ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৬
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
তারপর
প্রিয়তা পরিণত দৃষ্টিতে তাকালো অন্যতমার দিকে। মেয়েটার চোখ-মুখ জুড়ে এক রাশ দমচাপা কৌতূহল যেন ঠিকরে পড়ছে। প্রিয়তা ওর অস্থিরতা দেখে হালকা হাসলো। হাতের অ্যাপল ওয়াচে সময় দেখে বললো, “Now is time to iftari,” বলে চলে গেলো খাবার আনতে।
তবে অন্যতনা যেন অন্য কোন ঘোরের মধ্যেই আছে। সে প্রিয়তার বলা নিখুঁত বাস্তব গল্পটার প্রত্যেকটা লাইনের ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। প্রিয়তার বলা গল্পের প্রত্যেকটা দৃশ্যই যেন জীবন্ত সে নিজের চোখের সামনে ভাসতে দেখছিল। কাহিনীটা শুনতে গল্প মনেহলেও, এ যেন কারো জীবনের প্রখর বাস্তবতা। তাই সকাল গড়িয়ে কখন বিকেল আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে, তার বিন্দু মাত্র টের পায়নি সে সেই খেয়ালই ছিল না। কিন্তু এমন টান টান উত্তেজনায় এসে গল্প বলা বন্ধ করে দিতেই অন্যতমা মনে মনে হাঁসফাঁস করে উঠলো। পরবর্তী ২৮ দিনে কী কী ঘটেছিল তা জানার জন্য তার মনটা ভীষণ ব্যাকুল হয়ে পড়ল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সর্বোপরি তার মনে একটাই প্রশ্ন কাটার মতো বিঁধছে – চার বছর আগে কি এমন ঘটেছিল, যার জন্য ওরকম নরম সরম কোমল পদ্মফুলের মতো মেয়েটা আজ ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে গেলো? সত্যি কি এমন আঘাত পেয়েছিল মনে, যার জন্য ওই নরম মনটা আজ পাথুরে, অনুভূতিশূন্য? সত্যি কি সেই পুরুষের মনে ওর জন্য কিছু ছিল না? কিছু না থাকলে কেউ এত ভালোবাসে আগলে রাখে?
কিন্তু আর বেশি দূর ভাবতে পারলো না অন্যতমা। প্রিয়তা দুই হাতে ট্রে ভর্তি খাবার এনে রাখলো টেবিলের ওপর। নিজেও এসে বসে পড়লো অন্যতমার সামনের চেয়ারে। একটা পানির বোতল ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “Quick!”
অন্যতমা ও অন্যসব ভাবনা-চিন্তা আপাতত দূরে সরিয়ে “বিসমিল্লাহ” বলে রোজা খুললো। প্রিয়তার আনা একটা বার্গারে কামড় বসাতে বসাতে বললো, “আচ্ছা প্রিয়, তখন ও রোজার মাস ছিল, তাই না?”
অন্যতমার কথায় হাত থেমে গেলো প্রিয়তা গম্ভীর চোখে তাকালো অন্যতমার দিকে। মেয়েটার বেশ অস্থির, কৌতূহলী, চটপটে আর চঞ্চল, তাই প্রিয়তা ওর দিকে না তাকিয়েই ছোট করে বললো, “হুম।”
অন্যতমা এবার বানানা স্মুথিতে এক সিপ দিয়ে বললো, “তারপর কী হয়েছিল বল প্লিজ? তোর বড় আব্বু কি পরি আর তার মাস্টার মশাই কে মেনে নিয়েছিলেন? আর এত যখন ভালবাসতিস, তাহলে উনারে ছেড়ে বিদেশে আসতে কিভাবে রাজি হলি?
