমুদ্র আড্ডা দিচ্ছিলো।
তন্ময় আর থীরা পাশের সোফায় ঘুমাচ্ছিলো।
শুদ্ধকে এভাবে এত রাতে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে অবাক হয়ে গেলো ভাই-বোনরা।
অরণ্য ভুরু বাঁকিয়ে প্রেরণাকে বললো —

“কেসটা কী বলতো?”
প্রেরণা স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো —
“নিশ্চয়ই কোনো পেশেন্ট এমারজেন্সি এসে গেছে।”
ওরাও তাই ধরে নিয়ে আবারো গল্প-আড্ডায় মনোনিবেশ করল।
হাই স্পিডে ড্রাইভ করে ২ ঘণ্টার রাস্তা ৪০ মিনিটে পাড়ি দিলো শুদ্ধ।
গাড়ি থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে বার-এর ভিতর প্রবেশ করলো।
প্রণয়ের নেশা একদম তুঙ্গে।
মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না, আর যা বেরোচ্ছে সব জড়িয়ে যাচ্ছে।
তবু সে একের পর এক ওয়াইনের গ্লাস গলায় ঢালছে।
জড়োসড়ো হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে জাভেদ।
শুদ্ধ দিগ্বিধিক ভুলে দৌড়ে এলো প্রণয়ের কাছে।
প্রিয় বন্ধুর এমন অবস্থা দৃষ্টিতে আটকাতেই মনটা ভীষণ ব্যথায় জর্জরিত হলো।
শুদ্ধকে দেখে ছুটে এলো জাভেদ।

করুণ মুখে, কণ্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে বললো —
“Please স্যার, উনাকে নিয়ে যান।”
শুদ্ধ শুধু একবার তাকালো জাভেদের দিকে।
অতঃপর জাভেদকে ছেড়ে এগিয়ে গেলো প্রণয়ের কাছে।
প্রিয় বন্ধুর মনের দহন-জ্বলন অনুভব করে শুদ্ধকে ও কেমন অসহায়ত্ব এসে গ্রাস করছে।
সে এক পলক প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে, প্রণয়ের পাশে টুলে বসে পড়লো।
প্রণয়ের কাঁধে হাত রেখে ডাকলো —

“ভাই…”
প্রণয় রক্তিম চোখে তাকালো শুদ্ধর দিকে।
শুদ্ধকে এখানে দেখে প্রণয়ের মেজাজে যেন হুট করে আগুন ধরে গেল।
জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বললো —
“তুই এখানে কী করিস?
জনিস না, এটা পতিতালয়ের থেকে কম কিছু নয়?
তোকে না আমি সাফ সাফ জানিয়ে ছিলাম —
তুই স্মোকিং, ড্রিঙ্কিং করবি না।
কোনো নারীর আশেপাশে থাকবি না।

আমার রক্তজবা কে পাওয়ার জন্য তোকে শুদ্ধতম পুরুষ হতে হবে।
কোনো চরিত্রহীন কারো হাতে আমি আমার জান দেবো না!”
প্রণয়ের কথায় শুদ্ধ ও কোনো প্রত্তুত্তর করলো না।
তারও ভেতরটা জ্বলছে — অসহায়ত্বের শিকলে হাত-পা শক্তপোক্ত ভাবে বাঁধা।
শুধু প্রণয়ের হাতের হুইস্কির গ্লাসটা নিয়ে নিজের গলায় ঢেলে দিলো।
শুদ্ধর এহেন কাণ্ডে আরেক দফা হতবম্ব হয়ে গেলো জাভেদ।
সে কী!এক পাগলকে সামলাতে আরেক পাগলকে ডেকে বিপদে পড়লো?
এখন তো একটু পরে এদের দুজনকেই তাকে সামলাতে হবে।
আল্লাহ শত্রুকে ও এমন বস না দিক!
শুদ্ধ এক নিঃশ্বাসে বেশ কয়েকটা গ্লাস খালি করে থামলো, প্রণয়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো —
“খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, তাই না ভাই?”
বুকের বাম পাশে টোকা দিয়ে বললো —

“এখানে ব্যথা হচ্ছে।”
প্রণয় ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো শুদ্ধের দিকে, উপহাস মিশ্রিত কন্ঠে বললো —
“মজা দেখতে এসেছিস?”
প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো শুদ্ধ।
ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বললো —
“মজা দেখার হলে আরো কতভাবে দেখতে পারতাম।”
প্রণয় জবাব দিলো না। আগের মতোই গ্লাসে মন দিলো।
শুদ্ধ কিছুক্ষণ দম নিয়ে বললো —

“এখন তোর যতটা যন্ত্রণা হচ্ছে, বিশ্বাস কর, আমারও ঠিক ততটাই যন্ত্রণা হতো।
এখন তুই যে যন্ত্রণায় জলে পুড়ে মরছিস, সহ্য করতে পারছিস না, মৃত্যুর দিন গুনছিস —
সেই একই যন্ত্রণার আগুনে জলে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছি আমি।
একটা দুটো বছর নয়, ১২ বছর, ১২ বছর এই যন্ত্রণা আমায় কুড়ে কুড়ে খেয়েছে।
তবু ও মুখ বন্ধ করে দাঁতের দাঁত চেপে সবটা হজম করে নিয়েছিলাম, বাংলাদেশে পা রাখিনি।
তুই তো তাও দেখতে পাস, স্পর্শ ও করতে পারিস, অনুভবও করতে পারিস —
কিন্তু আমি?

আমি ছোঁয়া তো দূর, এই ১২ বছরে নয়নভরে একটাবার দেখতে পর্যন্ত পারিনি।
সে যন্ত্রণা বাড়তে বাড়তে আমাকে শেষ করে দিয়েছে, তবুও দূরে থেকেছি, যাইনি।
আমার ভালোবাসার ভাগ বুঝে নিতে, নিজেকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম।
খুব যন্ত্রণা হত?
বিশ্বাস কর, ভীষণ যন্ত্রণা হত।
একটা রাতও ঘুমাতে পারতাম না, প্রতিটা রাতে একা ছটফট করতাম।
তবু ও তোদের কারো সাথে কোনো সম্পর্ক রাখিনি।
কারণ কি জানিস?”
প্রণয় নিষ্পলক চোখে তাকালো।
শুদ্ধ সেই দৃষ্টি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো —

“কারণ, তুই আমার সুইটহার্টকে ভালোবাসতিস, ভীষণ আদরে যত্নে রেখেছিলি।
তুই ছিলি তার কাছে সব থেকে নিরাপদ আশ্রয়।
আমার সুইটহার্ট ও তোকে ভীষণ পছন্দ করত, তোর কাছে থাকতে চাইত সবসময়।
আমাকে চিনতই না, আমি ছিলাম একজন আউটসাইডার।
তবে আমি কেন আমার একতরফা ভালোবাসা দাবি জানাবো?
কেন আমার প্রিয় দুজন মানুষের জীবন নষ্ট করতে আসবো?
আমার কাছে ভালবাসাকে ছুঁয়ে দেওয়াটা জরুরি ছিলো না।
তাকে আমি দূর থেকেই ভালোবেসে যেতাম, আজীবন, নীরবে নিঃশব্দে।”
প্রণয় নিরব চোখে তখনও তাকিয়ে রইল।
শুদ্ধ এক সেকেন্ড দম নিয়ে আরো কয়েক গ্লাস গলায় ঢেলে বললো —
“তাহলে ভাবছিস, কেন আবার ফিরে এলাম?”