আর তোর সেই পুরুষের সম্পর্কে যতটা শুনেছি, তাতে আমার তার প্রতি জানার ইচ্ছা আরো, আরো বেড়ে গেছে।” অন্যতমার মুখের থেকেও চোখে বেশি প্রশ্ন ও আকাশসম কৌতূহল।
তবে অন্যতমার এত প্রশ্নে ও প্রিয়তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শান্ত, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “বাক্যের ভুল সংশোধন কর অন্যতমা, ‘সে আমার নয়।’ সে আমার জন্য চিরকালই নিষিদ্ধ পুরুষ ছিলো। তখন ছোট ছিলাম বুঝতাম না। অনুভূতির ভার বইতে না পেরে অনেক বেশি লোভ করে ফেলতাম, সীমা ছাড়িয়ে যেতাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, অন্যের জিনিসকে নিজের ভাবার মতো ছোটলোকি আর দুটো নেই। আর সেটা যখন সেই মানুষটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, তখন কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের গোটা দুনিয়াটাই থেমে যায়। নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজের উপরই প্রচণ্ড ঘৃণা হয়, অপমান ও আত্মসম্মান নষ্ট হওয়ার জ্বালায় জ্বলতে থাকে মন। তাই এখন আর আমার অন্যের জিনিসের প্রতি মায়া বা লোভ – কোনটাই নেই।”
প্রিয়তার বলা রুক্ষ কথাগুলোতে একটু থামলো অন্যতমা। নিজের সবচেয়ে প্রিয় পুরুষের সম্বন্ধে এত কঠোর কঠোর বাক্যগুলো বলে ফেললো কোন প্রকার কোনো অনুভূতির বহিপ্রকাশ ছাড়াই, একেবারেই নিলিপ্তভাবে, নিলিপ্ত কণ্ঠে। এটাতে একটু আশ্চর্য হল অন্যতমা। সে যখনই প্রিয়তার অতীত নিয়ে কথা বলে, তখনই খুব নিখুঁতভাবে প্রিয়তার ফেস এক্সপ্রেশন বুঝবার চেষ্টা করে – কণ্ঠের রাগ, অভিমান, ভালোবাসা অথবা ঘৃণার অস্তিত্ব মাপার চেষ্টা করে। কিন্তু তার সেই অদম্য প্রচেষ্টা প্রতিবারই বিফল হয়। তাই অন্যতমার মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়, সেই মরণ প্রেমের অস্তিত্ব প্রিয়তার মাঝে আদৌ আছে কিনা।
কারণ প্রিয়তার একেবারেই স্বাভাবিক জীবনযাপন আর চলাফেরার ধরন দেখে কখনো মনেই হয় না তার জীবনে কোনো হিডেন পেইন আছে। বরং মাঝে মাঝে মনে হয় প্রিয়তা হয়তো সেই ডীপ অবসেশন অনেক আগেই কাটিয়ে ফেলেছে। যেমন এখন – প্রিয়তার চেহারায় এক ছিটেও কোনো অনুভূতি নেই। বা সে যখনই প্রিয়তাকে তার অতীত নিয়ে প্রশ্ন করে, তখনই প্রিয়তা একদমই নির্লিপ্ত কণ্ঠে তার স্বাভাবিক প্রত্যুত্তর করে। কোনো রকম অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখায় না।
সে, সামনে বসা এই মেয়েটার সাথে তার চার বছর আগের বর্ণনার সেই মেয়েটার কোন মিল পায় না। সেই মেয়েটা ছিল কোমল, অবুঝ, ইম্যাচিউর – কিন্তু এই মেয়েটার সবকিছু যেন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি। কারণ এখন মেয়েটার বয়স ২০, হলেও তার কথাবার্তা, চলাফেরা, ভাব, গম্ভীর্য, ম্যাচিউরিটি আর পরিপক্বতায় মেয়েটাকে ৩৫ মনে হয়। তার চোখ-মুখে কোনো হাসি নেই, কোনো দুঃখ নেই, কোনো অনুভূতি নেই – যেন কোনো এক যন্ত্র মানবী।
অন্যতমা চঞ্চলতা ছেড়ে এবার সিরিয়াস কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “তুই যে আসক্তির বর্ণনা দিয়েছিস, সেসব মানুষ তার মরণের শেষ ক্ষণ পর্যন্ত ভুলতে পারবে না। আর তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই চার বছরেই সব ভুলে গেছিস! তুই যে পুরুষের বর্ণনা দিয়েছিস, সেই পুরুষের যত্ন আর ভালবাসা ভুলে যাওয়া কোন নারীর পক্ষে শুধু কঠিনই নয় – অসম্ভব! তাহলে তোকে দেখে কেন মনে হচ্ছে তুই সব ভুলে গেছিস? জীবনে অনেক দূরে এগিয়ে গেছিস। চার বছর দূরে থেকে তুই ১৬ বছরের সব কথা ভুলে গেছিস! সত্যি কি সব ভুলে গেছিস?”
অন্যতমার প্রশ্নে চার পাশে ছড়িয়ে পড়লো নিগূঢ় নৈঃশব্দ্য। প্রিয়তা কিছুক্ষণ থেমে স্বাভাবিক চোখে তাকালো অন্যতমার দিকে। অন্যতমার চোখে অবিশ্বাস। তা দেখে হালকা হেসে চোখ বন্ধ করল প্রিয়তা। প্রতি রাতে সযত্নে অধ্যয়ন করা স্মৃতির খাতার চকচকে পৃষ্ঠায় ভেসে উঠতে লাগলো – একের পর এক আদর মাখানো সেইসব দিন।
প্রিয়তা লম্বা শ্বাস টেনে দৃষ্টি মেলে তাকালো অন্যতমার দিকে। অন্যতমার চোখে হাজারো প্রশ্ন।
প্রিয়তা পুনরায় কণ্ঠ স্বাভাবিক মাত্রায় টেনে বললো, “উনি চেয়েছিলেন আমি যেন উনাকে ভুলে যাই, উনাকে আমার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেই। জীবনে অনেক উন্নতি করি, অনেক দূরে এগিয়ে যাই, সাবলম্বী হই – যাতে আমার নির্ভরশীলতার দায়বদ্ধতা থেকে উনি মুক্তি পান। উনি আমাকে বলেছিলেন, উনি নাকি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন – আমার উপর অতিরিক্ত দয়া দেখিয়ে। তাই মানুষের অনুগ্রহ আর দয়া পাওয়াটা আমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। উনি আমাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, উনি আর আমার ভালো-মন্দের দায়িত্ব নিতে পারবেন না – এগুলোই ছিলো আমাকে বলা উনার শেষ কথা। আর আমি, উনার কথা শুনবো না?”