প্রণয় ওয়াইনটা খেতেই নিচ্ছিল, কিন্তু শুদ্ধর কথায় হাত থেমে গেল।
গ্লাস নামিয়ে রেখে ভুরু কুঁচকে তাকালো শুদ্ধর দিকে।
শুদ্ধ কয়েক সেকেন্ড প্রণয়ের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো —
“তোর কি মনে হয় আমি তোকে থেকে ওকে ছিনিয়ে নিতে এসেছি?”
প্রণয়ের উৎসাহ নিভে গেল। কারণ সেসব জানে, তাই আর কোনো উৎসাহ পেল না।
তবে শুদ্ধ থামলো না। মাথা দুলিয়ে বললো —
“হ্যাঁ, আমি এটা মানি, আমি ওর বেলায় বড়ো স্বার্থপর।
ওর ওই চাঁদের মতো মুখটা দেখলে আমার সব গুলিয়ে যায়।
নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না।

এর মানে এই না যে, আমি শুধু ভালোবাসি বলে তোকে থেকে ওকে ছিনিয়ে নেব,
আমার একতরফা ভালোবাসা চাপিয়ে দেবো তোদের দুজনের উপর।
আর এটা তো তুইও কোনোদিনও মেনে নিতি না।
তাই নিজের ভালোবাসায় নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না, থাকতে পারি না ওকে ছাড়া —
এইসব কারণে আমি তোর থেকে তোর ভালোবাসা নিচ্ছি না।
আমি তোকে থেকে ওকে সরিয়ে দিচ্ছি কারণ, তুই আর ওর জন্য নিরাপদ নেই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, তুই ওর জন্য যতটা ভরসাযোগ্য,
তার থেকেও ও হাজার গুণ বেশি বিপদজনক, প্রাণঘাতী।
তোর সাথে যদি আমি ওকে থাকতে দিই, তাহলে আজ না হয় কাল প্রহেলিকা ওকে মেরেই ছাড়বে।
ওর যে পরিমাণ হিংসে আমার সুইটহার্টের উপর —

ও নিজের লাইফের সমস্ত অপূর্ণতার জন্য আমার সুইটহার্টকে দায়ী করে।
এর মাঝে ও এতটাই বিপদজনক যে, তোর সাথে দেখে ওকে কিডন্যাপ পর্যন্ত করিয়েছিল।
টেররিস্ট দিয়ে অপহরণ করাতে চেয়েছিল, শুধুমাত্র তোকে পাওয়ার জন্য।
যেকোনো সীমা অতিক্রম করতে পারে, যে কোন মুহূর্তে সমস্ত তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে।
তখন কি করবি তুই?
She is mentally unstable.

আর প্রিয়তার ভয়ংকর মৃত্যুটা তুই নিজের চোখে দেখতে পারবি না, আটকাতেও পারবি না।
আমি ও দেখতে পারবো না, আমি ও আটকাতে পারবো না। নিঃস্ব হয়ে যাবো আমরা দুজনেই।
তাই তোর থেকে ওকে দূরে করে দেওয়া এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
এখন প্রিয়তার যদি তোর থেকে দূরে থাকে, অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে যায় বা বিয়ে ঠিক হয়ে থাকে,
তাহলে প্রহেলিকা ওকে খুব একটা টার্গেট করবে না।
হ্যাঁ, হয়তো তুই এতে প্রচুর কষ্ট পাবি,

কিন্তু সেই কষ্ট ও কোথাও না কোথাও সয়ে যাবে ভাই।
কিন্তু একবার চিরতরে ওকে হারিয়ে ফেললে,
পৃথিবী উজাড় করে দিয়েও ওকে আর ফিরে পাবো না।
ও মরে যাবে — আর এটা তুই কিছুতেই সহ্য করতে পারবি না।
তাই তুই ওকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে, ভালো রাখতে চাইলে, ওর থেকে দূরে থাক, প্লিজ।
কষ্ট হলেও সহ্য কর, তবু ও দূরে থাক।
একবার ওর বিয়ে হয়ে গেলে, প্রহেলিকা আর এসব নিয়ে ভাববে না, চিন্তামুক্ত হয়ে যাবে।
তখন কোনোভাবে ওই এভিডেন্সগুলো নষ্ট করার চেষ্টা করবো।
কিন্তু ততদিন পর্যন্ত, প্রহেলিকার প্রতিহিংসা থেকে আমার ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
তাই তোকে দূরে থাকতেই হবে।
না হলে আজ না হোক কাল, প্রহেলিকা ওকে মেরেই ফেলবে — আর তুই কিছু করতে পারবি না।
তাই তার থেকে এই ব্যথাটা অনেক বেশি সফট।
সহ্য করে নে, মেনে নে।