প্রিয়তা আবার একটু দম নিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করলো, “আর তুই যে সময়টার কথা বললি, ওই সময়টা ছিল আমার জীবনের রঙিন অধ্যায় – সোনালি অতীত, যেখানে আমাকে ভরসা যোগানোর মানুষ ছিল, মাথার উপর বিশাল বটবৃক্ষের মতো ছায়া ছিল, আমার ব্যথায় আমার থেকে ও বেশি ব্যথিত হওয়ার মানুষ ছিল। সেসব দিন কি ভোলা যায়? উনি ছিলেন আমার শিক্ষক, অভিভাবক, পথপ্রদর্শক, আমার আইডল – যার উপর ছিল আমার সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীলতা। আমি কিছুই ভুলিনি অন্যতমা। তবে এটাও ঠিক বলেছিস – আমি আর চার বছর আগে সেই ব্যর্থ জীবনে আটকে নেই। আমি আমার জীবনে অনেকটা এগিয়ে গেছি। আর হয়তো আমার সকল ঝামেলা, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে উনিও উনার জীবনে অনেকটা এগিয়ে গেছেন।
আসল কথা কী বলতো? সময় কারোর জন্যই থেমে থাকে না। মানুষ বদলায়, সময় বদলায়, পরিস্থিতি বদলায়। যারা এক সময় বলেছিল, ‘আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না’ – দেখ গিয়ে আজ তারা দিব্যি বেঁচে আছে। বরং আগের থেকে ও ভালোভাবে বেঁচে আছে।
অর্থাৎ কেউ কারোর জন্য মরে যায় না। হয় ভুলে যায়, নয় একা একা বাঁচতে শিখে যায়। তাই আমি ও খুব ভালোই বেঁচে আছি। অতীত সবার জীবনে থাকে, আমার জীবনেও আছে – তাই বলে সেটা ধরে বসে থাকলে তো আর জীবন চলবে না! তাই আমি ও আমার অতীত – একটা রঙিন কাগজে মুড়িয়ে, মনের এক কোণায় রেখে দিয়েছি।”
অন্যতমা গভীর মনোযোগে প্রিয়তার কথাগুলো শুনলো। পুরোটা সময় সে চেয়েছিল প্রিয়তার নীলাভ চোখের গভীরে যদি কিছু দেখতে পায় – এই আশায়। কিন্তু আফসোস, এবারও সে অসফল হলো। চোখে পানি আসা তো দূরের কথা – চোখের পাতা সামান্য কম্পিত হতে ও দেখলো না। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পুনরায় প্রশ্ন করলো—
“উনি এখন কোথায়? কেমন আছেন? এই চার বছরে কি আর একবারও উনাকে দেখিসনি? উনি কি আর তোর কোনো খোঁজখবর রাখেন না?”