তুই নিজেই এখন তোর ভালোবাসার জন্য সবথেকে বেশি বিপদজনক।
পাগলামো করিস না, শান্ত থাক।”
সব যদি আগের মতো থাকতো, তাহলে আমি কখনো তোদের আলাদা হতে দিতাম না —
কিন্তু পরিস্থিতি এখন আর সেরকম নেই।
প্রণয়ও জানে, শুদ্ধর বলা এক একটা কথা ধ্রুব সত্য।
কিন্তু এই সত্যি কথাগুলো সহ্য করতে পারছে না প্রণয়। ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
সে তো জানে, তার পুড়া ভাগ্যে তার প্রিয়তমা নেই।
সে যাই ভালবাসে, তাই পুড়ে যায়, না হলে ধ্বংস হয়ে যায়।
আর এটা তো চরম সত্যি, তার জানের জীবনে ঘটা সকল বিপদের, তার উপর আসা এক একটা আঘাতের একমাত্র কারণ—সে নিজেই।

শুদ্ধ তো ভুল কিছু বলেনি।
সে যদি নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে যে হাত দিয়ে ছোট্ট নিষ্পাপ ফুলটাকে সে বুকে আগলে রেখেছিল সর্বোচ্চ ভালোবাসায়, সেই হাতেই সেই ফুলটাকে তার দাফন করতে হবে।
এর এমন দৃশ্য প্রণয় কোনদিনও সহ্য করতে পারবে না।
কিন্তু এত কিছু কি আর মন বুঝে?
সে তো ওই পাখিকে দেখলেই দুনিয়াদারির সব কথা ভুলে যায়, এলোমেলো হয়ে যায় তার সকল চিন্তা-চেতনা।
প্রণয় চিৎকার দিয়ে এক ঠেলায় সমস্ত ড্রিংকস মাটিতে ফেলে দিল।
বিকট শব্দে চূর্ণ হয়ে গেল মদের বোতলগুলো।

কাঁচ ভাঙার শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠলো জাভেদ।
তবে শুদ্ধ নির্বিকার—ওর ও নেশা চড়ছে ধীরে ধীরে।
জাভেদ ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দুই বসের দিকে।
শুদ্ধ আহত চোখে প্রণয়ের পাগলামিগুলো দেখলো।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো,
“তুই তো সব জানিস, জেনে-শুনে ওরকম পাগলামি করছিস!
একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাব।
শুধু কি তাই?
প্রহেলিকার হিংস্রতার কথা যদি আমি এক পাশে সরিয়েও রাখি, তবুও কি তুই প্রিয়তার সাথে একটা সুন্দর স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারবি বল?

দিতে পারবি প্রিয়তাকে একটা সিকিউর লাইফ?”
শুদ্ধর কথায় ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠলো প্রণয়ের বুক।
সে তীব্র অসহায়ত্ব নিয়ে তাকালো শুদ্ধর দিকে।
শুদ্ধ ম্লান হেসে বললো,
“পারবি, তুই ওকে একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ দিতে, একটা সুন্দর সংসার দিতে?
হ্যাঁ, তুই ওকে ভালোবাসিস প্রচণ্ড রকমের। যতদিন তোর নিঃশ্বাস চলবে, বুকের ভেতর ভরে রাখবি।
কিন্তু তোর এই নিঃশ্বাসের গ্যারান্টি কতটুকু?
তুই আজ এখানে আছিস, কাল সকালের সূর্যোদয় দেখবি কিনা, তারই তো কোন নিশ্চয়তা নেই।
তোর জীবন-মরণ ঝুলে আছে এক চুলের ব্যবধানে।