প্রিয়তা আগের মতই নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো, “যে মুক্তির আশায় ছিল, সে মুক্তি পাওয়ার পর কি আর খাঁচায় ফিরতে চায়? জানি না আমি উনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন। দেখি নাই আজ অনেকগুলো বছর। নিশ্চয়ই ভালোই আছেন। এত দিনে নিশ্চয়ই বাচ্চাকাচ্চার বাবা হয়ে গেছেন। উনি সুখী মানুষ, অন্যতমা – তাই বেশি দেখতে যাই না। পাছে যদি নজর লেগে যায়! বলা তো যায় না। আমি বড় লোভী প্রকৃতির মানুষ, চার বছর আগেও লোভ সামলাতে পারিনি – তাই এখনো নিজের উপর তেমন একটা বিশ্বাস নেই,” বলেই তাড়াহুড়ো করে চোখ নামিয়ে নিলো প্রিয়তা।
অন্যতমা এই প্রথমবার কিছু একটা দেখলো। তাই আরেকটু বাজিয়ে দেখতে বললো, “উনি তোকে অনেক ভালোবাসতেন, অনেক আদর করতেন, তাই না প্রিয়তা? কেমন ছিলো ওনার সেই গাঢ় বাদামি চোখের ভাষা, ওনার কথা, ওনার উপস্থিতি? কেমন ছিলেন উনি – এত মায়া, এত ভালোবাসা… , কী করে ভুললি তুই?আমি হলে তো মরে যেতাম।”
অন্যতমার কথায় যেন একটু অমনোযোগী হয়ে পড়লো প্রিয়তা। তার সুন্দর চেহারায় দেখা গেলো এক ঝলক অস্থিরতা। সে চোখ বন্ধ করে কিছু অনুভব করলো। নিঃশ্বাস আটকে বললো—
“তার ঠোঁট শীতল, কিন্তু নিঃশ্বাস ছিল গরম
তার কণ্ঠ পাহাড়ি ঝর্ণা, কিন্তু স্পর্শ ছিল নরম।”
প্রিয়তার চেহারায় কিঞ্চিৎমাত্র অনুভূতির ঝলক দেখতে পেলো অন্যতমা। তার দুই লাইনের এই হেঁয়ালি পূর্ণ বাক্যই যেন সেই পুরুষের বর্ণনা নিখুঁতভাবে দিয়ে দিলো।
অন্যতমা আরো কিছু বলতে নিলে বসা থেকে চট করে উঠে পড়লো প্রিয়তা।
অন্যতমা অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছিস?”
প্রিয়তা সোজা কণ্ঠে বললো, “বাড়ি।”
প্রিয়তার কথায় এবার লাফিয়ে উঠে পড়লো অন্যতমা। আর্তনাদ করে বললো, “এই না! বাকিটা বলে যা! না হলে আমি এখানেই পেট ফেটে মরে যাবো! আমি সব জানতে চাই!”
অন্যতমার চোখে কাকুতি। প্রিয়তা অন্যতমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। নমনীয় কণ্ঠে বললো, “আজ তো অনেক শুনেছিস। বাকিটা না হয় অন্য কোনোদিন বলবো। আজ আসি,” বলে মৃদু হেসে চলে গেলো প্রিয়তা।
সে চলে গেল, কিন্তু অন্যতমাকে যেন এক অথৈ সাগরে ফেলে গেল। অন্যতমার পুরো ঘটনাটা জানার জন্য পেট গুড় গুড় করতে লাগলো – তার জাস্ট একটাই প্রশ্ন:
কি হয়েছিল লাস্ট ২৮ দিনে, যা মেয়েটার কোমল সত্যাকে একেবারে শেষ করে দিল?
আর সেই পুরুষ, এত মায়া দেখিয়ে একটুও ভালোবাসেনি?
এটাই মানতেই কষ্ট হচ্ছে অন্যতমার – তবু আর কী করার!
বাকিটা শুনার জন্য থাকতে হবে – ধৈর্য ধরে বসতেই হবে।
Recharge Intelligence Lab of Canada — Underground Briefing Room
নিচু ভূগর্ভস্থ ঘরে হোলোগ্রাফিক স্ক্রিনের একটি সিসিটিভি ফুটেজের মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়ছে নিস্তব্ধ অন্ধকারে—
ঠান্ডা, কৃত্রিম এক জ্যোতির আবরণে মোড়া কক্ষটি।
ম্যাট ব্ল্যাক স্যুট পরা তিনজন বিজ্ঞানী গোল টেবিল ঘিরে বসে আছেন।
চোখেমুখে স্থিরতা, ঠান্ডা যুক্তিবাদ, আর নির্মম পেশাদারিত্ব।
ডক্টর ক্যাসলার ঠোঁটে অল্প বাঁকা হাসি নিয়ে ট্যাবলেটে একটা ছবি সোয়াইপ করে সকলের সামনে ধরলেন।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললেন—
“She’s exactly what we need — female, young, twenty years old, highly intelligent. Top 1% of her class in Business Administration at the University of Toronto. Look at this.”
(“এই মেয়েটা একদমই আমাদের মনের মত, ঠিক যেমনটা আমরা খুঁজছিলাম। হাইলি ইন্টেলিজেন্ট, বয়স পারফেক্ট। ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো-তে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের থার্ড ইয়ার ক্লাসে শীর্ষ ১ শতাংশের একজন। এটা দেখো।”)
তার কণ্ঠে কোনও উচ্ছ্বাস নেই—শুধু শীতল, লক্ষ্যভেদী নির্মমতা।
ট্যাবলেটের স্ক্রিনে ছবিটা আরও একটু জুম করে দেখালেন তিনি—
স্ক্রিনে একটা কোমল হাসি-মাখা মুখের প্রতিচ্ছবি, তার চোখ দুটোতে ভরে আছে অপরিসীম মায়া।
কিন্তু ডক্টর ক্যাসলার-এর চোখে সে কেবল একটা নিখুঁত ‘বডি’ আর ‘ডাটা’।
ডক্টর মালিক ভুরু কুঁচকে, ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন—
“She’s not Canadian, is am I right?”