তুই কি ভুলে গেছিস, বাংলাদেশসহ ওয়ার্ল্ডের বড় বড় ৪০টা দেশের সরকার তোকে পাগলা কুকুরের মতো খুঁজছে?
তোকে ধরার জন্য কোটি কোটি টাকার মিশন লঞ্চ করছে।
তারা কেউ একবার তোকে ধরে সনাক্ত করতে পারলেই, সাথেসাথে এনকাউন্টার করে দেবে।
তখন কি করবি তুই?
৪১টা দেশে তোকে পেলেই এনকাউন্টার করে দেওয়ার অর্ডার কোর্ট থেকে পাস হয়ে আছে।
You are the most wanted criminal.
আজ না হোক, কাল কোনো না কোনো ক্রসফায়ারেই তোর মৃত্যু হবে নিশ্চিত।
I know, তোকে ধরা এত সোজা নয়।
কিন্তু মানুষের ভাগ্য কখন কোন দিক থেকে পিছলে যায়, তুই কি বলতে পারবি?”
তুই এমনভাবে জালে জড়িয়ে গেছিস, যেখানে থেকে মৃত্যুর বেতিত তোর কোনও নিস্তার নেই।
তোর এই অনিশ্চিত জীবনে জড়াবি ভালোবাসা?
প্রণয় একদম স্থির হয়ে গেল।
শুদ্ধ আজ সব থেকে নিষ্ঠুর সত্য তুলে ধরলো তার চোখের সামনে।
কিন্তু এসব তো সে ভালোমতোই জানে—তার নিশ্বাসের কোনও গ্যারান্টি নেই।
আর তাই তো সব দিক বিবেচনা করেই সে নিজের প্রাণটা শুদ্ধর হাতে তুলে দিতে রাজি হয়েছে।
কারণ ওই পাখিটার একটু ও যন্ত্রণা পেলে, মরে ও শান্তি পাবে না প্রণয়।
সে তার জীবনে খুব সাধারণ একটা জীবন বাঁচতে চেয়েছিল, খুব সাধারণ একটা সংসার চেয়েছিল তার রক্তজবার সাথে—

যেখানে সে, তার রক্তজবা, আর তাদের ভালোবাসার চিহ্ন…
কিন্তু ভাগ্য আজ তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে!
তাই তো শত কষ্টেও এখন তার একটাই উদ্দেশ্য—
সে থাকতে থাকতে শুদ্ধর মতো একজন বিশ্বাসযোগ্য মানুষের হাতে, নিজের যত্নে গড়া আদরের পাখিটা তুলে দিতে চায়।
আর তার দৃঢ় বিশ্বাস—শুদ্ধ ও তার মতো করেই তার প্রাণপাখির যত্ন নেবে, ভালোবাসবে।
যা প্রণয় না দেখলে, ও তার আত্মা দেখবে।
কিন্তু জান পাখিটাকে দেখলেই যে তার সব গুলিয়ে যায়—
বুকে ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হয়।
তখনই এই পাখিটাকে অন্য কাউকে দিতে হবে ভাবলেও, বুকটা যন্ত্রণায় মরে যায়।
সে বড্ড স্বার্থপর হয়ে ওঠে তখন—

মন চায়, তার প্রাণ পাখি যেন সুখে থাকলে কেবল তার সাথেই থাকে, হাসলে ও কেবল তার সাথেই হাসে।
সে অন্য কাউকে ভালোবাসবে, অন্য কারো বউ হবে—এসব প্রণয় দুঃস্বপ্ন ভাবতে পারে না।
নিঃশ্বাসটা তখন গলায় ফাঁসের দড়ি মনে হয়।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না—এত হিংসে হয় কেন, যখন মনে পড়ে, অন্য কেউ তার প্রাণ পাখিকে বুকে জড়িয়ে ধরবে?
তখন নিজের হাতে নিজের জানটাকেই মেরে ফেলতে মন চায়।
উফফফফ…
শিকদারদের অবৈধ ব্যবসা প্রণয়ের হাত ধরে আন্তর্জাতিক মাপে পৌঁছেছে।
ওই এক দানা পাপকে প্রণয় এক সমুদ্র পাপে পরিণত করেছে।
সাদমান শিকদার তাকে পাপের রাস্তা ধরালেও, প্রণয় সেই পাপের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
পৃথিবীর বড় বড় দেশে প্রতি মাসে শুধু তার আন্ডারে ১০০-১০০ যুবতী নারী ও শিশু পাচার হয়ে যায়।
অবৈধ অস্ত্র আর মাদকের ব্যবসাও সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে, আর তা ক্রমশই উচ্চহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অর্গান ট্র্যাফিকিং রুটও বাড়ছে।