(সে কানাডিয়ান নয়, তাইতো?)
ডক্টর ক্যাসলার একটু হেলে বসে, আত্মবিশ্বাসী শিকারির ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন—
“No. Bangladeshi. Third-year international student. Lives with a paternal aunt, but no legal guardian on file.”
(“না, বাংলাদেশি। তৃতীয় বর্ষের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট। এক রিলেটিভের বাসায় থাকে, কিন্তু কোনো আইনি অভিভাবক রেকর্ডে নেই। পারফেক্ট।”)
ডক্টর আভা নীরবে পুরো ফাইলটা স্ক্যান করে নিলেন। ঠোঁটে নির্মম হাসি, কণ্ঠে হুঁশিয়ারি—
“So technically, no direct federal protection. No parent, no spouse, no dependent status.”
(“মানে, টেকনিক্যালি ওর কোনো ফেডারেল সুরক্ষা নেই। না বাবা-মা, না স্বামী, না নির্ভরশীল কেউ।”)
ডক্টর ক্যাসলারের চোখে ঝলকে উঠল ঠান্ডা এক বিজয়ী হাসি—
“Which means no paperwork. No one to sign anything. No one to file a report.”
(“মানে, কাগজপত্রের ঝামেলা নেই। সই করার কেউ নেই। রিপোর্ট করার কেউ নেই।”)
ডক্টর মালিক একটু ঝুঁকে ছবিটার দিকে তাকালেন—
“And genetically?”
(আর জেনেটিক্যালি?)
ডক্টর আভার চোখে ঝলক, ঠোঁটে বিষাক্ত প্রশংসা—
“IQ above 140. Emotionally self-contained. Genetically clean. Stable. She’s… ideal.”
(“আইকিউ ১৪০-এর ওপরে। এক্সট্রিমলি ইন্ট্রোভার্ট। জেনেটিকালি ক্লিন, স্থিতিশীল। নিখুঁত।”)
ডক্টর ক্যাসলার উঠে দাঁড়ালেন। চোখে দৃঢ়তা, ঠোঁটে সিদ্ধান্তের স্পষ্ট ছাপ—
“Shadow protocol begins. Visual contact within 48 hours. Extraction in one week.”
(“শ্যাডো প্রোটোকল চালু করো। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভিজ্যুয়াল কনট্যাক্ট। এক সপ্তাহের মধ্যে অপহরণ।”)
ডক্টর মালিক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—
“What if she resists?”
ডক্টর ক্যাসলার সামান্য হেসে উত্তর দিলেন—
“Then she learns what silence feels like.”
(“তাহলে সে বুঝবে—নিঃশব্দতা আসলে কেমন লাগে।”)
ট্যাবলেটের স্ক্রিনটা নিভে গেল।
কিন্তু ছবির মেয়েটার মুখ যেন সেই অন্ধকারেও এক মুহূর্ত বেশিক্ষণ থেকে গেল…
তবে তারা জানতেই পারলো না—
তারা কার কলিজায় হাত দিতে চলেছে।
আজ ২৪ শে মার্চ, শীতের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে।
চেরি ব্লসমের সুবাসে ভরে গেছে চারপাশ।
হালকা গোলাপি পাপড়িতে ঢেকে গেছে ফুটপাত, অলিগলি, ট্রামলাইন।
বসন্তের হাওয়ায় বৃষ্টির মতো চেরি ব্লসমের পাপড়িগুলো ঝরে ঝরে পড়ছে।
কানাডার টরন্ট শহরের অভিজাত রোজডেল এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে এক আধুনিক ডুপ্লেক্স ম্যানশন।
ধূসর, সাদা, আর ম্যাট ব্ল্যাক—
এই তিনটি স্বচ্ছ রঙের সমন্বয়ে গড়া তার বাইরের রঙের কাজ।
দেয়ালে হালকা টেক্সচারড হোয়াইট কংক্রিট ফিনিশ, মাঝেমধ্যে ধূসর স্টোন ক্ল্যাডিং—
যা বাড়ির গাম্ভীর্য ও প্রভাব আরও বাড়িয়ে তোলে।
প্রায় ৭০ শতাংশ গ্লাস ব্যবহৃত এই স্থাপত্যে সৌন্দর্যের পাশাপাশি আছে কার্যকারিতা—
প্রাকৃতিক আলো, মুক্ত হাওয়া, আর উন্মুক্ত জীবনের ছোঁয়া।
ফ্লোর টু সিলিং গ্লাস উইন্ডো, স্লাইডিং দরজা, ব্যাকইয়ার্ডের সংযোগ—
সব মিলিয়ে এক নিঃশব্দ বিলাস।
ছাদের ওপরে স্কাইলাইট—
দিনভর ঘরে ছড়িয়ে পড়ে নরম আলো।
ডাবল হাইটেড এন্ট্রিতে স্বচ্ছ গ্লাস ও ব্ল্যাক মেটাল ফ্রেম।