বিশ্বের বিশাল অংশের টাকা জালিয়াতি হচ্ছে—আর সব কিছুর মাস্টারমাইন্ড “ASK”।
পুরো ৪১টা দেশের সরকার শত চেষ্টা করেও “ASK” কে ধরতে পারছে না—আর না আটকাতে পারছে।
বিশাল অংশের পাচার আজ পর্যন্ত শুধুমাত্র “ASK” কে ধরার জন্য বিভিন্ন দেশ তাদের যৌথ প্রচেষ্টা চালিয়েছে, ব্যয় করেছে কোটি কোটি টাকা—
কিন্তু সে সবই ব্যর্থ হয়েছে।
কারণ প্রণয় শিকদার তাদের চিন্তা ভাবনার অনেক ঊর্ধ্বে চলে—
সে অতিমাত্রায় সাধারণ একটা জীবন যাপন করে, ৫১ ভর্তি বিশাল পরিবারের সাথে।
আর যাই হোক, এত বড় মাপের কোন ক্রিমিনাল এভাবে ওপেনলি ঘুরে বেড়ায় না—
আর এটাই হচ্ছে সরকারের সব থেকে বড় ভুল ধারণা।

আর জাভেদ তো বললোই—ওমন চেহারায় কারোই মনে হবে, সে কোনো অপরাধ করতে পারে।
আর কালো ব্যবসার পাশাপাশি প্রণয়ের সাদা ব্যবসাও আছে, আর তাও চড়চড় করে শীর্ষে উঠছে—
তাই পেছনের অন্ধকার দিকটা কারো দৃষ্টিতে পড়ে না ।এমনকি প্রণয় শিকদার নিজে না চাইলে তাকে খুঁজে বের করা কোন সরকারের বাপের কর্ম নয়।
সাদমান শিকদারও জানেন না প্রণয়ের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে।
তিনিই শুধু জানেন—উনার ছেলে উনার গুটিকয়েক অসৎ বিজনেস সামলাচ্ছে।
কিন্তু সেটা যে আকাশ ছুঁয়েছে অনেক আগেই, সে সম্পর্কে উনার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
শুদ্ধ প্রণয়ের মনের পরিস্থিতি বুঝলো।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো—

“দূরে থাক ভাই, প্লিজ দূরে থাক। আমি জানি ও তোকে অনেক ভালোবাসে।
তুই দূরে থাকলে, আমি চেষ্টা করবো যাতে ওকে সব ভুলিয়ে রাখতে।”
প্রণয় নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে আছে শুদ্ধর দিকে।
শুদ্ধর এত কথার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু বললো—
“মনে আছে, ওর জন্মের পর তোকে কোলে নিতে দিইনি।
সব সময় সবার থেকে দূরে নিজের বুকে ভরে রেখেছিলাম।
আশা ছিল—সাদা কাফনে না জড়ানো পর্যন্ত, এই বুক থেকে তাকে কাউকে ছিনিয়ে নিতে দেব না।
কিন্তু আমার কপালের লিখন দেখ, আল্লাহর মনে—হয়তো অন্য কিছুই ছিল।
তাই তো আজ আমি একেবারে নিঃস্ব, একেবারে সর্বস্বান্ত।
হেরে গেছি আমি, ব্যর্থ হয়েছি সবকিছুতে।

কিন্তু দেখ—সব হারিয়েও তুই হঠাৎ করে সব ফিরে পেলি।
আমার সব আমি এক নিমিষেই হারিয়ে ফেললাম।
কিন্তু এগুলোতে আমার আফসোস হবে না,
যদি আমার রক্তজবাকে তুই সর্বোচ্চ ভালো রাখতে পারিস।
তুই জানিস—ও একদম বাচ্চা, এখনো বাচ্চা।
আর ১০ বছর পরেও, আমি চাই, সে বাচ্চাই থাকুক।
কারণ আমি ওকে ওভাবেই রেখেছিলাম—বাস্তবতা থেকে দূরে, একদম হৃদপিণ্ডের ভিতরে।
সে দুনিয়ার ভয়ংকর রূপ সম্পর্কে জানে না—একদম অবুঝ, অভিমানী।
ওকে ওভাবেই রাখবি সব সময়।
জানবি—ও আমার কাছে, আমার ভালোবাসার আগে, আমার সন্তান।
কারণ ওকে নিজের সন্তান থেকেও বেশি ভালোবেসেছি।
তুই জানিস—প্রথমবার ওকে দেখেই একটা অদ্ভুত মায়া অনুভব করেছিলাম মনে—ভালোবাসা তো অনেক পরে হয়েছে।

তাই কখনও দুঃখ দিবি না।”
শুদ্ধ ম্লান হেসে বললো—
“ভালো, তুই একাই বেসেছিস।
আমি চাই তুই ও নিরাপদে থাক আমাদের সাথে—এইভাবেই বেঁচে থাক সারা জীবন।”
শুদ্ধর কথায় হেসে ফেললো প্রণয়।
হেসে বললো—
“এই জীবন একটা আস্ত অভিশাপ।
তুই যে কোনওদিনও আমার ভালো দেখতে পারিস না, সেটা আবারো প্রমাণিত হলো!
তাই বদদোয়া দিচ্ছিস নাকি? এত বছরের প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিস? কোনটা?”
প্রণয়ের কথায় ভুরু কুঁচকে ফেললো শুদ্ধ।

প্রণয় ওর কৌতূহল দেখে কৌতুক করে বললো—
“তুই কি আমায় বাঁচিয়ে রেখে নিজের সুখের সংসার দেখাতে চাস?
নাকি আমার পাপের বোঝা আরও বাড়াতে চাস?
আমি পৃথিবীতে একদিন বেশি বাঁচা মানে—আরও কত মায়ের বুক খালি হওয়া,
কত নারীর জীবন নষ্ট হওয়া।
আমার একটা দায়িত্ব আছে, শুদ্ধ।
সেটা থেকে যেদিন মুক্তি পাব, সেদিন আমি নিজেই আত্মসমর্পণ করবো—
ক্রস ফায়ারিং এর প্রয়োজন পড়বে না।”
প্রণয়ের কথায় আবারও শুদ্ধ অসহায় চোখে তাকালো প্রিয় বন্ধুর দিকে।
সত্যি, তার জীবনটা একটা মস্ত অভিশাপ।

ঘরে অভিনয়, বাইরে অভিনয়—জীবনে একটা ফোঁটা মানসিক শান্তি নেই।
আর তাও যতটুকু ছিল, সেটা তো শুদ্ধই কেড়ে নেবে—
বিনিময়ে তাকে আরও মৃত্যুতুল্য দিন উপহার দেবে।
সবদিকে শুধু কাঁটা যুক্ত বিষলতা।
দুই বছর আগে সে কত নাটক করে, কাঠ খড় পুড়িয়ে, প্রহেলিকাকে বোকা বানিয়ে ছিল।
মিথ্যে বিয়ের নাটক সাজিয়ে ছিল—
যাতে প্রিয় বন্ধুকে সত্যিই ওই নাগিনী বিয়ে করতে না হয়।
কিন্তু সব ভেবে, পুরনোতায় বুক চিরে দীর্ঘনিশ্বাস বের হলো শুদ্ধর।
সে আবারও প্রণয়ের দিকে চাইল।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫১

প্রণয় একের পর এক বোতল খালি করেই যাচ্ছে।
যতই খারাপ হোক—সে কখনও চায় না, তার বন্ধুর এতটুকু ও ক্ষতি হোক।
বুকের এক পাশে প্রিয়তা থাকলে, ও অন্য পাশে তার ছোটবেলার বন্ধু।
কিন্তু নিয়তি আজ তাদের কোথা থেকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে।
মাত্র একটা ষড়যন্ত্র—তাদের সবার জীবন যেন তাশের ঘরের মতো উলট-পালট করে দিয়েছে।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৩