গেটের পাশে, ইংরেজি হরফে খোদাই—
চৌধুরী ম্যানশন ১৯৯৯
কলিং বেল বাজার শব্দে চৌধুরী ম্যানশনের একমাত্র কেয়ারটেকার মিসেস জেনিফার গিয়ে দরজা খুলে দেন।
দরজার বাইরে প্রিয়তা একরাশ ক্লান্ত আর বিষণ্ন মাখা মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
মিস জেনিফার প্রিয়তাকে দেখে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন।
প্রিয়তা একপ্রকার ছুটে গিয়ে লিভিং রুমের সোফায় নিজের পরিশ্রান্ত শরীরটা ছুড়ে মারলো।
দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে, মাথা নিচু করে বসে রইলো কিছুক্ষণ।
মানসিক শান্তিবিহীন এই যান্ত্রিক জীবনে, দেহ ও মন এর যুদ্ধে সে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
কোথাও তো একটু ঠাঁই দরকার, একটু শীতলতা দরকার।
তার মনও তো চায় কেউ তার মাথায় হাত রেখে বলুক, “চিন্তা নেই, আমি তো আছি।”
তার মনও তো চায় কেউ নিজের প্রশস্ত কাঁধটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলুক, “এটা তোমার জন্য।”
মন তার আজকাল খুব করে একটু কোমলতা খোঁজে, একটু আশ্রয় চায়।
কিন্তু তার দুর্ভাগা কপালে কি আর তাই আছে?
এই পৃথিবীতে তার আপন স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যায় গুনলে কোন অভাব নেই।
তবুও সে একলা, একা, একদম নিঃসঙ্গ।
আর এই যন্ত্রণাটা একমাত্র তারাই বুঝে যাদের সব থাকার পর ও তারা এতিমের মত জীবন যাপন করে।
আর প্রিয়তা ও তাদের মধ্যে একজন।
একসময় তার সবকিছু থাকলেও এখন সে পুরোপুরি নিঃস্ব।
নিজেই নিজের একমাত্র সম্বল।
বাঁচলে তাকে এভাবেই বাঁচতে হবে।
আর কেউ হাত ধরে বলবে না, “আমি আছি, কোন চিন্তা নেই।”
এসব ভাবতেই বুক চিরে চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রিয়তার।
প্রাণটা হাঁসফাঁস করে উঠলো তৃষ্ণায়।
তাই সোজা হয়ে বসে পানি চাইতে নিলেই, তার মুখের সামনে একটা পানিভর্তি কাচের গ্লাস ধরলো কেউ।
প্রিয়তা ও বিনা বাক্যে পানি টুকু ঢক ঢক করে পান করে নিলো।
শীতল পানিটুকু পেটে পড়তেই যেন বিষাদের নোনতা ভাবটা একটু কাটালো।
প্রিয়তা পানির গ্লাসটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে চুপচাপ কেটে পড়তে নিলেই, পেছন থেকে মেহজাবিন চৌধুরী শক্ত কণ্ঠে ডেকে উঠলেন
“দাঁড়াও।”
সাথে সাথেই পা দুটো স্থির হয়ে গেল প্রিয়তা বুঝে গেল এখন কি হবে তাই চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস ফেললো।
মুখে সেই চিরাচরিত গম্ভীরতা টেনে, নিজেকে প্রস্তুত করলো আবারো এক ঝুট কথা-কাটাকাটির জন্য।
মেহজাবিন চৌধুরী ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন প্রিয়তার কাছে।
কণ্ঠে কোনো রাখঢাক না রেখেই বললেন,
“তুমি কী সত্যি আর বাংলাদেশে ফিরতে চাও না?”
প্রিয়তা পুনরায় বড় শ্বাস ফেলে পিছু ঘুরলো।
মেহজাবিন চৌধুরীর চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
“না ফুপ্পি, আমি আর বাংলাদেশে কখনোই ফিরতে চাই না।
ইনফ্যাক্ট, ফিরবো বলে তো আমি ওই দেশটা ছাড়িনি।
তার পরও প্রতিদিন এই একই প্রশ্ন কেন জিজ্ঞেস করো?”—বলে হালকা বিরক্তি প্রকাশ করলো প্রিয়তা।
মেহজাবিন চৌধুরী ও থামলেন না। পাল্টা জবাবে বললেন,
“কিসের এত জেদ তোমার? কার উপর জেদ?
কেন বারবার একই কথা বলছো?
ওই দেশটাই তোমার আসল ঠিকানা, তাহলে ওখানে যাবে না কেন?
ওই দেশে কি তোমার কেউ নেই?
তোমার বাবা, মা, ভাই, বোন নেই?
কেন তুমি সব থাকতে ও বছরের পর বছর বিদেশের মাটি কামড়ে পড়ে আছো?
এমনকি শুধু তাই নয়, তুমি তোমার পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখো না, তাদের সাথে কথা বলো না।
তারা ফোন করলে তুমি নাম্বার ব্লক করে দাও। এমন করো কেনো?
তুমি জানো, তোমার এই আচরণে তোমার বাবা-মার কত কষ্ট হয়?
এখানে আসার আগে কথা ছিল, তুমি দুই বছর পর ফিরে যাবে।
কিন্তু সেই দুই বছর সময় গড়িয়ে আজ চার বছরের উপরে।
কিন্তু তোমাকে যখনই দেশে ফেরার কথা জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি একই কথা বলো, খারাপ ব্যবহার করো।
কেনো? এই দেশে কি আছে তোমার?”
মেহজাবিন চৌধুরীর কথায় বিদ্রুপের হাসি ফুঁটে উঠলো প্রিয়তার ঠোঁটের কোণায়।
সে তাচ্ছিল্যের কণ্ঠে বললো,
“ওদের আমার জন্য কষ্ট হয়? বেস্ট জোকস অফ দ্যা ইয়ার, ফুপ্পি।
আর একটা কথা তোমাকে আর কয় বার বলবো ফুপ্পি?
আর কয়বার বললে তুমি বুঝবে?
আমার এই পৃথিবীতে কেউ নেই, একমাত্র ‘আমি’ আমার আপন।
ওরা আমার রক্তের ঠিকই, কিন্তু নিজের নয়।
জন্ম দিলেই, আর কিছু বছর লালন-পালন করলেই আপন হওয়া যায় না।
ওরাও আমার জন্য তাই।
আর আমি ওই দেশটা ছাড়ার সময়, আমার সকল পিছুটান ওই দেশের মাটিতেই ফেলে এসেছি।
তাই আমার আর কারো কষ্ট হয় না।
আমি জানি, আমি চার বছর ধরে তোমাদের বাড়িতে আছি, অনেক সমস্যা হচ্ছে।
কিন্তু তুমি চিন্তা করোনা ফুপ্পি, খুব তারাতারি আমি একটা পার্ট টাইম জব খুঁজে নেব।
তারপর হোস্টেলে চলে যাব।
আর আমার তো স্কলারশিপ আছেই, তাই কোনো কিছুর জন্য তোমাদের কাছে হাত পাততে হবে না।
তাই নিশ্চিন্ত থাকো।
আর একটা রিকোয়েস্ট, কাল আমার থার্ড ইয়ার অ্যাডমিশন।
তাই প্লিজ, পেইন দিও না।”
প্রিয়তার এমন রুড বিহেভিয়ারে মনে মনে ভীষণ আঘাত পেলেন মেহজাবিন চৌধুরী।
তিনি ভাইজির দিকে তাকিয়ে আহত কণ্ঠে বললেন,
“তুই এভাবে কথা বলছিস আমার সাথে?
এই বিদেশের মাটিতে, আমি ছাড়া আর কে আছে তোর?
তুই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি?
তোকে আমার ভাই, ভাবি আমার ভরসায় এই দেশে পাঠিয়েছেন।
আর তুই—?”
প্রিয়তার ও মনে মনে ভীষণ খারাপ লাগলো,
কিন্তু তারই বা কি করার আছে?
সে প্রতিদিন একই ঘ্যানঘ্যান শুনতে শুনতে, ভীষণ তিক্ত, বিরক্ত।
সবারই তো একটা ধৈর্যের সীমানা আছে।
তাই সে ও আর কথা বাড়ালো না।
চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
মেহজাবিন চৌধুরী অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন ওর যাওয়ার পথে।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“তুই ভুল ভাবছিস।
ওরা কেউ কখনো তোর খারাপ চায়নি।
আর আজ না হোক, কাল তোকে তোর আপনজনদের কাছে ফিরতেই হবে।
ওরাই তোর সবথেকে আপন।
অভিমান করে আর ক’দিন থাকবি?
আমি জানি, তুই কতটা কষ্টে নিজেকে শক্ত আবরণে ঢেকে ফেলেছিস।
কিন্তু এগুলো অহেতুক।
তোকে ওই দেশে ফিরতেই হবে।”
এবার ও রাজি হলো না তো “মম”—মেয়ের কথায় হতাশার শ্বাস ফেললেন মেহজাবিন চৌধুরী।
স্বেতা এবার উনার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“কেন এমন করছে? কিসের এত রাগ ওর নিজের মানুষদের উপর?
এমন তো নয় যে, ওর বাড়ির লোক ওকে এই দেশে আসতে খুব বেশি জোর করেছিল।
তাহলে কিসের রাগ ওর ওই বাড়ির মানুষদের প্রতি?”
মেহজাবিন চৌধুরীর কাছে এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।
মেয়েটা বড় হচ্ছে।
এখনই তো সঠিক সিদ্ধান্তটা নেয়ার সময়।
কিন্তু…
স্বেতা আবার বললো,
“আমি একবার কথা বলে দেখব মম।”
মেহজাবিন চৌধুরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিরাশ কণ্ঠে বললেন,
“দেখ, রাজি করাতে পারিস কিনা।
ও যদি একান্তই ওই দেশে যেতে রাজি না হয়, তাহলে এখানেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে”—বলে চলে গেলেন মেহজাবিন চৌধুরী।
স্বেতা চেয়ে রইলো প্রিয়তার বন্ধ দরজার পানে।
তার আজকাল কেন জানি মনে হয়, হয়তো সে চোখের সামনে যা দেখছে, যা শুনছে, তার সবটা হয়তো সত্যি নয়।
সবার দেখা ও জানার আড়ালে, আরো অনেক কিছু আছে।
খালি মনে হয়, প্রিয়তার জীবনটাও হয়তো ওর মতোই।
নাকি ওর জীবনটাই প্রিয়তার মতো হয়ে গেছে?
স্বেতা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো—
“আসলে মানুষ শুধু বাইরের রুক্ষতাটাই দেখে,
ভেতরের কোমলতাটা আর তাদের চোখে পড়ে না।
মানুষ শুধু পাল্টে যেতেই দেখে, পাল্টে যাওয়ার কারণটা খুঁজে না।”
বাংলাদেশ
শিকদার বাড়ির গার্ডেন এরিয়াতে খেলছে দুটো বাচ্চা।
তাদের চোখ মুখে উপচে পড়া উচ্ছ্বাস ও আনন্দের ফোয়ারা।
তাদের উচ্চ শব্দের হাসিতে হেসে উঠছে চারপাশ।
তাদের দুজনের চারপাশে ছিটানো বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট হাড়ি পাতিল।
বছর তিনের বাচ্চা মেয়েটা তার সামনে বছর তিনের বাচ্চা ছেলেটাকে আধো আধো অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো—
“এই যে চুনচেন, আপনি বচেপলুন, আমি আপনাকে কাবার দিচ্ছি।”
ছেলেটা বেশ আগ্রহ নিয়ে বসে, একই ভাবে বললো—
“আচকে কি লান্না কলেচো? লচগোল্লা?”
মেয়েটা একটা শিমুল পাতা, গুলাপ ফুলের কুঁচি বারতে বারতে বললো—
“আপনি আমাকে লচোগুল্লা বলছেন কেনু? পলি বলুন”—বলে পাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“এই নিন কান।”
হয় হায়!
চলবনাচ, এখানে চংচার পাতা হয়ে গেচে!
কারো একত্র কণ্ঠে ছেলে মেয়ে দুটো পেছন ফিরে তাকালো।
তাদের থেকে কিছুটা দূরে অরণ্য আর তন্ময় চোখ গুলগুল করে, মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“মামু আর চাচ্চু!”—দেখে অভিরাজ ও অবনীতা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।
রান্নাবাড়া ছেড়ে ছুটে গেল তাদের কাছে।
অবনী তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে কিউট মুখ করে বললো—
“মামু, কোলে নাও।”
তন্ময় ও একমাত্র ভাগনির গাল টেনে কোলে নিলো।
অবনীর রক্ত লাল গালে কষে একটা চুমু খেয়ে বললো—
“আমাকে সাথে না নিয়েই রেঁধে বেড়ে খেয়ে ফেলছো মামু?”
অবনী নিজের ছোট ছোট হাতে তন্ময়ের গাল ধরে বললো—
“চলি মামু, এল পল তেকে উনার চাতে তুমাকে ও লাখবো।”
সাথেসাথেই অরণ্যের কোলে থাকা অভিরাজ ঝড়ের গতিতে বিরোধিতা জানিয়ে বলল—
“না না, ছোট চাচ্চুকে লাখবো না।
চুধু তুই আল, আমি কেলবো”—অরণ্য ভাতিজা কে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতর দিকে যেতে যেতে বললো,
“ওরে বেটা! এ দেখি বাপের ও এক কাটি উপরে।
তুই তোর আব্বেত্তা চাচাদের টপকে, নিজের বাপের মতো মিরজাফরি করার ধান্দায় আছিস, তাই তো?”
অরণ্যের কথায় ঘুর সম্মতি জানিয়ে তন্ময় বললো—
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৫
“এসব চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো বাবু।
অটি হচ্ছে না!”
শিকদার বাড়ির যা যেমন ছিল, এখনও তা তেমনই আছে।
কিছুর পরিবর্তন হয়নি, শুধু দুজন নতুন সদস্য যুক্ত হয়েছে।